আজ ২৯ অক্টোবর কবি মলয় রায়চৌধুর’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
শুদ্ধ চেতনার রহস্য
ঠিক আছে, লাফাও
অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম কাচের জানালা খুলে কুড়ি তলা থেকে
বাতাসে ঝাঁপাও তুমি টাঙাইল আঁচল উড়িয়ে
শূন্যে ভাসবে কালো ঢাল এলোকেশ
দু পায়ে আচেনা নাচে পৃথিবীর রঙিন মাটিতে
নেমে এসো তুমি
তখন খামচে দেখো হাওয়ার শরীর কীরকম
খেলবে তোমাকে নিয়ে ওলোট-পালোট
আমার পায়ের কাছে পড়ে তুমি ছত্রখান হও
খণ্ড-বিখণ্ড হাড় থ্যাঁতা মাংস নাড়িভুঁড়ি সব একাকার
ঠোঁট যোনি উরু নাভি পাছা স্তন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে
সৌন্দর্য বিমূর্ত ক্বাথে মাছির খোরাক হবে তুমি
সব জড়ো করে তবু তুমি নও
তুমি সে-সময়ে রৌদ্রে ভাসমান
বুঝেছিলে মিথ্যে এই প্ররম্ভিক অধঃপতন ।
২১ আষাঢ় ১৩৯২
শিল্পোন্নয়ন
এ কী তুমি এইখানে পাগলাগারদে
পায়েতে শেকলবাঁধা নেয়ারের খাটে
উদোম উলঙ্গ শুয়ে আছো চুলে জট
নোংরা নক বেড়ে গেছে দুচোখে ঢুলুনি
সারাঘর বমি মুত পায়খানা ভরা
ভাতমাখা এনামেল থালা এককোণে
শরীর ধোওনি জলে নেমে কতদিন
চেনাই যায় না এককালে পাঁচতারা
হোটেলে নেচেছ নাভি নিতম্ব কাঁপিয়ে
আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচব সকলে তুর্কি গাঁজা-ভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নামে যাক ।
২১ শ্রাবণ ১৩৯২
বিজ্ঞানসন্মত কীর্তি
ফ্যান টাঙাবার ওই খালি হুক থেকে
কন্ঠে নাইলন দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ো
কপাট ভেজিয়ে দরোজার চুপিসাড়ে
উঁচুতানে রেডিও চালিয়ে তাড়াতাড়ি
শাড়ি শায়া জামে খুলে টুলের ওপরে
দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস-রশি পরে নিও
সারারাত অন্ধকারে একা ঝুলে থেকো
চোখ ঠিকরিয়ে জিভ বাইরে বেরোনো
দুপাশে বেহঁশ দুই হাত আর স্তন
জমাট ষোড়শি শূন্য পায়ের তলায়
পৃথিবীর ধরাছোঁয়া ছাড়িয়ে যেখানে
বহু পুরুষের ঠোঁটে আদর খেয়েছ
সে-শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ
দোলো লাশ নামাবার জন্য আছি আমি ।
১৯ শ্রাবণ ১৩৯২
সুফিয়ানা
এ কেমন ক্রিমতোলা বাংলায় কথা কোস তুই
যে ভেলকিবাজ রোদের ভয়ে ঝরে পড়া শিউলিফুলগুলো
পাখিদের রোমান্টিক গানকে নার্ভাস করে তোলে
যেন হাঁ-মুখে নার্সের থার্মোমিটার
দোলের দিন ডেকে-ডেকে হাঁপানি ধরে গেল কোকিলটার
আসলে তোর কেন মতামতহীন হবার আধিকার নেই
একটা হ্যাঁ-এর সঙ্গে একটা না মিশিয়ে তখনই জানা যায়
যখন প্রেমের ক্লাইম্যাক্সে মাটির সঙ্গে আমি যোগাযোগ হারাই
শাঁতার কাটবার মতন তোর গভীর টলটলে সংলাপে
যে-দিন জিরে-জিরে করে কুচোনো বিদ্যুতের সবুজ জোনাকি
ঘোড়াহিন রেসের মাঠে তোকে ঘিরে বেশরম হ্রেষা হয়ে উড়বে
ইরানি হরফে তোকে প্রেমপত্র লিখে রাখবে বটগাছের শেকড় ।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০১
দালাল
এ কী কুলনারী তুমি জাহাজঘাটায় দেহ বেচতে এসেছো
লুঙি-পরা পানখোর দালাল রাখোনি
সাদাপোষাকের কবি শরীর ঝাঁঝরা করে দেবে
শাঁখা-নোয়া খুলে তারা দুহাত হিঁচড়ে টেনে তুলবে লরিতে
লকাপে ল্যাংটো মাঝরাত…..সে-সময়ে গেয়ো তুমি রবীন্দ্রসংগীত
ছিহ কুলখুকি তুমি সবায়ের আদর কুড়োও
যারতার সাথে গিয়ে যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ো
চারিদিকে কটাচোখ ধ্রুপদী জোচ্চোর সব নজর রাখছে মনে রেখো
আমি তো স্ট্রেচারবাহী কিছুই করতে পারব না
হয়তো টিফিনবাক্সে এনে দেব রুটি আর আলুজিরে ভাজা
গান শোনাবার মাঝে ঝুঁকে-ঝুঁকে পয়সা কুড়োবো
ভোর হলে গঙ্গার পাড়ে তুমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বমি কোরো
হাসপাতালেতে পাবে বেডপ্যান গ্লুকোজ বোতলে জল
তালচিটে বিছানায় পাশে শোয়া ঘুমন্ত কুকুর ।
১৭ অঘ্রাণ ১৩৯২
বজ্রমূর্খের তর্ক
আজকে শুক্কুরবার । মইনে পেয়েচি । বোধায় শরতকালের পুন্নিমে ।
পাতলা মেঘের মধ্যে জোসনা খেলচে । মাঝরাত । রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
সামান্য টেনিচি তাড়ি । গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ ।
কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাত নেড়ি-কুকুরের দল
ঘেউ ঘেউ করে ওঠে । তাড়া করে । বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি ।
বুঝতে পারিনি আগে । রাজপথে এসে হুঁশ হয় ।
মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে । কী করে ফিরব বাড়ি ?
কেধ তো বিশ্বাস করবে না । ভাববে খেলেচে রেস,
গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে ।
বন্ধুবান্ধব কেউ নেই । রেসও খেলি না কতকাল ।
অন্য স্ত্রীলোকের খোলা-বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
ভুলে গেচি । জানি না বিশ্বাস করে না কেউ কেন ।
আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করিচি বুঝি ।
যা কইনি, সেকথা বলিচি । তাহলে এ পুন্নিমের মানে ?
কেন এই মাইনে পাওয়া? কেন গান ? কেন তাড়ি ?
আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে । নির্ঘাত কুকুরগুলো
গন্ধ শঁকে টের পাবে । ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে ।
যা হবার হয়ে যাক । আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার ।
২৭ আষাঢ় ১৩৯২
প্রিয়তমার নিলাম
বিশল্যকরণী বলে কিছু নই শেষ ওব্দি লক্ষ্মণের লাশ
রাবণের মর্গে পড়ে ভেটকে উঠেছিল
ভিড়ের দড়ির টানে
খর্ব অপুষ্ট জরাক্লিষ্ট মুখে কাঠের জগড়োনাথো ফিরেছে স্বস্হানে
ওরকম মুখ বুজে থাকব বলে আসিনি এখানে আমি
গন্ধমাদন কাউকে ল্যাজ তুলে আনতে হবে না
কেননা ভূমিষ্ঠ হয়েই মাটি কামড়ে ধরেছি কষদাঁতে
শীতকালে কেন ফিকে ন্যাপথালিনের গন্ধ মানুষীর নিশ্চুপ স্তনে
যে-মুখে রেখেছি হুল লেহনে বোটকা স্মৃতি বৃক্কে নেমে যাবে
ফেরারির অগ্নিচোখ অর্জন করেছি শ্রমে
বল্লম ধরার আগে আঙুলের খাঁজ হেজেছিল
বাতাসে বাবরি উড়বে চ্যাঁচাব দুখাঁধ তুলে
বুকের ওপরে দুই হাতা ঘুষি আছড়ে বলব বারবার
অগ্নি সংযোগ করো শান্তিভঙ্গ হোক ছারখার করো
ক্রন্দনরত কারা গুঁড়ি মেরে এলোচুলে ঘোর অন্ধকারে
শানাচ্ছে কুখরির ডগা উল্কাপাথরে ঘষে একটানা সুরে
টিকটিকিদের ল্যাজ আছড়াবার ক্ষীণ শব্দ
ঝড়ের ধুলোয় নাকে জ্বালা ধরে
মুখেতে রুমাল বেঁধে নিঃশব্দে ঘোড়া থেকে নামি
যে-রকম কথাছিল আবার এসেছি আমি নিলামের দাক দিতে
এইবার সবচে বেশি দাম ধরে দেব
মাত্র দু-পাঁচশো নয় কিংবা মাসখানেকের জন্যে ঘানির মজুরি
তুমি ধ্বংসধ্বনি খুকি
ভবিষ্যৎ থকথকে হারামরক্তে ডুবে আছে ।
১১ বৈশাখ ১৩৯২