আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
আজ ২২ জুলাই ২০২১। গতকাল একটি বিদঘুটে ধরনের কুরবানী ঈদের অভিজ্ঞতায় মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। ভোরে বের হবার তাড়া তাই মন থেকে আসছিল না। রাত বারটায় রান্না শেষ হওয়া মাংস প্রাতরাশ সেরে বাচ্চাদের তাগাদা দিলাম, চল বেরিয়ে পড়ি কোনো একদিকে। বাচ্চাদের সাড়া এবং আমার ইশারা রুমিকেও বেরিয়ে পড়ায় আগ্রহী করলো। সকাল আটটার দিকে গাড়ি ছাড়তে পারলাম। প্রথমে গেলাম চট্টেশ্বরী রোডে বেভারলী হিলসে কাছে, তারপর ও আর নিজাম রোড, এবং সবার শেষে বায়েজীদ বোস্তামী রোডে। তিন জায়গায় রুমির রন্ধন কর্মের নমুনা বিলিবন্টন করে এগিয়ে গেলাম অক্সিজেন মোড়ের দিকে। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ধরে অনন্যা আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত। তারপর ব্রিটিশদের তৈরি বিখ্যাত লক্করঝক্কর কালুরঘাট ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবার সময় বর্ষণে যৌবনবতী হয়ে ওঠা জল কলকল কর্ণফুলীর সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে বোয়ালখালীতে অবতীর্ণ হলে রুমি নদীর ধার দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় যেতে চাইল। আমি বললাম, এটা তো কাছেই, অন্য কোনদিন ভোরবেলা যাব। ভোরে অনেক বেশি ভাল লাগবে নদীর পাড়ের বাতাস। অতএব এগিয়ে গেলাম বোয়ালখালীর ছায়াঘন পথে। এদিকে অরণির মোশন সিকনেস প্রবল হয়ে দেখা দিলে রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে তার উদরমুক্তির ব্যবস্থা করা গেল। গোমদণ্ডীর ভেতর দিয়ে যাবার সময় এমন কিছু এলাকা অতিক্রম করলাম, মনে হলো যেন সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে। বৃক্ষরা এমন ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর আকাশটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে।
যেতে যেতে একসময় মনে পড়লো এদিকেই কোথাও মেধস মুনির আশ্রম রয়েছে। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম, আমাদের যাত্রাপথ থেকে কিছুদূর গিয়ে বামে ঢুকে অনেকদূর যেতে হবে। আঁকা বাঁকা পথ। চিকন বদর শাহ রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। দুই পাশে সবুজ বৃক্ষের সারি এবং একটু পর পর ছোট ছোট খৈয়া আর পুকুর। কোন কোন পুকুর পুরোটাই কচুরিপানায় ভরা, কোনটির ওপর এক ধরনের গাঢ় সবুজ গুঁড়ির পাতলা আস্তরণ। চট্টগ্রামে এগুলোর নাম খুইদ্যা পানা অর্থাৎ খুদে পানা (phytoplankton)। একটু পর পর বাঁক নিতে হয়। অনেক খানাখন্দ ডিঙোতে হচ্ছে। একটি জায়গায় একটি মিনিট্রাক রাস্তার ধারে এমনভাবে রেখে ড্রাইভার নিখোঁজ, টানা ৫ মিনিট হর্ন বাজিয়েও তার কর্ণ কূহরে সাড়া জাগাতে পারিনি। বেবিট্যাক্সিগুলো অবলীলায় পাশ দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার অপর পাড়ে এমন একটি গর্ত যে আমার চতুর্চক্রযান একবার খাদে পড়লে এ গাড্ডা থেকে উদ্ধারের কেউ এখানে নেই। অগত্যা বিসমিল্লাহ বলে সাইড মিরর বন্ধ করে হেঁইও করে দিলাম টান। ফেরার সময় কি হবে জানি না, তবে এ যাত্রা এগিয়ে যেতে আর বাধা রইল না। রাস্তার মারপ্যাঁচে অরণির খালি পেটে খিদে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। দুপুর বারটা অতিক্রান্ত। অদিতারও ক্লান্তি বোধ হচ্ছে। রুমি বিভ্রান্তিতে ভুগছে আর কতদূর এগুতে হবে। নাকি ফিরে যাব! আমি এতদূর এগিয়ে এসে পিছিয়ে যাবার পাত্র নই। আমি প্রকৃতির অদ্ভুত আলোছায়ার খেলায় এমন মুগ্ধ তাকিয়ে এগিয়ে চলেছি যে একসময় যাত্রাসঙ্গীদের সকল অনুযোগ স্তিমিত হয়ে গেল। এক সময় বদর শাহ রোড়ের পরে আরো সরু রাস্তায় গাড়ি ঢুকে পড়লো। চারপাশে ছোট ছোট কুঁড়েঘর এবং উঠান বারিছায় ভরা সবুজের সমারোহ, কোথাও পুকুর পাড়ে বিস্তীর্ণ কচুবনও দৃশ্যমান। কিন্তু রাস্তার অবস্থা ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। একটা বাঁক পেরোতে দেখি রাস্তাটা এমনভাবে ভেঙেছে যে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যথেষ্ট অনিরাপদ। রুমি ফিরে যাবার ঈঙ্গিত করলো। কিন্তু ফেরার পথও বন্ধ। অনেক লম্বা আঁকাবাঁকা পথ ব্যাক গিয়ারে চালাতে হবে। অতএব মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেলাম এই ভাঙা পথেই। নিরাপদেই ভাঙ্গাটা পেরিয়ে বেশ অনেকদূর নির্বিঘ্নে চললো। তারপর দেখি একটি সিমেন্ট জমানো তোরণে লেখা আছে ‘মেধস আশ্রম’। আমি সেই তোরণ দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, ভেতরে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা। তার উত্তরে জানা গেল একেবারে আশ্রমের মূল ফটক পর্যন্ত যাওয়া যাবে। অতএব ডেল কার্নেগিকে স্মরণ করলাম——দুশ্চিন্তাহীন মানব জীবন। আমার গাড়িতে গতি বাড়ালাম। কিন্তু তোরণ দিয়ে গাড়িটা ভেতরে ঢুকতেই চারপাশের বুনো প্রকৃতি দেখে আপনাআপনিই গতি কমে গেল। থেমে থেমে চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাই। এখন ছলিন বিছানো পথ, কিছুটা পাহাড়ী এলাকা, টিলার মতো। নানারকম ফলের বৃক্ষ ও আগাছায় পুরো পরিবেশে একটা বুনো ভাব। আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগেও এখানে গহীন অরণ্য ছিল। শেয়াল-হরিণের দেখাও মিলতো। মাথার ওপরে ঠাঠা রোদ্দুরে গাঢ় নীল আকাশের গায়ে শুভ্র সাদা মেঘের ঐন্দ্রজালিক ভেলার দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
একটু পরে দেখি রাস্তা ভাঙা। ভাঙা রাস্তার ওপর মোটা ইস্পাতের পাত বিছিয়ে রাখা হয়েছে, তবে নড়বড়ে। একটা বেবিট্যাক্সি অবলীলায় পার হয়ে গেল। আমি একবার গাড়িটা একপাশে রেখে হাঁটা শুরু করার পরিকল্পনা করলাম। দুটো মাইক্রোবাস যাত্রীদের এখানেই নামিয়ে দিয়েছে। তারপর ভাবলাম, একটু চেষ্টা করেই দেখা যাক। ঢংঢং ঝনঝন করতে করতে নির্বিঘ্নেই পার হয়ে গেলাম স্টিলের পুলসেরাত। তারপর উঁচুনীচু পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে একটি শানবাঁধানো পুকুর ঘাট পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই দৃশ্যমান হলো মন্দিরের মূল ফটক। কিন্তু সামনে যে পাকা চত্বরটা গাড়ির জন্যে নির্ধারিত তা বেবিট্যাক্সিতে গিজগিজ করছে, ফিরে আসা ক্লান্ত ভক্ত পূজারীদের নিয়ে যাবার জন্যে। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরতে গেলে পাহাড়ী পথের পাশে একটা ঘাসে ছাওয়া জায়গা মিললো। সামান্য ক’জন পূজারী তখন ফটক দিয়ে প্রবেশের প্রতীক্ষায়। তবে, তাঁরা ব্যস্ত কিছু নিয়ম পালনে। আমরা যেহেতু দর্শনার্থী, আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখি ধাপে ধাপে পাকা সিঁড়ি এগিয়ে চলেছে অনেক উঁচু পাহাড়ের দিকে। তবে আমার টিমের ভূটানে টাইগার টেম্পলে হেঁটে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে। পাহাড় পর্বত তো প্রায়শই বেয়ে থাকে। অতএব নিশ্চিন্তে এগিয়ে গেলাম সামনে। হাল্কা পাতলা জনমানুষের যাতায়াত চলছে। অনেকেই কিছু পথ এগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কোথাও মোমবাতি বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ সংগ্রহ করে নিচ্ছে মোমবাতি মন্দিরে দীপ জ্বালাবে বলে। আমরা চারপাশের পাহাড় ও প্রকৃতিতে বুঁদ হয়ে হেলে দুলে উঠে চলেছি। পাহাড়টি উঁচু বটে তবে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সমান হবে না নিশ্চয়। তবে দুপুরের কড়া রোদ্দুরে আমারদের কপাল ও কপোল উভয়ই চকচক করতে শুরু করেছে মুক্তার মতো স্বেদবিন্দুর উচ্ছ্বাসে। একসময় পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে গেলে প্রথমেই দেখা মিললো মেধস মুনির মূর্তির সাথে। তাঁর দুইপাশে প্রথম দুই শিষ্য রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধির মূর্তি করজোরে দণ্ডায়মান।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, “মার্কন্ডেয় পুরান, শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্ বা দেবীভাগবত পূরানে উল্লেখ রয়েছে ঋষি মেধসের এই আশ্রমের। মার্কন্ডেয় পুরান অনুযায়ী দেবী দুর্গা মর্তলোকে সর্ব প্রথম এই ঋষি মেধসের আশ্রমে অবতীর্ণ হন। ঋষি মেধসের এই আশ্রম প্রাচীন বঙ্গের চট্টগ্রামে অবস্থিত। শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে কথিত রয়েছে, রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি, মেধস মুনির কাছেই প্রথম দেবীমাহাত্ম্যম্ এর পাঠ নেন এবং এই স্থানে প্রথম দুর্গাপুজো করেন।” হাজার বছরেরও প্রাচীন পীঠস্থান হলেও এক সময় এই স্থান বিস্মৃত হয়ে যায়। ইতিহাস মতে, বিগত শতকের কোন একসময় চন্দ্রশেখর নামের কোন এক বেদান্ত বিশেষজ্ঞ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সাধনার সময় তার এক গুরু কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে এই ভূমির অন্বেষণে বের হন এবং একসময় বোয়ালখালীর করলডাঙ্গায় এই পাহাড়ের মধ্যে মেধসের আশ্রম আবিষ্কার করেন এবং পুনরায় দেবী দুর্গার পূজা চালু করেন।
আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলে দেবী দূর্গার মূল মন্দিরের সামনে প্রশস্ত চত্বরে ভক্তকুলকে কীর্তনে মগ্ন দেখতে পাই। আমরা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ না করে বরং চারপাশ দেখতে থাকি। দীপ জ্বালাতে ব্যস্ত তরুণদের দেখলাম। আবার বয়স্ক মহিলাদের দেখলাম বিভিন্ন ছোট ছোট মন্দিরে তাদের অর্ঘ্য নিবেদন করছেন নিবিষ্ট মনে। একপাশে নেমে গিয়েছে চিকন সিঁড়ির পাহাড়ি পথ। ওদিকে একটা নয়নাভিরাম পুকুর রয়েছে, যেখানে সীতার পায়ের ছাপ আছে বলে জনশ্রুতি বিদ্যমান। মূল মন্দির থেকে আমরা একপাশে সরে গিয়ে দূরে দিগন্তের তাকিয়ে হতবাক হয়ে যাই। সমস্ত চট্টগ্রাম যেন এক লহমায় চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমার চট্টগ্রাম——নদীমেখলা, সমূদ্রবেষ্টিত, পাহাড়সমৃদ্ধ, সবুজে আকীর্ণ। এই চট্টগ্রাম প্রকৃতির এক অপার রহস্য যেন। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে রই যতদূর দৃষ্টি গিয়েছে। একসময় ঘোরমুক্ত হয়ে নেমে আসি একই বিহ্বলতায়।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)