মেঘে ঢাকা তারা: দেশভাগ ও মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের গল্প
‘মেঘে ঢাকা তারা’ কে বলা হয় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম এক কাল্ট ক্লাসিক এবং ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে এক অসাধারণ অর্জন।
“আগেকার দিনে লোকে মাইয়ারে গঙ্গাযাত্রীর গলায় ঝুলায়া দিত, তখন তারা ছিল বর্বর। আর এখন আমরা সিভিলাইজড হইছি, তাই মাইয়ারে লেখাপড়া শিখাইয়া তারপর তারে নিংড়াইয়া, দইলা-পিইষা তার ভবিষ্যৎ নষ্ট কইরা দেই”– বিজন মাস্টারের এই এক উক্তিতেই যেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং একই সাথে বাঙালি সমাজের অনেকখানি অংশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নারী যেন সর্বদাই নিষ্পেষিত এক শ্রেণী, সবাই তার কাছ থেকে সুবিধে নিতে চায় কিন্তু সেই নারীরও যে সাধ-আহ্লাদ থাকতে পারে, সেও যে বাঁচতে চায় তা খুব কম মানুষই বোঝে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এমনই এক মধ্যবিত্ত নারীর সংগ্রাম ও নির্বাসনের গল্প যার পরিণতি আপনাকে এই সমাজ সম্পর্কে, সমাজের সুবিধাবাদী মানুষদের সম্পর্কে দু’বার ভাবতে শেখাবে, চিন্তার জগতে ধাক্কা দেবে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ কে বলা হয় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম এক কাল্ট ক্লাসিক এবং ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে এক অসাধারণ অর্জন।
এ সিনেমাটি ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগ নিয়ে বানানো ট্রিলজির প্রথম সিনেমা। এই ট্রিলজিতে আছে মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬৫)। ঋত্বিক ঘটক সবসময়ই নিজের সিনেমা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করতেন। ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি সাম্প্রদায়িক এবং একই সাথে আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যে সমস্যা তৈরি হয় এবং বিশাল একটি ডায়াস্পোরা তৈরি হয় তা লাখ লাখ মানুষের জীবনে প্রচন্ড বাজেভাবে প্রভাব ফেলেছিল। ঋত্বিক এই দেশভাগের সমস্যাগুলো তার সিনেমায় তুলে আনার বিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং সিনেমাটি তার এই প্রচেষ্টারই ফল।
মেঘে ঢাকা তারা (ইংরেজিতে The Cloud-Capped Star) প্রথম মুক্তি পায় ভারতে ১৯৬০ সালের ১৪ এপ্রিল। মূল কাহিনী শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা একই টাইটেলের উপন্যাস ‘মেঘে ঢাকা তারা’ থেকে নেয়া। পরিচালনা ছাড়াও ছবিটির স্ক্রিনপ্লে এবং চিত্রনাট্যও তার লেখা। এ প্রসঙ্গে ঋত্বিক বলেন যে তিনি মূল স্টোরিটি কলকাতার ‘চেনামুখ’ পত্রিকায় পড়েন এবং এটি তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। তখন থেকেই তিনি এটি নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর প্রয়োজন বোধ করেন। ছবিতে অভিনয়ে আছেন সুপ্রিয়া চৌধুরী (মূল প্রোটাগনিস্ট ‘নীতা’ হিসেবে), অনিল চ্যাটার্জি (বড় ভাই ‘শঙ্কর’), বিজন ভট্টাচার্য (বাবা), গীতা ঘটক(ছোট বোন ‘গীতা’), নিরঞ্জন রায় (সনৎ), গীতা দে (মা) প্রমুখ। সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন দীনেন গুপ্ত এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ৫ মৈত্র।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র নীতা। তার পরিবার মূলত ১৯৪৭ এর দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসা রিফিউজি। নীতার বাবা মাস্টারসাহেব সামান্য একজন স্কুলশিক্ষক, সেই সঙ্গে রয়েছে তাদের বড় পরিবার ও পরিবারের সদস্যরা। বড় ভাই শঙ্কর একদিন বড় গায়ক হবার স্বপ্ন দেখে, তাই সে গানবাজনা ছাড়া কিছুই করেনা, ছোট বোন গীতা বেশ আয়েশি স্বভাবের মেয়ে এবং আরেক ছোটভাইও পড়ালেখায় কোনোরকমে ঝুলে আছে। কলকাতায় রিফিউজি পরিবার হিসেবে থাকতে এই বড় পরিবারটির যে সংগ্রাম, তার মূল কর্ণধারই হলো নীতা। নিজে টিউশনি করে, ছেঁড়া চটি পরে, নিজের সব শখ-আহ্লাদকে দূরে সরিয়ে রেখে নীতা নিজের পরিবারকে একত্রে জুড়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। সে চায় ঘরের সকলের আবদার পূরণ করতে। বড় ভাই কোনো কাজ করেনা, তবুও সে তার গায়ক হবার স্বপ্নে পাশে দাঁড়ায়, সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়ে যায় ‘দাদা! তুই একদিন বিরাট হবি!’
নীতার টিউশনির টাকার পুরো ভাগটাই নীতার মা চায় সংসারের কাজে লাগাতে। কিন্তু নীতা তার ভাইবোনের শাড়ি, জামা ও জুতা কেনার আবদারও মেটাতে গিয়ে সব টাকা শেষ করে ফেলে। নীতার মাকে সিনেমায় দেখা যায় এক স্বার্থপর নারী হিসেবে যিনি এই উপার্জনের অবলম্বন বড় মেয়েটির থেকে এত সাহায্য পেলেও তাকেই তিনি গালমন্দ করতে পিছপা হন না। পরিবারের সবাই যেন ধরেই নিয়েছে যে নীতা শুধু তাদের জন্যেই কাজ করবে। আমরা দেখি যে পরের মাস শেষে টিউশনির পুরো টাকা নীতা তার মায়ের হাতে তুলে দেয়ার পর মা তাকে পাঁচ টাকা রাখতে বলে হাতখরচ হিসেবে। কিছুক্ষণ পরে নীতা সেই পাঁচ টাকাও তার বড় ভাই শঙ্করকে দিয়ে দেয়। এই থেকে তার যে ত্যাগের পরিচয় পাওয়া যায়, এই নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগই একদিন তাকে তার করুণ পরিণতিতে নিয়ে যায়।
নীতার একজন প্রেমিক থাকে এই সিনেমায়, যার নাম সনৎ। এই সনৎ চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে পরিচালক একদম সাধারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন পুরুষের মনমানসিকতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সনৎ-এর সাথে নীতার দীর্ঘদিনের পরিচয়, এই ছেলেটি তার বাবার পুরনো ছাত্র হওয়ায় অনেকদিন থেকেই তাদের জানাশোনা। এই সনৎ যখন বেকার থাকে, তখন নীতা তাকেও আর্থিকভাবে সাহায্য করে। নীতা চায় সনৎ তার মেধা কাজে লাগিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে গবেষণা করুক, সে নিজে বরং চাকরি করে তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু নীতা বুঝতে পারেনি যে তার দুবেলা টিউশনি আর সংসার চালানোর সংগ্রামের মধ্যে ফাঁক গলিয়ে তাদের দুজনের মাঝে ঢুকে গেছে ছোটবোন গীতা। গীতার চাঞ্চল্যকর স্বভাব দেখে সনৎ এর তার দিকে ঝুঁকে পড়া স্পষ্ট বোঝা যায় সিনেমার শুরু থেকেই।
নীতার বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ার পর নীতার আর এম.এ পড়া হয়না, সে চাকরি নিয়ে নেয় সংসার চালাতে। সেই মুহূর্তে সনৎ তাকে বিয়ের কথা বললে সে মানা করে দিয়ে বলে যে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে সনৎকে, পরিবার এখন তাকে ছাড়া অচল। সনৎ সেই মুহুর্তে বলে “অপেক্ষা করবো কেন?” তার এই স্বার্থপর উক্তিতে নীতা চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় পরমুহূর্তেই। এর কিছুদিন পর সনৎকে তার নতুন বাসায় খুঁজতে গিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায় নীতা। ঘরের ভেতরে সে টের পায় পর্দার আড়ালে অন্য এক নারীর অস্তিত্ব। এতদিন ধরে নিজের এত ত্যাগের বিনিময়ে এই আচরণ পেয়ে তীব্র যন্ত্রণায় নির্বাক হয়ে যায় নীতা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার চোখেমুখে ফুটে উঠে সেই যন্ত্রণা, যে যন্ত্রণার দায় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের! বাড়ি ফিরে আসার পর বোন তাকে বলে- “দুপুর রোদে ছুটে কোনো লাভ হবেনা দিদি। অপেক্ষা করবার মত ধৈর্য সবার থাকেনা।” অর্থাৎ নীতা বুঝতে পারে যে সনৎ-এর ঘরের সেই মেয়েটি আর কেউ নয়, তার আপন বোন! অথচ এই সনৎকে-ই আমরা বলতে দেখি আগে ”আদর্শ বলে একটা ব্যাপার আছে, যার জন্যে মানুষ সাফার করে।”
গীতাকে আমরা বলতে পারি সুযোগসন্ধানী এক নারী যে নিজের বড় বোনের আত্মত্যাগ ও ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে তার প্রেমিককে আত্মসাৎ করেছে। গীতার আচরণে সবসময়ই দেখা যায় যে সে তার নিজ পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা নিয়ে অখুশি থাকতো। “এ বাড়িতে শুধু অভাব আর অভাব। শুধু এটা নেই, ওটা নেই, শুধু নেই আর নেই!” গীতার এই উক্তিতেই তার স্বার্থপরতা স্পষ্ট। তাই সে যখন দেখলো সনৎ মোটা বেতনের চাকরি পেয়েছে, তাই সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে একটি নিরাপদ জীবনের আশায় সনৎকে বিয়ে করে ফেলে। কবিতায় বলা হয় “দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান..” কিন্তু আসলেই কি দারিদ্র্য মানুষকে মহান করে? ‘মেঘে ঢাকা তারা’ তে দারিদ্র্যর ফাঁদে পড়ে ছটফট করতে থাকা নীতাসহ সিনেমার কেউই এই অবস্থাকে মেনে নিয়ে মহান হতে পারেনি।
আরো পড়ুন: ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে
ঋত্বিক ঘটক তার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় সাউন্ড ও মিউজিক নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন। তিনি সুররিয়ালিস্টিক সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করেছেন কোথাও কোথাও। এখানে আমরা সিনেমার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শব্দ দিয়ে মানুষের আবেগ কিংবা মনের অবস্থা বুঝতে পারি। সনৎ-এর ঘর থেকে ফেরার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে নীতার যে প্রতারিত হবার তীব্র যন্ত্রণা, সেখানে তিনি চাবুকের ঘা পড়ার শব্দ ব্যবহার করেছেন তার কষ্ট বুঝাতে। এছাড়াও নীতার মা চাইতেননা যে নীতা কারো প্রেমে পড়ুক, কারণ সে বিয়ে করে চলে গেলে আয়ের অবলম্বন কেউ থাকবে না। যখনি তিনি তাকে সনৎ ছেলেটির সঙ্গে দেখেছেন, তিনি ঘরের বাইরে আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকতেন, সেই প্রতিটি দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটন্ত তেলে কিছু রান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় যা আসলে মায়ের এক ধরনের হিংসাত্মক বা ইনসিকিউরড মনোভাব কে বুঝানো হয়েছে। অভাবের তাড়নায় পড়ে তিনি নিজেই নিজের একটি মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারছেন না। ঘটক বলেন ‘’Sound can be very effective when it’s ornamental. And at last, silence is the most symbolic thing.”
সিনেমার একটি দৃশ্যে শঙ্কর ও নীতা; Image Courtesy: anandabazar.com
পুরো সিনেমা জুড়েই সেতারের এক অদ্ভুত সুন্দর মৃদু সঙ্গীত ছিল। সিনেমার এন্ট্রি দৃশ্যে নীতার আগমন দেখানো হয় যখন তার ভাই শঙ্কর গলা সাধছিল রেললাইনের পাশে এক খোলা মাঠে বসে। নীতা তখন টিউশনি সেরে ফিরছে, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসলো। এর পরের দৃশ্যেই দেখা যায় পাড়ার মুদি দোকানি নীতাকে তার দোকানের বাকি দেয়ার জন্য ভৎর্সনা করছে। কিন্তু নীতাকে যে সবাই মিলে শোষণ করছে তা এই দোকানি পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল! তাইতো সে একদিন শঙ্করকে বলে ”শরম নাই তোমার? তুমি না বড় ভাই? এই বইন তোমারে উপার্জন কইরা খাওয়াইতাছে। নীতারে আমি কই সিন্ধুবাদ (সিন্দাবাদ), এই সিন্ধুবাদের ঘাড়ের উপর চইড়া তোমরা সবাই খাইতাছো। মরণে মুক্তি মিলবো তার, মরণে! ছি ছি ছি!” সনৎ-এর সাথে ছোটবোন গীতার বিয়ে ঠিক হবার পর বিয়ের আসরে গাওয়ার জন্যে নীতা শঙ্করের কাছে গান শিখতে চায়। শঙ্কর তাকে রবীঠাকুরের ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানটি শেখায়। এই গানের অসম্ভব সুন্দর করুণ সুর এই সিনেমাকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এ সিনেমায় চরিত্রগুলোকে লং শটে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই এ সিনেমায় শটের সংখ্যা অন্য সব সিনেমার চাইতে কম। প্রতিটি শটেই তিনি চরিত্রের মুভমেন্ট রেখেছেন, কখনো বা in and out focus করতে হয়েছে একই শটে। ঋত্বিক এক ইন্টারভিউতে সিনেমার একটি দৃশ্যের কথা বলেন- “যখন নীতা আবিষ্কার করে যে তার গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে, সেই মুহূর্তে তার মা তাকে ডাকছে। তবুও সে ডাকে সাড়া দেয়। পুরো সময় ফোকাস রাখা হয়েছে মায়ের দিকে, যদিও যে কথা বলে তার দিকে ফোকাস রাখা নিয়ম। এখানে ইচ্ছে করেই উল্টোটা করা হয়েছে। পরে নীতার দিকে ফোকাস আনা হয় যখন আবার মা কথা বলে।”
নীতার বাবা এক সামান্য মাস্টার হলেও তিনি সবসময় এক ধরনের নস্টালজিয়ায় ভুগেন দেখা যায়, সারাক্ষণ কীটস, শেলী আওড়াচ্ছেন। ছেলে কারখানায় লেবার হয়েছে বলে রাগ করছেন। আবার এই বৃদ্ধ লোকটির বড় কন্যার প্রতি স্নেহও স্পষ্ট। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে নীতাকে সবাই মিলে শোষণ করা হচ্ছে। শেষে দেখা যায় তিনিই এক বৃষ্টির রাতে বলেন নীতাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।
নীতার বড় ভাই শঙ্কর নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যখন ফিরে আসে, এলাকার সবাই আগে যাকে অপদার্থ বলতো, তাকেই সবাই সালাম দেয় তখন। ওদিকে নীতা ঘরে কাতরাচ্ছে তখন, কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। শঙ্করই ঘরে ঢুকে রক্তমাখা রুমাল দেখে বুঝতে পারে যে নীতার টিবি হয়েছে। শঙ্করই তাকে পাহাড়ের কাছে এক হাসপাতালে ভর্তি করায় নিয়ে, যেই পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন নীতার আজীবন ছিল।
শঙ্কর যখন সেই হাসপাতালে বোনকে দেখতে গিয়ে বাড়ির গল্প বলছিল, তাদের বাড়ি কীভাবে দোতলা হলো, গীতার ছেলে কীরকম দুষ্ট এই সবকিছু শুনে হঠাৎ করে নীতা বলে ওঠে ”দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম! দাদা, তুমি একবার বলো যে আমি বাঁচবো। আমি যে সত্যিই বাঁচতে চেয়েছিলাম। দাদা, আমি বাঁচবো! দাদা, আমি বাঁচবো!” সিনেমার শেষ দৃশ্যই ছিল নীতার এই তীব্র আকুতি যা আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো তার বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছা!
নীতা তো বাঁচতে চেয়েছিল পুরোদমে, কিন্তু পারেনি। কবি অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন “খুব কম মানুষই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে। বেশিরভাগই যা করে, তা হলো স্রেফ টিকে থাকা।”
‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সনৎ একদিন চিঠিতে নীতাকে বলেছিল যে সে হলো এক মেঘে ঢাকা তারার মতো, যার মধ্যে আছে ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু সেই ঔজ্জ্বল্য যে সংসারের টানাপোড়েনে ক্ষয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত তা কেউ বোঝেনি। নীতার এই পরিণতির জন্যে হয়তোবা নীতা নিজেও কিছুটা দায়ী ছিল। সিনেমায় একটি দৃশ্যে নীতা সনৎকে বলে যে “এটাই আমার পাপ, যে আমি কোনোদিন প্রতিবাদ করিনি।”
মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রের জন্যে ঋত্বিক ঘটক প্রশংসিত হয়েছেন অসংখ্য জায়গায়, অনেক অনেক পুরস্কারও রয়েছে তার ঝুলিতে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, স্পেনসহ দেশবিদেশের প্রায় ২৯টি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে এই সিনেমাটি। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে ঋত্বিক ঘটক খুব কম সিনেমা বানিয়েছেন কিন্তু এই দেশভাগ ট্রিলজি তার সিনেমা ক্যারিয়ারের অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে যার শুরুটা হয়েছিল এই চলচ্চিত্রটি দিয়ে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’তে পরিচালক দারিদ্র্যের কশাঘাত, নারী শোষণ, মধ্যবিত্তের জীবনের কঠিন টানাপোড়েন, পুরুষতান্ত্রিকতা সবকিছুই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। নীতার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পরিচালক এখানে নীতাকে হিরো বানাবার চেষ্টা করেননি, বরং তিনি চোখে আঙুল দিয়ে বুর্জোয়া সমাজের অসঙ্গতি ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন। আর নীতাও নিজেকে ক্রমাগত শোষিত হতে দিয়েছে, সে কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে এটাই স্বাভাবিক, এই ত্যাগ তাকে তার পরিবারের জন্য করতেই হতো। কিন্তু বিনিময়ে সে কারো শ্রদ্ধাও পায়নি, বরং শেষে সে-ই হয়েছে বোঝা।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ আমাদের শেখায় যে ‘ত্যাগ’ এর নাম করে কোনো নারীকে আজীবন শোষণ করা যায় না পরিবারে, এই সিনেমা আমাদের শেখায় যে মুখ বুজে সব অন্যায় সহ্য করলে একসময় নিজের অস্তিত্ব থাকে না। তাই সমাজের প্রতিটি নারীর হওয়া উচিত স্পষ্টবাদী ও নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দিয়ে ঋত্বিক ঘটক আমাদের সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন।ঋত্বিক ঘটক আমাদের সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন।
বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।