নামতা লেখার স্লেটে পরীর গল্প
নামতা লেখার স্লেট পেয়েছি সেই কবে কোন্ ছেলেবেলায়;
ভুল করে নীল পরীর গল্প মকশ করেছিলাম তাতেই
বাড়ির সবাই ঘুমোলে পর ঘর-পালিয়ে দুপুরবেলায়।
নামতাগুলো সব মুছেছে ঘুরতে-ফিরতে হাতে হাতেই;
পরীর সেই গল্পটাই শুধু নৌকো হয়ে যাচ্ছে ভেসে
বিকেলে লাল মেঘের তলায়—
ম্লান জীবন
দিন যায়। পরতে পরতে জমে ধুলো। সে চলে যাবার পর
অর্গানের রীডে— যাকে আমি সুরের পাঁজর বলতাম—
আর কেউ আঙুল রাখে না। না রাখুক আমি বেশ আছি।
বাড়িময় আলস্যের ঘুম-ঘুম ঘোর, আকাঙ্ক্ষারা ফটকের বাইরে থাকে—
বিরক্ত করে না। ঝরা পাতার তলায় ঢাকা এই বাড়ি, এই ম্লান জীবনেরও
একরকম সুখ আছে, একরকম আস্বাদন আছে। — আমি বেশ আছি।
সব মিথ্যে। আসলে এ বাড়িতে কখনো অর্গান ছিল না
— যা ছিল, তা আমারই পাঁজর। আমিও মো্টেই বেশ নেই।
তুমি নিয়মমাফিক আসো— হেসে ওঠে বাড়ি; পাঁজরের ফাঁপা হাড়ে
অদ্ভুত বাতাস ভরে দাও। আমি আশঙ্কায় কাঁপি : বুঝতে পারি,
একদিন পূর্ণচ্ছেদ পড়ে যাবে, তারপর সত্যি সত্যি পরতে পরতে জমবে ধুলো।
সেই ম্নানতার জন্য, অমোঘ দুঃখের জন্য এভাবেই একটু একটু করে তৈরি হই।
অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি
কসবা-পঞ্চাননতলা থেকে মেয়েরা এসে বাড়ির কাজ করে যায়।
রমণী চাটুজ্যে স্ট্রীটের এই শেষ বাড়িটা হচ্ছে অসভ্য দাদাবাবুদের।
মেয়েরা টিপে টিপে হাসে, চোখ মটকে ইঙ্গিত করে :
অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি।
স্বাধীন চার বাইয়ের ছটা বড় বড় ঘর। মাঝে মাঝে কাজিনরা
এসে রাত কাটিয়ে যায়,
অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি জেন মঠের মতো চুপচাপ।
এ বাড়ি কি মহেশ যোগীর কোনো আর্কিটেক্টের করা?
স্পাইরাল গ্যালাক্সির মতো অচিন্ত্যনীয় সিঁড়ি…
আড়ি পাতার জন্য ছোট ছোট ফোকর আছে দেয়ালে…
সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় গোপন সুড়ঙ্গ থেকে হাওয়া এসে
শাড়ি উতলা করে…
ধ্যানঘরে অন্ধকার— হার্ট লাং ব্রেন সার্জারি টের না পাওয়া
চেতনালুপ্ত অন্ধকার…
রান্নাঘরে অনেক রকমের যন্ত্রপাতি— দাদাবাবুরা
কোনো কথা বলে না, হাতে ধরে রান্না শেখায়।
চার ভাই মিলে অনেক মাইনে দেয়— মেয়েটির
সন্দেহপুলক জন্মে : অসভ্যই যদি না হবে তো এত মাইনে দেবে কেন?
ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘটবে ঘটবে করে কিছুই ঘটে না,
তাই আরো ভয় করে : যেন অদৃশ্য স্তম্ভের মাথায়
বাজ চিল ঈগল কণ্ডর বসে আসে— স্তব্ধ,
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে— ঝপ করে মাছটিকে ধরে নিয়ে
নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ বসে বসে খাবেই একদিন।
নিরবচ্ছিন্ন প্রতীক্ষা, আধ্যাত্মিকতা, আত্মসমর্পণ।
বিড়ালী
বেড়ালটা সকাল থেকে কাঁদছে
কাল থেকে ওর বাচ্চাটা নিখোঁজ।
আমি রাতের বেলা রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করছিলাম,
সে শান্তির আশায় এসে দুই থাবা জোড় করে বসল।
কিন্তু হল না।
একটু পরেই সে মিউমিউ করে আবার কাঁদতে লাগল,
পাগলের মতো প্রদক্ষিণ করে ঘুরতে লাগল।
আর পুত্রশোক আগুনের মতো ঘিরে ধরল
রামকৃষ্ণদেবকে।
কোকিল
মৃত্যু হল কিনা জানব কি করে?
হাতুড়েরা বলল, নাক মুখ চোখ দিয়ে তখন প্রাণের বাতাস বেরিয়ে যাবে।
ডাক্তার বলল, যখন রাইগার মর্টিস শুরু হবে।
এ যেন এত সোজা— ‘বাড়িতে আছ নাকি, থাকলে সাড়া দাও।’
সাড়া না দিলে বুঝব, নেই।
গুরুজি বললেন, দ্যাখো, বাহার যদি ঠিক ঠিক হয়
তবে কোকিল ডাকবেই। বলে আলাপ করতে করতে
যেই কোমল নিষাদ থেকে ধৈবতে মিড় লাগিয়েছেন
অমনি দূরে সাড়া দিল কোকিল।
আমি ভাবছি— আমার বেলা, কোকিল যদি দেশে না থাকে?
ছটফটে বসন্তের শেষে কোকিল যদি ঘুমিয়ে পড়ে?
আমার গুরুর মতো গুরু হয় না। উনি মড়া জাগাতে পারেন।
তারপর থেকে বাহারের সঙ্গে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে
মৃত কোকিল!
সাপ
আমাদের দীর্ঘ আয়ু দরকার, হাজার বা লক্ষ বছরের, যাতে
শেষকালে বাধ্য হয়ে আলো ফোটে।
দিন আরো লম্বা হোক, রাত্রি আরো বেশি, যাতে
উদ্ভিদ ও বর্ণের পল-অনুপল চিনি, যাতে
আঁধার ও প্রাণীদের যাবতীয় হৃদয়কাঁপন ধরতে পারি।
একটি সঙ্গমকাল অর্ধেক বসন্ত স্হায়ী হোক— পেরোবার আগে
প্রত্যেক সিঁড়িতে বসে জীবন ও মরণ আমি উলটেপালটে দেখি।
তারপরই দীর্ঘ উপবাস— সাধুর শিষ্যের মতো বলে শীর্ণ সাপ,
বনে বাস, অকিঞ্চন, বেতের পাতার মতো হালকা শীর্ণ সাপ।
প্রলয় বা সমাধি
বেলপাতা ও টুপটাপ বৃষ্টির জলের নিচে
চাপা পড়ে আছে শিবলিঙ্গ।
সেই ভিজে পাতার স্তূপের নিচে
দিন : আষাঢ়সন্ধ্যার মতো,
রাত : দেহ-মাটি-হয়ে-যাওয়া বনগর্ভের মতো।
ওখানে, ঐ সম্পূর্ণ অবলম্বনহীনতার নৈঃশব্দ্যে
আমি শিবলিঙ্গের মতো আছি— শুধু এই কল্পনাতেই
আমি প্রলয়ের ধারণা পাই।
নীল
বৃদ্ধ কুকুরের চোখের মতো বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেছে আমার পুংস্ত্ব
অবলুণ্ঠিত শরীর বহুদিন হল নীরব অপমানের কাছে আত্মসমর্পিত।
তবু এখনো, শব্দে অভ্যাসস্পৃষ্ট সেই বোজা চোখেই যখন
আধা খোলে— ধক করে ওঠে চৈত্রের সিংস্র পিঙ্গল।
আলপিনের কপিশ মাথা ছুঁচের চকিত ছ্যাঁদার মধ্য দিয়ে
দেখে : নীল আকাশ— প্রতুদগামী
আনন্দকে তথাগত এবং আমি
‘আনন্দ, আমার পিঠ ব্যথা করছে,
আমি একটু শোব। সমাগতদের তুমি
উপদেশ দাও।’
তথাগত, এই কথা শুনে আমি মজঝিমনিকায়খানি
বন্ধ করি।
আড়াই হাজার চৈত্র— আর এতদিনকার উদবেদিল
অপরাহ্ণ, রক্তসন্ধ্যা, নিশীথ আক্ষেপ—
পৃথিবীর আমজামবট বন ঘুরে এসে
আমার ভেতর শুতে চায়। আমি সেই ক্লান্তির কারুণ্য
লক্ষ করি।
আনন্দ, আমার পিঠ ব্যথা করছে— কৃতকর্ম বড় বেশি ভারী।
আনন্দ, কখন আমি শোব?
অসীমবাবুর গল্প
শ্রাদ্ধ শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল বিকেলে—
সন্ধ্যার মুখে অসীমবাবুর পিণ্ড আর খাবার
নন্দ লেকের জলে দিলে এল।
লেকের ওইখানটায় কেউ বড় একটা যায় না।
জলে দলঘাস গজিয়েছে, কচি নলখাগড়া গজিয়েছে,
জলের নিচে শৈবাল।
বিদেহ অসীমবাবু যেন জানতেন— ওইখানেই গাছতলায়
বিমর্ষ আর ক্ষুধার্ত হয়ে বসেছিলেন—
নন্দ চলে যেতেই ময়লা প্যান্টের পা গুটিয়ে
পিণ্ডি নিতে জলে নামলেন।
পোড়াবার সময় চশমা সঙ্গে দেয় নি,
এখন আর ভালো দেখতে পাচ্ছেন না।
ওদিকে সূর্যের শেষ রশ্মি মিলিয়ে যাচ্ছে—
পিণ্ড কি জলে মিশে গেল?
না কি মাছেরা খেয়ে গেল?
অসীমবাবু অন্ধের মতো তাঁর রোগা হাতে
হাতড়ে হাতড়ে খোঁজেন।
মাঘের শীত মিশেছে লেকের জলে,
অন্ধকার মিশেছে লেকের জলে।
বড় কষ্ট হয়।
শীত, খিদে, নিঃসঙ্গতা কি এখানেও পিছু পিছু এল?
সামান্য একটু রেঁধে-দেওয়া অন্নের জন্য
সারা জীবন এত অপেক্ষা, তিতিক্ষা—
অসীমবাবু শরালের মতো কাঠি-কাঠি পায়ে
রাত্রির মধ্যে ভাতের টুকরো, পোড়ো মাছের টুকরো খুঁজতে লাগলেন।
ওঁ ভূঃ ভুবঃ স্বঃ।
শীত অচিরস্থায়ী। দু মাস পরেই বসন্ত এল।
পরিযায়ী শরালদের সঙ্গেই অসীমবাবু
দুই ডানা মেলে আকাশে উঠলেন।
ওঁ পার্থিব আকাশ।
ওঁ অপার্থিব আকাশ।
ওঁ আকাশ।
.
