| 23 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -৯)। হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস


 

নবজাগরণের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে একজন পণ্ডিত লিখেছেন:

‘ জীবনটাকেবল সহ্য করার মতো বস্তু নয় আসলে এটা একটা উপভোগ করা জিনিস— এরকম একটি নতুন অনুভূতি মানুষের মন অধিকার করতে লাগল। মানুষ এই পরিদৃশ্যমান বস্তু জগতকে গভীর আবেগের সঙ্গে ভালোবাসতে শুরু করল এবং পৃথিবীর প্রতি সেই প্রেমই জন্ম দিল কলা এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নবজাগরণের যুগের বিষ্ময়কর এবং মহিমা মন্ডিত শিল্প-কর্ম গুলির। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেল এবং রাফেল— এই তিনজন  মহান শিল্পী ছিলেন নবজাগরণ যুগের শিল্প আন্দোলনের প্রধান নেতা। মানুষ প্রকৃতিকে নতুন করে পরীক্ষা করে দেখতে আরম্ভ করল— যার ফলে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা হল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের নতুন অনুসন্ধানগুলি এর ফলেই সম্ভব হল। মানুষ তাদের ব্যক্তিগত উদ্ভাবনী দক্ষতা কাজে লাগানোর জন্য প্রেরণা লাভ করল এবং তার ফলে আবিষ্কৃত হল মুদ্রণ যন্ত্র।মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার জ্ঞানের বিস্তারের পথ সুগম করে তুলল। এইসব কারণে নবজাগরণকে আধুনিক জগত এবং আধুনিক মানসিকতার শুরু বলা হয়। এরপরেরঅধ্যায় গুলিতে আমরা মুদ্রণ যন্ত্র কোপার্নিকাস এবং কলম্বাসের কাহিনি বলব। কিন্তু সেই সব প্রসঙ্গে যাবার আগে আসুন আমরা নবজাগরণের যুগের  এক বিরাট বহুমুখী প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিই। তিনি হলেন মাইকেল এঞ্জেল।

মাইকেল এঞ্জেল

     মাইকেল এঞ্জেল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠচিত্রকর এবং ভাস্করদের মধ্যে অন্যতম।ইটালিরটাস্কেনিতে ১৪৭৫ সনে ৬ মার্চ তার জন্ম হয়। শৈশব থেকে চিত্রকলার প্রতি তার অদম্য আগ্রহ ছিল কিন্তু তার পিতা ভেবেছিলেন যে অভিজাত পরিবারের সন্তানের জন্য চিত্রকরহওয়াটা একটা সম্মানজনক বৃত্তি নয়। মাইকেল এঞ্জেলের বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর তখনই ফ্রান্সের ফ্রান্সেস্কগানাাচ্ছি নামের একজন চিত্রকরের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় । তার চিত্রশালায় মাইকেল এঞ্জেলশিক্ষানবিশীর  জীবন আরম্ভ করেন। চিত্রাংকন শিক্ষার অংশ হিসেবে তাকে বিখ্যাত চিত্র কিছু নকল করার কাজে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু চিত্রাংকনেরচেয়ে মাইকেল এঞ্জেলেরবেশি আগ্রহ ছিল ভাস্কর্য কলার প্রতি।

১৪৮৯ সনে মাইকেল এঞ্জেল ভাস্কর্য কলা শেখার জন্য ফ্লোরেন্সের শাসক লরেন্স দ্য মেডিছির কাছে যান এবং তার পৃষ্ঠপোষকতায় মাইকেল এঞ্জেলবাটলভ দা গিয়ভান্নির সঙ্গে শিষ্য হিসেবে  কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। তার অসাধারণ প্রতিভার কথা লরেঞ্জের কানে পড়ায় লরেঞ্জ তার নিজের রাজপ্রাসাদে বাস করার জন্য নিমন্ত্রণ করে। লরেঞ্জের রাজপ্রাসাদে বাস করার সময় মাইকেল এঞ্জেল সেই সময়েরনেতৃস্থানীয়মানবতাবাদী দার্শনিকদের আলাপ আলোচনা নিবিড় মনোযোগে শোনার সুযোগ লাভ করেন এবং তার প্রভাব তাঁর জীবনে চিরস্থায়ীহয়। 

১৪৯২ সনে  লরেঞ্জের মৃত্যু হয়।তার ছেলে পিয়ের দ্য মেডিছি মাইকেল এঞ্জেলকে তাঁর প্রাসাদে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মনের মতো কোনো কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় মাইকেল নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। এরকম সময় ফ্রান্স ফ্লোরেন্স আক্রমণ করতে উদ্যত হওয়ায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৪৯৪ সনে মাইকেল এঞ্জেলবাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তার ছয় মাস পরে ফরাসিসৈন্যবাহিনী ফ্লোরেন্স দখল করে  মেডিছিকে সিংহাসন চ্যুত করে। তারপরে চার বছরের জন্য ফ্লোরেন্স শাসন করে বিখ্যাত ধর্ম প্রচারক ছাভানারোলা। ইউরোপের নবজাগরণে মানুষের মনে যে নতুন চিন্তার স্রোত প্রবাহিত হয়েছিলছাভানারোলা ছিলেন সেই সমস্ত কিছুর বিরোধী। তিনি ছিলেন মধ্যযুগেরগোঁড়াধর্মবিশ্বাসের প্রতিভূ। কিছুদিনের জন্য তিনি মানুষের মনের উপরে গভীর প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু নবজাগরণেরমানবতাবাদী আদর্শ মানুষের জন্য এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠল যে সেই আদর্শের বিরোধিতা করার অপরাধে তারা অবশেষে  ছাভানারোলাকেফাঁসিদিয়েআধমরা অবস্থায় তাকে পুড়িয়ে ফেলল। 

পলাতক অবস্থায় মাইকেল এঞ্জেল প্রায় এক বছর বলোনায় বাস করেন।কিন্তুঅর্থাভাবেরসম্মুখীন হয়ে তিনি পুনরায় ফ্লোরেন্সে ফিরে আসেন এবং সেন্ট জন নামের একটি মূর্তি খোদাই করেন। তিনি যুবক বয়সে নির্মাণ করা অন্যান্য কয়েকটি মূর্তির সঙ্গে সেন্ট জনের মূর্তিটিও হারিয়েযায়।সান গিয়র্গিয়রকার্ডিনালেরপৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার আশায় ১৪৯৬ সনে তিনি রোমে যান।কার্ডিনালেরকাছ থেকে তিনি কোনোসহানুভূতি লাভ করতে পারলেন না। কিন্তু প্রাচীন মূর্তি সংগ্রাহক  জেকপোগেল্লি তাকে দণ্ডায়মানকিউপিডের একটি পূর্ণ উচ্চতা সম্পন্ন মূর্তি গড়ার কাজে নিয়োগকরেন।এই মূর্তিটাও আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়াযায়নি। সে যাই হোক না কেন গেল্লির সাহায্যে মাইকেল এঞ্জেলফরাসিকার্ডিনালজ্য দ্য ভিলিয়ার দ্য গ্রসলের থেকে ‘পিয়েটা’অর্থাৎ মৃত খ্রিষ্টকে কোলে নিয়ে থাকা কুমারী মাতার মূর্তি নির্মাণ করার জন্য কমিশন লাভ করেন। মাইকেল এঞ্জেলই নিজের সেই প্রতিশ্রুতি  অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।১৪৯৯ প্রতিশ্রুতিদিয়েছিল যে এই মূর্তিটা হবে রোমের সুন্দরতম মূর্তি  কোন জীবিত শিল্পীই  এর চেয়ে অধিক সুন্দর মূর্তি নির্মাণ করতে পারবেনা।মাইকেলএঞ্জেল নিজের সেই  প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন ।১৪৯৯ সনে এই মূর্তিটি বিশ্ব বিখ্যাত সেন্ট পিটার্সগির্জায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে মাইকেল নির্মাণ করা সমস্ত মূর্তির ভেতরে একমাত্র এই মূর্তিটিই তার স্বাক্ষর বহন করছে।এরকম একটি অসাধারণ মূর্তি নির্মাণ করার পরেও কিন্তু মাইকেল এঞ্জেল রোমে নতুন কোনো কাজ করার কমিশন পেলেন না। ১৫০১ সনে তিনি পুনরায়  ফ্লোরেন্সে  ফিরে এলেন। 

মাইকেল এঞ্জেল মোট পাঁচ বছর ফ্লোরেন্স থেকে দূরে ছিলেন। এই সময়ের ভেতরে ফ্লোরেন্সে অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটল। ফ্লোরেন্সে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তিত হল। এবার মাইকেল এঞ্জেল এত বেশি কাজ করতে শুরু করলেন যে তার খাবার ঘুমোবারসময়রইল না ।অন্যান্য অনেক কাজের সঙ্গে তিনি ডেভিডের একটা বিরাট মার্বেলের মূর্তি নির্মাণ করার কাজ আরম্ভ করে অসম্পূর্ণ অবস্থায় ছেড়েদিয়েছিলেন। মাইকেল এঞ্জেল সেই একই মার্বেলে তার ১৭ ফুট ডেভিডের নির্মাণের কাজ ১৫০১ সনের তেরো সেপ্টেম্বর তারিখে আরম্ভ করলেন।১৫০৫ সনের আট সেপ্টেম্বর এই মূর্তির নির্মাণ কার্য সম্পূর্ণ হল। ফ্লোরেন্সের ৩০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীকে দিয়ে গঠিত একটি কমিটি নির্বাচন করা একটি জায়গায় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হল। ডেভিড একটি অতি বৃহৎ আকারের নগ্ন পুরুষ মূর্তি। তিনি নিজের সম্প্রদায়ের শত্রু গলিয়াথের আগমনের জন্য শান্তভাবে অপেক্ষা করে রয়েছেন।

১৫০৪ সনে  লিওনার্দো দা ভিঞ্চি  ফ্লোরেন্সের শাসক পরিষদ ভবনের  পূব দিকের দেওয়ালে‘আঙ্গিয়ারির  যুদ্ধ’ নামের একটি বিশাল চিত্র এঁকেছিলেন। তার কয়েক মাস পরে দেওয়ালটির অন্যদিকে ৬০ ফুট দীর্ঘ এবং ২৪ ফুট প্রশস্ত একটি অন্য ছবি আঁকার জন্য মাইকেল এঞ্জেলকেনিয়োগ করা হল।তিনি নিজের চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিলেন ১৩৬৪ সালে যুদ্ধের সময় ঘটা একটি ঘটনা। ফ্লোরেন্সের সৈন্যরা নদীতে স্নান করছিল। এরকম সময় শত্রুর আগমনের সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে উঠে। মাইকেল এঞ্জেল এই চিত্রটি আঁকার সময়পিশার যুদ্ধ চলছিল। তাই তিনি এই চিত্রটির মাধ্যমে ফ্লোরেন্স বাসীকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন যে স্বদেশ রক্ষার জন্য তারা প্রত্যেকেই সব সময়ে তৈরি থাকা উচিত।

এই বিশাল চিত্রটি মাইকেল এঞ্জেলকেচিত্রকর হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করল।নবজাগরণের যুগের শিল্পকলার মহত্তম আদর্শ মাইকেল এঞ্জেলের এই চিত্রটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে উঠল আর মাত্র ত্রিশ  বছর বয়সে তিনি ইটালিরসর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী রূপে পরিগণিত হলেন।

১৫০৫ সনে রোমের পোপদ্বিতীয়জুলিয়েট মাইকেল এঞ্জেলকে রোমে নিমন্ত্রণ করে তাঁর সমাধি মন্দির নির্মাণ করার জন্য নিয়োগ করলেন ।পরম উৎসাহে এই কাজ আরম্ভ করার কিছুদিন পরে মাইকেল এঞ্জেল লক্ষ্য করলেন যে কাজটির  প্রতি পোপের আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে আসছে।১৫০৬ সনের সতেরো এপ্রিল তারিখ মাইকেল এঞ্জেলঘোড়ায় উঠে রোম থেকে পালালেন। পোপ তার পেছনপেছন তাড়া করলেন।কিন্তু পোপের অনুচর তাকে ধরার আগেই মাইকেল এঞ্জেলনিরাপদে এসে ফ্লোরেন্সে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তার কিছুদিন পরে পোপ পুনরায় তাকে রোমে ডেকে পাঠালেন এবং পোপের ব্যক্তিগত উপাসনা গৃহ ছিষ্টিনচেপেলেরসিলিংটাচিত্রাঙ্কনকরার কাজে তাকে নিযুক্ত করলেন ।এই বিরাট কাজের প্রস্তুতি আরম্ভ হল ১৫০৮ সনের মে মাসে।ছিষ্টিনচেপেলের কাজ শেষ হওয়ার পরে পোপ তাকে আরও একটি বড়ো কাজে নিয়োগ করলেন। এই কাজের জন্য মাইকেল এঞ্জেল সাত বছর সময়নিলেন। তাছাড়া এই সময়ের ভেতরে তিনি অন্য কোনো কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না বলে ঠিক করলেন। ১৫১৩  এবং ১৫১৬  সনের ভেতরে তিনি ‘মোজেস’ এবং ‘দাসের’ মূর্তি নির্মাণ করে শেষ করলেন।শিল্পকলার প্রসিদ্ধ ইতিহাস রচয়িতাভাছারি ১৫৬৮ সনে লিখলেনঃ‘মাইকেল এঞ্জেল যখন মোজেসের মূর্তি নির্মাণ করে শেষ করলেন তখন প্রাচীন বা আধুনিক এরকম কোনো মূর্তি রইল না যে মূর্তি মাইকেলএঞ্জলের‘মোজেস’ এর মূর্তির সমকক্ষ হতে পারে।

 এই মূর্তি এখনও রোমের সবচেয়ে বিখ্যাত মূর্তি।

এরপরে মাইকেল এঞ্জেল একের পর আর এক কয়েকজনপোপেরনির্দেশক্রমে অনেক চিত্র আঁকলেন এবং মূর্তি নির্মাণ করলেন। সেইসবের ভেতরে কিছু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প সৃষ্টির অন্যতম। ১৫৩৩ সনে মাইকেল এঞ্জেল পুনরায় রোমে গিয়েজুলিয়াসমনুমেন্টে অর্ধ সমাপ্ত কাজ শেষ করতে শুরু করলেন। কিন্তু পোপ ক্লিমেন্টেতাকে বললেন যে অন্য কাজ করার আগে তিনি ছিষ্টিন  চেপেলের বেদীরপেছনেরদেওয়ালে একটি ছবি এঁকে চেপেলেরচিত্রাঙ্কনের কাজ  সম্পন্ন করতে হবে।বিষয়বস্তু ঠিক হল ‘শেষ বিচার’। ১৫৩৫ সনে এই ছবি আঁকা শেষ হল। ছবিটা দেখে পোপ আবেগে অভিভূত হয়ে  সেখানেই প্রার্থনা করতে বসে গেলেন—‘ প্রভু তুমি যেদিন শেষ বিচারের জন্য অবতীর্ণ হবে সেদিন যেন আমার বিরুদ্ধে কোনো পাপের অভিযোগ না আনো।’

ইউরোপের নবজাগরণযে দুইজন অতি মানবিক প্রতিভার অধিকারীসর্বগুণী শিল্পীর জন্ম দিয়েছিল তাদের একজন হলেন মাইকেল এঞ্জেল। অন্যজনলিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি যার কথা আগেই বলা হয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলের বিষয়ে আমরা সাধারণ মানুষ জানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল এই যে তিনি তিনি কেবল সহজাত প্রতিভার বলেই শিল্পী হিসেবে অসামান্য কৃতকার্যতা লাভ করেননি।  প্রতিভার সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার অসাধারণ পরিশ্রমশক্তি। তিনি শিল্পী জীবন আরম্ভ করেছিলেন ভাস্কর হিসেবে। রোমের পোপ  তাকে ছিষ্টিনচেপেলের চিত্র আঁকার জন্য নিয়োগ করার আগে মাইকেল চিত্রাংকনের প্রতি কখনও বিশেষ মনোযোগ দেননি কারণ চিত্রকরহওয়ার তাঁর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না ।ছিষ্টিনচেপেলেরছবি আঁকার জন্য প্রথমে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন। পোপের ইচ্ছাই আইন।  তাঁর অবাধ্য  হওয়ার সাহস কার আছে?নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চিত্র আঁকতেশুরু করে প্রায় এক বছর পরে ১৫০৯ সনে ২৭ জানুয়ারি মাইকেল এঞ্জেল লিখেছিলেন—‘চিত্রাঙ্কন আমার বৃত্তি নয়। আমি মিছেমিছি আমার সময় নষ্ট করছি মাত্র ।কিন্তু ছিষ্টিনচেপেলের  চিত্র আঁকা যখন শেষ হল তখন সমগ্র সভ্য জগত স্বীকার করতে বাধ্য হল যে মাইকেল এঞ্জেলের আগে বা পরে কোনো চিত্রকর এর চেয়ে অধিক মহিমা মণ্ডিত  চিত্র কখনও আঁকেনি।

এত বড়ো কাজ করার জন্য পোপের দ্বারা নিযুক্ত হওয়া অন্যান্য শিল্পীরা সহকারী হিসেবে অনেক মানুষের সাহায্য নেয়।কিন্তুমাইকেল এঞ্জেল সম্পূর্ণ কাজটা করেছিলেনএককভাবে। তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। সেজন্য কাজ করতে থাকা পুরো সময়টাতে চ্যাপেলের ভেতরে কোনো মানুষকে প্রবেশ করতে দিতেন না। তার সমস্যার অন্ত ছিল না। প্রথমে তার চিত্রাংকনের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই কম সেই জন্য কাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেসিলিং এর প্রথম অংশটাখসে গিয়ে ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন সমগ্র ছবিটা তাঁকে পুনরায় নতুন করে আঁকতেহয়েছিল।এরকম একটা কঠিন প্রাণঘাতিক কাজে তিনি যখন দিনরাত মগ্ন হয়েছিলেন সেই সময় তার আত্মীয়-স্বজনরা আর্থিক সাহায্য চেয়ে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলছিল। এছাড়া ভূতের উপরে দানোরমতো ছিল পোপের অবিরাম তাগিদা।মাইকেলএঞ্জেল কারও সাহায্য না নিয়ে একা কাজ করার জন্য চ্যাপেলের ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য পোপ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ভেবেছিলেন যে কাজটা শেষ করার জন্য মাইকেল এঞ্জেল প্রয়োজনের চেয়েবেশিসময়নিচ্ছে। মাঝে মাঝে যে উঁচু চাঙে উঠে সিলিং এর ছবি আঁকতেনধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেবেন বলে  পোপ তাকে ভয় দেখাতেন। কিন্তু সমস্ত দুঃখ-কষ্ট এবং প্রতিকূল অবস্থা অগ্রাহ্য করে মাইকেল এঞ্জেল নীরবে কাজ করে যেতে লাগলেন।তাকে  কী ধরনের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছিল সেই কথা সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। যেহেতু ছবি আঁকতে হবে চ্যাপেলেরসিলিংয়ে  সেই জন্য মাইকেল অ্যাঞ্জেলকে একটা উঁচু চাঙে শুয়েপড়তেহয়েছিল।এভাবেশুয়ে থাকা অবস্থায় ছবি আঁকার সময় তাকে মাথাটা পেছনে হেলিয়ে রাখতে হত।একদিন দুদিন নয়  সুদীর্ঘ চারটি বছর।  যার ফলে তার গলার গ্রন্থি গুলি ফুলে ওঠে তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছিল।এইসবছাড়া চোখের কষ্ট তো ছিলই। চার বছরের অমানুষিক পরিশ্রমের শেষে ছিষ্টিনচেপেলেছবি আঁকা যখন শেষ হল তখন মাইকেল এঞ্জেলের বয়স মাত্র ৩৭ বছর। কিন্তু ছিষ্টিনচেপেল তাঁর যৌবন এবং শক্তি এভাবে হরণ করল যে মাত্র ৩৭ বছরে তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন।

 কিন্তু এরপরও মাইকেল এঞ্জেল আরও বাহান্ন  বছর বেঁচে ছিলেন। এই সুদীর্ঘ ৫২বছরের একটি দিনও একটি মুহূর্তও তিনি কাজ না করে থাকেন নি।তিনি ছিলেন একজন প্রেরণা মত্ত  এবং দুঃসাহসী  শিল্পী।কিন্তু তিনি কি শুধু শিল্পীই ছিলেন? চিত্র এবং ভাস্কর্যছাড়া তিনি সারা জীবনে ২৫০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। চিত্রাংকন এবং ভাস্কর্যের মতোই কাব্য রচনাতেও তিনি অতি মানবিক শ্রমশক্তিরপরিচয়দিয়েছিলেন।অনেকের মতে তিনি ইটালিরসর্বশ্রেষ্ঠ কবি। যে মানুষটি ছিলেন চিত্রকর ভাস্কর এবং কবি সেই একই মানুষকে প্রয়োজনের সময় সামরিক অভিযন্তার দায়িত্ব নিতে হয়েছিলঅর্থাৎ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতোই মাইকেল এঞ্জেল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীপূর্ণমানব।নবজাগরণের আদর্শ মূর্ত প্রতীক।

 মাইকেল এঞ্জেলের কলা মানব কল্পনার উচ্চতম সীমা অতিক্রম করেছিল। যে সমস্ত বিষয়ের চিন্তা পৃথিবীর সমস্ত যুগের সমস্ত ভাবুকের মন উদ্বেলিত করে রেখেছে—সৃষ্টির আদি এবং অন্ত—সেই শাশ্বত জিনিসতার কলায়অন্তহীন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। আলোর সৃষ্টি, প্রাণের উন্মেষ, পাপের উৎপত্তি, শেষ বিচারের দিন—এই সমস্ত কিছুই তিনি প্রকাশ করেছেন মানবদেহের গতি এবং আন্দোলনের দ্বারা। আমরা যে সমস্ত জিনিসকে মানুষের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলে গণ্য করি, সেই সবকিছুর ভেতরে একটি হল মাইকেল এঞ্জেলের শিল্প–কীর্তি। শিক্ষিত মানুষ মাত্রই তার বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে হলেও জানা উচিত ।




 


 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত