| 7 অক্টোবর 2024
Categories
ইতিহাস

রসিক মানুষ মির্জা গালিব

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

।।ডঃ এমরান জাহান।।

আধুনিক উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ট কবি মির্জা গালিব। ফারসি সাহিত্য রচনায়ও তাঁর খ্যাতি আছে। গালিবের সময়কাল ১৭৯৭- ১৮৬৯ পর্যন্ত। জন্ম ২৭ ডিসেম্বর  আগ্রায়।  তবে ৫০ বছর দিল্লীর স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। সাহিত্য চর্চা ছাড়া আর কোনো পেশা গ্রহণ করেননি জীবনে। চলা-ফেরায় দিল্লীর আশরাফ মুসলমানের ন্যায় আভিজাত্যের লেবাস ছিল। পুরো নাম মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব।

গালিব গবেষক পুস্পিত মুখোপাধ্যায় লিখেন, “বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যে গুরুত্ব, উর্দু সাহিত্যে মির্জা গালিবের গুরুত্ব তারচেয়ে অধিক বললে অত্যুক্তি হবেনা।” গালিবের গজল, শের, কবিতা উর্দু সাহিত্যে তো বটেই বিশ্ব সাহিত্যেও উজ্জল সম্পদ। মোগল শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহের সভা কবি ছিলেন মির্জা গালিব। বাহাদুর শাহ নিজেও একজন কবি ছিলেন। লালকেল্লায় উভয়ের আড্ডা হতো।

১৮৫৭তে দিল্লীর লালকেল্লা ও মোগল বাদশাহের ভাগ্যে  ঘটে চরম পরিনতি। মোগল বাদশাহকে লালকেল্লা থেকে বের করে দেয়া হয়। সঙ্গে মির্জার  জীবনেও নেমে আসে চরম অন্ধকার। অতিশয় দুঃখে,কষ্টে নানা উত্থান পতনে জীবন অতিবাহিত হয়। মদ্যপ, নাস্তিক হিসেবে নানা বদনামও জুটেছে কপালে। চৌসর নামক এক প্রকার বাজী ধরার খেলার অপরাধে ইংরেজ কোর্টে ৬ মাসের জেলও খাটতে হয়েছে তাকে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের চরম একটি ক্্রান্তিকালের প্রত্যক্ষ সাক্ষী মির্জা গালিব। ১৮৫৭ এর দিল্লীর ভয়ংকর হত্যাকা- লুটতরাজ, বাদশাহের নির্বাসন, নিজের ভাগ্য বিপর্যয় সবই ঘটেছে তার চোখের সামনে। সেই বিদ্রোহের দিনগুলোর কথা লিখেছেন তার দিনলিপি ‘দাস্তাম্বু’ গ্রন্থে। পেনশনের জন্য ইংরেজদের দরজায় বারবার আবেদন করেছেন। কলকাতায়ও এসেছিলেন কিছু সাহায্যের জন্যে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন।

সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় যে ,কোনো আঘাতই থেমে যায়নি মির্জা গালিবের লেখনী। দুঃখের ভার সুক্ষ্ম রসিকতায় হালকা করে দিয়েছেন, বিদ্রুপের বাঁকা হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছেন অনেক জটিল সমস্যা। মির্জা গালিবের কাব্যে রসবোধ ও কৌতুক উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এতে তাঁর জীবনের নানা ঘটনা ফুটে উঠেছে। নিবন্ধে মির্জা গালিবের কতিপয় রসাত্মাক কৌতুক উদ্ধৃত করা হল;

(এক) ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে মির্জার একটি কৌতুক। দিল্লীতে ‘রথ’কে কোথাও স্ত্রী লিঙ্গ আবার কোথাও পুং লিঙ্গ বলে। মির্জার এক কাছের বন্ধু এসে জিজ্ঞেস করলেন, মির্জা সাহেব আপনি তো কবি, বলুন তো ‘রথ’ স্ত্রী লিঙ্গ না পুরুষ লিঙ্গ? মির্জা এক ‘শের’ লিখে (পঙতি) উত্তর দেন “জনাব রথে যখন নারী বসা থাকে তখন স্ত্রী লিঙ্গ আর পুরুষ চড়লে পুং লিঙ্গ।”

(দুই) দিল্লীর এক নামী দামী ব্যক্তি ছিলেন দিউয়ান ফজলুল্লাহ খাঁ। মির্জা গালিবের বন্ধু ও ভক্ত তিনি। দিউয়ান সাহেব গাড়িতে করে মির্জার বাসার পাশ দিয়ে একবার আসা যাওয়া করেন। কিন্তু মির্জার সাথে সাক্ষাৎ করেননি। মির্জা দুঃখ পেলেন। চিঠি লিখলেন দেউয়ানজিকে। বলেলন “আজ আমার এতো অনুতাপ হলো যে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশী অযোগ্যতা আমার আর কি হতে পারে যে আপনি আমার বাসার পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করলেন, কিন্তু আমি আপনাকে একবারও সেলাম জানাতে পথে হাজির হতে পারিনি । কি বদ নসিব আমার।” চিঠি পেয়ে দেউয়ানজি খুব লজ্জিত হলেন এবং তৎক্ষণাৎ মির্জা সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন।

(তিন) একবার আমের মৌসুমে মির্জা গালিব লাল কেল্লায় গেলেন। সেখানে বাদশা বাহাদুর শাহ জাফর আম বাগানে পায় চারি করছেন, আর বাগানের পাকা আম দেখছেন। এই বাদশাহী আম বাদশাহী মহল ছাড়া কারো খাওয়ার অধিকার নেই। মির্জা অপলক নেত্রে আমের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাদশাহ বিষয়টি লক্ষ করলেন এবং কৌতুহল ভরে জিগ্যেস করলেন “মির্জা, এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?” মির্জা বিনয়ের সাথে শুধালেন, বাদশাহ নামদার, কোনো এক জ্ঞানী বলে গেছেন “বরসরে হর দানা বনোশতা অয়াঁ/ কায়ী ফঁলা ইবনে ফঁলা ইবনে ফঁলা।” অর্থাৎ শুনেছি প্রতিটি দানায় তার খাদকের এবং তার বাপ দাদার নাম লেখা থাকে। আমি দেখছি কোন আমে আমার ও বাপ দাদার নাম লেখা আছে।” সমজদার মোগল বাদশা একটি শাহী হাসি দিলেন। তারপর ঐ দিনই এক টুকরী শাহী আম গালিবের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। মির্জা বাদশাহকে বহুত শুকরিয়া জানালেন।

(চার) আম নিয়ে আরেকটি কৌতুক। মির্জা গালিবের প্রিয় বন্ধু হাকিম রজিউদ্দিন খাঁ। তিনি আম পছন্দ করতেন না। একদিন দুই বন্ধু দিল্লীর পথে হাটছিলেন। এসময় দুটি গাধা রাস্তা পার হচ্ছিল। গলিতে পড়েছিল আমের খোসা। গাধা দুটি তা না খেয়ে শুধু শুকে ছেড়ে দিল। হাকিম বন্ধুকে ঘায়েল করার সুযোগ পেয়ে বললেন “ দেখেছেন মির্জা সাহেব,আম কি রকম ফল যা গাধারাও খেতে চায় না।” মির্জার তাৎক্ষণিক তীর্যক উত্তর “ঠিকই বলেছেন হাকিম সাহেব, শুধু গাধারাই আম পছন্দ করে না।”

(পাঁচ)একদিন সন্ধ্যার এক কাহিনী। মির্জা গালিবের বন্ধু মির্জা সৈয়দ বাসায় এলেন। কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে বের হন। মির্জা গালিব লন্ঠন নিয়ে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত আসেন- যাতে লন্ঠনের আলোয় সৈয়দ সাহেব জুতো পড়তে পারেন ।

মির্জাকে এগিয়ে আসতে দেখে সৈয়দ সাহেব খুব সংকোচ বোধ করলেন এবং বিনয়ের সঙ্গে বলতে লাগলেন, “ছি: ছি:। আপনি আবার কষ্ট করতে গেলেন কেন? আমি নিজেই জুতো পরে নিতে পারতাম।” মির্জা গালিব অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন, আমি আপনার জুতো দেখানোর জন্যে  লন্ঠন আনিনি। আমি দেখতে এসছি , পাছে আমার নতুন জুতো জোড়াটি যেন চলে না যায়।”
ছয়) ১৮৫৭ সাল।

ইংরেজদের হাতে লাল কেল্লার (রেড ফোর্ট) পতন । কেল্লা থেকে বাদশাহকে ধরে নিয়ে গেছে ইংরেজ বাহিনী। আর দিল্লীতে গৃহবন্দী মির্জা গালিব। দিল্লীর বিশিষ্টদের হত্যা করছে, কাউকে বন্দী করছে গোরা সৈন্যরা। এক ভয়ংকর পরিস্থিতি দিল্লী শহরে। এমন সময় শরগোল আওয়াজ গালিবের মহল্লায়। গোরা সৈন্যরা মির্জা গালিবকে ধরে নিয়ে গেল ক্যাম্পে।

সেখানে ইংরেজ কর্নেল ব্রাউনের কাছে হাজির করা হলো মির্জাকে । তাকে জেরার করার ফাঁকে জিগ্যেস করা হলো, গালিব মুসলমান কিনা। লালকেল্লার সঙ্গে মির্জার পূর্বের যোগাযোগের কারণে তার ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনা। এই জীবন-মরণ সময়েও মির্জা রসিকতার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি কর্নেলের সামনে রসিকতা করে উত্তর দিলেন, ‘মুসলমান, কিন্তু আধা।’ কর্নেল ব্রাউন অবাক, সে আবার কি মুসলমান ? গালিব হাসলেন, বললেন, শরাব পীতা হুঁ , লেকিন শুকুর নঁহী খাতা’। (শরাব পান করি, কিন্তু শুকুর খাইনা। )

ব্রাউনসহ ইংরেজরা হেসে উঠলেন। গালিব ছাড়া পেলেন।
সাত) লালকেল্লার মোগল পরিবারের পতনের পর মির্জা গালিবের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। তছনছ হয়ে যায় গালিবের জীবন। এর পর বাকী জীবন ঋণগ্রস্ত অবস্থায় থাকেন । পেনশন মনজুর করতে তিনি একবার কলকাতায় গভর্নরের কাছেও আসেন। সেখানে দু’বছর থেকেও কোনোকিছু আদায় করতে পারলেন না। মানসিক কষ্ট আর দুশ্চিন্তায় তার শরীর ক্রমশ: ভেঙ্গে পড়ছিল। চোখের ক্ষমতা হ্রাস পায়, দেখা দেয় চর্মরোগ। একপর্যায়ে ওঠাবসার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। কঠিন বিমারি।

এঅবস্থায় অনেকেই চিঠিপত্র দিয়ে মির্জার খোঁজ খবর নিতে থাকেন। মির্জাও চিঠির উত্তর দিতেন। এসব চিঠিতে তিনি রসিকতা করতেন ছাড়েননি। একবার লোহারো থেকে নবাব আলাউদ্দিন খাঁ কবির খোঁজ নিয়ে ছিঠি লিখেন। উত্তরে গালিব রস করে লিখেন, ‘ম্যঁয় জিন্দা হূঁ, লেকিন- নীম মুর্দা।’ তারপর লিখেন, আমার অবস্থা আমার কাছে জানতে চাইছো কেন? এক আধ দিন পর পড়শীদের কাছে জেনে নিও। ( মেরা হাল মুঝসে ক্যায়া পুছতে হো, এক আধ রোজ মেঁ হুমসেয়োসেঁ পুছনা। )

আট) মির্জার আভিজাত্যবোধের একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি । ১৮৪২ সাল। সবেমাত্র দিল্লী কলেজ স্থাপিত হলো। সেখানে ফারসি ভাষার অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হবে। অনেকের অনুরোধে মির্জা নিয়োগ বোর্ডে যাওয়া স্থির করলেন। ভারত সরকারের সেক্রেটারি মি: টমসন পরীক্ষা বোর্ডের সভাপতি। চাকরীর মাসিক মাহিনা একশ টাকা। মির্জা পালকিতে চঁড়ে ভারত সচিবের অফিসের কাছে পৌঁছেন। তারপর তার আগমন জানিয়ে সচিব সাহেবের কাছে খবর পাঠানো হলো। সচিব সাহেব তাৎক্ষণিক মির্জা সাহেবকে বোর্ডে ডাকেন। কিন্তু মির্জা পালকিতে বসেই অপেক্ষা করছেন।

কারণ নিয়মানুযায়ী ভারত সচিব তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসলেই তিনি পালকি থেকে বের হবেন। তখনো মোগল রাজআমল নামে হলেও দিল্লীর কেল্লায় নড়াচড়া করছে। আর তিনি মোগল রাজদরবারের জনপ্রিয় শাহী কবি। আছে আশরাফ মুসলমানদের বাদশাহী কদর। সচিব বের হয়ে আসলেন, কিন্তু অর্ভ্যথনা না জানিয়ে বললেন, “ওয়েল, মির্জা সাহেব, আপনি যখন গভর্নরের দরবারে আসবেন তখন আপনাকে  সেইভাবে স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু এখনতো আপনি চাকরীর জন্যে এসেছেন। সুতরাং এখন সেটা স¤ভব নয়।”

মির্জা সাহেব ভারত সচিবের কথা শুনে মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, সম্মান বেশী পাবার জন্যে অধ্যাপক হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, সম্মান বিক্রির জন্যে আসিনি।” সচিব এবারও বললেন, আমি নিরুপায় মির্জা সাহেব, আপনাকে এ নিয়মই মানতে হবে। মির্জা গালিব বললেন, ‘দুঃখিত সচিব সাহেব, আমিও চললাম। এভাবে চাকরী করতে চাইনা।’  এ বলে মির্জা চলে  এলেন।

রসিক গালিব বেঁচে থাকলে এ লেখাটি পড়ার জন্যে পাঠককে সঙ্গে একটি ইনামের ( বখশিস) ব্যবস্থা করতেন হয়তো। কিন্তু বদ নসীব পাঠকের। মির্জা বহু পূর্বেই মুর্দা। আমি তার চরম আশেক এবং এখনো জিঁন্দা । তারপক্ষ থেকে আমিই একটি বোনাস দিচ্ছি।

আর তাহলো গালিবের একটি ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের গল্প। গালিব ৫০ বছর দিল্লীতে বসবাস করছিলেন । দিল্লী-আগ্রায় মোগলদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের বসবাসের জন্যে একটি বাড়ি কিনেননি। সারা জীবন থেকেছেন ভাড়া করা বাড়িতে। আবার সারা জীবনই শুধু বই পড়েছেন, মজার ব্যাপার হলো জীবনে তিনি একটি বইও কিনেননি। দিল্লীর পুস্তকের দোকান থেকে ভাড়ায় বই এনে পড়ার কাজটি সেরেছেন।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত