| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: কাবিননামা । মোহিত কামাল

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে।

হালকা বাতাসে জানালার পর্দা দুলছে; একবার ভেতরের দিকে উড়ে আসছে, আবার সেঁটে যাচ্ছে গ্রিলের সঙ্গে।

লাইট পোস্টের আলো ঢুকছে অন্ধকার ঘরে। রাতের গভীরতা টের পাওয়া যাচ্ছে না। আলো-অন্ধকারের কোমল এক ঢেউ পর্দার দুলুনির সঙ্গে নড়ছে, মায়ময় আবহ তৈরি হয়ে আছে ঘরের ভেতর।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শরতের আকাশ, ম্লান চাঁদের আলো বুকে নিয়ে পরিচ্ছন্ন আকাশ পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে পুরো জগৎ।

এমনি মায়াবি পরিবেশেও সাবার চোখে ঘুম নেই, চোখ খুলে শুয়ে আছে বিছানায়।

স্তব্ধতা গ্রাস করেছে ওকে। একুশ বছরের দুরন্ত তরুণীটি হঠাৎ পাথর হয়ে গেছে।

সাবার চারপাশ ঐশ্বর্যময়। শিল্পপতির একমাত্র মেয়ের জন্য কারও মমতার ঘাটতি নেই, ভালোবাসার অভাব নেই।

মায়ার জগৎ থেকে হঠাৎ করে সে ছিটকে পড়েছে। নিঃস্ব হয়ে গেছে। তার মনের শান্তি পালিয়ে গেছে। মাথার ওপরে আকাশ ভেঙে পড়েছে, লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে চারপাশ। অথচ বাইরে ঝড়ঝাপটা নেই, উত্তেজনা নেই। কেবল মগ্ন একাকিত্বের শেকড়ে ঘটে যাচ্ছে তাণ্ডব, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের দানবীয় বাতাস ওলটপালট করে দিচ্ছে ওর বর্তমান। ভবিষ্যতের সব কটি সাঁকো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। অতীতের সকল অর্জন মুহূর্তের মাঝে হারিয়ে গেছে।

গত দু দিন ধরে কারও সঙ্গে কথা বলেনি সাবা, একবারের জন্যও বের হয়নি বাসা থেকে, ডায়াল করেনি, কোনও কল রিসিভ করেনি। নিজ ঘরের টেলিফোন সেটটি খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে রেখেছে।

এ মুহূর্তে এত সুন্দর পরিবেশও সহ্য করতে পারছে না। মাথা ঝাঁকি দিয়ে হঠাৎ উঠে জানালার হাতল ধরে সজোরে টান দিল। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল কাচ।

পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন আসিফ চৌধুরী, সাবার বাপি।

মাথায় হাত রেখে পাশে বসলেন তিনি।

বাপির হাতের স্পর্শে জমে গেছে সাবা। শক্ত হয়ে গেছে ওর দেহ-মন।

ওর মনে হলো এটি আদুরে হাত নয়, কোনও এক অবিশ্বাসীর হাত দানবের মতো আঁকড়ে ধরেছে ওকে। ঝট করে মাথাটি টেনে নিয়ে সরে বসল।

শক খেলেন আসিফ চৌধুরী, হাহাকার করে উঠল তার মায়ার জগৎ।

এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। বাপির আদর পেতে মুখিয়ে থাকে সাবা। অথচ দুদিন ধরে বাবাকে সহ্য করতে পারছে না।

অজানা আশঙ্কায় টলে উঠলেন তিনি।

তবে কি টেবিলের ড্রয়ার সাবাই ঘেঁটে দেখেছে? ড্রয়ারটি এলামেলো দেখেছেন তিনি।

নিজ শোবার ঘরে রয়েছে ব্যক্তিগত পড়ার টেবিল। পড়ার ঘরে পারতপক্ষে তিনি পড়েন না। এই টেবিলে তিনি ছাড়া কেউ বসে না, কেউ হাত লাগায় না। টেবিলের ড্রয়ারে একান্ত কিছু কাগজপত্র রয়েছে, কিছু ছবি আছে। সর্বনাশ! ছবি এবং চিঠিগুলো কি তবে সাবা দেখে ফেলেছে!

দু দিন আগে ড্রয়ারটি লক না করে অফিসে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

সাবা তো এই শিক্ষা পায়নি। অন্যের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ঘেঁটে দেখার মানসিকতা তো তার গড়ে ওঠার কথা না। তবে?

কপালে ঘাম জমে গেছে। নিজ রুমে ফিরে এলেন চৌধুরী। ড্রয়ারটি খুলে দেখলেন সবই তো ঠিক আছে। তবে কেউ নেড়েচেড়ে দেখেছে, বুঝতে অসুবিধে হলো না।

সাবার বর্তমান প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ড্রয়ার ঘেঁটে দেখার একটি সম্পর্ক থাকতে পারে ভেবে ভয়ে শিউরে উঠলেন তিনি।

 

দুই

রাতে ঘুম আসেনি আসিফ চৌধুরীর।

একমাত্র মেয়ে সাবা তার সব। স্নেহের যে গোপন স্রোত নিজের মনে বহমান, তার পুরোটি রয়েছে সাবাকে ঘিরে। নিজের আদুরে মেয়ের কাছে ধরা খেলেন? কীভাবে নেবে সে ঘটনাটি? টেনশনে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন কেবল।

রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে সকালে এসেছেন ডাইনিং টেবিলে।

সাবা আগেই এসেছে টেবিলে, চা পান করছে। অন্য কোনও খাবার ছুঁয়ে দেখেনি।

তানজিনা চৌধুরী, সাবার মামণি, কিছু দিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছেন। এখন ভালো। স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন মেয়ের মুখোমুখি চেয়ারে। কিছুই বুঝতে পারছেন না। সবাই একসঙ্গে টেবিলে না এলে কেউ ব্রেকফাস্ট শুরু করে না। এটা এ বাড়ির নিয়ম। আজ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে।

আসিফ চৌধুরী কোনও প্রশ্ন করার সাহস পেলেন না। একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছেন, আর তাকাতে পারেননি। কী করবেন বুঝতে পারছেন না।

চা শেষ করে চট করে উঠে দাঁড়াল সাবা, নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

মেয়ের ভেতর গুমরে ওঠা কষ্টের দাবানল টের পাওয়া যাচ্ছে। চোখে-মুখে শক্ত অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ কেবল তার ব্যক্তিগত বিষয় নয়, পারিবারিক বিপত্তিও জড়িয়ে আছে।

আসিফ চৌধুরী বুঝতে পারলেন স্নেহময়ী কন্যার কষ্টের জন্য তিনিই দায়ী। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। স্তব্ধতার মাঝে ফ্যানের আওয়াজই মুখ্য এখন। শীতল বাতাসেও তার দেহ স্বস্তি পাচ্ছে না। কপালে ঘাম জমে গেছে। মনের ভেতর জট পাকাতে লাগল জীবনের নানামুখী দৃশ্য।

নিজেকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করলেন শিল্পপতি আসিফ চৌধুরী। উন্নতির শীর্ষদেশে রয়েছেন। অর্থ-বিত্ত, সম্মান-প্রতিপত্তি কোনও কিছুর অভাব নেই। একমাত্র কন্যার জন্য আদরের ঘাটতি নেই, স্ত্রীর জন্য ভালোবাসার অভাব নেই, পারিবারিক দায়দায়িত্বের প্রতি কখনও অবহেলা করেছেন বলে মনে পড়ছে না। তবু কেন তিনি জড়িয়ে পড়েছেন মেয়ের সমবয়সী মডেলকন্যা লাইজুর সঙ্গে? অন্য নারীর প্রতি এই আসক্তি কেবলই কি দেহের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর তাগিদ?

শারীরিক ব্যাপারে নিজের স্ত্রীর ইচ্ছের তীব্রতা নেই। অনেক সময় তার আগ্রহ থাকে না। এই অপূর্ণতা কি তাকে লাইজুর দিকে তাড়িত করেছে?

লাইজু অনেক বেশি কৌশলী, দক্ষ। দেহ-মন নেড়েচেড়ে উপভোগ করার সব নিয়ম তার করায়ত্তে। ভেতর থেকে তাই দুর্নিবার ইচ্ছে জেগে উঠলে, ছুটে যান লাইজুর কাছে, সময় কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসেন নিজ ঘরে। ব্যস, আর কিছু নয়।

ভেতরের এই দানবীয় ইচ্ছে কি মানুষের সব মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেয়?

সমাজ এবং ধর্ম তো তাই-ই বলে।

অথচ স্ত্রীর প্রতি দায়বদ্ধতা বিনাশ হয়ে যায়নি, সন্তানের প্রতি বাৎসল্যের বিন্দুমাত্র কমতি হয়নি, নিজের মূল্যবোধের তো কোনও অবক্ষয় তার চোখে ধরা পড়ছে না।

এমন কাজ ঘটিয়ে কি সবাই নিজের কাছে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ভাবে? নিজের অপরাধ কি কখনও নিজের দর্পণে ধরা পড়ে না?

আসলেই কি তিনি ধ্বংস হয়ে গেছেন?

নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন, আশ্বস্ত করার যুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখন। কিছুটা আশ্বাস পাচ্ছেন ভেতর থেকে। মেয়ের কষ্ট সেই আশ্বাসের ভিতটি টলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

অফিসে যাওয়ার জন্য নিজ ঘরে ফিরে এলেন চৌধুরী।

তানজিনা এগিয়ে এলেন সামনে। কিছু একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা উবে গেল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন কেবল।

আসিফ চৌধুরী প্রস্তুত হয়ে স্ত্রীকে একবার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। মুখ ফুটে কোনও কিছু বলতে পারলেন না। কেবল অনুভব করলেন তানজিনাকে এখনও প্রচণ্ড ভালোবাসেন তিনি।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল সাবা। শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়াতে হবে। মার কথা মনে হলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। বেচারি মা-মণি দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়েছে, কিছুই জানেন না তিনি।

এত ভালো বাপি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে, ভাবতে গেলে থরথর করে কেঁপে ওঠে বুক। পৃথিবীর আর কোনও পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় না।

না, কষ্ট ভোগ করে লাভ নেই। বাপিকে ছাড় দেওয়া যাবে না, তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে সরাসরি। মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে মায়ের অধিকারের জন্য।

আকাশি রঙের একটি শাড়ি পরেছে সাবা। কিছুদিন আগে এনেছে ভারত থেকে। সাধারণত শাড়ি পরে বের হয় না। নতুন শাড়িটি আজ সে প্রথম পরল।

মুখে কোনও প্রসাধন নেয়নি। ডার্ক সানগ্লাস পরেছে চোখ। সরাসরি বাপির মুখ দেখতে হবে, প্রতিক্রিয়া বুঝতে হবে। সানগ্লাসের এ এক বাড়তি সুবিধা, অন্যকে দেখা যাবে, নিজের চোখ দেখবে না কেউ।

নিজের মনে জেগে উঠেছে বেপরোয়া এক শক্তি। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছে সে। গাড়ির উইন্ড শিল্ডের ভেতর থেকে বাপির দোতলা অফিসের দিকে চোখ তুলে তাকাল একবার। এ অফিসটিকে আজ আপন মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে অচেনা কোনও অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে।

গাড়ি থেকে নেমে সাবা দ্রুত চলে এসেছে সিঁড়ির কাছে। পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার অনিন্দ্যসুন্দরী সাবাকে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে দুর্বিনীত নারী, যে কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে একবারও সে টলে যাবে না। প্রয়োজনে যে কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে দেবে, পিছপা হবে না।

দোতলার বিশাল হলঘর জুড়ে অফিস। কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে স্বচ্ছ গ্লাসে ঘেরা ছোট ছোট কিউবিকলস। পশ্চিম অংশ জুড়ে রয়েছে আগাগোড়া টিনটেড গ্লাসে ঘেরা বড় একটি কক্ষ। এটিই চেয়ারম্যানের কক্ষ। এখানে বসেন আসিফ চৌধুরী।

হল ঘরে ঢোকামাত্রাই বাপির ঘরের দরজায় চোখ গেল ওর। লালবাতি জ্বলছে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে কক্ষে ঢোকার অনুমতি নেই কারও।

সাবা উদ্ধত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। কোনও দিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। সরাসরি স্লাইডিং ডোরে হাত লাগিয়ে, একটানে খুলে ফেলল। লালবাতি জ্বললেও দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল না। সহজে সে ঢুকে গেল ভেতরে।

রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে উঁচু মাথায় বিষাক্ত এক বুলেটদৃশ্য আঘাত হানল। মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে গেল সাবা।

রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন আসিফ চৌধুরী। পাশে অন্য একটি চেয়ারে নিবিড় সান্নিধ্যে বসে আছে সেই মেয়েটি, যাকে ছবিতে দেখেছে বাপির কণ্ঠলগ্ন। মেয়েটির পরনে হালকা নীল রঙের সেই শাড়ি, যেটি ভারত থেকে সাবা এনেছিল বাপির অনুরোধে। তিনি ফরমায়েশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তার এক বন্ধুর মেয়েকে গিফট দেবেন।

এই কি তবে বাপির সেই কথিত বন্ধুর মেয়ে? এর সঙ্গেই তবে বাপির গোপন সম্পর্ক?

এই অবিশ্বাস্য ঘটনা তাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে, অবিশ্বাস করার আর তো কোনও উপায় নেই।

ভেতর থেকে বুকফাটা আর্তচিৎকার জেগে উঠল। বাইরে ধ্বনিটি প্রতিধ্বনিত হয়নি, নিজের মাঝে গুমরে উঠে থেমে গেল।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হলো সাবা। এক পা পিছিয়ে, ঘুরে দাঁড়াল ফিরে যাওয়ার জন্য।

মামণি, কেন এসেছো? টাকা লাগবে? বিপর্যস্ত আসিফ চৌধুরী কিছু একটা বলতে পেরেছেন। তার কথা জড়িয়ে গেছে। বুকের ভেতর ধড়াস করে আঘাত হেনেছে পারমাণবিক বোমা।

ঝড়ের বেগে এসেছিল সাবা, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে দক্ষতার সঙ্গে। বাপির কণ্ঠ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, বাপির দিকে নয়, মেয়েটির দিকে। চোখে সানগ্লাস না থাকলে সেই দৃষ্টিবাণে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেত মেয়েটি। কপালে শিরা ফুঁসে উঠেছে, চোখ-মুখ থেকে বেরুচ্ছে অগ্নিলাভা।

মায়ের পরাজয় নিজের চোখে দেখতে হয়েছে, বাপিকে নিয়ে যে দুর্মর অহঙ্কার ছিল, সেই মহান স্তম্ভটিও গুঁড়িয়ে গেল।

বাপির পদস্খলন মানে সন্তানেরও পরাজয় নয়?

ছোটবেলা থেকে পরাজিত হতে শেখেনি সাবা। বর্তমান পরাজয় তাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে, বেপরোয়া এক আগ্রাসী ড্রাইভ অঙ্কুরিত হয়ে গেছে নিজের মনে।

 

তিন

নিজের ঘরে নিশ্চল বসে আছে সাবা।

মেয়ের বর্তমান প্রতিক্রিয়া দেখে মামণি দিশেহারা। তাকে কিছু বলা যাচ্ছে না। বান্ধবীদের কাছেও মুখ খোলা সম্ভব নয়। নিকট আত্মীয় কারও কাছেও বিষয়টি শেয়ার করা যাচ্ছে না।

একা একা কষ্ট আর সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ধীরে ধীরে এই যন্ত্রণাটা হিংসাত্মক মারণান্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। বাপিকে শাস্তি পেতেই হবে। এই অবিশ্বাসের সাজা থেকে বাপিকে রেহাই দেওয়ার আর কোনও উপায় এখন হাতে নেই।

কলবেলের শব্দে হঠাৎ চমকে উঠে নড়ে বসল সাবা।

বুয়া দরজা খুলে দিয়েছে। ঘরে ঢুকেছে ওদের গাঁয়ের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়, ছিপছিপে লম্বা। কিছু দিন আগে ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটির নাম অনিকেত আহমেদ।

ছেলেটিকে দেখে উঠে পড়ল সাবা। নিজের ঘর থেকে ফিরে এল বসার ঘরে। মাথায় চট করে এক বুদ্ধি এসে গেল।

ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে হেসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। হাসি আসছে না। কঠিন ভাষায় বলল,

বাপির কাছে এসেছেন?

জি।

এনি প্রবলেম?

জি। চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসিফ কাকা আসতে বলেছিলেন।

গরিব আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি বাপির দরদের অভাব নেই, ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে সাবা। হয়তো গ্রামের এই শিক্ষিত অথচ দরিদ্র সম্পর্কের ভাতিজাটিকেও তিনি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। এ সুযোগ বাপিকে দেওয়া যায় না। বরং একে দিয়ে বাপিকে আঘাত হানতে হবে।

কত টাকার চাকরি দরকার?

জি?

কানে শুনতে পাচ্ছেন না? বলছি কত টাকার চাকরি হলে চলবে? ধমকের সুরে বলল সাবা।

অনিকেত চুপ করে আছে, হঠাৎ বেপরোয়া প্রশ্নবাণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। জবাব দেওয়ারই বা কী আছে।

সাবা উঠে দাঁড়াল। সামনে এসে মুখোমুখি হলো। অনিকেতও দাঁড়িয়ে গেছে। শুনুন, আমার একটা উপকার করতে হবে। যত টাকা প্রয়োজন দেব। কথার বরখেলাপ করতে পারবেন না।

সাবার মুখের ওপর প্রশ্ন করা যায় না, জানে অনিকেত। বড় লোকের আদরের দুলালি, সবার প্রিয়, যখন যা চায়, তাই-ই পায়। যা ইচ্ছে করবে, কেউ বাধা দেবে না। তবে সীমা লঙ্ঘন করে না। ভদ্র সুবোধ লক্ষ্মী মেয়ে হিসেবে শহর জুড়ে সবাই চেনে। অসংখ্য তরুণের হার্টথ্রব। গানে, আবৃত্তিতে, পড়ালেখায় অলরাউন্ডার

নীরবে দাঁড়িয়ে আছে অনিকেত।

বলুন, উপকার করবেন? সাবার কণ্ঠে অস্থিরতা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দেবে না, বুঝতে আর বাকি থাকল না অনিকেতের।

কী উপকার? কাঁপা স্বরে জানতে চায় অনিকেত।

আমাকে বিয়ে করতে হবে। সাবার সরাসরি জবাব।

কী বললেন! বিস্ময় নিয়ে সাবার মুখের দিকে তাকাল অনিকেত।

এতে বিস্ময়ের কী আছে? বলছি বিয়ে করতে হবে আমাকে। শর্ত একটা, আমার শরীর পাবেন না। বিছানায় জায়গা পাবেন না আমার সঙ্গে। এই বিয়ের চুক্তি তিন মাসের জন্য বলবৎ থাকবে, কাগজে-কলমে বিয়ে হবে আমাদের। বউ সেজে আপনার গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। তিন মাস পর বিয়ের চুক্তি শেষ হবে। তিন লাখ টাকা দেব। রাজি?

অনিকেত হঠাৎ ঘূর্ণায়মান এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেল। সাবার অপরিণামদর্শী বেপরোয়া ইচ্ছের কাছে আত্মসমর্পণ করলে কাকার সঙ্গে কি বেঈমানি হবে না?

এবার সাবা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রায় চিৎকার দিয়ে বলল,

কী, রাজি তো?

অনিকেত ওর মুখের দিকে সরাসরি তাকাল। অদ্ভুত সুন্দর লাবণ্যময়ী মেয়েটির মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে। উপকার করার মাঝে দোষের কিছু  দেখতে পাচ্ছে না সে।

আমার সম্মতিতে যদি আপনার কোনও উপকার হয়, উপকার করতে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হব না। রাজি আছি। তবে বিনিময়ে টাকার কোনও প্রয়োজন নেই। কেবল আনুষঙ্গিক খরচ দিলে চলবে।

 

চার

সাবা বউ সেজে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।

অনিকেতের আত্মীয়স্বজন মহাখুশি। বউ সেজে খাটে বসে আছে সাবা। এটা গ্রামের রীতি। অনিকেতও শর্ত দিয়েছে, গ্রামের রীতি ভঙ্গ করা যাবে না। গ্রামের অসংখ্য মানুষ আসছে। ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েটিকে অনিকেত কীভাবে জয় করল এটাই আলোচনার মুখ্য বিষয়। ভেতরের রহস্য জানে না কেউ। অনিকেতও দূর থেকে লুকিয়ে চুকিয়ে বউটিকে দেখে। কাগুজে বউ হলেও বুকের ভেতর চিনচিন একটা কষ্ট টের পায়। এই কষ্টই কি তবে নারীর জন্য পুরুষের ভালোবাসা? চোখে পানি চলে এল। একটু পর নিজেকে সামলে নেয়। ধনীর দুলালির বেহিসাবি সিদ্ধান্তের শিকার সে।

এই সিদ্ধান্তের জন্য মূল্য দিতে হবে তাকে, গ্রামের নিরীহ জনগণও কম কষ্ট পাবে না, বুঝতে অসুবিধে হলো না অনিকেতের।

সাবা ক্রমশ জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের জেদ কমে গেছে। অন্য রকম কষ্ট টের পাচ্ছে।

মামণির জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে। বাপিকে সাজা দেওয়ার জন্য এত সব কাণ্ড, তার জন্যেও কষ্ট হচ্ছে।

এত ভালো বাপি, এত সুন্দর সংসার। এমন হলো কেন?

অনেক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছোটবেলা থেকে সে ছিল সবার আদরের নয়নমণি, বাপির বুকের মানিক। সেই বাপির এমন রূপ! বুক ভেঙে কান্নার প্লাবন ছুটে বেরিয়ে এল, সামাল দেওয়া যাচ্ছে না আর যন্ত্রণা।

সাদের কথা মনে পড়ছে। বাপির বন্ধু শিল্পপতির ছেলে সাদ। অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট, হ্যান্ডসাম। ফ্লোরিডায় আছে, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করছে। এক মাস আগে ওর সঙ্গে ঘটা করে এনগেজমেন্ট হয়েছে সাবার।

টেলিফোনে প্রায় প্রতি রাতে আলাপ হতো। একটু একটু ভালোবাসা জাগছিল সাদের জন্য। ওর ভরাট কণ্ঠ শোনার জন্য মন ব্যাকুল থাকত।

এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবারের জন্যেও কেন সাদের কথা মনে হয়নি? এখন কেন মনে পড়ছে? এখন কেন ওর কণ্ঠ শোনার জন্য মন ব্যাকুল হচ্ছে। ঘটনাটা কীভাবে বিচার করবে সাদ? সে কি মেনে নেবে? আবেগ এতটুকু আচ্ছন্ন করেছিল কেন? কেন নিয়ন্ত্রিত আবেগ এবং বুদ্ধি দিয়ে একবারও পরিস্থিতি বিচার করতে পারেনি সে?

বুকের কোনও এক অচিন প্রান্তর থেকে কান্না ধেয়ে আসছে। সবাই সরে যাওয়ার পর বালিশ বুকে চেপে হুহু করে কাঁদতে লাগল সাবা। রাত প্রায় নটা। ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে গেছে। ঘুমের অতলে ডুবে গেছে।

গ্রামের বাড়ি হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। একসময় অনিকেতদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, দেখে তাই-ই মনে হচ্ছে।

একশো পাওয়ারের বাল্ব জলছে ঘরে। সাবার মুখে আলো পড়ছে। কী মায়াবি মুখ। ফোলা ফোলা লালচে ঠোঁট। দেহ জুড়ে আলুথালু ভঙ্গি, চুল অবিন্যস্ত। নিবিড় চোখে মায়াবি মুখটির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে অনিকেত।

আকস্মিক এই বিয়ের পেছনের রহস্য এখনও জানে না সে। শুধু এটুকু জানে, কাগজের বিয়ে হলেও আইনসিদ্ধ বিয়ে হয়েছে। সাবার নির্দেশে বিয়ের কাবিননামা ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আপাতত নিজের বউ সাবা। বউ হলেও ওর ভালোবাসা পাওয়া যাবে না কোনও দিন, ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যও না সে। এ যে আকাশকুসুম কল্পনা।

বাস্তবতার কারণে কল্পনাটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিতে ইচ্ছে করছে মেয়েটিকে। ভালোবাসার বিনিময়ে সম্ভব না হলে ছলে-বলে-কৌশলে কি অগ্রসর হবে? স্বামী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেবে কি?

ওদের বাড়ি থেকে একবারও পাল্টা আঘাত এল না কেন? কোন রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি এখন সে নিজে!

বুকের ভেতর মায়াবোধ ঘনীভূত হচ্ছে। এই মায়ার ভেতর তো কোনও ভণ্ডামি নেই, ভাবতে লাগল অনিকেত। তবে কি সত্যিই সে সাবাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?

সাহসী অভিপ্রায় জেগে উঠছে অনিকেতের মনে। প্রয়োজনে ওকে পাওয়ার জন্য চুক্তি বাতিলের ষড়যন্ত্র করবে, সাবাকে আপন করে পেতেই হবে।

 

পাঁচ

প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে।

অনিকেত পারতপক্ষে সাবার মুখোমুখি হয় না। রাতে সাবার ঘরে মেঝেতে বিছানা করে শোয়।

প্রতি রাতে শোয়ার পূর্বে এক গ্লাস দুধ পান করে সাবা। যথাসময়ে সে দুধের গ্লাস সাবার টেবিলে রেখে আসে। তেমন কোনও কথা হয় না দুজনার।

সাবা খাটে বসে আছে। আজও দুধের গ্লাস নিয়ে অনিকেত ঘরে ঢুকল। মাথা ওর নিচের দিকে। গ্লাসটা টেবিলে রাখার জন্য এগিয়ে গেল।

সাবা এই প্রথম অনিকেতের মুখের দিকে তাকাল। সুবোধ তরুণটির প্রতি বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে। একটুও অশোভন আচরণ করেনি। নত মুখটির দিকে তাকাতে গিয়ে চট করে মায়া জেগে উঠল ওর মনে।

হাত বাড়িয়ে সাবা বলল, দিন, গ্লাসটি এদিকে দিন।

অনিকেত চোখ তুলে তাকাল। মুহূর্তের মাঝে চোখাচোখি হলো দুজনার। বেপরোয়া ভালোবাসা বিদ্যুৎ গতিতে সঞ্চারিত হয়ে গেল অনিকেতের মনে।

এক চুমুকে গ্লাস শেষ করল সাবা। দুধের স্বাদ কেমন বিদঘুটে লাগল। অনিকেতকে অবিশ্বাসের কিছুই টের পেল না। একটু পর চোখ জুড়ে অপ্রতিরোধ্য ঘুমের স্রোত নেমে এল। ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল সে।

বাইরে থই থই জোছনা। উথালপাতাল জোছনা কি ভালোবাসার মশাল উসকে দিচ্ছে অনিকেতের মনে?

ঘরের লাইট বন্ধ করে দিয়েছে অনিকেত। ঘরেও প্লাবিত জোছনার নরম আলো ঢুকে পড়েছে।

রাত ক্রমশ গভীর হয়ে আসছে।

অনিকেত কোনও ক্ষতি চায় না সাবার। নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখল, নিজের অস্তিত্বে ঘুরপাক খাচ্ছে সাবার জন্য দুর্নিবার ভালোবাসা, ভালোলাগা। দেহ নয় কেবল, পুরো সাবাকেই চায় সে।

চাঁদের মাতাল আলো বুকের কবাট খুলে দিয়েছে। শুদ্ধতা নিয়ে ও হাত বাড়াল সাবার দিকে।

কোনও এক অচিন সমুদ্রে ডুবে ছিল সাবা।

হঠাৎ মোচড় দিয়ে জেগে উঠল শরীর। মন এখনও অন্ধকার গলিতে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। পথের সন্ধান পাচ্ছে না।

বুকের ওপর বিশাল এক পাহাড় চেপে বসেছে। তলপেট থেকে চিনচিনে হালকা একটা ব্যথা পুরো দেহে ছড়িয়ে যাচ্ছে। গলায়, ঠোঁটে এবং পুরো শরীরে পিচ্ছিল স্পর্শ টের পাওয়া যাচ্ছে।

সে কি স্বপ্ন দেখছে? কোনও অজগর কি জড়িয়ে ধরেছে?

একবার দেহ ঘোরানোর চেষ্টা করল, নিজেকে একটুও টলাতে পারল না। মনে হলো খাটের সঙ্গে কেউ তাকে গেঁথে রেখেছে।

মন এবার জেগে গেল।

মাথা ওপরের দিকে উঠানোর চেষ্টা করল, বুঝতে অসুবিধে হলো না, ভারী একটা কিছু হামাগুড়ি দিয়ে নেমে গেল শরীর থেকে।

চোখ খুলতে চাইছে, পারছে না খুলতে।

পুরো জগৎ কি ফাঁপা হয়ে গেছে? সে কি বাতাসে ভেসে রয়েছে? নিজের অস্তিত্ব কেন টের পাওয়া যাচ্ছে না?

প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি দিয়ে চোখ খুলে ফেলল সাবা। বাইরের ভরাট জোছনার নরম আলো ঘরে ঢুকছে। কোমল আলোয় দেখল উলঙ্গ অনিকেত দ্রুত কাপড় পরে নিচ্ছে।

নিজ দেহের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেল সে। উদোম শরীর। এক ফোঁটা কাপড় নেই দেহে।

তবে কি দুধের সঙ্গে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দিয়েছিল অনিকেত? পাশবিক ইচ্ছে মিটিয়ে নেওয়াই কি ছিল তার আসল উদ্দেশ্য?

সাবার বুঝতে বাকি থাকল না, নারীত্বের অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে। অনিকেত নামক পুরুষটি সব লুটে নিয়েছে।

পুরুষ শব্দটি মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে জীবনীশক্তি নিঃশেষ হতে লাগল। প্রিয় বাপিও তো পুরুষ। সেও তো অন্য তরুণীর সবকিছু লুট করে নিচ্ছে। অনিকেত আর বাপির মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

পার্থক্য নেই। ওরা এক। ওরা পুরুষ।

ভাবতে ভাবতে জ্ঞান হারাল সাবা, লুটিয়ে পড়ল খাটের ওপর।

 

ছয়

পরদিন নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছে সাবা।

আসার পূর্ব মুহূর্তে অনিকেতের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল। ওই চোখে কোনও পাপের চিহ্ন দেখেনি সে। দেখেছে তাকে ধরে রাখার তীব্র আকুলতা। ওকে ধর্ষণকারী মনে হয়নি। কেবলই মনে হয়েছে ওই যুবকটি একজন পুরুষ। পুরুষ পারে না, হেন কাজ নেই পৃথিবীতে। ওদেরকে বিশ্বাস করার কোনও গাঁথুনি নেই জগতে। বিশ্বাসের আলো ছড়িয়ে চারপাশের ছায়ার ভেতর ওরা অবিশ্বাসী খেলায় মেতে থাকতে পারে। বিশ্বাসহীনতাই পুরুষের ভালোবাসার প্রধান হাতিয়ার।

সাবাদের বাড়িতে এতদিন ছিল কবরের নির্জনতা। চারপাশ আবার নড়েচেড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে আসছে বাড়িতে, ঝি-চাকরদের মাঝে।

তানজিনা চৌধুরী আশ্বস্ত হয়েছেন। মেয়ে ভুল করেছিল। ভুল উপলব্ধি করেছে। শুধরে নেবে আবার সেই ভুল। আবার শুরু হবে নতুন জীবন। এ বোধ তাকে চাঙ্গা করে তুলল।

আসিফ চৌধুরী মেয়ের সামনে যেতে পারছেন না। স্নেহের বুভুক্ষায় কাতর হয়ে গেছেন। অপরাধের ভারে ন্যুব্জপ্রায়। দূর থেকে একবার দেখে এসেছেন সাবাকে। এ যেন সাবা নয়, অন্য কোনও নারী। বয়স অনেক বেড়ে গেছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না।

ফ্লোরিডা থেকে সাদ কয়েকবার ফোন করেছে, ফোন ধরেনি সাবা। মামণি এসে তদবির করেছেন ফোন ধরার জন্য, কোনও লাভ হয়নি।

নিজ ঘরের ল্যান্ড টেলিফোন সেটও তুলে রেখেছে সাবা।

বান্ধবীরা আসে, ফিরে যায়। কারও সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে হয় না। কেউ প্রশ্ন করলে বিরক্ত হয়। বুয়ারা খুশি হলেও এখনও বাড়িটি শ্মশানে পরিণত হয়ে আছে। বাড়ির আনন্দ, বাড়ির স্নেহ-মুখ মৃত লাশ হয়ে পড়ে আছে আলাদা এক কক্ষে।

 

সাত

সাবার ঘরের জানালার পাশে রয়েছে তিনটি ঝুলন্ত ফুলের টব। প্রতিটি টবে একটা করে লাল গোলাপ ফুটেছে।

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সাবা। হালকা বাতাস বইছে, শীতল বাতাস। নিজের ভেতর শিরশির অনুভূতি টের পেল। গোলাপ দেখে মনে জেগে উঠছে ভালোলাগা, স্বস্তি।

এর মধ্যে মাস পেরিয়ে গেছে, মাসিক হচ্ছে না। প্রায় পনেরো দিন ওভারডিউ। সকালবেলা মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে, বমি বমি ভাব হয়, বমি হয় না, টক খেতে ইচ্ছে করে।

তবে কি ‘কনসিভ’ করে ফেলেছে সে? সমগ্র চেতনা জুড়ে আলাদা অস্তিত্ব টের পেতে লাগল।

গহিন ভেতর থেকে কেউ কি স্পর্শ করছে? ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে?

চোখ বুজলেই ফুটফুটে এক গোলাপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে, হাসে। মিটমিট করে চেয়ে থাকে।

আলোকিত সত্য জেগে উঠছে। চেতনার গভীর থেকে অনাগত শিশুর মায়াবি আহ্বান বুঝিয়ে দিচ্ছে সব। ডাকছে, মামণি আমায় ফেলে দিয়ো না, কোলে তুলে নাও।

একটা ঝাঁকি খেয়ে জানালার পাশ থেকে সরে দাঁড়াল সাবা।

ধর্ষিতা সে, নষ্টা মেয়ে।

আসলেই কি নষ্ট হয়ে গেছে? আসলেই কি ধর্ষিতা?

ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনতা কি নষ্ট উপাধি থেকে রেহাই দেবে না ওকে?

মাসিক নিয়ন্ত্রণের পথে কি এগোতে হবে? এমআর করাতে হবে?

না। শক্ত অনুভব চেতনার স্তরে জমাট বাঁধছে। শক্তি সঞ্চার করছে, মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নিজেকে নষ্ট ভাবতে পারছে না, খারাপ ভাবতে পারছে না। নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে। নিজের অস্তিত্বের মাঝে বড় হচ্ছে আর একটি প্রাণ, আর একটি অস্তিত্ব। আপন রক্ত থেকে পুষ্টি নিয়ে, অক্সিজেন নিয়ে বেড়ে উঠছে নতুন কলি, সগৌরবে এগিয়ে আসছে।

ঐশ্বরিক মায়ার স্রোতে ক্রমশ ভেসে যেতে লাগল সাবা।

সেও তো তার বাপির সন্তান। মায়ের সন্তান। তাদের ভেতরও কি স্নেহের এমনি ধারা বহমান নয়?

অন্য নারীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক কি বাবার মন থেকে সন্তানের জন্য মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে দেয়? অপূর্ণ কোনও চাহিদা কি পরনারীর প্রতি বাপির আসক্তির প্রধান কারণ? মামণির জন্য ভালোবাসার ঘাটতির অন্য কোনও প্রমাণ তো হাতে নেই।

এ কোন নিয়তির খেলা। নিয়তির কী গভীর টানে যেতে হয়েছিল বাপির টেবিলের ড্রয়ারের কাছে? কেন সে কৌতূহলী হয়েছিল ড্রয়ার ঘেঁটে দেখার জন্য। কেন সে বিয়ে করতে গেল অনিকেতকে? কোনও এক ঐশ্বরিক গোপন চালে কি তবে নিয়ন্ত্রিত হয় মানব-মন?

বিক্ষিপ্ত চিন্তা মগজে আঘাত হানছে। দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বিছানায় এসে শুয়ে থাকল সাবা।

 

আট

খুব ভোরে একটা অফ হোয়াইট টয়োটা এসে দাঁড়িয়েছে অনিকেতদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া বড় সড়কের ওপর।

অবাক বিস্ময়ে অনেকে দেখল, সাবা নেমে আসছে গাড়ি থেকে। লাল শাড়ি পরেছে, সুবিন্যস্ত বাঁধানো চুল। এগিয়ে আসছে সে বাড়ির দিকে।

শোরগোল শুনে অনিকেত বেরিয়ে আসে, এগিয়ে যায় সামনে।

সাবাও এগিয়ে আসছে। মুখোমুখি দাঁড়াল দুজনে।

হাতব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করল সাবা। অনিকেতের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,

এই নিন আপনার বিয়ের কাবিননামা।

চুক্তি কি শেষ হয়েছে? ম্লান মুখে প্রশ্ন করে অনিকেত।

না, চুক্তি শুরু হয়েছে।

মানে?

মানে খুব সোজা। আমি ফিরে এসেছি।

আমার কাছে? অনিকেতের বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি।

না, আপনার কাছে নয়। আমি ফিরে এসেছি নিজের অস্তিত্বের ভেতর বেড়ে ওঠা অনাগত শিশুর শেকড়ের সন্ধানে। আমাদের সন্তানের যাত্রা শুরু হবে এই বাড়ি থেকে, সবুজ ধান আর মাটির গন্ধ নিয়ে বেড়ে উঠবে সে।

কথা শেষ করে সাবা নিবিড় চোখে তাকিয়ে থাকল অনিকেতের দিকে। একটুও বিরক্তি নেই, রাগ নেই ওই চোখে।

মায়ার শেকড় কি আসন গেড়ে নিল বুকের গহিনে?

অনিকেত বিহ্বল। ভোরের নরম রোদেও টের পাচ্ছে না নতুন দিনের শুরু হয়েছে। সেই রাতের মাতাল জোছনার জোয়ার ধেয়ে এসেছে আবার তাদের গাঁয়ে। অনিকেত হাত বাড়াল কাবিননামাটির দিকে। আলতো করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল ফাইলটি। তার শুদ্ধ মন পূর্ণ হয়েছে ভালোবাসায়। এই পূর্ণতায় নিজের মনে খাদ নেই। এর চেয়ে শুদ্ধতাও আর নেই পৃথিবীতে। কাবিননামাটিকেই মনে হলো শুদ্ধতম আলোর উৎস। নিজের বিরাট অপরাধটি ভেসে গেল প্রকৃতির কোনও এক গোপন টানে। এ টানের উৎস কোথায়? শুদ্ধ কাবিননামা? নিজেকেই প্রশ্ন করল অনিকেত।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত