পাঠপ্রতিক্রিয়া: ঋণ শোধের উপাখ্যান । রুমা মোদক
অমর মিত্রের ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’ উপন্যাসের আকড়ে এক মহাকাব্য। উপকথা=উপকাহিনীতে এর অবয়ব বৃহদাকার মহাকাব্যের কাছাকাছি। এই উপন্যাস পাঠে একটা বিষয় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে এটি পড়ার জন্য পাঠকের যে বিশাল প্রস্তুতি, ধৈর্য ও শ্রম দরকার, লেখক এটি লিখতে এর চেয়ে ঢের বেশি প্রস্তুতি, ধৈর্য ও শ্রম দিয়েছেন।
পুরাণ, উপকথা, লোকগাথা নিয়ে নিরীক্ষা অমর মিত্রের ঔপন্যাসিক প্রবণতা। অশ্বচরিত, ধ্রুবপুত্রে যার সাক্ষ্য আমরা পূর্বেই পেয়েছি। মোমেনশাহী উপাখ্যানে সেই নিরীক্ষা আরো পরিণত, গভীর ও মর্মস্পর্শী। নিপুন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এক উপন্যাসে কয়েকশ বছরকে বন্দী করা, পাত্র-পাত্রী, ঘটনা-প্রবাহ কে মিথ থেকে লোকগাথা এবং আধুনিক রাজনীতির সাথে সংশ্লেষ উপন্যাসটিকে মূলত ক্লাসিক মাত্রা দিয়েছে।
উপন্যাসটির শুরু একজন বিপুল সোমের দু’কামড়ার ফ্ল্যাটে স্থায়ী আবাসন গড়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। বিপুল সোমের এই নিজ গৃহ-প্রবেশ একটি বিশেষ ঘটনা বটে। এটি তার নিজস্ব বাড়ি। ‘বাড়ি’ মানে চৌচালা ঘর, এক টুকরো উঠান, প্রবেশদ্বার ঘিরে মধুমঞ্জরীর ঝোঁপ নয়। দু’কামরার ফ্ল্যাট। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় এটিই বাড়ি। উল্লম্ব বস্তি। এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাঁর জীবনের কত উত্থান-পতন। এই উত্থান-পতনই তাঁর গৃহ প্রবেশের ঘটনাটিকে বিশেষ করে দেয়।
যে বিপুল সোম কে দিয়ে উপন্যাসের শুরু, লেখক তাতে আর সীমাবদ্ধ থাকেন না। ছড়িয়ে যান আরো অনেক চরিত্রে, ঘটনায়। যার কিছু মিথোলজিক্যাল, কিছু সাম্প্রতিক। উপন্যাসটির তিনটি ধাপ, ১) পাতাল অন্ধকার বৃত্তান্ত। ২) লীলাবতী, খবরিয়া ও আয়না বিবির বৃত্তান্ত। ৩) বুনো হাসেঁর উড়াল।
এই তিনটি পর্বের নামকরণ ও শুধু নামের জন্য নাম দেয়া নয়। বরং প্রতিটি পর্বে তিনি কি বলবেন তার একটি সুচিন্তিত ইঙ্গিত রেখে যেতে চান। পাঠক প্রতিক্রিয়া পাঠ শেষ করে হয়তো নাম-মাহাত্ম্যের স্বরুপ আবিষ্কার করেন।
প্রথম পর্বে বিপুলের সাথে ভ্রমণে সহযাত্রী হয়ে আমাদের পরিচয় হয় বিপুলের জ্ঞাতি ভাই সুধীন্দ্র সোমের সাথে। তিনি লিখছেন নেত্রকোণার কবি অধরচন্দ্রের জীবনীভিত্তিক উপন্যাস। তিনটি আখ্যান এখানে এসে সমান্তরালে দাঁড়িয়ে যায়। বিপুলের আত্মজা কাজলরেখা, সুধীন্দ্রের স্ত্রী কুমুদিনী ইত্যাদি নাম আমাদের সযত্নে নিয়ে যায় ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে অনতিদূরে আন্দোলন-বিদ্রোহের ইতিহাসে, কমলা রানীর দীঘির লোকগাথা কী অদ্ভুত কৌশলে কনটেম্পোরারি পরিবেশ বিপন্নতায় আমাদের সচকিত করে তোলে, সুধীন্দ্র পুকুর ভরাট করা নিয়ে যখন প্রমোটারের সাথে বিবাদে জড়ায়, আমরা হঠাৎ সচকিত হয়ে আবিষ্কার করি কী সুনিপুণ কৌশলে অমর মিত্র লোককথায় কমলার তলদেশে হারিয়ে যাওয়ায় বেদনাকে আমাদের জলাশয় হারানোর বেদনার সাথে এক করে দেন।
দ্বিতীয় পর্বে শেকড়ের সন্ধানে বিপুলের নেত্রকোণা যাত্রা, আর তার সূত্র ধরে হাজং বিদ্রোহ, হাতিখেদা, বিদ্রোহ, টঙ্কঁ বিদ্রোহ ইত্যাদি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকগুলিকে জুড়ে দেয়ার অসাধারণ কৌশল, পাঠক টের পান না কখন সে এক শেকড় খোঁজায় অন্বেষণের সহযাত্রী হয়ে ঢুকে পড়েন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। এ লেখক অমর মিত্রের অসাধারন এক দক্ষতা।
৩য় পর্বে আমরা দেখা পাই কিছু বিদ্রোহী নেতার, যাদের তিনি বলতে চান বুনো হাঁস। তাই এ পর্বের নাম বুনো হাঁসের উড়াল। সেই বুনো হাঁসেরা গ্রাম-গ্রামান্তরে উড়াল দেন মানুষের মুক্তির সন্ধানে।
‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’ উপন্যাসের শুরুতে অবশ্য লেখক জানিয়েছিলেন ময়মনসিংহ গীতিকা আখ্যান সামান্য সূত্র মাত্র। তিনটি পর্বের প্রতিটিতেই তিনি সেই আখ্যানের বাইরের জীবনকেই আশ্রয় করেছেন। ময়মনসিংহ বা গারো পাহাড়ের দেশের বাইরের জীবনের উত্থা-পতন, নানা চরিত্রদের তিনি সন্নিবেশিত করেছেন প্রাসঙ্গিঁকতায়। মোমেনশাহী উপাখ্যান হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ময়মনসিংহের কয়েকশ বছরের ইতিবৃত্ত। অনন্য হয়ে উঠেছে নবতর ব্যাখ্যায়। এই নবতর ব্যাখ্যাই মোমেনশাহী উপাখ্যানকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে।
মূলত দীনেশচন্দ্র সেন যে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেছিলেন। পিতার সূত্রে মর মিত্র ও যেন এ কালের একজন সংগ্রাহক। তিনি নিজেই বলেন, ঋণ সালিশী বোর্ডের শুনানি করে তিনি ঘুরে বেড়াতেন ময়মনসিংহ জেলার গ্রামে গ্রামে। ৪৩ এর মন্বন্তরের কথা, ঋণগ্রস্থ কৃষকদের কথা তিনি বাবা-মার কাছে শুনেছেন। উপন্যাসের বিপুল যে ফিরে আসে নেত্রকোনায়, এ যেন লেখক অমর মিত্রের প্রত্যাবর্তন। আর আছে চাঁদু খবরিয়া। দুজনের সমান্তরাল অভিজ্ঞতায় আমরা পুরো উপন্যাসে আবিষ্কার করতে থাকি ময়মনসিংহকে, লেখক অমর মিত্র যাকে বলেন “ঋণ আমাদের, আমি সেই ঋণ শোধ করি”। এই ঋণ শোধের দায়েই যেন তিনি গীতিকার আখ্যান, লোকগাথা, ইতিহাস, আন্দোলন আর আন্দোলন পরশমনি পাথরের মতো সব অমূল্য সোনা হয়ে উঠে।
প্রেমকাহিনীর সন্ধানে যে যাত্রা, যাত্রার বাঁকে বাঁকে জনজীবনের সংকট আবিষ্কার, তা থেকে উদ্ভুত দায়বোধ লেখককে প্ররোচিত করেছে ঋণ শোধে। ফলে সাধারনের জীবনের নির্মমতা, বঞ্চনা তিনি তুলে এনেছেন তার কলমে। শত শত বছরের ঋণ তিনি শোধ করেছেন এই একবিংশ শতকে।
ঋণ কি আমাদের ছিল না? আমাদের সবার হয়ে তা শোধ করার চেষ্টা করেছেন অমর মিত্র। উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সবচেয়ে বড় অভিঘাত সৃষ্টিকারী ঘটনা দেশভাগ থেকে, সুধীন্দ্রের নিরুদ্দেশ হওয়া, বিপুলের ফিরে আসা, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা সব আয়োজন যেন কেবল উন্মোচনের। বিস্মৃতির চাদরে ঢেকে রাখা ইতিহাসের উন্মোচন আর তার সাথে আধুনিক সময়ের প্রতারনা।
শৈলীতে তিনি সাধকের মতো যেন ধ্যানবিন্দু নির্দিষ্ট করে সুবিশাল পঠভূমি-চরিত্র-ঘঠনাকে বয়ান করে গেছেন, কোথাও বিচ্যুত হননি, গোলমাল পাকিয়ে দেন নি, অযথা বাক্য বা বর্ণনায় আশ্রয় নেননি। এ যে কতোবড় দক্ষতা, অমর মিত্রের মোমেনশাহী উপাখ্যান পাঠে বিস্মিত হতে হয়।
ময়মনসিংহ গীতিকার ভাষার সাথে নিজের ভাষা যোগ করে, গীতিকার পদের সাথে স্বরচিত পদ সংযুক্ত করে অভিনবত্বের জন্ম দিয়েছেন তিনি। যুক্ত করেছেন কতক আধুনিক গানও। সব মিলিয়ে অমর মিত্রের মোমেনশাহী উপাখ্যান এক কালোত্তীর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।