দেশভাগের সময় নারীদের সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে, সব ধরনের নৃশংসতা সইতে হয়েছে। আজ এক শিখ নারীর গল্প বলব, যিনি ভারত ও পাকিস্তানের লাখো নারীর মতো দেশভাগের ধকল সয়েছেন। দেশভাগের আগেই রাওয়ালপিন্ডি মুসলমান-অধ্যুষিত শহর ছিল। কিন্তু সেখানে কিছু শিখও থাকত। বহু বছর ধরে সেখানে এই দুই সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বাস করেছে, পাকিস্তানের দাবি উত্থাপিত হওয়ার পরই তাদের মধ্যকার সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। দেখা গেল, রাতারাতি তাদের মধ্যে এক অলঙ্ঘনীয় বিভেদ সৃষ্টি হলো, ব্যাপারটা যেন এমন, তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একত্রে বসবাস করেনি।
শিখদের সহজেই আলাদা করা যেত, তারাই ছিল প্রধান লক্ষ্যবস্তু। বিশেষ করে শিখ নারীরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করতেন, তাঁদের অনেকেই ক্ষতি এড়াতে শহরের কাছে এক কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এক সদ্য কিশোরী শিখ বালিকার মা ও বোন কুয়ায় ঝাঁপ দেন, কিন্তু কিশোরীটি তা না করে দৌড়াতে শুরু করে। এক ধার্মিক মুসলমান পরিবার তাকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত তার সে দৌড় থামেনি। সেই দম্পতি ছিল নিঃসন্তান। ফলে এই মেয়েটি তাঁদের কাছে হয়ে উঠল ঈশ্বর-প্রেরিত সন্তান। তাঁরা মেয়েটিকে দত্তক নিয়ে তাকে মুসলমান হিসেবে লালনপালন করেন। তারপর সেই দম্পতি মেয়েটিকে মহিলা মাদ্রাসায় পাঠান, সেখানে সে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে।
পবিত্র কোরআনের ওপর মেয়েটির দখল এত বেশি ছিল যে নিজের স্কুলেই তিনি কোরআন শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। কেউই সন্দেহ করেনি, তিনি জন্মসূত্রে একজন শিখ। তারা শুধু জানত, তিনি পবিত্র কোরআনের একজন অন্যতম সেরা শিক্ষিকা। তিনি নিজেও আরবি শেখায় রীতিমতো নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে কোরআন ও ইসলামের মৌলিক মতবাদ তিনি ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারেন। কখনো কখনো আবার তিনি সঙ্গে করে আনা বাক্সটি খুলে গুরু নানকের ছবিটির দিকে তাকাতেন, সেটি ছিল তাঁর অমূল্য সম্পদ। ছবিটি তাঁকে নিজের শিকড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। এমনকি এক মুসলমান শিক্ষককে বিয়ে করার পরও তিনি এই ছবিটি দেখা বন্ধ করেননি। এটা শুধু স্মৃতিকাতরতা ছিল না, তার চেয়ে বেশি কিছুই ছিল। ছবিটি ছিল তাঁর শিকড়ের সঙ্গে একমাত্র সংযোগ। তিনি গর্ব বোধ করতেন এই ভেবে যে তিনি শিখ ধর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন।
মানুষ কখনোই তাঁর জন্মগত পরিচয় নিয়ে সন্দেহ করেনি। তিনি যে একজন শিখ, এমনকি তাঁর স্বামী বা একমাত্র ছেলেও সে সন্দেহ করেনি। সবাই মনে করত, তিনি জন্মসূত্রেই মুসলমান। আর পবিত্র কোরআনের ওপর তাঁর দখল ছিল বলে লোকে তাঁর কাছে দিকনির্দেশনা চাইত। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতি তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। একটা সময় দেশ দুটির মধ্যে যাতায়াত সহজ হয়ে আসে। মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করা শুরু করে। সে সময় সেই নারীর এক ভাই তাঁর খোঁজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন, তাঁর বোন কুয়ায় ঝাঁপ দেয়নি। একসময় ভাইটি জানতে পারেন, তাঁর বোন রাওয়ালপিন্ডিতে আছে। কিছুদিন চেষ্টা করার পর তিনি তার বাড়ি খুঁজে পান। তবে তাঁরা বেশিক্ষণ একসঙ্গে থাকতে পারেননি। সময়মতো সীমান্ত পাড়ি দিতে ভাইটিকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়। তবে খবরটি সেখানে চাউর হয়ে যায়। সবাই জানতে পারে, সেই নারী একজন শিখ।
অবশ্য তাঁর স্বামী সত্য মেনে নেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্ত্রী মুসলমান নন, এক মৌলভি দিয়ে তিনি তাঁকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলে এই ভেবে খুবই মর্মাহত হয় যে তার মা মুসলমান নয়, শিখ। ছেলেটি তার বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে শুরু করে, যারা আড়ালে তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, সে মনে করতে শুরু করে, তার জীবনটা ব্যর্থ। ছেলেটি মায়ের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে। তার মা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয়নি। সে এটা বুঝতেই চায়নি যে পাকিস্তান সৃষ্টির অনেক আগেই জন্মসূত্রে তার মা শিখ ছিল, এই সত্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
একদিন ছেলেটি একরকম প্রতিশোধ নেয়, সে তার মায়ের অমূল্য বাক্সটি চুরি করে। কাছের একটি খালে গিয়ে বাক্সের জিনিসপত্র ফেলে দেয় সে। সে দেখল, পানিতে গুরু নানকের ছবি ভাসছে, কিছুক্ষণ পর পানির স্রোতে ধীরে ধীরে ছবিটি ডুবে যায়। তারপরও ছেলেটি তার মাকে ক্ষমা করতে পারে না, তাঁর কাছেও যায় না।
ছেলেটি অন্তরে প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও সেই নারীর পক্ষে সত্য এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাঁর ভাই তাঁকে খুঁজে বের করেছেন, তিনি তো তাঁর ভাইকে খুঁজতে যাননি। সেই নারী তো তাঁর অতীতের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। তিনি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁর ভাই তো নিজেই তাঁকে খুঁজতে এসেছিলেন।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে ছেলেটি তার মায়ের অস্তিত্বকেই ঘৃণা করতে শুরু করে, তার মা আবার সেটা বুঝতেও পারে। ছেলেটির বাবা স্ত্রীর কষ্ট টের পান, কিন্তু তিনি মনে করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি কখনোই ছেলেকে এ ব্যাপারে কিছু বলেন না। দেশভাগের বৈপরীত্যের বিষয়টাও তিনি তাঁর ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন না, যেটা কিনা তিক্ততা ছাড়াই বোঝা উচিত।
তিনি জন্মসূত্রে শিখ, এর জন্য তাঁর ছেলে তাঁকে ঘৃণা করে, এ ব্যাপারে তিনি কী করতে পারেন? তিনি ছেলেটিকে বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, কিন্তু সে তাতে কর্ণপাত করে না। প্রতিটি পদক্ষেপে ছেলেটি তার মাকে অপমান করে। সে বোঝাতে চায়, তার তরফ থেকে সে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। তখন তিনি স্মরণ করেন, তাঁর মা ও বোন নিজেদের অতীত মুছে ফেলার জন্য কী করেছিলেন। তাঁরা কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন
তারপর একদিন, তিনি বাসায় একা, যন্ত্রণার অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সেই কুয়ার কাছে যান, যে কুয়ায় তাঁর মা ও বোন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। না, এবার আর তিনি দৌড়ে পালান না। তাঁর ছেলেই প্রথম দেখতে পায় তাঁর ভাসমান লাশ। হ্যাঁ, ওটা তার মায়েরই মরদেহ। এতে হয়তো তার রাগ কিছুটা পড়ে, কিন্তু মাকে হারিয়ে সে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।