অনুবাদ গল্প: সাদাত হাসান মান্টো’র দেশভাগের গল্প
১৯৪৭ এর আগস্ট মাসের মাঝ রাতে ভারতভাগের আঘাত সদ্য স্বাধীন দুই দেশকে থমকে দিল। হাজার বছরে এই ভূখণ্ডের মানুষ যা ভাবেনি তাই হলো। তাদের বাড়ি, প্রতিবেশি, ভাষা, সংস্কৃতি ভিন্নতার পরিচয় হয়ে গেল। দুই কোটি মানুষ এক রাতের ভোরে নিজদেশে পরদেশি হয়ে গেলেন। নিজেদের স্মৃতি, বিশ্বাস আর ভালবাসার তিল তিল করে গড়ে তোলা অর্থ এত আচমকা ধ্বসে পড়ায় মানুষের মাঝের হিংস্রতা, রক্ত আর অমানবিকতা চমকে দিয়েছে বিশেষ করে উর্দু সাহিত্যকে। সা’দাত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫) নিজে তখন তাঁর প্রাণের বোম্বে আর বন্ধুদের হারিয়ে লাহোরের একজন পাড় এলকোহোলিক। বিকেলে গিয়ে হানা দেন পত্রিকার অফিসে – টাকা দাও। পত্রিকার লোকজন কাগজ কলম এগিয়ে দেয়। মান্টো কখনো এক লাইন কখনো দেড় পৃষ্ঠার গল্প লিখে পাঁচ টাকা নিয়ে যান। সেই গল্প তীব্র, নির্মম গা শিউরানো রসিকতায় দেশভাগের দাঙ্গার গল্প। সেইগুলো এক করে বের হয় – সিয়াহ হাশিয়ে (১৯৪৮) নামে, মানে কালো সীমানা। তারই কয়েকটি এখানে দেয়া হল।
মিষ্টি খাওয়া
খবর পাওয়া গেল যে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করার জন্য অমৃতসর, গোয়ালিয়র আর বোম্বাইয়ের কয়েক জায়গায় লোকেদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।
কেরামতি
লুট করা মাল উদ্ধার করার জন্য পুলিশ তল্লাশি শুরু করলো।
লোকজন ভয় পেয়ে লুট করা মাল বাইরে ফেলে আসতে লাগলো। কেউ কেউ তো পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের মালপত্রও বাইরে ফেলে দিলো ।
এর মধ্যে একজন খুব ঝামেলায় পড়ে গেল। তার কাছে মুদি দোকান থেকে লুট করে আনা দুই বস্তা চিনি ছিল। এর মধ্যে এক বস্তা সে রাতের অন্ধকারে কোন রকমে পাশের কূয়ায় ফেলে দিলো কিন্তু দ্বিতীয় বস্তা ফেলতে গিয়ে নিজেও বস্তার সঙ্গে কুয়ায় পড়লো।
শব্দ শুনে লোকজন ঘুম থেকে উঠে এলো। কুয়ায় দড়ি ফেলা হল। দুই জন জোয়ান ছেলে কুয়ায় নামল। লোকটাকে তুলে আনা হল। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরে সে মরে গেল।
এর পর দিন যখন লোকজন কুয়া থেকে জল তুলল, দেখলো কুয়ার পানি মিষ্টি!
সেই রাতেই ঐ লোকের কবরে প্রদীপ জ্বলা শুরু হল।
জেলি
ভোর ছয়টার সময় পেট্রল পাম্পের কাছে ঠেলা গাড়িতে বরফ ফেরিওয়ালার পেটে ছুরি ঠুকিয়ে দেয়া হলো। বেলা সাতটা পর্যন্ত লাশ রাস্তায় পড়ে রইল। ঠেলা থেকে বরফ গলে গলে পানি হয়ে পড়তে থাকল।
সোয়া সাতটা বাজলে পর পুলিশ লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেল। বরফ আর রক্ত সেই রাস্তাতেই পড়ে থাকল।
পাশ দিয়ে একটা টাঙ্গা চলে গেল। তাতে বসা ছোট একটা বাচ্চা রাস্তায় জমে থাকা উজ্বল থকথকে রক্তের দিকে তাকাল। ওর জিভে জল এসে পড়ল। সে তার মায়ের হাত টেনে আঙ্গুল দিয়ে সে দিকে দেখিয়ে বলল – “দেখ মা, জেলি!”
চ্যালেঞ্জ
আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো … কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপরে সাইনবোর্ডে এই তখনো পড়া যাচ্ছিল …
“এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।”
জবাই আর কোপ
“আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, ধীরে ধীরে পোচ দিয়ে জবাই করলাম।”
“এ তুই কী করলি!”
“কেন?”
“জবাই করলি কেন?”
“এভাবেই তো মজা!”
“মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে …”
আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।
লোকসান
দুই বন্ধু মিলে দশ বিশজন মেয়ের মাঝ থেকে একটা মেয়েকে বেছে বেয়াল্লিশ টাকায় কিনে নিল। রাত শেষ হলে পর এক বন্ধু সেই মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলো “তোমার নাম কী?”
মেয়ে তার নাম বললো। নাম শুনে সেই বন্ধু হতবাক হয়ে রইলো। বলল “আমাদেরকে তো বললো তুমি অন্য ধর্মের!”
মেয়ে জবাব দিল “ওরা মিথ্যে বলেছে।”
এই কথা শুনে সে ছুটে তার বন্ধুর কাছে গিয়ে বলল, “ঐ হারামজাদারা আমাদের ধোকা দিয়েছে। চল মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে আসি।”
পাশবিক
খুব কষ্টে মিয়া বিবি ঘরের কিছু জিনিসপত্র বাঁচাতে পারল। জওয়ান মেয়ে ছিল একটা, তার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। ছোট আরেকটা মেয়ে ছিল, মা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে রইল। একটা বুড়ো মহিষ ছিল, দাঙ্গাবাজরা তাকেও টেনে নিয়ে গেল। গাই গরু বেঁচে গেল কিন্তু বাছুরটা পাওয়া গেল না।
মিয়া, বিবি, তাদের ছোট মেয়ে আর গরু এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল। রাত ছিল খুব অন্ধকার। ছোট মেয়ে ভয় পেয়ে কাঁদা শুরু করল। রাতের নিস্তব্ধতায় মনে হলো যেন ঢোল বাজাচ্ছে কেউ। মা ভয় পেয়ে মেয়ের মুখ হাত দিয়ে চাপা দিলো যেন দুশমন শুনতে না পায়। কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ল। বাপ আরো সাবধান হয়ে মেয়ের ওপরে মোটা চাদর চাপা দিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর দূর থেকে একটা বাছুরের ডাকার শব্দ পাওয়া গেল। গাই গরুর কান খাড়া হল। সে উঠে পাগলের মতো এখানে ওখানে ছুটতে শুরু করল। তাকেও চুপ করানোর অনেক চেষ্টা করা হল। লাভ হলো না।
শব্দ শুনে দুশমন এসে পৌঁছল। দূরে মশালের আলো দেখা গেল। বিবি খুব রেগে তার মিয়াকে বলল, “কেন তুমি জানোয়ারটাকে সঙ্গে আনলে!”
আতিথেয়তা
চলন্ত গাড়ি থামানো হল। অন্য ধর্মের সবাইকে বের করে করে তলোয়ার আর গুলি দিয়ে নিকাশ করা হল। এইসব কাজ শেষ করে গাড়ির বাকি যাত্রীদের হালুয়া, দুধ আর ফল দিয়ে আপ্যায়িত করা হল। গাড়ি আবার ছাড়ার আগে আপ্যায়নকারীরা যাত্রীদের সামনে এসে বললো, “ভাইয়েরা আর বোনেরা! গাড়ি আসার খবর আমরা অনেক পরে পেয়েছি। এইজন্য মন মতো আপনাদের খাতির করতে পারলাম না।”
নজরদারি
বন্ধুকে নিজের ধর্মের লোক বলে পরিচয় দিয়ে তাকে ঘরে পৌঁছানোর জন্য মিলিটারির একটা দলের সাথে রওনা হলো ক। যার ধর্ম বদলানো হলো সেই খ পথে সৈনিকদের জিজ্ঞাসা করলো, “আশেপাশে কিছু ঘটেনি তো?”
জবাব এলো, “তেমন কিছু না … অমুক মহল্লায় একটা কুকুর মারা পড়েছে।”
একটু ঘাবড়ে গিয়ে খ বলল, “আর কিছু না!”
উত্তর এলো, “না, তেমন আর কি? খালে আরো তিনটে কুকুরের লাশ পাওয়া গেছে।”
খ এর খাতিরে ক সৈনিকদের জিজ্ঞাসা করল, “মিলিটারি কিছু ব্যবস্থা করে না?”
জবাব এলো, “না, তা কেন … সব কিছু নজরদারির মধ্যেই হয়।”
জুতো
জটলা দিক বদলে স্যার গঙ্গারামের মূর্তির দিকে রওনা হল। মূর্তির ওপর লাঠির বাড়ি পড়ল, ইট ছোড়া হল। একজন গিয়ে মুখে আলকাতরা মেখে দিল। আরেকজন অনেকগুলো পুরোনো ছেঁড়া জুতো জমা করে মালা বানিয়ে মূর্তির গলায় পরানোর জন্য সামনে এগোল। কিন্তু এর মধ্যে পুলিশ এসে পড়ল। গুলি চলা শুরু হল।
জুতোর মালা বানানেওয়ালা জখম হল। চিকিৎসার জন্য তাকে স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে পাঠানো হল।
দুরদৃষ্টি
প্রথম ঘটনা ঘটলো যেখানে পাহারা ছিল তার কাছে এক হোটেলে। তৎক্ষণাৎ সেখানেও সিপাহি পাহারায় রাখা হল।
দ্বিতীয় ঘটনা দ্বিতীয় দিনেই একটা দোকানের সামনে ঘটল। সিপাহিকে প্রথম জায়গা থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় ঘটনা ঘটার জায়গায় মোতায়েন করা হল।
তৃতীয় কেস ঘটলো রাত বারোটার সময় লন্ড্রির পাশে।
ইন্সপেক্টর যখন সিপাহিকে নতুন জায়গায় পাহারা দেয়ার হুকুম দিলেন, তখন সিপাহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “যেখানে নতুন ঘটনা ঘটবে আমাকে বরং সেখানে পাহারায় বসান।”
দয়া
“আমার চোখের সামনে আমার জওয়ান মেয়েটাকে মেরো না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, লোকটার কথা রাখো। মেয়েটাকে ঐদিকে নিয়ে চল।”
পরিচ্ছন্নতা
গাড়ি থামানো হলো।
তিন বন্দুকধারী কম্পার্টমেন্টের পাশে এলো। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তারা যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করল, “কি ভাই! কোন মুরগি আছে?”
একজন যাত্রী কি একটা বলতে গিয়েও বললো না। বাকিরা জবাব দিল, “জি না, নেই।”
কিছুক্ষণ পর চার বর্শাধারী এল। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তারা যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করল, “কী ভাই, কোন মুরগি-টুরগি আছে নাকি?”
প্রথম বার কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল যে যাত্রী, সে জবাব দিল, “জি বলতে পারি না, আপনি ভেতরে এসে বাথরুমে দেখুন।”
বর্শাধারী ভেতরে এল। বাথরুমের দরজা ভাঙা হলো। সেখান থেকে একজন মুরগি বের হয়ে এলো।
এক বর্শাধারী বলল, “দে শেষ করে!”
দ্বিতীয়জন বললো, “না না, এখানে না। কামরা নোংরা হয়ে যাবে … বাইরে নিয়ে চল।”
সাম্যবাদ
ঘরের সব জরুরী জিনিসপত্র সে ট্রাকে উঠিয়ে আরেক শহরে যাচ্ছিল। পথে তাকে থামানো হল। একজন ট্রাকের মালপত্রের দিকে লোভী দৃষ্টি দিয়ে বললো, “আরে দেখো, একলা এতো মাল হজম করে ফেলছে!”
মালপত্রের মালিক হেসে বলল, “ভাই, এগুলো সব আমার নিজের।”
দুই তিনজন হেসে উঠল, “জানি ভাই, আমরা সব জানি।”
একজন চিৎকার করে উঠল, “লুট কর সব! এই শালা বড়লোক … ট্রাক নিয়ে চুরি করে!”
বিশ্রাম
“আরে মরেনি! এখনো বেঁচে আছে!”
“থাক দোস্তো … খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি!”
মজুরি
খুব লুটপাট চলছিল। সেই উত্তাপ আরো বাড়ল যখন চারদিকে আগুন লাগা শুরু হল।
এর মধ্যে একজন কোত্থেকে একটা হারমোনিয়াম তুলে নিয়ে গাইতে গাইতে খুশি মনে যাচ্ছিল – “যব তুম হি হ্যায়ে পরদেস লাগা কর ঠেস ও পিতম পেয়ারা, দুনিয়া মে কওন হামারা”।
একটা কম বয়সের ছেলে ঝোলার মধ্যে পাপড়ের পুটলি ঢুকিয়ে পালাচ্ছিল, হোঁচট খেয়ে পড়ে খোলা থেকে পাপড় ছড়িয়ে পড়লো। ছেলেটা পাপড় তোলার জন্য ঝুঁকলো, তখন একজন সেলাই মেশিন মাথায় এক লোক বলল, “ওরে রাখ, রাখ, তুলিসনি, যে গরম, আপনা-আপনি ভাজা হয়ে যাবে”।
বাজারের মধ্যে ধপ করে একটা ভারি বস্তা পড়লো। একজন দৌঁড়ে এসে ছুরি দিয়ে তার পেট ফাঁক করে দিল। আটার বদলে সাদা সাদা চিনি ছলকে বের হয়ে এলো। লোক জমা হয়ে গেল। সবাই তাদের ঝুলিতে চিনি ঢোকানো শুরু করল। কেউ কেউ ঝোলা না থাকায় জামা খুলে চিনি জমা করছিল। একজনের গায়ে জামা ছিল না। সে নিজের পাজামা খুলে মুঠো মুঠো চিনি ভরতে লাগল।
“সরো… সরো…” একজন টাঙ্গাওয়ালা একদম নতুন বার্নিশ করা আলমারি নিয়ে চলে গেল।
একটা উঁচু বাড়ির জানালার মধ্যে দিয়ে মখমল কাপড়ের থান ফরফর করে শব্দ তুলে বাইরে বের হয়ে এল। আগুনের জিভ তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরল। নিচে রাস্তায় নামতে নামতে সে ছাই হয়ে গেল।
“পোঁ পোঁ” মোটর গাড়ির হরনের আওয়াজের সঙ্গে দুইজন নারীর চিৎকারও ছিল।
দশ-পনের জন মানুষ একটা সাদা রঙের লোহার সিন্দুক টেনে বের করে লাঠি দিয়ে তা খোলার চেষ্টা করতে লাগল।
একজন কতগুলো “গো এন্ড গেট” দুধের কৌটো দুই হাতে ভর্তি করে তার চিবুক দিয়ে সেগুলো সামলাতে সামলাতে একটা দোকান থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে বাজারের মধ্যে দিয়ে চলা শুরু করল।
উঁচু গলায় চিৎকার শোনা গেল, “আয়, আয়, লেমনেড খাই, যা গরম পড়েছে!” দেখা গেল একজন লোক গলায় একটা নতুন টায়ার ঝুলিয়ে দুটো লেমোনেডের বোতল তুলে কাউকে ধন্যবাদ না দিয়ে চলে গেল।
আওয়াজ শোনা গেল, “আরে কেউ দমকলে খবর দাও, সব মাল পূড়ে ছাই হয়ে গেল!” কেউ এই বিজ্ঞ পরামর্শে কান দিল না।
এই উৎসবের মাঝেই নিয়মমত আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এমনই করে খুব ধুমধামের সঙ্গে লুটপাট চলছিল অনেক পরে কানফাটা আওয়াজ শোনা গেল। গুলি চলা শুরু হল।
পুলিশ এসে দেখল বাজার ফাঁকা। কিন্তু দূরে মোড়ের কাছে ধোঁয়ার মধ্যে একজনকে দেখা গেল। পুলিশের সিপাহি বাঁশি ফুঁকতে ফুঁকতে সেদিকে দৌঁড়ে গেল। লোকটা জোর কদমে ধৌঁয়ার মধ্যে ঢুকে গেল। পেছনে পেছে সিপাহিও ছুটল।
ধোঁয়ার সীমানা শেষ হতে পুলিশের সিপাহিরা দেখলো একজন কাশ্মিরি মজুর পিঠের ওপর ভারি বস্তা তুলে পালাচ্ছে। বাঁশির গলা শুকিয়ে গেল কিন্তু সেই কাশ্মিরি মজুর আর থামে না। ওর পিঠের ওপর ওজনদার বস্তা ছিল। মামুলি ওজন নয়। কিন্তু সে এমন ছুটছিল যেন পঠের ওপর কিছু নেই।
সিপাহিরা হাঁপানো শুরু করল। এর মধ্যে একজন ধাঁ করে পিস্তল বের করে গুলি চালিয়ে দিল। গুলি মজুরের উরু ছুঁয়ে গেল। পিঠের বস্তা এবার মাটিতে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে সে এবার তার পেছনে ছুটে আসা হাঁপাতে থাকা সিপাহিদের দিকে তাকাল। উরু হতে বইতে থাকা রক্তের দিকেও গভীরভাবে তাকাল। কিন্তু হঠাৎ করে উঠে এক ঝটকায় বস্তা পিঠে তুলে আবার ছুটতে শুরু করল।
সিপাহিরা ভাবল, “জাহান্নামে যাক ব্যাটা”।
কিন্তু ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে কিছু দূর এগিয়ে কাশ্মিরি মজুর পড়ে গেল। বস্তা পড়লো গিয়ে তার ওপর।
সিপাহিরা তাকে পাকড়াও করে বস্তা সমেত নিয়ে গেল।
পথে কাশ্মিরি মজুর বারবার বলতে লাগল, “হুজুর, আমাকে কেন ধরলেন! আমি গরীব মানুষ। চালের একটা বস্তাই তো নিয়েছিলাম। বউ বাচ্চাদের খাওয়াতাম। শুধু শুধু আমাকে গুলি করলেন!” কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো না।
থানাতে গিয়েও কাশ্মিরি মজুর আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনেক কিছু বলল, “হুজুর, অন্য লোকেরা তো দামী দামী মাল লুট করল, আমি গরীব মানুষ, শুধু এক বস্তা চাল নিয়েছি। হুযুর, আমি গরীব মানুষ, সব দিন খেতেও পাই না”।
বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে সে মাথা থেকে ময়লা টুপি খুলে মুখের ঘাম মুছে চালের বস্তার দিকে মন খারাপ করা নজর দিয়ে থানাদারকে হাত মেলে দিয়ে বলল, “আচ্ছা হুজুর, বস্তা আপনি রেখে দিন, আমার বস্তা বওয়ার মজুরি হলেই চলবে – চার আনা”।
সহযোগিতা
পঞ্চাশ জনের একটা দল লাঠিসোটা হাতে চল্লিশ লুটপাট করবে বলে একটা বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল।
হঠাৎ করে সেই ভীড়কে মাঝখান দিয়ে চিড়ে একজন মাঝ বয়সী রোগা মত লোক কোত্থেকে যেন উঠে এল। সে দলের দিকে মুখ করে লিডারের মত করে ভাষণ দেয়া শুরু করলো, “ভাইয়েরা আমার, এই বাড়ির মধ্যে তোমাদের চিন্তার বাইরে ধন-দৌলত, দামী আসবাব রাখা আছে। এসো, আমরা সবাই মিলেমিশে হামলা চালাই। মালে গনিমত যা পাওয়া যাবে, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেব।”
দলের মধ্যে একথা শুনে কিছু লাঠি আকাশের দিকে উঠল, যাদের হাতে লাঠি ছিল না তারা হাওয়ায় ঘুসি চালালো, আর কিছু শ্লোগান উছলে উঠল ফোয়ারার মতো।
চল্লিশ পঞ্চাশ জনের লাঠি হাতে দল সেই রোগা আধবয়সী লোকের নেতৃত্বে সেই বাড়ির দিকে দ্রুত এগোনো শুরু করল যে বাড়িতে অকল্পনীয় ধন-দৌলত আর অগুন্তি দামী আসবাব রাখা আছে।
বাড়ির সদর দরজার সামনে থেমে রোগা লোকটা আবার দলের দিকে ফিরে বলল, “ভাইয়েরা আমার, হুড়োহুড়ি কোরো না, নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি কোরো না … চলো”।
একজন চিৎকার করে বলল, “দরজায় তো তালা লাগানো”।
আরেকজন তার থেকেও জোরে চিৎকার করে উঠল, “ ভাঙো তালা”।
“ভাঙো, ভাঙো”।
হাওয়ায় কতগুলো লাঠি দুলে উঠল, কয়েকটা মুঠো করা হাত উঠল আর ফোয়ারার মতো শ্লোগান উছলে উঠল।
রোগা লোকটা হাতের ইশারায় তালা ভাঙতে এগোনো লোকটাকে থামিয়ে হেসে বলল, “ ভাইয়েরা, থামো… আমি চাবি দিয়ে দরজা খুলছি।”
এই কথা বলে সে পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে তার মাঝ থেকে একটা চাবি বেছে নিয়ে তালায় ঢোকাল। তালা খুলে গেল। শিশু কাঠের মজবুত দরজা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আপত্তি জানিয়ে খুলে গেল। চল্লিশ পঞ্চাশ জনের দলটা ভেতরে ঢোকার জন্য অধৈর্য হয়ে পাগলের মতো এগোতে লাগল। রোগা লোকটা জামার আস্তিনে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “ধীরে, ধীরে ভাইয়েরা। এই বাড়িতে যা আছে সব তোমাদের, হূড়োহুড়ি করার দরকার কী!”
একথা শুনে ভীড় একটু থমকে গেল। একজন করে খুব শৃংখলাবদ্ধ হয়ে সবাই ভেতরে ঢুকল। কিন্তু যেই জিনিষপত্র লুট শুরু হলো, শুরু হয়ে গেল কাড়াকাড়ি। মায়া দয়া ভুলে সবাই জিনিষপত্র টানা-হ্যাচড়া শুরু করল।
এই দৃশ্য দেখে রোগা লোকটা খুব দুঃখভরা গলায় লুটেরাদের বলল, “ধীরে, ধীরে, ভাইয়েরা আমার… নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটির কোন দরকার নেই। মিলেমিশে কাজ করতে হবে। কারোর হাতে বেশি দামে জিনিস এসে পড়লে ঈর্ষা করার কিছু নেই। এত বড় বাড়ি! অন্য কোন দামী জিনিস খুঁজে নাও। কিন্তু তাই বলে পাগল হওয়ার কিছু নেই… মারামারি করলে জিনিষপত্র ভাঙবে। এতে তো তোমাদেরই ক্ষতি।”
লুটেরাদের মধ্যে এই ভাষণ শুনে আবার শৃঙ্খলা ফিরে এল। ভরপুর বাড়ি ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে লাগল।
রোগা লোকটা মাঝে মাঝেই পরামর্শ দিতে থাকল, “দেখো ভাই, এটা রেডিও… সাবধানে তোলো, ভেঙে না যায়। আরে! রেডিওর তার ফেলে যাচ্ছ তো!”
“নিচু করে, আরেকটু নিচু করে! আখরোট কাঠের টেবিল, হাতির দাঁতের কাজ করা, খুব নাজুক জিনিষ। হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে”!
“আরে! আরে! এখানেই বোতল খোলা শুরু করলে! মাতলামি শুরু করবে তো! ঘরে গিয়ে খাও।”
“থামো! থামো! আগে মেইন সুইচ বন্ধ করি। পরে কারেন্টের শক লেগে মরবে!”
এর মধ্যে এক কোণ হতে কোলাহল শোনা গেল। কয়েকজন মিলে রেশমি কাপড়ের একটা থান নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। রোগা লোকটা দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গিয়ে খুব দুঃখী গলায় বলতে লাগল, “ তোমরা এতো অবুঝ! এতো দামী কাপড়ের কী হাল করছো! ঘরে মাপের ফিতাও নিশ্চয়ই আছে। খুঁজে নিয়ে নিজেদের মধ্যে মাপ মতো ভাগ করে নাও।”
হঠাৎ কুকুরের চিৎকার শোনা গেল “ভৌ, ভৌ, ভৌ”। আর চোখের নিমিষে বিরাট আকারের এক হিংস্র কুকুর লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই সে দুই তিনজন লুটেরাকে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিল। রোগা লোকটা চিৎকার করল, “টাইগার! টাইগার!”
টাইগারের ভয়ঙ্কর রক্তমাখা মুখে তখন একজন লুটেরার জামার ছেঁড়া কাপড় ঝুলছিল সে তখন নিজের নাম শুনে লেজ নাড়তে নাড়তে রোগা লোকটার দিকে চোখ নিচু করে এগোতে লাগল।
টাইগার ঘরে ঢুকতেই সব লুটেরা পালিয়েছিল। যার জামার ছেঁড়া অংশ টাইগারের মুখে ঝুলছিল, শুধু সেই বেচারা তখনো দাঁড়িয়ে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে রোগা লোকটাকে প্রশ্ন করল, “কে তুমি?”
রোগা লোকটা হেসে বলল, “এই ঘরের মালিক… আরে! আরে! সাবধান! সাবধান! তোমার হাতে কাঁচের জিনিস!”
বাটোয়ারা
লুটপাটের মাঝে একজন নিজের জন্য বেশ বড় একটা কাঠের সিন্দুক বাগিয়ে ফেলল। কিন্তু সিন্দুক উঠাতে গিয়ে জায়গা থেকে এক ইঞ্চি সরাতে পারল না। আরেকজন মানুষ বোধ হয় নিজের কাজে লাগার মতো কিছু পাচ্ছিল না। সে এগিয়ে এসে সিন্দুকওলা লোকটাকে বললো, “সাহায্য লাগবে?”
সিন্দুকওলা সাহায্য নিতে রাজি হয়ে গেল। যে লোকটা নিজের কাজে লাগার মতো কিছু পাচ্ছিল না, সে নিজের মজবুত হাত দিয়ে সিন্দুক ধরে নিজের পিঠে তুলে নিল। দ্বিতীয়জন হাত লাগাল, দুইজন বাইরে বেরিয়ে এল।
সিন্দুক বেশ ভারি ছিল। সিন্দুক কাঁধে লোকটার বেশ চোঁট লাগছিল। পা ভেঙে আসছিল। কিন্তু পুরস্কারের লোভে সে শরীরের ব্যথার তোয়াক্কা করল না।
সিন্দুক বওয়া লোকটার চাইতে সিন্দুক হাতান লোকটা ছিল বেশ দূর্বল গোছের। পুরো পথ সে কেবল এক হাত সিন্দুকের ওপর ঠেকিয়ে রেখে নিজের অধিকার কায়েম করে রাখল।
দুজনে যখন নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেল, তখন সিন্দুক এক দিকে রেখে সারা পথ পরিশ্রম করা লোকটা বলল, “এবার বলো, সিন্দুকের ভেতরের মালের আমি কতটা পাব?”
সিন্দুক প্রথমে দেখা লোকটা জবাবে বলল, “চার ভাগের এক ভাগ।”
“নাহ! খুব কম হয়ে যায়।”
“মোটেই কম না। বরং বেশি দিচ্ছি। আমিই তো সবার আগে সিন্দুকে হাত লাগাই।”
“সে ঠিক আছে। কিন্তু এই পিঠভাঙ্গা বোঝা এতদুর আনল কে?”
“আধা-আধিতে রাজি আছ?”
“ঠিক আছে। খোল সিন্দুক।”
সিন্দুক খোলার পর তার ভেতর থেকে একজন মানুষ বের হয়ে এলো। হাতে তলোয়ার। সে বের হয়েই দুই অংশীদারকে চার ভাগে ভাগ করে ফেলল।
যথার্থ ব্যবহার
দশ রাউন্ড চালিয়ে তিনজন মানুষকে জখম করার পর পাঠান শেষ পর্যন্ত সফল হয়েই ছাড়ল।
এদিকে এক ছূটোছুটি লেগে ছিল। মানুষজন এর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। লুটপাট তো চলছিলই। মারামারিও চলছিল সমানে। এর মধ্যে পাঠান তার বন্দুক নিয়ে ঢুকে পড়ল। মোটামুটি এক ঘন্টা কুস্তি করে শেষ পর্যন্ত একটা থার্মোফ্লাস্কের বোতল হাতাতে পারল।
পুলিশ আসার পর সবাই পালিয়ে গেল… পাঠানও পালাল।
একটা গুলি পাঠানের ডান দিকের কান ছুঁয়ে চলে গেল। পাঠান এর বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে লাল রঙের থার্মোফ্লাস্ক আরো শক্ত করে ধরল।
বন্ধুদের মাঝে পৌঁছে সে খুব বুক ফুলিয়ে সবাইকে থার্মোফ্লাস্ক দেখাতে লাগল। একজন হেঁসে বলল … “খান সাহেব, আপনি এটা কী নিয়ে এলেন?”
খান সাহেব খুব খুশি মনে থার্মোফ্লাস্কের চকচকে ঢাকনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন?”
“এটা তো ঠান্ডা জিনিসকে ঠাণ্ডা আর গরম জিনিসকে গরম রাখার বোতল।”
খান সাহেব বোতল নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল, “ কেন! আমি এতে নস্যি রাখবো… গরমে গরম থাকবে, ঠাণ্ডার দিনে ঠাণ্ডা।”
যথাযথ পদক্ষেপ
যখন মহল্লায় হামলা হল কিছু কম বুদ্ধির লোক তো মারা পড়ল, যারা বাকি ছিল তারা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে বাঁচল। একজন লোক আর তার বউ নিজের ঘরের তল্কুঠুরিতে গিয়ে লুকিয়ে রইল।
দুই দিন দুই রাত মিয়া বিবি খুনিরা কখন আসে এই ভয়ে দমবন্ধ করে কাটিয়ে দিল। কিন্তু কেউ এল না।
আরো দুই দিন কেটে গেল। মৃত্যুর ভয় কমতে লাগল। খিদে আর পিপাসার কষ্ট তার চাইতে বেশি হতে লাগল।
আরো চারদিন কেটে গেল, মিয়া বিবির জীবন মৃত্যুতে আর কোন আগ্রহ রইল না। দুইজন তাদের আশ্রয় ছেড়ে বের হয়ে এল।
মিয়া খুব দূর্বল কন্ঠে বাইরে থাকা লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, “আমরা নিজেই ধরা দিচ্ছি … আমাদের মেরে ফেলো।”
যার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল, সেই লোক চিন্তায় পড়ে গেল, “আমাদের ধর্মে তো জীব হত্যা পাপ।”
এরা সবাই ছিল জৈন। তাই তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে যথাযথ পদক্ষেপের জন্য মিয়া বিবিকে পাশের মহল্লার লোকদের হাতে তুলে দিল।
মূল উর্দু থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন। জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬। কুমিল্লায়। সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন গালিব গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। সাদত হাসান মান্টোর কালো সীমানা ছাড়াও মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
