| 20 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

অস্তিত্ব

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comরাত গভীর হতে শুরু করলেই পাশের বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজটা ভেসে আসে। বিড়াল না মানুষের কান্না সেটা অস্পষ্ট। তবে ম্যাঁ… ম্যাঁ… অথবা অ্যাঁ… অ্যাঁ… শব্দটা এরকম। চৈতী প্রথমে ভেবেছিল বায়ুগ্রস্ত সব লোকজন। কণ্ঠটা যারই হোক না কেন, শুধু কান্না হলে সে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু কান্নার সাথে ঝগড়াঝাটি, মারামারির শব্দও শোনা যায়। এটা তো আর সেই শৈশবকাল না যে গাঙনির পাড়ে উথাল পাথাল বৃষ্টিতে ভেজার অপরাধে পিঠের ওপর দুমদাম দুচারটা কিল-থাপ্পড় খাওয়ার পরও সব হজম করে খড়ের গাদার ওপর শুয়ে থাকা যাবে। ইহা বর্তমান। এবং চব্বিশ বছরের যুবতী হওয়ার অপরাধে বিবাহসূত্রে চৈতী এখন দেশত্যাগী। বিবাহই যত নষ্টের মূল। বিবাহের কারণেই সকল অতীত চৈতীকে এমন প্রবঞ্চনা করেছে। যে নিয়মে গাছে ফল হয়, নারী শরীরে সন্তান হয়, সেই নিয়মেই চৈতীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।

ছয় মাস আগেও একটা অর্থপূর্ণ জীবনযাপন ছিল যার সে কিনা এখন একটা অ্যাপার্টমেন্টে বন্দি। চাইলেই বন্ধুবান্ধবের সাথে প্রেসক্লাবের বিরানি খেয়ে আসা যায় না। একটা লোক, যাকে কোনো দিন সে দেখেইনি, চেনেইনি, যার দাঁতের মধ্যে হ্যালিটোফোবিয়া আছে বলেই মনে হয়, কারণ সে দিনের বেলায় পাঁচবার দাঁতব্রাশ করে আর হা হা করে নিজের মুখের গন্ধ নিজেই শোঁকে, সেইরকম একটি লোকের সাথেই কিনা সে একা একা বিদেশে থাকছে। চৈতী মনে করে, সবই ওর দোষ। মধ্যবিত্তের ঘরে জন্ম হওয়াটা ছিল এক নম্বর দোষ। আর দুই নম্বর দোষ হলো, এই বিয়েতে রাজি হওয়াটা। বাবা ছিলেন মফঃস্বল শহরে কাপড়ের ব্যবসায়ী। খুব রাগী মানুষ। তার রাগ দেখলে বাড়ির পিঁপড়াগুলো পর্যন্ত কেঁপে উঠত। ব্যবসা নিয়ে হয়ত তাঁর অনেক টেনশন ছিল। তাঁর খিটখিটে মেজাজের ভাব উঠলেই মান্নাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে গানটা সারাক্ষণ প্যাঁ প্যাঁ করে বেজে উঠতো। যতক্ষণ না ছোটভাই রিয়াজের আঙুলের চাপে পুরো টেপটাই পেচিয়ে যেত। বিবাহসংক্রান্ত সিদ্ধান্তে এই মানুষটিকে চ্যালেঞ্জ করা চৈতীর জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল।

চৈতী পাড়ার এক ছেলেকে পছন্দ করত। ছেলেটা গুরুদয়াল কলেজে মাস্টার্স পড়ছিল। সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সেই ছেলে তার আত্মীয়স্বজনসহ চৈতীদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবও নিয়ে আসে। কিন্তু চৈতীর বাবা অমন একটা বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দেবে না। ছেলেপক্ষের নিয়ে আসা এক ডজন মিষ্টির প্যাকেট, ফল, সাজানো ডালা কুলা, সব ঘরের সামনে থেকেই রাস্তার ধারের ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন তিনি। তাও সেটা পাত্রপক্ষের সামনেই। পাড়ার সবাই হা করে দৃশ্যটা দেখলো। কত্ত বড় অপমান, ভাবা যায়? সেই থেকে ওই ছেলের সাথে সব সম্পর্ক শেষ।

গভীর কালো চোখ আর ঢেউ খেলানো কুচকুচে কালো চুলে চৈতীকে একটু দেমাগী হলেই বরং ভাল মানাতো। কিন্তু সে লক্ষ্মী। তার অপর নাম মহালক্ষ্মী, সীতা, রাধা ইত্যাদি। ঢাকায় ওদের ম্যালা আত্মীয়স্বজন আর চেনা পরিচিত আছে। তারা ধরে বেঁধে আশিকের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো। আলমাস সাহেব যিনি বিপদে আপদে বাবাকে টাকা ধার দেন, ধানমন্ডিতে যার বিশাল আলিশান বাড়ি, তারই শ্যালিকার পুত্র আশিক। কাজেই বাবার পক্ষে না বলাটা মোটেই সুবিধের হতো না। যাই হোক, ছেলেটা কানাডায় লেখাপড়া শেষ করেছে। চাকরি খুঁজছে। বেকার থাকা সত্ত্বেও এই ছেলের সাথেই চৈতীর বিয়ে হলো এবং ওরা বিদেশ চলে এলো।

টরন্টো শহর থেকে একটু দূরে একটা শহরতলীতে ওরা থাকে। এলাকাটি নিয়ে আগাম জানাশোনার কোনো উপায় ছিল না। কম ভাড়ায় যা পাওয়া গেছে তাতেই ওরা খুশি মনে উঠে গেছে। পরে স্থানীয় লোকজনদের কাছে জানা গেল যে এখানে, নেশাখোর, চোর, খুনী আর নিম্নবিত্তের সংখ্যাই বেশি। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে যে আলাবিল গ্রোসারি স্টোর, যেখানে পোড়ানো আস্ত হাঁস কিনতে পাওয়া যায়, আর শীতের দিনে সেই ঝোল ঝোল হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য আশিক চৌদ্দবার তার মায়ের রান্নার উদ্ধৃতি দেয়। সেই মাংস কিনতে গিয়েই কথাটা জেনেছিল চৈতী যে এলাকাটা মোটেও সুবিধের নয়। কিন্তু ভাড়া জন্য চুক্তি সাক্ষর হয়ে যাওয়াতে বাড়ি বদলাবার কোন সুযোগ আর ছিল না। 

দুটো শোবার ঘর, একটা বসবার আর খাবার ঘর এক সাথে। আর দুটো বাথরুম। এই হলো বহুতল অ্যাপার্টমেন্টটির সীমানা। দ্বিতীয় শোবার ঘরটার জানালা দিয়ে যে মাঠটা দেখা যায় ঠিক তার মাঝখানটিতে একটা বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। নাম না জানা গুল্মপত্তরবিশিষ্ট কুঁজো সে। বয়স্ক। পাতাগুচ্ছগুলো ঝুলে নুয়ে পড়েছে। যেন হাঁটুতে কোনো জোড়ই নেই আর। সাধারণত শীতপ্রধান দেশে ভেজা আর স্যাঁতসেঁতে মাটিতেই এই গাছ হয়। আবাসিক এলাকাটায় বড় বড় মোট পাঁচটি দালান। শীতের শুরু থেকে চৈতীরা ৮০ নম্বর দালানের ৩১২ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টটিতে থাকতে শুরু করেছে। এসব বাড়িতে কোনো ব্যালকনি নেই দেখে চৈতীর হাঁপানি ধরে যায়। দম ফেলার জায়গা কই? সারা ঘরেই তো হ্যালিটোফোবিয়ার বাতাস। উপায়হীন চৈতী দ্বিতীয় শোবার ঘরের জানালার ধারটাকেই নিজের বলে মেনে নেয়। ওই জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালেই কুঁজো গাছটা শো শো করে চুম্বক টানে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে  কুন্ডলি পাঁকিয়ে বুকের ভেতরে এক টুকরো বাতাস গুঁজে দেয়। ওই জানালা দিয়ে এলাকার প্রধান ফটকটিও দেখা যায়। চৈতী প্রতিদিন দেখে ওই পথ ধরেই প্রতি সন্ধ্যায় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে একঘেয়ে গতিতে আশিক হেঁটে যায় এবং আবার, ভোরবেলা ফিরে আসে।

গাছটার ঠিক পেছনেই একটা দীর্ঘ লম্বা পথ। যার দুধারে সারি সারি বেগুনি আর হলুদ ফুল থরে থরে ফুটে আছে। ফুলগুলো এখন হাওয়া বদলের ফলে মলিন হতে শুরু করেছে। আর পাতাগুলোতে কুচি কুচি তুষার জল গড়িয়ে পড়ছে। চৈতীদের ওরেন্ডা কোর্টের ইশান কোনের ৩১৩ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টটিতে কোনো লোকজনকে যাতায়াত করতে দেখা যায় না। লম্বা করিডোর ধরে যতবার ওরা হেঁটেছে, বা আসছে যাচ্ছে ততবারই ওই দরজাটা বন্ধ। আশেপাশের লোকজনের সাথে পরিচয় হয়নি যে জিগ্যেস করবে ঘটনাটা কী? দিনের বেলায় গ্যাস আর ইলেক্ট্রিসিটি লাইনের নিয়মিত টুকটাক শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজই নেই। সব চুপচাপ। কিন্তু রাত হলেই ওই ভয়াবহ শব্দ! প্রতিদিন কী নিয়ে যে ওদের মধ্যে এত ঝগড়া হয় কে জানে! দুটো অ্যাপার্টমেন্টের মাঝখানের দেয়ালে কান পাতলেই চৈতী স্পষ্ট শুনতে পায়, একটা মিহিকণ্ঠী মেয়ে প্রতিদিন স্বামীর সাথে ঝগড়া করছে। আর স্বামীটা হয়ত মদ-টদ খেয়ে এসে ওকে পেটাচ্ছে। আহা, পাখপাখালি বাচ্চাগুলোও মায়ের সাথে সাথে কাঁদছে। ওরা নিজেদের মধ্যে কি এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে, সেটা চৈতী উদ্ধারই করতে পারে না। কলহ, বচসা, বকুনি এগুলোতো ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওতে নাক গলাবে কেন সে? তার উপর ওদের কথাগুলো গলার ভেতর থেকে এমনভাবে দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসে যে ওটা ইংলিশ না স্কটিশ, বোঝা খুব মুশকিল। চৈতীর আবার ইংরেজির দৌড়টা দি গিফট অফ দি ম্যাজাই পর্যন্তই। এর চাইতে কঠিন হলেই ওর পড়তে বা শুনতে অসুবিধে হয়। সেকারনে ওর দ্বারলগ্নকর্ণ অভ্যাসটা ঘন হতে শুরু করে দিন দিন।

প্রতিরাতেই সে কান পেতে পাশের বাড়ির ঝগড়া শোনে, আর এদিকে ভাতের হাড়িতে যে চাল সিদ্ধ হয়ে উথলে পড়ে যায়, ওর খেয়ালও থাকে না। পোড়ার গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে সে রান্না ঘরে। তারপর পাতিলের পোড়া কুড়াতে কুড়াতে একটা গান গায়……

আমি পাগলিনী… চুলার উপর ভাত উঠায়ে ভুলে গেলাম

শুধু সংসার জুড়ে হাতরে মরি…প্রেম সোহাগী এলোমেলো

মনের বেদন বলতে নারী, নারীরও নির্জন আপন গহীন মন 

সেই গ্রামে নাই শ্যামের জুড়ি… আমি নারী মরি মরি, আমি নারী…

একজন নামী গাতক একবার ওদের বাড়িতে এসে গানটা শুনিয়েছিল। প্রতিটা অক্ষর মুখস্ত হয়ে আছে। গানটা গাইলে চৈতীর ভেতওে কেমন যেন একটা বুনোহাঁস ভাব হয়। কিন্তু বেশিক্ষণ নিজের প্রতি নিজের আতিথেয়তার সুযোগ থাকে না। পাশের বাড়ির শব্দগুলো মাথার ভেতর ফের ঝিঁ ঝিঁ পোকা হয়ে বাজতে থাকে। সারাক্ষণই মনে হয়, কখন না বাচ্চাগুলো মা-বাবার বিরুদ্ধে পুলিশকে জানাবে। নাইন-ওয়ান-ওয়ান তিনটা ডিজিট মাত্র। কল করতে লাগে ২ সেকেন্ড। কিন্তু সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা বেজে বেজে রাতের পর রাত পেরিয়ে যায়। শব্দগুলো সহজে মিলায় না।

২.

একদিন খুব সকালে, রোদটা তখনও তীব্র হয়ে ওঠেনি, চৈতী জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, একটা ঝকঝকে নীল গাড়ি মাঠের মাঝখানে, ওই কুঁজো গাছটার নিচে ধীরে ধীরে এসে থামলো। দেখে মনে হলো যেন ইচ্ছে করেই গাড়িটা গাছের আড়ালে লুকোবার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পরই ত্রিশ-পয়ত্রিশ বয়েসী একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। ওর পরনে একটা টাইট জিন্স আর নীল টপস্। দূর থেকে মনে হচ্ছিল মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা। তবে দূর থেকে অতটা স্পষ্ট বোঝার উপায় ছিল না। হাতে একটা কালো চামড়ার জ্যাকেট আর নীল পার্স ঝুলছে। মেয়েটা অস্থিরভাবে সিগারেট টানছিল। কি দারুণ স্মার্টরে বাবা, দেখেই জোস্ লাগে চৈতীর। দশ পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর কিছুটা ক্ষিপ্ত ভঙিতেই মেয়েটা আবার গাড়িতে ফিরে যায়। এই ঘটনার পরপরই চৈতী লক্ষ করলো, পাড়ার মূল ফটক দিয়ে একটার পর একটা পুলিশের গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করছে। মুহূর্তেই পুরো এলাকাটাকে ওরা ঘিরে ফেলেছে। তারপর ওরা মাইকে ঘোষণা দিলো যে একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী এই এলাকাটিতেই লুকিয়ে আছে। ৮০ থেকে ৯০ নম্বর পর্যন্ত ওরেন্ডা কোর্টের সবগুলো দালানের প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালানো হবে। সবাই যেন পুলিশকে সহযোগিতা করে।

চৈতী উত্তেজিত হয়ে আশিককে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। বলল, শুনছো, একটা খুনী এসেছে। এখানেই আশেপাশে কোথাও আছে।

সারারাত ডিউটি শেষে বেচারা ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছিল। চৈতীর ডাক শুনে সে ধরফর করে উঠে বসল। সব শুনে নড়েচড়ে আলসেমি করে বললো, ধুর… খুনী কি আর পুলিশকে বলে কয়ে আসবে? সব গাধা কোথাকার!, বলেই সে আবার ধপাস করে ঘুমিয়ে পড়ল।  সে অস্থির হয়ে ভাবে, পাশের বাড়ির লোকজনদের ব্যাপারটা জানানো দরকার। এবং এরপরই চৈতী ওদের মূল দরজায় গিয়ে কয়েকবার ধাক্কা দেয়। বেলও বাজায়। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তরই আসে না। তারপর সে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। যথারীতি এবারও থমথমে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে রাতে আওয়াজ হলেও দিনের বেলায় কোনো আওয়াজ নেই। 

ভয়ে চৈতীর শরীরে শীত নামে। নারীকণ্ঠ, পুরুষকণ্ঠ, শিশু কণ্ঠ সব গেল কই? ওরা কি কেউ দিনের বেলায় বাড়িতে থাকে না? শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলাতে না পেরে চৈতী বিল্ডিং ম্যানেজারকে ঘটনাটা জানাবার জন্য ফোন করে। ম্যানেজার একটুও অবাক না হয়ে তাকে একটা অদ্ভুত তথ্য দেয়, যা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ওই অ্যাপার্টমেন্টটিতে নাকি বছর খানেক ধরে কেউ কোনো দিন থাকেইনি। দুটো সন্তানসহ যে দম্পতিটি ওখানে ভাড়া থাকতো তারা সকলেই মারা গেছে। স্ত্রীটা নাকি তার স্বামী সন্তানদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। তারপর সে নিজেই আত্মহত্যা করেছে। 

অ্যাপার্টমেন্টটি আপাতত বন্ধ।

৩.

এই ঘটনার এক মাস পর একটা ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানিতে ছোটখাটো একটা চাকরি পায় চৈতী। কারখানায় শোরগোল লেগেই থাকে সারাক্ষণ। যুবকেরা ফোর্ক লিফটে করে মালগুলোকে কাঠের স্কিডের ওপর তুলে দেয়। তারপর সেগুলো ট্রাকে করে দেশ-বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখানে অনেকের সাথেই চৈতীর পরিচয় হয়। মিশেল শেখায়, স্কিডে তোলার আগে কী করে মালগুলোকে মাপতে হয়, ট্যাগ লাগিয়ে কিভাবে অর্ডার তৈরি করতে হয়, তারপর শিপিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। চৈতী যতক্ষণ শোরগোলের ভেতর থাকে ততক্ষণ কানের ভেতর ঝি ঝি পোকার শব্দটা যন্ত্রণা দেয় না। কারখানা থেকে বেরুলেই শোঁ শোঁ শব্দটা মগজে বাজতে থাকে।

 সেদিন কাজ সেড়ে সে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল।

হঠাৎই লক্ষ করলো, কেনেডি রোডের দুপাশে হলুদ আর সাদা ফুলগুলো দলবেঁধে ফুটে আছে। যেন সেই ধলা গ্রামের সর্ষে ক্ষেত। সেইসব দিন যখন হলুদ ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ওরা দূর দূর অচেনা মাঠে হারিয়ে যেত। রেললাইনের ধার ঘেষে তিন মাইল যাবার পর বিশাল একটা তেঁতুল গাছ। কি মিষ্টি আর বাইল্যা তেঁতুল! সেই তেঁতুলের লোভে ওরা দৌড়ে দৌড়ে ছুটে যেত। বড়রা অবশ্য ভয়ংকর সব গল্প বলত। ওই গাছে ভূত থাকে, রাতের বেলায় লম্বা লম্বা চুলের মেয়েরা সেই গাছতলা দিয়ে হেঁটে যায়। সেখান দিয়ে হাঁটলে ছোটদের চুলের ভেতরও ভূত চড়ে বসে। এসব কারণে তেঁতুলতলায় যাওয়া ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এদেশে সর্ষে ক্ষেত নেই। আছে এই অচেনা হলুদ ফুল। যার নাম গোল্ডেন আলেক্সান্ডার।

চৈতী গোল্ডেন আলেক্সান্ডার ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটছে। রাস্তার মাঝ বরাবর বাসস্ট্যান্ড। কেনেডি রোডের আরেক প্রান্ত কুয়াশায় ছেয়ে আছে। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। চারদিকে কোনো জনপ্রাণী নেই। খাঁ খাঁ করছে লম্বা রাস্তাটা। গাছগুলোও অন্ধকারে ডুবে গেছে। লাইটপোস্টের ঈষৎ আলোয় বড় বড় ক্রিস্টমাস ট্রিগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কতগুলো ভূত দাঁড়িয়ে আছে।

 বাস আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বাসস্ট্যান্ডের কাঠের চেয়ারটাতে বসে পড়ে চৈতী। শীতের তীব্রতা বাড়ছে। নাক চোখ জমে যাচ্ছে। হঠাৎই নির্জন অন্ধকার থেকে হুড়মুড় করে একটা মেয়ে চৈতীর পাশে এসে ঝপাৎ করে বসে পড়ে। মেয়েটা যে ঠিক কোনো দিক থেকে শাই করে এলো বোঝাই গেল না। 

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মেয়েটা জিগ্যেস করল,

  • সিগারেট আছে?
  • চৈতী মাথা নেড়ে বলে, না, আমি সিগারেট খাই না।

মেয়েটা খুবই বিরক্ত হয়ে নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল। লাইটারও সাথেই ছিল। আশ্চর্য্য ব্যাপার! নিজের কাছে থাকতে অন্যের কাছে চাইবে কেন? যাহোক, ও সিগারেট ধরায়। জ্যাকেট আর টুপিতে এমনভাবে ওর মুখটা ঢাকা ছিল যে চেহারাটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। ধোঁয়ার পাক মুখ থেকে ফু মেরে বের করে আবারও জিগ্যেস করে,

  • হাও আর ইউ? এত রাতে এখানে কী করছো? 

চৈতী ঠিক বুঝতে পারে না এর কী উত্তর দেবে। এত রাতে তো ওই মেয়েটাও এখানেই আছে। ভেতরে ভেতরে একটু বিরক্ত হয় সে। শুধু বলে, কাজ থেকে ফিরছি।

  • কী নাম?

চৈতী মনে মনে ভাবে আরে…! এই বেডিরে লয়া তো দেহি মহা জ্বালা! আরে তুই কি এই মফলস্বল্যা বেডির লগে পারবি? দেখতে সাদাসিদা মনে হইলে কি হইবো, এক ঘুষি দিয়া তর নাক ফাডানোর যোগ্যাতা রাখে সে। 

কিন্তু মুখে একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলে, 

  • চৈতী
  • ফ্রম ইন্ডিয়া?
  • নো, বাংলাদেশ
  • চৈতীও পাল্টা জিগ্যেস করে। তোমার নাম?
  • মরিসা। ফ্রম বারবাডোস। তারপর মেয়েটা একটু দম নিয়ে বলে, বাংলাডেশ? এ ভেরি গুড ক্রিকেট টিম।

আহা! মনটা আমার মুহূর্তেই ভালো হয়ে যায়। মেয়েটা বাংলাদেশ চেনে? ক্রিকেট টিম চেনে! বাহ! চৈতী আবেগ ধরে না রাখতে পেরে ঠোঁটের সাথে হাতের তালু মিলিয়ে বাতাসের দিকে তিনটা চুমু ছুঁড়ে দেয়। চুমা চুমা চুমা।

মুখে শুধু বলে, থ্যাঙ্কিউ।

মরিসা দেখতে ঠিক কুঁচকুচে কালো না। এমনকি কালো মেয়েদের মতন ওর বোঁচা নাক বা মোটা ঠোঁটও নেই। হয়ত বাবা মায়ের একজন কেউ সাদা হবে। ওর ভাসা ভাসা চোখগুলো মায়ায় ভরা। টুপির ভেতর থেকে গভীর কালো চুলগুলো যেন ছলকে বেড়িয়ে পড়ছে। জ্যাকেটের ওপর থেকেই ওর একহারা গড়ন বোঝা যায়। তবে বয়সটা ঠিক বোঝার উপায় নেই।

 সেদিন মরিসার সাথে খুব ভাব হয়ে গেল চৈতীর। কানাডায় ওর প্রথম বন্ধু। দুজনার মধ্যে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্বও গড়ে উঠলো। ওরা প্রায়ই এখানে সেখানে বেড়াতে যেতে শুরু করল। সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখা, ডান্ডাস স্কয়ারে স্কেটিং করা, কফি শপে আড্ডা দেয়া এগুলো নিয়মিত চলছিল। খুব দ্রুতই ওদের সময়গুলো গড়িয়ে যাচ্ছিল।

৪.

আগের ঘটনার তিনমাস পর কোনো এক শনিবার সন্ধ্যায় মরিসাকে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় নিমন্ত্রণ করলো চৈতী। যদিও তখন পর্যন্ত চৈতী জানত না মরিসা কোথায় থাকে। শুধু জানে ওর স্থায়ীভাবে থাকার কোনো জায়গা নেই। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছিল চৈতী। ওয়েটার মেয়েটা একটু পর পর এসে জিগ্যেস করছিল, তুমি কি কোনো পানীয় নেবে? চৈতী বিব্রত ভঙ্গিতে বলছিল, আরেকটু অপেক্ষা করি। 

মরিসা এলো ঠিক রাত আটটায়। একটা লাল ঝকঝকে রেসিং কার এ চড়ে। রেস্তোরাঁর সামনে ওকে নামিয়ে দিয়ে গেল কেউ। চৈতী দেখলো, একজন তরুণ ড্রাইভিং সিটে বসা। নামার সময় ওরা পরস্পরকে চুমু খেল।

মরিসার পরনে আজ টকটকে লাল স্কার্ট আর ছোট প্রিন্ট টপস। টপসের সাথে মিলিয়ে লাল রঙের লিপ্সটিক আর হাই হিল সু। ভারী মেকাপ। চোখের পাতা ভার হয়ে আছে মাসকারায়। চৈতী ভেবে পেলো না ও এত সেজেছে কেন আজ! মরিসাকে সে জিগ্যেসই করে ফেললো, কি ব্যাপার এত সেজেছো যে? মরিসা শুধু একটু বেদনার হাসি দিলো। কিন্তু ছেলেটাকে নিয়ে চৈতীর মনে একটু সন্দেহও হলো।

  • কী খাবে বল? চৈতী জিগ্যেস করল।
  • টান্ডুরি চিকেন, ল্যাম্ব উইথ স্পিনাচ, অ্যান্ড হট অ্যান্ড সাওয়ার স্যুপ।
  • ডেজার্ট?
  • নো ডেজার্ট।- বলেই সে সেল ফোন টেপাটিপি শুরু করল।

পুরো টেবিল জুড়ে খাবার সাজানো। মরিসা যত না খায় তার চাইতে বেশি ছটফট করে। চৈতী ঠিক বুঝতে পারে না ওর কী হয়েছে। ওরা দুজনই নির্বিকারভাবে স্যুপটা শেষ করলো। বাংলাদেশ নিয়ে মরিসার প্রবল আগ্রহ। সারাক্ষণ জানতে চায়। ওখানকার মানুষেরা কী খায়? ওরা ভারতীয়দের চাইতে আলাদা হয় কীভাবে – এইসব।

চোখ খুলে দেশ নিয়ে কথা বলতে চৈতীর মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সে দেশ দেখতে পায়। চারদিকে দেশের ঘ্রাণ। মেঠোপথ ধরে সব বন্ধুরা দল বেঁধে তেঁতুলতলার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। কলার ছড়ি কাঁধে বাড়ির কামলা আলামিনও হাঁটছে। সে চোখ পাকিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে। মনে মনে বলছে, গেছিস তো মরেছিস। নির্ঘাত কপালে আজ ছ্যাচা আছে। ভূত তোর কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরবে। চৈতী কোনো কথাই কানে তোলে না। তাকিয়ে দেখে, বক উড়ে এসে ধান ক্ষেতে বসছে। কৃষকেরা লাঙল দিচ্ছে। ক্ষেতের আশেপাশে বাড়িগুলোর সুপারিতলায় অলস শালিকেরা হাঁটছে। হাজিবাড়ির পুকুরপাড়ে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে ঠিকাদার মনছুর আর ভ্যানচালক আজিজুল গুটি খেলছে।

মুখে বলে, আমার কাঁধে না ভূত আছে। আমি সবার সবকিছু দেখতে পাই।

মরিসা হঠাৎ এ কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে। ওদের পাশের টেবিলে তখন দুটো ছেলে বসে খাচ্ছিল। একজন ফর্সা সাদা, আরেকজন কালো। কালো ছেলেটি বার বার মরিসাকে দেখছিল আর ইশারা করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। মরিসা উল্টোদিকে বসাতে ঠিক টের পাচ্ছিল না। চৈতী মরিসাকে ইশারা করে বলল, ওই ছেলেটা তোমাকে ডাকছে।

মরিসা উত্তর দিলো, ডাকুক, চুপ থাকো। বোঝা গেল একটা কিছু ঘোলা ব্যাপার আছে। কালো ছেলেটি এবার উঠে এসে সরাসরি মরিসাকে প্রস্তাবটা দিয়েই বসে, আজ রাতে তুমি আমার সাথে যাবে? নগদ ৫০০ ডলার, হবে?

কথাটা শোনার পর চৈতীর অস্বস্তি ভাব হয়। মরিসা কিছুটা লজ্জা পেয়ে ছেলেটাকে একরকম টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায়। চৈতী দূর থেকে হালকা শুনতে পায় মরিসা চিৎকার করে বলছে, হাও ডেয়ার ইউ, আমার প্রাইভেসিকে তোমার রেসপেক্ট করা উচিত। আমি আমার বন্ধুর সাথে ডিনার করতে এসেছি। এটা বাজার সদাইয়ের জায়গা না। 

ছেলেটাও রেগেমেগে কী সব বলছিল, সেসবে চৈতী কান দিলো না। তবে মুহূর্তেই চৈতীর মাথায় সেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার আক্রমণটা শুরু হলো। শব্দটা বেশির ভাগ সময়ই নিরীহ থাকে। তবে একটা বিরক্তিকর অনুভব তো হয়ই। ডাক্তার বলেছে, কানের ভেতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোমগুলো ছিড়ে গিয়ে সঠিকভাবে মগজে সিগনাল দিচ্ছে না। তাই এই ভোঁ ভোঁ ঝি ঝিঁ শব্দগুলো শোনা যাচ্ছে। ঠিক হতে সময় লাগবে।

দূর থেকে ওদের ঝগড়া করা দেখতে দেখতেই হঠাৎই চৈতীর আবছা আবছা মনে পড়ে, অ্যাপার্টমেন্টের সামনের সেই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিই ছিল মরিসা। হ্যাঁ। ওটাই ছিল মরিসা। ভীষন বিষণ্ন মনে খুঁজছিল সে কাউকে। হয়ত কোনো খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছিল। নইলে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যাবে কেন? 

চৈতীর মনটা মুহূর্তেই অবষাদে ডুবে যায়। রেস্টুরেন্টের ব্যালকনিতে হেলান দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বরফে ভিজতে থাকে সে। হঠাৎ মরিসা পেছন থেকে এসে চৈতীর প্রায় জমে যাওয়া হাতটা চেপে ধরে বলে, ভেতরে এসো, তোমার ঠান্ডা লাগছে।

  • একটু দাঁড়াই?
  • চলো, আগে খাওয়া শেষ করি। বিলটাও তো দিতে হবে।
  • আমার আর খেতে ভালো লাগছে না।
  • কেন? তোমার দেশে কি কলগার্ল নেই? বলেই মরিসা তীব্র দৃষ্টিতে চৈতীর দিকে তাকায়।
  • না, না, কী বলো তুমি? সেটা কোনো ব্যাপার না।
  • তাহলে? এটা তো আমার পেশা। আমি নিজের ইচ্ছায় পেশাটাকে বেছে নিয়েছি।
  • নিজের ইচ্ছায়?
  • হয়ত হ্যাঁ। হয়ত না। কী যায় আসে?

তারপর সে তার শক্ত হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে চৈতীকে ভেতরে নিয়ে যায়। চৈতী শোনে ভয়াবহ এক বেদনার ইতিহাস। নাৎসি বাহিনী যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল তখন ওর মা দেশ ছেড়ে কালো বিদেশির হাত ধরে ক্যারিবীয় সাগরের একটা দ্বীপে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছিল। তার বাবা ছিল আফ্রিকান দাসদের বংশধর। ওদের বিশাল সুগার কোম্পানি ছিল। ব্যবসায় মন্দা শুরু হলে ওরা পাঁচ ভাইবোন নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। একসময় বাবা-মা মারা যায়। মরিসা নানা দেশ ঘুরে টুরে কানাডায় স্থিত হয়। ওর স্বামী সন্তান সবই ছিল। আজ ওরা কেউ নেই। এতটুকু অনর্গল বলে যায় মরিসা। 

কি অদ্ভুত একটা গল্প। এর বেশি আর কিছু জানার ইচ্ছেও হয় না আর চৈতীর।

৫.

পরের দিন গভীর রাতে মাইকেল গ্যারন হাসপাতাল থেকে চৈতীর কাছে একটা ফোন আসে। পুলিশ ইন্সপেক্টর ডেভিড জানায় গতরাতে মূল শহর ডাউনটাউনের একটা হোটেল থেকে মরিসার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। লাশে কোনো ধরনের বিষের আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবু পুলিশের সন্দেহ মরিসাকে কেউ হত্যা করেছে। পুলিশ আরও জানালো যে বেশ কয়েকটি চুরি, হত্যা মামলা এবং রেপ কেসের সাথে মরিসার নামটা অনেক আগে থেকেই যুক্ত ছিল।

এসব তথ্যের বাইরেও যা চৈতীকে সবচাইতে বেশি চমকে দিলো, তা হলো, মরিসার সমস্ত কাগজপত্রে ঠিকানা হিসেবে লেখা আছে অ্যাপার্টমেন্ট-৩১৩, ওরেন্ডা কোর্ট। চৈতীর সেই পাশের বাড়ি। তাহলে কি মরিসা এতদিন বেঁচেই ছিল?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত