| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: লাক্স-স্টার । মৌসুমী ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে শনিবারের রাতটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। পরের দিন সকালে উঠে অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। সারা সপ্তাহ ধরেই অফিস ফিরতি কাঁচা বাজার ফলমূল এনে নিই। আমাজনে কিনে ফেলি মুদির জিনিসপত্র। তাই শনিবারের রাত এলেই ওয়েব সিরিজ দেখতে ইচ্ছে হয় রাত জেগে, গান শুনতে ইচ্ছে হয় সারারাত। কখনো কখনো স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়। আজ ইচ্ছে হল কিশোর বয়সের লাক্স সুন্দরীদের স্বপ্ন দেখতে। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো জলে ভেজা আঢাকা কাঁধ, নিটোল ফর্সা পিচ্ছিল হাত-পা এ সময়ের নতুন লাক্স-গার্ল টি কে, জানতে নেট সার্চ শুরু করলাম। লাক্স সাবানের শতবর্ষ চলছে। সেই মধুবালা থেকে শুরু করে আলিয়া ভাট অব্ধি সবাইকে অনায়াসে চিনতে পারলাম, কিন্তু শতবর্ষে ইনি কে?  

          হঠাৎ ডোর বেলের শব্দ। কে এল এত রাতে? স্বপ্নে ভেজা চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবু জোর করে নিজেকে তুলে দরজা খুলতেই চমকে গেলাম। এ কি! আমার সামনে যে অপূর্ব সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁকে আমার খুব চেনা লাগল। মনে হল কোনো মডেলার। ক্যাট ওয়াক করতে করতে আমার ঘরে প্রবেশ করছেন। পরক্ষণেই মনে হল ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছেন তিনি।

          জিজ্ঞেস করলাম, কাকে চাই?

          মুচকি হেসে বললেন, চিনতে পারলে না?

          —হ্যাঁ খুব চেনা মনে হচ্ছে। কী নাম আপনার?

চোখ কচলে চেনার চেষ্টা করলাম। হেমা মালিনীর মতো লম্বা, শ্রীদেবীর মতো গলার স্বর, মাধুরীর মতো হাসি…

—যে কোন নামে ডাকতে পারো আমায়। আমার অনুমতি না নিয়েই আমার বেড রুমে ঢুকে শুয়ে পড়লেন তিনি।

—দীপিকা না কারিনা, কে আপনি?

—কোনোটাই নই। বলেই রিন রিন করে হেসে উঠল।

আমি আমার প্রথম প্রেমিকার নাম মনে করে বললাম, তুমি কি শ্রেয়া?

          সে মুচকি হাসল। আমি আলমারি খুলে আমার পুরোনো ডায়েরি বার করে শ্রেয়ার ছবি খুঁজতে লাগলাম। পেলামও। কিন্তু চোদ্দ বছরের শ্রেয়ার সঙ্গে এই সুন্দরীর কোনো মিলই খুঁজে পেলাম না, শুধুমাত্র দুজনেরই মুখের আদল লম্বা এই যা।

          —তুমি কি শ্রবণা? কলেজে পড়তে পড়তেই তো তোমার বিয়ে হয়ে গেছিল।

          সে উঠে বসল। গ্লেসি মোলায়েম চুলে বার কয়েক আঙুল বোলালো। হ্যাঁ, শ্রবণার মতো লম্বা গ্রীবা মেয়েটির। গায়ের রঙও শ্রবণার মতোই ফর্সা। কিন্তু শ্রবণা বেশ মোটা ছিল। গোল মুখ। আবার কলেজের পিকনিকের ছবিটা অ্যালবাম থেকে খুঁজে বার করলাম। শ্রবণা বেগুনী শাড়ি পড়েছিল পিকনিকে। না, শ্রবণা বলে তো মনে হচ্ছে না।

          আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি জানো আমি কে?

          —খুব জানি। সব জানি আমি তোমার সম্পর্কে। বলেই গড়গড় করে আমার নাম ধাম বয়স কী চাকরি করি বাবার নাম সব সব বলে চলল।

          —অনেক হয়েছে এবার থাম।

          একটু কি বিমর্ষ হল বকুনি খেয়ে? অভিমান ভাঙাতে চিবুকটা ধরতে যাব এমন সময় আবার কলিংবেল বাজল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দু’টো। এত রাতে কে আসতে পারে?

          —কাকে চাই?

          —শ্রীদেবী এসেছে আপনার ফ্ল্যাটে? একজন মহিলা খুব চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন। 

          —কই না তো। বলে বিরক্তি প্রকাশ করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলাম।

          ঘরে ফেরামাত্র সুন্দরী বলল, আমার মা এসেছিল আমার খোঁজে। তুমি মা’কে মিথ্যে বলে তাড়িয়ে দিলে?

          —আপনার নাম শ্রীদেবী বলেননি তো।

          —মা ঐ নামে ডাকে আমায়। আমার আসল নাম শ্রীদেবী নয়।

         

          কিছু সময় পর আবার ডোর বেল বাজল। একজন ভদ্রলোক এলেন। বললেন, মাধুরী এসেছে?

          আমি বললাম, না, শ্রীদেবী এসেছে।

          ভদ্রলোক বিমর্ষ হয়ে চলে গেলেন। ঘরে ফিরলে সুন্দরী বলল, আমার বাবা আমার খোঁজে এসেছিল। তুমি তাকেও তাড়িয়ে দিলে?

          আমি এবার রেগে বললাম, তুমি তো বললে তুমি শ্রীদেবী। আমার কি দোষ?

          —আমার বাবা আমায় মাধুরী বলে ডাকে।

          —তুমি তাহলে মাধুরী।

          —না আমার আসল নাম শ্রীদেবী বা মাধুরী কোনোটাই নয়।

          —আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার মা যে তোমায় শ্রীদেবী বলে ডাকে সেটা তোমার বাবা জানেন না?

          —না।

          —সেটা কীকরে সম্ভব?

          —আমার দাদু আমায় হেমা বলে ডাকে। দিদি ডাকে ক্যাটরিনা বলে, দাদা ডাকে দীপিকা বলে, তুমি আজ থেকে ডাকবে শ্রেয়া অথবা শ্রবণা বলে। তাবলে আমি তো হেমা বা শ্রীদেবী বা মাধুরী বা আলিয়া বা শ্রেয়া নই।

          বুঝলাম নাম নিয়ে খুব সেন্সেটিভ সুন্দরী। তাই বললাম, দাঁড়াও ফ্রিজ থেকে তোমার জন্য কোল্ড ড্রিংক্স আনি। আগে তুমি মাথা ঠান্ডা করো তারপর বোল তোমার আসল নাম কি।

          ঠান্ডা পানীয় নিয়ে ঘরে এসে দেখলাম সুন্দরীটি নাক ডেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। খুব রাগ হল আবার মায়াও হল। রাগ হল, কারণ আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে ঘুমাচ্ছে। আর মায়া হল এইজন্য, হয়তো সারা সপ্তাহ টাকার জন্য রাত জেগে আছে। আজ অনেক রাত পরে গভীর ঘুমে প্রবেশ করেছে মনে হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ভোর চারটে।

প্রতি সপ্তাহের মতো মন খারাপ হতে লাগল আমার। আজ রবিবার আজ রাত পোহালেই কাল থেকে আবার অফিস। হাতে মাত্র ২৪ ঘন্টা সময় আছে। খুব উত্তেজনা হল মনে। মনে মনে ভাবলাম, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যদি স্ব-ইচ্ছায় একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের ঘরে এসে রাত কাটায় তাতে দোষের কী আছে? তাছাড়া ও ঘুম থেকে উঠলে ওর সঙ্গে কথা বলব। ওকে আমার ভালই লেগেছে। ওরও যদি আমাকে পছন্দ হয় তখন না হয়, পাকাপাকিভাবে লিভ টুগেদার করা যাবে। ভাবতে ভাবতে বারান্দার দিকে গিয়ে দেখলাম, সূর্য বেশ খানিকটা লাফিয়ে উঠে পড়েছে সামনের একতলা বাড়ির ছাদটায়। সামনের রাস্তায় বাইক টোটো অটো মালবাহী গাড়ির ভিড় বাড়ছে ক্রমশ।

ভাবলাম সারারাত জেগে ক্লান্ত তাই স্নানটা আগে সেরে নিই। স্নানঘর থেকে শুনতে পেলাম ফোন বাজছে। কোনো রকমে তোয়ালে জড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করতে লিভিং রুমে এলাম। বেডরুমে উঁকি মেরে দেখলাম, ফোনের রিংটোনের শব্দে সুন্দরীর ঘুম ভাঙেনি। নিশ্চিন্ত হলাম।

—হ্যালো, কে বলছেন?

—আমি লাক্স কোম্পানির মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি সেকশান থেকে বলছি। কাল রাতে আপনি ফোনে একরাতের জন্য নব্বইএর দশকের লাক্স বিজ্ঞাপনের সুন্দরীদের কাউকে পাঠাতে বলেছিলেন। তাই আমরা তাদের মিলিয়ে মিশিয়ে একজনকে বানিয়ে পাঠিয়েছিলাম। যার কোড — নাইন জিরো ওয়ান ওয়ান। রাত শেষ আমরা তাকে নিতে আসছি। সে যেন আপনার কাছ থেকে কোথাও কারো সঙ্গে না যায়। আসলে তাড়াতাড়িতে আমরা তার মধ্যে ফিরে আসার ইনপুটটা দিতে ভুলে গেছি।

 

ফোন কেটে গেল। আমি শোবার ঘরের বাইরে থেকে উঁকি মেরে সুন্দরীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, মাধুরী ওঠো।

তাও সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। বললাম, রেখা ওঠো।

কিছুতেই যখন ওঠানো গেল না তখন রেগে মেগে ঘরে ঢুকলাম। অমনি সে উঠে বসে পড়ল। আমি তো অবাক। সে নাক টেনে আমার শরীরের থেকে ছড়িয়ে পড়া সদ্য স্নানের সুবাস নিল। মিষ্টি হেসে বলল, লাক্স মেক্সস মি…

আবার ফোন এল।

—হ্যালো, কে বলছেন?

—আমি লাক্স কোম্পানির পারফিউমার এজেন্ট বলছি। নাইন জিরো ওয়ান ওয়ানের গন্ধ তা আপনার কেমন লাগল তার প্রতিক্রিয়া পেতে আমরা আগ্রহী। যদি ভীষন ভালো লাগে ওয়ান বটম প্রেশ করুন, খুব ভালো লাগলে টু, ভালো লাগলে থ্রি… 

 বটম টেপা মাত্রই ফোন কেটে গেল। ফোন রেখে আমি বললাম, তুমি তৈরী হয়ে নাও চলো আমাদের পালিয়ে যেতে হবে। বলেই আমি আলমারি থেকে জামা কাপড় টাকা পয়সা প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র নিয়ে গোছাতে লাগলাম। সুন্দরী নিজেকে গুছিয়ে নিল নিমেষে। কিন্তু আমরা যেই বাড়ি থেকে বেরোতে যাব, কোম্পানির গাড়ি থেকে এজেন্ট নেমে এসে সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে ধরে সুইচ টিপল। নিমেষে সুন্দরী আর মাধুরী হেমা শ্রীদেবীর মতো রইল না।

সে হয়ে গেল কালো সুন্দরী। এতো জোজিবিনি, মিস ইউনিভার্স!

জোজিবিনি বলল, মাই বিউটি মাই স্ট্রেন্থ, লাক্স…

এজেন্ট হেসে বলল, আপনার গায়ের সুবাস বলছে আপনিও লাক্স-পুরুষ। ধন্যবাদ।

ডোর বেল বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে দেখি বুড়ি কাজের মাসি দাঁড়িয়ে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত