।।শুভজ্যোতি ঘোষ।।
জীবনানন্দের কবিতার বনলতা সেনকে ঘিরে কাব্যিক রোম্যান্টিকতা কিংবা রুপোলি পর্দার সুচিত্রা সেনকে ঘিরে চিরন্তন রহস্যময়তা – এগুলো বাঙালির চিন্তা ও মননের অংশ বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য আর একজন ‘মিসেস সেন’ যে অবিভক্ত বাংলা তথা সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেই আরও একটা দারুণ ঘটনার অংশ তা হয়তো অনেকেরই অজানা। তিনি ছিলেন প্রথম উপমহাদেশের প্রথম নারী বিমানযাত্রী।
এ তথ্যের সপক্ষে এখন যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে যে ১৯১০ সালের ১৯ বা ২০শে ডিসেম্বর কলকাতার টলি ক্লাব গ্রাউন্ড থেকে উড়েছিল ভারতের প্রথম শখের বিমান।
আর সেই প্রথম উড়ানের যাত্রীদের মধ্যেই একজন ছিলেন ‘মিসেস সেন’ – বিভিন্ন দেশ জুড়ে ছড়ানো অসংখ্য নথিপত্র ঘেঁটে ও দীর্ঘ গবেষণার পর অবশেষে যার পরিচয় উদ্ধার করা গেছে বলে জানাচ্ছেন এভিয়েশন গবেষক দেবাশিস চক্রবর্তী।
মি. চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নানা সূত্র ঘেঁটে ও পুরনো বিভিন্ন ফরাসি খবরের কাগজের ক্লিপিংস হাতড়ে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এই ‘মিসেস সেন’ ছিলেন উনিশ শতকের বাংলায় বিখ্যাত দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেনের পুত্রবধূদের একজন!
কেশবচন্দ্র সেনের পাঁচ ছেলের মধ্যে দুজন ভারতীয় বিয়ে করেছিলেন – আর সেই দুই পুত্রবধূর নাম ছিল মৃণালিনী দেবী আর নির্মলা ‘নেলি’ সেন।
দেবাশিস চক্রবর্তীর গবেষণা বলছে, টলি ক্লাব থেকে প্লেনে চাপা ‘মিসেস সেন’ আসলে আর কেউ নন, তিনি এই নির্মলা নেলি সেন।
‘মিসেস সেন’ যখন প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে প্লেনে চাপছেন, কলকাতা তখনও ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী।
জীবনানন্দের বনলতা সেন লেখা হয় আরো পঁচিশ বছর পরে, আর সুচিত্রা সেন প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান সেদিনের চল্লিশ বছর পর!
কিন্তু কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এই ঐতিহাসিক বিমানযাত্রা?
বেলজিয়াম থেকে বিমান নিয়ে কলকাতায়
উনিশ শতকের শুরুতেই (১৯০৩) আমেরিকায় রাইট ব্রাদার্স যখন প্রথম তাদের উদ্ভাবিত বিমান নিয়ে আকাশে উড়লেন, এভিয়েশন নিয়ে তখন থেকেই সারা বিশ্বের ধনী-অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে তৈরি হয়েছিল তুমুল আগ্রহ।
দেবাশিস চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, রাইট ভাইদের সফল বিমান যাত্রার সাত-আট বছর বাদে, ১৯১০ সালে একটা গোটা বিমানের সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ নিয়ে মুম্বাই বন্দরে এসে ভেড়েন দুই বেলজিয়ান অ্যাডভেঞ্চারার।
ব্যারন পিয়ের দ্য ক্যাটার্স ও জুল টিক নামে ওই দুই বেলজিয়ানের উদ্দেশ্য ছিল মুম্বাইতে এসে সেখানকার ধনী ইউরোপীয়ান আর ভারতের সম্ভ্রান্ত এলিট বা রাজা-মহারাজাদের বিমানে চড়ার স্বাদ দেওয়া, আর সেই সঙ্গে টাকা কামানো।
কিন্তু মুম্বাইয়ের নগর কর্তৃপক্ষ যখন তাদের বিমান ওড়ানোর অনুমতি দিলেন না, তারা সব জিনিসপত্র ট্রেনে চাপিয়ে সটান হাজির হলেন কলকাতায়।
কলকাতার বিখ্যাত ‘টলি ক্লাবে’ (টালিগঞ্জ ক্লাব নামেও যা পরিচিত) তখনও ছিল বিরাট প্রশস্ত মাঠ, তারা দুই বেলজিয়ান বন্ধুকে অনুমতি দিলেন বিমান চালানোর।
ক্লাবের গ্রাউন্ডেই নিজেদের ছোট বিমানদুটো ‘অ্যাসেম্বল’ করলেন তারা। ওগুলো ছিল ছোট আকারের বাইপ্লেন, মানে দুপাশের ডানাতেই ছিল ওপরে-নিচে দুটো করে ব্লেড।
১৯১০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জুল টিক টলি ক্লাব থেকে নিজের হেনরি ফারমান বাইপ্লেন নিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে কলকাতার আকাশে ওড়েন – সেটাকেই পরে ‘ফ্লাইট’ ম্যাগাজিন ‘ভারতের প্রথম পাবলিক ফ্লাইট’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সেদিন টলি ক্লাবে আর তার বাইরের রাস্তায় আকাশে বিমানের ওড়া দেখতে ‘হাজার হাজার মানুষে’র ভিড় উপচে পড়েছিল।
কিন্তু খুব সম্প্রতি জানা গেছে, ২৮শে ডিসেম্বরের ওই উড়ানের সপ্তাহখানেক আগে টলি ক্লাব থেকেই আরও কতগুলো ‘পরীক্ষামূলক ফ্লাইট’ চালানো হয়েছিল – আর তার একটাতেই ছিলেন আমাদের এই প্রতিবেদনের ‘মিসেস সেন’।
আর যেভাবে সেটা জানা গেল, সেই কাহিনীও কোনও থ্রিলারের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়!
কোলওয়াল, গায়ের্ন্সি আইল্যান্ড আর ই-বের নিলাম
টলি ক্লাব থেকে ভারতের প্রথম বিমান উড়ান নিয়ে মাসকয়েক আগে ক্লাবের সাময়িকী ‘দ্য ট্যাটলার্সে’ একটি নিবন্ধ লেখেন দেবাশিস চক্রবর্তী। পরে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’তেও গত জুন মাসে এ বিষয়ে আর একটি রিপোর্ট বেরোয়।
অনলাইনে সেটি পড়েন ইংল্যান্ডের কোলওয়ালের বাসিন্দা ডেনিস রিড, যিনি নিজেও একজন এভিয়েশন উৎসাহী – আর প্রথম যুগের বিমানযাত্রা সংক্রান্ত নানা জিনিস সংগ্রহ করে বেড়ানোই তার শখ।
তিনি মি চক্রবর্তীকে জানান, ই-বের অকশন সাইট ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার চোখে পড়েছিল টলি ক্লাবের সেদিনের ফ্লাইটের একটি মুদ্রিত নির্ঘন্ট, যাকে বলা হয় ‘এভিয়েশন প্রোগ্রাম’।
ই-বে নিলামের বিক্রেতা তাকে বলেছিলেন, গায়ের্ন্সি আইল্যান্ড থেকে পাওয়া ভারত সংক্রান্ত একটি বইয়ের ভেতরেই সযত্নে গুঁজে রাখা ছিল ওই প্রোগ্রামটি।
সেটি ছিল আসলে মিসেস ম্যাবেল বেটস নামে জনৈকা ইংরেজ রমণীর, যিনি ১৯১০ সালের ২৮ ডিসেম্বরের ওই ফ্লাইটে ছিলেন।
মুদ্রিত প্রোগ্রামের উল্টোদিকে তিনি নিজের হাতে কিছু নোট লিখে রেখেছিলেন, আর সেটাই বোধহয় ছিল ওই শতাধিক বছরের পুরনো কাগজের টুকরো থেকে পাওয়া সবচেয়ে দামী আবিষ্কার!
মিসেস বেটস নিজের হাতে ওই নোটে লিখে গিয়েছিলেন তার আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতার কথা, আর সঙ্গে ছিল সহযাত্রীদের নাম।
সেই তালিকার একেবারে ওপরে ছিল ‘মিসেস সেনে’র নাম, আর তার পাশেই লেখা ছিল ‘যারা গত সপ্তাহে উড়েছেন’।
আর এই নোট থেকেই ডেনিস রিড বা দেবাশিস চক্রবর্তীর মতো গবেষকরা এখন নিশ্চিত, ২৮ ডিসেম্বরের সাত-আট দিন আগেই টলি ক্লাব থেকে কিছু ‘ট্রায়াল ফ্লাইট’ও চালানো হয়েছিল, যার একটায় ছিলেন এই মিসেস সেন।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘ফ্লাইট’ ম্যাগাজিনের ১৯১০ সালের পুরনো সংস্করণেও এই ফ্লাইটগুলোর উল্লেখ পাওয়া গেছে।
কিন্তু এর পরেও যে প্রশ্নটা রয়েই গেল, তা হল এই মিসেস সেনের পরিচয়টা কী?
মিসেস সেনের সন্ধানে : কোচবিহার থেকে কেশবচন্দ্র
যেহেতু কলকাতা থেকে ওই বিমান চালাচ্ছিলেন ফরাসিভাষী দুই বেলজিয়ান, ফ্রান্সের নামী কাগজগুলোতে সে খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছিল।
দেবাশিস চক্রবর্তী পরে ‘ফিগারো’ পত্রিকার আর্কাইভে ১৯১০ সালের ২২ ডিসেম্বরের সংস্করণ ঘেঁটে পেয়েছেন, কলকাতার ওই ফ্লাইটের খবর সেখানেও আছে – তবে যাত্রীদের মধ্যে মিসেস সেনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে কোচবিহারের মহারানির ‘সিস্টার-ইন-ল’ (এক্ষেত্রে ননদ, জা বা ভ্রাতৃবধূ) হিসেবে।
কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের কোনও ভাই-বোনের সন্ধান পাওয়া যায় না, অতএব এরপর মনোযোগটা গিয়ে পড়ে কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবীর নিজের ভ্রাতৃবধূদের ওপর।
সুনীতি দেবী ছিলেন নব্য ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত দার্শনিক কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা – তার বিয়ে হয়েছিল সে আমলের প্রিন্সলি স্টেট কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে।
কেশবচন্দ্রের ছিল পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা। ছেলেদের মধ্যে একজন ছিলেন অবিবাহিত, দুজন বিয়ে করেছিলেন ইউরোপীয়ান মহিলাকে।
বাকি রইল সবচেয়ে ছোট দুই ছেলে, নির্মলচন্দ্র ও সরলচন্দ্র। নির্মলচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন মৃণালিনী দেবী লাডঢি-কে, আর সরলচন্দ্রের স্ত্রীর নাম ছিল নির্মলা সেন – যাকে অনেকে ‘নেলি’ বলেও ডাকতেন।
ফলে এটা নিশ্চিত যে ভারতের মাটিতে প্রথম বিমানে চাপা মহিলা মৃণালিনী দেবী (সেন) বা নির্মলা নেলি সেন – এই দুজনেরই একজন।
গবেষক দেবাশিস চক্রবর্তীর বিশ্বাস, এই স্বীকৃতি সম্ভবত নির্মলা সেনেরই প্রাপ্য, কারণ ফরাসি সংবাদপত্রগুলোর কোনও কোনওটিতে ওই যাত্রীকে ‘মিসেস এন সি সেন’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল।
নির্মলা নেলি সেনও ছিলেন কলকাতার একটি অভিজাত পরিবারের মেয়ে, তার বাবা পূর্ণচন্দ্র সেন বহুকাল বার্মার অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
আজ থেকে ঠিক একশো নয় বছর আগে একটি হাম্বার সোমনার বাইপ্লেনে বেলজিয়ান পাইলটের পাশে একমাত্র যাত্রী আসনটিতে বসে কয়েক মিনিটের জন্য আকাশে উড়েছিলেন সেই ‘মিসেস সেন’।
শুধু প্রথম বাঙালি হিসেবেই নয়, ভারতীয় হিসেবেও আকাশে সে দিন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন ওই ভারতীয় নারী – যদিও তার সঠিক পরিচয় নিয়ে ধন্দটা এখনও একশোভাগ কাটেনি!
সূত্র: বিবিসিবাংলা