গীতরঙ্গ: মরমি ও মুর্শিদি গানে সুফি দর্শন । মুহাম্মদ জহিরুল আলম
অর্থযুক্ত কথা, সুর ও তালের সমন্বয়ে মানুষের কন্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি হলো সঙ্গীত। প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের এ অঞ্চলে স্রষ্টার নামে সঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। চর্যাগীতির পর বাংলা সঙ্গীতে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে নাথগীতি। প্রাচীন নাথগীতি থেকে শুরু করে বর্তমানকালে আমরা যেসকল সঙ্গীত উপভোগ করে থাকি তার মাঝে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত বিশেষ স্থান লাভ করেছে। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞগণ লোকসঙ্গীতকে বিশ্লেষণ করে মরমি ও মুর্শিদি গান তথা তত্ত্বসঙ্গীতকে বিশেষ ধরনের লোকসঙ্গীত হিসেবে অভিহিত করেছেন। তত্ত্বসঙ্গীত মূলত মরমি ও মুর্শিদি গান। মরমি ও মুর্শিদি গানে সুফি দর্শন প্রকাশ পায়।
এ দেশের সব অঞ্চলে মুর্শিদি গানের প্রচলন রয়েছে। গানগুলোতে আমাদের সংস্কৃতির প্রতিফলন হয়- যা আমাদের প্রাণের কথা। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের মতে, “মুর্শীদ মানে গুরু। যে-গানে গুরুর প্রশংসা থাকে অথবা যে-গানে গুরুর নাম লইয়া ভক্ত-হৃদয়ের উচ্ছাস থাকে তাহাকে মুর্শীদ গান বলে।… মুর্শীদ গানে খোদাতালার কাছে ভক্তের আত্মনিবেদনও আছে। …এ যেন সুরালোকের একটি নতুন জগৎ। বিলম্বিত লয়ের সুরের সঙ্গে দ্রুত লয়ের সুর পাশাপাশি দাঁড়াইয়া একটি মনোরম সুর তৈরী করিয়াছে।” (জসীম উদদীন, মুর্শীদ গান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭)। ঐতিহাসিকভাবে গরিবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ভারতবর্ষে সামা বা আধ্যাত্ম গানের প্রচলন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমির খসরু, নুর কুতুবুল আলম, ফরিদ উদ্দীন গঞ্জে শাকর, নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.) প্রমুখ সাধক এ অঞ্চলে আধ্যাত্ম সঙ্গীতের ধারা চালু রাখেন। লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক ও বিশেষজ্ঞ মনসুর উদ্দীন মুর্শিদি গানের উদ্ভবের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, “বৌদ্ধ-বৈষ্ণব ভাবধারার মিশেলে গুরুবাদী আধ্যাত্ম সাধনা এ দেশে আগে থেকেই ছিল। পরে ধর্মান্তরিত মুসলমান মরমিয়া সাধনায় সুফিবাদের প্রভাবে ‘মুরশিদিবাদ’ গড়ে উঠে। চিশতিয়া তরিকার প্রবর্তক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির ফরাসি গজলে গুরুবাদী সাধন তত্ত্বের নিদর্শন আছে। মঈনুদ্দিন চিশতিসহ এ দেশের অনেক সুফি সাধক গান বাজনা পছন্দ করতেন।” (মনসুর উদ্দীন সম্পাদিত, হারামনি, লোকসঙ্গীত সংগ্রহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৫৯)। এ সঙ্গীত পন্থা অবলম্বন করে বাংলাদেশে মুর্শিদি গানের প্রচলন হয়।
সঙ্গীতের এ প্রেমময় ধারা উপলব্ধি করতে হলে সুফিবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও তা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে; তা না হলে এ তত্ত্বসঙ্গীত অজানাই থেকে যাবে; এর রূপ-রস, মনি-মঞ্জুসার কোনো আভাস পাওয়া যাবে না। উপরন্তু দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ধারণা ও মরমি কবির গভীর তাত্ত্বিক আলোচনার দান্দ্বিকতায় মানব মন বিভ্রান্ত হতে পারে। ধরণীর বুকে আমাদের অবস্থানকাল ও ধরণীর প্রবাহকাল এক নয়, রয়েছে ধারণাতীত ব্যবধান, অবশ্যই আমাদের মনোজগতে জ্ঞানের এ ব্যবধানের প্রভাব থাকবে। মনোজগতে উদার-বিশালতা নিয়ে আলোর সন্ধানে এগিয়ে না আসলে এ ব্যবধান কমবে না। হৃদয় প্রদীপ আলোকিত করতে হলে আলোর উৎসের সংস্পর্শে যেতেই হবে।
স্রষ্টার পরিচয় লাভের বিজ্ঞান সৃষ্টির আদিমতম বিজ্ঞান। যে বিজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ পরম করুণাময় আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারে, আত্মশুদ্ধি লাভের মাধ্যমে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়ে আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় পৌঁছতে পারে তাকে সুফিবাদ বা এলমে তাসাউফ বলে। বিজ্ঞান দুই প্রকার। একটি হলো জাগতিক বিজ্ঞান এবং অন্যটি হলো আত্মিক বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। সুফিবাদের জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দয়াময় আল্লাহর অস্তিত্ব বাস্তবে উপলব্ধি করে, তাঁর সান্নিধ্য অর্জন সম্ভব হয়। অনেকে সুফিবাদ (ঝঁভরংস) মতবাদটিকে মরমিবাদ (গুংঃরপরংস) নামেও আখ্যায়িত করেছেন। সুফিবাদকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় তাযকিয়ায়ে নফ্স বলা হয় এবং বিভিন্ন গ্রন্থে এলমুল কালব, এলমে মারেফত, এলমে লাদুন্নি, এলমে মোয়মেলা, এলমে মোকাশেফা, এলমে বাতেন প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে দয়াময় আল্লাহ্ বলেন, “আমি তোমাদের (ক্বালবের সপ্তম স্তর) নাফসির মোকামে বিরাজ করি। তবুও কি তোমরা দেখ না?” (সূরা আয যারিয়াত ৫১: আয়াত ২১)। যুগে যুগে পৃথিবীতে যত নবি-রাসুল, অলী-আল্লাহ্ এসেছেন প্রত্যেকেই আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে, তাঁর নির্দেশিত পন্থায় নিজে চলেছেন এবং তাঁদের অনুসারীদেরকে পরিচালিত করেছেন। আল্লাহর সাথে এ যোগাযোগের পন্থাই সুফিবাদ। আত্মাময় জগতের যত বিশেষ জ্ঞান রয়েছে তা সুফিবাদ চর্চার মাধ্যমে অর্জিত হয়। মানব দেহের যেমন রোগ ব্যাধি আছে, আত্মারও তেমনি রোগ ব্যাধি আছে। দেহের যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয় আছে, আত্মারও তেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয় আছে। দেহের খোরাক যেমন খাদ্য ও পানীয়, আত্মার খোরাক বা আহার হলো ফায়েজ এবং আল্লাহর জিকির। সুফি সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মিক পঞ্চ ইন্দ্রিয় জাগ্রত করে আল্লাহময় জগতের সমস্ত তথ্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। (ড. সৈয়দা তাকলিমা সুলতানা, সূফীবাদের আত্মপরিচয় ও ক্রমবিকাশের অন্তরায়)। তাই সুফিবাদ হলো ধর্মের আত্মা। এ সাধনার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো প্রভুর জ্ঞান লাভ করা-প্রভুকে হৃদয়ে ধারণ করা। তাই এ দর্শন নতুন কিছু নয়। প্রখ্যাত সুফি হযরত জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মসনবীতে’ বলেছেন, “তুমি যদি একটি নিকৃষ্ট পাথরতুল্য হও, তবে কোনো অলীর সংস্পর্শে গেলে সে তোমাকে পরশ পাথরতুল্য করে দিবে।”
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন- সুফিবাদের ঐ বিশেষ জ্ঞান দ্বারা মানুষ আল্লাহর পরিচয় এবং ইহলৌকিক শান্তি ও পরলৌকিক মুক্তির সন্ধান লাভ করতে পারে। এ জ্ঞান অর্জন করতে হয় এল্মুল ক্বালবের সাহায্যে। মরমি কবিদের গানে এ বিষয়টিই মূর্ত হয়ে উঠে। মরমি কবি লালন সাঁই গেয়ে যান-
“পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়
রূপকাষ্ঠের নৌকাখানি নাই ডুবার ভয়
সেই নৌকার নাই ডুবার ভয়।।
বেশরা নেয়ে যারা
তুফানে যাবে মারা একই ধাক্কায়
কি করবে (তোর) বদর গাজী থাকবে কোথায়
বদর গাজী থাকবে কোথায়।।
নবী না মানে যারা
মোহায়েদ কাফের তারা এই দুনিয়ায়
ভজনে তার নাই মজুরি সাফ লেখা যায়
দলিলে সাফ লেখা যায়।।
যে মুর্শিদ সেইতো রসুল
তাহাতে নাই কোন ভুল খোদাও সে হয়;
লালন বলে নাই এ কথা কোরানে কয়
সে কথা কোরানে কয়।।”
‘মোর্শেদ’ আরবি শব্দ, যার অর্থ পথপ্রদর্শক। যিনি সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় ও দিদার লাভ করেছেন, যিনি আল্লাহ্ ও রাসুলের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং অপরকে আল্লাহ্ ও রাসুলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সক্ষম তাঁকেই মোর্শেদ বলে। ‘মোর্শেদ’ শব্দের ফারসি প্রতিশব্দ হচ্ছে পির বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। পারস্য দেশের সুফি-সাধকগণ মোর্শেদ অর্থে পির শব্দটি ব্যবহার করতেন, যা কালক্রমে আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। তাই আমাদের সমাজে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গুরুকে ‘পির’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, যিনি মুরিদকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ও রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সক্ষম। তিনি মুরিদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন, হৃদয়ে ইমানের বীজ বপন করেন, মুরীদের চরিত্রকে সংশোধন করে দেন। মোর্শেদ মুরীদেরে অন্তরের খবর রাখেন, বিপদ থেকে রক্ষা করেন, নিজের জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসেন। (ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.), মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়, পৃষ্ঠা ১৩৬)। মোর্শেদ হওয়ার জন্য অলী-আল্লাহ্ হওয়া শর্ত। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “মু’মেন ব্যক্তির দিল হচ্ছে আল্লাহর আরশ।” অলী-আল্লাহ্গণ হচ্ছেন আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান। তাই তাঁদের আদর্শ ও শিক্ষা গ্রহণ করলে মানুষ চরিত্রবান হয়। আর চরিত্রই ধর্মের মূল। মুক্তিকামী মানুষ তাই তার মোর্শেদকে হৃদয়ের গভীরে স্থান দেয়, তাঁকে প্রাণ ভরে ভালোবাসে। তাই যেসব গানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মোর্শেদই প্রাধান্য পায় তাকে মুর্শিদি গান বলে। সাধক তাই ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে তার মুর্শিদকে স্মরণ করেন-
বেলায়াতে মুর্শিদ হইয়া, – “আসিলেন দ্বীনের নবী”।
মুর্শিদকে না পাইলে কি আর, রাসুল পাবি ৷
রাসুল জন্ম নিলো মক্কা, গেলে কেহ পায় না দেখা ৷
“কি দেখতে যাবি”৷
মদিনায় তার রওজা আছে, খুঁজলে কি দেখা পাবি ৷
মন তুই, খুঁজলে কি দেখা পাবি ৷
আপনা পীরের সোরাতে, সেইতো রাসুল হাকিকতে ৷
“হাতে হাত দিবি”৷
ঐ নবীজির হাত ধরিয়া, সিরাত পার হইয়া যাবি ৷
মন তুই, সিরাত পার হইয়া যাবি ৷
ইশ্রাইল শাহ কয় হাসান, যে নবী সামনে বর্তমান ৷
“তার তালিম নিবি”৷
রাসুল আমার বান্দার হায়াত, হায়াতে জিন্দা নবী ৷
আমার, হায়াতে জিন্দা নবী ৷
মুর্শিদি গানের প্রাণ সুফি দর্শন। এখানে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রভুপ্রেম মূর্ত হয়ে উঠে। যেন সমস্ত পৃথিবীতে একই সুর-হৃদয় বীণায় ঝংকৃত হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য সুদুর পারস্যের কবিদের মুখের ভাষা যেন সুর খুঁজে পায়, বাংলার বাউলের কন্ঠে। কারণ প্রেম সত্য-অবিনশ্বর। বিখ্যাত সুফি নূর আদ-দীন আবদার রহমান জামি (রহ.) এর একটি গান-
“মানতুজে খাকেম ও খাক আজ জামিন,
হামা বেহ কে খাকী বুওয়াদ আদমী”
আমি এবং তুমি মাটি হতে সৃষ্ট, যদি মাটির মত হও তাহলে তোমার মনুষ্যত্ব বিকাশ পাবে।
একই গান হুবহু ভেসে উঠে বাংলার বাউলের সুরে-
“মরার আগে ম’লে শমন জ্বালা ঘুচে যায়।
জান গো সে মরা কেমন, মুরশিদ ধরে জানতে হয়।
যে জন জেন্দা লয় খেলকা কাফন
দিয়ে তার তাজ তহবন,
ভেক সাজায়।
মরার আগে ম’লে শমন জ্বালা ঘুচে যায়।”
মুরিদের প্রাণজুড়ে থাকে মোর্শেদকে পাবার বাসনা। মোর্শেদকে ছাড়া মুরিদ কিছুই কল্পনা করতে পারে না, সকল কিছুই তার কাছে অর্থহীন। পরম সত্তাকে পেতে হলে মোর্শেদের দয়া অপরিহার্য। মুর্শিদি গানে হৃদয়ের সেই আকুলতা প্রকাশ পায় কুতুবুল আকতাব হযরত সৈয়দা হামিদা বেগম (রহ.)-এর লিখা একটি মুর্শিদি গান-
”আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।
আমি মরলে দেওয়ানবাগী আমায় সঙ্গে করে নিও,
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
এ বাজারের পানি দিয়ে আমায় গোসল না করাইও, গোসল না করাইও;
দেওয়ানবাগীর চরণ ধোয়া পানি দিয়ে আমায় তোমরা, গোসলও করাইও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
এ বাজারের আতর গোলাপ আমার অঙ্গে না মাখাইও, অঙ্গে না মাখাইও;
দেওয়ানবাগীর চরণধূলি আমার অঙ্গেতে মাখাইও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
এ বাজারের আগরবাতি আমার কাছে না জ্বালাইও, কাছে না জ্বালাইও;
মহব্বতের ফায়েজে আমায় মোহিত করাইও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
এ বাজারের সাদা কাপড় আমার অঙ্গে না পরাইও, অঙ্গে না পরাইও;
দেওয়ানবাগীর ছেড়া নেকড়ায় কাফনও পরাইও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
এজিদের ঐ দোসর দিয়ে আমার জানাজা না দিও, জানাজা না দিও;
দেওয়ানবাগীর আশেক দিয়ে আমার জানাজা পড়াইও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
অন্য কোথাও আমায় তোমরা সমাধি না দিও, সমাধি না দিও;
আমার মোর্শেদের পাক দরবারে তোমরা সমাধি মোর দিও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।
কুরান পড়ে – কিতাব পড়ে আমায় দোয়া না করিও, দোয়া না করিও;
দেওয়ানবাগীর মুখের বাণী আমার, দয়াল বাবার মুখের বাণী আমার কদরে পৌঁছাইও;
আর কিছু যে চাইনাগো দেওয়ানবাগী, আর কিছু যে চাইনা।।”
মুর্শিদি গানে গুরুকে দুই রূপে দেখা হয়। একদিকে মোর্শেদ হচ্ছেন মানব গুরু, অন্যদিকে মোর্শেদ হচ্ছেন পরমগুরু। মানব গুরুর কাছে দিক্ষা না নিলে স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভ করা যায় না। তাই মরমি সাধক লালন সাঁই বলেন-
“সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার
ভবে মানুষ গুরু দীক্ষা যার।”
মরমি ও মুর্শিদি গান হলো প্রার্থনামূলক গান। ভক্ত বিপদে মোর্শেদের দয়া ভিক্ষা চান। গানের ভাষায় মুরিদ মোর্শেদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। মোর্শেদ শত সহস্র মাইল দূর হতে ভক্তের ডাকে সাড়া দেন। এক আশেক-মাশুকের খেলা। মোর্শেদের বিরহ যাতনা মুরিদ সহ্য করতে পারে না। আশেকে রাসুল জসিম খান তাই গেয়ে যান-
“কতদিন হয় দেখিনাগো তোমার চন্দ্রমুখ,
কোন বা দোষে মোদের প্রতি হইলারে বিমুখ।
মুর্শিদও, ঘুরি আমরা আশেকেরা তোমায় দেখিতে,
জাদু ভরা মুখের হাসি পাইনা দেখিতে,
চাইনা আমরা ভুলে যেতে তোমার চন্দ্রমুখ,
কোন বা দোষে মোদের প্রতি হইলারে বিমুখ।”
মরমি ও মুর্শিদি গানের কথাগুলো কাব্যিক এবং তত্ত্বময়। অনেক সময় পন্ডিত লোকও আধ্যাত্মিক গানগুলোর অর্থ বুঝতে পারেন না, আবার অনেক সময় অতি সাধারণ মানুষ এর নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করতে পারেন। কারণ মোর্শেদের সান্নিধ্য না পেলে আধ্যাত্মিক সত্তার বিকাশ ঘটে না। এ গানগুলো অসাম্প্রদায়িক- প্রার্থনামূলক বাউল গান। অনেকসময় গানগুলোর গীতিকার ও সুরকার পাওয়া যায় না। মূল উদ্দেশ্য হলো গানে গানে প্রেমের মাধ্যমে মোর্শেদের নিকট প্রাণের আকুতি তুলে ধরা।
মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার বাসনা মানুষের চিরন্তন। একাকী সাধনা করে ষড়রিপুর বেড়াজাল হতে মুক্ত হয়ে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর নৈকট্য লাভ অসম্ভব। তাই প্রয়োজন কামেল মোকাম্মেল একজন অলী-আল্লাহ্কে মোর্শেদ রূপে গ্রহণ করে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণ করা। মোর্শেদের প্রেমাকর্ষণে দিশেহারা হয়ে সুরের মুর্ছনায় মুরিদ যখন তার অনুভূতি প্রকাশ করে, তাইতো মুর্শিদি গান। এখানে ভিন্ন চিন্তা অপ্রাসঙ্গিক। অলী-আল্লাহ্গণের সংস্পর্শে মানুষের চরিত্রের মলিনতা দূর হয়ে, হৃদয় আলোকিত হয়ে উঠে। সুর, মহান আল্লাহর নেয়ামত। দয়াময় আল্লাহ্ হযরত দাউদ (আ.)-কে অত্যন্ত মিষ্টি কন্ঠস্বর দিয়েছিলেন। মরমি ও মুর্শিদি গান মানুষকে আল্লাহর পথ হতে গোমরাহ করে না, এখানে কোনো অবান্তর কথাবার্তা নেই। বরং এ গানগুলো মানবাত্মাকে ঐশী প্রেমের ফায়েজে সিক্ত করে পরমাত্মার দিকে ধাবিত করে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
