| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

নূতন জীবন, এবং

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আমার বিয়েটা পুরোপুরি দেখাশোনার বিয়ে,একটি ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে সম্বন্ধ করে।বিয়ের আগে মাত্র দুবার দেখা হয়েছিলো আমার ওনার সাথে।একদম অপরিচিত একটি মানুষকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম। দ্বিধাদ্বন্দ্ব, দোলাচল ছিল মনে।মন তৈরী ছিলো না পুরোপুরি।

আমার শ্বশুরবাড়ি কুচবিহার জেলার সিতাইএ।এর আগে গ্রাম বলতে সিনেমা আর সাহিত্য ছাড়া কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিলো না।তা কি ভাবে বাঁশের সাঁকো পেড়িয়ে সারা গ্রাম ঘুরে শ্বশুরবাড়ি পৌছলাম,তা আমার কনে বিদায় রম্যরচনায় লিখেছি।তা শ্বশুর বাড়ি তো পৌঁছলাম।আমার সাথে আমার দুই বোন,পিউ আর মিতুন।পিউএর মেজাজটা একটু চড়া তারে বাধা বরাবরই।আর সারা রাস্তার ধকলে চড়া মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।আমারই বা কি এমন ভাল অবস্থা।মনে হচ্ছে কেউ একটা বালিস এনে দিলে উঠোনেই শুয়ে পড়বো।ক্লান্তিতে হাত পা খুলে আসছে।শুরু হল নানাবিধ নিয়ম।চালের বস্তা দেখে কিসব যেন বলতে বললো।গড়গড় করে বলে গেলাম।আর কত কিছু, বাপ রে, এই এগারো বছর পরে মনে করলেও ভয় লাগে।বাড়ি ঢোকার পর থেকেই পিউএর পাত্তা নেই।মিতুন ঈশারা করলো,সব ঠিক আছে।মিতুন, বেশ ঠান্ডা মাথার মানুষ।ভরসা করা যায়।পিউটা আমারই মতন,ছিটেল।যাই হোক একসময় সব নিয়ম শেষ হল সেদিনের মত।জানতে পারলাম সেদিন নাকি কালরাত্রি।অর্থাৎ বরের শ্রীমুখ দর্শন করা যাবে না।বাঁচা গেল।কী আনন্দ।তিন বোনে মিলে আমাদের এক ঘরে শোবার ব্যবস্থা হল।পিউএর অবস্থা শোচনীয়। বিয়েবাড়ির খাওয়াদাওয়া, তারপর এতটা রাস্তার ধকলে পেটের অবস্থা কাহিল।পুরো রাস্তা সে কোনরকমে চেপে বাড়ি অব্ধি এসে শরীর ছেড়ে দিয়েছে।আমারও কেমন পেট গুড়গুড় করছে।কিন্তু কাকে বলি।বাথরুমে যেতে গেলেও দুটো ঘর পার করে জনা পঞ্চাশেক লোকের চোখের সামনে দিয়ে যেতে হবে।নতুন বউ বলে কথা।ঠিক কোন ঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেটাও ঠিক মনে নেই।ধুত্তোর,যা থাকে কপালে মনে করে চোখ বুজলাম।কোনরকমে রাতটা পার হলে বাঁচি।

কিন্তু রাত পার করতে চাইলেই কি পার হয়?হায় রে, ঠিক মাঝ রাতে পেট গুরগুর।কি করি।মিতুনকে ঠেলে তুললাম।এবার সমস্যা হল রাস্তা গুলিয়ে গেছে।একে ঘোর অন্ধকার,তার উপর ঘুমের চোখে বাথরুমে যাবার রাস্তা আর খুঁজে পাচ্ছি না।যা থাকে কপালে,সামনে যে দরজা পেলাম, প্রাণের দায়ে ধাক্কা দিতে শুরু করলাম।বেশ কিছুক্ষন কোন সাড়া পেলাম না।তারপর খুট করে একটা শব্দ হল দরজা খোলার।চিচিং ফাঁক।সামনে শ্বশুর মশাই দাঁড়িয়ে। হে ধরনী দ্বিধা হও।কি লজ্জা কি লজ্জা।কোন রকমে পাশ কাটিয়ে আমরা তিন মুর্তি ছুঁট লাগালাম।ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে কোন ঘর, কোন দিকে,কোথা দিয়ে যাব, কিছুই ঠাহর পাচ্ছিনা।শেষ পর্যন্ত এসে পৌছলাম সেই আকাঙ্ক্ষিত দরজার সামনে।হাতরে হাতরে আলো জ্বেলে দেখি ঠিক দরজার মুখে আমার বরটি অঘোরে ঘুমোচ্ছেন মেঝেতে বিছানা পেতে।হায় রে কালরাত্রি।মুখ দেখা নাকি বারণ।

সেই রাতটা আর কোন উপদ্রব ছাড়াই কাটলো।সকালে মিতুন চুপিচুপি গিয়ে তার নতুন জামাইবাবুটিকে আমাদের অবস্থা বুঝিয়ে ওষুধ আনতে পাঠালো।ও বলা হয় নি,আমার এই বোনটি তখন হাফ ডাক্তার,মানে মেডিক্যাল পড়ছে।তাতে ওষুধ দিতে আটকায় না।সেদিন আমার বউভাত।

আজ এতদিন পর সেইসব কথা ভাবলে খুব হাসি পায়।আমরা বোনেরা হাসাহাসি করি।কিন্তু সেইদিন কিন্তু একটুও হাসি পায়নি।কান্না পাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল এ কোথায় এসে পড়লাম।সেই এসে পড়াটা আরো কষ্টকর হতে পারত।যার জন্য হয় নি,সেই অচেনা মানুষটিকে ততদিনে ধীরে ধীরে চিনতে শুরু করেছি।বাড়ি ভর্তি অপরিচিত লোকের মাঝে ঐ সদ্যচেনা মুখটিকে খুঁজেছি হয়ত নিজের অজান্তেই।

আমার শ্বশুরবাড়ি অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো,গ্রামের বাড়ি যেমন হয়।অনেক রকম গাছ,বিশাল উঠোন,তুলসীমন্ডপ,পুকুর।বিয়ে বাড়ি ভরা লোকজন।আমার শ্বশুর বাড়িতে দেখেছি কোন অনুষ্ঠানে দুর দুরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনরা আসেন।এত লোক।কাউকে চিনিনা।সবাই এসে পরিচয় করে যাচ্ছেন।আমি তোমার অমুক হই,আমি তমুক হই।আমিও ঢিপঢিপ করে প্রণাম করে যাচ্ছি।মনে তো থাকছে না কাউকেই।কাউকে দুতিন বারও প্রণাম রিপিট হয়ে যাচ্ছে।তা যাক।বাদ না পড়লেই হলো।এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করানো হল।প্রণাম করে মাথা তুলতেই সবাই চারপাশে হা হা করে উঠলো।আরে ওকে প্রণাম করছো কেন?ও তো বাপ্পার(আমার তেনার ডাক নাম) চেয়ে ছোট,সম্পর্কে তোমার দেওর হয়।কি কেলো।দেওরকে প্রণাম করতে হয়না বুঝি?সেসব আমি থোরাই জানি।কি জ্বালা।এতক্ষন কেমন নিশ্চিন্তে প্রণাম করে যাচ্ছিলাম।এবার থেকে আবার বড় ছোট বুঝতে হবে।শুধু বয়সে বড় ছোট বুঝলেই হবেনা।সম্পর্কে বড় ছোটও বুঝতে হবে।ওরে বাবারে। এর চেয়ে আমার ইঞ্জিনিয়ারিঙে অটোমেটা থিয়োরী ঢের সহজ ছিলো।

বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ হলে সেই রাতেই কনেযাত্রীর সাথে পিউ আর মিতুন ফিরে গেল কুচবিহারে। নতুন সংসার, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন। এত বছর বাড়ি ছেড়ে হস্টেল মেসে থেকে আমি ভীষণভাবে স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম সমস্যা হল শাড়ি পড়া নিয়ে।সারাদিন শাড়ি পড়ে থাকা,তাও না হয় হল।তার উপর ঘোমটা দিতে হবে। না কেউ নিয়ম জারি করেননি আমার উপর। শ্বশুরমশাই অনুরোধ করেছিলেন। সেই শাড়ি উঠতে বসতে পা এ জড়াচ্ছে। ঘোমটা তো মাথায় থাকবেই না,পণ নিয়ে বসে আছে যেন। একবার তো একঘর লোকের সামনে কুঁচি খুলে টুলে গিয়ে সে এক কেলেংকারী। শেষমেষ ঘোমটার কয়েদ থেকে মুক্তি দাওয়া হল।আমার অবস্থা দেখে বোধ হয় সবার মায়া হয়েছিল।তাই সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হল, দ্বিরাগমন সেরে ফিরে আর শাড়ি পরতে হবে না বাড়িতে। অবশ্য এই সিদ্ধান্তের পেছনে আমার ওনার হাত ছিল,সেটা তিনি না বললেও আমি জানি। সবাইকে বুঝিয়ে মত করিয়েছিলো।

বউভাতের পরেই দূরের আত্মীয়স্বজনেরা বেশীভাগ ফিরে গিয়েছিলো।তবুও বাড়িতে প্রচুর লোক।এত লোকের ভীরে আমার নতুন বিয়ে করা বরটির সাথে সময় কাটানো,বা কথা বলার সুযোগ ছিল না।একঘর লোকের মাঝে এক ঝলক চোখাচোখি, ওইটুকুই বরাদ্দ।যেই দ্বিধা নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসেছিলাম,সেটা কাটতে শুরু করেছিল।ঠিক প্রেম হয়তো নয়,কিন্তু একটা বিশ্বাস,নির্ভরতার জায়গা তৈরি হচ্ছিল।আর তার সাথেই এগিয়ে আসছিল ছুটি শেষের দিন।কিন্তু সত্যি বলতে কি,আমি সেভাবে কোন কষ্ট বা বিরহ গোছের কিছু অনুভব করিনি।বরং স্বীকার করতে লজ্জা নেই,আমার মন আমার পুরনো জীবনে ফিরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিল।আমার মেসের ঘর,একান্ত নিজের বিছানার পরিসরটুকু,আমার বইগুলো আমায় যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছিল।এভাবেই এগিয়ে এল ফিরে যাবার দিন।তার আগে মধুচন্দ্রিমা, শিলং এর পাহাড়ে।

এই প্রথম তাকে ভীরের থেকে আলাদা করে চেনার সুযোগ পেলাম।মনে হল বন্ধু হওয়াই যায়।তার ও আমার স্বভাবে আকাশ পাতাল তফাত।সে শান্ত,ধীর স্থির।আর আমি,থাক,নাই বা বললাম।তাও যদি নিতান্তই জোরাজুরি কর,তাহলে বলি,আমি অতি চঞ্চলমতি,মানে যাকে বলে ধিংগী অবতার ; মাথায় মাঝেমধ্যেই পাগলামোর পোকা নড়ে।সে আমার মত একটি পরমাশ্চর্য বউ পেয়ে কতটা খুশি হল, বা দুঃখ পেল জানি না।দুঃখই পেল বোধ হয়।আর সেই দুঃখেই বোধ হয় জ্বর বাধিয়ে বসলো।ধুম জ্বর।শিলং বেড়ানো পুরো মাটি।

কলকাতায় ফিরে এলাম।দুদিন পর সেও ফিরে যাবে তার কর্মস্থল,আমস্টারডামএ।যাবার দিন যত এগিয়ে আসছে,আমি নিজেই অবাক হচ্ছি দেখে,কই, আমার তো একটুও কষ্ট হচ্ছে না।বরং ভেতর ভেতর বেশ খুশি হচ্ছি।মনে হচ্ছে,যাক,বিয়ে বিয়ে খেলা শেষ।আমি আবার মুক্ত বিহঙ্গ। তার মন খারাপ,বুঝতে পারছি।আমি মনের ভাব মনে চেপে বেশ দুঃখ দুঃখ মুখ করে আছি।কিন্তু দুঃখটা হচ্ছে না মোটেই।যাবার দিন সকাল থেকে ব্যস্ততার মাঝে কিছু ভাবার সময় পেলাম না।ঠিক ছিল ও আমায় মেসে ছেড়ে দিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যাবে।ট্যাক্সিতে উঠলাম সব বাক্স প্যাটরা নিয়ে।ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো।আর আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, আমি কাঁদছি।না না, এবার কোন অভিনয় নয়।সত্যি কাঁদছি আমি।খুব কাঁদছি।নিজের উপর রাগ হচ্ছিল।কেন কাঁদছি আমি?এটাই তো চেয়েছিলাম আমি।এই স্বাধীন,নিজের শর্তে নিজে বাঁচার জীবন।তাহলে কেন এই চোখের জল?আমার মেসের সামনে ট্যাক্সি এসে থামলো।এবার তার যাবার পালা।বলার বিশেষ কিছু ছিলোনা।আমার চোখের জল বোধ হয় তাকে সবই বলে দিয়েছিল।শুধু কি তাকেই?আমাকেও কি নয়?

কান্নাভেজা গলায় শুধু এটুকুই বলতে পারলাম,তাড়াতাড়ি ফিরো।ট্যাক্সিটা দূরের রাস্তায় বাঁক নিল।এখন শুধুই অপেক্ষা।সে বলে গেছে,ফিরবে খুব তাড়াতাড়ি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত