অনুবাদ গল্প: একজোড়া জুতো । নয়নমণি হালৈ
লেখক পরিচিতি-গল্পকার নয়নমণি হালৈ অসমের নলবারীর বরসরকুছিতে জন্মগ্রহণ করেন।অসমিয়া সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।কর্মজীবনে রাষ্ট্রীয় দক্ষতা বিকাশ বিভাগের প্রকল্প রূপায়ক।আলোচ্য গল্পটির কাহিনি নিয়ে NSD সিকিম তথা JNU দিল্লি থেকে Arts and aesthetics য়ে অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করা অসমের ‘কিশোর ভরদ্বাজ বরুয়া ছোটো সিনেমা নির্মাণ করেছে।লেখকের গল্প,কবিতা এবং চলচ্চিত্র আলোচনা অসমের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
অসমিয়া এই গল্পটি বাংলা অনুবাদ করেছেন বাসুদেব দাস।
বিক্রমের এক জোড়াই জুতো।
পারতপক্ষে সে জুতো পরে না। হাতে বেলচা নিয়ে ট্রাক থেকে শিল, বালু,আদি নামানোর জন্য জুতোর প্রয়োজন নেই। আসলে তার জীবনে জুতোর প্রয়োজনই হল না; কিন্তু তথাপিও তাকে একজোড়া জুতো জোর জবরদস্তি কিনে দিয়েছিল রামেশ্বর এবং বুধি। সেই জোড়া পরে জানকীকে দেখতে গিয়েছিল আর তার একমাস পরে সে জানকীকে বিয়ে করে এনেছিল। বিয়ে আর কী, গ্রামের ছেলেরা একটা ভোজ খেয়ে ছিল, ট্রাকের মালিক তাকে একজোড়া কাপড় আর এক হাজার টাকা দিয়েছিল, রামেশ্বর বুধিরা গলা পর্যন্ত গিলেছিল আর কনের বাড়ির উঠোনে নেচে নেচে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সেদিন বড়ো স্ফুর্তি হয়েছিল, দুটো ছেলের জন্মের সময় রামেশ্বরদের ততটা স্ফুর্তি হয়নি। তারপরের দিনগুলি বিক্রমের জন্য ট্রাকের ঘর্ঘর, ধুলোবালি, পাথর বালুর মতোই নীরস এবং বিবর্ণ হয়ে এসেছিল। কিন্তু বহুদিন পরে বিক্রমের জীবনে পুনরায় স্ফুর্তি করার একটা দিন এল এবং তখনই তার জুতো জোড়ার কথা মনে পড়ল।
বিক্রমের শালীর বিয়ে। জনকীর ছোটো দুই বোনই কয়েকদিনের ব্যবধানে দুটো ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। কারোই খুব একটা খারাপ লাগল না, শুধুমাত্র মা রান্না ঘরে দুদিন চোখের জল মুছল,বাকি সংসারের একটা গাছের পাতাও নড়ল না। কিন্তু ছোটো বোনটি বড়ো লক্ষী মেয়ে। সেই জন্য ভালো পাত্র নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে এবং পাত্র এক বাক্যে বলে গেছে যে মেয়েকে সে সমাজকে সাক্ষী রেখে গ্রহণ করবে, না হলে দরকার নেই। দুই মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করার পরে বুড়ো বাপের একটু আনন্দ স্ফুর্তি করার ইচ্ছা হল, আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীরাও একটু উৎসাহ দিল, বিক্রমও জীবনে আর কত ট্রাকের ঘর্ঘর ধ্বনি শুনবে, সেও খারাপ পেল না। পুরোনো কালের ঘর এবং রান্নাঘর থেকে দুদিনের জন্য মুক্তি পাওয়ার আনন্দটুকু ধরে রাখতে না পেরে জানকীরও দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এসেছিল এবং আজকাল করতে করতে বিয়ে এসে যেন বারান্দায় পৌছে গেল। বিক্রম জানকীকে জুতো জোড়ার কথা পুনরায় একবার মনে করিয়ে দিল। জানকী পুরোনো দিনের ঘরের কোনো একটি কোণ থেকে যখন জুতো জোড়া বের করে আনল, দেখেই বিক্রমের জুতোজোড়াকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করল। আছে, জুতো জোড়া যেভাবে রেখে দিয়েছিল, সেভাবেই আছে। অবশ্য না থাকবেই বা কেন। সে আর কতদিন পরেছে। স্ত্রীকে সে ছেঁড়া কাপড়ে একটু মিঠা তেল দিয়ে মুছে জুতো জোড়া রোদে দিতে বলল; কিন্তু স্ত্রী তার মাথায় ঢুকিয়ে দিল কথাটা, ‘এই জোড়া যদি টাউনের একটা মুচিকে দিয়ে পালিশ করিয়ে আনেন, তাহলে একেবারে চকচকে হয়ে যাবে।’বেলচাটা নিয়ে বিক্রম পথে নেমে পড়েছিল, এটাই শেষ বিয়ে, কাপড়-চোপড় অলংকারাদির ক্ষেত্রে একটু জাঁকজমক করার ইচ্ছে যে তার ছিল না তা কিন্তু নয়।তারমধ্যে সে বড়ো জামাইবাবু,বিয়ের অনেকগুলি দায়িত্বই তার মাথার ওপরে।সে ফিরে এল এবং জুতোজোড়া একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
পুরোনো বাসস্ট্যাণ্ডের গায়ে লেগে থাকা চৌ্রাস্তার মুচিটার নাম নন্দু।কিন্তু এই নামটা অনেকেই জানে না,তবে তার মুখের একটা কথার জন্য তাকে পুরো শহরের লোকেরা জানে।‘জিন্দেগীত কী আছে হে,আজ আছি কাল নেই’,ঠিক এভাবে আরম্ভ করে,টাকা পয়সা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না,গ্রাহক যা দেয় তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া মানুষ সে।তারপরে সে পুরোনো একটা হিন্দি গান জোরে জোরে গায়।গানটাতে তোঁ জিন্দেগী শব্দ থাকেই,‘জিন্দেগী এক সফর হে সুহানা…’ ।এই ধরনের গান।বড়ো স্ফুর্তিবাজ মানুষ্টা।ঘর্ঘর শব্দ করে তার সামনে বিক্রমদের ট্রাকটা সেদিন থেমে গেল।গাড়ির বডি থেকে লাফ দিয়ে বিক্রম নামল এবং জুতোজোড়া নন্দুকে দিয়ে রেখে আসল।গাড়ির ওপর থেকেই রামেশ্বর চিৎকার করল,ঃঐ জিন্দেগী শালির বিয়ে,চকচকে হয়ে থাকতে হবে কিন্তু।
সেদিক থেকে নন্দুও চিৎকার করল,ঃ জিন্দেগীতে কী আছে,জুতোহে।
একগাদা কালো ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে ট্রাকটা তারপরে রাস্তার কোলাহলে মিলে গেল।সন্ধের আগে আগে নন্দুর সামনে যখন ট্রাকটা দাঁড়িয়ে পড়ল,তখন নন্দু তার খসে পড়া অদ্ভুত রঙ ধরা পুরোনো বেগ একটাতে তার উপকরণ গুলি ভরে নিল।‘ঐ দাঁড়া দাঁড়া’,বলে বিক্রম গাড়ি থেকে নেমে তার কাছে দৌড়ে গেল।এবার ও নন্দু ডায়লগ একটা মারার জন্য ভুলল না,জিন্দেগীতে টাইমের মূল্য আছে আমার ,আধঘন্টা দেরি হল তোর জন্য।
ওপর থেকে রামেশ্বর চিৎকার করল,ঃ এমনিতেই টাইমে চলা, গাজা খেতে হে যাবি ,আর কোথায় যাবি?নন্দু ও তার দিকে তাকিয়ে,ঃ ঐ জিন্দেগীতে আর কি আছে?খেয়ে দেয়েই তো জীবন বলে একটা চিৎকার করে উঠল। রাতে জুতো জোড়ার প্যাকেটটা বিক্রমের ঘরের বারান্দায় ঝুলে রইল। পরের দিন সকালে যাবার জন্য সবার তাড়াহুড়ো লাগল এবং পরার জন্য জুতো জোড়া যখন বিক্রম হাতে তুলে নিল তখন তার চোখ কপালে উঠে গেল। এই জোড়া দেখছি তার জুতো জোড়া নয়। সে চিৎকার করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল ঃ ঐ চারের পাশে তিনটে নয় বসিয়ে দিলে কত হয়? স্ত্রী পাঠশালার গণ্ডি পার হয়ে এসেছে;সে চট করে উত্তর দিল, পাঁচ হাজার, কেবল এক টাকা কম।
তারপর স্ত্রী বেরিয়ে এসে যখন বিক্রমের হাতে জুতো জোড়া দেখল এবং দামটা জুতো জোড়ার ভেতরে জ্বলজ্বল করতে দেখল সে একপ্রকার আর্তনাদ করে উঠল,–’তুমি পাঁচ হাজার টাকার জুতো কিনে আনলে?কোথায় পেলে এত টাকা? বিক্রম রেগে উঠে চিৎকার করে উঠল,–’ দাঁড়া চেচামেচি করবি না। একসঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা আজ পর্যন্ত দেখিনি। নন্দু নিশ্চয় ভুল করেছে।সে আমার জুতোর বদলে অন্য কারও জুতো পাঠিয়ে দিয়েছে।
—কী সুন্দর জুতো জোড়া! দেখলেই দামি যে বোঝা যায়।
জানকী জুতো জোড়া চোখের সামনে তুলে ধরল।
–একটা কাজ করি। তোরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, আমি শহরে গিয়ে নন্দুকে জুতো জোড়া দিয়ে আসি।
—দাঁড়াও কাল বিয়ের দিন না হয় এই জোড়া জুতোই পর ।একদিনের তো কথা। তারপরে না হয় দিয়ে আসবে।
— কিন্তু জুতো জোড়া বা কার! যদি কোনো মূর্খ মানুষের হয় নন্দুকে গালিগালাজ করবে।
—এত খারাপ মানুষ হবে না। এক দু দিনের জন্য কেউ গালিগালাজ করে না।এমনিতেও এতে তোমার তো কোনো দোষ নেই,সেই দোষ করেছে। কাল বিয়েতে পরে পরশু দিয়ে আসবে।।
বিক্রম জুতা জোড়া নেড়ে চেড়েদেখতে লাগল।জুতো জোড়া পরে নিশ্চয় খুব আরাম পাওয়া যাবে।সে জীবনে এই ধরনের জুতো পরার কথা কল্পনাই করতে পারে না।কিন্তু কে জানে ভগবান তাকে হয়তো একটা সুযোগ দিয়েছে। তার মধ্যে শালির বিয়ে ।জানকী ঠিকই বলেছে,আগামীকাল বিয়েতে পরেই সে নন্দুকে জুতা জোড়া ফিরিয়ে দিয়ে আসবে।বিক্রম জুতো জোড়ার ভেতরে পা ঢুকিয়ে নিল।
বিয়ে বাড়িতে কয়েকজন তাকে জুতো জোড়ার কথা জিজ্ঞেস করল। সেও যখনই চেয়ারে বসেছে, এক পায়ের উপরে অন্য একটি পা তুলে দিয়েছে।কখনও গভীর চিন্তা করার ভান করে সবাইকে দেখিয়ে পা নাচিয়েছে।পাশে বসে থাকা কোনো একজন হয়তো বলেছে—’ জামাইবাবু জুতো জোড়া কোথা থেকে কিনেছেন, এত সুন্দর লাগছে !’ বিক্রম হাসে। এক ধরনের বলতে না পারা সুখানুভূতিতাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। কেবল মাঝে মধ্যে নন্দুর মুখটা চট করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে এবং তখন ছুয়ে দেওয়া পোকার মতো মনটা সংকুচিত হয়ে উঠতে চায়। পুনরায় স্ত্রীর কথা ও মনে পড়ে ,-‘সে তো চুরি করে আনেনি , নন্দু ভুল করে পাঠিয়েছে,সে কী করবে !’
বিয়ের পরের দিন বিক্রমের শরীরটা একটু খারাপ লাগল।বিয়ে বলে দুদিন তার কষ্ট হল,ঘুমেরও ক্ষতি হল।কিছু একটা ক্লান্তি তাকে চেপে ধরল।সেদিন সে রামেশ্বরদের কাজে যাবে না বলে দিল।সেদিনটা সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল।পরের দিন সে সকালে ট্রাকের ওপর থেকে দেখল নন্দুর বসার জায়গাটা খালি।ট্রাকটা আর সেখানে না দাঁড়াতে দিয়ে বিক্রমরা চলে গেল।জুতোজোড়া ড্রাইভারের সিটের নিচে পড়ে রইল;কিন্তু পরের দিনও নন্দুকে সেখানে না দেখে বিক্রম কিছুটা আশ্চর্য হল।ও কোথায় গেল!
বিক্রম বেশি অবাক হল যখন সাতদিন পর্যন্ত নন্দুর ছায়াটা চৌ্রাস্তার কোণটাতে দেখতে পাওয়া গেল না।এই সাতদিন জুতোজোড়া ড্রাইভারের সিটের নিচে পড়ে রইল।রাতে ভাত খেতে বসে সে জানকীকে কথাটা বলল।জানকী বলল-‘রেখেই দাও জুতোজোড়া।এত দামি জুতোজোড়া কোথায় আর কিনতে পারবে!
বিক্রম কিছুই বলল না,একবার চোখ বড়ো বড়ো করে স্ত্রীর দিকে তাকাল।যা বোঝার জানকী তাতেই বুঝে গেল।
পরের দিন সে রামেশ্বরদের কাজে যাবে না বলে জানিয়ে দিল।জুতোজোড়া আগের সেই প্যাকেটে ভরে সে সকালবেলা নন্দুর খোঁজে বের হল,কিন্তু চৌ্রাস্তার কেউ নন্দুর বাড়ি চেনে না।তবে নন্দুর সঙ্গে তাকে আজ দেখা করতেই হবে।প্রতিদিন কাজের ক্ষতি করা সম্ভব নয়।সে বাসস্ট্যাণ্ডের ভেতরে বসা অন্য একটি মুচির কাছে গেল আর নন্দুকে চেনে নাকি জিজ্ঞেস করল।সে বাড়িটার সঠিক জায়গাটা বলতে না পারলেও সোণপুরের মেথরবস্তির আশেপাশে বলে জানাল।বিক্রম মেথর বস্তি পৌছাতে বিকেল হয়ে গেল।প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছটার নিচে থাকা শিবের মন্দিরটাতে গাঁজা খেয়ে নন্দু বসে থাকতে পারে বলে কেউ তাকে বলেছিল;কিন্তু সেখানেও সে নন্দুকে দেখতে পেল না।মন্দিরটার পাশের গলিতে শেষ ঘরটাতে নন্দু থাকে বলে একজন তাকে নিশ্চিতভাবে জানাল এবং সে গলিটাতে ঢুকে পড়ল।
পুরোনো কাঠ এবং ভাঙ্গা টিন দিয়ে এখানে সেখানে জোড়া-তালি দেওয়া নন্দুর ঘর।উঠোনে শুকনো কলাই ডালের বড়া শুকোতে দিতে থাকা নন্দুর স্ত্রী বিক্রমকে দেখে এক হাত লম্বা ঘোমটা টেনে দিল এবং নন্দু পেছনেই রয়েছে বলে আঙুল দিয়ে দেখাল।পেছন দিকে একটা খাল,জল কম।তার তীরে একটা পিঁড়িতে নন্দু বসেছিল।জুতোর প্যাকেটটা নিয়ে বিক্রম নন্দুর কাছে এগিয়ে গেল।বিক্রম তার পাশে বসল।সামনে জুতোজোড়া।নন্দুর একটা গাল ফুলে ছিল।চোখদুটি যেন জল শুকিয়ে যাওয়া দুটো খাল,নিস্তেজ,নিঃসার।স্ত্রী উঠোন থেকে বিড়বিড় করতে লাগল,- ‘জুতোজোড়ার জন্যই মানুষটাকে ওরা এভাবে মারধোর করল।একজোড়া জুতোর জন্যই একটা মানুষকে এভাবে মারধোর করা যায়!এরকম জুতো মানুষটা কত বানিয়েছে,দুজোড়া জুতো বানিয়ে দেবে বলার পরেও মানুষটাকে ছাড়ল না।’
বিক্রম নন্দুর দিকে আরও একটু এগিয়ে গেল।সে ভেবেছিল নন্দু তাকে বলবে , ‘জিন্দেগীতে কী আছে ,এক জোড়া জুতোই তো।’কিন্তু সে কিছুই বলল না।অনেকক্ষণ দুজনেই জুতোর প্যাকেটটা মাঝখানে নিয়ে বসে রইল।বেশ কিছুক্ষণ পরে জুতোর প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে নন্দু বলল,-প্যাকেটদুটি একই ছিল।সেখানেই আমার ভুল হয়ে গেল।
‘প্যাকেটদুটি একই ছিল,কিন্তু ভেতরে জুতোজোড়া আলাদা ছিল।’বিক্রম বল্ল-‘একজোড়া দামি আর অন্য জোড়া কমদামি।’
নন্দু আর কিছু বলল না।বিক্রমেরও কিছু বলতে ইচ্ছা করল না।দুজনেই জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।একদৃষ্টিতে।

অনুবাদক