ভারতীয় সংবিধানের যে অনুচ্ছেদের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পেয়ে আসছিল সেই ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। পাশাপাশি রাজ্যটিকে কেন্দ্রের শাসনের আওতায় আনতে পার্লামেন্টে বিলও তোলা হয়েছে।
এ বিল পাস হলে আগেকার অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মীর (রাজ্য) হয়ে যাবে জম্মু-কাশ্মীর (কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল)। আর জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ আলাদা হয়ে সেটিও হবে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। আর ৩৭০ ধারা রদের ফলে বেশকিছু সুবিধা হারাচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীর।
আগে যা ছিল, এখন যা হচ্ছে:
*আগে ছিল বিশেষ মর্যাদা, এখন তা থাকছে না: সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলুপ্ত হওয়ায় কাশ্মীরীদের বিশেষ সুবিধার নতুন একটি ধারাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে দিল্লি, গোয়ার মতো দেশের বাকি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে আর কোনও পার্থক্য থাকছে না জম্মু ও কাশ্মীরের। রাজ্যটির এখন আর বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা থাকছে না।
*ছিল দ্বৈত নাগরিকত্ব, এখন হবে এক নাগরিকত্ব: রাজ্যের বাসিন্দারা এখন আর দ্বৈত নাগরিক নন বরং একক নাগরিকত্ব ভোগ করবেন, অর্থাৎ, তারা এখন ভারতের নাগরিক হবেন।
* আলাদা পতাকা ছিল, এখন তা থাকবে না। কেবল থাকবে ভারতের তিনরঙা পতাকা।
* ৩৬০ ধারা (অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা) কার্যকর ছিল না, এখন কার্যকর করা যাবে: ভারতীয় সংবিধানে ৩৬০ ধারাবলে রাজ্যগুলোর জন্য অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থার বিধান রয়েছে। কিন্তু বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদার কারণে জম্মু ও কাশ্মীরে তা প্রযোজ্য ছিল না। এখন এ ধারা অনুযায়ী সেখানে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা কার্যকর করা যাবে।
* অন্য রাজ্যের কোনো ভারতীয় নাগরিক জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কিনতে এবং সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারতে না, এখন তা করতে পারবেন।
*কাশ্মীরে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ আইন ছিল না। এখন রাজ্যটিতে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু সংরক্ষণ আইন কার্যকর হবে।
* তথ্য অধিকার আইন কার্যকর ছিল না, এখন যা কার্যকর হবে।
* জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার মেয়াদ ছিল ছয় বছর। এখন অন্যান্য রাজ্যের মত এর মেয়াদও পাঁচ বছর হবে।
৩৭০ ধারা কি?
ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান ও ভারত নামে দুই রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন অনেকে।
কিন্তু ওই অঞ্চলের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং পাকিস্তান বা ভারত কারো সঙ্গেই যুক্ত হতে চাননি। তিনি প্রথমে জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন।
কিন্তু পাকিস্তানের আদিবাসীগোষ্ঠী আক্রমণ করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে আশঙ্কায় তিনি ভারতের কাছে তাদের প্রতিরোধে সাহায্য চান এবং বিনিময়ে বিশেষ সুবিধার শর্তে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি হন।
যার জেরে ১৯৪৯ সালে ভারতীয় সংবিধানে নতুন একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়, যেটি ‘আর্টিকেল ৩৭০’ নামে পরিচিত। এ ধারা অনুযায়ীই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ হলেও রাজ্যটি বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পায়।
রাজ্যটির নিজস্ব সংবিধান এবং নিজস্ব একটি পাতাকা হয়। এছাড়া পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ছাড়া বাকি সব বিষয়ে রাজ্য সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার পায়। এমনকী, কেন্দ্র সরকার বা ভারতীয় পার্লামেন্টের রাজ্যে সরকারের সহমত ছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরে কোনো আইন প্রণয়ন করার অধিকারও ছিল না।
পরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর সঙ্গে ৩৫এ নামে নতুন একটি ধারা যোগ করা হয়। এই ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা বিশেষ সুবিধার অধিকারী হন। যেমন: সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। কিনতে হলে অন্তত ১০ বছর জম্মু-কাশ্মীরে থাকতে হত।
স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরে অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও।
কে স্থায়ী বাসিন্দা এবং কে নয়, তা নির্ধারণ করার অধিকার ছিল রাজ্যের বিধানসভার। ৩৫এ ধারা অনুযায়ী, রাজ্য অর্থাৎ জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভাই ঠিক করতে পারত, রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কারা এবং তাদের বিশেষ অধিকার কী ধরনের হবে।
জম্মু ও কাশ্মীরের কোনও নারী রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে তিনি সেখানকার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। অর্থাৎ, তার সম্পত্তিতে তার আর কোনো অধিকার থাকত না। এমনকি, তার উত্তরাধিকারীরাও ওই সম্পত্তির মালিকানা বা অধিকার পেতেন না।
ভারতের একমাত্র মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্য হিসেবে সাংবিধানিকভাবে সেখানকার জনগণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রক্ষায় এটি করা হয়েছিল। ৩৭০ বতিল করায় এখন সেখানকার জনগণ এ সব সুবিধাই হারাবে।