আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিটএক সময় অসমের নাম ‘কামরূপ’ ছিল। আরও প্রচীনকালে কামরূপ ছিল ‘প্রাগজ্যোতিষ’ নামে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত। এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় রাজ্য দ্বারা অসম বেষ্টিত এবং অসম সহ প্রতিটি রাজ্যই উত্তরবঙ্গের একটি সংকীর্ণ অংশ দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া অসমের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে। চা, রেশম, পেট্রোলিয়াম এবং জীববৈচিত্রের জন্য অসম বিখ্যাত। অসমিয়াদের প্রধান উৎসব হলো বিহু। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অসমিয়ারা বিহু পালন করে। বিহু তিনটি- ব’হাগ (রঙালি) বিহু, মাঘ (ভোগালী) বিহু আর কাতি (কঙালি) বিহু। অসমীয়া সাহিত্য অন্য সমস্ত ভাষার মতো অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং অন্য অন্য বিষয়ক গ্রন্থে পূর্ণ। অসমীয়া সাহিত্য ভাষাটির বর্তমানের সাহিত্য সম্ভার ছাড়াও এর ক্রমবিবর্তনের সময়ে সৃষ্টি হওয়া পুরানো অসংখ্য সাহিত্যের সম্ভারে পরিপূর্ণ, যে ধারার আরম্ভ ৯ম-১০ম শতকের চর্যাপদ থেকে আরম্ভ হয়েছিল বলে ধরা হয়। অজিৎ বরুয়া, অনন্ত কন্দলী,অনিরুদ্ধ কায়স্থ, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী, আনন্দরাম বরুয়া , ইমরান শাহ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, ভোলানাথ দাস, মফিজুদ্দিন আহমদ হাজারিকা, মহেন্দ্র বরা, মাধবদেব, রবীন্দ্র সরকার, রমাকান্ত চৌধুরী, বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, স্নেহ দেবী, হরিবর বিপ্র, হীরেন ভট্টাচার্য সহ আরো অনেক অসমীয়া ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি আছেন। এই সময়ে অসমীয়াতে কি রকম কবিতা লেখা হচ্ছে কারা লিখছেন, এই সময়ের আলোচিত ও বির্তকিত কবি নীলিম কুমারের কবিতা নিয়েই আজকের আযোজন। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন অনুবাদক বাসুদেব দাস।
সাম্প্রতিক অসমের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত কবি নীলিম কুমার ১৯৬২ সনে অসমের পাঠশালায় জন্মগ্ৰহণ করেন। প্রকাশিত গ্ৰন্থ ‘আচিনার অসুখ’, ‘স্বপ্নর রেলগাড়ী’, ‘জোনাক ভালপোয়া তিরোতাজনী’, ‘নীলিম কুমারের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি।
‘এখানে একটা দরজা থাকতে পারত’ঘরটা বলেছিল।
আমাদের নতুন ঘরে অনেকগুলি দরজা-জানালার মধ্যে
একটা দরজা হয়তো ছিল না। যে কথা ঘরটা জানত।
আমি সেই জায়গাটিতে,যেখানে দরজা ছিল না,সেখানে দাঁড়ালে
সবসময় ঘরটা গুণগুণ করে বলত –এখানে
আমার,অর্থাৎ পরিবারটির প্রয়োজনেই দরজা থাকবে ।
না কি এখানে আমাদের ছাড়াও অন্য কেউ বাস করবে?
যার জন্য একটা দরজার প্রয়োজন ছিল
ঘরটা বলেছিল–কিন্তু তোমার বুকে বাস করে যে?
সে আসা যাওয়া করার দরজাটা কোথায়?
আপনার ভেতরে গাছ-পালা আছে। আকাশ বাইতে চাওয়া
লতা আছে। আপনার বুকের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বর্ণা।
আপনার বুকে পাথর আছে। ঝর্ণা সেই পাথরের মধ্য দিয়ে
গান গায়। সেই পাথর আপনার বুকে পাথর হয়ে থাকে না।
সেখানে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল গান গাওয়া যায়,
সবচেয়ে দীর্ঘ গান গাওয়া যায়।
আপনি বলেছিলেন,আপনি সবুজ। আপনাকে দেখার জন্যই
সূর্য ওঠে,চাঁদ ওঠে। আপনি সুর্যের মতোই প্রাটীন।
চাঁদের মতোই প্রাচীন। আপনি রঙ নন
আপনি মেঘ ভালোবাসেন। মেঘে পা রাখতে চান।
সেইজন্য বৃষ্টি আপনাকে ভেজায়
কখনও বা এক নাগাড়ে মেঘমল্লার মেঘমল্লার মেঘমল্লার
আর কখনও অনেক দিনের জন্য ভূলে যায়। তখন
ঝরাপাতায় আপনি মর্মরণির কার্পেট পাতেন
আর সেতারে বাজান পাখির কলরব।
আপনি কারও নন। আপনি আপনাতেই সবুজ ।
আপনি একটি অরণ্যের মতো। আমি সেই অরণ্যে
এখানে আমরা শুয়ে আছি। আমি এবং রাধা
নদীর তীরে নয়। পাহাড়ের নিচে নয়
এখানে আমরা শুয়ে আছি ;কংক্রীটের ঝুপড়িতে,
শীতের সাদা ঠাণ্ডা এক বিছানায়।
মাথার ওপর আকাশ নেই,ঈষৎ সাদা এক সিলিং
জ্যোৎস্না নেই,বিজলিবাতি,তারা নেই
এখানে আমার উন্মুক্ত বাহু পড়ে আছে তাঁর উন্মুক্ত পিঠে।
এখানে দুটো শ্বেতপন্ম ফুটে উঠেছে
এখানে আমরা শুয়ে আছি, আমি আর রাধা
আলো আর আঁধারে আঁকা জ্যামিতির শয্যায়।
জানি না এখানে আমরা শুয়ে আছি কিনা
রাস্তার মাঝখানে আমি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর দেখলাম যে
আমাকে ঘিরে মানুষগুলি জট পাকাচ্ছে রাস্তায়। ওদের চিৎকার টেচামিচি
আর ফিসফিসানিতে আমি আরও বেশি ঘুমিয়ে পড়লাম।
গমগম করে একটা ট্রাক এল ,হর্ণ বাজাল এবং
ভেঙ্গে গেল মানুষের ভিড়। পড়ে থাকলাম কেবল
ঘুমিয়ে পড়া আমি রাস্তার মধ্যে।
ট্রাকের পেছন পেছন বাসের সারি,তিনচাকার দুই চাকার সারিগুলি এল
আর যখন আমার ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল সেগুলি
যখন আমি গুড়ো হয়ে গেলাম তখন আমি গভীর নিদ্রায়।
একটা কুকুর আমাকে টেনে নিয়ে যাবার সময়,তার দাঁত
আমার শরীরে বসানোর সময় আমি ভাবলাম কুকুরটাও
অজস্র সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আস্তরণ পড়েছে আমার ঘুমে…
আমার এত ঘুম দেখে আমি ভাবলাম,কিন্তু
আমি ভাবতে পারলাম না নিদ্রায়
পড়ার আগেই কবিতাটা নাই হয়ে গেল।
এখন আপনি যা পড়ছেন তা হারিয়ে যাওয়া কবিতাটার কিছু চিহ্ন
তাতে যে একটা কবিতা ছিল সেকথা বলার জন্য
কবিতাটা কিছু জিনিস ফেলে রেখে গেছে,যাতে
আপনি কবিতাটাকে সনাক্ত করতে পারেন
কবিতাটা পরা পোশাক-আশাক বা স্যাণ্ডেলের দ্বারা
আপনার পোশাক-আশাক, স্যান্ডেল বা জোতাজোড়া কি
আপনার পরিচয়? না? তাহলে কবিতার প্রতি কেন অবিচার করবেন?
কবিতাকে আমাদের ছেড়ে দিতেই হবে
হাজার হাজার বছর ধরে কবিতাকে দাসী করার জন্য
কবির চেষ্টার ওপরে জল ঢেলে দিয়ে কবিতা পার হয়ে গেছে
স্বপ্নের পরে স্বপ্নের বারান্দা
ক্ষীণ আলোতে আমরা কখনও দেখা না দেখা করে আমরা কখনও
দেখেছি কবিতাকে,পড়ার আগেই নাই হয়ে যেতে
আর কেউ যদি নিজেকে একজন কবিতার পাঠক বলে ভেবেছে,
বা নিজেকে কবি বলে যে একদিন সামবেদ লিখেছিল
সেই সমস্ত কিছুর প্রতি তিলমাত্র আস্থা না রেখে কবিতা
নাই হয়ে গেছে লেখা বা পড়ার আগেই,এবং
কোনো কাব্য সমালোচকের বাগানে (অবশ্য তাদের বাগান থাকে না
ঘুরে বেড়ায় অন্যের বাগানে) হাসছে হাসছে হাসছে
অনুবাদক
১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। তিনি একজন নিয়মিত অসমিয়া সাহিত্যের অনুবাদক। NEINAD এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা- সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership দ্বারা তাকে সম্মানিত করা হয়।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩১ টি।
Related