| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

জীবনানন্দ দাশের অনুবাদে ‘মেঘদূত’

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

জীবাণু প্রবেশ করেছে।রোগটার লক্ষ্মণগুলো ফুটে উঠছে।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-র কোনও কবিতা ১৯২৭- এর আগে লেখা নয়।অর্থাৎ ১৯২৭-এর পর যা পাকাপাকি ভাবে জাঁকিয়ে বসবে তার সূত্রপাত ১৯২৭ বা তার আগে শুরু হয়ে গেছে।

আমি জীবনানন্দ দাশের আংশিক ‘মেঘদূত’ অনুবাদের কথা বলছি।

‘মেঘদূত’ অনুবাদের ক্ষেত্রে পরিণত বুদ্ধদেব বসুর পাশে ২৭/২৮ বছরের জীবনানন্দকে রেখে তুলনা করাটা একদমই ঠিক নয়। তবু আমরা নিরুপায়।এই একটি মানুষ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যর সঙ্গেই তো ভালোয় মন্দয় জীবনানন্দ আজীবনের জন্য জড়িয়ে গিয়েছিলেন!

তো যে রোগটার কথা বলছিলাম।মূল ভাষায় কালিদাসের উত্তর মেঘের ৬৭ নম্বর শ্লোকের শেষ লাইন,’নিত্যজ্যোৎস্নাঃ প্রতিহততমোবৃত্তিরম্যাঃ প্রদোষাঃ।।’।বুদ্ধদেব বসু কী অনুবাদ করলেন? ‘নিত্য জ্যোৎস্নায় আঁধার কেটে যায়,তাই তো মনোরম সন্ধ্যা।’।

আর জীবনানন্দ? ‘তিমিরবিহীন যামিনী জুড়িয়া জ্যোৎস্না দিতেছে দেখা!’।

কালিদাস কী তাই লিখেছেন? অলকাপুরীতে রাত্রিবেলা যে নিত্য বা চির জ্যোৎস্না তার কথাই তো বলছেন।বলতে চাইছেন, অলকাপুরীতে কখনও অন্ধকার হয় না।

মন্দাক্রান্তা ছন্দে লিখবার পথে বুদ্ধদেব বসু যাননি।নিজের মতো করে মাত্রা ঠিক করেছেন।দুই মাত্রা কমিয়ে।বাংলার চলনটা বজায় রাখতে।জীবনানন্দ তো আরও স্বাধীনতা নিয়েছেন।চার লাইনকে ভেঙে ছয় লাইন করে, শব্দ যোগ করে।৬+৬+৮।কিন্তু আমাদের আলোচনা তা নিয়ে নয়!

জীবনানন্দ লিখছেন তিমিরবিহীন যামিনী জুড়িয়া জ্যোৎস্না দিতেছে দেখা।এ কেমন হল?তিমিরবিহীন যামিনীই যদি হয়,সেখানে তো অবশ্যই জ্যোৎস্না আছে,নতুন করে জ্যোৎস্না দিতেছে দেখার অর্থ কী?এখানেই জীবনানন্দীয় অসুখ।এটা একটা ধাঁধা। জীবনানন্দীয় ধাঁধা।কালিদাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।জীবনানন্দ তবে কোন অন্ধকারের আলোর কথা বলছেন?যা জ্যোৎস্না ছাড়াই নিজের আলোকে আলোকিত।কোন সে অন্ধকার?

‘দিতেছে’ অর্থ?ঘটমান বর্তমানের জীবাণু তবে আক্রমণ করেছে? হাজার বছর ধরে পথ ‘হাঁটিতেছি’ র চারটা তবে ১৯২৭-এ জলে ফেলা হল?আধার ও আধেয়কে গুলিয়ে ফেলছেন তো?পূর্ণ ও অপূর্ণতার তত্ত্ব? খণ্ড ও অখণ্ড? ভারতীয় দর্শনের মূল সূত্রের দিকে আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তো।আপাত নিরীহ একটি বাক্য থেকে আগুন জ্বালছেন তো! দেরিদা যেমন প্লেটোর টেক্সটের অনিশ্চয়তা আবিষ্কার করেছিলেন।

যদি যামিনী তিমিরবিহীন হয় কেন জ্যোৎস্না?আর জ্যোৎস্না যদি আলো ক্রমে আসিতেছে-র মতো দিতেছে দেখা কীভাবে তার আগে যামিনী তিমিরবিহীন হয়।আসলে এখানেই জীবনানন্দর উড়ান।শিকড়ের ডানা।অতঃপর আমরা দেখব,কালিদাসে নেই অথচ প্রিয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে,তার সঙ্গে বিহারও হচ্ছে।কোন বিহার?অবশ্যই কামসূত্রের বিহার।ফোরপ্লে।আমরা দেখব ‘প্রহার’-এর মতো বিধ্বংসী শব্দও।বলাই বাহুল্য কালিদাসে নেই।

জীবাণু প্রবেশ করেছে।রোগটার লক্ষণগুলো ফুটে উঠছে।সময়ের এই স্থির একদিক তবু স্থিরতর নয়।প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।

* সামান্য এই লেখাটা কোনও মতেই তৈরি করে ওঠা সম্ভব ছিল না যদি না সন্মাত্রানন্দ মহাশয় ধৈর্য ধরে আমার শিশুসুলভ প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিতেন,মূল টেক্সটকে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে ব্যাখ্যা না করতেন বা আমাকে এই ভাবনার দিকে না ঠেলে দিতেন।আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কোনও বড়ো লেখার এইটি হয়তো সূচনা।

 

 

 

.

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত