ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুরারী ভাদুরীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন সিনেমা সাহিত্যের চাটুকারিতা করবে না, করলে একটা পৃথক শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমার ভবিষ্যৎ সীমিত হয়ে পড়তে বাধ্য। এ বেশ পুরনো কথাই। এ-ও পুরনো কথাই যে সাহিত্য অক্ষরের শিল্প, আর সিনেমা ইমেজ বা চিত্রকল্পের শিল্প। সিনেমার কাজ মূলতঃ কার্যকর ও দৃষ্টিনন্দন চিত্রকল্পের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকারের বক্তব্যটা পর্দায় তুলে ধরা, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতে পছন্দ করতেন “রূপের চলৎপ্রবাহ”। একটার পর একটা অর্থপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন চিত্রকল্প দিয়ে বলবার কথাটি যথাযথভাবে পর্দায় মেলে ধরা। তারপর তাতে শব্দ যোগ করা।
নানা শিল্পমাধ্যমের বৈচিত্র্যময় জগতটাতে সিনেমা হচ্ছে সর্বকনিষ্ঠ শিল্প। মাত্র সোয়া শ’ বছর বয়স এ শিল্পটির যেখানে লিখিত সাহিত্যের ইতিহাসই প্রায় কয়েক হাজার বছরের। ফলে নবীনতম এই শিল্পমাধ্যমটি সাহিত্যের মতো প্রাচীনতম এক শিল্পের কাছে, নানাভাবেই ঋণী, এবং সাহিত্যের দ্বারা, নানাভাবেই প্রভাবিত।
তবে সিনেমার নৌকাটি তো কেবল সাহিত্যের ঘাটে বাঁধা নেই, অন্যান্য আরো অনেক শিল্পমাধ্যমের সঙ্গেই সিনেমার রয়েছে দেয়ানেয়ার কুটুম্বিতা। সিনেমাকে আমরা তাই ঠাট্টা করে বলি “সাত ভাই চম্পার শিল্প।” আর সে সাত শিল্প হচ্ছে আলোকচিত্র-যা আজ নিজ যোগ্যতাতেই একটা পৃথক শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে; সাহিত্য-যাতে থাকছে গল্প, উপন্যাস, কবিতা; স্থাপত্য-যা থেকে সেই আইজেনস্টাইনের যুগ থেকেই কম্পোজিশনের ধারণাসহ সিনেমা অনেক কিছুই নিয়েছে; নাটক-সংলাপ ও Mise-en scene -য়ের ধারণাটা তো পুরোটাই নাটক থেকে নেওয়া; অভিনয়-অভিনয়টা আলাদা করে বলছি কারণ মঞ্চনাটক শুরু হওয়ার অনেক আগেও পৃথিবীতে অভিনয় ছিল; চিত্রকলা-রং ও কম্পোজিশন; এবং সঙ্গীত-যা যুগ যুগ ধরে চলচ্চিত্রকে নান্দনিক করেছে। আর প্রযুক্তি হচ্ছে সেই চম্পা বোন যার ছোঁয়ায় এসব শিল্প পর্দায় প্রাণ পেয়ে থাকে।
যেহেতু সিনেমার বয়স এসব প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পমাধ্যমগুলোর চেয়ে, যেসব শিল্পের কারো কারো বয়স দু’তিন হাজার বছর, চিত্রকলার বয়স তো আরো বেশী, অনেক অনেক কম, ফলে বাড়ীর ছোট ভাইটি যেমন সুযোগ পেলেই বড় ভাইয়ের মোটরবাইকটায় চেপে শহরে, বিশেষ করে মেয়েদের কলেজের সামনে, একটা চক্কর দিয়ে আসে, কিম্বা মেজ ভাইয়ের সুন্দর জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যায়, সিনেমাও তেমনি সুযোগ পেলেই এসব প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পমাধ্যমগুলি থেকে নির্বিকারভাবে গ্রহণ করে থাকে। এবং এখনও নিচ্ছে। সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় সিনেমার এই এক বাড়তি সুবিধা!
তবে সিনেমার ভাষাটা আবার পুরোপুরিই প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে সিনেমার ভাষা ও নন্দনতত্ত্বে ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। নির্বাক ছবির ভাষার অনেক পার্থক্য আছে সবাক ছবির সঙ্গে; একই ভাবে সাদাকালো ছবির নন্দনতত্ত্বের বড় পার্থক্য রয়েছে রঙীন ছবির সঙ্গে, কিম্বা ডিজিটাল সিনেমার ভাষা পাল্টে দিচ্ছে প্রথাগত সেলুলয়েড সিনেমার ভাষার অনেক কিছুই।
সাহিত্যের সব কটা উপাদানই সিনেমার উপাদান হয়ে এসেছে। উপন্যাস ও ছোটগল্পের তো কথাই নেই, কবিতা নিয়েও অনেক ভালো ছবি হয়েছে। কেই-বা ভুলতে পারে হ্যারি ওয়াটের “নাইট মেল” ছবিটিতে অডেনের কবিতার লাইনগুলির সেই অসামান্য ব্যবহার;
“That is the Night Mail crossing the border
Bringing in cheque and the postal order
Letters for the rich, letters for the poor
The shop at the corner and the girl next door”;
রেলগাড়ীর চাকার ছন্দের সঙ্গে কী চমৎকারভাবেই না হ্যারি ওয়াট মিলিয়ে দিয়েছিলেন কবিতার ছন্দকে!
আমি নিজেও কবিতা নিয়ে ছবি তৈরী করেছি। আসলে আমার প্রথম ছবিটাই ছিল একটি কবিতার চিত্রায়ন; কবি নির্মলেন্দু গুণের “হুলিয়া” কবিতাটি। আর আজ তো সিনে-পোয়েম বা পোয়ে-ফিল্ম সিনেমার জগতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। তারকোভস্কির মতো অনেকেই মনে করেন, সিনেমার লক্ষ্যই হওয়া উচিত কবিতার মতো হয়ে ওঠা। উনি তো বিশ^াসই করতেন ভবিষ্যতে কেবল “সিনেমার কবি”-রাই বেঁচে রইবেন।
কাহিনীচিত্র হলে গল্পের একটা কাঠামো থাকতে হয়। তাই হয়তো উপন্যাসই সিনেমার জন্যে সবচে’ বহুল ব্যবহৃত সাহিত্য-উপাদান। কারণ উপন্যাসে একটা ছড়ানো প্লট থাকে, সুনির্দিষ্ট সব চরিত্র থাকে, থাকে ঘটনার ঘনঘটা। তবে অভিজ্ঞতায় দেখি খুব বড় উপন্যাস আবার তেমন চলচ্চিত্রোপযোগী নয়। সিনেমা করার সময় দৈর্ঘ্যরে কারণে উপন্যাসটি থেকে অনেক কিছু বাদ দিয়ে ফেলতে হয়। ফলে উপন্যাসটির প্রতি তেমন সুবিচার করা হয় না। সিনেমার জন্যে বরং ছোট আকারের উপন্যাস, নভেলেট বা বড় ছোটগল্প ভালো। বাংলাভাষী চলচ্চিত্রে যার সেরা উদাহরণ হিসেবে চিরকালই হয়ে রইবে রবীন্দ্রনাথের “নষ্টনীড়” বড় ছোটগল্পটির সত্যজিৎ রায়কৃত অসামান্য চলচ্চিত্রটি-“চারুলতা”।
আর সাহিত্যের আরেকটি যে উপাদান-প্রবন্ধ সাহিত্য, তা’ নিয়েও ছবি তৈরী হয়ে থাকে। প্রামাণ্যচিত্রগুলি প্রবন্ধের চিত্রায়ন ছাড়া আর কী ? ইয়োরিস ইভেন্স বা মাইকেল মুরের ছবিগুলির কথা স্মরণ করুন। আমার নিজের কিছু প্রামাণ্যচিত্র-“কর্ণফুলীর কান্না” বা “বস্ত্রবালিকারা”, এসব ছবিকে আমি বড় প্রবন্ধ হিসেবেই মনে করি।
সত্যজিৎ রায় মনে করতেন, সিনেমার কাঠামোটা যতটা না সাহিত্যজাত, তার চেয়ে বেশী সাঙ্গীতিক। বলেছেন, পশ্চিমা ধ্রুপদ মিউজিক শুনতে শুনতেই সিনেমার কাঠামোর রহস্যটা ওঁর কাছে খুলে যায়। চিত্রকল্প সাজানোর গতিময়তার মাঝেই লুকিয়ে থাকে andante, allegro আর crescendo -র গতিময়তা। সিনেমার সৌকর্ষ অনেকটাই নির্ভরশীল এই সাঙ্গীতিক ছন্দটি অর্জনে তার সাফল্যের উপর। তবে সঙ্গীত বিশুদ্ধতম শিল্প। ফলে কেবল সিনেমা কেন, সব শিল্পেরই একটা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে সাঙ্গীতিক হয়ে ওঠার।
সেই জর্জ মেলিয়েরের যুগ থেকেই সিনেমা দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে লুমিয়ের ভাইদের বাস্তববাদী সিনেমা-বাস্তব লোকেশন, বাস্তব সূর্যের আলো, বাস্তব পোশাক-আশাক ও প্রপ্স। যার চরম প্রকাশ হয়তো র্লাস ভন ট্রিয়ের ও ওঁর সঙ্গী দিনেমার চলচ্চিত্রকারদের “ডগমা ফিল্ম”, যা সব রকম কৃত্রিম সেট ও স্পেশাল এফেক্টের বিরোধী। অন্য দিকে রয়েছে জর্জ মেলিয়েরের ফ্যান্টাসী বা কল্পনাশ্রায়ী সিনেমা যেখানে মূলতঃ কৃত্রিম সেট, কৃত্রিম আলো, ট্রিক ফটোগ্রাফী বা স্পেশাল এফেক্টসই প্রধান-হলিউড, বলিউড, টলিউড, ঢালিউড। আজো বিশ্ব চলচ্চিত্র বাস্তবধর্মী ও কল্পনাশ্রায়ী চলচ্চিত্র-এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রয়েছে।
তবে কল্পনাশ্রায়ী ছবি বলেই তাকে হেয় করার কিছু নেই। ঝপর-ঋর ছবিগুলি তো সবই কল্পনাশ্রায়ী। কিন্তু কেই বা ভুলতে পারে স্টানলী কুব্রিকের Ò2001 : A Space OdysseyÓ -র নান্দনিক শিল্পমান ও গভীর দার্শনিকতার কথা। এই বিশ^-ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি ও মানব-অস্তিত্ব নিয়ে কত গভীর কথাই না বলেছেন কুব্রিক এ ছবিতে। কিম্বা তারকোভাস্কি বলেছেন ওঁর “সোলারিস”-য়ে। আসলে আজকের কল্পনা, আগামী দিনের বাস্তবতা। প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, মানুষ ততই তার কল্পনাকে রূপ দিয়েছে। মেলিয়ের কী বানাননি ওঁর খুবই সীমিত প্রযুক্তি দিয়ে “এ ভয়েজ টু দি মুন”! আর ষাটের দশকে এসে নীল আর্মস্ট্রং তো সত্যি সত্যিই চাঁদের মাটিতে হাঁটাচলা করে এলেন!
কী হবে সিনেমার বিষয়বস্তু ? এক্ষেত্রে সিনেমা ও সাহিত্যের মাঝে কোনো নিষেধের লক্ষণরেখা নেই। সাহিত্যের মতোই, জীবনের সব কিছুই হতে পারে সিনেমার বিষয়, তা সে বন্দারচুকের বিশাল মহাকাব্যিক যুদ্ধের ছবি “ওয়ার অ্যান্ড পীস্”-ই হোক্ অথবা একটা সাইকেল চুরি গেলে একটা দরিদ্র পরিবারের জীবনে কী বিপর্যয় নেমে আসতে পারে সেটাও-“বাইসাইকেল থীফ”।
জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। মানবজীবনের প্রতিটা অভিজ্ঞতা, প্রতিটা অনুভূতি, প্রতিটা মুহূর্তই তাই অমূল্য। কথাটা খুব ভালো বুঝেছিলেন জিগা ভের্তভ। তাই একটা ঘুরন্ত লাটুর মতোই অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নে। দৈনন্দিন জীবনের নিতান্ত সাধারণ ফুটেজেরও যে পরবর্তীকালে কী অসামান্য আর্কাইভীয় মূল্য রয়েছে ভের্তভ তা’ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। ওঁর “ম্যান উইথ এ মুভী ক্যামেরা” তাই আজো হয়ে আছে জীবনসত্যকে খুঁজে ফেরার এক পরিশ্রমী চিত্রনির্মাতার এক আর্কিটাইপ ছবি হিসেবে।
সাহিত্য ও সিনেমা উভয় ক্ষেত্রেই স্মৃতি এক বড় বিষয়। মানবজাতির শ্রেষ্ঠ কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে যা ছিল মূলতঃ সাহিত্যিকের জীবনস্মৃতির অংশ। আমাদের চিরপরিচিত “পথের পাঁচালী” বা “শ্রীকান্ত” তো অনেকটাই লেখক বিভূতিভূষণ বা শরৎচন্দ্রের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার বয়ান। তেমনি শ্রেষ্ঠ কিছু চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে, যেমন ক্রুফোর “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ”, যা প্রায় পুরোটাই ক্রুফোর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা এবং এ ছবির চিত্রনাট্যটি কেবল ক্রুফোই লিখতে পারতেন! আসলেই স্মৃতির বিষয়টি সিনেমাতে খুব ভালো কাজ করে। কারণ চলচ্চিত্রে বাস্তবতাকে পুঃনির্মাণ করে দেখাতে হয়। ড্রেস, প্রপ্স, ও Mise-en-scene -য়ে বাস্তবতার ডিটেল্স যত নিখুঁত হবে ছবি হবে ততই বাস্তবসম্পন্ন। প্রত্যক্ষ স্মৃতি তাই চলচ্চিত্রকারদের জন্যে এক বড় শিল্প-উৎস।
সাহিত্যে কল্পনার সুযোগ হয়তো বেশী থাকে। লেখক কিছু ইঙ্গিত দিয়েই চরিত্রদের মনোজগত বা ঘটনার বর্ণনাটা দিয়ে দিতে পারেন। সিনেমায় আবার ডিটেল্সের মাধ্যমে পুরো দৃশ্যটাকে মেলে ধরতে হয়। অন্যথায় তা’ বিশ্বাসযোগ্যতা পায় না। সিনেমাকে সেট ও ডেকরের মাধ্যমে বাস্তবতাকে পর্দায় পুনঃনির্মাণ করে নিতে হয়। তবে সেরকমটি ছাড়াও ছবি আমরা দেখেছি- লারস ভন ট্রিয়েবের “ডগভিল” যেখানে বাস্তবতার আদৌ কোনো ডিটেল্স নেই, নেই কোনোই সেট বা ডেকর! পর্দায় ঘরবাড়ী, দরজা-জানালা এসব কিছু না থাকলেও দর্শকদেরকে কল্পনা করে নিতে হয়েছে মঞ্চনাটকের দর্শকের মতোই যে এসব আছে। অবশ্য লারস ভন ট্রিয়ের সব দিক থেকেই ব্যতিক্রমী এক চলচ্চিত্রশিল্পী। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে সিনেমাতে ডিটেল্সের কাজে কোনো খুঁত থাকলে দর্শকের মনোযোগ ধাক্কা খায় এবং ছবির শিল্পমান ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। সিনেমাশিল্পে সে কারণেই প্রত্যক্ষ স্মৃতি খুব কার্য্যকর হয়। অথবা থাকতে হবে, যথার্থ গবেষণা। যে যুগ অতীত হয়ে গেছে সেই যুগের ছবিতে বা পীরিয়ড ফিল্মে সেটা খুবই জরুরী। আর প্রামাণ্যচিত্রে তো গবেষণা ছাড়া এক পাও এগোনো যাবে না। গবেষণা যত গভীর, প্রামাণ্যচিত্র ততই সমৃদ্ধ।
সাহিত্যের মতোই, চলচ্চিত্রেরও আসল সাধনাটা রয়েই যায়-সত্যম-শিবম-সুন্দরম। সত্য চাই, ন্যায় চাই, আবার নান্দনিকতাও চাই। এখন প্রশ্ন, চলচ্চিত্র কোন্ সত্য বলবে ? শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সত্যও-শ্রেণীবিভক্ত। এ সমাজে প্রকৃত সমাজসত্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রনির্মাতাকে তাই তার অবস্থান বেছে নিতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। আপনি শাসকশ্রেণীর লোকজনকে আনন্দ দেবার জন্যে “ফীল গুড” জাতীয় পুতু পুতু মার্কা ছবি বানাতে পারেন। সিনেমায় সেটা বেশ সহজই, কিন্তু সে ছবি যেহেতু প্রকৃত সমাজসত্যের কথা বলে না, ফলে তা কৃত্রিম ও ঠুনকো হতে বাধ্য।
এখন প্রকৃত জীবনসত্যের কাছে সিনেমায় আপনি দু’ভাবে পৌঁছতে পারেন। প্রামাণ্যতার মধ্য দিয়ে-প্রামাণ্যচিত্র। আবার ঘটনার সঠিক বর্ণনা. সঠিক চিত্রায়ন ও নিখুঁত Mise-en-scene -য়ের মাধ্যমে-কাহিনীচিত্র। সত্যের কাছে পৌঁছানোর আসল জীয়নকাঠিটা হোল-সত্যের একনিষ্ঠ সাধনা ও গবেষণা। হাতে থাকতে হবে-সত্য-অন্বেষার মশাল। প্রয়োজনে সে মশাল দধীচির মতো নিজেরই বুকের হাড়ের পাঁজর দিয়ে জ¦ালিয়ে নিয়ে সত্যকে খুঁজতে হবে। সত্যসন্ধানী শিল্পীকে তাই হতেই হবে যন্ত্রণাবিদ্ধ-ঋত্বিক ঘটক।
সিনেমা বাস্তব হবে। তবে বাস্তব বলতে কেবল বাইরের জগতের বাস্তবতাই একমাত্র সত্য নয়। চরিত্রদের মনোজগতের বাস্তবতাও এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সত্য। মানুষের অবচেতন মনে যেসব অবরুদ্ধ কামনা-বাসনা-হতাশা-জুগুপ্সা রয়েছে, তার সৎ চিত্রায়নও চলচ্চিত্রকারের কাজের মধ্যেই পড়ে-জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট সিনেমা বা চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের হলিউডের ঋরষস Film Noir -য়ের তাই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমূল্য রয়েই যায়। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ধরণ ও বৈচিত্র্যময়তা যেমন সাহিত্যের অন্বেষা তেমনি মানব-সম্পর্ক নিয়ে ছবিও-বাস্তবতারই ছবি।
আর এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে কল্পনা ও ফ্যান্টাসীও সামাজিক সত্যেরই অংশ। কারণ সামাজিক মানুষই কল্পনা করে। আর সে কল্পনার পেছনে কাজ করে মানুষের চেতন-অবচেতন মনের অনেক সামাজিক বঞ্চনা, আশা ও স্বপ্ন। ষাটের দশকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকেরা সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজম আনার অনেক আগে থেকেই, সেই মেলিয়েরের “ট্রিক ফটোগ্রাফি”-র যুগ থেকেই, সিনেমা কিন্তু এক ম্যাজিক রিয়ালিজম। আজকের কম্পিউটারাইজড স্পেশাল এফেক্টস যাকে নানা বৈচিত্র্যময় পথেই চালিত করছে-“জুরাসিক পার্ক”, “ম্যাট্রিক্স”, “গ্রাভিটি”; বাস্তবতার বিজ্ঞানভিত্তিক এরকম যাদুকরী রূপটা সিনেমা খুব সুদক্ষভাবেই দেখাতে সক্ষম।
সত্য আপেক্ষিক-“রশোমন”। ফলে কোনো একটা সত্য নিয়ে শিল্পীর বেশী মাতামাতি না করাই ভালো। পরে ঘটনা ও ইতিহাস আরো এগোলে দেখা যেতে পারে যে সে সত্যটা পূর্ণ সত্য বা প্রকৃত সত্য ছিল না। শিল্পীর তাই এই অভিমান থাকা কাম্য নয় যে তিনি “আসল” সত্যটাকে খুঁজে পেয়েছেন। বরং এটাই তার পক্ষে ভাবা ও বলা সঙ্গত হবে যে অনেকগুলি সত্যের মাঝে তিনি একটি সত্যকে খুঁজে পেয়েছেন।
তবে যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কাঠামোর উপর সমাজগুলি দাঁড়িয়ে আছে, চরিত্ররা যে শ্রেণী-অবস্থানে দাঁড়িয়ে আচরণ করে, চলচ্চিত্রকারের দায় থাকে সে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কাঠামোর আসল বাস্তব চালচিত্রটাকে পর্দায় তুলে ধরার। অন্যথায় চরিত্রগুলি কোনো সামাজিক ভিত্তি পাবে না। ফলে বাস্তবতাকে দেখতে ও দেখাতে হবে তার সামগ্রিক দ্বান্দ্বিকতায়। খন্ডিত রূপে নয়। আর সে সমগ্রতায় সমকালের প্রেক্ষিতটা যেমন থাকবে, তেমনই তা’ হতে হবে ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহীও।
সাহিত্য ও সিনেমাসহ সব শিল্পেরই অন্বেষা হচ্ছে এই মানবজীবন– “Humanty in different conditions”। বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষকে বুঝতে চাওয়াই সাহিত্যিকের অন্বেষা। চলচ্চিত্রকারেরও। মানুষই অন্বেষা, মানুষই পাথেয়, মানুষই-লক্ষ্য। ওই যে মধ্যযুগে বড়– চন্ডীদাস বলেছিলেন; “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” শিল্পের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। আমাদের এই বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও লালনের কাছ থেকে আমরা যদি কিছু শিখে থাকি তো এটাই তো শিখেছি যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সবার উপরে হচ্ছে-মানুষ। সেই মানুষকে শ্রদ্ধা করে ও ভালোবেসেই আমাদেরকে মানুষের কাছে মানুষের গল্প বলতে হবে। তা মাধ্যমটা অক্ষর, সেলুলয়েড, টেপ বা পিক্সেল যেটাই হোক্।
তাই সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার উভয়েরই নিজস্ব কোনো জাতপাত বা সামাজিক শ্রেণী থাকলে চলবে না। একজন শিল্পীকে হতেই হবে-সর্বমানুষের। দেশ, জাত ও শ্রেণীর উর্ধ্বে উঠতে পারলেই কেবল তিনি সমাজসত্যের প্রকৃত নিগূঢ়তায় পৌঁছতে পারবেন। একজন শিল্পীকে তাই জীবনকে দেখতে ও দেখাতে হবে নির্মোহ দৃষ্টিতে। আমরা যখন ছবি তৈরী করি তখন এ কথা সর্বদা মাথায় রাখি যে আমরা কোনো জাতি, বর্ণ বা গোষ্ঠীর শিল্পী নই। আমরা তখন বাঙ্গালীও না, অবাঙ্গালীও না, হিন্দুও না, মুসলমানও না, আমরা তখন মানুষের শিল্পী-“Man with a capital M”। এই মানুষের মধ্যে আমি নারীকেও রাখছি। এটা কেবল মানবতাবাদী কোনো তত্ত্বের জন্যে নয়, শিল্পকে তার নিজস্ব শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্যেই এটা প্রয়োজন। অন্যথায় একজন চলচ্চিত্রকারের ছবি একদেশদর্শী, কৃত্রিম ও পলকা হতে বাধ্য। মহাকালের বিচারে তা’ টিঁকবে না।
কাল মার্কস বলেছিলেন কথাটা; “শীলারীয় কোর না, শেক্সপীয়ারীর কোর”। অর্থ্যৎ শ্রেণী সত্যকে সঙ্কীর্ণ করে না তুলে, শিল্পকে শেক্সপীয়ারের মতোই সর্বমানবের করে তোল। মানুষের জীবনসত্যকে তুলে ধরলে শ্রেণীসত্যটাও ফুটে উঠতে বাধ্য। মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে তাই “থিওরী অব অ্যাপারেন্ট কন্ট্রাডিকশন”-য়ের কথা বলা আছে। বাস্তবতার শ্রেণীনির্যাসটা তুলে ধরার জন্যে শিল্পীকে কোনো এক পক্ষের চিত্র আঁকবার কোনো প্রয়োজন দেখি না। সামাজিক ব্যবস্থার ভেতরেই রয়ে গেছে শ্রেণীবাস্তবতা ও শোষণের চালচিত্র। সমাজ বাস্তবতাকে যথাযথ নৈব্যর্ক্তিভাবে তুলে ধরতে পারলেই সেই সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বগুলো ও শোষণের চিত্রগুলোও আপনা থেকেই ফুটে উঠবে, যাকে মার্কস বলেছেন-“আপাতবৈপরীত্য তত্ত্ব”। আর সে কারণেই দেখি অনেক ঘোষিত বামপন্থীর চেয়ে অনেক উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানবতাবাদী চলচ্চিত্রকারের কাজে সমাজসত্যের চিত্রায়ন বেশী ভালো করে ফুটে ওঠে, যে সত্যের উপর দাঁড়িয়ে লেনিন বলতে দ্বিধা করেননি যে; “মায়াকোভস্কি ভালো, পুশকিন আরো ভালো”!
আমাদের মতো দেশে সমাজসত্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার দু’জনকেই একটা বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। তা’ হচ্ছে-ধর্ম। কারণ সমাজকে ধারণ, লালন ও চালনা করে ধর্ম থেকে উৎসারিত বিশ্বাস. সংস্কার ও মূল্যবোধগুলো। আর জনগণের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, জনগণের শিল্পী হিসেবে আমাদের কাছেও তা’ গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে ধর্মকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। মনে রাখতে হবে, ধর্ম কেবলই আফিম নয়, ধর্ম শোষিতের দীর্ঘনিঃশ্বাসও। ধর্মের মাধ্যমে স্বর্গের সমালোচনাকে এক সময় মর্ত্যরে সমালোচনাতে নামিয়ে আনতে হয়। কাজটা কঠিন, কিন্তু যুগে যুগে সুদক্ষ চলচ্চিত্রনির্মাতারা তা’ করতে ব্যর্থ হননি-“নাজারিন”, “ভিরিদিয়ানা”, লুই বুনুয়েলের এসব ছবিকে স্মরণ করুন। ধর্মের বরাতে ক্যাথলিক গীর্জাকে কী আক্রমণটাই না করলেন বুনুয়েল বা পৌত্তলিক কুসংস্কারকে সত্যজিৎ রায় “দেবী”-তে। এই বোধটাই আমাকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস “লালসালু” নিয়ে ছবি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সাধারণতঃ আমার ছবির জন্যে গল্প আমি নিজেই লিখে নিই। “লালসালু” ব্যতিক্রম, কারণ এখানে আধ্যাত্মিক জগতের সমালোচনাকে যথার্থভাবেই মর্ত্যরে জাগতিক জীবনের সমালোচনায় পরিণত করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
সব দেশের চলচ্চিত্রেই সে দেশের প্রাচীন ধর্মীয় চরিত্রগুলি, পুরাণ ও উপাখ্যান পর্দায় প্রায়শঃই ফিরে আসে। ফিরে আসে মীথ হয়ে। মীথের সুপ্রযুক্ত ব্যবহার সিনেমাশিল্পকে তাই সমৃদ্ধতরই করে, বার্গমানের-“দি সেভেন্থ সীল”। কখনো একজন ঋত্বিক ঘটকে মাতৃরূপের চিরন্তন আর্কিটাইপ জগদ্ধাত্রী মা দূর্গা বা কালীর মীথ হিসেবে পর্দায় ফুটে ওঠে, যা এক জনগোষ্ঠীর অবচেতন ইচ্ছের প্রতিফলন হিসেবে সিনেমা শিল্পকে, আরো সূক্ষ্ম ও গভীরতরই করেছে। সিনেমার যে একটা অন্তর্ঘাতমূলক বিপজ্জনক সম্ভাবনা রয়েছে এস্টাব্লিশমেন্ট সে বিষয়টি ভালই বোঝে। সিনেমাকে তাই তার জন্মলগ্নেই ডাইনীরূপী সেন্সরের আঁতুড়ঘর পেরিয়ে আসতে বাধ্য করা হয় যা সাহিত্যের ক্ষেত্রে করতে হয় না। জনগণের কোনো অংশ আপত্তি করলেই কেবল কোনো সাহিত্যকর্মকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কোনো সিনেমা, কেউ দেখার আগেই, সেন্সর বোর্ড নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। দেয়ও। এ অনেকটা একটা শিশুর জন্মের আগেই তাকে শেষ করে দেওয়া। জনগণ জানতেই পারল না শিশুটি কেমন ছিল!
সিনেমা ব্যয়বহুল মাধ্যম বলে সিনেমার ঝুঁকি থাকে কর্পোরেট পুঁজির খপ্পরে পড়ে তার শিল্পসত্তাকে হারানো। সব শিল্পের মধ্যে সিনেমাতেই তাই শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামটা সবচে’ কঠিনতম এক সংগ্রাম। বিশ্বায়নের এই যুগে, কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসিতায়, চলচ্চিত্রকারের উপর এক বিশেষ দায় বর্তায় নিজ নিজ দেশের “জাতীয় সিনেমা”-কে বাঁচিয়ে রাখার। যেহেতু সিনেমার ভাষাটা সর্বজনগ্রাহ্য, আন্তর্জাতিক, তাই দেশ-কালের উর্ধ্বে ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছনোর দিক থেকে মাতৃভাষায় রচিত সাহিত্যের চেয়ে সিনেমার একটা বাড়তি সুবিধা রয়েছে। বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার এই যুগে সে কারণে আমরা দেখি অক্ষরের সাহিত্য নয়, চিত্রকল্পের চলচ্চিত্র-মাধ্যমটিই আজ দুনিয়া জুড়ে মানুষদের, বিশেষ করে তরুণদের, আরো বেশী বেশী করে আকর্ষণ করছে, এবং আমার ধারণা, করতেই থাকবে। এটা ঠিক যে সিনেমা আন্তর্জাতিক শিল্পমাধ্যম, কিন্তু নিজ নিজ দেশের মাতৃভাষায় নির্মিত “জাতীয়” সিনেমাগুলিকে টিঁকিয়ে রাখাটাও বিশেষ জরুরী। কারণ জাতীয় সিনেমার মাঝেই সেই জনপদ ও জনগোষ্ঠীর জীবনের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও জীবনের সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতাগুলি সঞ্চিত থাকে। সকলেই যদি ম্যাকডোনাল্ড আর বার্গার কিং খায় থাক, কিন্তু মা-মাসী ও নানী-দাদীর অনবদ্য সেসব দেশীয় রান্নাগুলোকেও তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ঠাকুরমার ঝুলি হারিয়ে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম যে সাংস্কৃতিক শূন্যতায় পড়বে, কোনো কিছু দিয়েই কী সে শূন্যতা আর পূরণ করা সম্ভব হবে ?
সেই কবে জ্যাঁ ককতো বলেছিলেন যে, সিনেমা কেবল তখনই একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শিল্প হবে যখন ক্যামেরার দাম কলমের মতো, আর ফিল্মের দাম কালির দামের মতো সস্তা হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ সে সম্ভাবনাটা সৃষ্টি করেছে। আর এখন তো আপনি আপনার মোবাইল ফোনটা দিয়েও সিনেমা তৈরী করতে পারেন। ইরানের আব্বাস কিয়ারোস্তামিরা তো দেখিয়েই ছেড়েছেন যে কতভাবেই না চলচ্চিত্র তৈরী করা সম্ভব। গদার হয়তো খুব ভুল বলেননি যে, সিনেমার জন্ম হয়েছিল গ্রিফিথের হাত ধরে, মৃত্যু ঘটল কিয়ারোস্তামীর হাতে! পুরনো ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণের মৃত্যুঘন্টা আজ সত্যিই বেজেছে!
প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতায় সৃষ্টিশীলতার এক ব্যাপক বিস্ফোরণের বাস্তব সম্ভাবনা আজ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ওই যে জীবনানন্দ বলেছিলেন, সকলেই কবি নহে, কেহ কেহ কবি। তাই আগামী দিনে ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে বড় পর্দায় এবং কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের ছোট পর্দায় প্রচুর চলচ্চিত্রিক কাজ হয়তো আমরা দেখতে পাব, তবে তার কতটা শিল্প হয়ে উঠবে দেখবার বিষয় সেটাই।
একজন শিল্পীর এটা দায় থাকে যে শিল্পের যে মাধ্যমটিতে তিনি কাজ করছেন, তা’ সাহিত্যই হোক বা সিনেমা, সেই বিশেষ মাধ্যমটির নিজস্ব ভাষাটার আরো বিকাশ ঘটানো। তাকে আরো বৈচিত্র্যময়, সংবেদনশীল ও সূক্ষ্মতর করে তুলে সে ভাষার সীমান্তরেখাটিকে আরো কিছুটা প্রসারিত করার। বাংলাদেশে আমাদেরকে অত্যন্ত স্বল্প বাজেট ও সীমিত প্রযুক্তি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়। তা’ সত্ত্বেও চলচ্চিত্র-ভাষা নিয়ে কিছু নিরীক্ষা আমরাও করেছি। আমার দু’টো ছবির কথা বলতে পারি-“রাবেয়া” ও “লালন”। “রাবেয়া” হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মঞ্চস্থ সফোক্লিসের “আন্তিগনে” নাটকটির বাংলাদেশী চিত্রায়ন। প্রথমে আমি এটা একটা মঞ্চনাটক হিসেবেই লিখেছিলাম-“একাত্তরের আন্তিগনে”। পরে যখন নাটকটি সিনেমা হিসেবে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিই তখন ঠিক করি যে এমনভাবে চিত্রনাট্যটি লিখব যে একটা মঞ্চনাটক চলচ্চিত্রায়িত হলে যেমন হোত সেই নিরীক্ষাটা ছবিটিতে থাকবে। ফলে মঞ্চ-নাটকের মতোই বেশ কিছু দীর্ঘ সংলাপ-দৃশ্য রয়েছে ছবিটিতে। রয়েছে অনেক Mise-en-scene বা একক দৃশ্য যেগুলো যতটা না চিত্রকল্পনির্ভর তার চেয়ে বেশী মঞ্চ নাটকের মতোই সংলাপ-নির্ভর। মঞ্চ-নাটকের মতোই কখনো একটা চেয়ার, কখনো একটা সিঁড়িকে ব্যবহার করা হয়েছে দৃশ্যগত প্রতীক হিসেবে। আমাদের চেষ্টাটা ছিল একটা মঞ্চ-নাটক চলচ্চিত্রায়িত হলে দর্শকমনে যে রকম অনুভূতি হয় সেই অনুভূতিটা সৃষ্টি করার।
আর লালন ফকিরের প্রকৃত জীবনচিত্র যেহেতু কিছুটা ধোঁয়াশা, অনেক কিছুই রয়ে গেছে জানা-অজানার এক ধূসর জগতে, ফলে একটা সাধারণ বায়োপিক বা জীবনকাহিনীতে যেরকমটি করা হয় যে একরৈখিক একটা জীবনকাঠামো তুলে ধরা, “লালন” ছবিটিতে সেটা না করে আমরা লালনের জীবন ও দর্শনকে দেখাতে চেয়েছি ওঁর গানগুলোর মাধ্যমে। কারণ ওঁর গানগুলি ওঁর জীবনকাহিনীর মতো অনির্ভরযোগ্য নয়। ফলে “লালন” ছবিটা তৈরীর ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী হতে চেয়ে আমরা মূলতঃ লালনের গানগুলিকেই আশ্রয় করেছি। তৈরী করার চেষ্টা করেছি এক লোকজ ধরণের-মিউজিকাল ফিল্ম। তাই কখনো পুরো গানটি, কখনো একটি অন্তরা, কখনো বা ওঁর গানের বাণীর বিশেষ কোনো লাইনকে সংলাপ হিসেবে “লালন” ছবিটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এও এক ধরণের চলচ্চিত্রনির্মাণ। হয়তো এক ভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ!
সাহিত্য ও সিনেমা এ দু’টোই সুগভীর ও ব্যাপক দু’টি শিল্পমাধ্যম এবং এ দু’টি মাধ্যমের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আমি হয়তো পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি। কিন্তু এক জায়গায় তো আমকে থামতেই হয়! শুধু শেষের আগে বলব আমার নিজের কাছে সাহিত্য ও সিনেমা দু’টোই প্রিয়তম দুই শিল্প । জীবনসত্যের কাছে পোঁছনোর ক্ষেত্রে এ দু’টিই খুব শক্তিশালী দুটি মাধ্যম। পার্থক্য বলতে পারেন, সাহিত্য যেন সেই কিশোর বয়সের কোনো শরৎভোরে শিউলীগাছতলায় দেখা হওয়া প্রথম প্রেমিকা যাকে সারা জীবন ভোলা যায় না। আর সিনেমা হচ্ছে যৌবনের উচ্ছল সাহসী উন্মাদনা। জীবনাভিজ্ঞ মানুষেরা জানেন জীবনে এ দু’টোই কত গুরুত্বপূর্ণ! মানুষের প্রকৃত জীবনসত্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এ দুটো মাধ্যমের কারো চেয়ে কারো ক্ষমতা কম নয়। দু’টো শিল্প মাধ্যমকেই আমি তাই সমান ভালোবাসা ও গুরুত্ব দিতে চাই।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে।