| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
খবরিয়া

মুক্তচিন্তা ও বাংলাদেশের রাজনীতি । এ কে এম শাহনাওয়াজ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কার্ল মার্কস ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক অর্থে নেতিবাচকভাবেই বলেছেন। বক্তব্যটি বিতর্কিত। কিন্তু কেউ যদি নিজ উদ্দেশ্যে ধর্মের কথাকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান, তাহলে সেই দায় ধর্মের থাকে না। বিকৃত আফিমে যদি কেউ সরল মানুষদের বুঁদ করতে চান, তবে দায় ধর্মের নয়, ধর্মকে ভুল ধারায় ব্যবহারকারীর। কার্ল মার্কস এভাবে ব্যাখ্যা করেননি। তার চেয়েও আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের অনেক কর্মী-সমর্থক আছেন, যারা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের তৈরি করা রাজনৈতিক আফিম খেয়ে অনেক বেশি বুঁদ হয়ে পড়েন। সেখানে এ ধরনের আফিমখোর মানুষ মুক্তচিন্তার গুণাবলি হারিয়ে ফেলেন। বিবেক সুস্থ চিন্তা করার ক্ষেত্রে কাজ করে না। যাবতীয় অকল্যাণ তৈরি হয় এই ধারায়।

 

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস পাঠকমাত্রই জানেন, প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর যাবতীয় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে ধর্মীয় প্রণোদনা থেকেই। প্রাচীন মিসরে পিরামিড, স্ফিংস, মমি তৈরি হতো না যদি তারা পরকাল চিন্তা এবং পরকালে নেতৃত্ব দেয়া ফারাওয়ের দেহ সংরক্ষণের প্রয়োজন অনুভব না করত। প্যাপিরাস তৈরি, কাগজে ধর্মবাণী প্রকাশের জন্যই উদ্ভাবিত হয়েছিল প্রাচীন মিসরীয় লিপি হায়ারোগ্লগিফ। একই প্রণোদনায় পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, গণিত-জ্যামিতিরও উদ্ভাবন হয়। পৃথিবীর সব ধর্মের আদি গ্রন্থ পাঠ করলে দেখা যাবে, ধর্ম প্রধানত মানবকল্যাণের কথাই বলে।

কিন্তু রাজনীতি কি ধর্মের মতো এর প্রকৃত সৌন্দর্যকে ধারণ করতে পারছে? এখানেও দিনে দিনে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, হচ্ছে। আর একেক দলের রাজনৈতিক ধ্বজাধারীরা নিজ দলের পক্ষে জীবন বিপন্ন করতেও দ্বিধা করছেন না। যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি কেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর মতো দলকে সমর্থন করছেন? রাজনীতির মাঠ গুলজার করছেন? তাহলে কতটুকু সদুত্তর পাবেন। যদি স্বল্পশিক্ষিত থেকে শিক্ষিত দলবাজ মানুষদের প্রশ্ন করা হয়, আপনার সমর্থিত দলের আদর্শ কী? দলের নেতৃত্বে যারা আছেন তারা কি নিজ নিজ দলের আদর্শের পথে হাঁটতে পারছেন? অতীতে বা বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জনকল্যাণে কতটা নিবেদিত ছিলেন? স্বীয় রাজনৈতিক আদর্শ কতটা ধারণ করতে পারছেন? কী উত্তর দেবেন তারা! যদি তা না হয়, তাহলে সমর্থক মহলের কজন বিবেকের তাড়নায় প্রকাশ্যে নিজ দলের সমালোচনা করেছেন? অপ্রকাশ্যেও কি সমালোচনা করতে পারেন? অর্থাৎ রাজনীতির কঠিন আফিমে বুঁদ হয়ে আছেন সবাই।

 

জামায়াতে ইসলামীর কর্মী-সমর্থকদের বলি, আপনারা কি ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখেছেন, ইসলামের নামে দাঁড়ানো এই দল কখনোই সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারেনি। পাকিস্তান আমলটি ছিল সাংবিধানিকভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র। তার পরও কোনো নির্বাচনে গণমানুষের সমর্থন এ দলটি তেমনভাবে পায়নি। ওয়াহাবি আদর্শের অনুসারী বলে এরা ইসলামি আদর্শ বিচ্যুত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত করে না। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে এই দলের সমর্থক কোনো বিবেকবান কি প্রশ্ন তুলেছেন? মানছি মুক্তিযুদ্ধের সময় অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করা দলীয় আদর্শ রাজনীতি বিচারে অন্যায় কিছু নয়। তাই বলে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যা, বাঙালির জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করা, নারী নির্যাতন করা তো ইসলাম সমর্থিত হতে পারে না। ইসলামি নামধারী দল হিসেবে তারা কেন প্রতিবাদ করেনি? প্রতিবাদ দূরের কথা, বরং অমানবিক সব জঘন্য কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি সৈন্যদের দোসর হয়েছেন। তাই অন্তত এই প্রজন্মের মানুষ যদি ধর্ম মানেন এবং বিবেকবর্জিত না হন, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত থাকেন কেমন করে? আসলে এরা সবাই রাজনৈতিক আফিম সেবন করেছেন।

আমার এক কাছের মানুষ, তিনি বিএনপি সমর্থন করেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরিবার থেকে এসেছেন। কিন্তু তিনি বিএনপির আদর্শ ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা জেনেও এ যুগের আওয়ামী লীগ নেতাদের তার ভাষায় আদর্শচ্যুতি ও অন্যায় দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপিকে সমর্থন করছেন। অর্থাৎ জেনে-বুঝে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দিয়েছেন। আফিমে বুঁদ না হলে এমন হওয়ার কথা নয়। আসলে এমন ধারার বাস্তবতায় মুক্তচিন্তা ও বিবেক কাজ করে না।

 

আমি অবাক হয়ে যাই, কতগুলো প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না পেয়েও সমাজের অনেক শিক্ষিত সচেতন অংশ যখন বিএনপিকে সমর্থন দিতে থাকেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানসহ অন্য সেক্টর কমান্ডাররা সমানভাবে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কি না আমরা জানি না। কিন্তু এটি জানি, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী হিসেবে সামরিক পোশাক পরে এ দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এটুকু না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বিএনপিপন্থিদের প্রশ্ন করা উচিত, এমন নির্মম হত্যাকারীদের বিচার করা যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেখানে প্রেসিডেন্ট কেন ইনডেমনিটি জারি করে হত্যাকারীদের রক্ষা করলেন ও তাদের পুরস্কৃত করলেন?

যেখানে দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেখানে পাকিস্তানপন্থি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে তো বাঙালির বন্ধুত্ব হতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারী তো তারা হতে পারে না। তাহলে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানকে কেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী বানালেন? মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের বেছে বেছে সেনানিবাসে গোপনে হত্যা করতে থাকেন বিচারের নামে প্রহসন করে। এর পর থেকে পরাজিত পাকিস্তান যা যা চায়, তাই বাস্তবায়ন করতে থাকেন জিয়াউর রহমান ও তার মৃত্যুপরবর্তী বিএনপি সরকার। বেগম খালেদা জিয়ার আমলে এমন সব মানবতাবিরোধী ঘাতক যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদেরও মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছিলেন। বিএনপিপন্থি বা সমর্থক কেউ কি এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন?

 

একটি মুক্তিযুদ্ধ হুট করে সংঘটিত হয় না। এর জন্য দীর্ঘদিনে রাজনৈতিক প্রস্তুতির প্রয়োজন। নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। বঙ্গবন্ধুর তেমন বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাঙালি জাতি। অথচ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি নেতারা যখন ১৯৭১-পূর্ব দেশের দীর্ঘ রাজনীতির পেক্ষাপটে অনুপস্থিত ও অচেনা একজন মেজরকে সময়ের সুবিধা নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচার করতে থাকলেন, তখন শিক্ষিত কোনো বিএনপি অনুসারী কি প্রশ্ন তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন? আসলে রাজনৈতিক আফিমে বুঁদ হয়ে থাকলে তা সম্ভব হয় না। না হলে এতসব জরুরি প্রশ্নের নিষ্পত্তি না করে বিএনপিপন্থি নানা পেশাজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও রাজনীতির সূত্রে লাভালাভের প্রত্যাশী মানুষরা শুধু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপিভক্ত হতে পারেন কেমন করে?

এ যুগের আওয়ামী লীগভক্তদের সামনে দলকে সমর্থন দেয়ার আগে কি কোনো প্রশ্ন নেই? সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুদের গড়া আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক আদর্শ কি এখন অবলম্বন করে চলছে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে? বরং বৈষম্য বাড়ছে দিন দিন। দলীয় গণ্ডির বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের সম্মান কি সংরক্ষিত আছে এ সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কর্মভূমিকায়? প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দৃঢ়তায় দেশ নানা দিক থেকে অগ্রগতির সোপান অতিক্রম করতে পারছে ঠিকই; কিন্তু সামাজিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা থাকলে এ অগ্রগতি কতটা টেকসই হবে, এমন ভাবনা কি ভাবা হচ্ছে?

দলীয় গণ্ডি ভেঙে যেখানে যোগ্য নাগরিকদের দেশকল্যাণে যুক্ত করার কথা, সেখানে আরও কঠোর দলতন্ত্র জায়গা করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় তা বুমেরাং হতে বাধ্য। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থকরা অর্থাৎ রাজনৈতিক আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা অনুসারীরা এসব প্রশ্ন তুলছেন না। এ দেশের ক্ষমতাসীন সব দলের নেতা-নেত্রী ও সেয়ানা সহযোগীরা দুর্নীতি করে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। এ ধারা এখনো অব্যাহত। কিন্তু দলের নেতা-সমর্থকদের কাউকে তো আত্মসমালোচনা করতে দেখি না। এ ঘরানার মানুষরা রাজনৈতিক আফিমের কারণে বিবেক বিসর্জন দিয়েছেন বলে মুক্তকণ্ঠে কথা বলতে পারছেন না।

এসব কারণে এখন আমাদের রাজনৈতিক আফিমমুক্ত হওয়া জরুরি। এর পেছনে চালিকাশক্তি হতে পারে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বর্তমান প্রজন্মের বড় অংশ এই চেতনা বিচ্ছিন্ন। তাই রাজনৈতিক অঞ্চলের সুবিধাবাদীরা সহজেই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে দলে টানতে পারছেন। দুর্নীতি আক্রান্ত সমাজ তারুণ্যের আদর্শিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। আমরা কি বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনৈতিক সংস্কারক, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নওয়াব আবদুল লতিফ বা হাজী মুহম্মদ মহসীনের মতো সমাজ সংস্কারককে আর আবির্ভূত হতে দেখব? দেশপ্রেম ধারণ করা রাজনীতিকদেরই এখন এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন থেকে বেরিয়ে আসার পথনির্দেশনা দিতে হবে। এভাবে এক দিনে নয়, অনেক দিনে আমরা সফল হব কালের অন্ধকার তাড়াতে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত