উৎসব সংখ্যা গল্প: নাটকীয় । পার্থ ঘোষ
প্রথমে ভেবেছিল যাবে না। এসব অভ্যেস অনেকদিন চলে গেছে। একটা সময় ছিল যখন নাটক থিয়েটার প্রচণ্ড ভাবে টানত মনটাকে, তখন বাধ্য হয়েই মন টানত শরীরটাকে। তার ফলে নাটক, থিয়েটার, যাত্রা কিংবা সিনেমা কোনটাই বাদ পড়ত না।
মনের ওপর তখন চাপ ছিল না। সব সময়ই উড়ে বেড়াত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। এখন সে সুযোগ নেই। সুযোগ থাকলেও মনটা আর সাড়া দেয় না। মনটা যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, থেঁতলে গেছে সংসারের যাঁতাকলে। এখন জীবনটাই একটা নাটক। বেঁচে থাকাটাই একটা থিয়েটার। নিজেকে রঙ্গমঞ্চের কুশীলব বলে মনে হয় সর্বদা।
আমন্ত্রণ পত্রটা পেয়ে তাই দ্বিধায় পড়েছিল মনটা। অনভ্যাসের কাঁটা। শেষ পর্যন্ত কাঁটাটাকে তুলতে পেরেছিল প্রণতি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নাটকটা দেখতে যাবার। কিছুক্ষণের স্বাদ বদল। সংস্কৃতির আয়নায় নিজের জীবনটাকে দেখে নেওয়া।
স্মৃতি দিয়েছিল । না করতে পারেনি তখন। পুরোন দিনের বন্ধু । একসঙ্গে অনেক নাটক দেখেছে। কলেজ জীবনের অনেক রঙীন স্বপ্ন এক সঙ্গে ভাগ করেছে। সে এখন নাট্য কর্মী। ওদের একটা নাট্য সংস্থা আছে। স্বামী-স্ত্রীতে নাটক করে একসঙ্গে। ভালোবাসার বিয়ে। বেশ আছে দুটিতে।
বেশ কিছুদিন ওদের নতুন কোন প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়নি। অনেক রকম অসুবিধা থাকে একটা নাটককে মঞ্চস্থ করতে। স্মৃতিরা সখের থিয়েটার করে, নাটককে ভালোবেসে। দৈনন্দিন জীবন থেকে কিছু সময় চুরি করে, নিত্যকার সাংসারিক খরচ থেকে কিছু অর্থ সরিয়ে নিয়ে মনের ক্ষিধে মেটাতে, কিছু সৃষ্টি করার সৃজনশীলতায় মেতে উঠে ওরা নাটক করে। নাটক ওদের ভালোবাসা।
সবসময় সময় মত রিহার্সাল দেওয়া হয়ে ওঠে না। সবাইকে এক সাথে পাওয়াও যায় না। তারপর খরচের ব্যাপারটাও একটা বড় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও টিকিট বিক্রী, লাভ-লোকসানের হিসেব, অন্তর্জালের প্রকোপ থেকে মানুষকে প্রেক্ষাগৃহ মূখী করার প্রচেষ্টা, টিভি সিরিয়ালের রঙীন পরিবেশনা থেকে দর্শক ছিনিয়ে আনা এসব তো আছেই।
এত কিছু সামলে তবেই একটা নাটক মুক্তি পায় প্রেক্ষাগৃহের চার দেয়ালের বন্ধনে। সংসার তো নিজেই একটা মঞ্চ। যে মঞ্চে অনুষ্ঠিত দৈনন্দিন পালা সমাপ্ত হবার পরই তো অন্য নাটকের চিন্তা ভাবনা করতে হয়।
সেদিন স্মৃতির সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়েছিল বাজারে। স্মৃতি প্রণতিকে আমন্ত্রন পত্রটা দিয়েছিল। বলেছিল, “তুই তো এককালে নাটকের পোকা ছিলি, অনেক দিন পর একটা নাটক করছি, অনেক বাঁধা অতিক্রম করে; আসিস্। তুই আসলে ভালো লাগবে”।
প্রণতি বলেছিল – “নাটক!” – একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল ওর নাক থেকে। নাকের পাতলা পাটাটা একটু ফুলে উঠিছিল। নাকছাবিতে একটু ঝিলিক লেগেছিল রৌদ্রের। একটু থেমে সে বলেছিল – “আমার জীবনটাই তো এখন একটা নাট্যমঞ্চ। আমি নিজেই তো একজন অভিনেত্রী”।
স্মৃতির মুখের হাসি মলিন হয়েছিল। বলেছিল – “জানি তো সবই। কি করবি বল সব-ই ভাগ্য। সব ঝেড়ে ফেলে স্রোতে ফিরে আয়। দেখিস্ ভালো লাগবে। তোকে বাঁচতে হবে প্রণতি। নিজের জন্য বাঁচতে হবে”।
মৃদু হেসেছিল প্রণতি। আমন্ত্রণ পত্রটা গ্রহণ করে বলেছিল – “তোর নাটক তো! যাব। নাটক তো জীবনের আয়না। দেখব নিজেকে সেই আয়নায় দেখা যায় কি না”।
আমন্ত্রণ পত্রের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখেছিল প্রণতি নাটকের নাম – ‘তোমার জন্য আমি’। নীচে মুখ্য ভূমিকায় স্মৃতি আর তার স্বামী অর্নবের নাম ছাপার অক্ষরে।
তুমি, আমি; এই ব্যাপারগুলো এখন প্রণতির কাছে কিরকম ধূসর লাগে। মন থেকে যাকে তুমি বলে একধরণের বিজাতীয় আনন্দ পাওয়া যায় সে তো আজ প্রণতির থেকে অনেক দূরে। আমিটাই তার আমিত্ব নিয়ে আমসত্ত্বর মত বিরাজমান। তুমি এখন লজেন্সের মোড়কে শোভা বর্দ্ধন করে চলেছে।
(২)
অর্ণবের কাছ থেকে টিকিটটা চেয়েই নিয়েছিল প্রসূন। চেনা মানুষের নাটক। তার ওপর ‘আমি’ ‘তুমি’ ব্যাপারটাও জড়িয়ে আছে। জীবন নাটকের আমি তুমিতে ঘাটতি থাকলেও অপরের জীবনের ওগো, হ্যাঁগো, আমি, তুমি ব্যাপারটা দেখতে ভালোই লাগে। বেশ রসবোধ হয়। তাছাড়া অফিস থেকে ফিরে সময়টাও কাটে। প্রতিদিন শুকনো আড্ডা দিতে ভালো লাগেনা। নাটকের প্রতি মোহটা সেরকম নেই। তবে, সময় কাটানর জন্য নাটক, সিনেমা চলে যায়।
সিনেমা ব্যাপারটার তো এখন চল কমেছে। এখন সব মাল্টিপ্লেক্স। সিনেমার দর্শক এখন অনেক কম। নেট, মোবাইল, ট্যাব ওতেই সিনেমার স্বাদ মিটে যায় দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মত। মানুষের এখন সময় কম। তিনঘন্টা ধরে বসে সিনেমা দেখা পোষায় না। তার থকে ইউটিউবের শর্ট ফিল্ম বড়ই উপভোগ্য।
সাহিত্যেরও সেরকমই অবস্থা; উপন্যাস ছেড়ে পাঠক এখন পরমাণু গল্প পড়ে। রস চিপে রসগোল্লা খাওয়ার মত।
অর্ণবের সঙ্গে যোগাযোগটা ভালোই আছে প্রসূনের । অনেকদিন পর ওরা স্বামী স্ত্রী মিলে আবার একটা নাটক পরিবেশন করছে শুনে প্রসূন একটু উৎফুল্ল হয়েছিল। ওদের দুটিকে বেশ ভালোই লাগে কষ্টিউমে, স্পট লাইটে, স্বপ্নের জগতে, কল্পিত শব্দের ঝংকারে, সংলাপের বন্যায়। সত্যিই ওরা ‘মেড ফর ইচ্ আদার’; ‘ম্যাড ফর ইচ্ আদার’ তো বটেই ।
অর্ণব টিকিটটা দিয়ে বলেছিল – “মনে করে আসিস্ কিন্তু, তোর যা ভুলো মন। দিনটা হয়ত ভুলেই গেলি”।
প্রসূন হেসেছিল – “আরে, নিজে চেয়ে নিচ্ছি, তার পরও তোর মনে হচ্ছে আসব না?”
-“না, সেটা ঠিক আছে, আসলে তোকে তো চিনি। একদম মনস্থির করতে পারিস না। কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা তোর খুব কম। সে কি আর জানি না?”
-“প্যাঁক্ দিচ্ছিস্? দে দে, সময় ভালো তোর”। একটু থেমে প্রসূন বলেছিল- “আঁকড়ে তো অনেক কিছুই ধরতে চাই, কিন্তু ধরে রাখতে পারি কোথায়? জোরে কিছু চেপে ধরতে গেলেও তা পিছ্লে যায় বেশীর ভাগ সময়ই। হয়ত ধরার কায়দাটা ঠিক জানা নেই আমার। অথবা মুঠোর জোর কম”।
অর্নব হেসে ফেলে বলেছিল – “ডায়লগ তো ভালোই দিস্। মন খারাপ করিস না। নাটকটা দেখতে আয়, ভালো লাগবে। তোর জীবনের সঙ্গে মিল পাবি”।
হেসেছিল প্রসূন। ঈয়ারকী করতেও ছাড়েনি। বলেছিল – “কেন রে, শেষে আমাদের নিয়েই নাটক লিখলি নাকি? তোদের মত এই সাহিত্য সংস্কৃতি প্রেমী মানুষগুলোকে বড় ভয় লাগে; কখন যে কাকে নিয়ে লিখতে বসে যাস্। জীবনের সব কিছুই তোদের কাছে গল্প, নাটক”।
অর্নব বলেছিল – “জীবনটাই তো একটা রঙ্গমঞ্চ রে। আমরা তো সেই মঞ্চের কূশীলব। যতদিন বেঁচে আছি অভিনয় করে যাচ্ছি। সৃষ্টি করছি নাটকের সুখ, দুঃখ, মিলন, বিরহ। জানিস প্রসূন, নাটক করি কেন বল্ তো? যদি সমাজটাকে একটু পাল্টাতে পারি। যদি মানুষগুলোকে মুখ আর মুখোশের ব্যবধানটা চেনাতে পারি, অথবা দুঃখগুলোকে মুছে দিয়ে জীবনে আনন্দর বন্যা বইয়ে দিতে পারি; কিংবা বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া দুটি জীবনকে, দুটি সম্পর্ককে নাটকের মাধ্যমে এক করে দিতে পারি, তবে তো বুঝব এই বিরাট পৃথিবীতে নিজের স্বল্প ক্ষমতা আমি প্রয়োগ করতে পেরেছি ভালো কাজে। মানুষের উপকারে”।
একটু থেমেছিল অর্নব। তারপর বলেছিল – “জানি না পারি কিনা? পেরেছি কিনা? বা কখনও পারব কিনা? তবু ভালো লাগে। আশায় দিন গুনি। যদি কখনও কিছু করে উঠতে পারি। তবেই নাটকের জয় হবে, থিয়েটারের জয় হবে”। – একসঙ্গে এত কথা বলে হঠাৎই থেমে গিয়েছিল অর্নব। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। তারপর প্রসূনের পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলেছিল – “চলে আসিস্”।
এগিয়ে গিয়েছিল অর্নব প্রসূনকে ছেড়ে। প্রসূন ওর চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। মনে মনে বলেছিল, ‘সংস্কৃতির জয় হোক’।
(৩)
অঘটন মনে হয় এভাবেই ঘটে। কাকতালীয় শব্দটাও হয়ত এমন ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়। যদি তা নাই হয় তবে প্রসূন আর প্রণতির টিকিট দুটোর সীট নং পাশাপাশিই বা হবে কেন? অদৃশ্য নাট্যকার হয়ত এভাবেই নাটকের ক্লাইমেক্স রচনা করে থাকেন।
প্রণতি মনঃস্থির করার পর আর দেরী করার প্রয়োজন মনে করেনি। নাটকের প্রদর্শন শুরুর অনেক আগেই এসে সঠিক স্থানে বসে গেছে। সময় কাটাবার জন্য হাতের স্মার্ট ফোনে আঙুল চালিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিচরণ করছে।
হঠাৎই পাশের সীটে আগমন হল যে মানুষটির, ফোন থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল প্রণতি। দেখল প্রসূন তার ডান পাশের দর্শকাসনের দর্শক।
দুজনের চোখাচোখি হল। প্রসূন হাসল। বাধ্য হয়েই হাসল প্রণতি। ভদ্রতার খাতিরে। জোর করে। নিজ সীটে গুছিয়ে বসে প্রসূন বলল – “একেই বলে কপাল”।
প্রণতি বলল – “সীট নম্বর দেওয়া আছে। না হলে অন্যদিকে গিয়ে বসতাম। আমি থাকলে তোমার হয়ত অসুবিধা হবে, কিন্তু আপাততঃ কিছু করার নেই”।
প্রসূনের মুখে হাসি ছড়াল। বলল – “অসুবিধা! হলে হবে। মনে হয় সেরকম কিছু হবে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর কোন কিছুতে অসুবিধা হয় না। অবশ্য তোমার যদি হয়, তাহলে……”
-“হবে না। অ্যাডজাষ্ট করতে শিখিনি বটে, তবে আপাততঃ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছুটা হয়ত রপ্ত হয়েছে। সময় বড় শিক্ষক”।
-“তা বটে। তবে ভালো লাগছে”।
-“ভালো লেগে আর কি হবে? আর তো ক’টা মাস। তারপর তো সব শেষ হয়ে যাবে”।
-“শেষ দেখা যদি এটাই হয়, তবে মনে থাকবে। তাই না?”
-“বাদ পড়ে যাওয়া অঙ্গকে হাতে নিয়ে বয়ে বেরিয়ে কি লাভ?”
-“সব কিছুতে লাভ লোকসান দেখতে গেলে যে জীবন চলতে চায় না”।
-“যে জীবন থমকে গেছে তা আর চলবে কি ভাবে ?”
-“এক্ষুনি নাটক শুরু হবে, আমরা কি এভাবেই ঝগড়া করে যাব?”
-“মতের মিল তো কোনদিনই হয় নি। ঝগড়া দিয়েই শুরু ছিল, শেষটা ঝগড়া দিয়েই হোক্”।
-“তোমার উচ্চাকাঙ্খা, বাবা-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে একসঙ্গে না থাকতে চাওয়া ঝগড়ার কারণ, কিন্তু এখানে তো আমার কিছু করার ছিল না। আমি কাউকেই তো ছাড়তে পারিনা। তুমি যদি একটু অ্যাডজাষ্ট করতে, তবে হয়ত আজ এখানে এভাবে বসে থাকতে হত না। পাশাপাশি সীটের মাঝের দুটো হ্যাণ্ডেল দুরত্ব বাড়াচ্ছে কয়েকশো যোজন”।
-“আমি একাকী বড় হয়ে ওঠা মেয়ে তোমাদের সংসারে হাফিয়ে উঠছিলাম। তুমি একটু চেষ্টা করলে কি একটা উপায় বার হত না? কিন্তু তুমি তোমার গোঁ ভাঙ্গতে চাইলে না। তাই তো আমায় ফিরে যেতে হল বাবার কাছে। বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জানাতে হল। আমি তো পারব না এভাবে থাকতে। আমার বড় হয়ে ওঠার মধ্যে ভাগাভাগি ছিল না”।
-“ছোটবেলায় অনেক কিছুই থাকে না। বড় হয়ে হয়। চেষ্টা করলে মানিয়ে নেওয়া যায়, যায় না কি?”
-“মানাতে আমার সময় লাগত হয়ত। কিংবা কোনদিনই মানাতে পারতাম না। সবে তো আড়াই বছর বিয়ে হয়েছিল। এই আড়াই বছরেই আমি হাফিয়ে উঠেছিলাম তোমার সংসারে। তোমার মার নিয়ম, রীতি-নীতি আমাকে টিঁকতে দিচ্ছিল না। একদিকে হয়ত ভালোই হল”।
-“তা ঠিক। মনের মিল না হলে জোরা-জুরি না করাই ভালো। ফল ভালো হয় না। এখন এই অবস্থায় স্বপ্নগুলো ছিঁড়ে গেল, বেশিদিন বাড়তে থাকলে হয়ত স্বপ্নগুলো রক্তাক্ত হয়ে যেত। তার থেকে এই ভালো। দুজনার দুটি পথ মসৃণ থাক; জীবনভোর”।
-“আমাদের বিচ্ছেদের কাগজ আইনত হাতে পয়ে গেলেই যে টুকু যোগসূত্র আছে তা তো আলাদা হয়ে যাবেই। তখন তুমি স্বাধীন হয়ে যাবে”।
-“তুমিও তো স্বাধীন হয়ে যাবে তাই না?”
-“ছেলেদের স্বাধীনতা আর মেয়েদের স্বাধীনতার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে।
নাটকের প্রথম বেল ওদের কথার বিঘ্ন ঘটায়। বেলের কর্কশ শব্দ ওদের চুপ করিয়ে দেয় ক্ষণিকের জন্য।
প্রসূন পকেট থেকে মোবাইল বার করে সময় দেখে। প্রণতি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে দু ঢোঁক জল খায়। প্রসূনের দিকে তাকিয়ে বলে – “জল খাবে?”
প্রসূন বলে – “দাও। পরে আর সুযোগ হবে কিনা?”
প্রসূন অল্প করে গলা ভিজোয়। বোতল প্রণতির হাতে ফেরৎ দিয়ে বলে – “আজকের আমাদের স্বাক্ষাৎটা খুবই নাটকীয়”।
বোতল ব্যাগের মধ্যে রাখতে রাখতে প্রণতি বলে – “নাটক তো জীবন থেকেই নেওয়া”।
-“ঠিক আছে, জীবন নাটকের এই পর্বে আজকের নাটক চলাকালীন স্বামী স্ত্রীর মত পাশে বসে নাটকটা দেখার অনুমতি তোমার কাছে চাইতে পারি?”
-“লাভ! ক্ষতকে রক্তাক্ত করা ছাড়া তো এর মধ্যে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আর এই ব্যাথাটা একটা পুরুষের চেয়ে নারীরই বেশী অনুভূত হয়”।
-“প্রণতি, পুরুষেরও ক্ষত হয়। পুরুষ তা দেখাতে চায় না। কারণ পুরুষ সিমপ্যাথীর ভাগিদার হতে চায় না”।
-“প্রসূন, মেয়েদের ভেতরটা বড় নরম। তাদের আসল ক্ষতটাও তোমরা পুরুষরা ঠিক অনুভব করতে পারো না। শুধু ওপরের কাঠিন্যটাই পরখ কর। মেয়েরা শামুকের মত। ওই কঠিন আবরণ না থাকলে তোমরা পুরুষরা আমাদের চট্কে দিতে। তাই তো একটা মেয়ের ক’দিন পরে বিবাহ বিচ্ছেদে স্বামীর সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে জেনেও সে একা দু ঢোঁক জলটাও স্বামীকে না দিয়ে খেতে পারে না। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব”।
-“বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারটা কিন্তু তোমারই পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। তুমি চেয়েছ তাই আমি সায় দিয়েছি”।
-“এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। ধর না এর পেছনেও প্রেম আছে। তোমাকে তোমার পরিবারকে ভালোবেসে তাদের কাছ থেকে তোমায় ছিনিয়ে না নেওয়ার প্রেম। আমার আত্মত্যাগ। তোমরা ভালো থেক। আমার জন্য কেন তুমি তোমার পরিবার থেকে আলাদা হবে? ওঁদের সঙ্গে তোমার জীবনের অনেক মুহূর্ত কেটেছে। ওঁরা তোমার আপনজন, তোমার জন্মদাত্রী মা, তোমার ভাই-বোন। তোমার আত্মীয়, পরিজন। ওঁদের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক।”
দ্বিতীয় বেল প্রসূনকে কিছু বলতে বাঁধা দিল। প্রসূন মোবাইলের লক খুলে সেটাকে সাইলেন্ট মুডে সেট করে স্ক্রীনের আলো কমিয়ে দিল।
প্রণতি আগেই মোবাইল নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল। এবার সেটাকে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে এখন শীতল অনুভূতি। প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ। নাট্যমঞ্চের পর্দার আড়ালে ঘোষকের কণ্ঠস্বর – ‘আমাদের বিনীত নিবেদন, নাটক চলাকালীন দয়া করে আপনারা আপনাদের মোবাইল ফোন গুলো সাইলেন্ট মুডে অথবা অফ্ করে রাখবেন। প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে কোনরকম খাবার গ্রহন করবেন না। নাটক চলাকালীন ফ্লাশ ব্যবহার করে বা ফ্লাশ ব্যবহার না করে কোনরকম ছবি তুলবেন না। সঙ্গে শিশু থাকলে সে কেঁদে উঠলে, তাকে দয়া করে বাইরে নিয়ে যাবেন। আপনাদের সহযোগীতাই আমাদের একান্ত কাম্য।’
ঘোষণা শেষে তৃতীয় ও ফাইনাল বেল পড়তেই আলোকজ্জ্বল নাট্যমঞ্চে কুশীলবদের প্রবেশ সমস্ত প্রেক্ষাগৃহকে স্তব্ধ করে দিল। শুরু হল নাটক – “তোমার জন্য আমি”।
(৪)
নাটকে হাস্যরস একটু বেশী মাত্রায় ছিল। সংসারের ঘোরপ্যাঁচকে জাপটে নিয়েও নাট্যকার সরল ভাবে তা হাস্যরসের মাধ্যমে সুনিপুণ কায়দায় পরিবেশন করেছেন। যা দৃষ্টিনন্দন এবং গতিশীলতার মাধ্যমে দর্শককে টানটান ভাবে দর্শকাসনে বসে থাকতে বাধ্য করেছে।
নাটক চলাকালীন কেউ চীপ্স বা চানাচুর খাননি এবং কারো মোবাইল ফোনও বেজে ওঠে নি। এমনকি শিশুরা পর্যন্ত কাঁদতে ভুলে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে হাসির বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। ফলে নাটকের গতিতে বা হাস্যরসে কোনরূপ ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি।
সবচেয়ে আনন্দের কথা প্রযোজক তাঁর নাট্য পরিবেশনার মাধ্যমে আসন্ন দুই বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি ফাঁসে আবদ্ধ দম্পতিকে তাদের বর্ত্তমান অবস্থার কথা ভুলিয়ে দিয়ে হাস্যরসে মজে যেতে বাধ্য করতে পেরেছেন। হাসির মত ব্যায়াম আর দুটো নেই। আবার হাসির মত ছোঁয়াচে রোগও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হাসি মানুষের আয়ূ বাড়ায়। সম্পর্কের জটিলতাকে তরল করে।
প্রণতি আর প্রসূনও তাই হাসতে হাসতে একে অপরের হাত ছুঁয়ে ফেলেছে, একে অপরের মন ছুঁয়ে ফেলেছে। আবার হাসির বানে ভাসতে ভাসতে দশ মিনিটের বিশ্রাম কালে একসাথে চা বিস্কুট ও খেয়ে ফেলেছে। নাটক শেষে বিদায় বেলায় এখন দুজনে প্রক্ষাগৃহের বাইরের সিমেন্ট বাঁধান বসার জায়গায় বসে পটেটো চীপস্ খাচ্ছে আর অনর্গল কথা বলছে।
-“তাহলে আর একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক্ কি বল?” – জিজ্ঞেস করল প্রণতি।
-“তোমার যেরকম মত”। – প্রসূন বলে।
-“এতবড় ডিসিশন হঠাৎ না নেওয়াই ভালো বলে এখন মনে হচ্ছে আমার”।
-“আমারও তাই মত। যদিও সবটাই তোমার ওপর নির্ভর করছে। আমি নয়ত চেষ্টা করব নিজের একগুঁয়েমি গুলোকে কমিয়ে কোন উপায় বার করা যায় কিনা”।
-“তুমি চিন্তা কর। আমিও তোমার সঙ্গে আছি। তোমার পরিবারের সঙ্গেও আছি। আজই বাবাকে বলে উকিল কাকার সঙ্গে কথা বলব বিবাহ বিচ্ছেদটা যাতে স্থগিত করা যায় তার জন্য”।
-“বাবা রাজী হবেন?”
-“আমি রাজী হলেই বাবা রাজী হবেন। আর এখানে তো বাবার কোন মত নেই। বাবা অনেকবার আমায় সব মিটিয়ে নিতে বলেছিল। আমিই…… ভুল করেছি”।
-“আমিও তো ভুল করেছি”।
-“শুধরে নেব”।
-“আমিও নেব। তবে হ্যাঁ নাটকও দেখব। নিজে দেখব, অপরকেও দেখতে বলব”।
-“ধ্যুৎ”।
প্রণতির প্রেমময় থাপ্পড় পড়ল প্রসূনের পিঠে। ওরা দুজনে ‘হো-হো’ শব্দে হেসে উঠল।
অর্ণব আর স্মৃতি সেইসময় গ্রীনরুম থেকে মেকআপ তুলে বাইরে বেরোতেই ওদের দুজনের মুখোমুখি হয়ে পড়ল। ওদের একসাথে বসে উদাত্ত হাসি হাসতে দেখে ওরা থমকে দাঁড়াল। দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে নীচুস্বরে একসঙ্গে বলল – “জয় থিয়েটারের জয়”।

স্কুল জীবন থেকেই লেখার শুরু। ছোট, বড়, মাঝারি ও অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি। লেখাকে পেশা হিসেবে নয়, নেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরে, লেখায় মগ্ন থাকাই ভালোবাসা। ভালো লাগে শব্দ সাজিয়ে সাহিত্যের মালা গাঁথতে। ভালোলাগে নানান ধরনের বই পড়তে । ছোটগল্প বা অণুগল্প খুব প্রিয়।