| 3 মে 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: স্পীড থ্রী । পার্থ ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

শুভেন্দু ক’দিন ধরে একটা স্বপ্ন দেখছে। বেশ বড় স্বপ্ন।  অনেকক্ষণ ধরে দেখে।  সিনেমার দৃশ্যের মত ঘটনাগুলো চোখের সামনে একের পর এক আসতে থাকছে।  স্বপ্নটা দেখতে দেখতে সে কখনও হাসে।  কখনও উল্লাস করে। আবার কখনও কাঁদে।  আনন্দর সঙ্গে ভয়ও পায়।  আর ভয় পেলেই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়।  স্বপ্ন ভাঙ্গে, কিন্তু হারিয়ে যায় না।  পরের দিন আবার দেখে, পরের দিন আবার, পরের দিন আবারও।

গত তিনদিন ধরে স্বপ্নটা দেখছে সে রাতে ঘুমের মধ্যে। প্রথম দু’দিন তার দৈনন্দিন জীবনে সে স্বপ্ন কোন ছাপ ফেলেনি। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে তার মনে হতে শুরু হয়েছে – ‘সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?’ একটা ঘুমন্ত ভয় তাকে চেপে ধরতে চাইছে।  সেই সঙ্গে একটা আনন্দও ছেয়ে ফেলছে তার মন কে, মনে হচ্ছে যদি স্বপ্নের সুখের ছবিগুলো আবার তার জীবনে ফিরে আসে? সে সব দিন….. সেই সব মুহুর্ত…… পরক্ষণেই তার মনটা বিষাদে ভরে যাচ্ছে এই ভেবে, যে হারিয়ে যাওয়া সুখের দিনগুলো শুধু স্বপ্নেরই জন্য আর তার জীবনের জন্য নয় ।  তার মনে হচ্ছে সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।  তেরো বছর বয়সটা এখন তেতাল্লিশ।  শরীরের জোর মনের জোরের ঘাটতি শুরু হয়েছে।  এখন তো স্বপ্ন দেখারই সময়।  স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন। 

দূরে একটা তিনতলা স্কুল বাড়ী ইংরাজী ‘এল’ অক্ষরের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।  স্কুল বাড়ীর সামনের বিশাল মাঠটায় খেলে বেড়াচ্ছে কিছু শিশু, কিশোর।  তারা স্কুলের পোশাক-সাদা জামা আর সাদা প্যাণ্ট পড়ে আছে।  ছেলেগুলোর ভীড়ে একটা হাফ প্যাণ্ট পড়া ছেলেকে খুব চেনা লাগে শুভেন্দুর।  খুব চেনা…. খুব চেনা….

ক্রমশঃছেলেটার মুখটা স্পষ্ট হতে থাকে।  ছেলেটার মুখটা সে চিনতে পারে একটা সময়।  অবিকল তার মুখ।  ওই তো…. ওই তো এটা তো সে – শুভেন্দু রায়। সপ্তমশ্রণী ‘ক’ বিভাগের শুভেন্দু রায় নিজের ছোটোবেলাটা দেখে স্বপ্নের মধ্যেও আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে তার ঘুমন্ত সত্ত্বায় ।  মনটা তার উল্লসিত হয়ে ওঠে। 

ছোটো শুভেন্দু তখন বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।  পায়ে একটা বিবর্ণ ক্যাম্বিশ বল।  ক্রিকেট বলে-ই চলছে ফুটবল খেলা।  বইয়ের ব্যাগে তো আর ফুটবল নিয়ে স্কুলে আসা যায় না।  ক্রিকেট বলটাই টিফিন বক্সের পাশে জায়গা করে নিতে পারে।

স্কুল মাঠটা আজ পোশাকের উজ্জ্বলতায় ঝকমকে হয়ে উঠেছে।  মুখরিত হয়ে উঠেছে ছাত্রদের কলকাকলিতে।  শুভেন্দু দৌড়চ্ছে।  দৌড়চ্ছে বলটা নিয়ে; একজন, দু’জন, তিনজনকে কাটিয়ে ইঁট দিয়ে তৈরী করা গোলে জোরালো শট করল সে।  কুপোকাৎ গোলকিপার।  কলরব- গো-ও-ও-ল।

সাদা জামা,প্যাণ্ট ধূলি ধূসরিত।  গোলকিপার উঠে দাঁড়িয়ে ধূলো ঝাড়ল।  রয়ে গেল অনেকটাই।  রঙ বদলে গেল জামা প্যাণ্টের । আবার ঝাড়ল।  সবটা ধূলো গেল না।  শুভেন্দুর মনে হল গোলকিপার ছেলেটার দুটো তিরস্কার পাওনা হল আজ।  একটা মাষ্টারমশাইয়ের কাছে আর একটা মা-র কাছে।  হোক তিরস্কার, খেলতে তো হবেই।

স্বপ্ন হঠাৎ বদলে গেল।  শুভেন্দু দেখল স্কুল থেকে ফিরে সে মাঠে যাচ্ছে।  সূর্য ডুবছে নদীর অপর পারে।  সবুজ মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে সমবেত ক্রীড়ায় সে মেতে উঠেছে।   হাজার ঘোড়ার শক্তি তার পেশীতে।  কখনও ফুটবল, কখনও ক্রিকেট, কখনওবা খো-খো, কবাডি, চোর চোর খেলা।  আবার কোন সময় শুধু দৌঁড়….দৌঁড়…দৌঁড়….

ক্লান্ত শরীর সন্ধ্যেবেলা পড়ার টেবিলে ।  ঠাকুর ঘরে মার শাঁখের শব্দে নামল সন্ধ্যে।  কাচা শাড়ী গায়ে জড়িয়ে প্রদীপ হাতে মা তুলসী মঞ্চের সামনে।  বাড়ীর মাষ্টারমশায়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বর চোখের পাতা ছুঁয়ে আসা ঘুমের মৃত্যুদূত। পড়া লেখা, অঙ্ক করা একের পর এক। তারপর সন্ধ্যে ঢলে পড়া রাতের কোলে নিশ্চিন্ত বিশ্রাম। 

স্বপ্নের ছবি পাল্টাল।  সকাল হল।  আবার পড়তে বসতে হল।  তারপর স্কুল। এতসবের মাঝে মা-র আদর বাবার শাসন।  দুষ্টুমী, নিত্য নতুন আহার মা-র হাতের গন্ধ মাখা। এক নিটোল ছেলেবেলার স্বপ্ন শুভেন্দুকে হাসায়।  উল্লসিত করে। 

হঠাৎই ঘোর অন্ধকারময় রাস্তার মধ্যে দিয়ে হাঁটারছবি স্বপ্নে ভাসে চোখের পাতায়।  কোথাও কেউ নেই।  শুধু চাপ চাপ অন্ধকার। শুভেন্দুকে যেন গিলে খেতে আসে।  বর্ণময় জীবনটা যেন এক মুহূর্তে কি রকম হারিয়ে যায়।  চারিদিক থেকে আর্তনাদের শব্দ ছুটে আসে।   কিছু দেখতে পায় না সে।  শুধু মাঝে মাঝে রাগী মাষ্টারমশাইদের মুখগুলো দেখে।  তাদের অস্তিত্ব মিলিয়ে গেলে মুখোশ পরা কিছু মুখ এগিয়ে আসে শুভেন্দুর দিকে।  বীভৎস সব মুখ।  তাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর কানে বাজে, শুভেন্দুর। কোন  মুখ বলে আমি সমাজ, কেউ বলে – আমি কুসংস্কার, কেউ বলে আমি মরণ,  কেউ বলে আমি তোমার বার্দ্ধক্য।

শুভেন্দু ভয় পেতে থাকে।  স্বপ্নের মধ্যেও সে বুঝতে পারে তার গলা শুকিয়ে আসছে।  সে ছট্‌ফট্‌ করে ওঠে।  গলার জোরে সে চেঁচিয়ে উঠতে চায়।  কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না।  ঘুমের ঘোরে সে এপাশ ওপাশ করে।  হঠাৎই সেই ঘনঘোর অন্ধকার থেকে কেউ এক বালতী রক্ত ঢেলে দেয় তার শরীরে।  শুভেন্দু ভিজে যায়। আর তখনই তার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।  সে হঠাৎ জাগরণে স্বপ্নের রেশ মাখা চোখে আবিষ্কার করে তার বিছানায় শুয়ে রয়েছে।  বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করতে থাকে।  হৃদপিণ্ডের লাবডুব শব্দটা শুনতে পায় নিজের কানে।  ভোরের সূর্যের আলো জানলার কাঁচ ভেদ করে তার চোখে এসে লাগে। 

ধীরে ধীরে পরিস্থতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকে শুভেন্দু।  স্বপ্নটা একে একে তার মনে পড়তে থাকে।  সে বুঝতে পারে না শৈশবের মধুর স্বপ্নের সঙ্গে শেষ পর্বের ভয়াবহ স্বপ্নের কি সম্পর্ক?  কেন সে প্রতিদিন দেখছে এই স্বপ্ন! তবে কি হারিয়ে যাওয়া শৈশবের পরবর্তী জীবন তার স্বপ্নে অন্ধকার হয়ে দেখা দিচ্ছে? যে জীবন এখন বয়ে বেড়াচ্ছে এটা কি সেই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি!

শুভেন্দুর আধুনিক জীবন, যেখানে তার তেরো বছরের ছেলেটা রাত একটা পর্যন্ত পড়া মুখস্থ করে শুতে যাবার সময় বলে – “বাপি, সকাল ছ’টায় ডেকে দিতে ভুলো না; পড়তে বসতে হবে”।  কিংবা  কোনদিন বলে – “বাপি, সাতটায় ডেকে দিও পড়তে যাব স্যারের কাছে”।

শুভেন্দুকে ডেকে দিতে হয় ছেলেকে।  ইচ্ছে করে না ছোট্টোছেলেটাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে।  তবুও তাকে কাজটা করতেই হয়। 

ছেলেটা চোখ খুলতে পারে না ঘুমের ঘোরে।  অনেক কষ্টে পড়ার তাগিদে পৌষের সকালে লেপের ওম থেকে বেরিয়ে আসে, তখন ছেলেটার মুখ দেখলে কান্না পায় তার। নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ে যায়।

ওই শীতের সকালে কুয়াশা গায়ে মেখে ছেলেটা পড়তে চলে যায়।  ঘুম জড়ান শরীর কেঁপে ওঠে হিমেল হাওয়ায়।  পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায় পা। ছাত্র জীবনটা ওদের বড়ই প্রতিযোগীতার। 

ঘণ্টা দেড়েক প্রাইভেট পড়ে এসেই স্নান খাওয়া সেরে দৌড় স্কুলের দিকে।  শুভেন্দুর ছেলে সঞ্জয়ের স্কুলের ছোট্টো মাঠটায় খেলা হয় টিফিনের সময় ।  কিন্তু সে খেলার প্রকৃতি আলাদা।  বেশী দৌড়-ঝাঁপ করতে পারে না সঞ্জয়ের বন্ধুরা।  সঞ্জয়ও পারে না, অভ্যেস নেই।  একটু খেলে, তার থেকে বেশী গল্প করে, তারপর আবার ঢুকে পড়ে ক্লাস ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। 


আরো পড়ুন: গল্প: এবাদতখানার কলাকুশলী । সানজিদা শহীদ


নিজের শৈশবকে ভুলে শুভেন্দুর মত সব বাবা-মা-রাই এখন ভয় পায়, খেলতে গিয়ে যদি ছেলে মেয়ের চোট লাগে।  তার থেকে তুই শুধু পড়তেই থাক।  তোকে যে ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তোকে প্রথম হতে হবে। আগে যেন কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হত না, প্রথম হত না ।

স্কুল থেকে এসেই দু’মুঠো নাকে মুখে গুঁজে সঞ্জয় দৌঁড় দেয় প্রাইভেট পড়তে। আবার পড়া।  ওদের বাড়ীর পাশের ফাঁকা মাঠটা খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে সারা বছর।  মাঠের বুকে খুব ব্যাথা।  কচি-কাঁচারা মাঠে দাপিয়ে বেড়ায় না। তাদের ছোট ছোট পায়ে মর্দিত হয় না মাঠের সবুজ বুক।  ঘাস দলিত হয় না তাদের পায়ের চাপে।  তাই ঘাসেরা শুধু বাড়তেই থাকে ।  ঘাস বাড়তে বাড়তে জঙ্গলে পরিণত হয়।  মাঠ একদিন হয়ে যায় পোড়ো জমি।

প্রাইভেট স্যারের কোচিং থেকে ছাড়া পেতে পেতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যায়।  সঞ্জয়রা সন্ধ্যা চেনে না।  এখন যে কোথাও শাঁখ বাজে না।  উঠোনহীন বাড়ীতে ফ্ল্যাট সভ্যতায় তুলসী মঞ্চ  হারিয়ে গেছে।  সেখানে আর প্রদীপ জ্বলে না।  তাই সন্ধ্যে হয় না।  অথবা সন্ধ্যে হলেও বোঝা যায় না। 

সঞ্জয় ফেরে টিউশনি থেকে।  তারপর….  টিফিন খেয়েই বসে যায় পড়তে।  পরের দিনের  পড়াটা করে রাখতে হবে তো।  সকালে উঠেই তো পড়তে যেতে হবে।  পড়া চলতে থাকে রাত এগারোটা, বারোটা, একটা।  রাতচরা পাখিরা ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় বাড়ীর ওপর দিয়ে নিস্তব্ধ চরাচর বিদীর্ণ করে।  একসাথে ডেকে ওঠে সারমেয়র দল।  দূরের বাস রাস্তা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলে যায় হৃদয়বিদারক শব্দ তুলে।  পরিশ্রান্ত ছোট্টো ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ে। 

শুভেন্দু তখন নিজেকে অপরাধী মনে করে।  একটা শৈশবকে হত্যা করার অপরাধে সে অপরাধী।  একটা কুঁড়িকে বৃন্ত থেকে তুলে নেবার অপরাধে সে অপরাধী।  প্রতিযোগীতার ইঁদুর দৌড়ে একটা নিষ্পাপ শিশুকে জোর করে র্স্টাটিং পয়েন্টে দাঁড় করিয়ে দেবার অপরাধে অপরাধী। 

তার ভেতরের গুমরে ওঠা কষ্ট নিজের শৈশবের সঙ্গে ছেলের শৈশবের পার্থক্য, কোমলতা যান্ত্রিকতায় বদলে যাবার কষ্ট তাকে কাঁদায়।

পড়া পড়া আর পড়া।  ছেলেটাকে একটু নিজের করে পায়না সে।  দেখতে পায় না ছেলেটা নিজের মনে খেলছে।  স্কুল, পড়া, আবৃত্তি, আঁকা, স্পোকেন নিয়ে সারাদিন শুধু দৌঁড়…দৌঁড়…..দৌঁড়…।

মাঝে মাঝে মনে হয় শুভেন্দুর, সব বন্ধ করে দেয়।  একটু নিস্তার দেয় ছেলেটাকে।  কিন্তু পারে না। পারিপার্শ্বিক চাপ, গতিময় জীবন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাঁধা দেয়।  চলন্ত ট্রেন থেকে যেমন স্থির প্রকৃতিকে সচল লাগে, ঠিক সেরকম অন্য সবাইকে সচল দেখে নিজের ছেলেকে থামাতে পারে না সে।  পরিস্থিতির শিকার শুভেন্দু। 

ছেলেটাও কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে।  দৌঁড়ে যেন নেশা আছে।  সঞ্জয় নেশায় দৌঁড়ায়; বলে – “আমার মত সবাই তো এভাবেই পড়ে বাপি, তাদের তো অসুবিধা হয় না।  আমারও হবে না”।

কখনও বেশী দৌঁড়াতে বারণ করলে, থামতে বললে রেগে যায়। বলে ওঠে – “বাপি! আমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না।  তবে তুমি কেন বারণ কর? কই পলাশ, শংকর, সুমিত ওদের বাবা-মায়েরা তো বারণ করে না”।

শুভেন্দু থমকে যায়।  সে বুঝতে পারে সে থামতে জানে।  কিন্তু তার তেরো বছরের সপ্তম শ্রেণীতে পড়া ছেলে সঞ্জয় থামতে জানে না।  গতিই তার জীবন। স্পীড ওয়ান….. স্পীড টু…. স্পীড থ্রী……

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত