যৌবন / তসলিমা নাসরিন
………………………………..
গোটা যৌবন একাই কাটিয়েছি।
এখন আবার হঠাৎ একা লাগবে কেন আমার!
যদি লাগেও, ও মনের ভুল।
অথবা হয়তো শরীরের ভুল!
যাকে তাকে স্পর্শ করিনি গোটা যৌবন,
কেঁচোর মতো গুটিয়ে থাকতে কেঁচোও জানে না আমার চেয়ে বেশি!
গোটা যৌবন একা একা গেছে,
পুরুষ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে দ্রুত দৌড়ে গেছি ঘরে।
কাঙ্খিত দূরত্বে আজ মনে হয় পড়ে আছি হাজার বছর একা,
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বেরোই,
একটু ঝঞ্ঝাট বাধুক কোথাও, দেখি,
কেউ যদি ঠেলাঠেলি ভিড়ে হাতদুটো ধরে, না হয় ধরুক।
কেউ যদি গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে, না হয় বসুক।
আচমকা কী জানি কী মনে করে চুমু খায় যদি, খাক।
অসাবধানে বুকে যদি হাত লাগে কারো, না হয় লাগুক।
এ শুধু ভাবাই সার।
অভ্যেসের দোষে এখনও খেঁকিয়ে উঠি ত্রিসীমানায় ভিড়তে চাইলে কেউ।
গোটা যৌবন একা পার করে অভ্যেসের দোষে একাই পড়ে আছি একা একা।
নাকি গুণে? অভ্যেসের?
মাঝে মাঝে ভাবি,
না হলে ছিঁড়ে খেতো একশ ধর্ষক,
না হলে ভুলে যেতে হতো স্বাধীনতা কার নাম।
না হলে যাপন করতে হতো সেই জীবন যে জীবন আসলে আমার জীবন নয়।
গোটা যৌবন একাই কাটিয়েছি,
এ আমার দোষ নয়।
এ দোষ আমার নয়।
এ আমার স্বপ্ন ছিল না কোনোদিনই,
স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে আমাকে ধীরে ধীরে।
আজ না হয় বলিই সে কথা,
পুরুষই ছিল শুধু চারপাশে, মানুষ ছিল না।
মানুষ মানুষ করে এখনও পুরুষের ঘন বনে আমার অশরীরী শরীর দৌড়োয়।
এখনও অমাবস্যার রাতগুলোয়।
এত কিছু মেলে, মানুষ মেলে না।
একটি রহস্যময় কবিতা / অংশুমান কর
…………………………………………..
মাটি থেকে ছ’ইঞ্চি উঁচুতে পা
লোকটার বুকে স্টেথো বসিয়ে ডাক্তার আঁতকে উঠলেন
তারপর বললেন, আপনি বেঁচে রয়েছেন কী করে মশাই
আপনার তো হৃদয়ই নেই!
এতে অবশ্য লোকটা ঘাবড়াল না
ওই অবস্থাতেই শূন্যে গটগট গটগট করে হেঁটে গেল
অসুবিধে কিছু হচ্ছে বলে তো মনেই হল না।
একদিন দেখলাম জটলার মধ্যে মাইক্রোফোনের সামনে তর্জন-গর্জন
করছে লোকটা।
দেখে মনে হল কোনও এক রাজনৈতিক দলের নেতা
আমি খেয়াল করে দেখলাম মাটি থেকে ঠিক ছ’ইঞ্চি ওপরে
শূন্যে ভেসে রয়েছে লোকটার পা।
তারপর আর একদিন বলখেলার মাঠে লোকটার সঙ্গে দেখা
তিন-তিনটে ‘ম্যান’কে এমন ড্রিবল করল মনে হল
লোকটা মারাদোনা।
তবে মারাদোনার ছিল ভগবানের হাত
আর লোকটার অশরীরী পা, মাটিতে পড়ছে না।
তারপর একদিন দেখলাম ইংরেজিতে খুব ফুকো, লাকাঁ, দেরিদা
কপচাচ্ছে লোকটা
আর সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে জনা বিশেক ছেলেমেয়ে
সবার শেষে কাঁচুমাচু মুখে জীবনানন্দ দাশ
থার্ড সেমেস্টারে তাঁর পাশ মার্কস জোটেনি।
আমি তাকালাম লোকটার পায়ের দিকে
হ্যাঁ, এবারও মাটি থেকে ঠিক ছ’ইঞ্চি ওপরে ওর পা।
আমি ভয় পেলাম।
বললাম, আপনি কে? জিন? দত্যি? দানো?
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘পুনরাবৃত্তি’তে
আমাকে রাক্ষস সাজতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক
কিন্তু আমি জিন নই, দত্যি নই, দানো নই, রাক্ষসও নই
ইংরেজির অধ্যাপক।
কিশোর / শ্রীজাত
……………………….
ঘোড়ার ক্ষুরের দাগে রোমাঞ্চ। এমনই ভেবে তাকে
পাঠানো হয়েছে মাঠে। আর সে দেখেছে চক্রব্যূহ।
ও তার সমস্ত আদিপুরুষেরা উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে
বর্ষিত হয়েছে খাদে। এ বিষয়ে রণজিৎ গুহ
কোথাও কখনও কিছু বলেননি। সে-কিশোর যদিও
মুখের নরম প্রান্তে ভয় ও বিস্ময় নিয়ে দ্যাখে
সবুজ কুয়াশা যত, ভেদ ক’রে ক’রে বরণীয়
যোদ্ধারা মিলিয়ে আসে। তাদের পিছনে একে একে
অতীত যুগেরা সব, প্রেতের মতোই হেঁটে চলে।
যাদের স্বর্ণাভ কথা সে পড়েছে পুস্তকে, তারাই
মেঘের ছাইয়ের মতো এই শীতে মিলায় বল্কলে…
প্রিয় উপত্যকা তার, ফিরে দেয় বিষ ও রোশনাই।
এই তবে ইতিহাস। সোনার দ্যুতির মতো পাপ।
তুমি তার ভার নাও। সে নেবে তোমার অভিশাপ।
কফিন / বিভাস রায়চৌধুরী
…………………………………
আমার চোখ বুজে থাকার নাম চুমু
আমার এড়িয়ে যাওয়ার নাম গোলাপ
আমার ভালোমানুষির নাম মোমবাতি
#
কিন্তু আজ আকাশে তাকিয়ে দেখি
সার সার কফিন উড়ে যাচ্ছে…
#
কোথায় যাচ্ছে এইসব কফিন?
কাশ্মীর সীমান্ত ছেড়ে ,
কূটনীতি ছেড়ে,
আসন্ন নির্বাচন ছেড়ে,
টিভির টক-শো ছেড়ে,
কবির দেশপ্রেম ছেড়ে
কোথায় চলেছে এইসব কফিন?
#
পরিষ্কার শুনলাম আকাশের বন্দেমাতরম—-
“যাই
মা’র কাছে যাই একবার…
বউয়ের কাছে
আর বাচ্চার কাছে…
কতদিন দেখা হয়নি! ”
#
কী আছে এই কয়েকটা কথায়?
অনেক না-না-না-না জীবনে আছে বলেই সকাল-সকাল আমি
চুমু, গোলাপ আর মোমবাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম
হাত থেকে পড়ে গেল সব!
ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল এদেশের মানচিত্রের প্রতিটি কোনায়…
#
আকাশ আমাকে বলল,” ভারতবর্ষ!
তোমার চোখ বুজে থাকার নাম চুমু
তোমার এড়িয়ে যাওয়ার নাম গোলাপ
তোমার ভালোমানুষির নাম মোমবাতি..
গান / মুজিব ইরম
……………………….
এই গানে মেঘ জমে আছে
এই গানে জমে আছে কালিজুরি হাওরের ডাক।
কথা ছিলো
এই বার কালিজুরি হাওরে যাবো
সকল বিপদ তুচ্ছ করে
ঠেলে যাবো উজানের স্রোত…
এই দেহে বোশেখের ডাক
এই দেহে উল্টা স্রোত
বিষণ্ন ব্যাকুল
এই গানে কান্না জমে আছে
এই গানে জমে আছে কালিজুরি হাওরের ডাক।
সিঁড়ি / তৃষ্ণা বসাক
…………………………………
আমি একটা মানুষকে চিনি,
যার কাজ মন্দিরের সিঁড়ি ধোয়া,
পাহাড়ের ওপরে সে মন্দির,
যেখানে সবাই ছোট ছোট ঘণ্টা বেঁধে আসে,
হাওয়ায় ঘণ্টা নড়ে
আর এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে ছড়িয়ে যায় টুং টাং টুং….
গুণে দেখেছি
মোট ৭৭৭ টা সিঁড়ি ভেঙে সে মন্দিরে উঠতে হয়,
প্রতিদিন মানুষটা সেই ৭৭৭ টা সিঁড়ি ধোয়,
এটাই তার দিনের প্রথম কাজ,
তারপর তার হয়তো অনেক কাজ থাকে,
খেতিবাড়ি, চৌকিদারি, ড্রাইভারি,
কিংবা চুপচাপ নদীর ধারে একটা পাথরের ওপর বসে থাকা-
আমি শুধু তাকে সিঁড়ি ধুতে দেখেছি,
আমরা যখন হাঁপাতে হাঁপাতে
সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠছিলাম,
আর মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে
মোবাইলের টাওয়ার খোঁজার চেষ্টা করছিলাম,
আর না পেয়ে একটার পর একটা সেলফি তুলছিলাম,
তখন লোকটা কোনদিকে না তাকিয়ে সিঁড়ির পাথর ধুয়ে চলছিল,
আর তার মুখে ফুটে উঠছিল বিশুদ্ধ আনন্দ!
কত কাজ পড়ে,
তবু তার কোন তাড়া ছিল না,
তাকে দেখে মনে হচ্ছিল
পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো কাজটা সে করছে!
আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই
৭৭৭ কিংবা তার বেশি সিঁড়ি আছে,
আমরা সবাই তা বেয়ে
কোথাও না কোথাও ওঠার চেষ্টা করি,
কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই সিঁড়ির ধাপগুলো
এত ভালবেসে ধোয়ার কথা কেউ ভাবি না….
সময়ের ঘড়ি / আশিরব্রত চৌধুরী
………………………………………………..
জন্ম থেকে খুলে ফেলি
আহত সময়
বিস্তীর্ণ সকাল ধরে
যে বিষণ্ন প্রজাপতি
নিজের শরীরে
পলাশ ফুটিয়ে ছিলো
তার জন্মরেখা ভেসে গেছে।
অকুল সম্ভাবনা নিয়েও
তটরেখায় দাঁড়িয়ে আছে
প্রান্তিক নীরব।
খুঁজে যাচ্ছে
সমুদ্রগামী জাহাজের মাস্তুল।
পাঠক / তুষ্টি ভট্টাচার্য
………………………….
লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত
আমিই লিখেছিলাম
পাঠক যখনই বলে উঠল, ‘এ তো আমি! আশ্চর্য!’
নিজেকে গুটিয়ে নিল লেখক
যেভাবে বেডরোল নিজেকে গুটোয়
পরতে পরতে তার অভিসন্ধি থাকে
পাঠক জানে না।
ঘুমের ভেতর থেকে লেখক জেগে উঠে
আবার তাকেই খোঁজে
মোহনায় মিশে যাওয়ার আগে যেভাবে নদী
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়েছিল গিরিখাত।
কবিতা যদি একেই বল তুমি
যদি একেই বল দৃশ্য
আমি বলব-
তুমি এখনও আমায় চিনতে পারনি।
ছায়াবাজি / বৈশাখী রায় চৌধুরী
…………………………………..
সত্য মিথ্যের কোঠরে আমার ছায়ার সংসার
দুলে ওঠে অস্তিত্ব
একাকী ঘর পাতি
গুটি সাজায়
সত্যর মাটি নরম হয়ে এলে
মিথ্যের বীজ ধান পুঁতে দিই
গোলাপবাগান হয়ে ফোটে আমার দুঃখ
দুঃখের আরো যত্নের প্রয়োজন
যত্নের আরো দুঃখের…
হাতের করতলেই অমোঘ নিয়তি
ছড়িয়ে দিই
আমাকে ভুল বুঝো না প্রিয়
বারবার ঠিকয়ে যাওয়া ছায়ারও ধর্ম নয়।
ঘোর থেকে / নিবেদিতা শেলী
…………………………………..
শূন্যতাকে ছুঁয়েছি সহজেই
পাখির কাছে শিখে
একলা উড়ান
পাঠের পৃথক কোন ব্যবহার
জানা নেই আমার
তবু রোজ পাঠ করি উদয়
ফিরে দেখা অস্ত আঁকি
নিয়তির পিঠে
শুদ্ধ নিশুতির চিতা জ্বেলে
ভেদ করি ধর্মের চক্রবূ্হ্য
শব্দ চিনে চিত্রপট…
কবিতাগুলো চমৎকার!
প্রতিটি লেখা শেষ হবার পর আরও একটু খানি ফাঁকা জায়গা রাখা দরকার নয়তো আমার মতো বয়স্ক যারা তারা কবি আর কবিতার নাম মিশিয়ে গুবলেট করে ফেলবে। সম্পাদক ও সঞ্চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তসলিমা নাসরিন, তৃষ্ণা বসাক, মুজিব ইরম, অংশুমান কর, তুষ্টি ভট্টাচার্য… আমার পছন্দক্রম এগুলিই। দারুণ