আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
আজ ১৩ জুলাই কবি ঋষিণ দস্তিদারের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
জাহাজডুবি
পাথরে ভেঙে পড়ছিল সশব্দে, পর পর ঢেউ। চূড়ায় একা একা বাতির মুখে জড়িয়ে দিলাম রঙিন ফিল্টার। মঞ্চসজ্জা শেষে বর্ণালী থেকে ক্লথলাইনিং টেনেছি বারান্দায়, সারি সারি ক্লিপে যেন নাবিকের স্বপ্ন শুকায়। দূরে মৎস্যগন্ধা মেঘ, জলের আলোড়নে তুমিও অতীত দেখতে পেতে! যারা পাশাপাশি শুয়ে থাকে পাটাতনে, লাইটহাউস তাদের মুখে দেয় ঘনিষ্ঠ আলো। সন্ধ্যা প্রস্তুত, এখন অপেক্ষা।
দেরী হচ্ছিল তোমার। নিঃশর্ত আলিংগন থেকে পালিয়ে আসছিলে ছুটিতে, তাই বোধহয় আমাদের দেখা হয়নি। বাতির পেছনে নিজেকে আধপোড়া রেখে বালিতে ক্লান্ত নেমে আসি। ভাংগা জাহাজটা আরেকটু কাত হয়ে গেছে, পাখিরা বাসা সরিয়েছে মালামাল মুখে, ছানাগুলো উড়তে শিখে গেল জীবনমুখী। হারাবার আগে কি পৌঁছুবে ডাঙায়, ডুবে যাওয়া দেখে নিতে?
নতুন দূরবীন কিনেছো জানি। যখনই ছোঁয়াও চোখ নার্সারী ফুল হেসে ওঠে, পাহাড় হু হু দোলে; বৃষ্টি আসার যতো দেরী। রাজধানী সমুদ্র দেখে না, নিয়ত আছড়ে পড়ে অন্য কোলাহলে, অন্ধকারে দিশাহীন। ঝিনুকশয্যায় চশমা ছুঁড়ে দিয়ে ভেবেছি অতল, তার অবসরে বুঝে নেয়া যাক স্রোতের আসা যাওয়া।
এখনও মেঘ এগোয়নি শহরে গ্রামে। হাওয়ার টানে ঢেউ ও ফেনার তোড়ে এখানে সব বাষ্প জড়ো হয়ে আছে; গাংচিল, কাছেই শুশুক ও মাছ সুঠাম কাঁকড়া আর বিছে। একটু একটু করে নিমজ্জনে তুলে দেবে উপহার, অনেক গানের মত মায়া বাজবে লহমায়। জাহাজডুবি দেখতে দেখতে শেষে লাইটহাউস অন্ধ হবে। আমরা পাশাপাশি হেঁটে বালিয়াড়ি পার হব সহজ অভ্যাসে; ফটোএলবামে নিজেদের রাত্রি চেনাব।
শেষের আগে
কথা ফুরিয়ে যাবার আগে ফিরে এসো। কিংবা চেষ্টা করো ছড়িয়ে পড়া চিন্তার সুতো আংগুলে জড়িয়ে ক্রমশঃ ঘরবাড়ির দিকে পথের পাশে এসে দাঁড়াতে। যে বেরিয়ে গেছে, পেছনে তাকালে সে দেখতে পেতো বাগানবিলাসের আগুনরঙা ডাল একইরকম কাঁপছে তিরতির, কোনো জানালায় পর্দার ওড়াওড়ি। ছাতা বন্ধ করার পরেও জলের ফোঁটা এসে পড়ছে রাস্তায়, গাছের পাতায়। অথচ তুমুল শুষ্ক চুল নিয়ে অবাক তাকিয়ে আছো বিলবোর্ডে মনোহরি শ্যাম্পুর দিকে। ঘড়ি বন্ধ হবার আগে তুমিও বেঁচে ছিলে অন্যদের সময়ে, সলতের মৃদু সম্ভাবনায়। আর ছায়ার মতো ফিরে আসছিলে নিজের পিছু পিছু।
এবার পাতা সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় নামো। জেব্রা পার হয়ে যাবার পর অনুসরণে এগিয়ে চলো নতুন জলাশয়ের খোঁজে। নিখুঁত স্নানের চেয়ে তুমি বরাবরই মনোযোগী বিম্ব সন্নিহিত রঙে। দেখেছো, ভালোবাসা বাঘ ভেবে দূরে চলে যাচ্ছে সাঁতারের কাছে। জাগতিক ভোজবাজির মত তাই, মানুষের কাছে ফেরার দাবী আজও রয়ে যায়।
এরপর ঝড়ের সাথে শব্দ-বাক্য উড়ে গেলে, আচমকা, দীর্ঘ নীরবতার প্রস্তুতি শুরু করি আমরা। মাঝে মাঝে ছাঁট এসে ভিজিয়ে দেয় বিছানা মেঝে- জানালা বন্ধ না করে সবগুলো দরজাও খুলে দিই। দমবন্ধ গুমোট মিলিয়ে যেতে যেতে আলো নিভে আসে। মুহুর্তে আকাশ ফালাফালা করে গর্জে ওঠে নিষেধ। হারিয়ে যাবার আগে তখন বুকে জড়িয়ে কাঁদছিল ছাতার নগ্নতা, সমগ্র স্মৃতি।
যাত্রাপথে
এখন ট্রেনের কামরায় এত ঝাঁকুনি যে ফোনে লেখালেখি প্রায় দুঃসাধ্য, চঞ্চল টেক্সট কোন স্টেশনে নেমে পড়বে বলা যায় না। পত্রিকার কলামে চোখ রাখতে গিয়ে মন দুলকিচালে চলছিল ভিন্ন লাইনে। চারপাশে যা যা দেখেছি- ঘুমন্ত কারো মাথায় ঠুকে থামল ফ্যান, তাল সামলে নিতে সলাজ ছোঁয়াছুঁয়ি আর জল খেতে গেলে সুস্থিরমতি জামা প্রায়শই ভিজে যাচ্ছে। চায়ের কাপ ছলকে ঠোঁট পুড়িয়ে দিল, এরপর ওয়াশরুমে দাঁড়িয়েও খুব একটা জুত হচ্ছে না; করিডরে সব বিব্রত মুখের আদল।
শুধু বাইরে কালচে ঘন সবুজ পাল্লা দিয়ে ছুটছে। লাফাচ্ছে ফসলের ঢেউয়ে, ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার নদীর শরীর, বনের ধুসর পথ। আলোর চুড়ায় কিংবা হঠাৎ ছায়ার অবসরে জানালার পাশে পৌর চিবুকগুলোতে প্রবোধের মত ঘাম শুষে নিচ্ছে গরম হাওয়া। শেষ ঝাঁকিতে ভীড়ের প্ল্যাটফর্ম, আমরা হাসিমুখেই ছুটে বেরিয়ে যাব।
ঋষিণ দস্তিদার।
জন্ম ১৩ জুলাই ১৯৭৫। জন্মশহর চট্টগ্রাম।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বক্ষব্যাধি মেডিসিনে স্নাতকোত্তর; পেশায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বর্তমানে চট্টগ্রামে কর্মরত।