আজ ২৫ জুন কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ারের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
বালিকা আশ্রম ০৬
বুকের ঊনপঞ্চাশ পৃষ্ঠা খোলো:
এটা একটা বিষাদের নদী; অভিমানের পাহাড়ে তার বাড়ি
চোখের এক শ বত্রিশ পৃষ্ঠায় যাও:
এটা একটা সাইকেলের গল্প; বালকের পঙ্খিরাজ ঘোড়া
থুতনির বিরানব্বই পৃষ্ঠা ওল্টাও:
এটা একটা বর্ষার কবিতা; প্রথম চুম্বনের জলরঙে আঁকা
চুলের এক শ ঊনসত্তর পৃষ্ঠায় থামো:
এটা একটা রাত্রির গীতিকা; এখানেই চন্দ্রাবতী ফোটে
চলো তবে পরিশিষ্টে যাই:
এটা একটা কীটদষ্ট অধ্যায়; তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না
কবিতাবিষয়ক সেমিনার
ধর্ষকামমত্ত ছিল তারা
আহা প্রাজ্ঞজনা, কত বিত্তশালী সমালোচনায়।
ও বোন কবিতা, তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?
এ যদি উপমা খোঁজে, বাকিগণ রূপকসন্ধানী
এ যদি কৈবল্যবাদী, বাকিগণ ছন্দবিশারদ
এ যদি শৃঙ্গারপ্রিয়, বাকিগণ সঙ্গমবিলাসী
এ যদি করেছে চিৎ, বাকিগণ উপুড় করেছে
সাধু, সাধু, প্রাজ্ঞজনা…কামশাস্ত্রে পার্থক্যখচিত
ধর্ষকামমত্ত ছিল তারা
আহা প্রাজ্ঞজনা, কত বিত্তশালী সমালোচনায়।
ও বোন কবিতা, তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?
রাক্ষসনগরী
রাক্ষসের শিং—ঘাড়ে মাথা নেই—কাউকে চিনি না
এ আমারই মুদ্রাদোষ—কিছু দৃশ্য বেশি দেখে ফেলি
তার মানে এই নয়, তোমাকে চিনিনি
বাসের জানালা দিয়ে দেখা সেই নদীটাই তুমি
রাক্ষসনগরে কেন লেকের পোশাকে ঢেকে আছ?
এঁদো বাস্তবতা নিয়ে গল্প করে পাশের টেবিল
হাউমাউ ছড়া কাটে কলেজপড়ুয়া কিছু তরুণ রাক্ষস
আইফোন হাই তোলে—আমি দেখি পাখির কঙ্কাল
লোকটা পাগল
হতাশ কেন চাবির গোছা?
শেষ চাবিতেও দরজা খোলে
জোট বেঁধেছে প্রণামগুলো
একজোড়া পা খুঁজছে ওরা
জানলা আছে মুখখানা নেই
তার মানে মন নির্বাসিত
কার যেন চুল ঢোলকলমি?
সেই ঝোপটার পাশেই নদী
কোন্ নদীতে বান ডেকেছে?
তার ঠিকানা হিজল জানে
কেউ ডাকেনি, এমনি এলাম
শুনতে এলাম—’লোকটা পাগল’
নবীনতমকে
কেড়ে কেন নিতে চাও, কেন বল, ‘মাদুর সরাও’?
তুমি এসে গেছ বলে এ মাদুর উঠোনে পেতেছি
এই নাও কবিতার খাতা
কেটেছি সামান্য দাগ—মুছে দিও—রাবারও দিলাম
খুঁটিনাটি আরও যা যা সরঞ্জাম ছিল, সবই দিয়ে যাচ্ছি
অপছন্দ হলে ফেলে দিয়ো
কেড়ে কেন নিতে চাও, অগ্রন্থিত পৃথিবী তোমার
চালাও গুলি, আমরা ও বুকের তুষে চোখের আগুন জ্বালাতে জানি
তোমাদের হাতে দেশ
পায়ে কানুনের চাকা
যেভাবে গড়িয়ে নেবে
সেভাবেই বেঁচে থাকা
তার মানে এই নয়, আমাদের অন্য কোনও বেঁচে থাকা নেই
নতুন জমিনে ফের
পুরানো গাঁজার চাষ
তোমাদের সবই ভালো
বাকি সবই মুথা ঘাস
তার মানে এই নয়, তোমরা যা বলবে, সবই মেনে নিতে হবে
তোমরা ক্ষমতাধর
একে ধরো ওকে মারো
ব্যথা পেলে যদি কাঁদি
ছুটে আসে হুঙ্কারও
তার মানে এই নয়, আমাদের কান্না একদিন স্লোগান হবে না
আমাদের বুকে তুষ
চোখে আগুনের শিখা
তোমাদের হাতে ঐ
রাইফেলও মরীচিকা
চালাও গুলি, আমরাও বুকের তুষে চোখের আগুন জ্বালাতে জানি
ফের যদি কড়া নাড়ি
তোমাকে মানায় ভালো ভয় ও সংকোচহীন আইহনের ঘরে
তবে যে বারান্দা জুড়ে হেঁটেছিল পরকীয়া মেঘ ?
সিড়ি ভেঙে উঠেছিল বেণীবাঁধা হরপ্পার চাঁদ ?
যে-রাতে গুঁজেছ চুলে বেগুনী রিবনবাঁধা ভাঁট
সে-রাতে নরক ও ছিল প্রেমের তল্লাট।
তাতে কী, কানুও জানে, এই রাধা গৃহসন্ন্যাসিনী
একদা সে নদী ছিল, কানু বিনে মজে গেছে জল
এখন কেবলই পলি; কামেও শীতল।
তার মানে এই নয়, নৌকাখন্ড লেখা বারনীয়
ফের যদি কড়া নাড়ি, শীতলতা মুছে সাড়া দিও।
ক্ষমতা ও শীর্ষ
এক.
শীর্ষে ওঠা কঠিন
শীর্ষে টিকে থাকা কঠিনতর
দুই.
গাছের শীর্ষে থাকে মুকুল মুকুল কোমলস্বভাবী
পর্বতের চূড়ায় থাকে তুষার তুষার কোমলস্বভাবী
কঠিনস্বভাবী ক্ষমতা নিজের ভারেই শীর্ষচ্যূত হয়
নদীর পাশে একা
আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল পথ
পথের পাশে নদী
নদীর পাশে নৌকাবাঁধা ঘাট
ঘাটের পাশে শেষপারানির কড়ি
গাছঠাকুরের পূজো
দাঁড়িয়ে ছিল হাজার অমারাত
দেউটি হাতে একলা মাঠের চাঁদ
দূরে কোথাও বৃষ্টিভেজা ঘর
টিনের চালে বিঠোফেনের চিঠি
কোথাও একটা জানলা খুলে রাখা
কোথাও একটা কাঁকনপরা হাত
কোথাও একটা উড়ে একটা যাওয়ার সাধ
দাঁড়িয়ে ছিল কেমন-করা মন
মনের তলে মনের তলদেশ
তার অতলে হঠাৎ কারও মুখ
হঠাৎ কারও রাত্রিচেরা ডাক
হঠাৎ কোনও নারিকেলের পাতা
ঠান্ডা লাগা একজোড়া টনসিল
দাঁড়িয়ে ছিল ভুবনজোড়া মায়া
অষ্টরাণীর মৃত স্বামীর ছবি
শাদা ফ্রকের রিবন-বাঁধা চুল
কোলবদলের ধূসর ছেলেবেলা
অতীত-করা হাজার গতকাল
আষাঢ়-করা শ্রাবণ-করা মন
আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল পথ
পথের পাশে নদী
নদীর পাশে মানুষ কেন একা?
মানুষ কেন একা?