আজ ০৭ এপ্রিল কবি ও কথাসাহিত্যিক হাবীব ইমনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
মায়ার জীবন
মায়া ভেঙে যায়—এক একটি সকরুণ কবিতার ধ্বনি আমাকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলে। সকরুণ ধ্বনির ভেতরে হারিয়ে যাওয়া পথে হেঁটে চলতে চলতে অজান্তেই প্রবেশ করেছি জলপদ্মে। বহুরঙে গড়া গৃহহারা অভিমুখ—ভবিষ্যৎ কী নিখুঁত জানে! এতোদিনকার জীবন, যা বলেছি সব মুহূর্তেই ভুল। বলতে চেয়েছি—ভেঙে যাওয়া বাঁশি, বসন্তবৌরি পাখির চোখে। অপার্থিব অলোক আলোয় অনুশোচনার অনুবোধে যন্ত্রণা।
দিন আর রাত—হাত ধরাধরি এই জীবন, কখন যে একটার মধ্যে আর একটা ঢুকে পড়ে! আমার মায়ার শরীর, মায়া খুঁজি। জীবন—কিছুটা খেলাচ্ছল। বাকিটা বোঝাপড়া।
জানালার শিক ধরে আজও দ্বিখন্ডিত ছায়ামূর্তি হয়ে মা নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে, উচ্ছ¡ন্নে ছেলেটির জন্য। বাড়ি থেকে চলে যাওয়া ছেলের জন্য জানালার শিক ধরে একা স্থির প্রতীক্ষায় মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে আছে। যে সন্তানটি মরে গেছে, সে অতীত বিষণ্ণ দিনের শেষ অস্তরাগ; তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে, একমাত্র এই কথা তিনি জানেন। তাকে দেখুন, দুই চক্ষু ভরে প্রতীক্ষারত মাতৃমুক্তিটিকে দেখে নিন।
ভরা নদীরেখা আরও অস্পষ্ট হলুদ বিকেল—পথ এখনো বাকি। নোনাজলে ভিজে যায় আমার বেদনাখচিত অক্ষর। ধুয়ে যায়, আমি সেই শুকনো কালির ফাঁকে খুঁজি আধখানা গল্পের সুতোর বুনোন। জন্মের ধুলো ওড়ে আজ হলুদ। ঘরপোড়া জীবন বড় একা। না ঘর, না প্রেম, না পাখি।
মায়ার জীবন নিয়ত থাকে না, একসময় বিলীন হয়, মৃত্যুবাসনা তার দুচোখে কাজল।
মায়াবৃক্ষ
সেই পুরাতন রাতে আত্মারা তোমার দুয়ারে
বসে খুঁজেছিল তাদের স্মৃতি, আমাদের পরম্পরা স্মৃতি;
চাঁদ ছিলো না—সেই রাত ছিলো অমাবশ্যা-নিদ্রাহীন,
আচ্ছন্নদৃষ্টি নয় শুধু, ছেঁড়া-ফাটা প্রসববেদনার যন্ত্রণা
বৃক্ষগুলো নির্বাক দাঁড়িয়ে আর গির্জারঘড়ি গলে পড়েছিল অন্ধকারে
তারপর অচেনা আত্মাগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে মিলে গেলো—
বিস্মৃতির বাতাসে!
সেই কবেকার খুনসুটি গেছো ভুলে, তবু কী যে খিদে, চেয়ে থাকি অপলক
অভিমানের খিলান খুলে চলো, এসো আবার রঙ খেলি—
এই পোড়া পূণ্যভূমে আমার নিবাস, ভাঙা স্বপ্নের হোলি খেলা
তোমার গালে আবিরের আমার আঙুলে মায়া, তোমার আর্শিবাদের মায়া
এমনকী তোমার-আমার হাসিতে গলিয়ে পড়ে মায়াদের ফোঁটা।
আমার পাশে বসে সমস্ত হতাশা, রয়ে যাওয়া শিশিরের ফোঁটা
মুছে ফেলো, দূরে থাকা মানে দূরে হওয়া নয়;
আমার সামনে নাচে অথৈ জলে নর্তক
অনেক পায়ের শব্দ বিবর্ণ-বিপন্ন মুখ, গুড়ি গুড়ি তাথৈ তাথৈ
শ্যামল প্রান্তরে হাঁটছে মানুষ, বেদনাকে তাড়িয়ে আনন্দের দিকে
তুমি খেলবে সূর্যকে সাথে নিয়ে—
আজ এইদিনে মাথার ওপর হাতখানা রাখো
এ মায়াবৃক্ষ কখনো হারিয়ে যেনো না হয়।
পূর্বপুরুষের পদচিহ্ন মাস্টারপাড়া
তোমার জন্য কোথায় যেনো একটা টান
লেগে আছে পূর্বপুরুষের পদচিহ্ন-খচিত হয়ে
কী আভিজাত্য ছড়ায়, তোমার ঘুম ভাঙে না এখন
আজানের ধ্বনি দূর-বহুদূর,
মন্দিরে বাজবে ঘণ্টা শঙ্খ, পূজা নিবেদন আরো কিছু পরে;
তাল আর নারকেল ঘেরা পুকুরপাড় এখন শুধুই নেড়া এক স্মৃতি
আকাশ ভেসে এলোমেলো কেশ ছুটেছে পশ্চিমের তেঁতুল তলায়
বাঁশবাগানের মাথার উপরে নয়—
চাঁদটাও বাঁকা করে ওঠে শিরিশের পেছনে
সেই চওড়া রাস্তাটি এখন আর নেই।
সবিস্ময়ে ভাবতে থাকি কী করে সেই গাছ, একই মাটি
সময়ে এমনি সরে যায়, দূরে যায়
স্মৃতির অবাধ নিঃসীম প্রান্তরে শূন্যে মিশে যায়।
আছি কিছুদিন মায়া বেড়ে ওঠা
পূর্বপুরুষের পদচিহ্ন লেগে থাকা মাস্টারপাড়ায়
আজ আর রোদ নেই তেতে, গুড়ি গুড়ি নামছে বৃষ্টি।
পুরানো পাতার মতো স্মৃতিগুলো ভরে আছে ফেরার চিঠিতে
হারিয়ে গেছে, আর আমাদের ফেলে গেলো স্তব্ধতায়।
উপকূল এক্সপ্রেস
বহু ধুলোবালি মেখে চারিদিক খেলে
একটা আবছা নদীর সামনে এসে দাঁড়ালাম
স্তব্ধ আকাশ এখানে নতজানু হয়ে স্মৃতির গান শোনায়।
একটি মরে যাওয়া চিঠির প্রাঙ্গণে আমি অক্ষরে আভা হই
ওপারে নিবিড় জঙ্গলের অনিশ্চিত অন্ধকার জানি
পথ এখনও বাকি—তীর ছুঁয়ে থাকবার ঘোর।
উপক‚ল এক্সপ্রেস, নির্বাক যে অতীত, অচেনা বাঁকের টানে
পথে যেতে যেতে সেই টান, যে টানে
রঙের খড়ির বাঁকের মুখে বিস্তৃত হারিয়ে যাওয়া দেখি।
হাতছানি
আদিখ্যেতা! প্যান-প্যান-আর ভালো লাগে না
এতটুকু বয়স, কোথায় থামতে হয়—
এখনো শিখে উঠতে পারলাম না।
পলাতক মানুষের দুঃখ কী! বেদনাই বা কী!
চোখে দুশমন, মুখে দুশমন-সারাক্ষণই ঝপি;
‘দেয়ার ওয়াজ নো আইডিয়োলজি অফ দ্যা পেরিফেরি
বাট আই ফেল্ট ই্ট মাই প্লেস’—
তবে আর কী লাভ বলো জীবনের গল্পে?
চোখের আড়াল হ’লে হয়তো বুঝতে পারি
আমারও বা শক্তি কই-
পৃথিবীটা ঠিক কোথায়? আমি আসলে কোথায়?
হেঁটে যাচ্ছি দূরে অথবা বহুদূরে।
চলো প্রিয়-মহান মৃত্যু, মুক্তির কথা বলি!
চলো আমরা একযোগে মৃত্যুপান করি!!
ভেঙে দাও যাবতীয় শোক
ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ দ্যাখে, আঁতকে উঠেছি,
হাত-পা কাঁপছে ভীষণ ভয়ে। সমস্ত স্বরবাদ্য, সব সংকেত
নির্জন, পরিত্যক্ত …
অলস পায়ে এদিক-ওদিক দেখি ঘুরে ঘুরে
বাগানটা ছোটো হয়ে গেছে পুকুরটা দূরে
ঘোল পাকছে, দৃশ্য পালটাচ্ছে—
তন্দ্রাচ্ছন্ন সকাল আর হলো না, তার আগে মধ্যরাত!
নদীর অক‚ল প্রবহমানতা কী তার ভাঙন ঠেকাতে পারে!
সমস্ত শরীর মন উপচে ভরে গেলো সন্ধ্যার চারপাশ
লবঙ্গ পোড়া বিদায়ী বিষাদী সানাই।
বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে ভেঙে যাওয়ার কথাগুলো
ভালোবাসা জেগে উঠে ভেঙে দাও যাবতীয় শোক।

জন্ম ৭ এপ্রিল ১৯৮৩; মাইজদী, নোয়াখালী। এমবিএ। জার্নালিজমে ডিপ্লোমা। পেশা : সাংবাদিকতা। প্রকাশিত বই : কবিতা— অন্ধকার, নীল গান [স্বরাজ প্রকাশনী, ২০১১] কালো মেয়ের প্রতি ভালোবাসা [স্বরাজ প্রকাশনী, ২০১২] কবি হয়ে জন্মাতে চাইনি [অভিযান পাবলিশার্স, ২০১৬] গদ্য— লেখা-অলেখা [কলামসমগ্র; দেশ পাবলিকেশন্স, ২০১৫] একুশে ফেব্রুয়ারি : আঁধারে বাঁধা অগ্নিসেতু [সাকী পাবলিকেশন্স, ২০১৩] মুক্তিযুদ্ধের আগুনমুখো গল্প [সাকী পাবলিকশেন্স] অধ্যক্ষ আবদুল জলিল [স্মারক, যৌথ সম্পাদনা; স্বরাজ প্রকাশনী, ২০০৯]