শহরটাতে বেশি সংখ্যক মধ্যবিত্ত বসবাস করে। তারাই আগ্রহ সহকারে বহুতল-বাড়িটার সামনে ভিড় জমিয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকে পাড়ার এক বাসিন্দা পুলিশের সঙ্গে ছেলেটার কাকার কথোপকথন শুনছিলেন। সেই ব্যক্তিই সব শুনে বাকিদের জানালেন, ‘ছেলেটার দামি বাইক কেনার শখ ছিল।’ তা শুনে একেক জনের মুখ থেকে একেক রকম আশ্চর্য স্বর বেড়িয়ে এল।
পুলিশ ততক্ষণে ছেলেটার ডেডবডি বার করে এনে রেখেছে বহুতল-বাড়িটার গ্যারেজে। ছেলেটার কাকা পুলিশদের আঙুল তুলে গ্যারেজে রাখা ছেলেটার শখের বাইকগুলো দেখাচ্ছিল।
যে মেয়েটির মোবাইল চুরি করে পকেটমারটা পালিয়েছিল, সে এসে ডেডবডির কাছে মাথা হেঁট করে দাঁড়ালো। ছেলেটার কাকা পুলিশের বড়বাবুকে উদ্দেশ্য করে সেই মেয়েটিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘স্যার, এর নামে আমি অনিচ্ছাকৃত মার্ডার চার্জের কেস দিতে চাই।’ মেয়েটিও ঐ পাড়ারই বাসিন্দা। তাই প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন পুলিশের বড়বাবুকে ডেকে মেয়েটির পক্ষ নিয়ে হাতজোড় করে বলল, ‘স্যার, ও বেচারি নির্দোষ।’ মেয়েটা লজ্জায় ও ভয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। যদিও চারদিকের তুমুল গুঞ্জনে কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছিল।
ডেডবডিটা চেরাইখানায় নিয়ে যাবার জন্য কাঁচের গাড়িতে তোলার পর পুলিশ একহাতে একগাদা স্লিপিং পিলের ফাঁকা স্টিপ, অন্যহাতে ছেলেটার লেখার ডায়রি নিয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই গুঞ্জন থেমে গেল। শুধুমাত্র ছেলেটার কাকা হম্বিতম্বি করছিল, ‘খবরের কাগজে খবরটা ছাপা হবে’, এই বলে।
পুলিশটা ওর কাকাকে থামিয়ে জানালো, ছেলেটা ওর পার্সোনাল ডায়রিতে গতকাল রাতে থানা থেকে ফিরে লিখেছে, ‘দেশ বিদেশের সুন্দরীরা ফেসবুকে আমার জন্য ফিদা। অথচ আমার পাড়ার পাতি মিডিল-ক্লাস মেয়েটাকে আমি… পারলাম না। ধিক্ নিজেকে।’ মাঝের ও শেষের কিছুকথা প্রতিবেশীদের বিষন্নতা প্রকাশের জন্য আর শোনা গেল না।
মেয়েটি তখনো ডেডবডি যেখানে রাখা ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছিল। এই মেয়েটিকেই বেশ কিছুদিন ধরে ছেলেটি চিঠি-কার্ড-চকলেট দিয়ে প্রেম নিবেদন করছিল। সেদিন একটা মোবাইল উপহার দিয়ে ফোনে কথা বলার সুযোগ চাইছিল। মেয়েটি মোবাইলটি নিতে অস্বীকার করে ও ছেলেটি জোর করে হাতে গুঁজে দিলে মেয়েটি সেটি রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। সেই সুযোগে ছিনতাইকারিটা ভিড়ের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে মোবাইলটি তুলে নিয়ে পালিয়েছিল। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ বাইক চেপে ছিনতাইকারিটাকে ধাওয়া করে মোবাইলটা ফিরিয়ে এনেছিল। সেই সন্ধ্যেতেই মেয়েটির বাবা থানায় গিয়ে প্রেমিক ছেলেটিকে উত্যক্তকারী রোমিও বলে পুলিশে এফ.আই.আর. করেছিল। সেদিন রাতেই ছেলেটিকে পুলিশ বাড়ি থেকে ডেকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। যদিও ছেলেটির বাবার ডেজিগনেশন শোনার পর তৎক্ষণাৎ পুলিশ তার গায়ে হাতে হাত বুলিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। পুলিশ চলে গেলে মেয়েটি ধীরে ধীরে বলল, আমিই দুটি মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমি যদি মোবাইলটা না ছুঁড়ে ফেলতাম তাহলেতো…।
দ্বিতীয় মৃত্যুর খবরে ভিড়ের মধ্যে থেকে আবার বিষ্ময়ের স্বর ভেসে আসতে লাগল। তাদের থামাতে নেতা গোছের একজন চেঁচিয়ে জানাল, ‘যে ছিনতাইকারীটাকে আধমারা করে মেরে ছেলেটি মোবাইলটা ফেরত এনেছিল সে আজ সকালে হাসপাতালে মারা গেছে।’ কথাটা ভিড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর জড়ো হওয়া ভিড় ধীরে ধীরে দুভাগে ভাগ হয়ে দুই মৃত মানুষের জন্য শোক করতে লাগল। একপাশে জড়ো হয়েছিল অবস্থাপন্ন শিক্ষিত মানুষেরা, অন্যপাশে খেটে খাওয়া ঝুপড়িবাসীরা। রাস্তা দিয়ে তখনও অজস্র মধ্যবিত্ত শহরবাসী ভিড়কে তোয়াক্কা না করে সাইকেল রিক্সা টোটো বাইক চেপে নিজেদের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে।
মর্গ থেকে ছেলেটির মৃতদেহ ছাড়া হলে মৃতদেহটি ফুলে মালায় সাজিয়ে শ্মশানে নিয়ে গেলে চুল্লিতে দেবার লাইনে ছেলেটির মৃতদেহটি ছিনতাইকারীটির পিছনে হল। ছেলেটির কাকা শ্মশানে কোন আলাদা লাইন খুঁজতে যখন এদিক ওদিক করছে। তখন বস্তিবাসীরাই ছেলেটির মৃতদেহটিকে আগে চুল্লিতে ঢুকিয়ে দিতে বলল। ছেলেটির কাকা কারণ জানতে চাইলে, বস্তিবাসীরা জানালো, ছেলেটির মৃতদেহটিতে অনেক আগেই পচন শুরু হয়ে গেছে ও ওর মৃতদেহটিকে শ্মশানে আনা মাত্র বিভৎস গন্ধে চারিদিক ভরে গেছে। তাই ওকে আগে চান্স দেওয়া হল। ছেলেটির কাকা তখন নিজের বৃত্তের মানুষদের খোঁজে লাইন ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু শহরটাতে তখনো মধ্যবিত্তদের সংখ্যা বেশী থাকায় মৃতদেহগুলির শ্মশান-বন্ধুদের ভিড়ের মধ্যে থেকে বহুতলবাড়ির প্রতিবেশীদের খুঁজে পাওয়া তারপক্ষে সম্ভব হল না।
পরেরদিন, খবরের কাগজে জেলার খবরের পাতার এক নজরে খবরের কলমে নিজস্ব প্রতিনিধি দ্বারা লিখিত একটি প্রতিবেদনে লেখা ছাপা হল, ‘শহরের এক বিশিষ্ট শিল্পপতির একমাত্র পুত্র আত্মহননের পথ বেছে নিল। তার পরিবার জানিয়েছে, সে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বেশ কিছুদিন হল মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। শহরের আর একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনায় এক মোবাইল ছিনতাইকারি, যার নাম রাজা, গণপিটুনির স্বীকার হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে, মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ছিনতাইকারীটি শরৎ কলোনির বাসিন্দা ছিল।’ প্রতিবেদনটির হেডিং ছিল, ‘প্রেমিক ছেলেটি ও ছিনতাইকারী’।
![মৌসুমী ঘোষ](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2024/10/1708785462966216-0-150x150.jpg)
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। ‘সাইন্যাপস পত্রিকা’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনের যুগ্ম সম্পাদক। ‘জ্বলদর্চি’ নামক লিটিল ম্যাগাজিনের ‘ছোটোবেলা’ ওয়েব সংস্করণের বিভাগীয় সম্পাদক। ‘মৌসুমী যে অণুগল্পগুলি লিখেছিল’ নামে অণুগল্পের বই ও ‘সোনালি খড়ের বোঝা’ ও ‘জাঙ্গুলিক’ নামে ছোটগল্পের দুটি বই। ‘যেসব গল্পের কোনো মানে হয় না’ নামক যুগ্ম গল্পের বইএর লেখিকা। ‘বহুস্বর’ পত্রিকা আয়োজিত ‘অনন্ত কুমার সরকার স্মৃতি, ২০১৭’ ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম, ‘আমি বাংলায় কথা কই’ গ্রুপ আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের (২০২১) ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম। ‘গল্পসল্প’র আটচালা’ আয়োজিত ‘উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি ২০১৯ অণুগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম, চক্রবর্তী-চ্যাটার্জী ও ‘দেব সাহিত্য পরিষদ’ আয়োজিত ‘উত্তরাধিকার কাদের হাতে’ অণুগল্প প্রতিযোগিতা ২০২১ দ্বিতীয়, ‘পথের আলাপ’ আয়োজিত ছোটগল্প প্রতিযোগিতা ২০২০ অন্যতম সেরা দশে স্থান লাভ। ‘বইসই’ আয়োজিত অনলাইন অণুগল্প প্রতিযোগিতা, ২০২৩ সেরা দশে স্থান পায়। সানন্দা, কিশোরভারতী, আজকাল রবিবাসিরীয়, দৈনিক স্টেটসম্যান, সুখবর, তথ্যকেন্দ্র, আরম্ভ, দ্য ওয়াল পত্রিকায় নিয়মিত ছোটগল্প প্রকাশ।