কালো পাথরের জীবন
শরীরের সমস্ত নাড়িগুলো আগুনের তাপে নাভির ঠিক সাত থেকে আট ইঞ্চি নিচে পুরুষাঙ্গটাকে জড়িয়ে গুটলি বেঁধেছে। অনেকটা আভাবি ছেলেদের ছেঁড়া কাপড় দিয়ে তৈরি চামড়া ছাড়ানো ফুটবলের মতো। পুরুষাঙ্গটাকে যেন কিছুতেই পুড়তে দেবে না নাড়িগুলো।
অনেক চেষ্টা করে মংলুর দেহটা পুড়ে ফেললেও নাড়ি জড়ানো পুরুষাঙ্গখানি আর পোড়ানো গেল না। বাংলা খেয়ে খেয়ে অনেকেই শ্মশানের পাশে চিৎকার করছিল, পারবি না-রে, পারবি না! ওটা কি আর সহজে পোড়ানো যায়। ছেড়ে দে! অর্ধেক পোড়া অবস্থায় কালো মতন ঝলসে যাওয়া পুরুষাঙ্গের গুটলিখানি নদীর তলায় পুঁতে দিয়ে, শ্মশানের ওপর জল ঢেলে ঠান্ডা করে, এক জণ্ডিস রোগ আক্রান্ত মানুষের ন্যায় হলুদ পাতাওয়ালা তুলসী গাছ লাগিয়ে ফিরে এলো সকলে।
বিয়ের রাতে সঙ্গম করতে গিয়েই মৃত্যু হল মংলুর। মংলু দেখতে বিশ্রি, কালো মতো, গ্যাজা দাঁত, হেংলা পাতলা চেহারা। মাথার মাঝখানটায় বিঘা খানেক জায়গার টাক। এই কারণেই বহুদিন বিয়ে হয়নি। বিয়ের আগে কিছুদিন লোকের বেগার খেটেছে, তারপর দক্ষিণ ভারত, কেরালা, ব্যাঙ্গালুরু, গোয়া, সুন্দরী বিদেশিনিদের গলা জড়িয়ে ছবি! এসব পার করে হাটে-বাজারে কালো মানিকের দাঁতের মাজন বিক্রি করেছে। এটা মংলুর একটা জীবন। মংলুর আরেকটা জীবন আছে। এক মুসলমান ফকিরের পেছন পেছন ঘুরে কিছু তুক্-তাক্ ও কবিরাজি ঔষধ বানানো শিখেছে। পুরুষের স্বপ্নদোষ, ধ্বজভঙ্গ, শীঘ্রপতন, মিলনে অনীহা, মেয়েলি রোগ ইত্যাদির ঔষধ দিয়ে বেশ নাম করে ফেলেছে গ্রামে। আর এর জন্য খাওয়া-পরার অভাব তার কোনোদিন হয়নি। যখন ইচ্ছে যার-তার বাড়িতে পাত পেরে বসে পড়ে। এমনকি কোমরের গামছা ঝাড়া দিলে হাজার পাঁচশো বেড়িয়ে পড়তো। পাড়ার উঠতি ছেলে-ছোকরাদের কাছেও মংলুর বেশ আদর ছিল। ছেলেরা মংলুর কাছে জানতে চায়,
– জিনিসটা ক্যামনে বানাইছো কাকা!
– কি জিনিস?
– ওই যে ওইটা! তোমার দশ ইঞ্চি মালটা। পুরা আইফেল টাওয়ার।
– বানাইছি আর কই! জন্মের থেইক্যাই…!
মংলুর পুরুষ-অঙ্গের খ্যাতি প্রায় সকলেরই জানা। সাধারণের তুলনায় বেশ বড়ো ও সঙ্গমেও দীর্ঘস্থায়ী। মংলুর বয়সি পুরুষেরা মংলুর পুরুষাঙ্গকে রীতিমতো হিংসে করে। মংলু জানে নারী সঙ্গমের একাধিক কৌশল ও আনন্দদায়ক পদ্ধতিগুলো। আর এসব বিষয়ে সে রীতিমতো গুরুজন লোক। মংলু যে-বার যাত্রাদলের সীতার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েটিকে কাঁদিয়েছে সেদিন থেকে তার সঙ্গম-খ্যাতি বন্ধু মহলে ছড়িয়ে পড়ছে। মংলু তার বন্ধুদের বলে, টাকা পয়সা থাকলে সব হয় না। সঙ্গমে পটু হ। সংসারে সুখ হইব। শইল্যের খিদা পেটের খিদার থেইক্যাও ভয়ঙ্কর।
মংলুর কথা সকলে যে কান দিত তা নয়। যাদের সমস্যা ছিল তারা বেশ গুরুত্ব দিয়েই মংলুর কথা শুনতো। আর উপায় জানতে চাইতো। মংলু তাদের খাঁটি মধু, অর্জুন গাছের ছাল শুকিয়ে ঔষধ বানিয়ে দিত। তাতে কাজও হতো। আর এভাবেই মংলুর খ্যাতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বন্ধু মহলে।
এই মংলু যখন বিয়ের রাতে সঙ্গমে প্রাণ হারায় তা কেউ মেনে নিতে পারে না। মংলুর বন্ধুরা যারা চালা ঘরের পেছনে অপেক্ষা করেছিল সঙ্গম আনন্দ উপভোগ করবে বলে, তারা জানায় পর পর চার বার সঙ্গমে পরাজিত হয়ে পঞ্চমবারের সঙ্গমে মংলু প্রাণ হারায় আর তার স্ত্রী অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে সে মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গমে মজে থাকে। মংলুর সারা শরীরে নখের চিহ্ন ও পুরুষাঙ্গেও একের পর এক দাঁতের কামড়ের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছিল। শ্মশান বন্ধুরা মংলুকে চিতায় উলঙ্গ করে তোলার সময় এসব লক্ষ্য করেছে। মংলুর মৃত্যুর পর বউটি ভয়ে সে রাতেই পালিয়েছে।
যে-ঘাটে মংলুর পুরুষাঙ্গেরর গুটলিখানি জলের তলায় পুঁতে রাখা হয়েছিল সে ঘাটখানিও বেশ জমজমাট। আশেপাশের মরা সব এখানেই পোড়ানো হয়। পাকাপোক্ত কোনও শ্মাশান ঘাট এখানে নেই। মরা পোড়ানোর পর ঘাটখানি নোংরা করে চলে যায় সবাই। অর্ধেক পোড়া কাঠেরগুড়ি, কলাগাছ সব পড়ে থাকে। এই ঘাটেই আবার ধোপা পাথরের ওপর কাপড় কাঁচে, যাদের বাড়িতে জলের কল নেই তারা খাবার জলও নিয়ে যায়। আবার বিকেল বেলায় এই ঘাটের পাশেই লোকেরা নদীর শীতল হাওয়া খেতে আসে।
প্রতিবার বন্যার জল ঘাটখানির সব ওলটপালট করে দেয়। নদীর আশপাশের কিছু বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার নদীর পাড়-টাও ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে যায়। সব ধুঁয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে জলের নিচে নতুন বালির স্তর পড়ে, বালির ওপর রোদের আলো পড়ে চকচক করে। সাদা বক লম্বা লম্বা পা ফেলে মাছ ধরে। মাছরাঙা ছোঁ মারে জলে, সারস মাছ ধরার জন্য চুপ করে জলের দিকে চেয়ে থাকে।
নদীর জল কমতেই সেনাবাহিনীর গাড়ি এসে হাজির। যখন এদের কোনও কাজ থাকে না তখন এদের ওপরওয়ালারা নদী থেকে বালি তুলে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলে। এরা প্রতিবারই এসে চকচকে বালি তুলে নিয়ে যায়। এবার বালি তুলতে এসে খোঁজ পেয়েছে এক বিশাল আকারে পাথরের। সচরাচর যার এখানে থাকার কথা নয়। দশ বারো ফুট লম্বা ও পাঁচ ছ’ফুট গোলাকার পাথরখানি সেনাবাহিনীর গাড়ির সঙ্গে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ডাঙায় তোলা হয়। কালো কুঁচকুঁচে মসৃণ পাথরখানি দেখতে লোকের ভিড় জমে যায়। ওপার থেকে লোক ছুঁটে আসে, এপার থেকেও যায়। মংলুর কয়েকজন বন্ধু এসে আবিষ্কার করে পাথরখানি যেন মংলুর পুরুষাঙ্গের মতোই, তাতে চকচকে দাঁতের কামড়ের চিহ্ন যেন এখনও রয়েছে।
বেশকিছু দিন পাথরখানি দেখতে লোকের ভিড় জমতো। তারপর ধীরে ধীরে লোকজন কমতে থাকে। শেষে পাথরখানি একা একাই জল আর ডাঙার মাঝে পড়ে থাকে। নদীর জলের স্রোত এসে পাথরের গায়ে ধাক্কা খায়। খপ্ খপ্ শব্দ হয়। মংলুর বন্ধুরা বলে সে শব্দ যেন মংলুর বিয়ের রাতে সঙ্গমের শব্দের মতোই। ধোপা এসে এক গাদা করে কাপড় কাঁচে পাথরের ওপর ফেলে। শহরের ছেলে-মেয়েরা পাথরের ওপর বসে নদীর জলে পা ডুবিয়ে গল্প করে আবার কখনও পাথরের আড়ালে নিয়ে গিয়ে ছেলেটা মেয়েটার মাই টিপে ধরে। কেউ কেউ আবার এসে পাথরটিকে সিঁদুর ফোঁটা দিয়ে দেয়। শহরের এক কবি এসে মাঝে মাঝে বসে পাথরখানির ওপর। দু’ছত্র কবিতাও লিখে ফেলে!
”কালো পাথরের ওপর বসে,
নীল দিগন্তে ভেসে ওঠা তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকি।”
একদিন এক ভাস্কর এসে পাথরের ওপর ছেনি হাতুরি চালাতে শুরু করল। দাঁতের চিহ্ন মুছে গেল। কালো পাথরের হাত বের হল, পা বের হল, মাথায় টুপি তারপর মুখ। দেখলে মনে হয় যেন এক সর্বহারার নেতা। মহান মে দিবসের দিন একদল লোক এসে মূর্তিটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে শহরের মাঝখানে এক শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। শ’পাঁচেক রিক্সাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা সে মূর্তি দেখতে জড় হয়েছে। শ্রমিক নেতাদের একের পর এক মাল্যদান, ফুলের তোড়ার নীচে মূর্তিটি চাপা পড়ে যেন মালাগুলি গলায় ফাঁস হয়ে ঝুঁলছে। একের পর এক নেতা মঞ্চে উঠে ঘন্টা দেড়েক ধরে ভাষণ দিয়ে গেলেন। মংলুর গ্রাম থেকেও কিছু লোকজন এসেছিল। তারা এসেই শনাক্ত করল মূর্তিখানি কোন শ্রমিক নেতার নয়, বরং মংলুর। টাই-কোর্ট পরিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা গ্রামে গিয়ে রটিয়ে বেরিয়েছে, মংলু তার পুরুষাঙ্গের খ্যাতির জন্যই শহরে মূর্তি হিসেবে স্থান পেয়েছে। মংলুর প্রতি তার গ্রামের লোকের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।
এপর যা ঘটল তা লোকচক্ষুর আড়ালে। রাতের বেলা শহরের সমস্ত মূর্তিগুলো জীবন্ত রূপ নিয়ে নতুন মূর্তিটির পাশে জমা হল। সভাপতি, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ এক এক করে সবাই এসে চেয়ার আলো করে বসল। একজনের দাঁড়িগুলো ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতো, অন্যজন পাগড়িওয়ালা, বিবেকানন্দের মুখটা যেন কেড়ে নিয়েছে! আর একজন চশমাপরা আম্বেদকর টাইপের। আর যারা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের চেহারাগুলো বিনয়-বাদল-দীনেশের চেহারার মতো।
শুরু হল সভার কার্য-কলাপ। একদল নারী মূর্তি এসে কালো মূর্তিটির গায়ে হলুদ মেখে দিল, তারপর জল ও কিছুটা দুধ। এবার মন্ত্রপাঠ :
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
কয়েকটি মূর্তি কালো মূর্তিটির চারপাশে তিন পাক ঘুরতেই কালো পাথর থেকে একটি জীবন্ত দেহ বেরিয়ে এলো। তারপর চোখ খুলতেই লম্বা দাঁড়িওয়ালা সভাপতি জিজ্ঞেস করল:
-নাম?
-জানি নাতো।
-ছ্যা-ছ্যা! বাপ মা?
-তাও জানি না!
-বেজম্মা নাকি রে। বাপ-মায়ের নামও জানো না ।
তারপর আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করে সভাপতি বলল, শোনো তোমার নাম রেখেছি মং। আর আমাদের সমাজের নিজস্ব কিছু নিয়ম-নীতি আছে। তোমাকে তা মেনে চলতে হবে। নিয়ম ভঙ্গ করলেই আমরা তোমার শক্তি কেড়ে নেব, ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবে।
-আচ্ছা! মং মাথা নাড়ল।
-নিজের শক্তির জোরে তুমি যেখানে খুশি যেতে পারবে। কিন্তু কোনও মানুষ যেন তা টের না পায়। মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ। আর রাতের বেলায় একমাত্র তোমার শক্তি কাজ করবে। পাগড়িওয়ালা সম্পাদক বলল।
-আচ্ছা! মং আবার মাথা নাড়ল।
-পয়সাকড়ির কোন সমস্যা হবে না। আমরা আছি। কিন্তু কোনও সঞ্চয় বা বাজে খরচা নয়। আর যখন বিপদে পড়বে তিনবার মন্ত্রটি উচ্চারণ করবে আমরা তৎক্ষণাৎ হাজির।
মং সব শুনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দীর্ঘসময় ঘুমিয়ে উঠলে মানুষের যেমন অবস্থা হয় মংয়ের অবস্থাও ঠিক তেমন হয়েছে। কতদিন পর দেহে প্রাণ পেয়েছে! মাথাটা কাজ করছিল না। কিছুতে কিছু বুঝতে পারছে না। সে শুধু কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা না-বুঝে হ্যা-না বলে গেল। সেদিনের মতো সভার কাজ শেষ করে সবাই যে যার মতো ফিরে গেল। যাবার আগে বৃদ্ধ সভাপতি দাড়ি হাতিয়ে হাতিয়ে বলে গেল: নিময় ভাঙলে কোন ক্ষমা নেই! মনে থাকে যেন!
মং বুঝতে পারছে তার জীবন্ত দেহটা পাথরের মধ্যে বন্দি। সে এখন ইচ্ছে করলেই উড়তেও পারবে। সন্ধ্যায় ‘পুক কাট, মাথা কাট’ বলে এ পাক ঘুরে এলো নদীর ধার থেকে। রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে শহরের অন্যান্য মূর্তিগুলিকে দেখল। বৃদ্ধ ও পাগড়িওয়ালাটাকেও খুঁজে পেয়েছে। তারা চুপ করে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মংয়ের মন চঞ্চল, সে মানুষের সাথে মেলামেশা করতে চায় কিন্তু মূর্তি সমিতির নিয়মের ভয়ে যেতেও পারে না।
এভাবে মং কিছুতেই থাকতে পারবে না। একদিন রাতের বেলা কালো কোট-প্যান্ট পড়া মং তার পাথরের খোলস খুলে ফেলে জীবন্ত শরীর নিয়ে আবার চলতে শুরু করল, উড়তে শুরু করল। সারা শহর সে হেঁটে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়। ফুটপাতে যারা ঘুমোয় তাদের সাথে গল্প করে। সারারাত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে আবার ভোর বেলা স্ব-স্থানে এসে হাজির হয়। দিনের বেলায় অনেক লোক এসে বসে মংয়ের পায়ে কাছে গোল করা বেদিতে। রাজনৈতিক দলগুলির একটা বড় আশ্রয় হয়েছে এই মংয়ের পাদদেশ। শাসক দল, বিরোধী দল সবাই এসে মংয়ের মূর্তিটির পাশেই মঞ্চ বেঁধে জনসভা, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। প্রেমিক প্রেমিকারা পাথরের মূর্তিখানির পাশে বসলে তারাও কিছু না কিছু চিহ্ন রেখে যায়। কেউ লেখে এস্ প্লাস পি, কেউ একটি গোলাপ এঁকে নিচে লিখে রাখে ‘আই লভ্ ইউ’, কেউ এঁকে রাখে নারীর যৌনাঙ্গ বা পুরুষাঙ্গের ছবি, আবার কেউ ‘ফক্ ইউ’। শহরের কাক-পক্ষীগুলো এসে মাঝে মাঝে মংয়ের মুখ ও কালো কোটের ওপর হেগে দিয়ে চলে যায়।
কিছুদিন আগে রাজনীতির ভোল বদলে যাওয়ায় শহরের ভোলও বদলে যায়। শহরটার নতুন পুরনো সব সরকারি বিল্ডিংগুলো চুনকাম করা হয়। তার সঙ্গে মূর্তিটিগুলোর রং বদলে ফেলা হয়। মং-ও কালো থেকে হয়ে যায় সাদা। শহরটা বাড়তে শুরু করে। পূর্ব-পশ্চিমে জায়গা না-থাকায় উত্তর দক্ষিণেই বাড়ে। শহরটার উত্তরে ছিল বস্তি, ঝুপড়িপট্টি, কিছু বিশাল বড় বড় গাছ, তার মধ্যে একটা বৃদ্ধ বট। একটু দূরেই নদীর ঘাট, প্রতি বছর ভাসানের মেলা বসে। বস্তিতে বেশির ভাগ ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, কুলি আর কিছু মেয়েছেলে শরীর বেচে খায়। সন্ধ্যা হলেই এরা বাংলা গিলে পকেটে পঞ্চাশ টাকা গুজে মেয়েছেলেদের দরজায় খট্ খট্ করে আবার কেউ মাগনাতেই মেরে দিয়ে চলে যায়।
শহর ঘুরতে ঘুরতে মং একদিন উড়ে এসে জুড়ে বসে এই বস্তিতে। বস্তি মানুষগুলির সঙ্গে বসে গল্প করে, বিড়ি ভাগ করে খায়, সময়ে বাংলা মালের কয়েক কাপ মেরে ‘ছোটলোক’গুলোর মতো রাস্তার পাশেই পড়ে থাকে। তারপর ভোর হতে হতেই হাপিস হয়ে যায়। ছোটলোকগুলোর কোনও কৌতূহল নেই এই আগন্তুককে নিয়ে। মং ভেনেজুয়েলার গল্প শোনায়, বলে ‘চিনের চেয়ার ম্যান আমাদের চেয়ার ম্যান’-এর গল্প তার সঙ্গে রসিয়ে রসিয়ে পতিতা পল্লীর খানকিদের গল্পও বলে। বস্তির এক হার্নিয়া আক্রান্ত পুরুষ জিজ্ঞেস করে: ভেনেজুয়েলা কে ছিলেন? আর ওই খানকি পাড়ায় চিনা মাগিদের ঠেক আছে শুনেছি, একজন চেয়ারম্যানও আছে। মং রেগে গিয়ে বলে, ওই জানবে! তাছাড়া আর কি বাল জানো?
-জানি, জানি! শুনবে? ছোটলোকগুলোর মধ্যে একজন বলে।
-শোনাও! মং শুনতে চায়! ততক্ষণে মালের নেশা চড়ে গিয়েছে। মুখের কথায় জড়তার এসে গেছে। একজন বলে আরেকজন জবাব দেয়
-জাতীয় ফুল?
-প..প…পদ্দ!
-জাতীয় পাখি?
-ম.ম…ময়ূর!
-জাতীয় পশু?
-য. য.. যতি..!
মালের নেশায় পুরো নামটা আর গলা দিয়ে বের হয় না। সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। আবার আরেকজন শুরু করে :
‘ঘাডের আটা মিলর খই,
কংগ্রেস বেডা গেল কই?
লাল সুতা নীল সুতা?
কংগ্রেসকে মারো জুতা!’
আবার হো হো হাসি। এভাবেই রাতের পর রাতে কেটে যায়।
এই বস্তিতেই মাস তিনেক আগে সরকারি নোটিশ জারি হয়েছে। শহর সম্প্রসারণ হবে, দুটো বিশাল আকারের শপিংমল হবে, আর বিদেশি গাড়ির কারখানা। যত দ্রুত সম্ভব জায়গা খালি করতে হবে। কিন্তু বস্তিবাসী যাবে কোথায়? এই প্রশ্নই তুলেছিল হরেণ, রিক্সা ইউনিয়নের সহ-সভাপতি। সঙ্গে ছিল রহমত, সুবান, মানিক ও রাধে। কিছুদিন মিছিল করল, সভা করল বস্তির মানুষদের নিয়ে।
-আমরা কিছুতেই জমি ছাড়বো না।
-না না! ছাড়বো না।
সভা থেকে চিৎকার কখনও উল্লাস ধ্বনি উঠল। সভার মধ্যে থেকেই কাওকে বলতে শোনা গেল-
-এসব করে বাল হবে!
কাগজেও লেখালেখি হল। তারপর একদিন হরেণ ভেনিস। বডিটা প্রায় আধপচা অবস্থায় পাওয়া গেল টাউন বাসস্টান্ডের ঠিক উল্টো দিকের সাপ ব্যাঙ কচুরিপানা ভর্তি পুকুরটায়। বডিটার নাকের ডগায় ফড়িং বসে ছিল। এই পুকুরটার পাশেই বেসরকারি নারসিংহোমে সস্তায় গর্ভপাত করানো হতো। আর মৃত ভ্রুণগুলোকে পুকুরের জলে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হতো।
সবাই বলে হরেণকে নাকি তার দলের লোকেরাই মেরেছে। দল ঘটা করে শহিদ দিবস পালন করল। ‘অমর রহে! অমর রহে!’ শ্লোগান উঠল। তারপর সবাই আবার চুপ। হরেণের বৌ-টা বস্তির কর্ণারেই একটা চায়ের দোকান দিয়ে বসেছে, লুকিয়ে বাংলা মালও বেচে। মংয়ের সঙ্গেও খুব ভাব হয়েছে। অনেক সময় মাগনাতে দু’এক কাপ খেতে দেয়। বৌটার বিশ্রি রূপের মধ্যেও যৌবন যেন এখনও গা থেকে ঢলে পড়ছে। মং ওই রূপের মোহেই দোকানে বসে থাকে। সকলে সন্দেহ করে বলে,
-কী ভায়া হয়েছে নাকি দু’একবার। মং এসবে কান না দিয়ে বলে,
-কী ভাবে বস্তিটা বাঁচবে সেটা ভাবলে? বৌ ছাওয়া নিয়ে কোথায় উঠবে শুনি?
হরেণ খুনের পর বস্তি নিয়ে কেউ কথা তোলে না। মংয়ের-ই বা কি দায় পড়েছে এসব নিয়ে ভাবার। সে শুধু আসে হরেণের বৌয়ে কাছেই। দোকান বন্ধ হলে হরেণের বাড়িতে বসে গল্প করে আবার চলে যায়। রাত বেশি হলে কোনদিন বারান্দার চৌকিতে শরীর লুটিয়ে দেয়। আর অগত্যা বৃষ্টি চলে এলে ঘরের ভেতরেই ঢুকে পড়ে।
একদিন বস্তিতে শুরু হল ভাঙাগড়ার খেলা। সরকারি অফিসারের দল বিশাল বিশাল যন্ত্রদানব নিয়ে এসে বস্তি উচ্ছেদ শুরু করে। বড় বড় গাছগুলো দু’তিনটেকে চোখের নিমেশেই কেটে ফেলল মেশিন করাতিরা। বস্তির লোকেদের চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়া আর কোন প্রতিবাদ নেই, বরং গাছের চিল-কাক-পক্ষীগুলোর যেন বস্তির প্রতি দরদ খুব বেশি। এই গাছগুলোর বাসায় ও কোটরে তাদের স্বজন আর আত্মজরা বড় হচ্ছিল। তারা দল বেঁধে ধারালো ঠোট নিয়ে সাঁই সাইঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো লৌহদানবের চালকেদের ওপর। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প যারা এতদিন শুনিয়েছিল তারা সেদিন সত্যিটা দেখতে পেল। তারওপর কোত্থেকে এক বাজপাখি এসে বড় বটগাছটার মগডালের মৌ-চাকে ছোঁ মেরে পালাল। এখন আর যাবে কোথায়? লোকগুলো মৌমাছির কামড় খেয়ে মুখগুলো হয়ে গেছে যেন অচেনা গম্বুজের মতো। সেদিনের মতো সব বন্ধ।
রাতের বেলার উৎপাত আরও ভয়ঙ্কর। বস্তি ভাঙার প্রতিবাদ করায় কয়েকজন পুলিশের লাঠির পেদানি খেয়ে কেসের ভয়ে পালিয়েছে। কেউ বস্তি থেকে স্বেচ্ছায় উঠে গেছে। যেতে পারেনি কাক-পক্ষীগুলি। রাতের বেলাতেও চেঁচামিচিতে বস্তিটা মাথায় তুলে রেখেছে। মৌ-মাছিও উড়ে গেছে। রাতে বাড়তেই মং এসে হাজির। রমজান, সুবান, মানিক এদের কাওকেই খুঁজে পেল না। হরেণের বৌকেও না। ঝুপড়িগুলো প্রায় ফাঁকা। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না-করে এদিক ওদিক তাঁকিয়ে দেখে যখন কাওকেই পেল না তখন হাতে তালি দিয়ে :
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
বার তিনেক উচ্চারণ করতেই ঝাঁকে ঝাঁকে শহরে সবগুলো মূর্তি এসে হাজির হল। তারপর একে একে সভাপতি, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ এসে হাজির। সভার কাজ শুরু হল। বাদী-বিবাদী সমস্ত পক্ষে যুক্তি বিশ্লেষণের পর ঠিক হল সরকার অন্যায় ভাবে বস্তিবাসীদের পূর্ণবাসন না দিয়ে জমি দখল করেছে। সুতরাং সরকারি নির্দেশ অমান্য করেই সমস্ত যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দেওয়া হোক। আর তার সঙ্গে মূর্তি সমাজের সংবিধান অমান্য করায় মং-কে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হল একাধিক অভিযোগ এনে। তার মধ্যে একটা অভিযোগ হরেণের বিধবা বৌয়ের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি। মং-কে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ থেকেও রেহাই দিল না মূর্তিগুলি। বৃদ্ধ সভাপতি আবার দাঁড়িতে হাতিয়ে হাতিয়ে মংয়ের মুখের কাছে এসে বললেন, বলেছিলাম না, নিয়ম ভাঙলে ক্ষমা নেই। আমরাও নিয়মের দাস। তারপর আগুন জ্বলে উঠল, সমস্ত লৌহ-দানবগুলিকে ডিজেল পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। তার সাথে মং-য়ের শক্তি কেড়ে নিয়ে তাকে তার জায়গায় পুনরায় পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিয়ে সকলে ফিরে গেল।
ক্রমে বস্তির ভাঙা বাড়িগুলোতেও আগুন লাগল, দমকল পুলিশ আধা-সামরিক বাহিনী সব ছুটে এলো। সে এক এলাহি ব্যাপার। পরদিন পোষা সংবাদিকেরা মনের মতো করে বানিয়ে বানিয়ে কাগজে ছাপলো ঘরপোড়া গরুর গল্প। শহরের ‘মানবাধিকার ও বু্দ্ধিজীবী’ প্রাণীরা মংয়ের মূর্তির তলে প্রতিবাদ জানিয়ে মামলা ও স্মারকলিপি জমা দিলেন। আদালত থেকে গরম গরম রায় বের হল, বস্তিবাসীর পুর্নবাসন না-দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে না সরকার। দমকল তদন্ত করতে এসে হরেণের ঘর থেকে একমাত্র মংয়ের একখানা কোট খুঁজে পেয়েছে। মংয়ের নামে দমকল কেস ফাইল করে সরকারি সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ এনে। নামজাদা চিত্রশিল্পীকে দিয়ে হরেণের বৌয়ের মুখে থেকে শুনে শুনে মংয়ের চেহারা ও মুখের স্ক্যাচ করানো হল। শহরের অলিতে-গলিতে, ট্রেনে, বাসস্ট্যান্ডে, স্টেশনে, পতিতাপল্লীতে ‘ওয়ানন্টেড’ লিখে মংয়ের ছবি সেঁটে দেওয়া হয়। একটা গিয়ে পড়ে সাদা মূর্তিটির গায়েও। একদিন এক বাচ্চা ছেলে আবিষ্কার করে মংয়ের চেহারা আর মূর্তির চেহারাটি অভিন্ন। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? টিভির আসরে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, মনোবিজ্ঞানি, রসায়নবিদ, নেতা! যত মত তত পথ! এখন সমস্যা হল মূর্তিটিকে কি এখানে রাখা নিরাপদ না বিপদজ্জনক? যারা মূর্তির পায়ে কাছে বসে ডাল-ভাজা ফেরি করত তাদেরকে বলতে শোনা গেল, পাথরের মূর্তিটি আর কার পোদ মেরে দিল ভায়া?এসব কী শুনছি! শেষমেষ মূর্তিটিকে গলায় আড়াই প্যাঁচ লোহার তার পেচিয়ে ক্র্যান দিয়ে তুলে নদীর কিনারায় ফেলে আসা হল। কিছু লোক প্রতিবাদ করল কিন্তু কে শোনে কার কথা। জোর যার মুল্লুক তার!
বস্তিতে পুনরায় সকলে ফিরে আসে। হরেণের বৌ নতুন করে দোকান খুলে আবার লুকিয়ে বাংলা বেচতে শুরু করল। মংয়ের মূর্তিটি নদীর কিনারায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, কেবল কিছু ফড়িং মূর্তিটির ভেসে থাকা নাকের ডগাটিতে বসার জন্য প্রতিযোগিতা করে। বাচ্চা ছেলেরা স্নানে এসে কিছুক্ষণ মূর্তিটির ওপর বসে বুকে কান ঠেকিয়ে শব্দ শুনতে চায় প্রাণ আছে কী না? একদিন এক ছেলে মূর্তিটির বুকে কান লাগিয়েই তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে:
‘পুক্ কাট্, মাথা কাট্!’
সেই বছর বন্যার পরে আর মূর্তিটিকে আর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখনও ছেলেগুলো স্নান করতে এলেই একে অপরকে চিৎকার করে বলতে থাকে:
‘পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
পুক্ কাট্, মাথা কাট্!
পুক্ কাট্, মাথা কাট!

জন্ম : ২৮-০৪-১৯৮৮,
পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমার খড়িকাবাড়ী গ্রামে।
প্রকাশিত গ্রন্থ: পরিবর্তন (নাটক ২০১২),কাকতাড়ুয়ার গল্প (গল্পগ্রন্থ ২০১৮)।