ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: বেহুলা’র স্নান-পর্ব । অমিত মাহাত
ঘাড় বেঁকিয়ে কান পাতলে বেহায়া বাতাসে শনশন আওয়াজ সিঁধেল চোর হয়ে সেঁধিয়ে পড়তে চায়। ছেঁড়া কাপড়ের কানফেট্টি ভেদ করে মাথার গভীরে ঘা মারে। মারতে থাকে। সন্ধ্যের আধো অন্ধকার। শুধু শনশনানি হলে একরকম। সাথে দোসর পুটলি বাঁধা শীতের বরফ হিম কনকনানি। নিজের শোয়ার জায়গা নাই ফের শংকরাকে ডেকে আদর মারানো। এ যেন তাই। ঠান্ডা বুকে এসে ধাক্কা দেয় বেহুলা’র। কাঁপন ধরায় শরীরে।
বেহুলা শবর নদীঘাটে এসে অপেক্ষা করছিল বেলা ডুবে যাওয়ার জন্য। ও চাইছিল বিকেল ফুরিয়ে যাক। অন্ধকার নেমে আসুক। অন্ধকার হয়ে আসলে ও ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বড়কোলা’র ঘাটে।
মকরের স্নান পিঠালাঠা বুচকি বেঁধে যারা এসেছিল গাড়ি ভাড়া করে বৈতা’র ঘাট। ওদের একটা দল নদীর বালিতে হাঁটতে হাঁটতে মেলার অভিমুখে সানন্দে আসছিল। সব কটা দামড়া ছেলে। ওরা বেহুলাকে দেখে থমকায়। ছেঁড়া কাপড় মাথায় টেনে ওঠালে হাঁটু জোড়া বেহায়ার মতো উদোম হতে চায়। বিকেলের আলো হেসে ওঠে। বেহুলাও খিলখিলিয়ে ওঠে।
মেলার দলটির সাগরেদ বলল ‘দেখেছিস মাগীর পুলকানি!
-পুলকানি না রে ভাই। চুলকানি। অন্যজন সাথ দিল তাকে। সংলাপ জন্মায়।
-চ না চুলকে দিই ভাই।
-পুলিতে পুর ঢেলে ডুমুপিঠা বানাই চল।
-দেখে তো মনে হচ্ছে পাগলি টাগলি হবে। কামড়ে দিলে কান্ড হবে মাইরি।
নদীর ওইপারে মেলা। পরকুল। বছরের শেষদিনে এসে কালো শ্যামল বরন মানুষগুলো সব স্নানের আয়োজন করে। মকর ডুব। মকর স্নান। পৌষের সংক্রান্তি উপলক্ষে স্নান। স্নান উপলক্ষে মেলা। কুস্তি লড়াই। লাঠি ফরি খেল। বালির চরায় পাথর আর ঢেলা মাটি সহযোগে উনুন। উনুনে কড়াই। কড়াইএ গরম তেল। টগবগিয়ে ফুটে। লাল হলুদ জিলিপি। প্যাঁচ। হাতের পাঁচ উড়িয়ে দেওয়া পালি ঝান্ডি। ঝান্ডা মুন্ডা। কাফান হরতন।চিড়িতন। রুপিতন। লাগলে রুপিয়া আসবে। তিন তাসের ভাগ্য পরীক্ষা। দান ধরুন। পঞ্চাশ। একশ। দুশ। পাঁচশ । হাজার। লাগলে ডবল। বাজিমাত। ডিমের ঘেরঘরি। পাঁচ টাকায় তিনটে ডিম। সেদ্ধ। চাকা ঘুরতে ঘুরতে দান ধরুন। বন্ধুবান্ধব মিলে খোসা ছাড়িয়ে সেদ্ধ ডিম খান। নেশা সামগ্রী। পান গুটখা। সিগারেট। দেদার ধোঁয়ার কুন্ডলি। পাক খেতে খেতে ধাবিত হয়। প্রথম হাতেখড়ি। প্রেম। শুকনো কাশ ঝুড়ে ঠোঁটে ঠোঁট। লোকচোখের আড়ালে চোরা আদর।
লদীধারে ডুমকা বিলাতি
তকে করল লো কে পুয়াতি?
টুসুগান ভেসে আসছিল বেহুলা’র কান অব্দি। ছি ছি কি লজ্জার! ভেতরে সুপ্ত বাসনা। বুধু শবর তাকে পোয়াতি না করেই ভেগে পড়েছে। এমনই এক মেলার দিনে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে চেয়েছিল সে। সেসব কবেকার কথা। কিশোরীবেলা। এখন পড়ন্তবেলায় সূর্য ডুবতে বসেছে।
ভেলাইডিহা’র সাহেব শবরের ব্যাটা বুধিয়া। বুধু শবর। প্রথম দেখার দিনটা আহা কী সুখ। রোমন্থনে এত সুখ! স্বমেহন স্বর্গের উচ্চতায় খাড়া কিশোরী স্তনে প্রথম বুধুর স্পর্শ। আর এগোলই না। নদীধারের ডুমকো প্যাট নিয়ে বিলাতির দশা ওর হল না।
অবশ্য বিয়েটা হল। মাঘ মাসেই। বুধু শবর উঠে পড়ল খড়ের চালে। বিয়ের পোশাক। ধুতি সাদা স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে রেখেই। যেটা বলতে হয়। এতদিন যা বলে এসেছে বাপ কাকারা। যা শিখিয়ে গেছে পূর্বপুরুষ। বুধা ঘরের চালে উঠে সেটাই আউড়ে গেল -মু পড্ডি মরি যাব্ব। এ জি রাখব্ব নি। পড্ডি মরি যাব্ব।
সে তখন বিয়ের কনে। নব পরিণীতা। স্বামী শ্বশুরের ভিটেই এসে উঠতে না উঠতে মরদেই এই কান্ড। মরদকে আশ্বাস দিল সে। মায়েদের শেখানো কথা আউড়ে।
-অলহি আসঅ অলহি আসঅ। তুমার ভার আমার। তুঁগা তাড়ি খাওয়াব্ব। বলেই খুন্তি জাতীয় লোহার অস্ত্রটি মরদের দিকে তাক করে।
তারপর বুধু শবর নেমে আসে। নামতেই বাপ সাহেব বুড়ো তার কুঠারটি ছেলের হাতে তুলে দেয়। বলে -তঅর কি চিন্তা রে! এতবড় বন থাকতে ভোখে মরবিস? শুকনা ডাল পালা যা পাবিস ওতেই হবেক। ভাদর মাসে ভোখ লাগলে তিতা বাঁওলা তুড়ে খাবিস। দুধি লতা ছিঁড়বিস। রোদের দিনে বনের কেঁদ পাকা। বৈঁচি। হত্তুকি। বহড়া। ধুনা। সব তোকে দিলি। গোটা লালগড় বনটার ইজারা আজলে তোর হাতে। আর চিন্তা কী। চাষের দিনে চাষির ঘরে খাটবিস মাগ ভাতার। মাটি চটাবিস। পাথর ফাটাবিস। শর মাইসরে নামাল দেশ টা তোর নামে লিখে দিলি।
খুশি তো? বুধু শবর হাতের চাঁদ পেয়ে যায়। নিজেকে রাজা মহারাজা ভাবে।এই ভাবনায় একটি বছর। পার।
এই না হলে জীবন। সমগ্র লালগড় বনভূমি আজ থেকে তাদের। বনের কেঁদ মহুল তাদের। শাল পাতা তাদের। শাল বীজ দুধিলতা সব। বাঁউলা চুরকা আলু, বুনো পুঁইশাক ঢলঢলে ফ্যানে সাঁতলানো ডাবাক ডুবুক বেসাতি। আহা অমৃত। জিভে জল খেলে যায় বুধুর। বউ কাঁচা হাতে এগিয়ে দেবে ধাদরা শুকা ঝাল ঝাল বাঁটনা সহ। বন কুঁদরি আর ঘি কাল্লা’র হালি হালি বাস। আর কী চাই।
আষাড়ে পুটকা পাতড়া ছাতু। টাটার হাটে বিকিব। চাল লিব নাই। তেল লিব নাই। বউএর কানের সোনা লিব। ধুউর। মেয়েলি টুসু গীত ভুলভাল গাইতে থাকে বুধু। সাথে নিজের পাছা চাপড়ায়। মুখে মাদলের বোল। সে দেখে বেহুলার কী হাসি। হাসির চোটে পরনের কাপড় নেতিয়ে পড়ে ভুঁইএ। হাসি তবু থামে না। থামতে চায় না।
বুধু গাঁ মাথার গরামের দিব্বি দিয়ে বসে। হাসি থামা নাহলে …গরামের কিরা তোর হবেক।
-না হলে কী?কী হবেক? বেহুলা বলে -তো হাসতে মানা ক্যানে? ভুলভাল গাহলে হাসব্যেক লাই!
-তো ঠিক টা গা।
-শুনবিস তো
-হঁ হঁ।
-মাঁই তুইএই ত গো দকান পাঠালি
আমি নাই যাব বল্যেছিলি… তুইএই ত গ…
বুধু নিজের পাছা চাপড়ে সংগত দেয় তালে তালে। মাদল কিংবা চাঙু বাজনা হলে জমে যেত। মাথা নাড়ায়। বছরের শেষ দিনে স্মরণীয় করে রাখতে চায় দুজনেই।
এদিকে যত দিন যায়, একটু একটু করে বনভূমি কমতে শুরু করেছে। আগের মতো বনও উদারতা দেখায় না আর। শুকনো ডালপালা ঝুড়িঝাঁটি হাতের কাছে মেলে ধরছে না প্রকৃতি কৃপনা হয়ে যাচ্ছে। বনেও এখন হরেক লোকজনের আনাগোনা। শীতের প্রাক মরশুম থেকে বুড়ো শালের রক্তক্ষরণ হয়। চামড়া চোকলা ফেটে ঘায়েল প্রায়। শাল গাছ ধুনো ছাড়ে। কাটারি দিয়ে চেঁচে দিতে কষ্ট দলা পাকায়। বুধু ভাবে নিজের চামড়া ছুললে ব্যথা লাগবে না? এটা পারে না। শাল গাছে কুঠার কোপ দিতে হয় অগত্যা। এ কাজেও মনের সায় থাকে না। ভেতরে ভেতরে চাপা কষ্ট দলা পাকায়। টনটন করে ওঠে বুকের কুঠুরি ওর। রাতে ছটফটানি বাড়ে।
বেহুলা বোঝে। মরদ বিবাগী হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে দিলে সমূহ বিপদ। মরদ বন যেতে চায় না। গাছে কুঠার চালাতে চাইছে না। গাছের নাকি এতে ব্যথা হয়। গাছের ব্যথা তারও ব্যথা। তবে খাবে কী? ছেলে পুলে হলে ডামাডোলের শেষ থাকবে না।
ফাগুনের রাতে চাঁদের দাপট বেশ। ঝলমলে দিনের মতো আলো। খোড়ো চালের ফাঁক ভেদ করে সে আলো নেমে আসে বিছানায়। বেহুলার খোলা পেটে খেলতে চাইছে এখন চাঁদ। যে খেলোয়াড় সে পিঠ ফিরে শুয়ে পড়েছে। ও মরদের কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। নিজের দিকে টানতে থাকে।
-হা ভাল দ্যাখ চাঁদের কান্ড দ্যাখ।
-ক্যানে ক্যানে?
-দ্যাখ অ না। প্যাটময় চাঁদের আলো।
-তো?
-চাঁদ চাইছে আমার গব্বে সেঁধাতে।
-ই কি কথা? খেপেছিস পাগলি!
-হঁ গো। চল না ই চাঁদ টাকে লিয়ে আসি। আমাকে তুমি মা বনাও।
বেহুলা ওর মরদের উপর উঠে আসে। সবেড়ে জাপটে ধরে। পুরুষ হাত দুটো টেনে নিজের স্তনের নরম মাংসে রাখে। বলে -লাও পোয়াতি বনাও ইবার।
বেহুলা মা হতে চায়। ওর গর্ভে সাহেব শবরের উত্তর পুরুষ আসুক বংশে। এর বেশি কিছু চায় না। মরদের সেদিকে কোনও ভাবনা নেই। সে রাতে বুধু শবর বেরিয়ে গেছিল। খালি হাতে।অন্য সময় হাতে কুঠার নিত। সাহেব শবরের দেওয়া কুঠার পড়ে থাকে। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই টের পেয়েছিল সে। পেছন পেছন কিছুটা এগিয়ে এসেছিল বেহুলা। গরাম থান অব্দি।তারপর ফিরে যায়। বিছানাময় তখনো চাঁদের লুটোপুটি।
মরদ ভেলাইডিহার সীমানা ছাড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায়।
রাত ভোর হয়। বেলা বাড়ে তরতরিয়ে। মরদ ফিরে আসে না। দিন যায়। রাত কাবার হয়। চাঁদ ডুবে যায়। অমানিশা অন্ধকার আসে। বুধু আসে না আর। মাস। আত্মীয়বাড়ি যায় নি। পুন্নাপানি বেহুলার বাপের গ্রাম যায় নি। বোনের বাড়ি। সাঁঘাত মৈতর কেউ কোনও খোঁজ দিতে পারে না।
এভাবে বছর পার। বুধু ফেরে না। দু বছর। তিন বছর ফুরোতে আর বাকি নেই। বেহুলা জোর খাটিয়ে ছিল মরদের উপর। ও মা হতে চেয়েছিল। চেয়েছিল ডুমু পিঠার পুর পুরে দিক ওর গর্ভে। মাঘ মাস তো বাড়ৈল সংসারের মাস। আম বৃক্ষে ফুল আসার মাস। সে রাতে মরদের কান কামড়ে বলেছিল -আমার বড় সাধ। আমাকে আম গাছ বনায়ে দে। ফুল এনে দে গর্ভে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। তারারা সব লন্ঠনবাতি জ্বেলে দিয়েছে একে একে। জোনাকিরা ঘুটেল গাছের পাতায় পাতায়। ওদের আলোর ব্যস্ততা একবার চোখ উঁচিয়ে দেখে নেয় বেহুলা। দিনের আলোয় যাদের অস্তিত্ব ঢাকা পড়ে। রাতে স্বমহিমায় উজ্বল।
মোক্ষম সময় এগিয়ে আসছে। ও এগিয়ে যায়। ছায়া হাঁটছে আগে আগে। ও পেছন পেছন আপন ছায়া অনুসরন করতে করতে এগোয়। এগোতে থাকে। পেছনে পায়ের ছাপ ওকে অনুসরন করে ফের। একই অঙ্গে তিনটি মানুষ। প্রথম টি ওর পুরুষ। দ্বিতীয়টি নারী। বেহুলা। পেছনের এগিয়ে আসা পায়ের ছাপটি ওদের সন্তান।
শীর্ণকায় কাঁসাই এর হাঁটূজলে চাঁদের মুখ। চাঁদ ওর গর্ভে আসতে চেয়েছিল। – চাঁদ মুখ সন্তান আয় বাছা আয়। বেহুলা দু হাত বাড়ায়। ধরতে চায়। জলে নামে। ওর হাতে জল লেগে ভেঙে যায় চাঁদের শরীর। নদীকে শোনায় – তুই আমার সন্তান ফিরায় দে। মরদ আসে পোয়াতি করুক।
নদীটি নিরুত্তর বয়ে যায়। বেহুলা হাঁটুজলে বসে বুক ডুবিয়ে রাখে। ধাবিত জলরাশি ওর বুকের আড়াল সরিয়ে আদর করে। বিলকুল ওর মরদের মতো লাগে সে আদর।

জন্মসাল -১৯৮৯
বসবাস -পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত জেলা ঝাড়গ্রাম।
লেখালেখি – লিটিল ম্যাগাজিন ও ডিজিটাল মাধ্যমে। মূলত গল্প লিখি৷
গল্প প্রকাশিত হয়েছে দ্য ওয়াল, কবিতা আশ্রম । জঙ্গলমহলের জনজীবন নিয়ে জার্নালধর্মী লেখা ‘শালপাতার ডায়েরি ‘ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে দেশ-মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমে।
প্রকাশিত গ্রন্থ নেই।