| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: ৫ সেম । ইন্দ্রনীল বক্সী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

“৩২৫২… চার ঘরে খেলবেই লিখে রাখ” হারুদা বিড়িতে শেষ জোরে টানটা দিয়ে সুতো পার করে দেয়। চোখ সরু করে ডেইলি লটারির ১১টার খেলার রেজাল্টের দিকে তাকিয়ে থাকে আর হাতে গুনতে গুনতে বিড়বিড় করতে থাকে।

ছেনো অল্পদিন টিকিট কাটা ধরেছে। ওর কোটা ৬০টাকার, পাঁচ সেমের দুটো সেট তিরিশ তিরিশ ব্যাস! এর মধ্যে একদিন দুঘর গ্যারান্টিতে হাজার দেড়েক মেরেছে। আনন্দে হারুদাকে নিয়ে একটা পাঁইট উড়িয়েছে ওর চাঁচ বেড়া বাঁশ আর মাটির সেলুনের ঝাঁপ নামিয়ে , কারন হারুদাই তো নাম্বার বাতলেছিলো!

কিসব হিসেব জানে হারুদা! শুধু ওকে নয়, ওদের মদন মাস্টার স্মৃতি পাঠাগারের মেম্বারদের যারা যারা টিকিট কাটে একবার হারুদাকে শুধিয়ে নেয়। অনেকদিনের এক্সপিরিয়েন্স টিকিটের ব্যাপারে হারুদার, দু একবার নাকি বড় প্রাইজে লাগিয়েওছিলো শোনা যায়! এমনি নির্বিরোধী, সাতকুলে কেউ না থাকা এক সুখী মানুষ। অনেকেই তাই জানতে চায় কোন নাম্বারে খেলবে, হারুদাও দরাজ মনে গম্ভীর মুখে কিসব গুনে টুনে আগের রেজাল্ট দেখে নাম্বার বলে দেয়।

মাঝে মধ্যেই কারও না কারও এক ঘর দুঘর মেলে, ৫০ ১০০ ২৫০… কান চেপে বেরিয়েও যায় অনেক সময়! এই তো সেদিন রফিকের একঘরে মার খেলো হাজার সাতেক! ওর ছিলো ৪৫৭৩ আর খেলেছে ৪৫৬৩! আফোশোস হবে না! তবে কোনো কোনো দিন কেউ হাজার দুহাজার পেলেই হারুদার জন্য দারু মাস্ট। ছেনো এমনিতে সাবধানী, নেশাকে বশে রাখতে জানে। সে মদ হোক আর লটারী, মেয়েছেলের নেশা ওর নেই । এদিকে রফিক আর বাবলুর সবেতেই বাড়াবাড়ি! গড়ে চার পাঁচশো প্রতিদিন এবেলা ও বেলা মিলিয়ে। খাতাই আছে নিমাইয়ের দোকানে!

নিমাইয়ের দোকানের ওরা সবাই খদ্দের। দোকান বলতে একটা ছোটো টেবিল আর একটা চার্জার লাইট, ব্যাস জমজমাট ব্যাবসা। মাঝে মধ্যে সিরিজে প্রাইজ লাগলেই নিমাই অমনি একগাদা গেঁদাফুলের মালাটালা দিয়ে টেবিলটাকে সাজিয়ে ফেলে। প্রাইজের নাম্বারটা বড় করে জেরক্স করে সাঁটিয়ে রাখে বোর্ডে। সেদিন অন্য দিনের তুলনায় ভিড় একটু বেশিই হয়, দোকানের নাম বাড়ে। তবে কিনা এমন দিন খুব কমই আসে।

“ছেনো একটা বাম্পার নে, বেশী নয়, মাত্র দুশো টাকা…অল্প টিকিটে খেলা।” নিমাই সন্ধ্যার টিকিট গুলো গুছিয়ে ক্লিপে আঁটতে আঁটতে বলে ওঠে। ছেনোরও যে ইচ্ছে করেনা তা নয়! শালা এক টিকিটে ওর সাত পুরুষের হিল্লে হয়ে যেতে পারে! মারলে ওই একখান মারতে হয়… কিন্তু বউয়ের কথা ভেবে গুটিয়ে যায়।

“ নাঃ শালা লোভ দেখাস না… দুশো টাকা কি মাগনা নাকি রে!” একটা পাঁচ সেম তুলে নাম্বার দেখতে থাকে। আজকাল আবার সুবিধে  হয়েছে, ছাপা টিকিটের বাইরেও খেলা যায়! ইচ্ছে মতো নাম্বার লিখিয়ে। নাম্বার পিছু দশটাকা। ছাপা টিকিটের নাম্বার অনুযায়ীই খেলা হয় তিনবার, সকালে, বিকেলে আর রাতে। ছেনো ভাবতে থাকে হারুদার বলা নাম্বারটা নিয়ে…৩২৫২…

ছেনোর বউ পিংকি মেয়ে খারাপ নয়, তবে রেগে গেলে খুব মুখ খারাপ করে এই যা। একদিন মদ মেরে ছেনো বালিশে বমি করাতে এমন খিস্তিয়েছিলো যে ওদের  কলোনীর আশেপাশের লোকের কান লাল হয়ে গেছিলো!

যাইহোক ভাবতে ভাবতে চার ঘর লিখিয়ে দেয় ছেনো। চারঘরে পুরো চল্লিশটাকা দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে সরে আসে নিমাইয়ের দোকান থেকে। সন্ধ্যার টাইম বাকি রাখতে মন চাইলো না ছেনোর, নিমাইয়েরও তো ব্যাবসা! বউনির টাইম। তাছাড়া আজ বাজার ওর ভালোই গেছে , কাল লক্ষীবার ছিলো , লোকে সেলুনে কমই আসে, তাই আজ সকাল থেকেই বেশ চাপ। এক ফাঁকে খেয়ে এসেই আবার লেগে গেছিলো কাজে।

কালভাটের উপর আসতেই আবার মিলের সেদ্ধ ভাতের মতো গন্ধটা পেল ছেনো। ওর বেশ লাগে গন্ধটা! পিংকিকে যখন সব খুলে তক্তোপোশে শুইয়ে দেয় ছেনো, যখন পিংকি বেশ ভালো মেজাজে থাকে শুধু মুখ ঘুরিয়ে দেওয়াল খোঁটে না, তখন ওর গা থেকে খানিকটা এরকমই গন্ধ বেরোয়। পকেটে মালকড়ি থাকলে ছেনোরও পিংকিকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। পকেটে এখন বেশ কটা টাকা রয়েছে, আজ আর মালের আড্ডায় যাবেই না, বরং কটা সিংঙাড়া নিয়ে যাবে বাড়িতে। রাতে রুটির সঙ্গে খাওয়ার জন্য রসগোল্লা, দুটোই পিংকির খুব প্রিয়। এমনিতে অন্য কিছু  ওর জন্য নিয়ে গেলে আবার যদি পছন্দ না হয়! মুখ করবে।

আমতলা বাজারে ঢুকতেই সেই সেদ্ধ ভাতের মতো গন্ধটা ফিকে হয়ে আসে। বাজারে কত রকমের গন্ধ! সবজি বাজারের চত্ত্বরটায় লাইন দিয়ে বাল্ব গুলো ঝুলছে ওপর থেকে, জল ছিটাচ্ছে, মুছে রাখছে বেগুন … বেগুন একটু চকচকে না হলে চলে! এখন বেশিরভাগ অফিস ফেরতা বাবুদের ভিড় থাকে, একটু চকচকে ফেরেস মাল না হলে তাদের চোখে ধরবে না। ছেনোও সন্ধ্যার টাইমে খুলে রাখে কিছুক্ষন,তবে কি ওদের ওদিকে তেমন অফিস বাবু নেই। আর ওর কাঁচা দোকানে খোদ্দের বলতে এই নিমাই, হারুদার মতোরা 

“বাব্বা … আজ আবার এত কিছু এক সাথে! বাজার ভালো বুঝি নাকি টিকিট লেগেছে?”

রাতের রুটির আটা মাখতে মাখতে আড় চোখে দেখে নিয়ে বলে ওঠে পিংকি।

“আনলাম … মনগেলো, তা আজ বাজার মন্দ নয়”

“তাই! বেশ … আমায় কটা টাকা দাও দরকার আছে”  আটা মাখা হাতটাই বাড়িয়ে ধরে পিংকি।

“আরে কি লাগবে বলো না!” গলা আর এক ধাপ নরম করে জিজ্ঞেস করে ছোনো।

“না … আমার টাকাই লাগবে। কেন! নিজে কিছু কিনতে পারিনা? দরকার পড়তে পারে না বুঝি!” একটু ঝাঁজ টের পাওয়া যায় পিংকির গলায় । কথা না বাড়িয়ে ছেনো শ দেড়েক টাকা পিংকির দিকে বাড়িয়ে দেয়।

“ব্যাস … দেড়শো ! বাকি কি টিকিটে উড়িয়েছো নাকি মালে?” আবার সেই ঝাঁজ!

“আরে …মাইরি বলছি শুধু একঘর খেলেছি …চল্লিশটাকা! আর মাল আজ খাইই নি ! এই দেখো …” বলে পিংকির কাছে সরে এসে হাঁ করে গন্ধ শোকায় ছেনো।

“আরে ধুর… হাটো… গন্ধ শোঁকাতে এসেছে! আমি যেন বুঝিনা… আজকাল কত রকমের মাল বেরিয়েছে , গন্ধ পাওয়াই যায় না !…”  একটু ঝাঁজ যেন কমের দিকে! তা হলেও পিংকি বলে চলে। টাকাটা কোমড়ে গুঁজে পাছার কাপড়ে হাতটা একবার মুছে নিয়ে আবার আটা মাখতে থাকে। ছেনো একটু দমে গিয়ে বিড় বিড় করতে থাকে আপন মনে।

“ধুর শালা… না আনলেও দোষ , আনলেও দোষ…” বাইরে এসে হাত পা ধুয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে বারান্দার মাদুরে হাত পা ছড়িয়ে বসে ছেনো মোবাইল টা ঘাঁটতে থাকে। কোলনীর গলিতে সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এবার রাতের দিকে ঢলেছে। কাদের বাড়িতে একটা বাচ্চা খুব জোরে জোরে কাঁদছে। ক্লাবের টিভির আওয়াজ এখান থেকে শুনতে পাচ্ছে ছেনো। চ্যাঙড়া গুলো এই করবে এখন বেশ রাত অবধি। বাচ্চাটা এবার হাফিয়ে গিয়ে ফোঁপাচ্ছে। মার খেয়েছে মন হয়। ছেনো পিংকির এখনও বাচ্চা কাচ্চা হলো না পাঁচ বছর বিয়ে হয়ে গেলো, পিংকিটা আগে এতটা খিট খিটে ছিলো না! যদিও ডাক্তার বলেছে, চিন্তা নেই হবে ঠিক,  বয়সই বা কত পিংকির!

মাদুরে শুয়ে হিজিবিজি ভাবতে থাকে ছেনো। গলি পেরিয়ে, বোসেদের বাড়ি পেরিয়ে ইট ভাটার উপরে ক্ষয়াটে চাঁদটা কেমন ঝিম মেরে ঝুলে আছে। আবার সেই মিলের ধান সেদ্ধর ভাত ভাত গন্ধটা ফিরে আসছে ছেনোর নাকে।

“চার ঘরে খেল ছেনো… চার ঘরে খেল…” হারুদা বলেই যাচ্ছে টানা এক সুরে! ৩২৫২ ৩২৫২… ৩২৫২… ছেনোর মাথায় গিজ গিজ করছে। ধরফর করে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে ছেনো। ঘামে ভিজে গেছে বালিশ , তক্তোপোশের চাদর। ভোর রাত,  পাশে পিংকি অঘোরে ঘুমোচ্ছে, নাইটিটা কোনো রকমে গলানো গায়। কাল রাতে পিংকির কি হয়েছিলো কে জানে! ছেনোকে ছিঁড়ে খাচ্ছিলো কাল! … এরকম দিন ছমাসে নমাসে আসে ছেনো জানে।

সকালে উঠেই পিংকি সব কাজ সেরে নেয়, ওদের চার ঘরের একটাই বাথরুম আর পায়খানা, ব্যাটাছেলেরা তাও কলতলায় উদোম হয়ে স্নান সারতে পারে! কিন্তু মেয়েছেলেদের উপায় কি! তাই একেবারে পায়খানা স্নান সেরে ফেলেলে নিশ্চিন্তি। তারপরে নিজের কাজে লেগে পরে পিংকি। দুজনের সংসার হলেও যেন কত কাজ জমে যায়! সে সব সেরে পিংকি শাড়ির ফলস বসানোর কাজ করে, এই কয়েক মাস হলো শুরু করেছে, সময়টা নষ্ট করে কি হবে! দুটো পয়সাও আসে। এ পয়সা ওর নিজের কাছেই থাকে। ছেনো নেশাখোর হলেও যা করার নিজের পয়সাতেই করে , এদিকে পিংকির কপাল ভালো। পাশের রত্না বৌদির মতো অবস্থা ওর নয়। পিংকিও অবশ্য কঠিন ঠাঁই, বেয়াড়া হলে টাইট দিতেও জানে। তাই চার চালার এই ভাড়া ঘরে এমনকি আশেপাশের অনেকেই ওকে বেশ সমঝে চলে।

পিংকির ঠেলা খেয়ে ছেনো তড়াক করে উঠে বসে বিছানায়। বেশ বেলা হয়ে গেল। চায়ের কাপটা ঠকাস করে নামিয়ে দিয়ে দুমদাম করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কে বলবে এই পিংকি রাতের সেই পিংকি! সকাল হতেই মূর্তি বদল। ছেনোর অবশ্য গা সওয়া হয়ে গেছে এসবে, ও জেনে গেছে এসব পিংকির ওপর ওপর।

স্নানটান সেরে রাতের থেকে যাওয়া দুটো রুটি গুড় দিয়ে মেরে ছেনো সাইকেল ছোটায় দোকানের দিকে। আজকের দিনটা বেশ ভালো লাগছে, ঝলমল করছে রোদ বাতাস কেটে পাট ক্ষেতের পাশ দিয়ে ঢালাই রাস্তা ছেড়ে পিচ রাস্তায় ওঠে ছেনো। রাস্তায় রোদ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কালো পিচের রাস্তাটা চকচক করেছে ঝড়ের সময়ে দেওয়া পঞ্চায়েতের ত্রিপলটার মতো! শুধু মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে লম্বা চৌকো চৌকো পট্টির মতো ধান শুকোতে দেওয়া আছে।

বাজারে ঢুকতেই এক নজর দেখে নেয় ছেনো পল্টুর চায়ের দোকানে হারুদা বসেছে কিনা। নাঃ নেই! সোজা দোকানে গিয়ে তালায় পেন্নাম করে ঝাপ খুলে দেয়। দুপুরে খেতে যাওয়ার আগে একবার নিমাই কাছে খবর নিতে হবে… ৩২৫২র কি খবর হলো!

“চা বল ছেনো সঙ্গে সিগরেট… আজ বিড়ি খাবো না” নিমাইয়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই বলে উঠল নিমাই। কমিশন কেটে সাড়ে চার হাজার টাকা লেগেছে ছেনোর! ছেনো থম মেরে যায়, শরীরটা বেশ হাল্কা লাগছে, প্রথম ওর এত বড় নাম্বার লেগেছে। নাঃ আজ হারুদাকে মাল খাওয়াতেই হবে! আজ শনিবার ওর বাজারও হাল্কা ছিলো, বাড়ি যাবে কড়করে সাড়ে চারহাজার টাকা নিয়ে ভেবেই মুড খোলতাই হয়ে গেল ছেনোর। হারুদার এই নম্বরের ছকটা আজ জানতেই হবে ছেনোকে! পিংকিও আজ হেবী খুশি হবে, কদিন ধরে মাথা খাচ্ছে একটা স্টিলের আলমারী কিনবে বলে। খালি কথা শোনাতো“ টিকিট কাটো একটা বড় দেখে প্রাইজ লাগাতে পারোনা!… ওই হাজার বারোশোয় আলমারী হয়!”

নাম্বার লেগেছে যখন কিছু টাকার টিকিট কিনতেই হয়! শ পাঁচেক টাকার টিকিট কেটে ফেলে ছেনো। প্রোগ্রাম বানিয়ে নিমাইকে বলে যায় সময় মতো যাতে দোকান বন্ধ করে চলে আসে ছেনোড় দোকানে, আজ পার্টি হবে।

সময় মতো ঝাঁপা নামিয়ে ছেনো, নিমাই, হারুদা, বাবলু আর রফিক বসে পড়ে বোতল খুলে। ক রাউন্ড হয়ে যাওয়ার পরেই ছেনোর মনে হতে থাকে দোকান ঘরটা যেন দৈর্ঘে প্রস্থে বড় হয়ে যাচ্ছে! গায় গায় বসে একে অপরের ঘামের গন্ধের মধ্যে, চাখনার গন্ধ, মদের গন্ধ, সিগারেটের গন্ধ মিশে গাঢ় হওয়া ভারী বাতাসটাই এখন বেশ ভালো লাগছে ছেনোর। মিলের ধান সেদ্ধর গন্ধের মতই আবেশে চোখ বুজে বুজে আসে।

“গুরু এবার বলেই ফেলো…ছকটা কি! কি করে নাম্বার বাতলাও তুমি?” হারুদার হাতটা চেপে ধরে ছেনো জিজ্ঞেস করে। হারুদা ধুনকিতে অল্প দুলছে, সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে গল গল করে ধোঁওয়া ছেড়ে কালচে ছোপ পড়া দাঁত বের করে হাসতে থাকে হারুদা।

“আরে ভাই কোনো ছক নেই … আমার যখন যে নম্বরটা মনে হয় বলে দিই … তবে সেটা কিছু না কিছুর তো বটেই!”

“তাহলে ৩২৫২ … এটা কিসের নাম্বার?”

“আমার বাপ ৩২ শে ফুটে গেছিলো আর আমার মা ৫২এ …ব্যাস এই কেস”

“মানে! … বাপ মা মরার দিন বলেছো তুমি?” হাতের গ্লাস আর ঠোঁট অবধি পৌঁছায় না ছেনোর।

“হ্যাঁ … আর দেখ আমার বাপ মা আমাকে কিছু না দিয়ে গেলেও তোকে প্রাইজ পাইয়ে দিলো…হা হা হা”

ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। রাত হয়েছে কিছুটা, দোকানের মধ্যে এখন আর সেরকম কথাবার্তা নেই। আসরের সবাই বেশ মৌজ হয়ে আছে, তরল নেশা শিরা ধমনী দিয়ে ছুটছে। একে একে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় সবাই বাইরে। এবার বাড়ি যেতে হবে। রফিকের একটু বেশীই নেশা হয়েছে। সামনে পিছনে দুলছে।

বাড়ি এসেই পিংকির হাতে কড়কড়ে টাকাগুলো তুলে দিতেই পিংকির ঝাঁজিয়ে কিছু বলবার জন্য খোলা মুখ খোলাই রয়ে গেলো। বার বার গুনতে লাগল পিংকি নোটগুলো, একসঙ্গে এতগুলো টাকা বহুদিন গোনেনি সে। ধুনকিতে দুলতে থাকা  ছেনো আলহাদে জাপটে ধরতেই পিংকি“ উঁ মালের গন্ধ…” বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেও অন্যদিনের মতো মুখ ঝামটা দিলো না।

ছেনোদের পারায় রাত নেমেছে সময় মতো। নিশুথি রাত ওদের পাড়ায় সেভাবে নামে না, কোনো না কোনো শব্দ ভেসে আসেই। কোনো বাড়িতে বাচ্চা কাঁদছে তো কেউ মদ খেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরে খেউড় করছে। পাশাপাশি ঘেঁসাঘেসি করে বেড়ে ওঠা বসতির এর ওর সংসারের রোজনামচা কারও কাছেই বিশেষ গোপন থাকে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অভ্যাসের এই সব শব্দ শুনতে শুনতে ছেনো ভাবতে থাকে কারও বাব মা মরার বছর কি করে ওর কপাল খোলে ! পিংকিকে ওসব বলেনি, টাকা পেয়ে থেকে পিংকির মুড খুব ভালো আজ।

শোওয়ার আগে রোজকার টুকটাক সাংসারিক কাজ সেরে পিংকি সারাদিনের বাঁধা খোঁপা খুলে চুল ঝেড়ে বিছানায় উঠে আসে ছেনোর গায়ের কাছে। মিলের ধান সেদ্ধর গন্ধটা খুব মৃদুভাবে খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে ছেনো টের পায়। জানালা দিয়ে একটা মৃয়মান আলো এসে ঘরটাকে আলো আঁধারি করে তুলেছে। কিসের আলো না জানলেও ছেনোর সেটাকে চঁদের আলো ভাবতে ভালো লাগছে। 

“হ্যাঁ গো টিকিটের নম্বর কিভাবে বুঝলে!”

“ও কি বোঝা যায়! কিছুটা আন্দাজে কিছুটা ছকে খেলতে হয় পছন্দের নাম্বার…”

“ও … জানো রত্না বৌদিও লটারির কারবার করছে কদিন হলো, বেশ দু পয়সা কামাচ্ছে …”

“তাই নাকি… এখন ঘরে ঘরে টিকিট সেল হবে! ভালো ধান্দা…”
“হ্যাঁ আমায় কদিন ধরেই বলছিলো টিকিট নেওয়ার কথা… বলল টিকিট না নিয়ে পছন্দের নাম্বারও লাগানো যায়, লিখিয়ে দিলেই হবে …” পিংকি বলতে থাকে ছেনোর বুকে বিলি কাটতে কাটতে।

“হুঁ …যায় তো …”

“আমার কাছে জমানো টাকা ছিলো আমিও লিখিয়ে দিয়েছি… তোমার জন্ম সাল ১৯৮২ তাই না?”

ছেনোর হাত পিংকির শরীরে খেলতে খেলতে চমকে থেমে যায়। এই প্রথম সেদ্ধ ধানের গন্ধে ছেনোর কেমন গাটা গুলিয়ে ওঠে। 

 

 

 

One thought on “ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: ৫ সেম । ইন্দ্রনীল বক্সী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত