| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: রামায়ণ এবং একটি দুপুর । জয়তী রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

“মে মাসের দুপুর রোদ্দুরে আকাশের ওই চিল আর আমার মতো এক বেকুফ ছাড়া তোর জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকবে না রাহুল।”
-“তা রেগে গেলে গরম কমবে না কাফে ডে তে বসবে একটু? বেকুফ না হলে ঠান্ডা কোথায়ও বসে ফোন করতে পারতে পৌঁছে যেতাম সেখানে!”
-“বাজে বকিসনি। এখানেই দাঁড়ানোর কথা ছিলো। গাড়ি আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলো। তুই তো বলেছিলি, তারপরে এক ঘন্টা পরে এলি! অদ্ভুত!”
-“তো? স্ট্যাম্প পেপারে সই তো করাই নি? ওই তো রাস্তার ওপারে কফি শপ। কতবার বসেছি। যেতে পারলে না? চলো এখন। হাত ধরো। রাস্তা পার হতে পারোনা এখনো?”
-“উফ। তোর এই বাবাগিরি দেখলে কে বলবে যে তুই বিয়াল্লিশ আর আমি বাহান্ন?”
-“মল্লিদি। ঠান্ডা হয়ে বসো একটু। প্রচুর কাজের কথা আছে। ব্ল্যাক কফি খাও। মুখটা লাল হয়ে গেছে গরমে।”
-“তুই থামবি? আমার মুখ আমি বুঝবো।”
-“তুমি বুঝলে তো ঝামেলাই থাকতো না । এমন কাছা খোলা মহিলা আমি জীবনে দেখিনি।”
-“রাহুল। তুই হলি কলির কেষ্ট। এই বিয়াল্লিশেও তুই কাঁপিয়ে চলেছিস হৃদয়। ইন্দ্রানী খুব ভয়ে ভয়ে থাকে মনে হয়।”
-“দেখো মল্লিদি, রয়েছি ফিল্ম লাইনে, বানাই শর্ট ফিল্ম। মহিলা ছাড়া কি করে চলবে আমার? এবার মহিলারা যদি ঝাঁপায় সেটা তাদের দায়িত্ব। তবে ইন্দ্রানী আমাকে চেনে। ওই সব হালকা মনের মেয়েরা আমাকে টানে না, ও জানে সেটা।”
-“আহা। কফি খেয়ে প্রাণে জল এলো রে রাহুল। কাজের কথা শুরু করি এবার? তবে সীতা আর রাবণের প্রেম – দেখিস বাবা, হামলা না হয় আমাদের উপরে।”
-” ওমন প্রেম তো নয় মল্লিদি। রগরগে, যৌনতা কিছু থাকবে না। একটা রহস্য। তুমি দৃশ্য কল্পনা করো, অন্ধকার সমুদ্র তীরে ওই শক্তিশালী পুরুষ , শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলা যায়, দীন কাঙাল প্রেমিক। বীণা বাজিয়ে চলছেন একলা বসে।
-“রাবণ বীণা বাজাতেন বুঝি?”
-“বাজাতেন। শুধু বীণা নয়, আরো অনেক যন্ত্র বাজাতে পারতেন। ছবিও আঁকতেন ভালো। এ আমার কথা নয়, একেবারে বাল্মীকি রামায়ণের কথা। not from কৃত্তিবাস, রাবণ দারুণ বীণা বাজাচ্ছিলেন এবং অশোক বনে সীতা বসে আছেন। ঘুম আসছেনা। ভাবছেন রামের কথা।”
-“আরে রাহুল। তোর কপালে চুল এসে পড়েছে। কতদিন কাটিস নি চুল? আচ্ছা! তুই বলতে চাস , সীতা আর রাবণের একটা সম্পর্ক ছিলো ? কিন্তু, প্রশ্ন হলো, রাবণের মন্দদোরীর মতো ওমন প্রিয় মহিষী,আর সীতার রামের প্রতি অগাধ টান- এমন দুজন তৃপ্ত মানুষ- অন্য কাউকে ভালোবাসবে কেন রে? রাহুল যুক্তি দে। যুক্তি না দিলে বিদেশে এসব কাজ ছুঁড়ে ফেলে দেবে!”
-“যুক্তি? হাসালে। আচ্ছা শোনো ভুলে যাবার আগে বলে নি , তোমার ছেলে কবে আসছে লন্ডন থেকে? তুমি তো সেই সময় ব্যস্ত হয়ে যাবে! কাজগুলো সেই হিসেবে গুছিয়ে রাখবো।”
-“চিন্তা নেই রে। ছেলের বাবা, তোর অতনুদা কে তো জানিস। আমাকে কোনো চাপে রাখেনা। সীতা রাবণের গল্প__ নামে তোর এই মুভির কাজ নিয়ে ও নিজেই ভীষণ উৎসাহ দিচ্ছে। টাকা পয়সা সব দিকে।
-“সত্যি অতনু দা র মতো মানুষ হয়না। মল্লিদি, তুমি খুব লাকি।”

-“সে তো তুইও। ইন্দ্রানী কতো খেয়াল রাখে তোর। “
-মাঝে মাঝে কষ্ট হয় বউটার জন্য। আমার মতো এমন বাউন্ডুলে পাগলকে নিয়ে ঘর করছে মুখ বুজে। নিজের ট্যালেন্টকে জলাঞ্জলি দিয়ে।”

-“বুঝি রে রাহুল। কিন্তু ইন্দ্রানী জানে ওর পাগল বরটা কেবল ওকেই ভালোবাসে।”

-“সেটাও কি নিশ্চিন্তে বলা যায় ? সীতাকে জোর করে তুলে আনতে গিয়েছিলো রাবণ। বোন সূর্পনখার নাক কান কাটার প্রতিশোধ নেওয়া ছিলো উদ্দেশ্য। কিন্তু সীতাকে দেখার পরে ওমন নিঃস্ব মনে হলো কেন নিজেকে তাঁর? রূপ was not important। রূপসী কম ছিলো না আশেপাশে। তবে ? What was the logic behind ? “
-হমম। তোর ভাবনা ছুঁতে চেষ্টা করছি। কৃত্তিবাসের রামায়ণে, রাবণের ভুল চরিত্র আঁকা হয়েছে। বাল্মিকীর রামায়ণে রাবণ প্রেমিক।”
-“প্রেমিক কেমন হয় জানো মল্লিদি? যে এক ভালোবাসার দ্বীপ বানায়, নিজের কল্পনায়। সেখানে সেই নারীকে সে চায় যে হবে তার আশ্রয়। তার সমস্ত আবেগকে ধারণ করবে সে। প্রতিদিনের তুচ্ছ ঘটনা গুলিও সেই নারী মহার্ঘ রত্নের মতো নিজের কাছে রাখবে সযতনে। রাবণ সব পেয়েও এক অতৃপ্ত প্রেমিকের মতো ছিলো। সীতা তার কাছে ওই ভালোবাসার দ্বীপের মতো নরম সুন্দর পবিত্র। তাঁর অশান্ত মনের আশ্রয়।
-“এ প্রেম তো হতাশা আর হাহাকারে ভরা থাকবে!”
-“না গো । ভালোবেসে মানুষ কাঙ্গাল হয় বটে, মনের মধ্যে এক অর্শিনগরের পড়শীর খোঁজে পাগল হয়, সে কথাও ঠিক। কিন্তু দুঃখী হয়না। ভালোবাসার খোঁজ তো ঈশ্বর খোঁজার মতো অন্তহীন।
-“কেমন সুন্দর করে বলিস রে রাহুল। মুগ্ধ হয়ে যাই।”
-“দাঁড়াও, ঝগড়া আছে তোমার সঙ্গে। গতকাল ফোন করোনি কেন? আমি চেষ্টা করছিলাম বার বার। তোমার ফোন বন্ধ ছিলো। খুব চিন্তা হচ্ছিলো। এসব কি ছেলে মানুষী বলো তো!”
-“আরে অদ্ভুত তো! ফোন খারাপ ছিলো। অতনু কি সব করে টরে ঠিক করলো।”
-“ফোন নতুন কেনো এবার। রোজ রোজ এক কথা। ফোন খারাপ। তোমার সঙ্গে একদিন কথা না বললে আমার মেজাজ খারাপ হয় মল্লিদি। তুমি জানো না?”
-“কাজের কথা তো হয় আমাদের। আবার কি কথা?”
-“আমি জানি না মল্লিদি। তবে তোমার গলা একবার শুনতেই হয় আমার। নাহলে কেমন শুন্য লাগে নিজেকে।”
-“এসব বলিস কেন রে? এমন করে বলিস কেন তুই?”
-“আজকের এই হলুদ শাড়ি, নানারঙ্গের ব্লাউস, ওই টিপ তোমাকে কি সুন্দর লাগছে। “
“সেই সঙ্গে ঝুলে পড়া গাল, বসে যাওয়া চোখ, উঠে যাওয়া চুল… এগুলো বললিনা? আমাকে রাগাস না রাহুল। তুই আমার থেকে দশ বছরের ছোটো।”
-“আমি রোজ রাতে তোমার কথা ভেবে কলম ধরি । কারো কোনো সুন্দর মুখ মনে পড়েনা আমার। তুমি সেই আশ্রয় যেখানে কোনো কোলাহল নেই, যেখানে বৃষ্টি আর পাতাঝরা বিকেল সব আপন আনন্দে খেলা করে।”
-“আমি এখন যাবো। এতো অকাজের কথা বলার সময় আমার নেই!”

-“মুকুটমণিপুর যাবে মল্লিদি? চলো না ?একদিন সব সম্পর্ক দূরে রেখে দুজনে নিবিড় হয়ে বসি একটু? “
-“রাহুল। মানুষ এমনিতেই বাঁধন ছিঁড়তে চায়। তাকে আর লোভ দেখাস না। মনের বায়না মেটাবো কেন এই বয়েসে? অতনু কি দোষ করলো?”
-“অতনুদা দোষ করেনি, বয়সও অনুভূতিকে মারতে পারেনি। এগুলো খুব বোকার মতো ভাবনা। শেষ তিন বছর যতো কথা আমরা বলেছি, যেভাবে একে অন্যকে বুঝেছি- তিনশ বছরেও আমি ইন্দ্রানীর সঙ্গে বলবো কিনা সন্দেহ।”
-“বিকেল হয়ে এলো …। এই গরমে চার কাপ কফি খাওয়া হয়ে গেলো। তোর কাজের কথা কিছুই হলোনা , শুধু শুধু বসে রইলাম।”
-“শুধু শুধু? কি করতে বাড়ি ফিরে? থোড় বড়ি খাড়া! ঘষা কাঁচের ওপারে রোদে পোড়া জীর্ণ শহরকে সুন্দর দেখায়।
জানো, সীতার চোখেও ওমন এক ঠুলি পরানো ছিলো । নিজেকে মহান, সংস্কারী সতী ভাবার ঠুলি। কি পেলো বলতে পারো? বার বার নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধতা প্রমাণ করা ছাড়া? তুমি কি জানো? বাল্মিকী রামায়ণে আছে রাবণের ওখান থেকে মুক্ত হবার পরে সমুদ্র তীর ধরে একলা হেঁটে এসেছিলেন তিনি। রাম পাল্কি দেননি। চেয়েছিলেন দীনের মতো হেঁটে আসুক সীতা সকলের চোখের সামনে দিয়ে।”
-“তারপরেও সীতা কে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলা এবং সমস্ত প্রজাদের সামনে।”
-“সীতা প্রেগন্যান্ট ছিলো যখন তাঁকে না জানিয়ে বাল্মিকীর আশ্রমে নির্বাসনে দেওয়া হলো। কারণ জানো? একবছর সীতা ছিলো রাবণের কাছে। তারপরে গর্ভবতী হওয়ার ফলে প্রজারা সন্দেহ করবে যে সীতা আর রাবণ– উফফ। এই কারণে শুধু এই কারণে গোপনে গর্ভবতী স্ত্রীকে নির্বাসনে দিলেন।”
-“মল্লিদি, তুমি একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো? এর চেয়ে রাবণের সঙ্গে তুমুল ভালোবাসায় ভেসে গেলে ক্ষতি কি ছিলো? সমাজ সমাজ করে মানুষ সবচেয়ে বেশি বলি দেয় নিজেকে।”
-“ঠান্ডা হয়ে বস একটু। জল খা। আরেকবার কফি বল। সঙ্গে স্যান্ডউইচ। তোর পছন্দের চিকেন স্যান্ডউইচ। বড্ড সাহসী ছবি বানাতে চলেছিস রাহুল। পয়সা উঠবে না। সেন্সর আটকাবে।”
-“ছাড়ো কাজের কথা। ও আমি দেখে নেবো। তোমাকে যে কথাটা গত দুমাস ধরে বলছি তার কি হলো? স্পষ্ট বলছি মল্লিদি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব খুব চাই তোমাকে। তোমার সঙ্গে সন্ধ্যে কাটাতে চাই, রাতে বসতে চাই কাছে, বৃষ্টিতে হাত ধরে ভিজতে চাই তোমার সঙ্গে।”
-“তার জন্য দুটো মানুষকে ঠকাতে হবে। নিরন্তর মিথ্যে বলতে হবে। রোজ অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে?”
-“আর নিজেকে ঠকালে কি হয়? নিজেকে ঠকানোর মধ্যে কোনো মহত্ব নেই এ কথা মানতেই হবে তোমাকে। তুমিও জানো আমার সঙ্গে কতো সুন্দর থাকো তুমি। “
-” আমি আছি তোর সঙ্গে রাহুল। থাকবো। দুজনের মাঝে কেবল এক না পাওয়ার লোনা জলের সমুদ্র থাকবে। সেটাই সত্য। সেই রামায়ণের যুগ থেকে ভালোবাসা কে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। আজও দিতে হবে। যুগ বদলেছে। কিন্তু আমরা বদলাই নি। পারবো না। চল। উঠি। অনেক কাজ সামনে। রাতে ফোন করিস রাহুল।”
-চলো মল্লিদি। যাবার আগে আরো একটু শোনো আমার ভাবনাটাকে। তুমি না শুনলে কোনো লেখা সম্পূর্ণ হয়না আমার।
– সীতা ফিরে এলেন লঙ্কা থেকে। কিন্তু হয়ে পড়লেন নিঃসঙ্গ। রাম খুব ব্যস্ত । আর্যা বর্তগড়ে তুলতে হবে। বর্ণ প্রথা চালু করতে হবে। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় এই দুই জাত কে প্রাধান্য দিতে হবে। এর মধ্যে সীতা আর তার নিঃসঙ্গতা? সময় কই ভাবার?
নিঃসঙ্গ সীতা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান। রাবণের হাতে অপহৃত সীতাকে পুরোনারীরা তেমন চোখে দেখেন না। এমন একলা দুপুরে তাঁর মনে পড়ে এক জোড়া চোখের কথা। গোপনে দেখতো তাঁকে সেই চোখ। মুগ্ধতা ,শ্রদ্ধা প্রেম মেশানো সেই দৃষ্টির মালিক কোনোদিন স্পর্শ করেনি তাকে। শুধু নীরবে আরতি করে গেছে দূর থেকে। সীতা আপন মনে রং তুলি নেন, আঁকতে থাকেন অভিমান আর আর্তি ভরা দুটি চোখ। রামচন্দ্র নিঃশব্দে পিছনে দাঁড়িয়ে দেখেন সেই আঁকা , নিঃশব্দে ফিরে গিয়ে সীতাকে নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। মল্লিদি, এই হলো রামায়ণ বা প্রেমায়ণ। “

-“প্রেম নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেছিস রাহুল। সুন্দর বিশ্লেষণ। তবে একটা কথা বলি? আমাকে প্রেমিকা ভাবিস না। বরং বন্ধু ভাবিস। প্রেম আমি জানি না। অতনু আমার স্বামী। খুব গম্ভীর কেজো সৎ স্বামী। বাহান্ন বছর বয়সে হয়ে গেলো, এখনো কোনো উদভ্রান্ত চোখ দেখিনি, যে কেবল আমাকে খোঁজে। একটাই জীবন রাহুল। কেটে তো গেলো। তবে আজ তোর সীতাকে আমার হিংসে হচ্ছে। রাবণের মতো ওমন প্রেমিক সব নারী চায়।”

-“মল্লিদি, গাড়ি আসবে রাস্তার ওপারে। তোমার হাত ধরে পার করে দি। তুমি তো একলা পারবে না।”

বিকেলের বিষণ্ন আলো ছড়িয়ে পড়লো তাদের চুলে, শরীরে সর্বত্র। নিদির্ষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে তাদের। কিন্তু কোনো গন্তব্যই কি পূর্বনিদির্ষ্ট হতে পারে কখনো? নাকি কোনো জায়গা মানুষের নিজের অধিকারে থাকে?

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত