উৎসব সংখ্যা উপন্যাস: মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ২০২০
পর্ব-১
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে
মহামারী নিঃশব্দে প্রবেশ করছিল এক একটি নগরে। অলক্ষ্যে। তারপর যখন তা টের পাওয়া গেল, নগরগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। পরিভাষায় তা লকডাউন। লকডাউনের আগে এবং লকডাউনের ভিতরেই মানুষজন নিজ দেশে, নিজ নগরে, নিজ গ্রামে ফেরা শুরু করেছিল। ইতালির ভেনিসের পথেও যাত্রা করেছিল একজন। ভেনিসে ফেরার পথে এক নতুন দেশে এসেছে ভূ-পর্যটক মার্কো পোলো। সূচনা হল এই ভুবন লিখনের।
# #
ইতালির ভেনিস নগরে লকডাউন চলছে। একটি ভিডিও এসেছিল মাসখানেক আগে। দুপুর ২-৩০
নাগাদ নগরে একটিও মানুষ নেই। নিস্তব্ধ নগরে শুধু কিছু পায়রার শান্ত চলাফেরা । গির্জার ঘন্টাধ্বনি। মার্কো পোলো ভেনিসের মানুষ। ভূ-পর্যটক। বহু দেশ বহু জনপদ পেরিয়ে সে ভেনিসের পথে চলেছে। জন্মভূমিতে। যে নগর যে জনপদ পেরিয়ে এসেছে সে, তার কথা শুনুন মেয়র মহোদয়। হায় বন্ধু, সেইসব নগরে এখন মানুষ নাই। কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরোন মাসাধিক কাল বন্ধ। ভূপর্যটক, খবরিয়া মার্কো পোলো সেই খবর নিয়ে এখন সেযান শহরের মেয়রের মুখোমুখি। সেযান শহরটি সেযান নদীর কূলে। নদীর থেকেই নগরের নাম। সেযান শব্দের অর্থ সুন্দর। এই শহরের রূপের তুলনা নেই।
মেয়র মহোদয়, আমি সেযান শহরে পৌঁছেছি কত নগর, জনপদ পেরিয়ে। সেযান নদীর ওপার থেকে দেখেছি অপরূপ এই নগর। উপাসনালয়, রঙ্গালয়ের শীর্ষ… কোন পথে এখানে এল মার্কো, তা সে নিজেই জানে না। মার্কো শুধু পৃথিবীর পথে হেঁটেছে। শুনুন মেয়র স্যার, কোন মার্কো পোলো তা আমি জানি না। ৭৫০ বছর আগের, না পরের ? আমি ছেলেবেলায় ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিলাম, টাইফয়েডে ভুগেছিলাম, আর বসন্ত তো ছিলই। জল বসন্তে ঘরের ভিতরে ঘর, মশারীর ভিতরে ছিলেন বিদ্যাধর। তখন পেনসিলে আমি খবরের কাগজ লিখতাম। সেই আমার প্রথম লেখা। লেখার চেষ্টা। একটা বিমান আঁকলাম, তার নিচে খবর লিখলাম, বিমান দুর্ঘটনায় এতজনের মৃত্যু। হ্যাঁ, সেই সময় প্যান আমেরিকান বিমান দমদমে অবতরণ করতে গিয়ে কৈখালির কলাবনে আছড়ে পড়েছিল। অনেক জীবনহানি হয়েছিল। আমি এত বয়সে এসে সেই খবরের কাগজ লিখছি…। করোনার দিনগুলির খবর। মেয়র মহোদয়, শুনুন,এই যে মৃত্যুভয়, এই ভয় এই প্রথম নয়। হিরোসিমা নাগাসাকি পার করেছে জাপান, চেরনোবিল পার করেছে পূর্ব ইওরোপ, প্লেগ, স্প্যানিস ফ্লু, ফ্রেঞ্চ ফ্লু…কত মহামারিতে মরেছে মানুষ। কালান্তক ভাইরাসের ভয়ে মশারির ভিতরে আত্মগোপন করে আমি আমার মতো করে খবর লিখছি। বিমান বাহিত হয়ে এই অদৃশ্য ঘাতক মহাদেশ থেকে মহাদেশে ঢুকে পড়ে মানুষ মারছে। ছেলেবেলায় মা শীতলার এমন অদৃশ্য পরিভ্রমণের কথা শুনেছি। ঠিক এই সময়ে। এই চৈত্রদিনে, যখন শিমুল পলাশ ফোটে, বাতাসে কাপাস, শিমুল তুলো ওড়ে, আমের মঞ্জরীতে দশদিক ম ম করে, গাজনের সন্ন্যাসীরা মহাদেবের চরণের সেবা লাগি…ডেকে ডেকে গ্রামের পথে হাঁটে, তখন ওলাওঠা বুড়ি, শেতলাবুড়িও খর রোদের ভিতর হাঁটে মানুষের খোঁজে। পথের কুকুর গন্ধ পেয়ে লেজ গুটিয়ে বাগানে, ঝোঁপেঝাড়ে ঢুকে পড়ে জিভ মেলিয়ে হ্যা হ্যা করতে থাকে। আমি এখন করব কী ? মশারির ভিতরে বসে খবর লিখছি। সারাজীবন ধরে কত খবর পেয়েছি, এখনো পেয়ে যাচ্ছি, রয়টার, পি,টি,আই, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস( এ, পি ), নিজস্ব সংবাদদাতা…যেমন খবর পাঠাত সেই পৃথিবীতে, তেমন খবরই আমি দেব, আমি বুড়ো খবরিয়া বলছি সেই অদৃশ্য ঘাতকের কথা। ডাকিনির ঝাঁটায় উড়ান দিয়ে সে পৌঁছে গেছে মহানগরে। মহানগর থেকে গাধার পিঠে চেপে মফঃস্বলে গেছে। তেহট্ট, চন্দননগর, শিলিগুড়ি, নিউইয়র্ক, ভেনিস, সিডনি, দিল্লির মহাসড়ক থেকে অলিগলিতে।
আবার মার্কোর কথায় ফিরে আসি। সেযান শহরের মেয়র এবং মার্কো মুখোমুখি। মার্কো বলছিলেন লকডাউনের কথা। কলকাতা পাটনা দিল্লি লাহোর কাবুল সমরখন্দ, নূর সুলতান শহর, আস্তানা, মস্কো…সব ঘুমিয়ে আছে। পথে মানুষ নেই। বন্য জন্তুরা কোথাও কোথাও পথে, লোকালয়ে এসে ঘুরছে। অদৃশ্য এক ভাইরাস অধিকার করে নিয়েছে পৃথিবী।
তুমি যে সব কথা বলছ, লকডাউন করে সকলকে ঘরে ফিরে যেতে আদেশ করেছে গভর্নর, মেয়র, তাহলে মানুষ বেঁচে থাকবে কী করে, মানুষ ঘরে থাকলে চাষ করবে কে, প্রাসাদ নির্মাণ করবে কে ?
কেউ না। মার্কো বলল।
উৎপাদন বন্ধ ? সেযান শহরের মেয়র জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, কল কারখানা, চাষবাস সব ঘুমিয়ে আছে।
বেচা কেনা, আমোদ আহ্লাদ ? মেয়রের জিজ্ঞাসা।
নেই।
রঙ্গালয়, অপেরা ?
বন্ধ।
মেয়র বললেন, কী ভয়ানক কথা নিয়ে এসেছ তুমি মার্কো পোলো।
মার্কো পোলো বললেন, সকলেই ঘরে ফিরে গেছে, কিংবা ঘরের পথে শত শত মাইল পথ হেঁটে চলেছে, ভয়ার্ত, ক্ষুধার্ত মানুষ। বলতে বলতে মার্কো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, দেখছিলেন নদীর ওপার থেকে শহরের এক রূপ, এপারে সেই রূপ বদল হয়ে গেছে যেন।
অপূর্ব এই নগরের পুরুষ এবং নারী। নারীদের রঙিন ঝালরের গাউন, মাথায় রঙিন বস্ত্র, নাকে নাকছাবি, গলায় রঙিন সব পুঁতির মালা, হাতে লাল সবুজ নীল বলয়- মার্কো নদী পার হয়ে আসতে আসতে দেখেছেন। কতদিন মানুষের কোলাহল শোনেননি। নিশ্চিন্ত মানুষের পায়ের শব্দ। গান। কাবাব,। রুটি। সুন্দরী কন্যারা সব রঙিন প্রজাপতি যেন। বাদ্য, বাদক, ডোমব্রা, গারমন, বাঁশি-র সম্মেলক বাদ্য–সব এই শহরে আছে।
সেযান শহরের মেয়র এই প্রথম মার্কোর দেখা পেলেন। ভূ-পর্যটক মার্কো পোলো ৭০০ বছর আগে এই মহাদেশে কোথাও এসেছিলেন তাতার সম্রাটের কাছে। ইনিও মার্কো পোলো। পিছনের৭০০ বছর হেঁটে এসেছেন, নাকি তাঁর পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকার নিয়ে এসেছেন? মেয়র দেখলেন মার্কোর গায়ের রঙ রোদে পুড়ে পুড়ে তামাটে, সোনালি চুলে ধূসরতা। মেয়র মার্কোর যে ছবি দেখেছেন, তার সঙ্গে এই প্রবীণের মিল আছে। মনে করলেই মিল। চিবুকের গড়নে, চোখের তারায়, মিল খুঁজে পান মেয়র। ঈষৎ ছুঁচোল চিবুক, নীল তারা, জলে ধোঁয়া মুখ। মুখে অনেকটা দাড়ি জমেছে নিয়মিত ক্ষৌর কর্ম না হওয়ার কারণে। মেয়র নিজে সাড়ে ছ’ফুট লম্বা। মস্ত চেহারা। তিনি মধ্যবয়সী। মেয়রের কত কিছু জানতে হয়। শহরে একজন বিদেশি এসেছে, সে নাকি সেই কত বছর আগে, কত শত বছর আগে দূর পাশ্চাত্য ভেনিস নগর থেকে এসেছিল এই নগরে। মেয়রের মনে হচ্ছিল, লোকটার গায়ে বহু দেশ, বহু জনপদের ধুলো, বহুদেশ বহু জনপদের বাতাস, বহু বর্ষের স্মৃতি আর স্বপ্ন। লোকটা বলছে, ঘুরতে ঘুরতে সে ভুলেই গিয়েছিল এই জনপদের কথা। সে ঘুরতে ভালোবাসে। ঘুরতে ঘুরতে একদিন আচমকা দেখতে পেল আঙিনায় মানুষ নাই, সড়কে মানুষ নাই। অশ্বগুলির মুখে লাগাম, পিঠে জিন নাই, লাগামে বোঝা যায় তারা বনের ঘোড়া নয়, তারা বন থেকে মানুষের কাছে এসে পোষ মেনেছিল। তারা প্রভু পেয়েছিল। কিন্তু এখন একেলা ঘুরছে হেথা হোথা। খাদ্যের সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। গৃহে অন্তরীন প্রভুরা তাদের ত্যাগ করেছে।
মেয়র শুনতে শুনতে অবাক হলেন, বললেন, এমন তো শুনি নাই, এই নগরে এমন ঘটে নাই, বেওয়ারিশ অশ্ব, সারমেয়, গোরু এই শহরে নাই, সকলেই গৃহে পালিত।
মহামান্য মেয়র, নগরাধিপতি, অন্যত্র ঘটেছে। আমি ভেনিস নগরের ফিরতে ফিরতে ঘুরুয়া বাতাসে ভুল পথে গিয়ে, আবার পথ পরিবর্তন করে, সেযান শহরে এসে পৌঁছলাম।
নগরাধিপতি মার্কো পোলোকে দেখছিলেন। মানুষটার চোখমুখে ভয়ের চিহ্ন। মার্কো বলল, মহারাজ আমি বহু জনপদ ঘুরে আসছি, মানুষ এখন মানুষের মুখের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে।
স্বাগত মার্কো পোলো, ভেনিসীয় পর্যটক, কী দেখেছেন বলে যান। মেয়র তাঁকে বললেন।
মার্কো বললেন,খবরিয়ার কথা শুনুনঃ
কে খবরিয়া? মেয়র জিজ্ঞেস করলেন।
আমি তো ভিনদেশি, সব দেশেই ভিনদেশি, হয়ত আমার নগর ভেনিসেও হব এখন, যখন সেই ১২৯৬ সালে আমার পিতা এবং পিতৃব্যকে নিয়ে ভেনিস নগরে ফিরেছিলাম ২৫ বছর বাদে, সকলেই ভিনদেশি বলে ত্যাগ করেছিল, আপনজনেরাও, তারপর কত কিছু হয়েছিল প্রমাণ করতে…, সে কাহিনি পরে শুনবেন মাননীয় মেয়র।
আমি জিজ্ঞেস করেছি খবরিয়া কে? মেয়র আবার একই প্রশ্ন করলেন।
যে মার্কোকে সব জানায় মাননীয় মহাশয়, কীভাবে জানায়, তা না হয়, না জানলেনই। মার্কো বললেন, খবরের সূত্র গোপন রাখাই বিধি।
মেয়র সন্তুষ্ট হলেন মার্কোর জবাবে। বললেন, খবরিয়ার কথা বলো।
খবরিয়ার পাঠানো বৃত্তান্তঃ
গত ১৪-ই মার্চ থেকে আমি মেলা-মেশা বন্ধ করেছিলাম করোনা ভাইরাসের ভয়ে। অতঃপর দুটি দিন, ১৫ এবং ১৬-ই মার্চ ঘরে বসে কাটল। কিন্তু কলকাতা আছে কলকাতাতেই। বাসে ট্রামে মানুষজনের ভীড়। টেলিভিশনে ভয়ের কিছু দেখলাম না তেমন। তবে এক অদৃশ্য ঘাতক এসে গেছে এই শহরে তার ইঙ্গিত আসছিল। ১৭-ই মার্চ দিনটি ছিল রৌদ্রালোকিত। সেদিন লেখক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু, অরিন্দম বসু সকাল নটায় খবর দিল। সুব্রতর মৃত্যু আমাকে আবার বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল। প্রখর হয়েছে রোদ্দুর। রোদে হাঁটতে হাঁটতে মেট্রো ষ্টেশন। মেট্রো ছিল অপেক্ষাকৃত ফাঁকা, তবুও গা ঘেষাঘেষি করে যেতে হলো। মুখে মাস্ক। অস্বস্তি হচ্ছে। কবি নজরুল ষ্টেশন থেকে অটোয় করে সোনারপুর চললাম। গড়িয়ার ব্রিজ পার হইনি তখনো, পথের ধারে কী এক মন্দিরে দেখছি বেজায় ভীড়, লম্বা লাইন গায়ে গা, কাঁধের উপর দিয়ে মুখ ঘেষে, রমণীরা দেবীর জন্য সিধে এনেছেন। নারিকেল, মিষ্টান্ন, ইত্যাদি। দেবী শীতলা কিংবা কালী হবেন। কাঁসর ঘন্টা বাজছে। এমন কেন ? ভয় নেই। অটো থেকে দেখছি কোথাও কোনো ব্যত্যয় নেই। দোকানপাট খোলা, বেচাকেনা চলছে। ব্যাগ হাতে লোকে হাঁটছে। গাড়ির অবিশ্রান্ত হর্ন শুনতে পাচ্ছি। সবুজ জামা নীল প্যান্ট তরুণ সিভিক পুলিশ লাঠি হাতে যান নিয়ন্ত্রণ করছে। তার মুখে কাপড়ের মাস্ক। লোকজন রাস্তা পার হচ্ছে, ভবঘুরে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঠিক করতে পারছে না কোন দিকে যাবে। আমি তো মৃত বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ব্যারাকপুরের সুব্রত সোনারপুরে লিভার ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গত রাত ১১টা ৫৫মিনিটে মারা গেছে। আমাকে ডাকছে, আয় বন্ধু, আমাকে দেখে যা। সোনারপুর যেতে যেতে দেখছি সমস্ত শ্যামলিমা উধাও। কংক্রিট আর কংক্রিট। এত বহুতল, ফ্ল্যাটের পর ফ্ল্যাট…কত মানুষ এইটুকু জায়গায়।
দুই
লিভার ফাউন্ডেশন হাসপাতালে যেতে সোনারপুরে অটো বদল করতে হয়। সোনারপুরে অটো হাঁকছে, বাস হাঁকছে, রিকশা প্যাঁক প্যাঁক করছে। থিক থিক করছে মানুষ। সবাই কাজের ভিতর আছে। সব রকম বয়সের সব রকম মানুষের সব রকম কাজ থাকে। খর রোদে হাঁটছি। রেললাইন পার হয়ে অটো স্ট্যান্ড কম দূর নয়। রাস্তা দিয়ে চলা যাচ্ছে না এত মানুষ পথে। কেউ যেন জানেই না কিছু, জানে না অদৃশ্য ঘাতক কার ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে। সোনারপুর বদলে গেছে। মনে পড়ে গেল, অনেক বছর আগে এক বর্ষার দুপুরে গাড়ি নিয়ে সোনারপুর হয়ে কলকাতার দিকে যাচ্ছিলাম। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, গাড়ি আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। নিঝুম রাস্তা দিয়ে হেলেদুলে নিশ্চিন্তে কতক কই মাছ হাঁটছে।নিশ্চিন্ত মৎস্য রাস্তা পার হচ্ছিল। সেই অবারিত মাঠ, হোগলাবনের সোনারপুর এখন নেই, সব মুছে গেছে। রেল লাইন পার হয়ে অনেকটা হেঁটে আবার অটো। ১১-৩০ হয়ে গেল পৌঁছতে। খুব কষ্ট হয়েছিল সুব্রতকে দেখে। রূপবান বন্ধুর মুখ কালো হয়ে গেছে। রাজ্যের ধুলো এসে পড়েছে যেন মুখখানির উপর। যেমন হয়েছে এই সোনারপুর। গরম হাওয়ায় বালি উড়ছে বাতাসে। কিন্তু এর ভিতরেই দেখেছিলাম একটি রঙিন প্রজাপতি। সুব্রত যে ছায়ায় শুয়ে আছে, তার একটু দূরে। কত রঙ তার ডানায়। বুনো ফুলের উপর বসে মধু পান করছিল। জগত যেমন ছিল তেমনিই আছে। চির ঘুমে ডুবে থাকা সুব্রতর উপর দিয়ে একবার ঘুরে গেল রঙিন ডানা থিরথির প্রজাপতি, কয়েক সেকেন্ড। মনে হল, চোখ মেলল যেন সে। তারপর প্রজাপতি নেই। সুব্রত আবার চোখ বুঁজল।
শুনতে শুনতে মেয়র বললেন, অস্বাভাবিক কিছু তো দেখলাম না এই বিবরণে, ঐ প্রজাপতি সেযান শহরে নেই, কেন নেই বলতে পারব না, অথচ ছিল কত, মৃত্যু হয়নি তো তার ? মেয়রের গলায় উদ্বেগ।
মার্কো বলল, না সে তো উড়ে গেল, আপনার নগরে প্রজাপতি বনের ভিতরে থাকবে, আছে নিশ্চয়, কিন্তু সেই দিন মৃত রূপবান সেই বন্ধুর কাছে ঘুরছিল যে প্রজাপতি, তার রূপটি বড় একটা দেখা যায় না।
সেযান শহরের প্রজাপতিরা আছে নিশ্চয়, কত বড় শহর, যদি উড়ে গিয়ে থাকে, ফিরেও আসবে আবার, সেযান স্বাভাবিক, কিন্তু পৃথিবী তো অস্বাভাবিক, অন্তত তোমার কথা মতো। মেয়রের গলায় স্বাভাবিক স্বর ফিরে এল।
পৃথিবীর বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেযান শহর অস্বাভাবিক, এখানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিকতাই অস্বাভাবিক। মার্কো বলল।
মেয়র বললেন, এই কথা সত্য, নিঝুম নগর গঞ্জ এখন কীট-পতঙ্গ থেকে সমস্ত প্রাণীর অবাধ বিচরণ স্থল, তাই হয়ত আমাদের সেযান শহরের প্রজাপতিরা নেই, ডানা কাঁপিয়ে দূরের নগর গঞ্জে চলে গেছে।
মার্কো চুপ করে ভাবছিল সেই প্রজাপতিটির কথা। কত রঙ তার থিরথিরে ডানায়।
মেয়র ফিরে এলেন পুরোন প্রসঙ্গে, বললেন, বন্ধুর মৃত্যুতে বন্ধু যাবে, জনপদ স্বাভাবিক থাকবে, প্রজাপতি উড়বে, মধু পান করবে ফুলে ফুলে ঘুরে, স্বাভাবিক, আর শুনলাম সেই জনপদে একবার বর্ষার দিনে কতক মৎস্য পার হয়ে যাচ্ছিল এক পথ থেকে আর এক পথে, সেই মৎস্য কত বড়?
মার্কো কথাটি শুনেছে অটো রিকশার ভিতরে বসেই বাকি তিন সহযাত্রীর কথোপকথনে। শুনেছে সেই মাছটির নাম কৈ।
মেয়র বললেন, আপনি জিজ্ঞেস করেননি, যে মাছ একদিন বৃষ্টি হয়ে গেলে ডাঙায় হেঁটে বেড়ায়, সেই মাছের কি দুটি পা আছে, নাকি সে তার পুচ্ছ ভর করে লম্ব ভাবে উঠে দাঁড়ায়, তারপর চতুর্দিক নিরীক্ষণ করে রওনা হয়। নাকি সে তার পাখনা দিয়েই হাঁটে, আমি এমন মৎস্যের কথা শুনেছিলাম, আফ্রিকায় নাকি এমন দেখা যেত, তারা মিউটেট করতে করতে থেমে গেছে, না হলে মানুষ হয়ে যেত একদিন।
সে আমিও শুনেছিলাম, গল্পে পড়েছিলাম, আসলে এখন এমন নেই, পুষ্করিণী ভরাট হয়ে হর্ম্য শ্রেণী মাথা তুলেছে, সেই মৎস্য হয়ত বিলুপ্ত হয়েছে, নতুবা তার স্বাভাবিক জন্ম রুদ্ধ হয়েছে, মানুষই তার জন্ম দেয়, ভক্ষণ করে।
সেই মৎস্য কোন দিকে চলেছিল, পুব থেকে পশ্চিমে?
মার্কো বলল, হয়ত পুবে, এখন পুব বন্ধ হয়ে গেছে মস্ত প্রাচীরে, কাঁটাতারে।
মেয়র জানালার শার্সির ভিতর দিয়ে দেখছিলেন বাইরে তুষারপাত শুরু হয়েছে। তুষারপাতের শেষ নেই, শীত গিয়ে বসন্ত আসার সময় হয়েছে, কিন্তু এবার শীত অতি দীর্ঘ, তিনি ভাবছিলেন এই ভূ-পর্যটক দাবা খেলতে জানেন কি না। মেয়র সাজাতে লাগলেন তাঁর সৈন্য সামন্ত। মার্কো সেই মাছটির কথা ভাবছিল। আসলে এমন হতে পারে ঐ মাছের কথা সত্য নয়। কত সত্য মিথ্যা যে ভেসে বেড়াচ্ছে এখন জনপদে জনপদে। জলের মাছ ডাঙায় হেঁটে বেড়ালে, সে মৎস্যকুমার কিংবা কুমারীও হতে পারে যাদের কেউ কখনো দ্যাখেনি। মার্কো নিজেও দ্যাখেনি, অতএব মিটে গেল সমস্যা। কিন্তু জল থেকে বেরিয়ে তারা কি অন্য জলাশয়ের দিকে যাচ্ছিল, নাকি চিরকালের মতো পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। আর জল, বায়ু, আলো, অন্ধকার দরকার হবে না তাদের বেঁচে থাকার জন্য। এসব ছাড়াই শক্তিমান হয়ে উঠবে অন্ধকারের জীব।
মার্কো চমকে উঠল। সেই যে ভাইরাস, কোভিড-১৯, সে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সে এই কথাই শুনেছে পথে পথে। কোভিড-১৯ কি এমনি?
খবরিয়া বলছে :
১৮ তারিখের পর থেকে ঘরে। অনেকেই ঘরে। স্যোসাল মিডিয়াতে বারবার বলা হচ্ছে জমায়েতে না যেতে। ঘরে থাকতে হবে। ইতালির ভেনিসের একটি ভিডিও এল ভোরে হোয়াটস আপে। নিঝুম দুপুর। একটি মানুষও নেই শহরে। এ কোন শহর? ক্যামেরা এক নিঝুম শহরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অলিগলি দিয়ে, সেই ক্যানেলের পাশ দিয়ে, নৌকো বাঁধা রয়েছে, কিন্তু কোনো মানুষ নেই। সব দোকানের শাটার নামানো। রাস্তায় কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছিল বিজয়ী ঘাতক করোনা ভাইরাস আমাকে প্রাণহীন শহর দেখিয়ে দিচ্ছে। দেখ দেখ দেখ, মানুষের কী হাল করেছি আমি। অলিগলি আমাদের কলকাতার মতো। আর সেই ক্যানেল! স্পিড বোট, গন্ডোলা ঘাটে বাঁধা, দুপারের অপূর্ব স্থাপত্যের অট্টালিকার ছায়া পড়েছে ঝিম মেরে থাকা জলে। বড় বড় অট্টালিকা নিয়ে প্রাচীন রেনেসাঁর দেশ ঘুমিয়ে আছে। ভেনিস ভূ- পর্যটক মার্কোপোলোর জন্মস্থান, মার্কোর কথা আরম্ভেই বলেছি, এখান থেকেই যাত্রা করেছিল ভূপর্যটনে। মার্কোর মনে পড়ে, সেই যে সেই যুবকের বাসনা জেগেছিল শহর দেখার। সে বনে বনে ঘুরে হয়েছিল ক্লান্ত। তারপর একদিন পৌঁছল ইসাডোরা নামের এক শহরে, যে শহরে নিখুঁত দূরবীন তৈরি হয়, বেহালা তৈরি হয়। দুই সুন্দরীর যে কোনো একটিকে পছন্দ করা নিয়ে মনের ভিতরে দ্বন্দ্বের জন্মালে তৃতীয় এমন একজনের সন্ধান পাওয়া যায়, যে কিনা অধিকতর সুন্দরী। সেই যুবক এমন এক নগরের কথাই মনে মনে ভেবেছিল, কিন্তু সমস্তজীবন হেঁটে যখন সে পৌঁছেছিল সেখানে তখন সে বৃদ্ধ। শহরের কেন্দ্রে কোথাও এক জায়গায় বসে সে দেখছিল অল্প বয়সীদের। না, দেখছিল নগর জনমানবহীন। বৃদ্ধ এবং নগরের সৌধ, পায়রা, ঈগল, চিল…। ভেনিসের ভিডিও আমার কাছে এইভাবে এসে দেখা দিয়েছিল।
ভেনিস বড় মিউজিক কম্পোজার আন্তনিও ভিভাল্ডির জন্মস্থান। সিম্ফোনিক ও অপারেটিভ মিউজিক এর ইতিহাসে ভিভাল্ডির জায়গা অনেক উঁচুতে। ভেনিসের সব সঙ্গীত গিয়াছে থামিয়া। সেই ভিডিও যেখানে পৌঁছয় সেই জায়গা এক প্রশস্ত চাতাল। মনে হয় আনন্দের জায়গা ছিল। চার্চের ঘন্টা বাজছিল। শেষ ঘন্টা…, না পায়রার দল মাটিতে খুটে খাচ্ছে দানা। পায়রারা আছে। বুঝতে পারছি ভেনিস কী হয়ে গেছে। বাঁচতে সকলে ঘরে ঢুকে গেছে। আমাদের এমনি ভাবেই শহর ফাঁকা করে দিতে হবে। এমনি করে পায়রাদের কাছে গোটা শহর রেখে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে হবে।
মেয়র বললেন, তুমি কি ভেনিসে ফেরার পথে এদিকে এসেছ হে মার্কো পোলো, তুমি যে সেযান শহরে আসবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি, ৭০০ বছর কি কম সময়?
মার্কো বলল, আমি কোথায় ফিরছি জানি না মহাশয়, কিন্তু ফিরছি, ফিরতে ফিরতে সব বিপ্রতীপ দেখছি, আয়নায় যেমন দেখা যায়, যা যেদিকে ছিল তা সেদিকে নেই, পাহাড়টা পশ্চিমে ছিল, এখন সেদিক ধুধু প্রান্তর, স্তেপভূমি দিগন্তে গিয়েও থামেনি, দিগন্ত পেরিয়ে আকাশের শেষ সীমা ফুঁড়ে কোথায় গেছে যে জানি না।
বলতে পারত নিকোলাই ইভানোভিচ । দাবার ঘুঁটি নাড়াচাড়া করতে করতে মেয়র বললেন।
মার্কো বিস্মিত হয়ে মেয়রের মুখের দিকে তাকাল। মেয়র বললেন, গণিতজ্ঞ, কিন্তু সে নাই, সেযান বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি যান, অনেক গণিতজ্ঞ এই দূরত্ব মেপে নিতে পারবে।
তিনি কোথায়?
সেই কথাও সেখানেই জানা যাবে। মেয়র বললেন।
মার্কো বলল, অসীমের সীমা হয় না হে নগরাধিপতি, আমি যত মেপে যাব, সে তত দূরে চলে যাবে, গণিতজ্ঞের সাধ্য নাই তার হিশেব খুঁজে বের করে।
খবরিয়ার আরো খবর:
আমাদের কলকাতা ফাঁকা হয়নি। মানুষ ঘর থেকে যে বেরচ্ছে তা দেখছি টেলিভিশনে। যাঁকে অফিসে যেতে হবে, যেতেই হবে। যাঁকে ব্যবসায় যেতে হবে, যেতেই হবে। চৈত্র মাস পড়ে গেছে, এই সময় কলকাতা শহরে কেনাকাটার বড় ধূম পড়ে যায়। হাতিবাগান, গড়িয়াহাটে বস্ত্র বিপনি, হকার সকলেই বেচা কেনা করে অনেক। লক্ষ্য ১লা বৈশাখ। আমরা ১৮- ই মার্চ তারিখে যখন হাতিবাগান পার হয়ে আসছি পথঘাট ফাঁকা। আলো ঝলমল দোকানদানি একা বসে ঝিমোচ্ছিল। হকারের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল না। সন্ধ্যার ভীড় নেই। আমরা তিনজন এক গাড়িতে ফিরছিলাম কলেজ স্ট্রিট থেকে। সমীর, অপু বলছিল লোকে ভয় পেয়েছে। আমিই নিজেকে আশ্বস্ত করতে বললাম, না, সবে চৈত্র পড়েছে, সেলের বাজার শুরু হতে দেরি আছে। রাত্রে আমরা, আমি মিতালি নর্থ ক্যারোলিনায় চকোরি, মৈনাকের খবর নিই, আমেরিকায় সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ওদের ওয়ার্ক অ্যাট হোম শুরু হবে হবে করছে। ওরা থাকে শারলট সিটিতে। বলল, গণ পরিবহন নেই শারলটে, তাই কিছু হয়নি তেমন। তবে ওরা সতর্ক হচ্ছে। বাচ্চার ইস্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইন লেখাপড়া হবে। ধনী দেশ। প্রযুক্তির শীর্ষে ওঠা দেশ, হবে এমন। কিন্তু কদিন বাদে কী হল। নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলস, সানফ্রান্সিস্কো, ফ্লোরিডা, মিয়ামি বিচ…, সব দখল হয়ে গেল অদৃশ্য ঘাতকে। ভারতেও করোনা ঢুকছে তখন। কীভাবে ঢুকছে, উড়ানে করোনা বীজ বয়ে আনছে ভীত ভারতীয় ছাত্ররা, ভ্রমণকারীরা, কাজের জন্য বিদেশ যাওয়া ব্যক্তিরা…ইওরোপ, ইতালি, চিন, ব্রিটেন, স্পেন, আমেরিকা থেকে বীজ আসছে আমাদের দেশে। তাদের দেশে এই ভাইরাস বয়ে নিয়ে গেছে প্রতিবেশি দেশ প্রত্যাগত মানুষজন। কেউ উড়ান বন্ধ করেনি, মানুষ তার দেহে ভাইরাস নিয়ে দেশান্তরে গেছে। ভুবনগ্রামে ছড়িয়ে গেল মহামারী। এই সময়, এই অবরুদ্ধ সময় ধরা পড়তে লাগল, স্যোসাল নেটওয়ারকিং সাইটে। তরুণ কবি তিমির চলে গেল বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে নিজ গ্রামে, যামিনী রায়ের দেশে। সে লিখে গেল,
‘এই প্রথম বাড়ি ফেরার সময় এত বিষণ্ণ। কলকাতাকে মনে হচ্ছে যেন ওরান শহর। ময়ূরাক্ষী এক্সপ্রেস ট্রেনে বসে ভাবছি ওরান শহরের মতো এই শহরও লকডাউন হয়ে যাবে কি, আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি? পলাতক? কতদিন আগে পড়া প্লেগ উপন্যাসের ঘটনাগুলি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর ভয় পাচ্ছি। এরমধ্যে সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতীরে ফিরে এসেছে ডলফিন। ইতালির ক্যানেলে ফিরে এসেছে হংসদল। চিন, ইটালি,ফ্রান্স, স্পেনে কমে গেছে বায়ুদূষণের মাত্রা। প্রকৃতি কি কিছু বলতে চাইছে? যে সভ্যতা শুরু হয়েছিল প্রকৃতির সঙ্গে অবিরাম লড়াই আর ধবংসের পথে সেই গতিপথ বদলানোর সময় এসে গেল কি? প্রকৃতি মাতা কে প্রণাম। মা নিশ্চয় তার শিশুদের বাঁচিয়ে তুলবে আশা রাখি।’
সেযানের মেয়র শুনতে শুনতে বললেন, সে তার কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল?
হ্যাঁ, সকলে ফিরতে লাগল ঘরে, অদৃশ্য ঘাতক ঘুরছে, ঘাতকের ভয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সকল বিপনী, কারখানা, জমিতে ফসল মরছে, মহাসড়কে পড়ে আছে যানবাহন, নিষেধাজ্ঞায় যাত্রী নাই, চালক এবং তার সহকারীও ঘরে ফিরতে লাগল পায়ে হেঁটে হেঁটে।
মেয়র শুনতে শুনতে বললেন, এত বিষাদ তোমার কথায়, শহরটা কেমন আমাকে বলো, আমি একটু স্বস্তি পাই, তুমি নিখুঁত বর্ণনা করতে পার, আমি সেই শহর দেখি নাই, একটা মানুষ এক জীবনে সব নগর, বন্দর দেখতে পায় না, তখন অন্যের কাছে শুনে নিতে হয়।
মার্কো বলল, আমাকে একটু ভদকা দিলে খুশি হই, আমি শীতার্ত।
মেয়র তার ব্যবস্থা করলেন। পরিচারক এসে ভদকা এবং কচি বাছুরের সুসেদ্ধ মাংস পরিবেশন করল। সঙ্গে কিছু ফল। আঙুর, পেস্তা, বাদাম, ছোলা। সবুজ লেটুস পাতা, মালবেরি…। মার্কো খুশি হলেন। নিশ্চিন্ত হলেন। খাদ্য আর পানীয় থাকলে তিনি কতবার ভূপর্যটনে যে যেতে পারেন। দেশ-দেশান্তরে ঘুরে নগর ও জনপদের সাক্ষী হতে পারেন। মার্কোর শীত কমে এল। ক্ষুধা সাময়িক ভাবে নিবৃত্ত হলো। তিনি তো ক্ষুধার কাহিনিও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কম না। নগর জনপদ মানে হর্ম্যশ্রেণী, মহাসড়ক, মোটরগাড়ি, ফিটন গাড়ি, বায়ুযানই নয়, নগর জনপদ মানে রঙ্গালয়, খাদ্য এবং পানীয় আর সমবেত উল্লাস নয়, ক্রীড়াভূমি কিংবা মধুশালা নয়, নগর এক ভিখারিনী মাকেও চিনিয়েছে তাকে। পাইপের ভিতরে মানুষ, বস্তির ভিতরে মানুষ, একটি ঘরে সাতজন মানুষের কুঁকড়ে থাকা, বাতাসের অভাবে বাতাস খুঁজে বেড়ান মানুষ চিনেছে মার্কো। সে ঝিমঝিমে মাথায় মেয়রকে প্রথমে কলকাতার মানচিত্র বোঝাতে লাগলেন। পশ্চিমে এক নদী। শহর ঐ নদীর কূলে গিয়ে শেষ হয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে হলে শহরের কেন্দ্রস্থলে যে সবুজ প্রান্তর আছে, সেখানে গেলে ভালো। একটা নগরের পশ্চিম তো এক জায়গা থেকে পশ্চিম নয়, অনেক জায়গা থেকেই পশ্চিম দেখা যায়। কিন্তু সব পশ্চিমই গঙ্গা নামের এক পবিত্র নদীর ওপারে দেখা যায়। নদীর এপারে কোনো পশ্চিম নেই। নদীর ওপারে অন্য শহর, সেখান থেকে পশ্চিম চলে গেছে অনন্ত দ্রাঘিমা পার করে কোথাও। মার্কো সেই কেন্দ্রস্থলের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এক দুর্গের পশ্চাতে সূর্যোদয় দেখেছিল একদিন। তখন তাঁর সন্মুখে এক ভিখারিনী মা তার সন্তান কোলে সূর্যাস্ত দেখছিলেন। মার্কো বলল, কলকাতার নানা জায়গা থেকে সূর্যাস্ত দেখেছে সে, কিন্তু ভিখারিনী মায়ের সামনে রক্ত বলয় হয়ে সূর্যদেব অস্ত যাচ্ছেন, কন্যাকে তা দেখাচ্ছেন তিনি, এমন দ্যাখেনি আগে। ভিখারিনী মা বললেন, শহরটা তাঁর ছিল, শহরটা তাঁর নেই, দেশটা তাঁর ছিল, দেশটা তাঁর নেই, কিন্তু ফিরে আসবে এই ভেবেই সন্তান গর্ভে ধরা। তারপর যখন নগরের অনেক মানুষ, তারা স্থুলকায়, শীর্ণকায়, উচ্চশির, নতশির, দীর্ঘকায়, খর্বকায় মানুষ সেই সবুজ প্রান্তর ধরে সূর্যাস্তের দিকে চলতে আরম্ভ করেছে…।
সূর্যাস্তের দিকে কেন? মেয়র জিজ্ঞেস করলেন।
কোথাও তো যেতে হবে হে নগরাধিপতি, কিছু মানুষ পশ্চিমে হাঁটে, কেউ হাঁটে পুবে, পরদিন ঐ দিকেই সূর্যোদয় হবে, সেই ভিখারিনী মা বিপরীতে হাঁটল।
সেই বিপরীতেও কি প্রান্তর বয়ে গেছে স্তেপভূমির মতো ? মেয়র জিজ্ঞেস করলেন।
না। মার্কো বললেন, কিছুটা গিয়েই বহুতল হর্ম্যশ্রেণী পরপর। সেই দিকে যেন প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভিখারিনী যুবতী মা তা যেন ভেদ করে গেলেন। কিছুই তাঁকে আটকাতে পারেনি। আমি তাঁকে অনুসরণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু পথে শুনতে লাগলাম খবরিয়া খবর বিলি করে বেড়াচ্ছে। সংবাদপত্র স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছে মানুষ। মুখে মুখে যা শোনা যাচ্ছে তা শুনছে। তার ভিতরে কত সত্য কত মিথ্যা, অর্ধসত্য তা কেউ জানে না। মহামারী প্রবেশ করছে। বিমান বন্দর থেকে নগরে গঞ্জে মফসসলে। মানুষ তার ভয়ে গৃহাভিমুখী…।
মেয়র বললেন, সেযান শহরে মহামারী নেই, মার্কো তুমি এই শহরে স্বাগত, তুমি আমাকে পৃথিবীর কথা শোনাও…, কোন নগরে কী ঘটছে, ঘটে যাচ্ছে, কোন দেশে কী ঘটছে, ঘটে যাচ্ছে…।
মার্কো বলল, শুনুন মেয়র মহোদয়…।
শুরু হলো মার্কো পোলোর ভুবন পরিক্রমা।
খবরিয়ার খবর লিখন:
কলকাতায় আর এক বীরপুঙ্গব জ্বরে পড়েছেন। তিনি এক ব্যবসায়ীপুত্র। লন্ডনে গিয়েছিলেন, নাকি লেখাপড়া করেন, এম, বি,এ, পড়েন তা নিয়ে কৌতুহল নেই। সেই যুবক কলকাতায় ফিরে বাবার স্যানিটারি ফিটিংসের দোকানে গিয়ে বসেন। ঘোরাফেরা করতে থাকেন। ধনী তাই করোনা ছোঁবে না। তাঁরা কাউকে পাত্তাই দেন না, থোড়াই সরকারি ফরমান মানেন, ওসব ফালতু আদমির জন্য। গরিব আদমির জন্য। কিন্তু এ দেখি ধনীর রোগ। যুবককে ধরল। জ্বর এল। তখনো সেই হাউজিঙের ম্যানেজাররা বলে যাচ্ছে তারা সব ঠিক করে রেখেছিল। কিচ্ছু হবে না। বাচ্চা ছেলে করে ফেলেছে…। টেলিভিশনে তা দেখেছি। সব কিছুকে ভয়ানক তুচ্ছ করার প্রবণতা এইসব মানুষের। পয়সা আছে, ক্ষমতাকে কিনে নিতে পারেন। ছড়াল ভাইরাস। পরিবারে পরিচিকা সহ আরো তিনজন আক্রান্ত হলো। সেই হাউজিঙে অনেক ক্ষমতাবানের বাস। ক্ষমতার লক্ষণ হলো সমস্ত রকম আইন ভাঙা।
মেয়র শুনতে শুনতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এমন হয়ে থাকে?
আমি দেখেছি এমন। মার্কোর মনে পড়ছিল অন্য কথা। নগর জনশূন্য হয়ে গেলে নগর কেমন হয়ে যায়। যেন নগর তৈরি হয়ে গেছে। বড় কোনো স্থপতি তা নির্মাণ করে চলে গেছেন। সেই নগর মানুষ আসার অপেক্ষায়। মানুষ এসে প্রবেশ করবে অট্টালিকাগুলিতে। পথে পথে ঘুরবে সুন্দরী নারী, পুরুষ। বিপনিগুলির দরজা খুলে যাবে। ভরে উঠবে খাদ্য সম্ভারে। মার্কো দেখেছেন নগরের পথে সারমেয়রা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাঝে মাঝে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেনস। সেখানে বসন্ত এসে গেছে, কদিন আগেই রঙের উৎসব গেছে। তারপরই সব ঝিম মেরে গেল। কিন্তু হ্যাঁ, সেযান শহরে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শোনা যায় না।
খবরিয়া লিখছে:
লকডাউন: পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে ঘর থেকে না বেরতে বলা হচ্ছিল। থিয়েটার সিনেমা হল সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর শপিং মল। বারবার বলা হয় জমায়েতে থাকবেন না। তারপর পুর শহরগুলি লকডাউন। কিন্তু মানুষ ছুটির মেজাজে ঘুরছিল। পথের মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে…মানুষ বিশ্বাসই করছিল না। লকডাউনের দিনই আমাদের বাড়ির দুই গৃহকর্মী মহিলাকে বলা হলো না আসতে। এক তারিখে এসে বেতন নিয়ে যেতে। আসলে আমাদের ভয় করছিল। রুকসানা মাসি থাকে বেলগাছিয়ার বস্তিতে। সারাদিন বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায়। সকালের চা বিস্কুট পায় এবাড়িতে। তারপর প্রাতরাশ, রুটি তরকারি। তাকে নিয়ে ভয় বেশি আমার। ঘিঞ্জি বস্তি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ…। গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ থাকে সেখানে। একটি ঘরে পাঁচ-সাতজন থাকে সেখানে। সেখানে ছড়ালে মহামারি লাগবেই। পরে বুঝতে পেরেছি বহুতল, স্বাস্থ্যকর আবাসনই হলো ভয়ের। বিলেত ফেরতরা কেউ বস্তিতে থাকে না। এক ঘরে পাঁচ-সাতজন থাকে না। কিন্তু আমি বললাম, চা খেয়ে চলে যাও মাসি। কাজ থাকবে, কিন্তু সকলের বাঁচার জন্যই আমাদের এখন দূরে দূরে থাকতে হবে। মাসি আমার স্ত্রী মিতালিকে বলল, বউদি আজকের টিফিনটা নেব তো ?
আহারে। না এলে টিফিন গেল। খাদ্য চাই খাদ্য। করোনায় রুকসানা মাসির তিনটে রুটি এবং অনেকটা তরকারি হাতছাড়া হলো। বেলায় এসে টিফিন নিয়ে বিমর্ষ রুকসানা চলে গেল। আবার কবে সকালের খাদ্যটি তার জুটবে জানে না। এই টিফিনই ছিল তার দুপুরের খাদ্য। বেলা চারটেয় বাড়ি ফিরে ভাত খায়।
রুকসানা মাসি এবং রান্না করেন যিনি তিনি না আসাতে আমি-আমরা যেন বাঁচলাম। আমার কাছে বেলুড় বিদ্যামন্দির কলেজের এক ছাত্র আসবে বলেছিল, বারণ করে দিলাম। ঘরে থাকলাম আমরা তিনজন। তখন কিন্তু বাইরে মানুষের ঢল কমেনি। স্যোসাল নেটওয়ারকিং সাইটে তার বিরুদ্ধে লেখা হতে লাগল।
লেখক জয়ন্ত দে ২৩-০৩ তারিখে লিখলেন:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটশিলায় এক রাতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় দূরে একটা আলো দেখেন। তিনি আলোর দিকে যেতে চান। বন্ধুরা বারণ করেন। কিন্তু তিনি যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, এক গাছের নীচে বাঁশের চালায় একটি মৃতদেহ। তিনি তার সামনে যেতেই শবের শরীর থেকে কাপড়টি উড়ে যায়। আর তখনই চমকে যান বিভূতিভূষণ, চিৎকার করেন ওঠেন। সেদিন তিনি সেই মৃতদেহর জায়গায় নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন। বলা হয়, এই মহান সাধক লেখক তাঁর নিজের মৃত্যুর কথা আগাম জানতে পেরেছিলেন। এরপর বিভূতিবাবু বেশিদিন বাঁচেননি।
এমনই, একজন আব্রাহাম লিঙ্কনও স্বপ্নে তাঁর মৃত্যুর কথা আগাম জেনে গিয়েছিলেন।
এই দুটিই আত্মোপলব্ধির একটি স্তর। যে স্তরে আমরা কোনওদিন পৌঁছাতে পারব না।
তবে হ্যাঁ, আমরা কাপড় ওড়াতে পারি বা একটা স্বপ্নদৃশ্য দেখে ফেলতেই পারি। সেই জায়গায় আমরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে শবদেহের উড়ে যাওয়া কাপড়ের নীচে নিজের বাবা মা, প্রিয়জনের মুখটি দর্শন করব। হ্যাঁ, যারা ‘লকডাউন’টা উৎসব ভাবছেন। এখনও ফুর্তিতে, মজাতে, রাস্তায় ঘুরছেন, ছুটি বানাচ্ছেন, ছোট ছোট দলে উপদলে উৎসবে মাতছেন, সচেতনতার ধার ধরছেন না। মনে করছেন, আপনার কিছু হবে না। আপনার পরিবার সুরক্ষিত। তাঁরা তৈরি থাকুন কাপড় উড়ল বলে—। বিত্তশালীদের দান বিত্তহীনদের মড়ক ডেকে দেবে। চাল ডাল মাংস মদ সব জমিয়ে রেখেছেন। দয়া করে এবার প্রাণবায়ু জমান। নাহলে হাওয়া বইছে…
ইতালি কিন্তু আপনাদেরই মতো কাপড় উড়িয়েছিল, এখন কাঁদছে…।
মেয়র শুনতে শুনতে বললেন, কলকাতা শহরের মানুষ খুব ভয় পেয়েছে!
মার্কো চুপ করে আছে। তার চোখে অশ্রুকণা দেখতে পেলেন সেযান শহরের মেয়র। মেয়র ভাবছিলেন মার্কো যে শহর থেকে এল সেই শহরের মতো তাঁর শহরেরও একটি নদী আছে। তার নামও সেযান। এই নদীও তাঁর শহরের পশ্চিমকে ঘিরে আছে। গঙ্গা যেমন পবিত্র নদী, এই নদীও পবিত্র। গঙ্গা যেমন ঐ জনপদে মাতৃরূপে বন্দীত, এই নদীও এই নগরের মানুষের মা। এই জাতির জন্ম হয়েছে সেযান নদী থেকে। মেয়র এই শহরকে ভালোবাসেন। তাঁর পিতৃপুরুষ যোদ্ধা ছিলেন, মেষপালক ছিলেন, কৃষিকাজ করতেন, নৌকো বাইতেন, সওদাগরী করতেন, অতিথি বরণ করতেন। এখনো করছেন। ইতালীয় ঘুরুয়া মানুষ মার্কো পোলোর ভূ-পর্যটনের কথা মেয়র ইতিহাসে পড়েছেন। ৭০০ বছরেরও আগের কথা। মার্কো তাঁর শহরে এসেছে, তিনি তাঁর আপ্যায়নের ত্রুটি রাখবেন না।
মার্কো পোলো ভুলেই গেছে সেই ভেনিসের কথা। কতকাল আগে ভেনিস ছেড়ে বেরিয়েছে। জনপদের পর জনপদে গিয়েছে। যেতে যেতে ভেনিসের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। ভেনিসে ফেরার জন্যই তার ক্রমাগত চলন। মার্কো পোলো জানে একদিন সে ভেনিসে পৌঁছে যাবে। মার্কো এই শহর দেখেছিল নদীর ওপার থেকে। ওপার থেকে এই সেযান শহর পুবে। যেমন কলকাতা শহর যদি গঙ্গা নদীর ওপার থেকে দেখা হয়, পুবেই দেখা যাবে। এক জনপদের সঙ্গে আর এক জনপদের কত মিল। এই মিল এক ১০০০ বছরের শহরের সঙ্গে ৩০০ বছরের শহরের। সেযান যত প্রাচীন, ভেনিসও তত। মার্কো যদি সেযান শহরের দিকে চেয়ে ভেনিসের মুখ দেখতে পায়, সেই মুখে কলকাতার ভিখারিনী মায়ের মুখের আদল এসে যায়। ভেনিস কিংবা সেযান কিংবা সেই কলকাতা, কেউই সেই মায়ের মুখ চেনে না। ভুলে গেছে।
মেয়র বললেন, এই নগরকে আপনি কেমন দেখেছেন ?
নদীর ওপার থেকে দেখেছি যেমন, পুবে তাকিয়ে, নাকি পশ্চিমে তাকিয়ে এই নগরের কেন্দ্রভূমি থেকে ? মেয়রের উত্তরের অপেক্ষা না করে মার্কো বলল, ভেনিসের মতো, ভেনিসকে যেমন মনে পড়ে।
ভেনিসকে কেমন মনে পড়ে মার্কো ?
মার্কো বলল, এই শহরে এসে আমি ভেনিসকে দেখতে পাই যেন, যেমন দেখেছিলাম কলকাতার ভিতরে ভেনিসের প্রাণ, কত মানুষ, অত মানুষ আমার ভেনিসে ছিল না, মানুষে মানুষে গলাগলি করে থাকে যেন, খুব উল্লাস করে, যেমন ভেনিসের মানুষ করে, ছবি আঁকে, রঙ্গালয়ে ভীড় করে, ক্রীড়াভূমিতে ভীড় করে, যেমন আমার ইতালি করে, ভেনিস করে, অথচ কলকাতার বয়স কতটুকু।
মেয়র শুনতে শুনতে বললেন, যেন আমার সেযান শহরের কথা শুনছি মহাশয়।
মার্কো চুপ করে থাকল। মেয়র তো জানেন না, সে ভেনিসের কথা হয় ভুলে গেছে, অথবা ভেনিস দ্যাখেনি কখনো, তার জন্ম হয়েছিল অজানা এক জনপদে, তার মা তাকে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছিলেন, হয়ত ভেনিসের পথেই চলেছিলেন, কিন্তু মা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেলেন, তা মার্কোর জানা নেই, মা চলে গেলেন এক সৈনিকের সঙ্গে, নাকি এক আমলার সঙ্গে, ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে, সওদাগরের সঙ্গে, তাকে রেখে গেলেন এক এতিমখানায়, মার্কো তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কথা ভুলেই গেছে সব, শুধু জানে তাকে ভেনিস যেতে হবে, ভেনিস যাওয়ার কুহক মা তাঁর কানে দিয়ে গেছেন, মার্কো পর্যটক, নগরে জনপদে যাওয়া তার রক্তে, তার পূর্বপুরুষের কথা সে তার মায়ের কাছে শুনেছে, অভিযাত্রা ছিল তাদের রক্তে, এমন হতে পারে তার পূর্বপুরুষ সে নিজে, তার উত্তরপুরুষও সে। এই ভয়ানক দিন না এলে তার দিন চলে যাচ্ছিল চমৎকার, এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে গিয়ে সেই জনপদকে প্রাণ ভরে আস্বাদ করতে করতে জীবন মধুর হয়ে উঠেছিল যখন, তখন নগর, জনপদের ফটক পড়তে লাগল। সকলে নিজের শহরে, নিজের গ্রামে ফিরতে লাগল। মার্কোর তখন মনে পড়ল ভেনিস। ভেনিস ফিরে যেতে হবে। মা বলত, আমরা ভেনিস ফিরে যাব। মায়ের মুখ মার্কো ভুলে গেছে। মায়ের কথাটি মার্কোর নিজ কল্পনা কি না সে বুঝতে পারে না। মেয়রের কথায় মার্কো তাঁর দিকে ফিরল। শুনতে পায়নি স্পষ্ট করে। কী বলছেন নগরাধিপতি, মেয়র মহোদয় ?
মেয়র তাঁর কথা আবার বলতে মার্কো বলল, সে সেযান নদীর ওপারে পৌঁছে, পুবের দিকে তাকিয়ে, দূরবীনের ভিতর দিয়ে দেখেছিল গির্জার চূড়া, মসজিদের মিনার, রঙ্গালয়ের আশ্চর্য গড়ন, প্যারাবোলার মত ঢেউ তার শিয়রে, দেখে মনে হয়েছিল ভেনিস, তাই পার হয়ে এসেছিল, হ্যাঁ, মেয়রের কথা সত্য, সেযান শহরকে তার ভেনিসের মতো মনে হয়, যদিও ভেনিসের সব স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার কাছ থেকে, কিংবা আছে, স্বপ্নের ভিতরে হানা দেয় তাহলে কোন শহর ? যে শহরে প্রবেশ করতে গেলেই ভেঙে যায় স্বপ্ন। সেই শহর এইসব কোনো শহরের মতো নয়, আবার এইসব শহরের মতোও হয়ত। বুঝতে অসুবিধা হয়। স্বপ্নের স্থায়িত্ব খুব কম। একটা ক্যানেল দেখতে পান অনেক দূরে। তারপর ? অন্ধকার। অন্ধকারে জেগে উঠে দূর থেকে ভেসে আসা এক সুরের মূরচ্ছনা শুনতে পায় সে। ভেসে এসে মিলিয়ে যায়। ভেনিস তো সুরের শহর। তাকে কলকাতার এক সুরসাধক বলেছিল আন্তনিও ভিভাল্ডির নাম। শুনিয়েছিল চার ঋতুর মূরচ্ছনা। শুনতে শুনতে মার্কো নিজের দেশটিকে দেখতে পেয়েছিল। বসন্তে তুষার গলেছে। ঝর্না মুক্ত হয়েছে দেখতে পাচ্ছিল সে। তারপর গ্রীষ্ম এল, সবুজ হয়ে আছে মাঠ প্রান্তর। নিষ্পত্র গাছ ভরে উঠেছিল সবুজে। মাথার উপরে নীল আকাশ। আহ। মার্কো অন্ধকারে সেই সুরের একটা রূপ দেখতে পায়। গ্রীষ্মের পর হেমন্তে পাতা খসানোর আগে গাছ-গাছালির পাতা ভরে ওঠে রঙে আর রঙে। আগুন রঙে ভরে যায় সব। মার্কো দেখতে পেয়েছিল। রঙ যেন মোর মর্মে লাগে। রঙ যেন ঢেউ হয়ে গাইছে। আবার মনে পড়ে যাচ্ছে সামনে শীত। ঢেউ কখনো মিলিয়ে যাচ্ছে, কখনো জেগে উঠছে প্রবল হয়ে। তারপর এল শীত। তুষারে ছেয়ে গেছে সব। মানুষ ঘরে ঢুকে গেছে। তুষারে ছাওয়া মহাপ্রকৃতির ভিতরে একটি ঈগল। নিঃসঙ্গ ঈগল। মার্কোর মনে হয়েছিল সে নিজে, সে-ই তুষারাচ্ছন্ন মহাপ্রকৃতির ভিতর দিয়ে একা হেঁটে যাচ্ছে, তিনিই সেই নিঃসঙ্গ ঈগল। লকডাউন। সব দুয়ার বন্ধ।
মেয়র ভাবছিলেন তিনি শহরটিকে সাজিয়েছেন অনেক। আরো সাজাবেন। সেযান শহর যেন এক বাগান। কোথাও যেন কোনো খুঁত না থাকে। বাগানের প্রতিটি ফুল যেন সময়ে ফুটে ওঠে। এই নগরে কোনো ভয় নেই। শিশুদের ভয় নেই, বৃদ্ধদের ভয় নেই, যুবক যুবতীদের ভয় নেই। সুবৃহৎ মসজিদ, গির্জা এবং সর্বধর্মের উপাসনালয় এই নগরেই। মসজিদ অভিমুখে যাত্রা করেছে যে মধ্যবয়সী, সে গির্জার সমুখে এসে বুকে হাত রাখে। আমেন। শান্তি। এই নগরের মেয়েরা খুব সুন্দর। তাদের হাসি আরো সুন্দর। তাদের সেবা আরো সুন্দর। সব মিলিয়ে তারা একটি রঙীন প্রজাপতি যেন। জয়িত্রী এক সুন্দরী প্রজাপতির নাম। মেয়রের মনে হলো জয়িত্রী মার্কোর সঙ্গী হতে পারে। মার্কো তার সঙ্গে এই নগর দেখতে যেতে পারে।
পাঁচ
অপেরা, কনসার্ট, সিনেমা, থিয়েটার দেখাতে নিয়ে যেতে পারে জয়িত্রী। রেস্তরাঁয় নিয়ে গিয়ে সব চেয়ে পছন্দের খাদ্য খাওয়াতে পারে। মেয়র অতিথি পরায়ণ মানুষ। সেযান শহরের সুখ্যাতি যেন মার্কোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেযান শহরে অসুখ নেই, তা যেন মার্কোর ভ্রমণ বৃত্তান্তে থেকে যায়। গ্রীষ্ম আসতে দেরি আছে প্রায় এক মাস। ফুটবে চেরি। চেরি প্রস্ফূটন পর্যন্ত যেন পর্যটক এই শহরেই কাটিয়ে যায়। যতদিন ইচ্ছা মার্কো পোলো এই শহরে থাকতে পারে। তিনি আতিথ্য দেবেন। মেয়র দেখলেন তুষারপাত হয়েই যাচ্ছে। পথে একটিও মানুষ নেই। তুষারপাত হলে এমন হয়।
টেলিভিশনই খবরের উৎস:
টেলিভিশন দেখাচ্ছে বাজারে কত মানুষ। গায়ে গা, ঠেলাঠেলি করে বাজার করছে। চাল ডাল আটা তেল নুন চিনি…। যদি সংক্রমণ হয় এই শহর রক্ষা পাবে না। ভেনিসে যত মানুষ বাস করে, আমাদের একটি পাড়াতেই বোধ হয় তত মানুষ। রাত্তিরে, দুপুরে সংবাদ দেখতে দেখতে ভয় পাই। মানুষ ঘরে ঢোক। জবাব আসে, ঘরে যাব তো খাব কী ? দিন আনি দিন খাই মানুষের অবস্থা কী হবে? শহর কি আপনার একার, তাদেরও। ঐ যে রিকশাওয়ালা বুড়ো, থাকে পাইপের ভিতর রাতে, সারাদিন পথেই থাকে। ছায়ার নিচে রিকশা রেখে দুপুরে ঝিমোয়। প্যাসেঞ্জার পেলে মেট্রো স্টেশনে নিয়ে যায়। সে যাবে কোথায়? কোন ঘরে কোয়ারান্টিনে ? রিকশা নিয়েই নিঝুম দুপুরে সে আছে। জনকোলাহলের ভিতরও আছে। এমনি আছে মুসুম্বির রস বেচতে বসা মধ্য বয়সী। দেখেছি গ্রীষ্মের দুপুরেও মাঠে ফুটবল পিটছে ছেলেরা। সব বস্তি থেকে বেরিয়ে আসে। ঘরে জায়গা নেই, থাকবে কোথায়? তাই এই শহর পায়রাদের হাতে, ঘুঘু, কুবো পাখিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সব মানুষ ঘরে ঢুকে যাবে না। ঘরই নেই যে। আজ ২৫শে মার্চ। ভোর রাতে ঘুম ভাঙতে কতরকম কথা মনে আসছে, আচ্ছা সারাদিন গাড়ি-ঘোড়া নেই, রাত তো আরো নিঝুম, যারা দিনে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তারা ঘুমিয়েছে সারারাত। রাতে যে লরি চলে, কিছু কিছু গাড়ি ছুটে যায় তাও নেই। ভোরের ট্রামের ব্রিজ কাঁপিয়ে ধর্মতলার দিকে ছুটে যাওয়া নেই। আকাশ নির্মল। বাতাস নির্মল। ধূলিকণা নেই। এই সময় যারা মানুষের ভয়ে লুকিয়ে থাকত বেরিয়ে আসবে না কি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী ফিরে পেয়ে ? তিমির লিখেছে যে সিঙ্গাপুরে চিন সাগরে ফিরে এসেছে ডলফিন। মনে পড়ল বাঘডাঁশার কথা। শ্যামলদা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর দশ লক্ষ বছর আগে’ উপন্যাসে কী লিখেছিলেন? আজ ২৫শে মার্চ, তাঁর জন্মদিন। অকালে চলে গেছেন, আমি সেই দশ লক্ষ বছর আগে উপন্যাসটিকে স্মরণ করি…
শ্যামলবাবু, দশ লক্ষ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই প্রাণীটি যাকে গভীর রাতে জানালা দিয়ে দেখেছিল এলসা টিঁচবোর্ণ, সেই মাইক্রোবায়োলজির গবেষক, সেই বাঘডাঁশা আবার ফিরে আসছে আপনার কল্পনাকে সত্য করে। আপনি জানেন না গোটা পৃথিবীর মানুষ এখন ঘরে। যে গ্রহটিকে মানুষ হাতুড়ি মেরে মেরে, ডিনামাইট ফাটিয়ে ফাটিয়ে শেষ করেছে, তার রিপেয়ারিং চলছে এইভাবে। দশ লক্ষ বছর ধরে হোম কোয়ারান্টাইন এ থাকা প্রাণীরা এতদিন বাদে মুক্ত হয়েছে। এলসা টিচবোর্ণ, শ্যামলবাবু তাদের দেখতে পেয়েছিলেন সত্যি। আমিও দেখতে পেলাম আপনি ওদের সঙ্গে হাঁটছেন।
শ্যামলবাবুকে স্মরণ করে শেষ রাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনে ফেসবুক ঘাঁটছি, দেখলাম ছত্তিশগড়ের আদিবাসীরা শালপাতার দুই কোণে সুতো বেঁধে কী চমৎকার মাস্ক তৈরি করেছে। এখন শাল জঙ্গলে নতুন পাতা এসেছে। কচি শালপাতায় নাক মুখ ঢেকেছে তারা। এই আমাদের দেশ। সকলে জেনে গেছে অদৃশ্য ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পেতে এই হলো উপায়। এরপর দেখলাম আমেরিকার কথা। ইতালির কথা। ভয় আমার ভিতরে প্রবেশ করল আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।
২৫শে মার্চ ভালো ছিল দিনটি।
অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম ভারতে প্রথম করোনায় আক্রান্ত দম্পতি, যাঁদের একজন ৭০, অন্যজন ৬৮, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। প্রবীণ কিন্তু পারলেন। আর করোনা আক্রান্ত মানুষ ১১জনের মৃত্যু হয়েছে, ৪৮জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মনে হলো ভারতীয়দের বুঝি প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। জীবন-যাপন খুব সাধারণ, বেঁচে থাকি কত কষ্ট করে, সারা বছর কত ভাইরাস যে নিজেদের অজান্তে প্রতিরোধ করি। গরিব তস্য গরিব মানুষ কীভাবে বাঁচে। কত পরিশ্রম তাদের দৈনন্দিনতায়। তাই আমরা পারব এই ভাইরাস প্রতিরোধ করতে। আমাদের স্যানিটাইজার চেনাল এই ভাইরাস। আমরা কলকাতার জল খেয়ে ভালোই থাকি, বাঁকুড়া পুরুলিয়ার লোক কুয়ো থেকে জল তুলে খেয়ে দুর্জয় বেঁচে থাকে। খরা বন্যা আমাদের নিত্য সঙ্গী। আমরা পারব। আবেগে এইসব লিখে দিলাম। চতুর্দিক থেকে যত ভয় ঘিরে ধরছিল আমাদের তার ভিতরে এই খবর হল কালো মেঘে রূপোলি রেখা।
ভয়ের ভিতরে ভয়:
ইতালি আত্মসমর্পণ করেছে।মৃত্যু মৃত্য মৃত্যু! আমেরিকায় মৃত্যু বাড়ছে। নিউ ইয়র্ক নিবাসী লুৎফুন্নাহার লতা নিয়মিত খবর দিয়ে যাচ্ছেন। লতা আপার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ২০১৮-র এই সময় মিশিগানে, তারপর ১৪ই এপ্রিলের পর নিউ ইয়র্কে। লতা বাংলাদেশের মঞ্চ এবং টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। উপস্থাপিকা ছিলেন। রাশান আমেরিকান মার্ক সায়েবকে বিয়ে করেছেন। মার্ক ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। এক অনুষ্ঠানে উইকি থেকে আমার সম্পর্কে তথ্য নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন ভাঙা বাংলায়। লতার লেখা পড়ে বুক ভেঙে যায়। আমি এই চেরি প্রস্ফুটনের সময় ঐ দেশে ছিলাম। লতা এক বছর বত্রিশের তরুণী মায়ের মৃত্যু সংবাদ শেয়ার করেছেন। তিন সন্তান সহ ত্রিশ-বত্রিশের মায়ের ছবি কী সুন্দর। বাংলাদেশের ঢাকার নিকটবর্তী মুন্সিগঞ্জের কাজি হাসান লিখছেন…
.২৬.০৩.২০
কাজি হাসান, গেনডারিয়া, মুন্সিগঞ্জ,
নিউইয়র্কে করোনা ভাইরাসে মুন্সীগঞ্জের তৃষার মৃত্যু!
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের সন্তান, তিন সন্তানের জননী আমিনা ইন্দালিব তৃষা (৩৯) ’র মৃত্যু হয়েছে গত ২৩ মার্চ। ইন্নলিল্লাহে ওয়াইন্না….রাজিউন। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। স্বামীর নাম বোরহান চাকলাদার। এ নিয়ে নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা তিন বাংলাদেশীর মধ্যে তিনি একজন। চার বছর আগে তৃষা সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন।
নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের বাংলাদেশ সোসাইটির কবরস্থানে আজ ২৬ মার্চ নিউইয়র্ক সময় ১০ টায় জানাজা শেষে তাকে সমাহিত করা হবে বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।
আমরা তৃষা’র বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি….
সূত্র : সভ্যতার আলো
প্রবাসে দৈবের বশে, জীব তারা যদি খসে…, জীব তারা খসে যাওয়ার খবর দিনে দিনে আসতে লাগল জয়িত্রী।
জয়িত্রী মেয়েটির মুখখানি কঠিন নয়, সরল নয়, আবার কোমল যে তা বলা যাবে না। মার্কো তার সঙ্গে এসেছে একটি উদ্যানে। কেন্দ্রীয় উদ্যান নয় এইটি, তবু কত বড়। তুষারপাত নেই আজ। আকাশ ঝকঝকে নীল। চমৎকার রোদ উঠেছে। নগরের এখানে ওখনে তুষার জমাট বেঁধে আছে। মার্কো এবং জয়িত্রী বসে ছিল এক বেঞ্চে। জয়িত্রীর হাতে একটি বই। যদি মার্কো একা ঘুরতে চায় উদ্যানে জয়িত্রী বইটি পড়বে। সে গিয়েছিল অনেক দূর। আস্তানা। অন্য দেশ অন্য শহর। জয়িত্রী গিয়েছিল এক সম্মেলনে। সাংবাদিকতা ছিল সম্মেলনের বিষয়। সাংবাদিকের দায়িত্ব ছিল তার বক্তব্যের বিষয়। জয়িত্রীর ইচ্ছা সাংবাদিক হবে। সে বছর ২৪-এর এক তরুণী। জয়িত্রী তার বই রেখে মার্কোকে জিজ্ঞেস করল, তুমি নিউইয়র্ক শহরে গেছ ?
মার্কো বলল, এই সেযান শহর ব্যতীত সব শহর হয়ত আমি দেখেছি।
তুমি আমাকে নিউ ইয়র্ক শহরের কথা বল।
মার্কো বলল, এখন নিউ ইয়র্ক, অবিরাম কান্নার বিবরণ শুনতে চাও?
জয়িত্রীর মুখখানি অন্ধকার হয়ে গেল। মাথা নামাল একবার। বলল, ‘তৃষার কথা জানি মার্কো, এত কষ্ট হচ্ছে, সে হয়ত আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিল, সে ফেসবুকে তার তেলিপাড়া গ্রামের ছবি দিত ,বাঁশবাগান, নদী, নৌকা, বিল, শস্যক্ষেত্র, তেলিপাড়ার আশ্চর্য সব ছবি আমার মোবাইলে সেভ করা আছে, সে ফেসবুকে লিখেছিল, এবার ঈদের সময় দেশে যাবে…
মার্কো বলল, বাচ্চা তিনটি হয়ত নিউইয়র্ক থেকে তেলিপাড়ার নদীর ধারে ফিরে যাবে, আর…।
জয়িত্রী দুহাতে মুখ ঢাকল, বলল, বাচ্চারা কী সুন্দর, তাদের ছবিও আমি সেভ করে রেখেছি, ভালো কিছু পেলে আমি তা ধরে রাখতে চাই, শোনো মার্কো, আমার আরো দুই বন্ধু আছে ঐ শহরে, তাদের ফোনে পাইনি, ক’দিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মার্কো বলল, আমি একসময় এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম, গ্রামখানি ছোট-বড় পাহাড় দিয়ে ঘেরা, সেখানে এক বটমূলে এক দেবী দেখেছিলাম, সেই দেবীর কথা খুব মনে পড়ছে, তিনি মানুষের কান্না থামাতে পারতেন, কাঁদনা বুড়ি ।
জয়িত্রী বলল, তার এক পিসি আছে, সে তিনবার বিয়ে করেছে, তিনটি বিয়েই ভেঙে গেছে, পিসি সংসার করতে চায় কিন্তু কোনো সংসারই টেকে না, পিসির জীবন কান্নায় ভরা।
মার্কো বললেন, হ্যাঁ, এমন হয়, কিন্তু এইটাই সত্য নয়, কান্না কতরকমে আসে, নিউইয়র্ক শহরে টাইমস স্ক্যোয়ার এক আনন্দের জায়গা, সেখানে পরিচয় হয়েছিল ব্যক্তির সঙ্গে, আর এক দেশের নাগরিক, তার নিজের শহরের নাম হবিগঞ্জ, তারা হবিগঞ্জের চারজন একটি বাড়ির একটি ঘরে থাকে, খাদ্য বিপনিতে কাজ করে, প্রতিদিন ৫০ ডলার পায়, তাদের ভিতর দুজন খুব ভালো রান্না করে, আয়ের থেকে মাসে ৫০০ ডলার দেশে পাঠায়, তাদের দু’জনের একজন দেশে গিয়েছিল একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে, মরে গেছে, এবং গোটা গ্রাম সংক্রামিত করে গেছে, একজন নিউইয়র্কে মারা গেছে, বাকি একজন পালিয়েছে, আছে একজন, সুস্থ।
কোথায় পালিয়েছে? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করল।
জানি না, হয়ত হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছিল, বাকিরা পারেনি।
হাসপাতাল থেকে কোথায় গেল খোঁজ নেই? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করে।
হয়ত হাসপাতালে মারা গেছে, কবর হয়ে গেছে। মার্কো বলল।
জয়িত্রী বলল, তুমি নিউইয়র্ক শহরের কথা বল, ভয়ের আগে সেই শহর কেমন ছিল।
মার্কো বলল, তোমাকে কি তৃষা বলেনি?
জয়িত্রী বলল, না, তার কাছে মুন্সিগঞ্জ, সিরাজদিখান উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের কথাই শুনতাম, আমি তো অমন নদীর কথা আগে শুনিনি, পদ্মা মেঘনা যমুনা…, কত নদী কত নদী, কত পানি আর কত পানি…।
মার্কো বলল, নিউইয়র্কে কথা শোনো জয়িত্রী, এমনি সেই নগর, আকাশচুম্বী বাড়ি, রঙ্গালয়, উদ্যান, যাদুঘর, খাদ্য বিপনি, ক্রীড়াভূমি, হাডসন নদীর ভিতরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, নদীর উপরে প্রাচীন সেতু…ঠিক এমনি শহর।
তবে যে আমার বন্ধুরা বলে, এমনি না অন্যরকম, সন্ধ্যায় ঐ নগর নাকি প্রতিদিনই উৎসব-নগর হয়ে ওঠে।
তাহলেও এমনি, এমনি সে নগর, হাডসন নদীর ওপার থেকে দেখলে যেমন, সেযান নদীর ওপার থেকে দেখলেও তেমন, সেই শহরে যে বিদেশীরা থাকে, তারা সেখানে গিয়ে আর ফিরতে চায় না, আমার তো মনে হচ্ছে এই সেযান শহরে বাকি জীবন থেকে যাই। মার্কো বলল জয়িত্রীকে।
জয়িত্রী হাসল। সেই হাসির অনেক অর্থ হয়, মার্কোর মনে হলো, জয়িত্রী তার এই বাসনায় অনুমোদন দিল। আবার মনে হলো, না অনুমোদন দেয়নি। সে নিজেও তো কাযাখস্তান দেশের আস্তানা নগর থেকে ঘুরে এল ক’দিন। তার নিজের কি মনে হয়েছিল এই ১০০০ বছরের প্রাচীন শহর ছেড়ে আর এক সুন্দর শহর আস্তানায় চিরকালের মতো থেকে যায়? মার্কো নিজেই কি তা পারবে ? ৭০০ বছর ধরে মার্কো পোলো হাঁটছে ভেনিস ছেড়ে এসে, সে কি কোথাও থেকে যেতে চেয়েছিল ? কোথাও চিরকালের মতো থেকে গেলে অন্য কোথাও যাওয়া যায় না।
জয়িত্রী বলল, সেই শহরে যারা গিয়ে পড়ে, তারা যদি না ফিরতে চায়, তবে তো সেই শহরের কুহক আছে।
খবরিয়ার নিবেদন:
# #
২৭.০৩.২০
সারাদিন বাড়িতে। টেলিভিশন কম দেখছি। দেখলে এত রকম কথা, ভয়…। আমি বরং ভি এস নইপলের ইন এ ফ্রি স্টেট বইটিই পড়ি। করোনা আতঙ্ক থেকে মুক্ত হতে বই পড়া চমৎকার। পড়তে সেই কতকাল আগে আফ্রিকার এক রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। সময় আলাদা ছিল। তখন মানুষে মানুষে দেখা হত, কথা হত মুখোমুখি…। লম্বা সফর করা যেত পাহাড় জঙ্গল দেখতে দেখতে।
নইপল বড় লেখক কেন, বুঝতে পারছি। আফ্রিকার এক রাজ্য স্বাধীন হয়েছে। এতকাল যাদের উপনিবেশ ছিল তারা, শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিণে চলে যাচ্ছে, এশিয়ানরাও হটে গেছে, তাদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি দখল করেছে আফ্রিকানরা। এক দীর্ঘ যাত্রা আছে এই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্টের। সেই যাত্রায় দেশটির রূপের যে আশ্চর্য বিবরণ দিয়েছেন লেখক, তা অনিন্দ্যসুন্দর। অপরিমেয় ক্ষমতা না থাকলে হারাতে বসা জনপদ আর প্রকৃতির সেই রূপের নিবিড়তা লেখক নির্মাণ করতে পারেন না। মুগ্ধতা কাটছে না। শাদা এবং কালো মানুষের সম্পর্ক, কালো মানুষের প্রতি ঘৃণা আবার মমত্ববোধ সবই আমাকে শিখিয়েছে লেখকের দেখার চোখ। উপন্যাসের চলন মন্থর। তাই ক্লাসিক। চলন সমস্ত দিন ধরে। মেঘ গাহাড়, উপত্যকা, বর্ষাবাদল এবং ভীরু, দরিদ্র কালো মানুষ যারা পেয়েছে স্বাধীনতা, কিন্তু সব চিনিয়ে দিয়েছেন লেখক স্বর বর্ণ, ব্যঞ্জন বর্ণ চিনিয়ে দেওয়ার মত করে। এমন লেখা পড়তেই করোনা থেকে মুক্তি চাই। এই পৃথিবীর সম্পদ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলা, গান, বাদ্য, সবই ধরা থাকে বড় লেখকের কলমে। পড়ছি অনুবাদে। নিভৃত পাঠের সুখই আলাদা।
এই দিন ফেসবুকে বিশ্বেন্দু নন্দর একটি লেখায় বুকে জোর পেয়েছি। তিনি বলছেন,
আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া দধীচি পূর্বজদের জন্যে বেঁচে যেতে পারে? এখনও নির্দিষ্ট করে বলার সময় সময় আসে নি। কিন্তু প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাচ্ছি, তাতে কতগুলো কথা মনে হয়েছে – বলার অনুমতি দিন। যেখানে ম্যালেরিয়ার ইতিহাস আছে সেখানে কোভিদের আগ্রাসন খুব নিস্তেজ। অর্থাৎ উপনিবেশের হয়ে রেল, সড়ক রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে যে কোটি কোটি আফ্রিকীয় দক্ষিণ এশীয় পশ্চিমীদের তৈরি করা ম্যালেরিয়া মারিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের তৈরি করা দেহ সুরক্ষায় কী কোভিদ সংক্রমণ আটকাচ্ছে? সর্বোপরি কোভিদ সংক্রমণ রুখতে ম্যালেরিয়ার একমাত্র নিদান ক্লোরোকুইন জাতীয় ওষুধ, কাজ করছে। অর্থাৎ আমরা কী ম্যালেরিয়ায় প্রাণ দেওয়া পূর্বজদের তৈরি করে দেওয়া ইমিউনিটির জন্যে খুব বেশি করোনায় আক্রান্ত হচ্ছি না?…
খবরিয়া বলে, তা যদি সত্য হয় আশীর্বাদ, ভবিষ্যৎ বলবে এই আশা কুহকিনী কি না।
খবরিয়ার মন নেই কোথাও:
২৮.০৩ ২০
এইদিন খবর পেলাম দিল্লির বাস টারমিনালে জমা হয়েছেন বহু মানুষ। নিজের রাজ্যে ফিরবেন। সকল মানুষের একটা রাজ্য থাকে, জেলা থাকে, মহকুমা থাকে, ব্লক এবং গ্রাম। গ্রামে ফিরবে কিংবা তার শহরে ফিরবে। তারা ভয় পেয়েছে। কী করে ফিরবে, প্রশাসন ব্যবস্থা করেনি। বহু মানুষ হাঁটতে আরম্ভ করেছে মহাসড়ক ধরে। এ কি ভয়ানক স্বদেশযাত্রা! ১৯৪৭ সালে পার্টিশনের পর এমন দেখা গিয়েছিল। তা ছিল উচ্ছিন্ন মানুষের মহাযাত্রা, নতুন দেশের খোঁজে যাত্রা। আর এ হলো নিজ কুলায় ফেরা, পাখিরা যেমন ফেরে। ঘরে বসে বিচলিত হয়ে করব কী, আমার কী করার আছে, মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে যাওয়া বারণ। দেখি নিউইয়র্ক থেকে খবর এসেছে।
তখন নিউ ইয়রকের লতাজি লিখছেন, ভয়ের কথা লিখছেন…প্রবাসে দৈবের বশে আবার জীব তারা খসে গেল কার? কোন সুজনের?
লতা, নিউ ইয়রক, ২৭.০৩
বেলা ২টা। আমার ডান পাশের প্রতিবেশীর ঘরে কান্নার রোল। এখনো জানি না কে হারিয়ে গেল!
বুক কাঁপছে।
রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। আমি যেন শুনতে পেলাম নিউইয়রকের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের কান্নার রোল। তখন খুব ভোর আমার শহরে, কিন্তু ওই দেশে বিকেল কিংবা সন্ধে। কেউ কারো খোঁজ নিতে ভয় পাচ্ছে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। কী হয়েছে জানতে ভয় পাচ্ছে। ঘাতক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে, ঢুকে পড়েছে পাশের ফ্ল্যাটে কিংবা দূরে কোথাও, অন্যদেশে তার স্বজনের গৃহে। খবর এসেছে। এই খবর দিয়েছে খবরিয়া!
মার্কো রঙ্গালয় থেকে ফিরছিল জয়িত্রীর সঙ্গে পায়ে হেঁটে। তার আশ্রয়স্থল কাছেই। সেখানেই জয়িত্রীর গাড়ি রাখা আছে। যে অপেরা দেখল তারা, তা ছিল এক প্রেমের কাহিনি। মার্কো এমন দ্যাখেনি সেই দক্ষিণ এশিয়ার কলকাতায় কিংবা ঢাকায় কিংবা দিল্লিতে। মার্কো একটি কনসার্ট দেখেছিল লস এঞ্জেলস শহরে। বহু মানুষ নিয়ে সেই কনসার্ট দেখতে কয়েক হাজার মানুষ রবিবারের সকালে। বৃদ্ধ বৃদ্ধার সংখ্যা কম নয়, বৃদ্ধ বৃদ্ধারা কনসার্ট শুনতে শুনতে যৌবন ফিরে পাচ্ছিল যেন, এক একটি পর্বের পর তাঁদের কি উল্লাস, করতালি।
খবরিয়ার কথা:
সারাদিন লকডাউনের ভিতর ঘর থেকে বেরতে ভয় পাচ্ছি। পড়া আর এই দিনলিপি সংগ্রহ করা নিয়ে সকাল থেকে বিকেল, সন্ধ্যা… লকডাউন নিয়ে তরুণ বন্ধু দেবব্রত শ্যামরায় লিখছেন বিপন্ন শ্রমিকদের কথা যারা দিল্লি থেকে রাজ্যের পথে, গ্রামের পথে হাঁটা শুরু করেছেন। শত শত মাইল। ট্রেন, বাস বন্ধ, এদের কাজ বন্ধ, খাওয়ার জোগাড় নেই, সুতরাং গাঁও চল। হায়রে ভারতবর্ষ, ভিনদেশ থেকে বিমানে করে ধনীদের ফেরালে তুমি, এদের রেখে দিলে খোলা আকাশের নিচে। এরাই তো গড়েছে সব, নয়ডা, গুরুগ্রাম…সব।
দেশের রাজধানী ও প্রধান শহরগুলি থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল হেঁটে চলেছে দেহাতের দিকে। এই মুহূর্তে গাজীপুর ফ্লাইওভারের ওপর প্রায় লক্ষ লোকের লাইন। হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকেরা উত্তরপ্রদেশ- বিহারে নিজেদের গ্রামে ফিরতে চাইছেন। যে শহরে বাস করে, দিনের পর দিন সস্তা শ্রম দিয়ে তারা বাড়িঘর, সেতু, শপিং মল ও হাসপাতাল তৈরি করেছেন, সেই শহরে তাঁদের জন্য কোনও খাবার নেই। ২৪ বছরের চন্দ্রমোহন, কলের মিস্ত্রি, ১৭ জন সমগোত্রীয় বন্ধুকে নিয়ে দিল্লি থেকে ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া শুরু করলেন। ট্রেন নেই, গাড়িঘোড়া নেই, এই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটেই পেরোনোর জন্য তারা তৈরি৷ “আমি হয়তো করোনায় মরব না, কিন্তু অনাহারে নিশ্চয়ই মারা যাব। তার আগে যে করে হোক নিজের গ্রামে পৌঁছতে হবে আমাকে।” ওয়াশিংটন পোস্ট লিখছে, পায়ে হেঁটে এত বিপুল মানুষের সরণ উপমহাদেশ শেষ দেখেছে আজ থেকে বাহাত্তর বছর আগে, ১৯৪৭ সালে।
খবরিয়ার অশ্রুপাত:
ওরে আমার বাল্যকাল, আমার সেই খবর লিখন। ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ সংবাদ মূলত মহাভারতের যুদ্ধ শেষের ধ্বংস আর মৃত্যুর বিবরণ। সংবাদ এক অভ্যাস, যে অভ্যাস খুঁজে নিয়ে আসে মরণের দিনলিপি। আমি এখন পেনসিল আর কাগজ পরিত্যাগ করি কীভাবে ? আক্রান্ত কমল কি কমল না, টিভি দেখতেও ভয় করছে। নির্বাচনের ফলের সময় টিভিতে যেমন জয় পরাজয়ের হিশেব ক্রমাগত পার হয়ে যেত, এখন আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। আক্রান্তের ইতিহাস জানা যাচ্ছে এখনো, অর্থাৎ বিদেশযোগ। তার মানে সামাজিক সংক্রমণ হয়নি। মৃত্যু একটি দুটি। এভাবেই নাকি হয়। প্রথমে পাটিগণিতের যোগের হিশেব। পরে বীজগণিতের গুণিতক হিশেব। প্রথমে ২, ৪, ৬,৮…, পরে ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২…, তারপরে ২,৪, ১৬, ২৫৬…। ভয়ের ভিতরে না ডুবে আমি বরং স্থিতধী মানুষের কথা শুনি। দেশের অবস্থা কী? আমরা কি ইওরোপের পথে চলেছি? আমাদের ম্যালেরিয়া অতীত গেল কোথায় ? লকডাউন কমিয়ে দেবে না কি ভাইরাসের দাপট ?
অমিতাভ প্রামানিক বাঙ্গালুরু থেকে লিখছেন,
সন্ধেবেলা অবধি আশায় আশায় ছিলাম, আজ মনে হয় থমকে যাবে। তখনও মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৬৭। সাধারণভাবে সংখ্যা ফট করে বেড়ে যায় দশটা নাগাদ, সম্ভবত বিভিন্ন ল্যাব থেকে পজিটিভ টেস্টের এক ব্যাচ রেজাল্ট ঐ সময় হাতে আসে। সাড়ে নটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে একলাফে সংখ্যা বেড়ে হাজার ছাড়িয়ে গেল। এই মুহূর্তে ১০২২। আজকেই পজিটিভ ১৩৬।
… লকডাউনের এফেক্ট জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই সবে সাড়ে পঁচানব্বই ঘন্টা গেল। এখনও যারা করোনা-পজিটিভ বেরোচ্ছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই লকডাউনের আগেই ইনফেক্টেড হয়েছেন।
চব্বিশ তারিখে, যেদিন লকডাউন ঘোষিত হয়, সেদিন ও তার আগে পাব্লিশ-হওয়া বিভিন্ন জায়গার এপিডেমিওলজিস্টদের কিছু মডেল স্টাডিজ পড়ে জানলাম, কী ভয়াবহ প্রেডিকশন তারা করেছেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল স্টাডিজের গবেষক রাজেশ সিং-এর মডেল অনুযায়ী নব্বই কোটি ভারতীয় কোভিড নাইন্টিনে আক্রান্ত হতে চলেছে। অন্য একজনের হিসাব একটু নরম, মাত্র আঠারো কোটি! অর্থাৎ অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে জিনিসটা সম্পূর্ণ হাতে বাইরে বেরিয়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই।
তবে ইওরোপে অবস্থা সম্ভবত সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গেছে, এবার হয়ত ক্রমে ক্রমে সংখ্যাটা নামতে থাকবে। আমেরিকাতে আজ নতুন রোগী অবিশ্বাস্যভাবে কম। আশা করা যাক, এরা সকলেই নিজেদের সামলে নিতে পারবে খুব দ্রুত।
সেটা ভারতের পক্ষে খুব প্রয়োজনও। অনেক কিছুর জন্যেই আমরা এদের ওপর মুখাপেক্ষী। ওষুধ হোক বা টিকা, খুব সম্ভবত এদের কারও গবেষণাগার থেকেই আসবে। আর আসবে এমার্জেন্সির সময় করণীয় মূল্যবান উপদেশ ও সাহায্যও।
আমাদের কী হবে? আশায় থাকতে হবে ঐ দরিদ্র-নিরন্ন-গৃহহীনরা এখনও অন্তত এই রোগে আক্রান্ত হয়নি এবং যেভাবে পারা যাক, ওদের সাহায্য করতে হবে। তিন, পরিস্থিতি যাই হোক, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। চার, কোনোভাবেই নিজে অসুস্থ হয়ে পড়া চলবে না এবং বাড়ির অন্য কেউ যেন অসুস্থ না হয়, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। পাঁচ, আমরা এক দরিদ্র দেশের সন্তান, এটা বুঝেই যথাসম্ভব ব্যবস্থা করতে হবে। আগেও লিখেছিলাম, আমাদের টাকাপয়সা কম থাকতে পারে, জ্ঞানগম্যি কম থাকতে পারে, মানবিকতায় যেন আমরা কখনোই হেরে না যাই, সেটা স্থাপন করার এই হচ্ছে সুযোগ।
পেনসিলে যা লিখেছিলাম:
মাল্যবান, জলপাইহাটি, বাসমতীর উপাখ্যান লেখা হয়েছিল পেনসিলে। আফসার আমেদ কপি করে আনত ন্যাশানাল লাইব্রেরি থেকে। ভাইরাস আক্রান্ত দিনে মানুষের কথা মানুষ লিখে যাচ্ছেন পেনসিলেই। কোনটি থাকবে, কোনটি আবার ভেসে উঠে আমার কাছে চলে আসবে দু’বছর বাদে, আমি জানি না। কিন্তু পেনসিলে লেখা উপন্যাস একটিও হারায়নি যেমন, পেনসিলে লেখা শোকের বিবরণ মুছে যাবে না। আশাদীপও নিভে যাবে না। মানুষই তো লিখছে মানুষের কথা। মানুষ বলছে সবই তোমার উদ্দেশে লেখা। তুমি আমার কথা শোনো। খবরিয়া তুমি জান, তুমি শোনো। খবরিয়া তোমাকে জানাচ্ছি, তুমি খবরটি দিও। এমন অসুখ পৃথিবীতে আসে কত, মানুষ মরেছে যেমন মানুষ বেঁচেছেও। ভয় পেও না খবরিয়া। তুমি ভয় পেলে খবর নিয়ে ঢোল সহরত করবে কে? এমনিতে অতি প্রত্যুষে খবরিয়ার নিদ্রা ভাঙে। তখন বাইরে অন্ধকার। কাকও ডাকে না। কী করবে সে? অন্তরজালে দূর পৃথিবীর খবর নেয়। বাংলাদেশ, ইওরোপ, আমেরিকা। ভোরে হোয়াটস আপ কল করে নিউইয়র্কের খবর নেয়, লস এঞ্জেলসের খবর নেয়। আর তাকে পাঠান অনেক খবর পড়তে থাকে। তার দেশের খবরও পায়। ঘুম ভেঙে গেলে খবরিয়া দেখল অচেনা এক অদিতি সরকার তাঁর মায়ের কথা লিখেছেন। খবরিয়া আর এক মহামারি, অতিমারির কথা শোনো। ৬৩ বছর আগের কথা। হয়ত তুমি মশারির ভিতরে বসে খবর লেখা শুরু করেছিলে তখন। এই খবর পাওনি। এখন দিলাম তোমাকে।
অন্য এক অতিমারির কাহিনি শুরু করি। ১৯৫৭-র ১১-ই মে কুনুরে ভারত সরকারের ইনফ্লুয়েঞ্জা সেন্টারে খবর এসেছিল এশিয়ান ফ্লুর। জাপান ও মালয়েশিয়া হয়ে মারণ জ্বর এশিয়ান ফ্লু ভারতে এসে গেল প্রায়। এই রোগেরও সূত্র চিন দেশ। গুইজু প্রদেশ। হাঁস থেকে উৎপত্তি এই ভাইরাসের। চিন থেকে রওনা হয়ে ফেব্রুয়ারিতে সে সিঙ্গাপুর পৌঁছয়। তারপর এপ্রিল মাসে হংকং। যে শহরে পা রাখছিল এশিয়ান ফ্লু, মানুষ মারছিল এক নাগাড়ে। এবার সে এসে পড়ল এদেশে। ৯-ই মে ১৬২২ জন যাত্রী এবং ২০০ জন ক্রু নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে যে জাহাজ যাত্রা করেছিল দক্ষিণ ভারতের নেগাপত্তম বন্দরের উদ্দেশে, ৭ দিনের ভিতর তার ২৫০ যাত্রী জ্বরে আক্রান্ত হয়, আর টি মেসেজে সেই খবর এলে জাহাজকে নেগাপত্তমে না এসে মাদ্রাজ বন্দরে যেতে বলা হয়। ১৬-ই মে সকালে জাহাজ মাদ্রাজে এসে পৌঁছয়। জাহাজটিকে সমুদ্রের ভিতর কোয়ারান্টাইনে রাখা হয় কেন না জাহাজে চুয়াল্লিশজন জ্বরে ভুগছিল, কুনুর থেকে একটি মেডিক্যাল টিমকে টিমকে রোগীদের চিকিৎসার জন্য ও লালা রসের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য জাহাজে পাঠানো হয়। চারদিন বাদে কয়েকজন সেবিকার শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করে…যেভাবে কোভিড ছড়িয়েছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে, সেই ভাবেই। অক্টোবরে শুরু হয়েছিল সংক্রমণ, এরপর জানুয়ারিতে উত্তর চিন, ফেব্রুয়ারিতে সাংহাই, এপ্রিলে হংকং, এবং মে মাসের মাঝামাঝিতে মাদ্রাজে দেখা দিল এশিয়ান ফ্লু… রোগ দ্রুত ছড়িয়ে যেতে থাকে পৃথিবীর অনেক দেশে।
শুনতে শুনতে জয়িত্রী বলল, আমাদের নদী পথে এসেছিল কি এশিয়ান ফ্লু?
আমি ভারতের কথা বলছি। তোমার দেশের কথা আমার কাছে নেই। তবে অতিমারি হিশেবে ঘোষণা করা এই জ্বর তোমার দেশে এসেও থাকবে, না আসতেও পারে, কোভিড-১৯ যখন আসেনি, এশিয়ান ফ্লু না আসতেই পারে।
জয়িত্রী একেবারেই নিঝুম হয়ে গেল। স্পন্দনহীন। নিঃশ্বাসও যেন পড়ছে না তার। বাতাসও যেন নিচ্ছে না সে। তখন মার্কো এক সদ্য বিবাহিত তরুণীর কথা বললেন। তার সঙ্গে যেন মার্কোর দেখা হয়েছিল খিদিরপুর হেস্টিংসের মেরিন হাউসে। তার নাম কল্যানী। তার স্বামীর নাম বিজনকুমার দত্ত। কল্যানী থাকত সোদপুরে। মে মাসের শেষ। মধ্য জৈষ্ঠ। পচা গরম। রোদের তেজও খুব। সোদপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদা, সেখান থেকে বাসে খিদিরপুর হেস্টিংস। গঙ্গার ধারে মেরিন হাউসে তার অফিস। অফিসে পৌঁছনই ছিল কষ্টের। পরিবেশ ভালো। এলাকাটিও নিস্তব্ধ। কিন্তু অনেক দূর যে। সে অন্য চাকরি খুঁজছিল। পায়নি, হয়ত পেয়েই যেত, ইন্টারভিউ দিয়ে আসছিল। কিন্তু তার ভিতরেই সেই চিনা জ্বর, এশিয়ান ফ্লু তাকে ধরে নিল। বড়ই ছোঁয়াচে সেই জ্বর। মেরিন হাউসে সারাদিন জাহাজিরা আসে, দেশি এবং বিদেশি। তারাই সংক্রামিত করেছিল তাকে। সেদিন সে অন্য এক অফিসের লাউঞ্জে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে বসে ছিল। বসেই ছিল। কাঁপিয়ে জ্বর এল। সেই অবস্থায় কী করে শিয়ালদা, সেখান থেকে ট্রেনে সোদপুর তা আর জানতে পারেনি কল্যানী। কিন্তু ধুম জ্বর নিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছতে পেরেছিল।
তুমি এত কথা জানলে কী করে মার্কো? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করে।
তখন আমি ওই শহরে, শিয়ালদা স্টেশনের কথা বলি শোনো জয়িত্রী, তখনো পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু আসা অব্যহত ছিল, শিয়ালদার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ ছিল, বরিশাল এক্সপ্রেস খুলনা অবধি যেত, সবুজ রং ছিল সেই ট্রেনের। আমি ভারত ভাগ দেখেছি, কল্যানীর বাবা মা তাকে নিয়ে ফরিদপুর থেকে এদেশে এসেছিলেন, কল্যানীর স্বামী বিজনের পরিবার এসেছিল ময়মনসিংহ, ভৈরববাজার থেকে। উদ্বাস্তু পরিবার। কাজের জন্য মেয়েরা তখন ঘরের বাইরে বেরিয়েছে। দেশভাগ এই করেছিল। শিয়ালদা থেকে কল্যানীকে আমি আগলে রেখেছিলাম। বুঝেছিলাম এই কন্যাটিকে বাড়ি অবধি দিয়ে আসতেই হবে, এশিয়ান ফ্লু ধরেছে একে। পৌঁছে দিয়েছিলাম, না হলে কানা জাদুকর তাকে কব্জা করে ফেলত।
কানা জাদুকর কে? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করে।
তাতার দেশের কানা জাদুকর, যে মৃত্যুর গন্ধ পেলেই হাজির হয়, তার কথা পরে শুনবে, আগে সেই কল্যানীর কথা শোনো, গা দিয়ে আগুন ছুটছিল সেই রোগা পাতলা মেয়েটির, বাড়ি গিয়ে আছড়ে পড়ল, কানা জাদুকর তাকে ধরেই নিত পথের ভিতর, পারেনি, আমি ছিলাম, তারপরের কুড়িটি দিনের কথা তার জীবন থেকে মুছে গেছে। পরে শুনেছিল তার নাকি এশিয়ান ফ্লু হয়েছিল। হাসপাতাল নিতে চায়নি, বলেছিল বাড়িতেই আইসোলেশনে রেখে সেবা করতে, না হলে হাসপাতালের অন্য রোগীরাও সংক্রামিত হয়ে যাবে। তার বাড়িতে তখন বলতে গেলে তার স্বামী বিজন। ভাসুর ছিলেন আর্মির ক্যাপ্টেন, ঝাঁসির কাছে বাবিনা বলে এক সেনাছাউনিতে পোস্টেড। তাঁর স্ত্রীর প্রথম সন্তান সম্ভাবনা, শ্বশুর শাশুড়ি গেছেন সেখানে। দেওরের তখনও বিয়ে হয়নি। কানা জাদুকর তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, বিজন তার সঙ্গে যেন যুদ্ধ করল কুড়িটি দিন। জাদুকর প্রায় নিয়েই নিয়েছিল তাকে, ষোল দিনের মাথায় তার জীবন স্পন্দন প্রায় থেমেই গিয়েছিল যেন, কিন্তু শেষ অবধি বিজনের প্রতিজ্ঞা আর চিকিৎসকের পরামর্শ হারিয়ে দিল মৃত্যু দূতকে। কোরামিন ইঞ্জেকশন দিয়ে স্পন্দন ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। জয়িত্রী আমার বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল কন্যাটির উপর। আমি সেই বাড়িটির উল্টোদিকে বসে থাকতাম। এক একবার তাদের বাড়ির ভিতরেও চলে যেতাম। জাদুকর আমাকে দেখে কুঁকড়ে যেত, আমি তার আসল চেহারাটি ৭০০ বছর আগে তাতার সম্রাটের সামনে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে তার পিছনে আমি আছি, আমার পিছনে সে আছে। কল্যানী বেঁচে গিয়েছিল ভালোবাসার জোরে। ভালোবাসার সঙ্গে কানা জাদুকরের চিরকালের বিরোধ।
দু’ দিন পর চোখ খুলে জড়ানো গলায় কল্যানী প্রথম কথা বলেছিল, লুচি খাব।
***
এরও দু বছর পর মেয়েটা মেয়ে থেকে মা হয়েছিল। অদিতির মা। মেরিন হাউসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল কল্যানী। অন্য এক অফিসে ঢুকেছিল। সেদিন তার বয়স ছিল ২৫, আজ ৮৮।
অদিতি বলছে, “সেদিন তারুণ্যের যে শক্তি দিয়ে লড়াইটা থেকে জিতে ফিরেছিল মা, আজ চাইলেও যে আর সেই শক্তিকে জোটাতে পারবে না শরীরে। করোনা ভাইরাস, হাত জোড় করি তোমায়, পায়ে পড়ি। ফিরে যাও, ফিরে যাও।”
# #
মানুষ গৃহবন্দী হয়ে তার কথা লিখে যাচ্ছে। লিখবেই তো। লিখতে পারা এখন বলতে পারা। বলতে পারলে অনেক চাপ কমে যায়। মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। যে যতই বলুক, মানুষ এক স্বার্থপর প্রজাতি। সভ্যতার এই বিপুল সমৃদ্ধি মানুষকে আরো স্বার্থপর করেছে। কিন্তু তাইই সব নয়। স্পানিশ ভাষাবিদ জয়া কুণ্ডু গত রাতে কী লিখে গেছেন আমার জন্য, তা পড়ে দেখছি আধো-অন্ধকারে। কোথায় বারসিলোনা, মাদ্রিদ, জয়া খুব উদ্বেগে আছেন আটলান্টিকের উপকূলের জন্য।
জয়া কুণ্ডু ২৮-০৩
স্প্যানিশ ডেইলি পড়ছিলাম। উফফ শুধু আতঙ্ক। দেশটা বিধ্বস্ত পুরো। ৭২২৪৮ জন সংক্রামিত, মারা গেছে৫৭০৪, আর তারমধ্যে শুধু আজ সারাদিনে ৮৩২ জন।
স্পেনের সাইজ আমাদের পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের এক খাবলা নিলেই শেষ। ওইটুকুতে এত পরিসংখ্যান। সমানে নিউজে বলে যাচ্ছে Quedate en la casa. Es obligatorio. বারবার এক কথা। বাড়ি থাকা ছাড়া আর কিছু রেমেডি নেই। কদিন আগে ফোন করেছিলাম বার্সিলোনায়। বন্ধু বলল- এখানে তো Jaleo হয়ে গেছে। মানে সোজা কথায় তাণ্ডব লেগে গেছে।
আর আমাদের দেশে কী অবস্থা? সাইট খুলে বুঝতেই পারছি না কতজন এফেক্টেড? 918 জন সংক্রামিত আর 19 জন মৃত আজ পর্যন্ত। এই তথ্য বিশ্বাস যোগ্য মনে হয় আপনার? ভারতের সাইজ স্পেনের কত গুণ? জনসংখ্যা কত গুণ? দেখলাম আজ প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেচেন আয়ুশ প্র্যাক্টিশনারদের সঙ্গে মানে আয়ুর্বেদ, যোগা, ইউনানি, হেকিমি ইত্যাদি যারা করে। এই হচ্ছে ভারতের মত মিনি মহাদেশের কর্ণধারের প্রচেষ্টা।
আমরা বাঁচলে বাঁচব এমনিতেই, দৈব কৃপায় বাঁচব। মরতে পারব না বলেই বাঁচব। নইলে…
এর ভিতরেই কাটোয়ার জপমালার কথা কানে এল। কবিতা লেখে। কথা বলতে ভালোবাসে। আনন্দে থাকতে চায়। সে যেন ডাকছে, দাদা, দাদা, আমার কথা শোনো, দাদা, আমি কেমন ভাবে বেঁচে আছি, দাদা, আমিও তোমাদের কথা শোনার জন্য ভালো থাকতে চাই…
জপমালা ঘোষরায়।
“৩/৪ মাস হল অসুস্থতার কারণে খুব একটা কাজ করতে পারিনা। ওষুধ কিনতে রাস্তায় বেরোলে বুকে চাপ লাগে পড়ে যেতে যেতে সামলাই, পথচারীরা বাঁচান। এখন তো সব কাজ করতে হচ্ছে। ১০০০ স্ক্যোয়ারফিট দোতলা বাড়ির স্যানিটেশন বজায় রাখতে গিয়ে কখনো ঘরের মেঝেয় বা সিঁড়ির চাতালে ঝাঁটা বা ঘর মোছা লাঠি নিয়েই শুয়ে পড়ছি। একটু সুস্থ হলে আবার উঠছি। কখনো বিছানার চাদর কাচতে গিয়ে বাথরুমের জলের মধ্যেই শুয়ে পড়ছি। এমনিতে অন্যান্য প্রবলেম আগের চেয়ে কম কিন্তু হার্টে একটু সমস্যা হচ্ছে কিছুই করার নেই। করতেও হবে। যতটা পারি। কিন্তু ভয় ভয় করছে। এগুলো বলার কথা নয়। তাও বললাম। কাকেই বা বলবো। অদ্ভুত আঁধার…’’.
অ্যানড্রয়েড ফোন খবরের উৎস:
দেশ-বিদেশ থেকে আতঙ্কের খবর ভেসে আসছিল। কত ভয়ের কথা। আমেরিকায় কত বন্ধু। নিজের কন্যা, জামাতা, ছ-বছরের ঝিলমিল আছে শারলট সিটিতে। ওদের জন্য উদ্বেগে আছি। কত রকম ভাবনা হয়। মানুষের মন। মন কেন আছে মানুষের? অন্য প্রাণী কি স্মৃতিকাতর হয়? যে বাঘিনীর সন্তান মাকে ছেড়ে জঙ্গলে কোথায় চলে গেছে, সেই বাঘিনীর কি সন্তানটির কথা মনে পড়ে ? তার প্রাণ সংশয় হয়নি তো। সে ভালো আছে তো। শিকারীর বন্দুকের গুলি তাকে বিদ্ধ করেনি তো? বাঘিনী কি এইসব উদ্বেগ নিয়ে কাতর হয়ে থাকে, নিদ্রা হতে পারে তার? বাঘ তো সন্তানের খোঁজই রাখে না। আমরা বন্যজীবন পার করেছি কত সহস্র বছর। কিন্তু নগরে গড়েছি কৃত্রিম বন। তবু মানুষ এখনো বাঘ হয়ে ওঠেনি। বাঘিনীও হয়নি কোনো মা। বুড়ি হয়ে যাওয়া মা, তার মধ্যবয়সী পুত্র কন্যার জন্য কাতর হয়ে থাকে, শিলিগুড়িতে বসে মা বারবার ডাক দেয় কলকাতায় আটকা পড়া মেয়েকে।
শারলট সিটিতে লকডাউন চলছে। ঘরে বসে কাজ। খাদ্য অনলাইন অর্ডার করলে চলে আসছে। উত্তর ক্যারোলাইনা রাজ্যের ছোট্ট শহর শারলট সিটি। ঐ শহরে আমি গিয়েছিলাম এই সময়েই। ২০১৮ সালের ২৮ কিংবা ২৯শে মার্চ। মিশিগান থেকে সড়কপথে ৭৫০ মাইল। সব মিলিয়ে ২১-২২ ঘন্টা লেগেছিল। এখন আমি আইডাহো শহরবাসী অনামিকার কথা শুনি। সে মেরীকে নিয়ে কী লিখেছে স্যোসাল সাইটে তা দেখে নিই।
নিউইয়র্কের মেরী হালদার। আমাদের মেরী বৌদি। নিউইয়র্কের ফ্লাশিং হসপিটালের ল্যাবে কর্তব্যরত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট।
এ মূহুর্তে নিউইয়র্ক কোভিড-১৯ এর এপিসেন্টার, জানেন আপনারা। আজ একটু আগে আক্রান্ত সংখ্যা ৩৭,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। সারা আমেরিকায় মোট আক্রান্তের প্রায় অর্দ্ধেক। এই আতঙ্কের ভরকেন্দ্রে থেকেও নিজেকে ঘরবন্দী রাখতে পারেননি মেরী হালদার। তার ল্যাবে রক্তের নমুনা পরীক্ষার কাজ চলছে নিরলস । করোনা আক্রান্ত রোগীদের এই রক্ত দেওয়া হবে। প্রতি মূহুর্তে আতঙ্ক ও ভয়কে তুচ্ছ করে হাজার হাজার রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে চলেছেন তিনি ও তার সহকর্মীরা, আমাদের প্রিয় শহরটিকে আবার সপ্রাণ সারিয়ে তুলবেন বলে। এবং ভুলে যাবেননা- যথেষ্ঠ PPE ( Personal Protective Equipments) কিন্তু নেই তাদের কাছে। আমেরিকার মত বিত্তশালী দেশেও সম্ভব হচ্ছেনা প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য পি পি ই বরাদ্দ করা। মেরী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তার স্বভাব মত, অভিযোগ-হীন হাসিটি নিয়েই। নিউইয়র্ক আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার হৈরৈ করে তার রাস্তা ভরে উঠবে লক্ষ মানুষের পদচারণায়। মেরীদের জন্যই তা’ হতে পারবে। এই বাঙালিনী’র জন্য আমরা গর্বিত ।
আমি অনামিকার পোস্টে লিখলাম, মেরী দিদির গৃহে জামাইকা কুইনস সিটিতে ন’দিন ছিলাম ২০১৮-তে। তখন ওখানে ভালো শীত তবে চেরি প্রস্ফূটন শুরু হয়েছে, মেরী দিদি জিন্দাবাদ।
অনামিকা সামাজিক মানুষ। অধ্যাপনা করেন আইডাহো বিশ্ববিদ্যালয়ে, অনামিকা সাহসী। তার আর একটি লেখা আমাকে সাহস জুগিয়েছে।
অনামিকা আবার বললেন,
ইনি জাস্টিন। আমার পাড়ার বার্বার। আমার ছেলে থেকে, পাড়ার মার্ক দাদু, সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা শাফি, সেনেটরের বাড়ির সদস্য, ইস্কুলের সাফাই কর্মী মারিয়া- সবাই এর কাছেই চুল, দাড়ি কাটেন, ছাঁটেন। কত গল্প , সুখ-দুঃখের কথা চলে আমাদের জাস্টিনের সাথে। কত উইকেন্ড, মন্থর দুপুরবেলা আমাদের পাড়ার পি এন পি সি- তে কেটেছে। কার বেড়াল অসভ্য, অন্যের ব্যাক-ইয়ার্ডে ঢুকে পড়ে; কে বাড়ির লন মো করছেনা, পোকা হচ্ছে- সব খবর জাস্টিনের দোকানে বসে ফ্রী পেয়ে যাবেন। জাস্টিনের চারটি বাচ্চা।আজ প্রায় পনেরোদিন ওর দোকান বন্ধ। তাই আমরা ঠিক করেছি, ওকে সবাই আমাদের মাসিক পেমেন্ট-টা করে আসবো। চালু রাখবো ওর রোজগার, যতটা সম্ভব। জাস্টিন আর তার বাচ্চারা সব হিসেব রাখছে। কার খাতে কত ঢুকছে। পৃথিবী সুস্থ হলে আমাদের পরিষেবা দিয়ে ফিরিয়ে দেবে। পুঁজিবাদী দেশের সাধারন মানুষের বেঁচে থাকার গপ্পো বল্লাম। আপনারাও বলুন।
এসব হলো অনন্ত অন্ধকারের ভিতরে এক বিন্দু আলো। কিন্তু এতে সাময়িক স্বস্তি। আসল ঘটনা তো গভীর হৃদয়বিদারী, আর যখন তা ঘটছে ঐ দেশে, সেই সময় সেই প্রকৃতি আমার চেনা। এই সময়েই ছিলাম আমি ঐ দেশে, ঠিক এই সময়ে দু’বছর আগে। পরে তা বলছি…।
যে ভয় লুকিয়ে রাখি:
সকাল ৬টায় বেরিয়েছি সওদা করতে। বেলগাছিয়া মোড়ে চলে গেছি পাঁউরুটি বিস্কুটের সন্ধানে। ওপারে খুব বড় মুসলমান বস্তি। গরিব মানুষের বাস। বড়লোকরা এদিকে ফ্ল্যাট কিনে, মস্ত প্রাসাদ হাঁকিয়ে চলে এসেছেন প্রায় অচ্ছুৎ গরিবের বসতি ছেড়ে। রাস্তার ওপারে মসজিদ হয়েছে একটি। আগে ছিল না। এই বস্তিতেই থাকে আমাদের রুকসানা মাসি। বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায় সারাদিন। আমার স্ত্রী মিতালি বলেছে, ১ তারিখে এসে বেতন নিয়ে যেও মাসি। যখন আসতে বলব, তখন এস। তোমার কাজ যাবে না। ছুটিতে থাক। কী দেখলাম, রুকসানা মাসি, তেলচিটে শালোয়ার কামিজ, লাল উড়নি নিয়ে বস্তির গলিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে। ছোটখাটো বছর চল্লিশের নারী। রোগা। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে, চোখ কোটরে ঢুকে আছে, প্লাস্টিকের চটি ফটফট করতে করতে ওড়নায় মুখ চাপা দিয়ে রাস্তা পার হয়ে এসে আমাকে দেখে দাঁড়াল, বেরিয়েছ দাদা, কী কিনবে, ডিম, মাংস, মাছ, টাকা দাও, আমি কিনে দিয়ে আসছি।
আহা না মাসি, তুমি কোথায় যাচ্ছ? তফাতে সরে জিজ্ঞেস করলাম।
কাজ সারতে, সবাই তো ছুটি দেয়নি দাদা, তুমি কেন দিলে, বউদির কত কষ্ট হচ্ছে, তুমি তো কিছু কর না, শুধু লিখ। বলল রুকসানা অভিযোগের সুরে।
এখন ঘরে থাকতে হবে মাসি, তুমি ওদের বলো। আমি দূরত্ব বজায় রেখে বললাম।
না, ছুটি করলে বেতন দিবে না, বেতন না দিলে চলবে কী করে ? বলে রুকসানা চলল তার কাজের বাড়ি। আমি বিস্কুটের দোকানের সামনে। চতুর দোকানির খুব ফুর্তি। একদিনেই দোকান খালি হয়ে গেছে। সব জিনিশের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। নিলে নাও, না নিলে নিও না। রুটি আসছে না। যা আছে সব সস্তার বিস্কুট। অনামী কোম্পানির বিস্কুট। আমাকে বলল, নিয়ে নিন নিয়ে নিন, এরপর এসবও মিলবে না, কোল ডিং আছে, নিয়ে যান, পরে পাবেন না, আইসক্রিম আছে, পাবেন না পরে। বলতে বলতে তফাতে দাঁড়িয়েই দোকানি লম্বা এক হাঁচি বের করল নাকের দুই ছিদ্র থেকে। হেঁচে দিল, ভয়ে সরে গেছি। মাস্কে ঢেকে আছি নাক মুখ, তবু বিরক্তি প্রকাশ করলাম। বললাম সব আইসক্রিম তুমি খাও, জান না মুখে চাপা দিয়ে হাঁচতে হয়?
সে দাঁত বের করে হাসল, বলল, কুছু হোবে না বাবু, সব ফালতু, দুদিনে সব মিটে যাবে, মুসলিম বস্তির দিকে যাবে না, সব হবে সেখানে, গন্ধি আদমি আছে।
লোকটার কথায় সত্যি আতঙ্কিত হলাম। কী বলছে ও? মহামারি এইভাবেই আসে নাকি আমি জানি না। শুনেছি মহামারি এসেছে ১০০ বছর বাদে। ভাইরাস মাঝে মধ্যে এদেশ ওদেশে আসে, মানুষ মেরে চলে যায় দ্রুত। এই ভাইরাসও তাই যাবে মনে হয়। আমার কোনো ধারণাই নেই। বিশেষজ্ঞদের এক একজনের মত এক একরকম। যাঁরা আশাব্যঞ্জক কিছু বলছেন, তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছে। ভরসা হচ্ছে তাঁদের কথায়। তবে সবে তো এদেশে এসেছে। ক’দিন গেলে বোঝা যাবে। দুকানিয়া যুবক কিন্তু খুব আহ্লাদিত হয়েছে। কয়েকদিনেই সে খুব লাভ করেছে। এমন চললে তাকে আর দেখে কে?
এক বৃদ্ধের মুখ ঢাকা কাপড়ে। খুকখুক করে কাশছিলেন। তিনি বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা, দুদিন আগে তাঁর রিকশায় আমি চাল আটা ইত্যাদি নিয়ে গেছি, অনেক উপদেশ দিয়েছি, অভয় দিয়েছি, সতর্ক করেছি। আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কিন্তু এই কাশি তো স্বাভাবিক কাশি। বিড়ি ফেলেছেন তিনি সুখটান দিয়ে এই তো এখনই। কিন্তু আতঙ্ক ছাড়ছিল না। দ্রুত সরে এলাম। পাউরুটিবিক্রেতা ভ্যান থেকে রুটি নামাচ্ছিল তার গুমটিতে। তার কাছে দীর্ঘদিন রুটি নিই। আজ রুটি নেব বলতে সে ঘাড়ের কাছে এসে কথা বলতে লাগল, কেন ৫টাকা বেশি লাগবে। ভয় করতে লাগল। সরে দাঁড়ালাম। ভয় করতে লাগল খুব। এই ভয় আমাকে জড়িয়েই আছে।
কবি, বন্ধু মৃদুল দাশগুপ্ত যা বলেছিল, তা সত্যিই। আমি ভীরু। আমাদের দেশে কত মানুষ, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা আমাদের হবে কী করে? সেই জায়গাই নেই। এখন রাস্তায় গাড়িঘোড়া নেই, তাই দূরে দূরে দাঁড়াতে পারছি। সব্জিওয়ালা, ডিমওয়ালারা, ফলবিক্রেতারা তাদের ঝাঁপি খুলছে। সরকারের রুই মাছ আসছে, তা বিক্রি শুরু হবে, গোটা নিতে হবে, ১৫০ টাকা প্রতি কিলো। তার ব্যবস্থা করছে যারা, সংখ্যা অন্তত জনা আট, সকলেই নিঃশঙ্কচিত্ত, সকলের মুখে কাপড়ের পট্টি মাস্ক। তা খুলে কথা বলছে। বাজার বসার আয়োজন হচ্ছে। চায়ের দোকান চালায় যে রুগ্ন মেয়েটি সে এর ভিতরে চা করে ফেলেছে। থালায় করে চা বিস্কুট নিয়ে যাচ্ছে সব্জিওয়ালাদের জন্য। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কাকু চা খাবেন। মাথা নাড়লাম। বস্তির যে ছেলেটি ছোটবেলায় আমার সঙ্গে টালা পার্কে খেলত, এখন বহুদিন ভয়ানক বৃদ্ধ, হাড় ছাড়া শরীরে কিছু নেই, চোখ দুটি ঢুকে আছে আঁখি-কোটরে, পা টেনে টেনে হাঁটে, বুকের খাচা নড়বড়ে, চাপ দিলেই যেন পাটকাঠির মতো পটপট করে ভেঙে যাবে, বাংলা মদ খেয়ে খেয়ে, নাকি না খেয়ে খেয়ে এমন অবস্থা, কোন কারখানায় কাজ করত, এখন বাজারই তাকে খেতে দেয়। এর ওর ফাই-ফরমাস খাটে, কোনো বাবু, যে ছিল তার বাল্যকালের খেলার সাথী, তাকে দিয়ে বাজার পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। সে কোনো ক্রমে বয়ে নিয়ে যায়। দিয়ে এসে পাঁচ টাকা পায় হয়ত, তাকে দেখে মনে হয় যে কোনোদিন মরে যেতে পারে, এই রকম মনে হচ্ছে অনেকদিন, তা প্রায় বছর কয়েক ধরে, কিন্তু সে আছে, বেরিয়ে এসেছে বাজারের পিছনের বস্তি থেকে, চা খাবে। মেয়েটি তাকে বলল, বস বেঞ্চিতে, আসছি দিয়ে। সে আমাকে দেখে হাসল। সত্যিই হাসল। বহু বছর বাদে আমার সঙ্গে কথা বলল, খুব ভয় লেগেছে গো, সত্যি অমন হবে, সবাই বাড়ির ভিতরে থাকবে আর কুকুর বেড়াল, শালিক চড়ুই রাস্তায় থাকবে, আকাশে উড়বে?
আমি কতকাল বাদে তার কথায় দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছি, কী নাম যেন, ঘুঘু, কঞ্চি… মনে পড়ছে না। খুব চতুর, বুদ্ধিমান ছিল কম বয়সে, বাজারে এসে সব্জি, ডিম, ফল, আম, কলা, আপেল ইত্যাদি গেঁড়াতে ওস্তাদ ছিল, কলা, বেগুন, মুলো পটাপট তুলে নিয়ে নিজের থলেতে ভরে দিত। হাসলাম সেসব কথা মনে করে, বললাম, সাবধানে থেক।
তুমিও সাবধানে থেক, আমার কিছু হবে না, চা খাবে বাবুজি? সে আমার ছেলেবেলার নামটি মনে রেখেছে। আমি তার নাম ভুলে গেছি। ঘুঘু, কঞ্চির বাইরে একটা নাম ছিল, ভুলে গেছি, মাথা নেড়ে বললাম, তুমিই খাও।
আচ্ছা, কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনে, বলবে ? ভাঙা গলায় সে বলল।
ঘর থেকে একদম বেরবে না।
এতো মোদি বলছে, মমতা বলছে, টিভিতে বলছে, তুমি কী বলছ? ঘুঘু বলল।
আমিও ওই কথা বলছি।
তা’লে আর নতুন কী বললে, আমার কিছু হবে না। সে চায়ে চুমুক দিল আয়েশ করে।
না, কাজ না থাকলে বাড়ি যাও। আমি বোঝাতে চাইলাম, ঘরে বসে থাক।
আবে, আমার ঘর তো ঘরই না, একটা ঘর, বউ, দুই মেয়ে, ভাগ্নি এসে জুটেছে, ঘরেই রান্না, বউ লোকের বাড়ি কাজ করে, এখন তারা নিচ্ছে না, মায়না দেবে কি না জানি না, শালা মাক্কি চোষ, মায়না না দিলে উপোস, ঘুমোনোর সময় ছাড়া ঘরে থাকিনে, ঘরে থাকলে মরে যাব, তুমি একদিন দেখে এস। সে বলল, আমার ঘর আছে যে ঘরে যাব? নেড়ি কুত্তার মতো সারাদিন বাইরে থাকি।
কী বলব, চুপ করে আছি।
কুকুর বেড়ালের হচ্ছে না তো? সে জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়লাম, বললাম, মানুষ থেকে মানুষে চলে যাচ্ছে, ছোঁয়াচে খুব।
দুর, আমি আবার মানুষ নাকি, নেড়ি কুত্তাকে বিস্কুট খাওয়ায় দেখেছ, আমাকে তাও দেয় না, হবে না, নেড়ি কুত্তার হবে, আমার হবে না। বলে সে তার টিংটিঙে পা নাচাতে লাগল, ওসব তোমাদের রোগ, বাড়ি যাও তুমি। বলে বিড়ি বের করল বুক পকেট থেকে, বিড়িতে আগুন দিল দেশলাই জ্বালিয়ে, ধোঁয়া উড়িয়ে দিল, বলল, ঘর থেকে বেরবে না, ঝামেলা যাক, একদিন দেখতে এস আমার ঘর, বুঝবে।
আমি চললাম। দুই থলেতে ভর্তি খাদ্য। ডিম, চিকেন, মাছ, রুটি সব্জি। এখনো কলা, পাতিলেবু নেওয়া হয়নি। ঘুঘু আমার পেটমোটা থলে দেখছিল, বলল, অনেক বাজার… । আমি এগোই। আর দাঁড়ান যায় না।
বাজারের কলাওয়ালা ঠাকুরও গড়ে সিজিনে সিজিনে। বলল, অন্নপূর্ণা ঠাকুরের কত বায়না ছিল দাদা, সব ক্যানসিল হয়ে গেছে, ১লা বৈশাখের গণেশ ঠাকুরের সব অর্ডার গেল…।
আমাদের বেলগাছিয়া বাজার লম্বায় দুশো মিটার হবে। তিন কোণা পার্ক থেকে বেলগাছিয়া মোড় অবধি ফুটপাথ ধরে। মাছের বাজার ভিতরে। সরকারি মাছ অবশ্য ফুটপাথে তক্তা পেতে বিক্রি হচ্ছে। বাজারের যাঁরা রাজারহাট, লাউহাটি থেকে আসেন সব্জি নিয়ে তাঁরা আসতে পারছেন না। কিন্তু স্থানীয় বিক্রেতারা আছেন। সব্জি মিনি ট্রাক নিয়ে আসছে। সবই মিলছে। দর বেশি নয়। ডিম করোনার আগে ১০টাকা জোড়া ছিল, এখন ১১ টাকা জোড়া। বলল আনা নেওয়ার খরচ বেড়েছে। সাবধানে ঘুরে ঘুরে বাজার দেখছি। কিনছি। দুধের সাপ্লাই যথেষ্ট। আলু পিঁয়াজ সব আছে। মনে পড়ল প্রথম সেই ২২ তারিখের লক ডাউনের দিন সন্ধ্যায় ডিম আলু কিনতে বেরিয়েছিলাম। কী ভীড়। রটে যাচ্ছিল কিছুই মিলবে না। কত কষ্ট করে ডিম আলু পিঁয়াজ সংগ্রহ করেছিলাম আতঙ্কিত হয়ে। ক’দিন আগের সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। আমার পাশে সেই আলো আঁধারির ভিতর কিনছিলেন তিনি, যার মুখে দুবার অপারেশন হয়েছিল ক্যানসারের কারণে। মুখ আঁচলে ঢেকে তিনি বাজার করছিলেন আরো আতঙ্কিত হয়ে।
আতঙ্কিত হয়ে আছে, ক্ষুব্ধ হয়ে আছে কত মানুষ। ক’দিনের গৃহবাসেই বিরক্ত, ক্ষিপ্ত। কাজে না গেলে বেতন মিলবে না। ভয় হয়েছে মানসের। সে আমাকে তার ভয়ের কথা বলতে লাগল। কাপড়ের দোকানে কাজ করে। বিনা বেতনে চলবে কীভাবে ? ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে লেখক বন্ধু অলোক গোস্বামী। সিগারেটের নেশা তার। কদিন ধরে একটিও পায়নি। একজন ধরিয়েছিল তার সামনে হাউজিঙের ভিতর, অলোক বলেছিল, দাম দিয়ে নেবে। তিনি দেননি। তাঁর লাগবে। সে ফোনে বলল, এই অবস্থা কদিন চলতে পারে, পারে না, আপনি ফেসবুকে অত ভয়ের কথা লিখবেন না, সাহিত্যের কথা লিখুন…। অলোক কী লিখেছে ২৯.০৩ তারিখে…।
অলোক গোস্বামী ২৯.০৩
কি চাইছেন? এই ভয়াবহ সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাওয়া মানুষ মানসিক অসুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুক? আমার অন্ততঃ তেমনই মনে হচ্ছে। কারণ এই গৃহবন্দী পরিবেশ কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। সুস্থ মানুষের এমন অভ্যেস কোনদিনই ছিল না। হয় মেনে নাও অথবা মরো, পরিস্থিতিটা যেহেতু এমনই তাই বাধ্য হচ্ছে মেনে নিতে। কিন্তু কতদিন? উত্তর নেই। তবুও কি সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে? উত্তর নেই। রোগজনিত কারণে মৃত্যু এবং খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে মৃত্যুর ভেতরে কি কোনো পার্থক্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না, আপনি দেবেন কারণ পথেঘাটে বাঘ সিংহ ছেড়ে দেয়া, সেনা, পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করার পক্ষে আপনি। না, আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। কারণ বিশ্বের চিত্রটা দেখে আতঙ্কিত আপনি। কোনটা আপনার পক্ষে মঙ্গলকর হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। অর্থাৎ এ লেখার প্রথম লাইনে ফিরে যান, নিজেই সিম্পটমগুলো টের পেয়ে যাবেন।
আপনাকে ঘাবড়ে দিতে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করা যাক। সমগ্র দেশবাসীকে চিকিৎসা দেয়ার মতো পরিকাঠামো কি আমাদের রয়েছে? ন্যায্য দামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাবার অধিকারকে মান্যতা দেয়ার মতো সদিচ্ছা কি সরকারের আছে? ঘরে বসে জিনিসপত্র পেয়ে যাবার মতো নেটওয়ার্ক চালু করা কি অত সোজা? বিশেষকরে মহানগরগুলোতে যখন সে ধরণের সার্ভিস দেয়ার লোক গ্রামাঞ্চল থেকে আমদানি করতে হয়?
এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলি, ভিনরাজ্য থেকে রওনা দেয়া শ্রমিকের ভিড় দেখে এই যে আপনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন, কখনও নিজেকে ওদের জায়গায় বসিয়ে ভেবেছেন? অতদূর ভাবতে হবে না, কখনও দূরপাল্লার ট্রেনে সফর করতে গিয়ে বন্ধের সম্মুখীন হয়েছেন? জল নেই, খাবার নেই, কেউ আপনার খোঁজ খবর নিতে আসছে না, ট্রেন কখন চালু হবে জানা নেই? এবং পাশাপাশি এটাও জুড়ে নিন যে আপনার পকেটও প্রায় শূন্য?
যদি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়ে থাকেন তাহলে জাস্ট কল্পনা করে নিন, দেখবেন করোনা এফেক্ট চালু হয়ে গিয়েছে আপনার ভেতরে।
একটা ব্যাপারে আমিও কিন্তু আপনার সঙ্গে একমত। সরকার কেন এই মানুষগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে ঘরে ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিচ্ছে না?
আমাদের এই ঐকমত্যের কারণ আমিও তো আপনার মতোই মানসিক বিশৃঙ্খলার শিকার। নাহলে সরকারের কাছে এমন দায়িত্ববোধ আশা করি? বিশেষ করে পৃথিবী জুড়ে বিপর্যয়ের খবর পেয়ে যাবার পরও যে সরকার মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য লক ডাউন চালু করে এবং প্রহর পেরনো মাত্র শঙ্খ উলুধ্বনি কাঁসর সহ দলে দলে মানুষকে পথে নেমে পড়তে উৎসাহিত করে?
কিংবা যদি আরও খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে ভাবি, দলে দলে মানুষকে দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য ঘর সংসার ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হয় কেন? সেই রাজ্য যদি সংস্থান জুটিয়ে দিতে পারে তাহলে স্বরাজ্য পারে না কেন?
এতদূর যদি পড়ে থাকেন তাহলে অবধারিত ভাবেই আপনার মনে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কী চাইছি আমি? লক ডাউন ভাঙতে?
একদম নয়। আমি আত্মহত্যা প্রেমী নই। এমন কী কাউকে খুন করার কথা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। আমিও আপনার মতোই সপরিবারে, সবান্ধবে, সুস্থ সমাজে বেঁচে থাকতে চাই। পাশাপাশি এটাও মানি যে সমাজ মানেই সব ধরণের লোকের বসবাস, খুনী, ধর্ষক, আত্মহত্যাবাদী, অপরের বেঁচে থাকার ইচ্ছায় কাঁটা দেয়া মানুষ, সব ধরণের।
সুতরাং বলি কী, ঘরে থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নেট কিংবা টিভি মারফত জেনে নিন সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন। অহেতুক আতঙ্কিত হবেন না এবং সেই আতঙ্ক অপরের ওপরে উগরে দেবেন না। Mass Hysteria ও কিন্তু কম ভয়াবহ নয়!
করোনার সংক্রমণ ক্ষমতা অসীম হলেও মারণ ক্ষমতা কিন্তু ততটা নয় যেমনটা কিনা অন্য অনেক ভাইরাসের রয়েছে।
আসুন হাসাহাসি করি। সরকারের কাজ সরকারকেই করতে চাপ দেই। এবং সেটা অবশ্যই মানুষ পেটানোর উপদেশ নয়।
আগামী পৃথিবী কালকে দুভাবে চিহ্ণিত করবে, AC- after corona, BC- before corona।
আসুন, মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা নিয়ে BC থেকে AC তে প্রবেশ করি।
# #
হ্যাঁ, করোনার কালে প্রবেশ করেছি আমরা। করোনার আগে যে জীবন ছিল, তা থেকে এই জীবন আলাদা। করোনা মুক্ত পৃথিবী কেমন হবে, জানি না।
তবুও সংবাদ মূলত আতঙ্ক:
খবর আসছিল পরপর। খবরিয়া আমি একা নই। যে যে খবরটি পেয়েছে সে সেই খবরটি ছড়িয়ে দিচ্ছে। খবর ছিল পাঞ্জাব নিয়ে, সে এক ভয়ানক ভয়ের খবর। ভয় থেকে বেরিয়ে আসব সে উপায় নেই। ভয় যে সব বোধ, চিন্তা-ভাবনা অসাড় করে দেয়।
ইতালি, জার্মানি ঘুরে পঞ্চনদের তীরে পৌঁছেছিলেন শিখ ধর্মগুরু। তখন করোনার বীজ তার ভিতরে বাসা বেঁধে ছিল। প্রশাসনের নিষেধ উপেক্ষা করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্মীয় প্রচার শুরু করেন তিনি। কয়েক দিন পর ওই ধর্ম গুরু অসুস্থ হয়ে মারা যান। পরীক্ষায় তাঁর শরীরে করোনা পজিটিভ সংক্রমণ ধরা পড়ে। কিন্তু ততদিনে তিনি প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সংস্পর্শে চলে এসেছিলেন! ফলে তাঁর শরীর থেকেই বিপুল সংখ্যক মানুষের শরীরে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে পঞ্জাবের বাঙ্গা জেলায়। আপাতত ১৫টি গ্রামকে নজরবন্দি করে রেখেছে প্রশাসন। সেই গ্রামগুলির প্রতিটি বাসিন্দারই করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রশাসনের কর্তারা।
যে ধর্মীয় গুরু এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁর নাম বলদেব সিং। প্রশাসনের আশঙ্কা যদি শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়, তাহলে এটিই হবে দেশের সবথেকে বড় গোষ্ঠী সংক্রমণের ঘটনা।
কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এখন অনেক শান্ত। তিনি প্রথমে স্বেচ্ছা অন্তরীনের বিপক্ষে বলেছিলেন আমাকে, পরে টের পেয়েছেন এই সময় মোটেই ভালো নয়, কিন্তু অন্তরীনের দিনগুলি থেকে ভয় সরিয়ে রাখতে মৃদুল সময়কে নিজের মতো বেঁধে রাখতে চাইছেন।
২৯.০৩.২০
“ভয়ে ত্রাসে দমবন্ধ পৃথিবীর এককোণে এই টংয়ের ঘরে অন্তরীণ দশার অখণ্ড অবসরে নিজের প্রকাশিতব্য কবিতাগ্রন্থটির পাণ্ডুলিপিটি সাজিয়ে ফেললাম। এই দুঃসময়েই ঝুলি খুলে দেখলাম ‘আগুনের অবাক ফোয়ারা’ নাম্নী গ্রন্থটির ১০০ কবিতা রচনার বছর দশকের কসম আমি পূর্ণ করতে পেরেছি। শতাধিক লিখে ফেলেছি। মনে প্রশান্তি এলো।
তবু হাজার হাজার মানুষ এখন ঘরে ফেরার জন্য হাইওয়ে ধরে শত শত মাইল পার হয়ে যাচ্ছে। আমি গৃহবাসী। আমার গত দশবছরের প্রচেষ্টা তার এক কণাও তুল্য নয়। তবু কী করে জানি না,আগামী পৃথিবীর উদ্বেগ এই বইটিতে জড়িয়ে রয়েছে।
সবাই ভালো থাকুন। এ নাস্তিক সকলের মঙ্গল চাইছে।”
# #
আমি ঘুরছি দুয়ারে দুয়ারে। কে কেমন আছে এই দুঃখের দিনগুলিতে। এই ভয়ের দিনগুলিতে। কবির কাছেই যেতে হয় আবার। মৃদুলের কথা শান্ত করেছে আমাকে। যশোধরা কী বলছেন, কবি যশোধরা রায়চৌধুরী কী লিখলেন ২৯.০৩ তারিখে…
“ ভয়ানক একটা ঘোর সময়ের ভেতর আমরা ঢুকে পড়ছি।
মাথা ঠিক রাখা প্রায় অসম্ভব হচ্ছে। ব্যক্তিগত পরিসর থেকে স্থানীয়, রাজ্যের এবং দেশের, আর সারা বিশ্বের, এই হেন পরিস্থিতি কোনদিন দেখব ভাবিনি ত।
বন্ধুদের ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা মায়েদের কেমো নেওয়া বন্ধ। মাঠে মাঠে ফসল পচে যাচ্ছে। অসংখ্য পরিবার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। বহু শহরে আটকে যাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষ প্রায় সর্বস্বান্ত। আবার শুনলাম ৮০-৯০ লাখ খরচ করে বিদেশ থেকে প্রাইভেট জেট নিয়ে এসেছে ধনীপুত্রপুত্রীদের।
হ্যাঁ আমরা ইতিহাসের সাক্ষী অবশ্যই। শুধু সেটা ভাবার আত্মগৌরব নিয়ে ই থাকলে পারলে ভাল হত।
এখনো মাথার ওপর ছাত আছে এই বিশাল প্রিভিলেজের জন্য প্রায় অনুশোচনা বোধ করছি আজ৷ অগুনতি মানুষের কোন আশ্রয় নেই আজ৷
শুনতে পাচ্ছ তোমরা, তোমাদের বধিরতা পেরিয়ে এখনো কি ঢুকছে না মানুষের কান্না, দেশের কান্না?”
# #
আমি ঢুকে যাব কি ভয়ের কৃষ্ণগহ্বরে ? সমস্ত সত্য, সমস্ত সুন্দর গ্রাস করে নেয় এই গহ্বর। টেনে নিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। আমি টেলিভিশনে দেখলাম আলো মাখানো সংবাদ। খবরিয়া পেনসিলিয়া লিখল,
প্রথম আক্রান্ত সুস্থতার পথে। তার দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে বলে জানা যায়নি। এক বৃদ্ধের হয়েছে, তার স্ত্রী পুত্রের হয়নি। এসবই আশার আলো। এই যে এত মানুষ ঘরে ফিরবে বলে দিল্লির বাস টার্মিনালে জমা হয়েছেন, এদের বিমান ভ্রমণের ইতিহাস নেই। এদের আছে মাইলর পর মাইল পায়ে হাঁটার অভ্যাস। এদের কাছাকাছি বাবুরা যান না, এদের সংক্রমণ হবে না। হে ভারতবর্ষ, এরাই তোমার প্রাণ। এরাই শক্তি। এদের কাজ গেছে। তাই পেটে ভাত নেই। এদের ভাত রুটি চাই। এরা না হলে আমরা পরজীবী মানুষ বাঁচব না। মনে করুন চাযাবাদ নেই, গমের ক্ষেত শূন্য, মনে করুন রেস্তোরাঁয় পরিচারক নেই, বারে ওয়েটার নেই, আমার জীবন চলবে? চলবে কাগজ পৌঁছে দেওয়ার হকার না থাকলে, সব্জি ডিম বিক্রেতা না থাকলে? কফি হাউসের বেয়ারা না থাকলে মজলিশ হবে? জন্মদিনের পার্টি হবে এদের ছাড়া। মুড়ি, চিড়ে না ভাজলে খাব কী? এদের জন্য আগে ভাবতে হবে। সরকার এই মানুষের পাশে দাঁড়ান। তিন মাস ই এম আই দিতে হবে না ঋণের। এদের জন্য কী প্যাকেজ? আছে। তা যেন ও পি এল, বাবু বি পি এল সেজে খেয়ে না নেয়। ত্রাণ এলে স্থানীয় বাবুরা ফুলেফেঁপে যান। তা যেন না হয়। ঐ যে সন্তান কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছেন ভারত জননী, ওঁকে গ্রামে পৌঁছে দিন। উনি অভুক্ত। ওঁর ঘরে খাদ্য দিন। যদি ভুল বলে থাকি মার্জনা করবেন।
আমার কেমন মনে হচ্ছিল এই জনতার কিছু হবে না। এরা সংক্রামিত হবে না। এদের দায়িত্ববোধ অনেক বেশি, এদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি। কে ঘর করেন, কারা মারি নিয়ে ঘর করেন ? না, আমরা নই। আমরা সুখে থাকি। গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়েই সারা বছর ভাবিত থাকি। থাকি বহুতলে, থাকি ক্ষমতার গজদন্ত মিনারে বসে, মারি নিয়ে ঘর করেন তাঁরা যারা শত শত মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। চেন্নাই থেকে ফিরেছিল যারা তাদের কাহিনি বলি।
অনেক পথ পার করে তারা বরাভূম স্টেশনে নেমেছিল। তারপর হেঁটে গ্রামের পথে। বাড়িতে কি আলাদা ঘর আছে যে কোয়ারান্টিনে যাবে ? গাঁয়ের মানুষই তাদের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাছের উপর খাটিয়া বেঁধে মশারী টাঙিয়ে দিয়ে তাদের বলল, ঐভাবে চোদ্দ দিন অশৌচ পালন কর। তারা তাইই থাকল। বুঝুন গ্রামের মানুষের সচেতনতা। তারা জেনেছে এই রোগ প্রথমে লুকিয়ে থাকে, বসন্ত রোগের মতো একটু একটু করে ফুটে উঠতে থাকে। তখন ছোঁয়াছুঁয়ি হলে ছড়িয়ে যাবে। বলছি, এঁরা অক্সফোরডে পড়েন না, এঁরা সুইৎজারল্যান্ড থাকেন না, এদের বাবারা ডাক্তার নন, ব্যবসায়ী নন, কিন্তু এঁরা জেনেছেন কী করতে হবে। একা হয়ে থাকতে হবে চোদ্দদিন। বাড়িতে মৃত্যু মানে বাড়ি দূষিত হয়েছে, মৃত্যুর বীজানু রয়েছে ঘরবাড়ি, মৃতের বিছানা মাদুরে। সুতরাং বাড়ি বীজানু মুক্ত করতে হয়, মৃতের বিছানা পুড়িয়ে ফেলতে হয়, শ্মশান থেকে ফিরলে নিমপাতা।লোহা, আগুনে শুদ্ধ হতে হয়। চোদ্দ দিন অশৌচ পালন মানে কোয়ারান্টিনেই থাকা। এসব আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় আচার। পক্স হলেও, অমনি বারো দিন পরে নিম পাতা হলুদ দিয়ে স্নান, এই আচার তো সেই কোয়ারান্টিন থেকে মুক্ত হওয়া। সেই শ্রমিকরা বাড়ি না গিয়ে গাছে বাঁধা খাটিয়ার উপরে থেকে কোয়ারান্টিন অশৌচ পালন করতে লাগলেন। হাটেও গেলেন না, বাজারেও না। বুক বাজিয়ে বললেন না, খড়্গপুর থেকে আসা হলো বটে। পুরুলিয়া জেলার খবর এই। কদিন বাদে বিডিও জানতে পেরে অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। মারি নিয়ে ঘর করেও এই ভাবে বেঁচে থাকে গাঁয়ের মানুষ। এই জনগোষ্ঠীর অসামান্য সমাজবোধ। এই শিক্ষা আমাদের মধ্যে নেই।
শুনতে শুনতে জয়িত্রী বলে, এমন কি সত্যিই হয়েছিল ?
হয়েছিল।
তুমি দেখেছিলে ?
দেখেছিলাম, সেই বরাভূমের মাটি রক্তাভ, ভূমি উচ্চাবচ, পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, কিন্তু ফসল হয় কম, কাজ নেই, লোকের খুব প্রাণ শক্তি, পেটের ভাতের জন্য মানুষ দূর দেশে যায়, সেখানে কাজ বন্ধ হলে তারা নিজভূমে ফিরেছিল, সেই বিবরণই দিলাম জয়িত্রী।
কবির কাজ:
কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য জার্মান কবি কার্ল ক্রোলোর একটি কবিতা অনুবাদ করেছেন অন্তরীন কালে, তা শোনো জয়িত্রী…
বোঝা
যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি
আগামীকাল
সেখানেই একটা কবর খোঁড়া
হতে পারে
অথবা একটা বিরাট গর্ত
যার শুরু শেষ নেই
তুমি তার মধ্যে তলিয়ে যেতে পারো
যা তুমি বুকের ভিতর নিচ্ছ
আগামীকাল
তা হয়ে উঠতে পারে মৃত্যু
তোমায় ফানুসের মতো
টেনে ছুঁড়ে দিতে পারে
কসাইখানায়
তুমি কিছুই জানো না
বেঁচে থাকাটাই কত স্বীকৃতি
বেঁচে থাকাটাই কত পুরস্কার
বেঁচে থাকাটাই কত সম্মান
কারণ মৃত্যু মানে
একটা দলাপাকানো
পচা
মাংসপিণ্ড ছাড়া
আর কিছু না
তোমার জুতোর নীচে
যেমন থেঁৎলে পড়ে থাকে
একটি আরশোলা
বেঁচে থাক, চুমু খাও,
কিছু একটা লেখ
পৃথিবীর শেষ মানুষের মতো
আনন্দে।
জয়িত্রী বলল, থাক আমার ভয় করছে, কেন ভয় করছে মার্কো?
তোমার শহর নিরুপদ্রবে আছে, ভয় কেন তোমার ?
জয়িত্রী বলল, জানি না, বলতে পারব না।
খবরিয়ার খবর
সন্ধ্যায় দাদা ফোন করেছিলেন। দৈবপাখি নাটকটি ২৮শে মার্চ মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। হলো না। ৮১ পার হয়ে গেছেন। অনেকদিন পায়ের সমস্যায় ভুগেছেন। বেরোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বছর দেড়। তারপর এই নাটক নিয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। নাটকের মানুষের নাটক ছাড়া আর ফেরা হবে কীভাবে ? নাটকটি অনেক পরিমার্জন করেছেন। আমি পড়েছি। সক্রেটিস এই নাটকের প্রধান চরিত্র। আমার কাছে দুঃখ করছিলেন, রিহার্সাল খুব ভালো হয়েছিল, ২৮ তারিখের শো খুব ভালো হত, আবার সব নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। কবে হবে তা আমার কাছে জানতে চাইলেন। যেন আমি সব জানি। আমি বললেই হয়ে যাবে। বয়স হলে নির্ভরতা দরকার হয়। আমি খবরিয়া। কত খবর রাখি। আমাকে ফোন করে পরামর্শ নেন। খোঁজ নেন দেজ পাবলিশিঙের অপু কিংবা করুণা প্রকাশনীর বামাবাবু কেমন আছেন। সকলে ঘরে থাকছে তো? খোঁজ নিলেন আমরা কেমন আছি। চাল ডাল, আলু, ডিম ঘরে আছে তো? আমি বললাম তুমি ইউ টিউবে পুরোন ছবি দেখতে পার। দাদা বললেন, ইন্টারনেট আছে, কিন্তু ওসব পারি না। এই বয়সে তা আর সম্ভব নয়। ও বাড়িতে যাঁরা থাকেন সকলে বৃদ্ধ। কেউ ইন্টারনেটের ব্যবহার জানেন না। দাদার হোয়াটস আপ করা অ্যানড্রয়েড ফোনটিও নষ্ট হয়ে গেছে এই সময়। আমি জানি রোদ ওঠার আগে এবং রোদ পড়লে তিনি বসে থাকেন ব্যালকনিতে। সামনে একটি নিমগাছ। একটি কেরল দেশীয় নারকেল গাছ। বাড়ির পিছনে হিমসাগর আমের গাছ। গাছে বৌল এসেছে। তার গন্ধ বাড়িটিকে ঘিরে আছে। এই সুগন্ধ কি ভাইরাস আটকাতে পারবে ? শুনতে পাচ্ছেন দূষণ নেই। আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে। বাতাসে ধূলিকণা কম। হৃদযন্ত্রে একবার বাইপাস এবং স্টেইন বসেছে আর একবার। বাইপাস হয়েছিল ২০০৩ সালে। স্টেইন ২০১০ নাগাদ। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনতে পাচ্ছি উত্তর মেরুর হিমবাহ গলন থেমে গেছে।
হ্যাঁ, আমি হোয়াটস আপে পেলাম।
দাদা জিজ্ঞেস করলেন, শুনতে পাচ্ছি ভেনিসের ক্যানেলে হাঁসেরা ফিরে এসেছে?
হুঁ, কে যেন বলল, উটি থেকে কোয়েম্বাটোরের রাস্তায় হরিণ বসে আছে, ফেসবুকে দেখা গেছে।
আমাকেও ফোন করে বলল একজন, আমার অ্যানড্রয়েড ফোনটা নেই, আমি হোয়াটস আপে এসব পেলাম না, আকাশ বাতাস দুশো বছর আগের মতো হয়ে যাচ্ছে?
হতে পারে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখন অনেক দূর দেখা যাবে?
যাবে বলতে দাদা বললেন, আমার ব্যালকনি থেকে অনেক দূর দেখা যাচ্ছে মনে হয়, আগে যা দেখতে পেতাম না, তা…।
৮১ বছর পেরিয়ে ৮২-তে পা দেওয়া অভিনেতা, নাট্যকার, দার্শনিক বসে আছেন তাঁর ব্যালকনিতে। তিনি তাকিয়ে আছেন বহুদূরে। আকাশ বাতাস পরিষ্কার হয়ে গেছে। সীমান্তের অদৃশ্য দেওয়াল সরে গেছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন সব। ঐদিক পুব। তাঁর জন্মভূমি। ঐ দিক পুব, তাঁর ছেলেবেলা…সাতক্ষীরে, ধূলিহর, বেত্রবতী, কপোতাক্ষ, ময়মনসিংহ, কালিহাতি, ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোণা, গারোপাহাড়…সব ফিরে আসছে তার কাছে। আহা, এই জীবনে এমনও দেখা যায়। বাংলাদেশ মনে পড়তে লাগল। খুলনা, রূপসা, ১৯৪৭, লঞ্চঘাটে হারিয়ে গিয়েছিল রঙিন ছাতা।
সবই সত্য, কিংবা কল্পনা, বিপন্ন সময়কে একটু সদর্থক ভাবা উজ্জীবিত হওয়া। দৈবপাখি কবে হবে? সিনেমা থিয়েটারে কবে আবার লোক ভীড় করবে ? করবে করবে। মানুষ আবার ছন্দে ফিরবে। মানুষ কি পাশাপাশি বসে আবার থিয়েটার দেখবে ? সিনেমা না হয় ঘরে বসে ইউটিউব থেকে নানা অ্যাপ থেকে দেখা যায়, কিন্তু থিয়েটার? ৫২ বছর বয়সে সেক্সপীয়র অজানা জ্বরে মারা যান। বুবোনিক প্লেগ লন্ডন শহরকে ছেয়ে ফেললে ক্রমান্বয়ে ৬০ মাস থিয়েটার হল বন্ধ ছিল। সেক্সপীয়র তখন রীতিমত সক্রিয় এবং সৃজনশীলতার শীর্ষে। ১৬০৩ থেকে ১৬০৯ অবধি এই ঘটনা ঘটেছিল। তখন অভিনেতা, নির্দেশকদের কোনো কাজ ছিল না। প্রায় নাটক থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন সেক্সপীয়র। মহামারি তো এমনিই হয়। ইওরোপ মহামারিতে মরেছে কতবার। মহাবীর আলেকজান্ডার অজানা জ্বরেই মারা গিয়েছিলেন। দাদাকে ডাকলাম, সেক্সপীয়রের কথা বললাম।
দাদা বললেন, জানি, গেল বছর আবার সেক্সপীয়রের বাড়ি অ্যাভন নদীর তীরে স্ট্যাটফোরড গিয়েছিলাম। সেক্সপিরিয়ান থিয়েটার ওরা যত্ন করে রক্ষা করছে। থিয়েটার শেষ হলে এক জায়গায় ঢুকে বড় বড় অভিনেতারা সকলে মদ্যপান করতেন। অন্ধকার একটা ঘর। আগে যেমন ছিল, তেমনিই রেখেছে। ওরা ওদের ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে চায়। সেই অ্যাভন নদীর পাড় বাঁধানো। জলে বড় বড় কানাডিয়ান হাঁস চরছে। সব মনে পড়ছে। পৃথিবীটা এখন রিপেয়ারিং হচ্ছে। দ্যাখ মনে হচ্ছে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ দেখা যাবে আর কদিন পর। অ্যাভন নদীর হাঁসগুলিকে দেখা যাবে। আমাদের থিয়েটার কবে হবে জানি না।
হ্যাঁ বাংলাদেশের খবর এল। কবি এবং উপন্যাস লিখিয়ে ভাস্কর চৌধুরীর গলা বুঁজে এল বোনের কথা বলতে বলতে। বোন করোনা কিংবা নিমোনিয়ায় মারা গেছেন চাঁপাই নবাবগঞ্জে। তিনদিন আগের ঘটনা। ভাস্করের বোনের মৃত্যু সংবাদ আমি দেখেছিলাম। ভাস্কর শেষ দেখা দেখতে যেতে পারেনি। সব কিছু বন্ধ, সর্বগ্রাসী আতঙ্ক একেবারে ঝড়ের মেঘের মতো ব্যপ্ত হয়ে চতুর্দিক অন্ধকার করে দিয়েছে। যেতে চেয়েছিল চাঁপাই নবাব গঞ্জ। চাঁপাই নবাবগঞ্জে ঐতিহাসিক বড় সোনা মসজিদ। আমের সময় বড় বাজার হয়। আম আর আম।তার বোনের শ্বশুরবাড়ির মস্ত আম বাগান, আমের বৌল এসে গেছে। বোন ক’দিন আগে ফোন করেছিল, তখন সে ভালো ছিল। বলেছিল, ভাই, এবার আম খুব ভালো হবে, জামাই বলেছে, যদি নষ্ট না হয় ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে, তবে বাম্পার ফলন। সিজিন গেলে গাড়ি আনবে ইন্ডিয়ার মালদা থেকে, তখন তুমারে গাড়ি পাঠায়ে নিয়ে আসব। ভাই আম তো আম, আমের বৌলে কী গন্ধ ছড়ায়, আমাদের ওদিকেও ছড়ায়, কিন্তু এতটা নারে ভাই, রাজশাহী বলো, নাটোর বলো, এমন গন্ধ নাই কুথাও।
তারপর কী হলো? জ্বর এল। জ্বরের ভিতরে একদিন ফোন করল হাসিমন, ভাইরে, কী হলো আমার, জ্বরে পুড়তেছি, সেই আমের বৌলের গন্ধ উধাও হয়ে গেছে, কোনো গন্ধ নাই, কোন ডাকিনি এল রে ভাই। ভাস্কর যেতে চেয়েছিল খুব করে। কোনো গাড়িই রাজি হলো না।
বোন বলতে লাগল, গন্ধ নাইরে ভাই, গন্ধ ফিরুক, আসিস, আমের সময় আসিস, আর এক-দেড় মাস। সেই শেষ কথা, আমের বৌলের গন্ধ হারিয়ে হাসিমন চলে গেল। করোনা টেস্ট হয়নি। ভাস্কর একটি শোকগাথা লিখেছে। তার একটু অংশ…
১
আমার আত্মার কসম
আমি এ লাশ
ফেলতে পারবো না।
এ লাশ আমার বোন ছিলো
অনেক বছর
এ লাশ আমার ভাই ছিল
অনেক বছর
এ লাশ
আমার পড়শী ছিলো
আশি টা বছর
আমি এ লাশ ফেলতে পারবো না
আমি বসে আছি
গায়ে জ্বর
কেউ কেউ চলে গেছে
আমি আছি
আমিও লাশ হবো
এ লাশের সাথে যোগ হবো
এম্বুলেন্স আসলে যাবো
না এলেও যাবো
সকলেই গেল
এ শহর ফাঁকা করে
অন্য কোথাও দালান উঠবে
এখানে মরে গেলে
হাসপাতাল হবে
বাড়ির উঠোন ভরে
কচি ঘাস হবে
লাশের সারে বেড়ে যাবে দ্রুত
তখন হাসপাতালগুলো
প্যাথলজি করে
লিখে যাবে
সর্দি ছিলো
জ্বর ছিলো
কাশি ছিলো
হাঁপানি
চিনি রোগ ছিলো
হার্টের সমস্যা ছিলো
ওরা সব আদ জাতির মতো
গজবেই মরে গেছে।…
ব্রেইলে লেখা বাক্যগুলি
মার্কো পোলোর গাইড হয়ে জয়িত্রীর লাভ হয়েছে কম না। হাজার হাজার মাইল ঘুরে আসা ভেনিসীয় পর্যটক মার্কোর কাছে যে খবর পেয়ে যাচ্ছে, তা সে পাবে কোথায় ? মেয়রের কথায় জয়িত্রী সব নোট রাখছে। সেযান টাইমস পত্রিকায় লিখবে গুছিয়ে নিয়ে। মেয়র তা বলেছেন। সেযান শহরের মানুষ জেনে নিক পৃথিবীর খবর, অদৃশ্য এক ঘাতক কীভাবে সব স্তব্ধ করে দিয়েছে। খবর দিচ্ছে খবরিয়া মার্কো পোলো যে কিনা লকডাউনের সময় ভেনিসের পথে যাত্রা করে ভেনিস ভেবে সেযান শহরে এসে পৌঁছেছে। মার্কো ভেনিস ভুলে গেছে। ১৭ বছর বয়সে ভেনিস থেকে বাবা নিকোলো পোলো এবং কাকা মেফিও পোলোর সঙ্গে সেই যে বেরিয়েছিল কনস্টান্টিনোপল জেরুজালেম আর্মেনিয়া, জর্জিয়া হয়ে এশিয়ার পথে, তারপর কী হলো মার্কোর মনে নেই। ১২৯৫-এ ২৪ বছর বাদে ভেনিসে ফিরেছিল যখন নিকোলো পোলো, মার্কোও ফিরেছিল তো। ফিরেছিল না ফিরছে সে। ক্রমাগত ফিরেই চলেছে নিজের শহরে অথবা এমন এক শহরে, পৃথিবীর মানুষ বলে তা মার্কোর শহর। মার্কো বলে, ঢাকাও তার শহর, কলকাতাও তার শহর, নিউইয়র্ক, সিডনি, লন্ডন, মাদ্রিদ, ভেনিস, মিলান…তারই শহর। লকডাউনের সময় পরবাসীরা নিজ গৃহে ফিরবে, তাই মার্কোও ফিরছে। দিল্লি, অমৃতসর, লাহোর, করাচি, কাবুল, সমরখন্দ, আস্তানা…। মার্কো জিজ্ঞেস করল, অ্যালেক্স সাড়া দিল?
কবে ফিরতে পারবে জানি না, একা একটা ঘরে বসে আছে, আচমকা বন্ধ হয়ে গেল যাওয়া আসা। জয়িত্রী বিষণ্ণ মুখে কথাটি বলল, লক্ডাউন কবে শেষ হবে মার্কো?
মহামারী চলতে থাকবে, তারই ভিতর মানুষ বেঁচে থাকবে।
গাল ভর্তি দাড়ি, কী অন্ধকার মুখ, ওর শহরের নাম গুয়াইকুল, ইকুয়েডর, সে দেশে ভয়ানক সংক্রমণ হয়েছে, রাস্তায় মৃতদেহ নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পরিবার, সে গুয়াইকুল থেকে দূরে আছে, সেখানে মহাকাশ বিদ্যার জন্য বড় বিদ্যায়তন, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়, রাতে আকাশ দেখার পক্ষে খুবই উপযোগী এই সময়, কিন্তু সব বন্ধ। ছোট শহর। দেড় লক্ষর মতো মানুষের বাস। সে একটা বাঙলোয় একা, বাড়িগুলো ছাড়া ছাড়া, একটা থেকে আর একটার দূরত্ব আছে, কথা হয় না, মানুষের মুখ দেখা যায় না, দূরে এক বৃদ্ধ বৃদ্ধা থাকেন, তাঁরা হাত নাড়েন, কী রকম একা, উফ!
মার্কো বলল, পৃথিবী এক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, মন শান্ত করো, শোনো, অন্য কথা বলি, ঢাকাই কুট্টির রসিকতা, শহরের এক বাবু, চোগা চাপকান, সুরমায় সুশোভিত, সে চায়ের পেয়ালা নিয়ে আয়েশ করে বসেছে চা-কফিখানায়, চা এসেছে সুদৃশ পেয়ালা ভরে, সে দেখল চায়ে ভাসছে এক মরা মাছি, সে চিৎকার করে ডাকল ওয়েটারকে, মাছি কেন চায়ের ভিতর ?
ওয়েটার হেসে বলল, পাঁচ টাকার চায়, মাছি পড়ব না তো কি এরোপ্লেন পড়ব?
এই কথা কেন ? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করল।
মন খারাপ থেকে বের করে আনতে বললাম, ঢাকা অনেক পুরান শহর, ঢাকার মানুষ রসিক, ঢাকায় শুনেছি ৭০০ মসজিদ আছে, হাজার হাজার রিকশা চলে, বাবুরা রিকশায় হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফেরেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশা চাপেন। আগে ছিল ফিটন, তার সঙ্গে জোড়া দুবলা ঘোড়া, এখন তার বদলে রিকশা, কিন্তু নামী দামী গাড়িও কম না, অবশ্য তাদের আগে রিকশা ছোটে, বাসও আছে, ডবল ডেকার, প্যাসেঞ্জাররা বাসে উঠেই কন্ডাকটরকে বিঁধতে আরম্ভ করে, ভাগ্না, গাড়োয়ানকে বলো নিচে নেমে ঠেলতে, গাড়ি আর যায়ই না। কন্ডাক্টর উত্তর দেয়, আরে মামা বস, যে টেকা ভাড়া দিছ, তার চেয়ে বেশি টায়েম ফ্রি দিচ্ছি, এক ভাড়ায় ডবল যাচ্ছ…।
ঢাকার বয়স ৪০০ বছর হবে, পুরোন নাম জাহাঙ্গীর নগর, ঢাকার মসলিন নিতে এক সময় দূর-দূরান্ত থেকে বণিকেরা আসত। ঢাকাই জামদানির সুখ্যাতি পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু এখন সব বন্ধ। গারমেন্টস ফ্যাক্টরির কর্মীরা বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার এসেছে ফিরে। কাজ ছাড়া অন্ন নেই। ভাইরাস আসে আসুক। কত মারবি মার। ঢাকার শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছিলাম ২১শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে, শোনো বাংলাদেশে ভাষার জন্য কী হয়েছিল।
জয়িত্রী জানে। তখন মার্কো ঢাকার মানুষের কথা বলতে লাগলেন। কী শুনেছেন কী দেখেছেন মার্কো তা। ঢাকা শহরের প্রান্তেও এক নদী আছে, বুড়ি গঙ্গা। ঢাকার এক পুরোন শহর আছে, নতুন শহর আছে। নতুন শহরে আকাশচুম্বী বাড়ি দেখতে দেখতে রিকশায় করে পুরান শহরের হাভেলিতে পৌঁছে যেতে পার। মহামারীর কারণে দুই ঢাকাতেই ছুটি চলছে। সব বন্ধ। কোভিড-১৯ এসে গেছে উড়ানে উড়ানে। নিমোনিয়া হয়ে মানুষ মরছে। মরছে আবার বেঁচেও যাচ্ছে।
৩০.০৩ তারিখে ঢাকার এক রাগী কন্যা জান্নাতুম নয়িম প্রীতি লিখল
“আমি কেয়ামতে বিশ্বাস করিনা, কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধে বিশ্বাস করি। আমরা সচেতন মানুষরা আশংকা করছিলাম এক সময় এন্টিবায়োটিক ওষুধে আর কাজ হবেনা, মুড়ির মতো করে এন্টিবায়োটিক লেখা আমাদের ডাক্তাররা থামান নাই। এখন সেইসব ওষুধ খেয়ে রেজিটেন্স পাওয়ার কমানোর পরে আরও শক্তিশালী একটা ফ্লু অর্থাৎ করোনা যখন এল, তখন আমরা হা করে আছি আর হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছি। গত বছর গ্রেটা থানবার্গ যখন বিশ্বনেতাদের বারবার করে দুনিয়ার তাপমাত্রা কমাতে বলল- নোবেল প্রাইজ কমিটিও তারে পাত্তা দিলোনা, নোবেল পাইলেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলি। অথচ আনবিক যুদ্ধ থামানোর চেয়েও, স্পেস শাটল বানানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাপমাত্রা কমানো।
টাইম ম্যাগাজিনের কয়দিন আগেই ইউভাল নোয়া হারারি লিখেছেন- দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংকট মহামারী না, সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে- দুনিয়ার একজন নেতা না থাকা!
দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি বলেছেন গতকাল জানেন? করোনায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি রাখতে পারাই হবে তার কৃতিত্ব!
অথচ সিরিয়ায় শিশুদের ওপর বোমা ফেলা, প্যালেস্টাইনের ওপর ইজরায়েলের আধিপত্য বিস্তার থেকে সৌদি আরবের সাথে জোট বেঁধে কি পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প? বিগত ইরাক যুদ্ধেই বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতো খরচ ছিল?
চীন উইঘুরদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানাতে যে পরিমাণ ব্যয় করেছে, করোনার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার নিউজ রুখতে কী পরিমাণ ব্যয় করেছে?
লক ডাউন দেয়ার কারণ এইটা না যে আপনি লক ডাউন দিয়ে ভাইরাস সংক্রমণ আজীবনের জন্য ঠেকাবেন। লক ডাউনের কারণ এইটা যে সংক্রমণটা ধীর করে দেয়া। … কারণ দুনিয়ায় যে পরিমাণ রোগী এইমুহূর্তে করোনা ভাইরাসের সাথে ফাইট করছেন তাদের অর্ধেকের বেশিকে মেডিক্যাল সাপোর্ট দেয়ার ক্ষমতা দুনিয়ায় কোনো রাষ্ট্রেরই নাই। যেটা আছে সেইটা হচ্ছে নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া আর মেডিকেল সাপোর্ট বানানো। ভ্যাক্সিন বানানো। গবেষণায় টাকা ঢালা।
১৪ শতাব্দীতে ব্ল্যাক ডেথ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, পাশাপাশি চিকেন পক্স, প্লেগ, সার্স, ইয়েলো ফিভার প্রতিটি মহামারীর ইতিহাস এবং গতিপ্রকৃতির একটা রেখা আছে। সারা দুনিয়ার তথ্যভাণ্ডার বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন। ইতিহাস শিক্ষা দেয় মহামারীর ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য বিনিময় না থাকলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া যায়না। চীন যদি এই তথ্যগুলো আরও আগে দিতো তাহলে দুনিয়ার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এইরকম হইতো না।
রিচার্ড প্রেস্টনের ‘ক্রাইসিস ইন দ্যা রেড জোন’ বইতে ইবোলার সংক্রামণ সংক্রান্ত নানান তথ্য আছে, ইবোলা বাদুড় থেকে হইলেও মানবদেহে জেনেটিক রিকম্বিনেশন ঘটায়, ফলে এই মিউটেশানের কারণে আফ্রিকায় মহামারী ছড়িয়ে পড়লেও আফ্রিকান সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তথ্য দিয়েছিল বলেই আমরা সেই আকারের মহামারীর পাল্লায় পড়িনি। এখন আপনি যখন এই লেখা পড়ছেন তখনো করোনা নামক ভাইরাসটি মিউটেশান ঘটাচ্ছে!…।
নেটিভ আমেরিকান একটা প্রবাদ আছে- যখন শেষ গাছটি কেটে ফেলা হবে, শেষ মাছটি খেয়ে ফেলা হবে, শেষ জলাধারটি বিষাক্ত হবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে টাকা খাওয়া যায়না…।
প্রিয় মানুষ, আপনি বুঝতে শিখুন যে প্রকৃতি নিজের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে জানে। আর কতোবার সে প্রতিশোধ নিলে আপনি বুঝবেন যে তার ওপর ছড়ি ঘুরানোর ক্ষমতা আপনার নাই?
সে আপনার কোটি কোটি টাকার ধার ধারেনা। তার ওপর অত্যাচার নির্যাতনের জবাব সে কড়ায় গণ্ডায় দিতে জানে।তারে আপনি ঠ্যাকাবেন কি করে?
# #
হবে কি হবে না জানি না। কী আছে সামনের দিনে জানি না। ক্ষুব্ধ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য প্যারাসাইট ছবি দেখে প্রশ্ন তুলেছেন,
কে বেশি বিপজ্জনক ভাইরাস না দারিদ্র?
কে বেশি বিপজ্জনক, প্যারাসাইট না সাবওয়ের নীচে থাকা মানুষের গায়ের গন্ধ?
আসলে কারা পরজীবী? কারা ভাইরাস? কারা সংক্রমণের কারণ?
আমাদের বাড়িটা ভাঙে না। প্রত্যেকের বাড়ির ভিতরে এই গুপ্ত কুঠুরীতে লুকিয়ে আছে কেউ না কেউ। আমরা যাদের কাছে পরজীবী। আমরাই , এই পৃথিবীর জঘন্যতম ভাইরাস।
কবির ক্ষোভ দরিদ্রের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা যা ঘটছে গত কয়েকদিন ধরে।
কবি রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ? জয়িত্রী অস্ফুট স্বরে বলে, তুমি বিপক্ষ হলে, রাষ্ট্র তোমাকে হতাশ করে যাবে সব সময়।
খবরিয়ার কাছে যে খবর এল:
মৃত্যু সংবাদ পেলাম নিউইয়র্ক নিবাসী এককালের ঢাকা টেলিভিশনের প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী লুৎফুন্নাহার লতার লেখায়। কী কষ্ট! বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি করোনার খবর নিতে। খবরিয়া খবর নেবেই। লতা লিখলেন এক শোকগাথা। লতার কত প্রিয়জন যে চলে গেলেন এই ঘাতকের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মির্জা ভাই, এত তাড়াতাড়ি বিদায়?
তাকে আমি ডাকি মির্জা ভাই বলে। আমার সিনিয়র অথাব জুনিয়র সেই খবর আমি জানি না। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ঠিক এমন সম্বোধন থেকেই। মির্জা ভাই আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। তবে বন্ধু শব্দটায় যেমন গলাগলির একটা সম্পর্ক বুঝায় ওঁর সাথে আমর সম্পর্কটা ঠিক তা ছিল না। তাঁর সঙ্গে ছিল আমার দীর্ঘদিনের ভালো এক পেশাদারী, আন্তরিক আবার আত্মিক সম্পর্ক। হায়! এই “ছিল” শব্দটা লিখতেও বুকটা আবার কেঁপে উঠলো। সম্ভবত ২০০৯ সাল থেকে মির্জা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। অসাধারণ অমায়িক, চৌকুস আর ভদ্র মানুষ বলতে যা বোঝায় মির্জা ভাই ছিলেন ঠিক তাই। আমি তাকে সম্বধোন করতাম ’মির্জা ভাই’ আর মির্জা ভাই আমাকে বলতেন ’বস’। তিনি কেন আমাকে বস বলতেন জানি না তবে তিনি অনেককেই ’বস’ বলে সম্বধোন করতেন। এটাই ছিল তার স্টাইল। আহা! কত স্মৃতি তাকে নিয়ে? কোন স্মৃতিটা ছোব আর কোনটা ছোব না?? আমি তখন দেলওয়ারে উইলমিংটনে থাকি। আইটি জব করি। কিন্তু মনটা সারাক্ষণ পরে থাকে নিউইয়র্কের দিকে। প্রতি শুক্রবার সপ্তাহান্তে আমি দেলওয়ার থেকে নিউইয়র্ক চলে যেতাম। তখন মির্জা থাকতো ভার্জিনিয়াতে অথবা ওয়াশিংটন ডিসিতে। ঠিক মনে নেই। সেও নিউইয়র্ক যেত। কারণ নিউইয়র্কে তার এবং আমাদের আরেক বন্ধু আকতার ভাইয়ের একটা আইটি স্কুল ছিল। আমাকে দেলওয়ার থেকে মাঝপথ থেকে তারা প্রায়ই তুলে নিত। গাড়িতে উঠলেই মির্জা ভা্ই বলতো, “বস, আপনি ড্রাইভ করেন”। তারপর দেলওয়ার থেকে নিউইয়র্ক এর সেই দীর্ঘ তিন ঘন্টার পথ। আর সেই পথ কত দ্রুত শেষ হয়ে যেত! সেই যাত্রাপথে থাকতো কত আড্ডা! কত গল্প! কত ভবিষ্যত পরিকল্পনা!
আমি বাংলাদেশে আসার সপ্তাহখানেক আগের কথা।হঠাৎ মির্জা ভাইয়ের কল।
”বস, একটা অনলাইন পত্রিকা করতে চাই। আপনার হেলপ দরকার।” আমি বললাম, “ আপনি পত্রিকা বের করবেন আর আমি থাকবো না? দেশ থেকে ঘুরে আসি তারপর আপনার সাথে বসবো এই নিয়ে।” সেই ছিল শেষ কথা তার সাথে। আর কী বসা হল মির্জা?
এই কিছুক্ষণ আগে বাংলাদশ থেকে খবর পেলাম মির্জা ভাই আর নেই। করোনায় তার প্রাণ দিতে হয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এলমহার্স্ট হাসপাতালে ছিল । সে খবর আমার জানা ছিল। আমার আরেক বন্ধু পাভেল চৌধুরী নিউইয়র্ক থেকে জানিয়েছিল মির্জা ভাই আগের থেকে একটু ভালো। শুনে মনটা কিছুটা হলেও স্বস্থি পেয়েছিল। আজ শুনলাম সে আর নেই। একটা মানুষ এই পৃথিবী থেকে এত দ্রুত ’নেই’ হয়ে যেতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না। যে লোকটা দু সপ্তাহ আগেও অফিস করেছে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করছে। চোখে তার কত স্বপ্ন! শুনলাম ভাবিও নাকি করোনায়া আক্রান্ত! হায় নিষ্ঠুর নিয়তি। তার ফুটফুটে দুটো সন্তান আছে। খোদা তো সে খবরটা জানে, নাকি? পৃথিবী এত কঠিন কেন? এই কি আমাদের সাধের ঠুনকো ভালোবাসার জীবন?
মির্জা ভাই, আপনাকে বিদায় জানাই কীভাবে? “বস, এত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছ থেকে আপনার চলে যেতেই হল?” কী অদ্ভুত! এখন আপনার আত্মার শান্তি কামনা করে এই লেখা লিখতে হচ্ছে আমাকে! হায়! পৃথিবীটা কত নিষ্ঠুর! আপনার ফুটফুটে দুটো সন্তানের দিকে আমি তাকাতে পারছি না। হ্যা, এখন ভাবিই তাদের একমাত্র ভরসা।প্রাণপণে দোওয়া করছি ভাবিও যেন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন।
কী দুঃসময়! কী দুঃসময়!! বিশাল এক মৃত্যু মিছিলে আমরা হাটছি। এর শেষ কোথায়? কেউ জানি না।
সবাই আমার এই বন্ধুটির আত্মার শান্তির জন্যে দোয়া করবেন।
খবরিয়া পেনসিলিয়া লিখছে,
ভোরে আমার ঘুম তো ভাঙেই, দূর থেকে আযানের সুর ভেসে আসে ঘুমের ভিতর। আমি মোবাইল ফোনে দেখি কে কেমন আছেন, অচেনা ওয়াহিদ জালাল ম্যানচেষ্টার থেকে কী বলছিলেন, আমার ঘুমের ভিতরে তা আমি শুনতে পেয়েছি,
আমরা কে কোথায় আছি কিংবা কোথায় যাব কেউ জানি না। এই পৃথিবীতে আমাদের কোথাও লুকানোর জায়গা আজও কেউ তৈরি করতে পারেনি,পারবেও না। আত্মসমর্পণ ছাড়া কোন উপায় নেই। আসুন একে অপরের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ্ তুমিই আমাদের মালিক।
তুমি এত ভয় পেলে তোমাকে ধরে নেবে ভাইরাস, ওয়াহিদ ভাই।
ওয়াহিদ বলল, আমার সব দিন মনে হয়, করোনা ভাইরাস ধরে নেবে আমাকে, বিবি বাচ্চারা দেশে, আমি ভেবেছিলাম নিয়ে আসব ঈদে বাড়ি ফিরে।
দেশ কোথায়?
বাগেরহাট, গেরাম মধুকুলি, মধুগুলগুলি একটা আমের নাম, খুব মিষ্ট, সেই মধুগুলগুলি থেকেই মধুকুলি, খান জাহান আলির মাজার খুব কাছে, আমি ফোন দিয়েছিলাম, বিবিরে বলেছি মাজারে গিয়ে দোয়া প্রার্থনা করতে, হুজুর বাঁচাও, হুজুর ছাড়া কেডা বাঁচাবে, ঈদের সময় যেতি পারলি আম খাওয়াতাম তুমারে পোলো ভাই, উপায় নাই, চাদ্দিকে হচ্ছে, আমার কী হবে, আমি আর আমার বিবি বাচ্চাদের দেখতি পারব কি না জানিনে, আল্লা তুমি তাদের দেখ, তুমার কাছে তাদের রেখে যাচ্ছি।
জয়িত্রী বলল, থাক মার্কো, ভয় আমারও করছে শুনতে শুনতে।
৩১শে মার্চ ভোরে কত পাখি কলকল করতে লাগল, আমি হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার সং অফ দ্য রিভার শুনছিলাম, আহা শুনতে শুনতে ফেসবুক খুলেছি। রাজু আলাউদ্দিন মশায়ের কান্নাই প্রায় মিশে গেল চৌরাশিয়ার বাঁশির সুরের ভিতর। সৃষ্টির অতল তল থেকে হাহাকার ধ্বনি উঠে এল।
“ছবির মানুষটিকে পত্রিকা ও আলোকচিত্র জগতের অনেকেই চেনেন। অন্তত নব্বুই দশকের সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের কাছে তিনি পরিচিতি ছিলেন নিশ্চয়ই। ওই সময়ই তাকে বাংলাবাজার পত্রিকায় সহকর্মী হিসেবে পাই, পরে মানবজমিন-এও সে আমার সহকর্মী ছিল। চটপটে, আলাপী আর বন্ধুবৎসল ধরনের মানুষ ছিল আবদুল হাই স্বপন। খুব সম্ভবত ২০০০ সালের পর তিনি মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। । ১৯৯৯ সাল থেকে আমি তার কোনো খোঁজই জানতাম না প্রবাসী হওয়ার কারণে। ২০১০ ফিরে আসারও বহু বছর পর, সম্ভবত ২০১৬/১৭ সালে তার সাথে হঠাৎ করে যোগাযোগ হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। সে-ই কীভাবে যেন আমার খোঁজ পেয়ে প্রথমে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় এবং পরে ফোনে আলাপ হয়। আমাকে দেখার ইচ্ছার কথা জানিয়ে আমেরিকায় যাওয়ার দাওয়াতও করেছিল। আমি কথা দিয়েছিলাম পরের বার গেলে যোগাযোগ হবে। আমি পরে দুবার গেলেও স্বপনের সাথে আর যোগযোগ হয়নি। আজ শুনলাম সে এখন যোগাযোগের সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছে। করোনার নির্বিচার শিকার হলো আমার এক সময়ের সহকর্মী ও বন্ধু স্বপন। এই প্রথম এত কাছের এবং এত পরিচিত কেউ করোনার শিকার হলো। সত্যি জীবন কত অনিশ্চিত। স্বপন বয়সে আমার সমান কিংবা আমার চেয়ে দুএক বছরের ছোটই হবে। আমি যে এখনও বেঁচে আছি– এটাই বিস্ময় । হে বন্ধু, বিদায় জানাবার কথা কখনো ভাবিনি। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার আলিঙ্গনের। কিন্তু করোনা সেই আলিঙ্গন থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করলো অসময়ে।”
খবরিয়ার কথিকা পঠন:
খবরিয়া দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে মানুষের ক্ষোভ,আতঙ্ক, মানুষের কান্না, মানুষের আর্তনাদ ক্রমশ বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। মন ভালো ছিল না। সন্ধ্যাবেলায় অগ্রজ লেখক প্রফুল্ল রায়কে ফোন করলাম। ৮৫ বছর বয়স। তিনি একা থাকেন। স্ত্রী চলে গেছেন ক’বছর হলো। এখন মেয়ে এসে আছে। তিনি বললেন, এমন দেখতে হবে ভাবিনি অমর। ৪২-এ ঢাকা থেকে কলকাতা চলে এসেছিলাম কাজের আশায়। ৪৩-এ মন্বন্তরে আবার পালিয়ে গেলাম ঢাকা। তারপর ৪৬, ৪৭…দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু হয়ে আবার চলে আসা কলকাতা। জীবনে কত কিছু দেখলাম। সদ্য প্রয়াত লেখক সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেক কথা বলতে লাগলেন। আমাকে বলতে লাগলেন, একদম বেরবে না। একদম না। তাঁকে বেরতে হয়েছিল ওষুধ আনতে। আবার কদিন বাদে বেরতে হবে টাকা তুলতে। ব্যাঙ্ক কাছেই আছে। তবে এখন খুব ভীড়। কদিন বাদে গেলে হবে। সমরেশ ( মজুমদার ) ফোন করেছিল। সুধাংশু ফোন করেছিল। বামাবাবু ফোন করেছিলেন। অমর একদম বেরবে না। একদম না। রবি চলে গেছে, শচীন চলে গেছে, দীপঙ্কর চলে গেছে, সুব্রত চলে গেল…হাহাকার করে উঠলেন তিনি। শচীনের কথা বলতে লাগলেন। সেই মৃত্যুটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন যে। আচমকা জানা গেল সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে গেছে রোগ। আহা। শচীন নারসিং হোমে আমার হাতদুটি চেপে ধরেছিল। যাবে না। যেতে চায় না। চলে যেতেই হলো তাকে। আটকান গেল না। পারলাম না। মানুষের সেই শক্তি নেই। কতজন চলে গেছে, শ্যামল কত কম বয়সে গেল, কতদিন চলে গেছে! আফসার আমেদ গেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম টেলিফোনের রিসিভার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে। প্রফুল্ল রায় হাহাকার করছেন।
আমার সমকালের এই বন্ধুরা অকালে চলে গেছে। করোনার দিনগুলি ওরা দেখে যায়নি। তার অনেক অনেক আগে। সুব্রত করোনায় যায়নি।
ভয় অন্তরাত্মায় প্রবেশ করেছে। ক’দিন ধরে খবরের কাগজ স্পর্শ করছি না। খবরের কাগজ, কাগুজে নোট, ধাতুর কয়েন কি ভাইরাসের আশ্রয় হতে পারে ? কেউ বলছে হ্যাঁ, কেউ বলছে না। হোয়াটস আপ ভরে যাচ্ছে নানা তথ্যে। তবে হু বলেছে ঘড়ি আংটি থেকে সাবধান। আংটি কে আর পরে? না পরে, জ্যোতিষে যাদের বিশ্বাস, তারা। ঘড়ির পাট উঠেই গেছে মোবাইল ফোন আসায়। একজন বললেন লিকার চা খেলে ভাইরাস মরবে। অন্যজন বললেন এই তথ্য ভুল। এসব ভুল তথ্য ছড়ান ঠিক না। খবরের কাগজের ব্যাপার ধরা যাচ্ছে না। আমি অনলাইন পড়ছি, মিতালি অনলাইন পড়তে পারে না। তার অসুবিধে বেশি। খবরের কাগজ তাকে ঘর থেকে বাহিরে নিয়ে যায়। সে কী করে পারে? ঠিক হলো, একদিন মানে ২৪ ঘন্টা বাদে পড়া হবে। সকালে দুটি কাগজ আসে। পড়ে থাকে। পরদিনও পড়ে থাকে। বাসি কাগজ কি পড়া যায়? কিন্তু কাগজের হকারকে বারণ করিনি। খবর আসছে। পড়ছি, আবার পড়ছিও না। কোভিড-১৯ এর খবর খুব নিরাশা নিয়ে আসে মনে। কাগজ সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সিনেমা আছে, বইয়ের পাতা নেই। টেলিভিশন এবং হোয়াটস আপ, ফেসবুক অনেক খবর দিয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে এক খবরের কাগজ বিক্রেতার আবেদন পড়তে দিলেন অরুণ দে। ৩১ তারিখ ভোরে। আবেদন তাঁদের প্রতি যাঁরা সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছেন।
“ এ কেমন আতঙ্ক ,তা থেকে তৈরি গুজব!
বেশ কিছু দৈনিক সংবাদ পত্র পাঠক ইদানিং কাগজ নেওয়া বন্ধ রেখেছেন।
তাঁদের মনে হয়েছে , কাগজ থেকে করোনা ভাইরাস তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করতে পারে।
এটি একটি ভুল ধারণা।
হু (W.H.O) ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে বারে বারে ঘোষণা করা হয়েছে/হচ্ছে , ‘সংবাদ পত্র থেকে উক্ত সংক্রামক সংক্রামিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই ‘।
পৃথিবীর কোনো দেশে দৈনিক সংবাদ পত্র এখনও পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। গুজব দাতাদের গুজব ছড়ানো থেকে নিরস্ত্র করছেন সংবাদদাতারা।
এরপর আর এক শ্রেণীর পাঠক বলছেন , কাগজ হাত থেকে হাতে ঘোরাঘুরি করে।
তা পাঠক বন্ধু, আপনার পকেটের কত টাকা হাতাহাতি করে আপনার হাত দিয়ে পকেটে ঢুকেছে সে খেয়াল রাখেন, না রাখছেন?
তার বেলা ?
পরিশেষে জানাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী , রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ অত্যন্ত সচেতন হয়ে লক্ ডাউন’এ যেগুলি বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে সংবাদ পত্র আছে?
আমি একজন কাগজওয়ালা , গুছিয়ে কথা বলা বা লেখার শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার নেই। কাউকে জ্ঞান বা আঘাত করা উদ্দেশ্য আমার বা আমাদের নয়। একটু সহানুভূতি,একটু মানবিকতার কাঙাল আপনার কাজওয়ালাটি। যে সারাবছর আপনার ঘুম ভাঙার আগে ঝড়,জল , দুর্যোগ সঙ্গে নিয়ে হাসি মুখে আপনাকে দিয়ে যায়, টাটকা সন্দেশ । এরপর শুরু হয়, সোনালী রোদ আর এক ঝলক তাজা বাতাস নিয়ে আপনার দিন।
করজোড়ে আমরা আপনাদের কাছে অনুরোধ করি, কাগজ বন্ধ রাখার আগে, আর একবার আপনার কাগজওয়ালাটিকে স্মরণ করুন।
নিশ্চিত খুঁজে পাবেন না ,তার মুখে লেগে থাকা হাসিটি। যেটি আপনিই ফিরিয়ে দিতে পারেন আপনার একটা ভুল ধারণা থেকে সরে গিয়ে।
সকলে সাবধানে থাকুন।
ভাল থাকুন।
ব্যাবস্থা করুন করোনা’কে সরানো।
কাগজ বিক্রেতা।
কত মানুষ এই একটা সুযোগে কাগজ বন্ধ করে দু’পয়সা সাশ্রয় করছেন। সংবাদে কী হবে ? তাঁরা যেন সংবাদের চেয়ে ইতিহাস পড়তে ভালোবাসেন। অতীতের কথা। বর্তমান নয়। হায়। লক্ষ্মীর পাঁচালী আর পঞ্জিকা ব্যতীত ঘরে একটিও বই ছিল না, এবার খবরের কাগজ ত্যাগ করা গেল।
খবরিয়ার সংগ্রহ:
আজ রাত বারোটায় দেশব্যাপী লকডাউনের এক সপ্তাহ পূর্ণ হতে চলেছে।
প্রচুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে অবিরত ফরোয়ার্ডের মাধ্যমে। চা খেলেই নাকি করোনাভাইরাস সেরে যাবেই, এ একেবারে অব্যর্থ দাওয়াই। চিনের যে ডাক্তারবাবু হুইশল-ব্লোয়ারের ভূমিকা পালন করে এই রোগেই প্রাণ দিয়ে গেলেন, তার গোপন ডায়েরি হাতে পড়েছে সেখানকারই এক বাঙালির হাতে, সে কষ্ট করে ভিডিওর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে চিনের এই গোপন ওষুধ! আসলে মানুষ পরিত্রাণ চায় এই ভয়ানক ভাইরাসের হাত থেকে, মানুষ আঁকড়ে ধরতে চাইছে খড়কুটো। বাঁচতে চেয়ে মানুষের স্বসৃষ্ট কত রকম দাওয়াই।
ফ্লু-তে চা বা যে-কোন গরম পানীয় মাঝে মাঝে খাওয়া (চিনি-ছাড়া) আরামপ্রদ, তাতে গলার খুকখুকে কাশি বা হালকা ইনফেকশন সারিয়ে ফেলতে সমর্থ। সঙ্গে আদা, লবঙ্গ, লেবু ইত্যাদির প্রলেপ থাকলে তো বটেই। এ দিয়ে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা বশ করা যায়, বশ করা যায়, আশা করতে দোষ কোথায় ? আশা নিয়েই বাঁচে মানুষ। ফুসফুসটিকে যত্ন করে সুস্থ রাখতে হবে এভাবে।
বাঙ্গালুরুবাসী অমিতাভ প্রামানিকের একটি লেখা পেলাম,
…আমেরিকার পরিস্থিতি খারাপ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। সামনে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন, ট্রাম্পের ওপর প্রচুর চাপ। ট্রিলিয়ন ডলার প্যাকেজে রোগীও কমছে না, মৃত্যুও কমছে না। বিরোধীদের চাপ বেড়েই চলেছে। কন্সপিরেসির পক্ষে আসতে শুরু করেছে প্রচুর জোরালো বক্তব্য। চিন-আমেরিকা বাণিজ্যযুদ্ধ এই সমস্যার সমাধানের পর চলে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমেরিকানরা বাস্তববাদীর চেয়েও আমেরিকাবাদী। তারা ছেড়ে দেবে না। অন্য এক ধরনের বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি হয়ত ঘনিয়ে উঠছে পৃথিবীর আকাশে।
এসব থেকে মুখ ফিরিয়ে আসুন আমরা আমাদের দেশের ব্যাপারটা দেখি। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ অবস্থা অন্যদের চেয়ে আমরা ভারতীয়রা অনেক ভালো ট্যাকল করতে পারব। আমাদের সহিষ্ণুতা ও অদ্ভুত সৃজনীশক্তি আমাদের এই বাধা কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করবে। তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সর্বত্রই।
আর্মির লোকেরা তাদের বসতবাড়ি খালি করে দিচ্ছে আইসোলেশনে থাকা সম্ভাব্য রোগীদের জন্যে। আর্মির কারখানায় যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হয়, সেখানে এখন জরুরি অবস্থায় তৈরি হচ্ছে মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার। চিনির কারখানা জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করছে স্যানিটাইজারের অ্যালকোহল। চারদিন আগে টেস্টিং সেন্টার ছিল ৫৯টা, এখন তা বেড়ে দেড়শোর কাছাকাছি। হাসপাতাল অধিগ্রহণ করে তাকে অস্থায়ী হাসপাতাল বানানো হচ্ছে। রেলওয়ের কোচে তৈরি হচ্ছে রোগী রাখার ব্যবস্থা। বিভিন্ন এলাকা স্যানিটাইজ করা হচ্ছে ড্রোন দিয়ে স্প্রে করে।
ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাব ঘোষণা করেছে, তারা ভেন্টিলেটর তৈরি করে ফেলেছে। ভেন্টিলেটর তৈরি করেছে মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রাও। বিভিন্ন রাজ্যে অতিরিক্ত হাসপাতাল বেড তৈরি করা হচ্ছে সম্ভাব্য প্রয়োজনের কথা ভেবে। কর্ণাটক সরকার অ্যাপ বানিয়ে গুগল প্লে স্টোরে টাঙিয়ে দিয়েছে, যাতে সবাই জানতে পারে তার আশেপাশে কতজন মানুষ কোয়ারান্টাইনে আছে। দিল্লি সরকার গরিবদের আর্থিক সাহায্য ছাড়াও খাবারের রেশন বিলি করছে।
আমার ছোটোবেলার বন্ধু স্বপন মুম্বইয়ে একটা ন্যানো কোটিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। সে আমাকে ফোন করে বলল, ল্যাব চালু করে দিয়েছি, জানিস? সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে ন্যানো-সিলভার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কোটিং বানাচ্ছি, দরকারে ফ্রিতে দেব। স্যানিটাইজারও বানাতে পারি, যদি অ্যালাউ করে। এই অবস্থায় ঘরে পড়ে থাকলে এতদিন কী ছাতার সায়েন্স পড়লাম!
স্বাস্থ্য নিয়ে ধ্যানধারণার জন্যে মানুষ যেমন ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ওপর ভরসা করে থাকে, তেমনি চিকিৎসার জন্যে ইউএস এফডিএ-র। ওদের সার্টিফিকেট মিললে তবেই ওষুধ বাজারে আসে, তবেই তা প্রেসক্রাইব করা যায়। সবাই জানে ওর মধ্যেও বাণিজ্যিক ঘাপলা থাকে। এখন যখন সবাই জেনে গেছে হু কত অপদার্থ, সে রকম পরিস্থিতি এলে চিকিৎসকরা এফডিএ-র অনুশাসন না মেনেই হয়ত চিকিৎসা শুরু করবেন এবং আমার বিশ্বাস তাতে ভাল ফল পাবেন।
আজকের লেখাটা শেষ করি একটা পেপারের তথ্য-বিশ্লেষণ দিয়ে। আমেরিকা-ইতালি-স্পেনে কেন এত রোগী হচ্ছে ও মরছে, আমাদের দেশে কেন কম, সেই ব্যাপারে এক ক্ষীণ আলোকপাত করেছেন নিউ ইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অভ বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের একদল গবেষক। তাদের মতে আমাদের ছোটবেলায় নেওয়া বিসিজি টিকা (যেটা প্রধানত যক্ষ্মারোগ সামলায়) হয়ত এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে কিছু প্রতিরোধ খাড়া করতে সমর্থ। আমেরিকা-ইতালি-স্পেনের বাচ্চাদের বিসিজি নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। চিনে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল অবধি এই টিকা নেওয়া স্থগিত ছিল। তাই এইসব জায়গায় জিনিসটা দ্রুত ছড়িয়েছে, আমাদের এখানে ছড়ায়নি।
এও সেই আশা নিয়ে বাঁচা। ভবিষ্যৎ বলবে আমাদের কী হবে?
জয়িত্রী বলল, ম্যালেরিয়া, যক্ষার ইতিহাস কি বাঁচাবে মানুষকে ?
ভবিষ্যৎ বলবে। মার্কো বলল, খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাইছে মানুষ, সবই অনুমান।
৩১শে মার্চ ২০২০ (রাত এগারোটা)
এই লেখাটি আশ্বস্ত করল ভোরের বেলা। আসলে আগের দিন অধিক রাতের লেখা আমার কাছে আসে পরেরদিন অতি প্রত্যুষে। ভোরেই উঠি। এখন উদ্বেগ নিয়েই উঠি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যাণ্ড থেকে বিপ্লব পাল লিখেছেন।
অতবড় দেশ, অত পাহাড় আর নির্জন প্রান্তর, জনবসতি কম শহরের বাইরে। কিন্তু শহর জনাকীর্ণ। সে দেশে কত চেনা মানুষ, স্বজন পরিজন। বিপ্লব লিখেছেন সন্ধ্যা ছটার কথা। মানে আমাদের এই ভোর।
এখন সন্ধ্যা ছটা। আজ এখনো পর্যন্ত গত আঠারো ঘন্টায় আমেরিকাতে মৃত্যু মিছিল ছাড়িয়েছে ৬৫০+, নতুন আক্রান্ত ২১,০০০। বারোটা বাজতে সত্যিই অনেক দেরী। আজকেই কি মৃতের সংখ্যা ১০০০ ছাড়াবে? কে জানে! সবই ত আজকাল নাম্বার। মৃতদেহ, পেশেন্ট, ভোটার, ভেন্টিলেটর!
প্রতিদিনই ভাবি, আমরা পিকে পৌছেছি। কাল কমবে। একটু আশার আলো। কিন্ত প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ব্রেক করছি।
আমেরিকার মতন একটা দেশ কেন মহামারি আটকাতে পারছে না? কারন অনেক…
চীনের মতন কোথাও কোন বল প্রয়োগ করা হয় নি। ঘরে কেউ থাকলে থাকছে, না থাকলে না থাকছে। মাস্ক নেই। থার্মাল স্ক্যানিং এর ব্যবস্থা নেই কোনো স্টোরে।
কলকারখানা, গ্রোসারি-সবই খোলা। শুধু রেস্টুরেন্ট বন্ধ। এসব কিছুই ঠিক ছিল-যদি প্রোটেক্টিভ মাস্ক, থার্মাল স্ক্যানিং, স্যোশাল ডিস্টান্সিং ও চলত কঠোর ভাবে। তাহলেই আটকে যেত এই মৃত্যু মিছিল।
কিন্ত আমেরিকার মানুষ স্বাধীনতা প্রিয়। গত কাল আমাদের মেরীল্যান্ডের গর্ভনর হোগান ঘোষনা করেছেন সবাইকেই ঘরে থাকতে হবে। এদিকে রাস্তায় প্রচুর লোকে গাড়ি চালাচ্ছে । পুলিশে থামাবে না। পাবলিক হুমকি দিচ্ছে আমেরিকান সংবিধান অনুযায়ী নাকি এমন ডিক্রি কেউ দিতে পারে না। এমন কি ট্রাম্প নিউ ইয়র্কে লক ডাউন করতে চেয়েছিলেন। যেমন চায়না করেছিল এপিসেন্টারকে। ট্রাম্পকে নিউ ইয়র্কের মেয়র হুমকি দিলেন কোর্টে দেখে নেবেন।
এ দেশ চালায় কোর্ট আর উকিলে। এত নোবেল লরিয়েট, ডাক্তার বিজ্ঞানী থেকে হবেটা কী?
একটা দেশের মাথায় উকিলদের বসালে এই হবে। পাশাপাশি এই প্রশ্ন উঠবে, হেলথ কেয়ার সেক্টর প্রাইভেট মার্কেটের হাতে ছাড়া যায় কি না। কারন এটা পরিস্কার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের সঙ্গে কমিউনিটির স্বাস্থ্যও গুরুত্বপূর্ন। এপিডেমিক রোখার কোন কাঠামোই এই দেশের নেই। এটা অন্তত শিক্ষা হোক যে চিকিৎসা ব্যবস্থা যতই উন্নত হোক, এপিডেমিকের সামনে, তা অকার্যকর।
মার্কো জয়িত্রী আলাপন:ঃ
মার্কো বলল, পৃথিবীজুড়ে শুধু বিষাদ মেঘ, শোনো জয়িত্রী, আমি ঢাকা ছেড়ে একদিন রওনা দিয়েছিলাম, কোথায় যাব ঠিক নেই। বাস কলকাতার দিকে যাচ্ছে। আমি হয়ত কলকাতাই যাব। নাকি অন্য কোথাও, আমার ফোনে ক্রমাগত মেসেজ আসছিল মার্কো, এস। পথেই তোমাকে নামিয়ে নেব। পদ্মার আরিচা ঘাট, গোয়ালন্দ, ফরিদপুর, মধুখালি, যশোর, নাভারন…, নাভারনেই তুমি নামবে মার্কো।
কী সুন্দর সব নাম! জয়িত্রী মুগ্ধতা প্রকাশ করল।
পদ্মার মতো বড় নদী আমি দেখিনি জয়িত্রী। পদ্মার কুল নাই। জ্যোৎস্না রাতে পদ্মা যেন সকল আবরণ মুক্ত হয়ে আকাশে পাড়ি দেয়। পদ্মা এক শাদা পরী, নদীর রূপ নিয়ে এপার ওপারকে স্নিগ্ধ করছে। হ্যাঁ, আমি নাভারন থেকে আর এগোতে পারিনি বেনাপোল সীমান্তের দিকে। নাভারনে আমাকে নামিয়ে নিল তুহিন। শুভ্র। মন্ময়। তারা বলল, মার্কো, তুমি সাতক্ষীরা যাবে না?
সেখানে লকডাউন ছিল না?
ছিল, ওরা অনুমতি নিয়ে নাভারন চলে এসেছিল। নাভারন থেকে বাম দিকে রাস্তা চলে গেছে সাতক্ষীরা, খুলনার দিকে। সোজা বেনাপোল, স্থল বন্দর। তা পেরিয়ে ভারত। এইসব দেশ একদিন এক ছিল। এখন ভিন্ন। সাতক্ষীরে এক ছোট শহর। শহরের গায়ে গায়ে গ্রাম, জলাভূমি, মাছ আর ধান, নারিকেল, শুকিয়ে যাওয়া নদী বেতনা, প্রাণসায়র। সাতক্ষীরের কাছে কলারোয়া, সেখানে সোনাই নদী, নদীর ওপারে ভারত। সাতক্ষীরের ১৫ কিমি দূরে সীমান্ত, ঘোজাডাঙা স্থল বন্দর। সাতক্ষীরে থেকে কলকাতা যেতে তিনঘন্টা বড় জোর। সাতক্ষীরের মিষ্টান্ন সুস্বাদু। জোড়া সন্দেশ, কাঁচা গোল্লা, রসগোল্লা, চমচম। কিন্তু তখন সব ময়রার সব দোকান বন্ধ ছিল। ওরা মার্কোকে নিয়ে চলল কপোতাক্ষ নদ দেখাতে। মার্কোর স্মৃতিতে কপোতাক্ষ আছে। কীভাবে আছে তা মার্কো জানে না। সে কি সাগরদাড়ির কবির কথা জানে ? তার কপোতাক্ষ প্রশস্তি পড়েছে ? সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে… সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে। সেই সাগরদাড়ি যশোর জেলায়। সেখেন থেকে দক্ষিণে সাতক্ষীরে, আরও দক্ষিণে খুলনা। কপোতাক্ষ যেন আদ্রিয়াক সাগরে গিয়ে মিশেছে। কিংবা আদ্রিয়াক সাগর থেকে এসেছে। সাতক্ষীরেকে তার ভেনিস মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল হারানো দেশ, হারানো শহর ভেনিসে এসে গেছে সে। ভেনিসের সেই হর্ম্যশ্রেণি নেই বটে, মনে হয় ভেনিসের অদূরে এক আলাদা দ্বীপভূমি। খুব কাছেই সমুদ্র। সমুদ্র দেখা যাবে জানালা দিয়ে। আকাশ নীল, সমুদ্রপাখীরা উড়ছে, নেমে আসছে জলে। দূরে একটি সোনালি চুলের বালক হাঁটছে। তাকে আমি চিনি। চিনি মনে হয়।
আমাকে নিয়ে তুহিন, শুভ্র, মন্ময় মনিররা ব্রহ্মরাজপুর গেল। চেনা লাগল। খুব চেনা। সেই ঘোষ জমিদার না তালুকদারের গৃহ ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। কাল ভৈরবের মন্দির রয়েছে। পথে ধুলিহর গ্রাম, কে যেন ডাক দিল, কেডা যায়, চিনা লাগে যেন।
মার্কো চেনে। নিকোলো পোলো বলে গিয়েছিল এসব গ্রাম নগর না দেখলে জগতের কিছুই দেখা হবে না তোমার। আমার সব চেনা লাগতে লাগল। নিকোলো পোলো যেন রয়েছেন কোথাও। আম, নারিকেল বাগানে, পান সুপারির দেশে। সেইসব গ্রামে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করেনি। শুধু একটা খবর হলো, আয়না বিবি, ময়না বিবি, নাজনিন বিবিদের স্বামী আরব দেশে রয়ে গেছে। ফিরতে পারেনি। এখন তাদের ফোনও বন্ধ। কী হলো তাদের ? কাজ গেছে যাক, মানুষ তো ফিরবে ? পেটে ভাত জুটছে তো। শুষ্ক, বিশুষ্ক বালিভরা কপোতাক্ষ, মৃতপ্রায় কপোতাক্ষর তীরে বসে তারা অশ্রুপাত করছিল। তাদের চোখের জলেই কপোতাক্ষয় যেন বান এসে যাবে। মার্কো এই দেখতেই বুঝি এতদূর এল। জয়িত্রী, কে যেন বলেছিল চোখের জল ফুরিয়ে গেলে অন্ধতা নিবিড় হয়।
মহামারি অনাহার কোন কলমে লিখি
১লা এপ্রিলের খবর যা যা এসেছিল।
পেন্সিলিয়া খবরিয়া বলল, ঐ দিন দুপুর থেকে গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয় ছড়াল। ইতালি, আমেরিকা ব্রিটেন গোষ্ঠী সংক্রমণে বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে। খাদের কাছে বলা যায়। আমাদের দেশে এতদিন অবধি যে খবর পাচ্ছি সবই বিদেশ প্রত্যাগত দ্বারা সংক্রামিত। কিংবা ভ্রমণ সংক্রান্ত। কিন্তু এ কী খবর। দিল্লির নিজামুদ্দিনে ১৩ই মার্চ থেকে ১৫-ই মার্চ অবধি ধর্মীয় সংগঠন তবলিগের এক বড় জমায়েত হয়। দিল্লি পুলিশ তা করতে দিয়েছিল। কিন্তু মহারাষ্ট্র তার অনুমোদন দেয়নি। দিল্লি পুলিশের ভূমিকা অবাক করেছে। ভয় বাড়ছিল তিরুপতির মন্দির থেকে পাড়ার শেতলা মার মন্দিরের জমায়েতে। মানুষ কত নির্ভয়।
পশ্চিমবঙ্গ থেকেও ৭০-৭৫ জন গিয়েছিল নিজামুদ্দিনের ধর্ম সভায়। ভয়ের খবর, সেখানে চিন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব থেকে ধর্মগুরুরা এসেছিলেন। তাদের দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে কি হয়নি তা আন্দাজ না করতে পেরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে চিহ্নিত মানুষকে হোম আইসোলেশনে রাখার কথা বলা হয়েছে। এই রকম আর এক ধর্ম সমাবেশের কথা ২৯ তারিখে মুরারী সিংহর কাছে শুনেছি। পঞ্জাবের বাঙ্গা জেলায় ১৫টি গ্রামকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সেই শিখ ধর্মগুরু মারা গেছেন। নিজামুদ্দিনে সমাবেশে অংশগ্রহণ করা মানুষ সারা ভারতে ছড়িয়ে গেছেন। এইসব মানুষকে আমি কিছুটা চিনি। হতদরিদ্র। ধর্ম ব্যতীত কিছুই জানেন না। সরকারও ভয় পেয়েছে। ফেসবুক হিন্দু মুসলমান হয়ে গেল সত্যি। তার ভিতরে অতি সক্রিয় হয়ে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক কথা বলতে লাগলেন। সুর ভালো না। কিন্তু কোনো কোনো সুরে সত্য উচ্চারণ।
ডোনাল্ড ট্র্যাম্প ভারতে আসার প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে সতর্কবার্তা এসেছিল, অতিমারী ভাইরাস কোভিড-১৯ প্রবেশ করতে যাচ্ছে ভারতে, যে কোনো ভাবে ঢুকে পড়বে, ভারত সরকার সেই সতর্ক বার্তা অগ্রাহ্য করেছিল। ভেবেছিল কিছুই হবে না। ভারতে এই মহামারী ছড়িয়ে যাওয়ার আগে ভারতের কাছে প্রায় দু’ সপ্তাহের বেশি সময় ছিল। উড়ান বন্ধ করতে পারলে, যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারান্টাইনে পাঠালে মহামারী থমকে দাঁড়াত। শুধু মাত্র সরকার খানিক সচেতনতা অবলম্বন করলেই তা হত। কিন্তু না আমরা তা করিনি।
শুভেন্দু দেবনাথ বললেন, আমরা সব অগ্রাহ্য করেছি, তার বদলে গা এলিয়েছি, আর বলেছি আরে ওই তো ইতালিতে মরেছে, আরে ওই তো চায়নারা অখাদ্য কুখাদ্য খায়। আসলে আমরা ভারতীয়রা ভেবেছিলাম যেমনভাবে বিভিন্ন ঘুর্নিঝড় ভারতের গাঁ ঘেষে বাংলাদেশ বা অন্যান্য দেশে আছড়ে পড়ে আর ভারত বেঁচে যায়, এবারও তাই যাবে। …
এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে অতি ভীত, মৃত্যু ভয়ে ভীত, বাঁচব কী করে, লকডাউনের ফলে আগামী মাসের মাইনে ঢুকবে কিনা পরের মাসের মুদি কিনতে পারব কিনা এই ভয়ে ভীত আমি ভারতের এক সাধারণ নাগরিক।
মার্কো জয়িত্রী কথোপকথন
মার্কো পোলো বলল, সমস্যা ক্রমশ বাড়ছিল। মানুষ দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। কদিন ধরে পারস্পরিক দোষারোপ চলছিল। পৃথিবী কতটা দূষিত হয়ে গেছে তা দেখা যাচ্ছিল। মাটি জল দূষিত হলে, মানুষ কি বাদ থাকে জয়িত্রী?
জয়িত্রী আজ লং স্কারট পরেছে, তার ভিতরে কত রঙ। মার্কোর মনে হলো জয়িত্রী এক সাত রঙের পাখি। মার্কো এমনি এক কন্যাকে দেখেছিল, সে দিন রাত ছুটে বেড়াত, কবিতা লিখত, গান গাইত। সেই মেয়ের সঙ্গে কলকাতার এক কাফেতে আলাপ। কেউ চেনেনি, সে চিনেছিল। সে এসে বলেছিল, স্যার আপনিই ভূ- পর্যটক মার্কো পোলো?
মার্কো অবাক। তার ছিল জিন্স আর ফুল হাতা শার্ট। লাল কালোয় চেক। শ্যাম বর্ণ। মুখখানি পান পাতা। চোখের মণি ঈষৎ বাদামি। সে যেন একটি প্রজাপতি। রঙে রঙে ফুট ফুট। যেমন এই জয়িত্রী। মার্কো জিজ্ঞেস করেছিল, সে কে?
তার নাম ইসাডোরা। ইয়েস ইসাডোরা ডানকানের নামে তার নাম। নৃত্যশিল্পী। আমি তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম জয়িত্রী। সেই কবে শুনেছি। কোন যৌবন কালে। তখন ছিল কৌতুহল বেশি। সব কিছু আমার করে নিতে হবে। কত কিছু জানতে হবে। দস্তয়েভস্কি পড়তে হবে, তলস্তয় পড়তে হবে, বেটোভেন শুনতে হবে, সোয়ান লেক দেখতে হবে, দেখতে হবে ব্যাটলশিপ পটেমকিন, জানতে হবে কে ইসাডোরা ডানকান।
জয়িত্রী বলল, আমি জানি আমি জানি, আমার একটা নাম ইসাডোরা, আমার মা বলত।
তারপর ?
মা চেয়েছিল আমি নৃত্যশিল্পী হই।
তারপর?
আমি অপেরায় জয়েন করি।
তারপর?
জয়িত্রী বলল, একটা অপেরা আছে, অদ্ভুত সুন্দর তার কাহিনি, আমরা সকলে দেখেছিলাম, আমার দাদা, আমি, মা, বাবা, তাতে একটা গ্রামের মেয়ে ছিল, সে ঘুমের ঘোরে এক পুরুষকে দেখল, পুরুষকে তার পছন্দ হয়ে গেল, সে বলল, ঐ যুবককে ছাড়া সে কাউকে বিয়ে করবে না।
মার্কো বলল, ওদিকে স্তেপের শেষে আর এক গ্রামে একটি যুবক ছিল, ভেড়া চরিয়ে বেড়াত, সেও এক স্বপ্ন দেখল, একটি সুন্দরী কন্যা তার জন্য ভাবছে বসে এক ঝর্নার ধারে বসে।
জয়িত্রী বলল, ঠিক তাই, মা বলল, তুই অপেরায় অভিনয় করবিরে ইসাডোরা।
কে ইসাডোরা মা?
মা বলল, ইসাডোরা জন্মেছিল সানফ্রান্সিস্কোতে…
ইসাডোরা ডানকানের কথা বলতে লাগল মা।
তোমার মা কোথায় বাবা কোথায় জয়িত্রী?
মা নেই। মা চলে যেতে আমার ইসাডোরা নামটিও হারিয়ে গেল, মার ইচ্ছে ছিল অপেরায় অভিনয় করবে, ইচ্ছে পূরণ হয়নি, আমাকে বলেছিল অপেরায় যেতে, বাবার মত ছিল না, আমি ভাবতাম বাবার মতো জারনালিস্ট হবো।
বাবা কোথায়?
জয়িত্রী বলল, বাবার নতুন সংসার হয়েছিল, বাবা চেয়েছিল আমি সাংবাদিক হই, থাক মার্কো, তুমি যে কথা বলছিলে, বল।
মার্কো বলল, তার নাম ইসাডোরা ইসলাম, সে বলল, খবর পেয়েছে মার্কো ঘুরছে শহরে।
জানল কী করে? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করে।
সে বলল, সাংবাদিকের খবরের সূত্র সাংবাদিক বলবে না, সে জানত দুপুরে আমি সেই কাফেতে যাব, কাফের নাম অবাক জলপান।
এমন সুন্দর নাম।
মার্কো বলল, কলকাতায় এমনি হয়, একদল কবিতা লেখে, আর একদল কবিতার বই ছিঁড়ে দেয়, একদল গান গায়, আর একদল গানের মাইক্রোফোন খুলে দেয়, একদল প্রতিবাদী মিছিল করে, অন্যদল মিছিলে লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবাক জলপানে কবিরা আসে শুনে আমি গিয়েছিলাম।
কেন সেই কফি হাউস?
সে তো আছে, একদল সেখানে যায় না, যার যেমন পছন্দ, তো ইসাডোরা ইসলাম আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল, একটা সাক্ষাৎকার নেবে তাই।
তারপর?
তখন কোভিড-১৯ ঢুকে পড়েছে শহরে, শহর ফাঁকা হতে শুরু করেছে, তিমির, সেলিম, অচিন্ত্যরা যে যার বাড়ির পথে যাত্রা করেছে, কী হতে যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না, আমাকে সে জিজ্ঞেস করল আমি কি ভেনিস থেকে আসছি? ভেনিসের কী অবস্থা, ভেনিস থেকে আসিনি বরং আমি ভেনিসে ফিরে যাব শুনে ইসাডোরা বিষণ্ণ হলো।
ইসাডোরাঃ ভেনিস খুব বিপদে আছে মার্কো, সব ঠিক হোক, তারপর যেও।
মার্কোঃ সকলে নিজ গাঁও-এ ফিরছে, আমিও ফিরব।
মার্কো, তোমাকে কি কেউ চলে যেতে বলেছে, আমাদের শহর কলকাতা সকলকে গ্রহণ করে, কাউকে পরিত্যাগ করে না?
মার্কোঃ জানি, কতদিন ধরে আমি এই শহরে রয়েছি, অলিগলি সব চিনি, কিন্তু মনে হয়, পৃথিবীর পথে রওনা হওয়ার এইই শ্রেষ্ঠ সময়।
মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে, তুমি ঘরের বাইরে চলে যাবে?
মার্কোঃ ঘর কোথায় আমার, সে তো বহু বর্ষ আগে ভেনিসে ছিল শুনেছি, তাই ভেনিসের পথে হাঁটব।
জয়িত্রী বলল, ইসাডোরা ঠিক প্রশ্ন করতে পারেনি তোমাকে।
মার্কোঃ ঠিকই প্রশ্ন করেছিল, আমি ঠিকই জবাব দিয়েছিলাম, সকলেই ঘরের পথে হেঁটেছে, আমিও,
ভারতবর্ষ হাঁটতে আরম্ভ করল দুদিন বাদে, তুমি ভাবতেই পারবে না, মহাসড়কগুলি কেঁপে উঠছে কর্মহীন বিপন্ন ও ভয়ার্ত মানুষের পদশব্দে। গোটা দেশ বন্ধ হয়ে গেছে, রেল বন্ধ, বাস বন্ধ, মানুষের কাজ বন্ধ, তারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গেছিল কাজ করতে, কাজ গেছে, ভাত নেই পেটে, অনাহার শুরু হয়ে গেছে, আমি তাদের সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করলাম জয়িত্রী, ইসাডোরা আমার কাছে ভেনিসের খবর না পেয়ে বলল, সে আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি করবে ভেবেছিল, কিন্তু মার্কো পোলো যদি ভেনিসের কথাই না জানেন, তাহলে কী নিয়ে স্টোরি করবে সে, কী লিখবে বানিয়ে বানিয়ে?
লিখেছিল কি সেই ইসাডোরা?
লিখতে পেরেছিল কিনা জানি না, আমি পরদিন হাঁটতে শুরু করলাম, সেই যে শুরু তারপর আর তা শেষই হচ্ছে না, কত শত মাইল পথ হেঁটে তারা নিজ গাঁয়ে পৌঁছবে, কাজ নেই ভিন দেশে, অনাহার আর অনাহার, মরলে গাঁও এ ফিরে মরবে…।
তখন জয়িত্রী বলল, থাক মার্কো, অন্য কথা বল।
মার্কো বলল, হ্যাঁ, অন্য কথা বলি, মানুষের মহাযাত্রার কথা আমি পরে শুনাব তোমাকে। বরং সিলেটের মানুষ, প্যারিসবাসী এমদাদ রহমানের কথা বলি তোমাকে,
খবরিয়া পেন্সিলিয়ার সংগ্রহ:
ফরাসী দেশ থেকে তখন লেখক, অনুবাদক এমদাদ রহমানের সাড়া পাওয়া গেল। কদিন ধরে এমদাদের দেখা নেই। সে দিন দশ আগে লিখেছিল আকাশ খুব নীল, ঘুরেছে নানা মলে, রুটি দুধ সব ফুরিয়ে গেছে। তাদের খাবার চাই। এমদাদ সিলেটের যুবক। লন্ডনে থাকত। এখন ফরাসী দেশে, পরবাসী। এমদাদের লেখাটি দমবন্ধ ভাবটি কাটিয়ে দিল। কত আর সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ দেখে যাব। কত আর এসব পড়ে রক্তচাপ বাড়ানো যায় ? সরকার পারছে না, সরকার পারছে, হিন্দু, মুসলমান, মেঘনাদ বধ কাব্য কিসে খারাপ, গরিব মানুষ, কেড়ে খায় না কেন ( গল্পটি, ছিনিয়ে খায়নি কেনঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)। যে যেমন পারে লিখে যাচ্ছে। ফেসবুক কখনো কখনো অসাধারণ (!)
আলব্যের কামু লিখেছিলেন প্লেগ আক্রান্ত, অবরুদ্ধ শহর ওরান শহরের -এর কথা। প্লেগ প্রসঙ্গে তরুণ রাজসিক বলছিল, একটি ছবির কথা, ‘মন্টি পাইথন অ্যান্ড দ্য হোলি গ্রেল’-১৯৭৫-এর ছবি। সেই ছবি আরম্ভ হয় ৯৩২ সালে ইংল্যান্ডের এক কাউন্টিতে। কাউন্ট তাঁর অনুচরকে নিয়ে পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। হয়ত তাঁর ভেট সংগ্রহে। প্রজার দেওয়া কলামুলোতেই তো রাজা-জমিদার জীবিকা নির্বাহ করেন। শীতকাল। প্লেগ মহামারি হয়ে ছড়িয়েছে সমস্ত অঞ্চলে। মানুষ মরছে। এক ঘিঞ্জি বসতিতে একটি প্লেগ কার্ট এল। তা টানছে একজন। অন্যজন ঘন্টা বাজিয়ে দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে হাঁক দিচ্ছে, ‘ব্রিং আউট ইওর ডেড’। প্লেগ কার্টই বুঝি মৃত্যুদূত। তার ঘন্টা শুনে যারা, যেসব দুস্থ বৃদ্ধরা পথের ধারে বসে ছিল, সকলে লুকিয়ে পড়তে চাইল। এক বৃদ্ধ আতঙ্কে তার মাথা ঢুকিয়ে দিল চ্যাঙারির ভিতর। প্লেগ কার্ট তাকে নিতেই এসেছে যেন। গাড়িটি বুঝি আবর্জনা সংগ্রহে এসেছে এমন। প্লেগ কার্ট ডাঁই হয়ে আছে মৃতদেহে। একের পিঠে অন্য। হ্যাঁ, শীতের সেই অনুচ্চ আলোর ভিতরে মুমূর্ষু মানুষ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল একজন। লোকটি কাঁদছে। তার মৃত্যু হয়নি তখনো। যে মানুষটি প্লেগ কার্ট পরিচালনা করছিল ঘন্টা, হাতুড়ি হাতে, সে তার হাতুড়ি মারল লোকটির মাথায়। মরে গেল। গাড়িতে থাকে ফেলে দিল তার বাহক। ইওরোপ কত মহামারি পার করেছে। আমরাও পার করেছি। তা সেভাবে ডকুমেন্টেড নেই। এসব ভাবছিলাম। মহামারীতে এমন হয়। মৃতদেহ ছুঁয়ে দেখবে না কেউ। ভোরে কত রকম ভাবি যে। ভাবতে ভাবতে অথৈ বিষাদ সিন্ধুতে ভেসে যাই। তখন ফেসবুকে ভেসে এল এমদাদ রহমান। বেশ ক’দিন বাদে ও লিখেছে কিছু। ও কেন অনেকদিন বাদে দেখা দিল, এতদিন ছিল কোথায়? ঘর-বন্দি। ঘর-বন্দিই আছে। তার মনে পড়ে রাতভর সাইরেন বাজাতে বাজাতে বাবাকে নিয়ে ফিরছে ঢাকা থেকে সিলেটের গ্রামের বাড়ি। প্যারিস শহরে সেই সাইরেন তাকে জাগিয়ে দেয় মধ্যরাতে। মধ্যরাতে সাইরেন নৈঃশব্দ যেমন ভেঙে দেয়, সাইরেনের শব্দ দূরে চলে গেলে, আরো নিস্তব্ধতা জুড়ে বসে। তার সম্বল একটি ট্যাব। তা দিয়েই যোগাযোগ দেশের সঙ্গে, বিদেশের সঙ্গে। ঘুম আসে না। মনু নদীর কথা মনে পড়ে। চাতলা ঘাট। মায়ের গায়ে ফুলের গন্ধ। সেই গন্ধ যখন ফুরিয়ে যায়, তখন বারবার মনে পড়ে বাবা কোথায়। সে এক গন্ধহীনতা, সেও এক পরম নৈঃশব্দ। সেই গন্ধহীন নিস্তব্ধতা আর এই সাইরেন চলে যাওয়া মধ্যরাত একাকার। এমদাদের মনে হয়, কেউ না থাকা মানেই নৈঃশব্দ। কেউ না থাকা মানে একটি ট্যাব এবং স্যানিটাইজারের শিশি। ট্যাব ধরতে গিয়ে হাতের আঙুল স্যানিটাইজারের শিশি ধরে আগে। পৃথিবীটা বদলে গেছে।
৩১শে মার্চ। এমদাদ গত ১৫ দিন চার দেয়ালে আটকে আছে। তখন অপরাহ্ণ বেলা, জানলা গলে রোদ ঢুকছে। হয়ত তাকে আরও ১৫ দিন ওইভাবে থাকতে হবে। এপ্রিল যাবে, হয়তো মে, জুন…চলে যাবে। সব কিছু বিশ্রামে থাকবে। পৃথিবী- বড় বেশি ক্লান্ত হয়েছিল…
এমদাদের মনে পড়ল, ভারগাস ইয়োসা চুপি চুপি বলছিলেন- প্রত্যেক যুগের নিজস্ব আতংক আছে।
বোর্হেস বলেছিলেন- সংবাদপত্র তিনি কখনোই পড়েননি, তার একমাত্র কারণ এখন কী ঘটছে তার চেয়ে বরং বহুদিন আগে কী ঘটেছিল- তা জানার এক উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। বর্তমান নয়, অতীত। এ এক ধরনের মানসিক অবস্থান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি ছিলেন জেনেভায়। জেনেভায় বসে তিনি পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস পাঠ নিয়েছিলেন। সেই সব বই, যার ভিতরে ছিল অতীত। তাঁর বিস্ময় ছিল চারপাশ নিয়ে, কী অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই যেন হঠাৎ করেই সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, ভাল কথা, কিন্তু, কী অদ্ভুত, সাম্প্রতিক ডামাডোলের ভিতর কেউই আগ্রহী নয় কার্থেজের যুদ্ধের ব্যাপারে, কিংবা কেউ আগ্রহী নয় পারসিক ও গ্রিকদের মধ্যকার যুদ্ধে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে জানতে, কিন্তু, সবাই আগ্রহী হয়ে পড়েছেন- সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে… ।
অতীত ছাড়া কি বর্তমানে প্রবেশ করা যায়!
সারামাগোর অন্ধত্ব উপন্যাসের শুরুতেই The Book of Exhortations থেকে এক আশ্চর্য কীর্ণলিপি পাই-
If you can see, look.
If you can look, observe.
পুরো উপন্যাসের মূল কথাটাই যেন দুই লাইনে ব্যক্ত। সারামাগো প্যারিস রিভিউকে বলছেন- অন্ধত্ব এখানে মেটাফর। মেটাফর, কেননা এ অন্ধত্ব মানুষের দ্বারা ছড়িয়ে পড়েছে। এই অন্ধত্বই মঙ্গলে পাথর পরীক্ষার জন্য মহাকাশযান পাঠাবার ব্যবস্থা করছে, একই সময়ে আমাদের গ্রহে অযুত নিযুদ সংখ্যক মানুষ খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত। আমরা হয় অন্ধ নয় তো উন্মাদ।
if you can look, observe! …।
এমদাদ বলল, মার্চের শেষ দিনটি চলে যাচ্ছে। ঝকঝকে আকাশ থেকে হাসছেন দিনমণি, তার উজ্জ্বলাভা ঢুকে পড়ছে ঘরে। পৃথিবীরে, কবির মতো, মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ বলে মনে হচ্ছে।
এমদাদের সঙ্গে কথা বলার পর, এক মৃত্যু সংবাদ পেলাম, না, করোনায় মৃত্যু নয়। নভশ্চর আলেক্সেই লিওনভ প্রথম মহাকাশে হেঁটেছিলেন ১৯৬৫ সালের ১৮-ই মার্চ। মস্কোতে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। সম্প্রতি নিজেদের ওয়েবসাইটে নভশ্চর লিওনভের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস। লিওনভ ১২ মিনিট মহাকাশে হেঁটেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশযান ভস্তক-২ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল মহাকাশে। পড়লাম তাঁর অপূর্ব অনুভূতির বিবরণ। শূন্যে হেঁটে চলেছেন শিশুর মতো। পড়ে যাচ্ছেন না। তাঁকে ঘিরে আছে নক্ষত্রদল।
০১.০৪.২০
আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত ৩৭, মৃত্যু ০৩। সারা ভারতে আক্রান্ত ১৭৫০, মৃত্যু
এরই ভিতরে একেবারে আড়ালে থাকা পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় মানুষ মানুষের কাছে চাল ডাল আটা পৌঁছে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পুরুলিয়ার গ্রাম জানকিবেড়া,চুলাপাণি,হেঁটবেড়া,ভীমজারা,উপর বামনি,হেঁট বামনি,চুনকুড়ি, কমলাবহাল, ঘাঁটিয়ালি, পিঁটিটিরি। ভয়ানক তাপমাত্রা। জলের অভাব। গরিবস্য গরিব মানুষের কাছে খাদ্য নিয়ে যাচ্ছে কবি, লেখকদের একাংশ। জীবন তাঁরা এইভাবে চেনেন।
২রা এপ্রিল
এই দিনটি গেছে ভয়ে। সারাদেশ জুড়ে দিল্লির নিজামুদ্দিনের ঘটনা নিয়ে চুলচেরা বিচার চলছে। খড়্গপুর থেকে কজন বিদেশিকে চিহ্নিত করে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। কলকাতার হজ হাউসে ৫৩জন আগেই কোয়ারান্টিনে গেছেন। ফেসবুক কদর্য কথাবার্তায় ভরে উঠছে। কবি সৈয়দ কওসর জামাল কঠিন ভাষায় নিজামুদ্দিন কাণ্ডের নিন্দা করেছেন। তাঁর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন অনেক মুসলমান যুবক, মধ্যবয়সী। যা নিন্দার নিন্দা করতে হবে। সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য লিখছেন দক্ষিণ কোরিয়ায় খ্রিস্টানদের এক জমায়েত সে দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে। তবলীগের জমায়েত মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়ায় কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়েছে। ওই দেশগুলি ইসলামিক দেশ। এইটি হিন্দু মুসলমান ব্যাপার নয়। লড়াই ধর্মান্ধতা এবং শিক্ষার, জ্ঞান বিজ্ঞানের। হ্যাঁ, এইদিন ছিল রাম নবমী। কলকাতার রাম মন্দিরে প্রত্যেকবারের মতো ভক্তের ঢল নেমেছে। মুখে কাপড় দিয়ে ভক্তরা একের উপর অন্যরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। রাম নবমী বাঁকুড়ায় পালিত হয়েছে। মিছিল হয়েছে। এ জাতির কী হবে ? ধর্ম যে আফিম তা এখন বুঝতে পারছি বেশ। এইদিন আমাদের দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এক লাফে অনেকটা বেশি। ৪০০-র উপরে।
আজ এক অভিজাত আবাসন থেকে পরিচারিকাকে তাড়িয়ে দিয়েছে জ্বরজ্বর ভাব থাকায়। তারা হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। মনে পড়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাদা অ্যাম্বুলেন্স গল্পটিকে। তা ছিল পক্সে আক্রান্ত পরিচারকের গল্প। এমনিই বের করে দিয়েছিল ধনী গৃহস্ত। ভাবুন, এই পৃথিবীর এই বিপর্যয়ের কারণ এরাও নিশ্চয়। এত নিষ্ঠুর এত লোভী প্রাণী এরা, কে মরল কে বাঁচল তা দিয়ে এদের কিছু যায় আসে না। মানুষের কাজ মানুষ করেছে, বস্তির লোক পুলিশে খবর দিয়ে পথের পাশ থেকে উদ্ধার করেছে বালিকা পরিচারিকাকে। মানুষের কত রকম আছে। দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন।
২রা এপ্রিল গেছে আতঙ্কে। সন্ধ্যায় দেখলাম অতনু ঘোষ পরিচালিত ছবি ‘ময়ূরাক্ষী’। কী বিষাদ এবং বিমর্ষতার ছবি। কিন্তু এক ভয়ানক সত্য। সেই বিমর্ষতা কাটিয়ে উঠবে মানুষ, সেই ইঙ্গিতে ছবি শেষ। এর আগে একটি সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম দেখেছি তাঁর। অ্যাবি সেন। অসম্ভব ভালো। অতীতচারিতা তাঁর প্রিয় বিষয়। যেন ইতিহাস খনন করছেন। লকডাউনের এই সময় পুরোন দিন, হারিয়ে যাওয়া দিন, সময় ফিরে আসে মনে। অতনুর ছবি দেখতে দেখতে তাইই এল। মনে হলো ময়ূরাক্ষী যেন লকডাউনের ছবিই। বিস্মৃতি, একটি জানালা, অসুখী জীবন… লকডাউন থেকে মানুষ মুক্ত হবেই।
কিন্তু এও সত্য হয়ত আগামীকাল পৃথিবীতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। এখন অবধি পৃথিবীতে মৃতের সংখ্যা ৫০,০০০ এর উপর। ভারতে একদিনে ৪০০-র উপরে। আমাদের কি সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে ? ভয় গ্রাস করে নিচ্ছে ক্রমশ। এর ভিতরে পুরুলিয়ায়, কেরালার কোথাও চন্দন কিংবা যদুবাবু আর্তের সেবা করছে। দিন মজুরদের অন্ন সংস্থান করছে। মানুষের সকলে আমাদের মতো ফেসবুকসেবী নয়। উত্তরাখণ্ডের দেব প্রয়াগ জেলার গণেশ ভাট নিজের গাড়িকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে ফেলেছে। এইভাবে দিল্লি, ইন্দোর, তিরুপতি, নাগপুর সর্বত্র কিছু মানুষ এই অদৃশ্য ঘাতককে প্রতিরোধ করতে অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এমন হয়েছে ইন্দোরে কোভিড-১৯ খোঁজ করতে গিয়ে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী পুলিশকে আক্রমণ করছে একদল মানুষ। উন্মাদ এরা। এদের কে বোঝাবে ? না বোঝান গেলে বন্দুকের মুখে শাসন করতে হবে। যে মানুষ বাঁচতে চায়, তাকে মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করার অধিকার নেই কারো। গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়ে গেলে কী হবে? মানুষ কি জীবনের নিভৃতি ভুলে গেল। একটু একা হলে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান যায় না ? ঘরে থাকা মানে তো নিঃসঙ্গ থাকা নয়।
আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে মাসের পর মাস একা থেকেছি। গ্রামে গঞ্জে। তখন গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, তাদের কথা শুনতে শুনতে হাটে যেতাম, মেলায় যেতাম। আসলে তো একাই। এক বরষার দিনে ধান রোয়া করতে জমিতে নেমেছি। কীভাবে করে বুঝব। সাঁওতাল কামিনদের কী হাসি। পুরুষটি শিখিয়ে দিতে লাগল কী করে গোছ ধরতে হয়, জলে ডোবা ক্ষেতে পরপর গেড়ে দিতে হয় বীজতলা থেকে নিয়ে আসা ধান, ব্যান বলত মনে হয়, ভুলে গেছি। একা জীবন ছিল সতেজ সতেজ, সবুজ সবুজ। তখন যেন সহস্র মাইল দূরে কলকাতা। নতুন লেখা গল্পটির কথাও কাউকে বলা বা পড়ে শোনান যেত না। চিঠি লিখতাম প্রভাত চৌধুরী, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, শচীন, সমীরকে। বাসে উঠে পাশকুড়া বা খড়্গপুর পৌঁছাতে পারলে মনে হত কলকাতা যাচ্ছি। বন্ধু আর মা বাবা ভাই বোনদের পাব। একা আমি থাকতে পারি। একা থাকার অন্য আনন্দ আছে। তখন কিন্তু ফোন, মোবাইল ফোনের কোনো সুযোগ ছিল না। আমার একটি রেডিওও ছিল না। মনে হয় ট্রাঞ্জিস্টার অত প্রচলিত হয়নি ১৯৭৫, ৭৬,৭৭, এই সময়। ইলেক্ট্রিক ছিল না সেই সব গ্রাম গঞ্জে। হেরিকেনের আলো। লম্বা কাচের কেরোসিন ল্যাম্প৷ জনতা স্টোভ। ১৯৮০ তে একটি এইচ এম ভি ফিয়েস্তা রেকর্ড প্লেয়ার কিনতে পারি। ইলেকট্রিক পেলাম প্রথম। রেকর্ড কিনে কিনে নিয়ে যাই। দীঘায় সমুদ্রতীরে থাকি তখন। ওই রেকর্ড প্লেয়ার ছিল সঙ্গী। আর লাইব্রেরির বই। নিজেও কলকাতা থেকে ফেরার সময় বই নিয়ে যেতাম অনেক। এই একা থাকা নিশ্চয় লকডাউন নয়। কিন্তু সেই অভ্যাসে এখন তো খারাপ নেই। বাড়িতে আছি। পড়ছি। লিখছি। সিনেমাও দেখছি। অনেক সুবিধা এখন। এত সুবিধা দিয়েছে সভ্যতা। ঘরে বসে সিনেমা, ভাবাই যেত না। এখন যেন আমার কাছে ৪০/৪৫ বছর আগের পৃথিবী ফিরে আসছে। কারোর সঙ্গে দেখা হয় না। কফিহাউসে যাইনি কতদিন। টেলিফোনে , ভিডিওতে আড্ডা হচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে। কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
০৩.০৪
সন্ধ্যায় দেবেশ রায়কে ফোন করলাম। কানে যন্ত্র লাগিয়ে কথা শুনতে পাচ্ছেন। না হলে মেসেজ করে কথা হয়। ৮৫ বছর চলছে দেবেশদার। সদ্য লিখতে এসে তিন লেখকের সংস্পর্শে এসেছিলাম। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায় এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর প্রফুল্ল রায়, অতীন, সিরাজ, সুনীল…কতজনকে চিনেছি। দেবেশদার উপন্যাসে রুশ উপন্যাসের ব্যপ্তি থাকে। এখনো পড়েন। মাথা সচল রয়েছে। আমাকে বললেন, অমর আমার ভয় করছে।
কিসের ভয় দেবেশদা, মে-জুনের ভিতরে মিটে যাবে সব।
তুমি বলছ?
হ্যাঁ আমি বলছি।
তুমি কে বলছ? দেবেশ রায় জিজ্ঞেস করেন।
মার্কো পোলো।
দেবেশ রায় বললেন, ভেনিসের মার্কো, ভূ-পর্যটক, আরে তুমি কেন এখানে, পৃথিবীর পথে হেঁটে যাও, তিস্তাপারের খবর এনে দেবে আমাকে?
ইয়েস স্যার, তিস্তা, ভূটান পাহাড়, তিস্তাবুড়ি…সব খবর এনে দেব।
মার্কো আমার খুব সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে, পুরোন ছবি, যা অল্প বয়সে দেখেছি, তা, মারসেল্লো মাস্ত্রোয়ানি এবং সোফিয়া লোরেনের সিনেমা, সান ফ্লাওয়ার, লা দোলচে ভিতা, ফেলিনির ছবি, অ্যানিটা একবারগ ছিল, সোফিয়া লোরেনের সান ফ্লাওয়ার, ভিত্তোরিও ডি সিকার বাই সাইকেল থিভস যদি আর একবার ।
এসব দেবেশ বাবু বললেন, নাকি মার্কো তাঁকে তালিকা করে দিল নিজের দেশের বলে অনেকটা জানা থাকায়। একটা ছবি ছিল, ম্যারেজ ইতালিয়ান স্টাইল, দুজনেই ছিলেন, মাস্ত্রোয়ানি এবং সোফিয়া লোরেন…সোভিয়েত রাশিয়ার তারকোভস্কির ছবি, নস্টালজিয়া, স্যাক্রিফাইস…। মনে মনে দেবেশ রায়ের জন্য সিনেমার তালিকা করে দেতে লাগল মার্কো, তিনি চুপ করে শুনতে লাগলেন। আহা সত্যিই কি দেখতে পাব আবার?
জিজ্ঞেস করলাম, লিখতে পারছেন?
দেবেশবাবু বললেন, কী আর করব, সেই ইউসুফ জুলেখা লেখাটির শেষ পর্বটি লিখছি।
স্বপ্নের ভিতরে মরুভূমি পেরিয়ে জুলেখার খোঁজে যাওয়া। মার্কো বলল।
হ্যাঁ, তাই বললাম তোমাকে, ২৬শে মার্চ দেওয়ার কথা ছিল, ৪ তারিখে আহমেদাবাদ যাব ঠিক ছিল, আটকে গেলাম।
আহমেদাবাদে পুত্র থাকে। এই ফ্ল্যাটে তিনি একা থাকেন। দুজন পরিচারিকা ছিল। একজন বাড়ি গিয়ে আর আসতে পারেনি। যে আছে সে আমার মা অমর। তাকে বলি, তুই হাসপাতালে না গিয়ে আমাকে পেয়েছিস হা হা হা। ও দুয়েকদিন অন্তর বের হয়। কিনে নিয়ে আসে এটা ওটা। তুমি বেরিও না। একদম বেরবে না। আমি ভাবছিলাম চারতলার উপর সেই ফ্ল্যাটটির কথা। লিফট নেই বল্মীক আবাসনে। ঐ ফ্ল্যাটে এক সময় কত মানুষ। কাকলি বৌদি, দেবেশদার বৌদি, লেখক দীনেশচন্দ্র রায়ের স্ত্রী, তাঁর বৌঠান, পুত্র, ভাইঝি। এখন একা। আছে দেওয়ালজুড়ে বইয়ের তাকে বই। বইয়ের সঙ্গেই যেন কথা বলেন। রুশ লেখকরা নেমে আসেন বুক সেলফ থেকে। ওভারকোট, হ্যাট, লংকোট পরা গোগোল, পুশকিন, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি …তিনি তাঁদের সঙ্গে গল্প করেন। উপন্যাস নিয়ে কথা বলেন।
খবরিয়ার প্রতিবেদন:
আমার জানালার বাইরে জলের রিজার্ভার। সেখানে রৌদ্র। দূরে কয়েকটি কুকুর ডেকেই যাচ্ছে। রিজারভারের উপর একটি বেড়াল ঘুমিয়ে। জানালায় সাফাই কর্মী নির্মল। নির্মলের বাবা এক মাস আগে মারা গেছেন। এখনো মাথা চুলে ভরে ওঠেনি। আমার প্রশ্নে বলল, খাওয়া পাচ্ছে, দুদিন অসুবিধা হয়েছিল। একদিন আগরওয়াল বাড়ি থেকে রুটি তরকারি দিয়েছিল, কিন্তু তাতে বিল্টুদা খুব রাগ করেছে। চোটপাট করেছে বউদির উপর। আচ্ছা দাদা, আমি তো চাইনি, দিয়েছিল বলে নিয়েছিলাম…। শুনে মিতালি বলল, নির্মল প্রতিদিন সকালে তুমি এসে নিয়ে যেও, রুটি তরকারি তোমার জন্য থাকবে। পরের দিন নির্মলকে জানালার সামনে দেখতে পেয়ে ডাকলাম। ও নিয়ে গেল। তারপরের দিন ও আসেনি। অনেক বেলায় আমি জানালার ধারে দেখতে পেয়ে ডেকেছি, ও নির্মল, বউদি ডাকছে…।
নির্মল মিতালিকে বলেছিল, নিতে দরজায় এসেও সে ফিরে গিয়েছিল, লজ্জা করছিল।
মার্কো বলল, জয়িত্রী, একদিন তোমায় নির্মলের কথা বলব।
পুঁথি পত্রে যা লিখে রাখছি
যেদিন মেয়রের সময় হয়, মার্কো পোলো সেদিন তাঁর কাছে পৃথিবীর বৃত্তান্ত দিয়ে আসেন। মেয়র এক একদিন তাঁকে তলব করেন। আসুন এক দান দাবা হয়ে যাক। জয়িত্রী একদিন ছুটিতে যাক।
জয়িত্রী বলল, সে একা, ছুটিতে যাওয়া মানে একা ঘরে বসে থাকা। তার বান্ধবীরা রবিবারটিতে বেরয় বয় ফ্রেন্ড নিয়ে। কাফেতে যায়, অপেরায় যায়, পার্কে যায়, নদীর ধারে যায়, সেজান লেকে বোটিং করে, অথবা বাড়িতে জমায়েত করে, সকলেই কিছু কিছু নিয়ে আসে, কেউ বিরিয়ানি করে আনে, কেউ মাটন কিংবা বিফের একটা পদ, কেউ সব্জি, কেউ মিষ্টি নিয়ে আসে, আর ওয়াইন কিংবা হুইস্কিও কেউ নিয়ে আসে।
মার্কো বলেছে, এই রকম ঠিক নিউ ইয়র্কে দেখেছিলাম, কিন্তু এখন কি তা হতে পারে, এখন মানুষ কোথাও যায় না, ভয় পায়, কবে বেরবে ভ্যাকসিন, তার জন্য অপেক্ষা করছে, প্রতিদিনই কেউ না কেউ খবর দিচ্ছে , অমুক দেশে অমুক সময় বেরিয়ে যাবে ভ্যাকসিন, কিন্তু সমস্তটাই আশ্বাস।
তাহলে ঐ সব শহরের অপেরা হাউস? জয়িত্রী বলল।
অপেরা হাউস, রঙ্গালয়, সিনেমালয়, শপিং মল… সব ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে পড়ে আছে, আমি অবাক হয়ে ভাবি সেযান শহরে সেই ঘাতক প্রবেশ করেনি, এখানে কি ঈশ্বর বাস করেন?
জয়িত্রী বলল, না মেয়র বসত করেন, জয়িত্রী বসত করে, আমি শনি রবি বাড়িতে বসে অপেক্ষা করব অ্যালেক্স যদি ফোন করে, চেষ্টা করব তার সঙ্গে যোগাযোগের, না হলে শুধু ঘুমোব, আপনি মেয়রের কাছে যান দাবা খেলতে খেলতে গল্প করবেন, মানে কোন শহরে কীভাবে মানুষ মরছে, সেই কথা শোনাবেন, মেয়র তা পছন্দ করবেন, তিনি মৃত্যু সংবাদ পেতে চান মনে হয়।
খবরিয়া পেনসিলিয়া কী লিখল:
দুপুরে টেলিভিশনে দেখলাম ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৪ ঘন্টায় ৪০০-র কাছকাছি বেড়ে গেছে। মোট আক্রান্ত ২৯০০-র উপরে। মহারাষ্ট্রে আক্রান্ত বাড়ছে। ভয় মুম্বইয়ের ধারাবি বস্তি নিয়ে। সেখানে যদি এই ভাইরাস ঢুকে পড়ে ভয়ানক কান্ড হবে। কলকাতায় আমাদের বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজে এমন ঘিঞ্জি বসতি আছে। তা নিয়ে ভয়। তারা বিমানে করে আনবে না। কিন্তু যদি সংক্রামিত হয়ে যায় অন্য কোনোভাবে, তা হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর। টেলিভিশন এও বলল, করোনা আক্রান্তর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে জুনের মাঝামাঝি নাগাদ। সেপ্টেম্বর অবধি লকডাউন চলতে পারে। এই অনুমানের সূত্র আমেরিকার গবেষকদের মতামত। কী জানি এসব খবর দিয়ে চ্যানেলটি মানুষের আতঙ্ক কেন বাড়াচ্ছে। যা হবে কি হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই, তা টেলিভিশনে দেখিয়ে বুকে কাঁপুনি ধরান কেন? এর ফলে টেলিভিশনের ঐ চ্যানেল দেখা বন্ধ করতে হবে নাকি ? খবর না পেয়ে এসবও খবর ? খবরের আরো সূত্র স্যোসাল মিডিয়া। সেখানে এক দিগগজ লিখেছেন, ইতালিতে নাকি ৮০ বছরের উপর করোনা আক্রান্তদের হাতে প্যারাসিটামল ধরিয়ে দিয়ে গাছ তলায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবরের সূত্র কী? এমন ভয় দেখান পোস্ট করে তিনি ভাবলেন বড় কিছু দিলাম। তাতে একজন মত প্রকাশ করল, আমাদের এখানেও এমন হবে। হবে, তুমি জেনে বসে আছ ? ইতালিতে হয়েছিল এমন তা তোমাকে ইতালির সেই অসহায় বৃদ্ধ বলেছেন ? গাছতলায় বসিয়ে দেবে কেন পুজো হয়ে যাওয়া কার্তিক কী মা শেতলার মূর্তির মতো? তাঁর বাড়ি নেই। মিথ্যার সূত্র স্যোসাল মিডিয়া– হোয়াটস আপ, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি। সকলেই বিদ্যা ফলাচ্ছেন। সকাল থেকেই তাঁদের কাজ হলো নানা রকম ভিডিও, গুড মর্নিং, মনে কর শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর ইত্যাদি আপনার কাছে পাঠানো। এই মেসেজ হোয়াটস আপে কত পেলাম…। মৃতদেহ পথে পড়ে থাকবে…, আকাশ থেকে শকুন নেমে আসবে, সৎকার হবে না। আতঙ্ক তৈরি করেই আনন্দ।
এই আপতকালীন সময়ে মানুষের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকে এক কবিতা ঘুরছে, কখনো সেই কবিতার নাম শঙ্খচিল, কখনো তার নাম ‘মহামারী’। কখনো তা জীবনানন্দের কবিতা, কখনো তা শঙ্খ ঘোষের, কোভিড-১৯ এর মতো সে মিউটেট করেই যাচ্ছে। প্রতিপাদ্য হলো ‘ আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে…আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে…আমাদের দেখা হোক বীজানু ঘুমালে—ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রাবন্তী ভৌমিক জানালেন, এই কবিতা তাঁর বাবা শঙ্খ ঘোষের নয়। বাবার নামে যা ঘুরছে তা কে লিখেছে কেউ জানে না। ঘরে বসে যে যা পারছে করছে। এত ভিডিও, এত কার্টুন, এত সব ভুয়ো সংবাদ আসার বিরাম নেই। সংবাদ ভুয়ো হয় জানি। গুজব রটিয়ে এক এক গোষ্ঠী এক একরকম স্বার্থ সাধন করে। কিন্তু কবিতার গুজব এই জাতিই পারে।
সে কে? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করে।
সে এক কবি, কিন্তু অসফল জীবন, সব কবিদের উপর তার রাগ, থাকে বনগাঁ কিংবা চাকদা, আবার খোদ কলকাতা হতে পারে, বালিগঞ্জ কিংবা টালিগঞ্জ… সে কবিতা নয়, একটি প্যারডি লিখে শঙ্খ ঘোষের নামে ছেড়ে দিয়ে বলল, বেশ হয়েছে, ঘরে বসে এই ভালো। তারপর সেই কবিতা এমন একজনের কাছে গেল, সে নিজের নামে ছেড়ে দিল, সেই কবিতা এরপর কে একজন জীবনানন্দ দাশের নামে ভাসিয়ে দিল…, মানুষ ঘরে বসে এইসব করতে লাগল, বনগাঁ থেকে পুরুলিয়া অবধি। ম্যাঞ্চেষ্টারের ওয়াহিদ জালাল যখন মৃত্যু ভয়ে কাতর, বনগাঁ, কলকাতার মানুষ কবিতা লিখে নানা কবির নামে ভাসিয়ে দিতে লাগল আর মজা লুটতে লাগল। মজা যেমন এইভাবে হয়, তেমনি হয় কতরকমে। গো-চোনা পান করলে করোনা সারবে, মন্দিরে মানত করলে করোনা সারবে…। কাদার ভিতরে বসে থাকলে করোনা সারবে। চোরাবালিতে ডুবে গেলেও করোনা সারবে ! কী মজা মহামারিতে। হা হা হা। মানুষ তো আতঙ্কিত, তাই এসব বিশ্বাসও করতে লাগল কেউ কেউ।
জয়িত্রী বলল, মেয়র যদি অনুমোদন করেন তবে এসব হতে পারে, ওই শহরগুলির মেয়র চেয়েছিলেন এসব চলুক, মানুষের সব কিছুকে ঘোটালা পাকিয়ে দাও।
মার্কো বললেন, হতে পারে, একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায়। জয়িত্রী তার কথা শোনো। সে অমলেন্দু।
জয়িত্রী বলল, কিন্তু ওই যে কে বলেছিল ইতালিতে বৃদ্ধদের চিকিৎসাই করা হচ্ছে না, সত্য?
আমি তো আসিনি ইতালি থেকে, আমি তো যাচ্ছি ইতালির পথে।
আমি শুনেছিলাম বৃদ্ধদের জন্য এই ভাইরাসের সৃষ্টি, বৃদ্ধরা সমাজের বোঝা, পেনশনভোগী, তারা চলে গেলে দেশের ক্ষতি হবে না। জয়িত্রী বলছে।
কে বলেছিল তোমাকে?
হোয়াটস আপে মেসেজ পাঠিয়েছিল অ্যালেক্স, বলেছিল এই ভাইরাস তাকে মারবে না, তার স্যারকে মেরে দিয়েছে, তিনি জিনিয়াস জ্যোতির্বিদ ছিলেন, অলেক্সের গাইড, বাতাস না নিতে পেরে মারা গেলেন, এই ভাইরাস ফুসফুস খেয়ে ফেলে।
কত তরুণ আক্রান্ত হয়েছে জানো।
অ্যালেক্স যা বলে আমি তাই জানি।
তুমি অমলেন্দুর কথা শোনো, একটু আলাদা কথা, পৃথিবীতে কত রকম মানুষ আছে, তা এখন টের পাচ্ছি জয়িত্রী।
অমলেন্দু সরকার মস্ত ফ্ল্যাটে একা মানুষ। স্ত্রী নেই। পুত্র আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরে থাকে। কন্যা বিবাহের পর বারাসতে থাকে। খুবই সাধারণ জীবন তার। কাজের লোক সকালে রেঁধে দিয়ে যায়। কাচাকুচি, বাসন ধুতে আর একজন। এখন একজন আসছে না। রান্নার দিদি আসছে। বারণ করেনি। যদি আসে আসুক। না এলে ডাল আলু সেদ্ধ খাবে। ওষুধ ছিল না। একদিন বেলায় বেরিয়ে অনেক ঘুরে পেয়েছে। অমলেন্দু সরকারকে আমি এটি এম থেকে টাকা তুলে দিয়েছিলাম একদিন ভোরে। সে এসব ভালো পারে না। এই একা থাকার ভিতরে অমলেন্দুর আনন্দ ছিল দুবেলা বেরোন। হাঁটা। অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে প্রাতঃভ্রমণের সময়। তাদের নিয়ে হেঁটে, ব্যায়াম করে, বাজারে গিয়ে, সকালের ঘন্টা দুই-আড়াই ব্যয় হয়ে যেত। বিকেলে তার ব্যানারজিদা আছেন। তাঁর সঙ্গে ঘোরে। এই লকডাউনের কালে অমলেন্দুর হয়েছে খুব বিপদ। দুবেলা হাঁটা বন্ধ। একেবারে একা। সকালে বেরতে পারলেই তার নিঃসঙ্গতা কাটে। সকালেই আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। কথা হয়। অমলেন্দু সরকার আমার সিনিয়র ছিল। কদিন অমলেন্দুর ভালো ঘুম নেই। না হাঁটতে পারলে ঘুম হবে কী করে ? প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। রাতে অনেকবার উঠতে হয়। অমলেন্দু ফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার ঘুম হয় কি না, না হেঁটে ? হয়। অমলেন্দু বলল, তার হয় না। কিন্তু সে পরদিন আবার বেরবে। কেউ কেউ বেরচ্ছে। দূরে দূরে হাঁটছে। সে ও তা করবে।
কারো সঙ্গে কথা বলো না, কাছাকাছি যেও না। আমি উপদেশ দিলাম।
অমলেন্দু বলল, যাব না, গেলেই বা কী, ৭২ হয়ে গেছে…আমার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই, ছেলে কতদূরে আছে সেই ডেট্রয়েট, আমার বউমার সন্তান হবে, মে মাসে ডেট, কী যে হবে, ঘুম আসে না রাতে, ছেলে মানুষ করলেই বিদেশ পাঠিয়ে দিতে হবে, এ কেমন দিন এল, আমেরিকায় কী আছে, আমেরিকা তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুর আমার কী হবে। না হাঁটতে পারলে আমি ঘরে বসেই শেষ হয়ে যাব…, ভোরে আমি বেরবই, অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে পড়ব না হয়…।
শুনতে শুনতে জয়িত্রী বলল, তুমি কত মানুষকে চেন মার্কো।
মার্কো বলল, তোমাকেও চিনতে হবে, সাংবাদিকতা করবে, মানুষ না চিনে কী লিখবে। মুকুন্দলাল সাহা থাকেন শালবনি, বন পাহাড়ের দেশ, সেখানে এক নদী আছে, তার নাম তমালি, হাসিখুশি মানুষ, তাঁর হয়েছে জটিল অসুখ, ক্যান্সার পেশেন্ট, কলকাতায় দেখাতে আসতে হয়, রুটিন চেক আপ। না করলে উপায় নেই। খুব কষ্টের অসুখ যে। লক ডাউনে তিনি বাড়ি ছেড়ে আসতে পারছেন না। সব বন্ধ। সব। শেষে জেলার নারসিং হোমে ভর্তি হতে হল সাময়িক স্বস্তির জন্য। কিন্তু কলকাতায় না এলে বিপদ হয়ে যাবে। কী হবে কে জানে? নারসিং হোমে করোনা ধরা পড়েছে, তাঁকে বাড়িতে ফেরত আনতে হলো, অনেকের পরিবার তাঁদের, খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইরা সব পাশাপাশি থাকেন, গায়ে গা ঘেষে থাকেন, তারা বলতে লাগল, মেজদা, ভয় নেই, জেলা শাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, তিনি পারমিশন দিলেই কলকাতা নিয়ে যাব তোকে। মেজদা মুকুন্দলাল জানালা দিয়ে নির্মল আকাশে চেয়ে থাকেন, এই বাড়িতে বছর খানেক আগে তাঁরা একটি উৎসব করেছিলেন, কত মানুষ এসেছিল, আরো ভাই বোন যারা অন্যত্র থাকে, ঝাড়গ্রাম, বিষ্ণুপুর, লালগড়ে থাকে, কলকাতায় থাকে, জামাইরা, মেয়েরা, নাতি নাতনিরা, ভাগ্নে ভাগ্নি…বেয়াই বেয়ান্… সকলের মুখ মনে পড়ছে। বাল্যকাল, বনভূমি, প্রান্তর, দূরের পাহাড়…কলকাতা তাঁকে সুস্থ করতে পারবে না জানেন, কিন্তু গাড়িতে কলকাতা যাত্রা মানে রাস্তার দুপাশে ঘুমিয়ে পড়া দেশটিকে দেখতে দেখতে যাওয়া। তিনি কলকাতা যেতে চান, আবার ফিরেও আসতে চান।
০৫.০৪
মার্কো এসেছে মেয়রের কাছে। সেই বড় জানালা। বহুদূর অবধি দেখা যায় পশ্চিম। মেয়র দাবার বোর্ড পেতে সৈন্য সামন্ত সাজিয়ে নিচ্ছেন, মার্কোর মনে পড়ছে সেই অ্যান আরবর শহরের কথা…। সেই হিমেল বাতাস, বাড়ির সামনে তুষার জমাট বেঁধে আছে, মেয়র শুনুন।
অমলেন্দুর পুত্র যেখানে থাকে সেই ডেট্রয়েটের কাছে অ্যান আরবরেই বিশ্বদীপ থাকে। বিশ্বদীপ চক্রবর্তী ডেট্রয়েটের মোটর কারখানার ইঞ্জিনিয়ার। খুব ভালো গল্প লেখে। তার কোম্পানি বন্ধ। শাটডাউন। কারণ এখন মোটরগাড়ি বিক্রি হচ্ছে না। অ্যান আরবর মিশিগান শহর সংলগ্ন। মিশিগানে সংক্রমণ হয়েছে ভালো। অ্যান আরবরে কম। জনবসতি কম। ছবির মতো শহর। বাড়িগুলো দূরে দূরে। আমেরিকায় সবচেয়ে আক্রান্ত নিউইয়র্ক, লসএঞ্জেলস এবং সিয়াটোল। চিনের উহান থেকে সরাসরি বিমান যোগাযোগ ছিল এই তিন শহরের। উদ্ভ্রান্ত হয়ে আছে বিশ্বদীপ। বন্ধুরা থাকে ঐসব শহরে। অর্থনীতি ধসে যাচ্ছে। কী হবে ভবিষ্যৎ অজানা। আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করতে লাগল বিশ্বদীপ। খোঁজ নিতে লাগল। বলল, তুষারপাত হয়েই যাচ্ছে। ডেট্রয়েটে কালো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। তারা একসঙ্গে অনেকে থাকে। দারিদ্র তাদের সঙ্গী। বলতে বলতে বিষণ্ণ হয়ে গেল বিশ্বদীপ।
লস এঞ্জেলসের জীবন
যশোর ঝিনাইদহর ছেলে জীবন আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী। জীবনের পরিবার ঢাকায় থাকে। ঢাকায় থাকা অনেক সেফ। যাদের দ্বারা সে আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকায়, তারা তার পরিবারকে চিহ্নিত করতে পারবে না। জীবন ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আছে। গ্রিন কার্ডের জন্য অপেক্ষা করছে অনেকদিন। ভোরে ওদের দেশে যখন বিকেল তখন আমার ফোনে উল্লসিত হয়ে ওঠে গৃহবন্দি জীবন। লসএঞ্জেলস একটু উষ্ণ প্রকৃতির এলাকা। তাই হয়ত নিউইয়র্কের মতো অতটা হয়নি। জীবন লসএঞ্জেলস থেকে বলল, মরছে ইমিগ্রান্ট, হিস্পাহানিরা, গুয়াতেমালা, সান সালভাদর, পানামা, মেক্সিকোর মানুষ। তারা খুব পারিবারিক। তাদের অনেক ছেলেমেয়ে হয়। তাদের মেয়েরা বিয়ের আগেই সন্তান ধারণ করে ফেলে। তারা একসঙ্গে অনেকজন থাকে বলে তারাই মরেছে বেশি। বাংলাদেশি বা ভারতীয়রা কেউ মরেনি। তবে ব্ল্যাক আমেরিকানদের অবস্থা খারাপ। তারা আবার বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। তাদের মৃত্যুও তেমন হয়নি। সংক্রামিত হয়নি বলে। জীবন আগে চাকরি করত সেভেন ইলেভেন নামে এক বিক্রয় বিপনিতে। এখন করে আমাজনে সপ্তাহে দুদিন। আর এক জায়গায় তিনদিন। কিন্তু পনের দিন বিপনিতে যাচ্ছে না করোনার ভয়ে। ঐ শহরে সে একজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকে। বাড়িতে বসে অনলাইন কিছু করতে চাইছে। করছেও। সে আমাকে বারবার বলল, দাদা, বাইরে যাবেন না, একদম না। কতবার এক কথা বলল জীবন। দুদিনের পরিচয়। সে বলল, একটা গাড়ি কিনতে পেরেছে। দাদা আর একবার আসুন। আমি শর্ট ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত এদেশে। আমার সঙ্গে লাতিন আমেরিকান ইমিগ্রান্টদের যোগাযোগ আছে। আপনি আসুন দাদা। আমরা লকডাউনে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। কিন্তু আমরা আসলে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি আরো আরো। কোভিড-১৯ ভাইরাস আমাদের আরো একাত্ম করে দিয়েছে। জীবন কতবার যে বলল, দাদা, আপনি বেরবেন না। ভোরেও না। ঘরে থাকুন দাদা, ঘরে থাকুন।
আজ খবর পেলাম দক্ষিণ কলকাতায় রাতে শিয়াল, ভাম বেরিয়ে আসছে। দিনেও দেখা যাচ্ছে তাদের। রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় শিয়াল আছে অনেক। শব্দের ভয়ে তারা বেরোয় না। এখন সব নিস্তব্ধ। তারা নিশ্চিন্তে ঘুরছে ফিরছে। বন দপ্তর লক্ষ্য রাখছে। আজ হোয়াটস আপে নিউইয়র্কের টাইমস স্ক্যোয়ারের ছবি দেখলাম। খা খা করছে জায়গাটি। ওখানেই ব্রডওয়েতে নিউইয়র্কের বিখ্যাত নাট্যমঞ্চগুলি। সব বন্ধ। একজন ফেসবুকে তারাপদ রায়ের কবিতা পোস্ট করেছেন, একা মানুষ কতরকমে সময়কে পার করতে চাইছে। অনেকদিন পর তারাপদ রায়কে পড়ে বুক থম্থম করে উঠল।
এক জন্ম।। তারাপদ রায়
অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
কী হবে জানি না। সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বন্ধু তোমার সঙ্গে দেখা হবে কি হবে না, যদি হয় কবে হবে তা জানা নেই। বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। হয়েই যায়।
খবরিয়া পেন্সিলিয়া লেখেন
০৫.০৪
দুপুরে দেবাঞ্জন চক্রবর্তী ফোন করেছিল। একটি খবর দিল, আমাদের এই এলাকায় কৃষ্ণমল্লিক লেনে তার বন্ধুর দাদা কোভিড ১৯-এ মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর লালারস পরীক্ষার রিপোর্ট আসে পজিটিভ। তাদের পুরো পরিবারকে পুলিশ তুলে নিয়ে রাজারহাটে কোয়ান্টেরিনে পাঠিয়েছে। দেবাঞ্জনের ভাই খবর দিয়েছে দাদাকে। সে এখানে দেবাঞ্জনদের পুরোন বাড়িতে থাকে। আমি ভাবছিলাম ঐদিকে ডায়মন্ড টি সেন্টারে যাব চা আনতে। দেবাঞ্জনের কথায় কুঁকড়ে গেলাম। এত কাছে এসে গেছে ? দুপুরে আগাথা ক্রিষ্টির গল্প পড়তে পড়তে সব ভুলতে চাইলাম। পারলাম না। রেখে দিলাম আগাথা ক্রিস্টি। মহামারির ভয় চেপে বসছে। গত দুদিন ধরে পড়েছি গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ প্রণীত ‘ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’। প্রেম ও মৃত্যুর অভাবিত এক বিবরণ, যার সমস্তটাই বলে দেওয়া আছে, কিন্তু সমস্তটাই ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। আজ ৫-ই এপ্রিল। আজ রাত ন’টায় ঘরের আলো নিভিয়ে আলো জ্বালাতে বলেছেন ভারতের প্রধান মন্ত্রী। এখন সমস্ত দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিজামুদ্দিনের জমায়েত হোক, রাম নবমী হোক, সবেতেই জমায়েত হচ্ছে ভালো রকম। ধর্মে মাথা মুড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। জমায়েত থেকে কে কোথায় ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে লুকিয়ে পড়েছে তা খোঁজা হচ্ছে। কী দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ অজানা। কতদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে, জানি না। এখন এসব কেন বুঝতে পারছি না। সংকল্প, একাত্মতা কি এই ভাবে হয় ? মন বলছে এখন এই ধারাবাহিক মৃত্যর দিনে এসব ঠিক না। দুপুরে সিডনির তপনজ্যোতি মিত্রকে ফোন করলাম।আমার সদ্য যৌবনের বন্ধু তপনজ্যোতি বহুদিন ঐ দক্ষিণ গোলার্ধে। ছিল নিউজিল্যান্ডে বহুদিন। এখন অস্ট্রেলিয়ায়। আমাদের দুপুর তিনটেয় ওদের সিডনিতে রাত নটা। আগের দিন ২৪ ঘন্টা কাজ করেছে। ও ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্কিং সেকটরে কাজ করছে। সকাল দশটায় কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছে। এখন ওদের কাজের চাপ বেশি। ইস্টার পরব সামনে। না, সিডনি খোলা নেই। সমস্ত পরব বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ফরমানে। দিন পনের আগে ও বলেছিল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষের আতঙ্কের কারণে। আজ বলল, সব কিছু শান্ত হয়ে মেনে নিয়েছে মানুষ। প্রথম সকালে সিনিয়র সিটিজেনরা বেরবেন। তারপর অন্যরা। হ্যাঁ, ইস্টার পরব, ক্রিসমাস পরবে কেনাকাটা বেশি হয়। পরব বন্ধ হলেও অনলাইনে কেনাকাটা হচ্ছে। বেশ চাপ আছে। ঘরে থেকেই মানুষ উৎসব করবে। নানা কথা হতে লাগল। লকডাউনের সুফল ফলতে আরম্ভ করেছে। স্পেন, ইতালি, ব্রিটেনের মতো অবস্থা ভয়ানক হয়নি অস্ট্রেলিয়ায়। তাদের সিডনিতে। তপনজ্যোতি বলল, দেখ অমর, ভাইরাস, এই যমদূতের ঘুম ভাঙিয়েছি আমরা। এমন মহামারি কতবার হয়েছে পৃথিবীতে। আরো হবে। আরো। দূষণ, হিমবাহর গলন এসব শুনেছ তো, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। তপনজ্যোতি হিমবাহর নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলল আমাকে। নিউজিল্যান্ডে থাকার সময় আওরাকির মাউন্ট কুক ন্যাশানাল পার্ক দেখতে গিয়েছিল তারা। আওরাকি নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের দ্বীপভূমি। নিকটেই একটি শহর আছে ট্যাইজেল। মাউন্ট কুক নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পর্বতমালা। মাউন্ট কুক অঞ্চলেই গিয়েছিল তপনজ্যোতিরা। তারপর তাসমান হিমবাহ, হুকার হিমবাহ, লেক পুকাকি, লেক টেকাপো দেখেছিল। সবই হিমবাহ গলে জন্ম নিয়েছে। হেলিকপ্টার তাদের নামিয়ে দিয়েছিল হিমবাহর উপর। সে এক অনন্ত তুষার স্ম্রাজ্য। মাথায় অপূর্ব এক ঘননীল আকাশ। তার সঙ্গের গাইড বলেছিল, ছোটবেলায় তার ঠাকুরদার কাছে শুনেছিল, লেক ছিল না একশো বছর আগে, ঠাকুরদার ঠাকুরদা তাঁকে তাঁর বাল্যকালে বলেছিলেন তা। ছিল হিমবাহ, বরফের বিস্তার ছিল অসীমে। সেই বরফ গলে লেকের জন্ম হয়েছে। তপনজ্যোতি বলল, সেই প্রথম দেখার কুড়ি বছর বাদে আবার গিয়েছিল সেই লেক দেখতে। দেখেছিল লেকের বিস্তার বেড়েছে, আর সেই হিমবাহ দূরে সরে গেছে। কুড়ি বছরে অনেকটাই গলে গেছে তা। এই এক মাস, দেড় মাস, দু’ মাসের লকডাউন হয়ত কিছু দূষণ কমাবে। হিমবাহগুলির গলন কমাবে উষ্ণায়ন কমলে। তার বন্ধু এক জৈব বিজ্ঞানী তাকে বলেছে, আন্টারটিকায় হিমবাহর নিচে লক্ষ লক্ষ বছর যারা ঘুমিয়ে আছে, উষ্ণায়নে বরফ গলে গেলে, তাদের ঘুম ভাঙবে। সভ্যতার বিপর্যয় ঘটে যাবে তখন। তপনজ্যোতিকে ঘুমতে যেতে বললাম। ওদের ওখানে রাত অনেক। ঐ গোলার্ধে এখন শীতকাল আসছে।
কিছুই করার নেই। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি ফোনে। বই পড়ছি। স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে কথা বলছি। ভবিষতের কথা আন্দাজ করতে চাইছি। নেট অনুসন্ধান করছি। করতে করতে অনলাইন আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৮৯৮ সালের মহামারির কথা পেয়ে গেছি। প্লেগ মহামারি হয়েছিল। দলে দলে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছিল কলকাতা থেকে, সেই বিবরণ রয়েছে ‘ অনুসন্ধান ‘ নামে এক পত্রিকায়। সেই বিবরণ না শুনিয়ে পারছি না। খবরটি বেরিয়েছিল ১৩০৫ সালের ২৫শে বৈশাখ। কবির জন্মদিনে।
“কলিকাতার লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বৈভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা সঙ্গে লহিয়া শহর ত্যাগ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কী ধনী, কী নির্ধন, কী বৃদ্ধ, কী বালক, কী যুবক, কী যুবতী– সর্বসাধারণের সে আশঙ্কা, সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না। কেহ রেলওয়ে স্টেশন অভিমুখে, কেহ স্টিমার ঘাটে, কেহ নৌকা সন্ধানে, কেহ গড়িতে, কেহ পদব্রজে- যে যেরূপে যেদিকে সুবিধা পাইল সে সেইরূপ সেইদিকে ছুটিতে লাগিল।…সহস্র সহস্র লোক ভাগীরথীর বক্ষে হাওড়া স্টেশন অভিমুখে ছুটতে লাগল। স্টেশনে দুই হাজার করিয়া লোক বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। টিকিট কিনিয়াও স্থান না পাইয়া সেদিন ৫০০ লোক ফিরিয়া আসিল। অবস্থা বুঝিয়া রেল কোম্পানি নিয়মিত ট্রেন ব্যাতীত অতিরিক্ত তিনখানি ট্রেনের বন্দোবস্ত করিলেন। সমস্ত ট্রেনই পরিপূর্ণ হইয়া গেল। শেষে মালগাড়িতে লোক লইতে বাধ্য হইলেন। স্টেশন হতে পোল পর্যন্ত লোকের ভিড়ে চলাফেরা বন্ধ হইয়াছিল। শেষে গাড়ি, পাল্কি, নৌকা মেলা ভার হইল। অনেক পুত্র-পরিবার লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া হাঁটিয়া পলাইতে আরম্ভ করিলেন’। তখন গুজব রটে যে কোয়ারেন্টাইন জারি হবে।”
এই প্লেগ রোগেই স্বামী বিবেকানন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা আর্তের ত্রাণে পথে নেমেছিলেন। পরিস্কার করছিলেন কলকাতার পথঘাট। ১৮৯৬ সালের কথা।
না এখন কেউ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে না। বরং গৃহে বন্দি হয়ে আছে। কিন্তু আতঙ্ক একই। এখন পালাবার পথ নাই, যম আছে পিছে।
রাত ন’টার সময় আলো নিভিয়ে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালাতে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আলো কেউ নেভাল, কেউ নেভাল না। প্রদীপ কেউ জ্বালাল, কেউ জ্বালাল না। কিন্তু ন’মিনিট অতিক্রান্ত হলে যেভাবে শব্দ বাজি পুড়ল, আকাশ ভরে গেল আলোর বর্ণালিতে তা আমাকে গভীর বিমর্ষতার ভিতরে নিয়ে গেল। আবার মোমবাতি, মশাল নিয়ে মিছিল বেরল। গো ব্যাক করোনা, শ্লোগান শোনা গেল। দেশটা কেমন আমাদের? দেশের মানুষ কেমন? শিক্ষা কেমন ? হায়! একি বাজি পুড়িয়ে আনন্দ করার সময়? প্রকৃতি দূষিত হলো যে। সারাভারতেই তা হলো।
দূর লন্ডন থেকে বন্ধু, লেখক নবকুমার বসু বললেন, ‘আমরাও দূর দেশের ভারতীয়। মরণের পাড় ধরে হাঁটছি। তখনই দেশের কিছু মানুষ আলোর উৎসব করলেন! হায়।’
০৭.০৪.২০২০
আজ সাতই এপ্রিল। গত দুদিন ধরে আক্রান্তর সংখ্যা বাড়ছে। টেলিভিশন দেখতে ভয় লাগছে। একটি চ্যানেল ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, লকডাউন সেপ্টেম্বর অবধি চলবে। কোন মার্কিন সংস্থা বলেছে তা। এতে আমার প্রতিবেশি বিপন্ন পরিবারের গৃহিনী ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি, খুব ভয় করছে যে। তাঁর বয়স ষাটের উপর। স্বামী অসুস্থ প্রায়। বাজারঘাট তাঁকেই করতে হয়। অনেক ওষুধ লাগে। আনতে যেতে হয়। চাল-আটা তাঁকে বয়ে আনতে হয়। ফোনে মিতালিকে বলতে লাগলেন, খুব ভয় করছে মিতালি, অতদিন, আমি কি পারব? কাজের লোক নেই, সব করতে হচ্ছে আমাকে। আমিই না অসুস্থ হয়ে পড়ি মিতালি। আমি শুনে বললাম, অতদিন হবে না। আর ওই চ্যানেল দেখতে বারণ কর, ওরাই শুধু এইসব কথা বলছে। যদি হয় তো হবে। ধীরে ধীরে হবে। মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এখন থেকে অনুমান ভিত্তিক খবর না করলে মানুষের আতঙ্ক কমে।
নবকুমার বসু ব্রিটেন থেকে লিখল।
England is mourning while PM is transferred to the Intensive Care Unit at the St Thomas Hospital in London. Corona death rate is still going high.
ইংল্যান্ড শোকগ্রস্ত হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতালে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তরিত করার খবরে। করোনায় মৃত্যুর হার ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।
সিলেটের লেখক রুমা মোদক তার ভাসুরের মৃত্যু সংবাদ দিল। মিশিগানে তিনি প্রয়াত হয়েছেন কোভিড-১৯ এ। গত রাতে। কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতাল প্রায় বন্ধ, হৃদরোগে আক্রান্ত এক ব্যক্তির প্রয়ানের পর দেখা গেল তাঁর ভিতরে এসে বাসা বেঁধেছিল করোনা ভাইরাস। চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকরমী মিলিয়ে ৭৯ জনকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়েছে। অনেক রাতে টেলিভিশন খবর দিল, ৩০জনের লালা রসের রিপোর্ট এসেছে, সবই নেগেটিভ। আশ্বস্ত হলাম।
আবার এও জানা গেছে পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত, যাদের রিপোর্ট পজিটিভ, সেই ৬৬জন আক্রান্ত হয়েছে ৭টি পরিবার থেকে। গোষ্ঠী সংক্রমণ আরম্ভ হয়নি মনে হয়। মুম্বয়ের যশলোক এবং ওখহারড হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সকল ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকরমী কোয়ারান্টিনে।
এবারে শিরোনামে ফিরে এসেছে বাঙালির প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যাল। বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ৭০০ টাকা পুঁজি নিয়ে একদিন এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন।উনিশ শতকের শেষ দিকে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯০১ সালে তা লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালসই ভারতের প্রথম ওষুধ নির্মাণকারী সংস্থা। এই লাভজনক সংস্থাকে বিলগ্নী করণে পাঠিয়ে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। কিন্তু করোনার সংকট কালে ফের খবরের শিরোনামে বাংলার এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। মূলত ম্যালেরিয়ার জন্য ব্যবহৃত এই ওষুধ রোগ প্রতিরোধে সাহায্যকারী। করোনার মোকাবিলা করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের দ্বারস্থ হয়েছেন। ভারত সরকার এই ওষুধ রপ্তানি করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু যাই হোক আমেরিকায় এই ওষুধ পাঠিয়েছে। আর্ত সাহায্য চাইলে দিতে হবে। ওই দেশে প্রচুর ভারতীয় বসবাস করেন। একটা দায় আমাদের আছে। সরকার বলছে আমাদের যা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশিই আছে। ভারত পরে ইংল্যান্ডে প্যারাসিটামল পাঠিয়েছে। বাংলাদেশেও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পাঠিয়েছে।
মহামারি যুগে যুগে বহু মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। মহামারি কি মানুষের সংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করে? মহামারি না হলে, পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি জমি কি ভরে যেত মানুষের পদচিহ্নে? অত মানুষের খাদ্য কোথা থেকে আসত? দেখছি না, ধান জমি নষ্ট করে কীভাবে নগর পত্তন হয়েছে। হয়েই যাচ্ছে। হিমবাহ গলনের কথা তো আগেই বললাম। এখন হিশেব নিই মহামারি কীভাবে শেষ করেছে মানুষকে। সিন্ধু সভ্যতা, ব্যবিলনীয় সভ্যতা, বিলুপ্ত সভ্যতা কি মহামারিতেই বিলুপ্ত হয়েছিল?
মানব ইতিহাসে, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং টিউবারকিউলোসিস, যক্ষা এসেছিল বন্য প্রাণীকে গৃহপালিত করে তোলায়। অনেক মহামারি অনেক নগরকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। খ্রীস্ট জন্মের ৪৩০ সাল থেকে ৪২৬ সাল, গ্রিস এবং স্পারটার যুদ্ধের সময় এথেন্স নগরে প্লেগ এবং টাইফয়েডে এক চতুথাংশ মানুষ মারা যায়। ২০০৬ সালে এথেন্স নগরের গবেষকরা এথেন্স নগরের গণকবর খুঁড়ে মানুষের দাঁত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা টাইফয়েড ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন।
খ্রিস্ট পরবর্তী ১৬৫ থেকে ১৮০ সাল সময়সীমায় আন্তোনীয় প্লেগ নামে অভিহিত, আসলে যা ছিল গুটি বসন্ত, সেই মহামারিতে ৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। মহামারি সব সময় কেউ না কেউ বহন করে আনে। এখন এসেছে তা বিমান বাহিত হয়ে, তখন এসেছিল নিকট পুবের দিক থেকে ফিরে আসা রোম সম্রাটের সেনাবাহিনির সঙ্গে। প্রাচীন রোমক ঐতিহাসিক দিও ক্যাসিয়াস লিখে গেছেন, সেই মহামারিতে রোম নগরে প্রতিদিন ২০০০ মানুষ মরছিল। রোম সম্রাট লুসিয়াস ভেরাস এই মহামারিতে ১৬৯ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
মার্কোর কাছে মেয়র মহামারির কথা শুনছেন। মহামারির কথা শুনতে শুনতে দাবায় মন বসে কি।
মার্কো জিজ্ঞেস করলেন, মাননীয় মেয়র, সেজান শহরে কোভিড-১৯ প্রবেশ করেনি কেন?
আমরা বৃদ্ধদের সব সরিয়ে দিয়েছিলাম আগে, ফলে নগরে ঢুকে দিশাহারা হয়ে কোভিড মরে গেছে, আমাদের শহর কোভিড-১৯ ভাইরাসের বেঁচে থাকার অনুকূল নয়, উৎস ধ্বংস করেছি।
সেই বৃদ্ধরা কেমন আছেন?
খুব ভালো, তাঁদের আইসোলেশনে থাকতে হবে যতদিন ভ্যাকসিন না বেরোয়।
যুবক যুবতীদের হবে না, এই গ্যারান্টি কি আছে?
তাদের সঠিক ইমিউনিটি আছে, প্রতিরোধের শক্তি আছে। মেয়র দাবার বোড়ের ঘর বদল করতে করতে বললেন।
আমাকে জয়িত্রী এসব কিছুই বলেনি।
জয়িত্রী আপনাকে কিছু বলবে না, আপনিই তাকে বলবেন, জয়িত্রী আপনার কাছ থেকে পৃথিবীর খবর
নেবে যা তা লিখবে, সাংবাদিক খবর নেয়, খবর দেয় না।
মার্কো বলল, আমি কি একবার বৃদ্ধাবাসে যেতে পারি ?
মেয়র বললেন, না, আমাদের শহরে বৃদ্ধদের জন্য আলাদা উপনগর গড়া হয়েছে, প্রবেশ করা যাবে না অন্তত দু’বছর, তাঁদের সুরক্ষার জন্যই এই নিয়ম।
মার্কো চুপ করে থাকলেন। তাঁর কত বয়স তিনি জানেন না। তিনি বৃদ্ধ না যুবক, নবীন না প্রবীণ জানেন না। আর মেয়র। মেয়রের বয়স ধরা যায় না। কখনো মনে হয় নবীনকান্তি এক যুবক, আচমকা মনে হয় তাঁর ভিতরে অনন্ত বার্ধক্য লুকিয়ে আছে। মার্কো দাবার চাল না দিয়ে উঠে পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করল, তাহলে বিমর্ষতার কোনো কারণ নেই?
মেয়র বললেন, না, নেই, কোনো বিমর্ষতার কারণ নেই, আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি ভাইরাস, বয়স ও নিয়ন্ত্রণ করেছি অনেক, সেযান শহরে মানুষের বার্ধক্য আসতে সময় নেয়, ইমিউনিটি কমতে সময় নেয়, তুমি বৃদ্ধ কম দেখবে, দেখতেই পাবে না সেযান শহরে, উপনগরীতে যাদের রাখা হয়েছে, তাঁরা নড়বড়ে, অনেক বছর ধরে বৃদ্ধ হয়েছে, এখন ভাইরাস তাদের শেষ করে দিতে পারে, যে কোনো সময়ে কিছু হয়ে যেতে পারে, তাঁরা আমাদের সম্পদ, এক সময় দেশকে দিয়েছেন অনেক, আমরা তাঁদের ভালো রেখেছি। ভালো রাখা আমাদের দায়িত্ব।
মার্কো পোলো সেদিন একটা শহরের স্বপ্ন দেখলেন। সেখানে শিশুরা সব চুপ করে বসে আছে পথের ধারে, বাগানে, পার্কে, লেকের ধারে। শিশু নয় তারা বৃদ্ধ। বৃদ্ধরা তাদের বার্ধক্য নিয়ে শিশু হয়ে গেছে অথবা শিশুদের গ্রাস করেছে বার্ধক্য। এই স্বপ্ন অনেকদিন বাদে দেখলেন ভূপর্যটক।

কথাসাহিত্যিক
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১ বাংলা দেশের সাতক্ষীরার কাছে ধূলিহর গ্রামে। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবন কাটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক দপ্তরে। তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তর থেকে। এ ব্যতীত ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ( ভাগলপুর ), ১৯৯৮ সালে সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার স্বদেশযাত্রা গল্পের জন্য। ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে সমস্ত জীবনের সাহিত্য রচনার জন্য যুগশঙ্খ পুরস্কার, ২০১৮ সালে কলকাতার শরৎ সমিতি প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং গতি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে প্রথম ভারতীয় লেখক যিনি গাঁওবুড়ো গল্পের জন্য ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছেন।