ইরাবতী উৎসব সংখ্যা উপন্যাস: ট্রয় শহরের মেয়েরা । অদিতি ফাল্গুনী
পসেইদনঃ সমুদ্রের দেবতা আমি। ইজিয়ানের নোনা গর্ভ হতে উত্থিত, যেখানে মৎস্যকুমারিরা রেশমি ছন্দে নৃত্যপরায়ণা, প্রিয় বর্শায় বিক্ষত, শামান্দার নদীর রাত বিলাপে আর্ত, বন্দি ট্রোজান রমণীর কান্নায়। গ্রিক প্রভুরা তাদের নিয়ে যাবে আর্কাদি, থেসালি নারী যত গ্রিক নগরে, এথেন্সের প্রভু থিসিয়ুস পুত্রও ক্রীতদাসী হিসেবে পাবেন কিছু ট্রোজান রমণী। একদা সুখী ট্রয়! বিদায়!
(পসেইদন ফিরে তাকতেই দেবী প্যাল্লাস এথেনা আবির্ভূত হন।)
ফোন বাজছে। বিমলকান্তি মিত্র বিরক্ত হন। উফ্, এথেনার সঙ্গে এখন পসেইদনের বাদানুবাদ হবে। এথনা বিজয়ী গ্রিকদের রণদেবী আর পসেইদন পরাজিত ট্রোজানদের সমুদ্র দেবতা। আর, এখন কিনা … নির্ঘাৎ সুহাসিনীর ফোন…সংসারের একঘেয়ে কথাবার্তা চলবে…তবু, সুহাসিনী বলেই আজ নয়টা বছর ধরে… কলেজ কমিটির প্রেসিডেন্ট তাঁর বিরুদ্ধে তহবিল আত্মসাতের মিথ্যে মামলায় ঝুলিয়ে… কেস অবশ্য প্রমাণ করতে পারেনি। দেড় বছর হল হাইকোর্টের রায়ে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবার পর, দশ মাস আগে গত সাড়ে সাত বছরের প্রতি মাসে না পাওয়া অর্ধেক বেতন পুরোটা কলেজ কমিটি তাকে দিতে বাধ্য হওয়ায় সেই টাকায় রাজার চরে ঝুরঝুরে দোতলা দালান করা গেছে… এই সব ধকল সুহাসিনীর মতো আর কোন্ মেয়ে সামলাবে? আমেরিকায় থাকা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বদলে সুহাসিনী তাঁর গলায় মালা দিয়ে নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটন ডি. সি. দূরে থাক, ঢাকাও জীবনে চোখে দেখতে পেল না। এমনকী নয় বছর অর্ধেক বেতনে চলতে গিয়ে বউ, মেয়ে আর ছোট বোনটাকেও গ্রামে রাখতে হয়েছে তাঁকে। গ্রামে থেকেই মেয়ের ম্যাট্রিক আর বোনের ডিগ্রি পরীক্ষা হলো আপাতত। চাকরিটাই চলে যাবার কথা ছিল। কলেজে তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয়তা আর শুরু থেকেই মামলার কাগজপত্র নিরেট জাল প্রমাণিত হতে থাকায় চাকরিটা থেকে গেছে। একদম জেলা শহরে দেওয়ানি আদালতে শুরুতেই কলেজ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত। সে সময় তাঁর ছ”মাসের মতো সাসপেনশনও গেছে। তারপর চাকরিতে ফেরত তবে অর্ধেক বেতন ও বিনা প্রমোশনে । কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়েছে। প্রমোশনও আটকে ছিল তাঁর। সেই প্রমোশনও পাওয়া গেছে। এবার পুজোর পর মেয়ে, ছোট বোন আর বউকে রাজারচরের গ্রামের বাড়ি থেকে এই জেলা শহরের বাসায় নিয়ে আসতে হবে।
“হ্যালো… সুহা, কী খবর? সব ভালো তো?”
“হ্যাঁ… শিবু বলল আগামী মাসের বারো তারিখ নতুন দালানের গৃহ প্রবেশ অনুষ্ঠান। তারপর মায়ের পুজোটা শেষ করেই আমরা সবাই তো তোমার সাথে ফিরছি, না?”
শিবু, শিবপ্রসাদ। ঠাকুর্দার আমলের গোমস্তা হরিদয়ালের নাতি শিবপ্রসাদ আর তার পরিবারই গ্রামে পড়ে থাকা তার মা–বউ–বোন–মেয়েসহ সেই আদ্যিকেলে পোড়ো দালান আর মন্দিরটা দেখেশুনে রাখছে। এমন বিশ্বস্ত মানুষ কমই দেখা যায়।
“হ্যাঁ, ভগবানের ইচ্ছায় সেরকমই… একটা জীবন অনেক কষ্ট হল তোমার! শান্তা আর মণিকা কই?”
“আছে… ওরাও এখন থেকে তোমার সঙ্গে থাকতে পারবে ভেবে লাফাচ্ছে! কলেজ ছুটি হবে কবে থেকে?”
“এখনতো গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটি এমনকি রোজার ঈদের ছুটি পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। এই সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে!”
“আজ এগারোই সেপ্টেম্বর। তাহলে ধরো আর দিন দশেক পরই তো আসছো?”
“হ্যাঁ, তেইশ তারিখ আসব। শান্তা আর মণিকা আছে নাকি কাছে?”
“না, আমি একটা কাজে কালুকে নিয়ে এই চরমোনাই এসে তোমাকে ফোন করছি। রাজারচরে তো কোন ফোনের দোকান নেই!”
“তা ঠিক। চিন্তা কোরো না। আমি আর দিন দশেকের ভেতরই আসছি!”
ওপারে ফোন রেখে দেয় সুহাসিনী। এবছরই নববর্ষে তাঁর দেওয়া নীল শাড়িটার মায়াভা কি সুহাকে ঘিরে? সুহা গৌরী। বাঙালি মেয়েদের হিসেবে লম্বাও।! শান্তাও মায়ের চেহারা পেয়েছে। সুহাকে ট্রোজান নারী হিক্যুবার চরিত্রে অভিনয় করতে দিলে কেমন হবে? নাহ্, প্রাণে ধরে নিজের স্ত্রীকে তিনি তাদের শহরের “বৃন্দ নাট্যগোষ্ঠি”র আর দশজন ছেলের সামনে অভিনয় করতে দিতে পারবেন না। এছাড়াও প্রিয়ামের স্ত্রী হিক্যুবা বৃদ্ধা। সুহাকে রাজবধূ হেলেন বা রাজকন্যা কাসান্দ্রা না হোক, ট্রোজান বীর হেক্টরের বিধবা স্ত্রী এ্যান্ড্রোমেকের চরিত্রে অভিনয় করানো যায়। সুহা… সুহাসিনীর বয়স আটত্রিশ। শান্তা একমাত্র মেয়ে, এবার পনেরো হল। নিজের বয়স চুয়াল্লিশ। ছোট বোন মণিকা এবার গ্রামে থেকেই ডিগ্রি দিয়েছে। মণিকার বয়স বাইশ। রাজারচর গ্রাম হতে চরমোনাই উপজেলা এমনকী কখনো কখনো এই জেলা শহরে এসেও সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে একটা/দু’টো অনুষ্ঠান করে যায়। ঢাকায় থাকা বি.সি.এস, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারের পাত্রের সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মণিকাও গররাজি নয়। মণিকা… আহ্, নিজের ছোটবোন যদিও… তবে, নাট্যকারের চোখ হতে দেখলে…মণিকাকে হেলেন চরিত্রে মানায়। তাঁর একষট্টি বছরের বৃদ্ধা মা খনারাণী, যিনি কলকাতায় তাঁর ছোট দুই ভাইয়ের কাছে থাকেন, তিনিও বেশ সুশ্রী।
হ্যাঁ, খনারাণীকে হিক্যুবা চরিত্রে দেওয়া যায়। আসলে তাঁদের পরিবারের রূপের সুনাম আছে। কলেজে ষোল বা আঠারো বছরের মেয়েরাও … বলতে গেলে তাঁর নিজের মেয়ের বয়সি মেয়েরাও… মাঝে মাঝে তাঁকে পরীক্ষার খাতা বা হোম ওয়ার্কের নোট জমা দিতে প্রেমের চিরকুট জমা দেয়। ১৯৪৯ সালের বঙ্গীয় প্রজাসত্তা আইন পাস হওয়ার আগে অবধি চরমোনাইয়ের রাজারচর গ্রামের ও আশপাশের কিছু এলাকার জমিদার ছিলেন তাঁরা। প্রায় দেড়শো বিঘা জমি সরকারের হতে চলে গেছে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইনের আওতায়। রাজারচরের পাশের গ্রামে তারাপাশার মেয়ে সুহাসিনী। সুহাসিনীর ঠাকুর্দা ছিলেন কাঠের ব্যবসায়ের কারবারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোরা সৈন্যদের রসদ সাপ্লাই করে রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। সুহাসিনীদের বাড়িতে আজও দুর্গাপুজো বড় করে হয়। পালদের ডেকে বড় প্রতিমা বানানো ছাড়াও দু/তিনশো বছরের পুরনো অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা আছে তাদের। একাত্তরে বিমলকান্তির বড় জ্যাঠা গুলি খেয়ে মরলেন আর চুয়াত্তরে ছোট কাকা জবাই হলেন। এরপরই বাবা বাকি ষাট বিঘা জমির চল্লিশ বিঘা জলের দরে বিক্রি করে বিমলের ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ওপারে গেলেন। বাবা মারা গেলেন পঁচাশি সালে। ওপারেই। মৃত্যুর বয়স যদিও তখনো হয়নি। মা এর পরপরই ছোট দুই ভাইয়ের ওখানে চলে গেলেন। ছোট দুই ভাইই ওপারে থাকে। একা বিমলকান্তি গত নয় বছরের কুৎসিত মামলা, আধা বেতনের চাকরি, বউ–মেয়ে–বোনকে গ্রামে ফেলে রেখে নিজে শহরে একটা ভাড়া বাড়িতে এক রুমের ঘরে প্রায় ব্যাচেলর জীবন যাপনের যন্ত্রণার পরও কেন জানি বাংলাদেশ ছাড়তে পারলেন না। একটু বামপন্থী রাজনীতি, একটু কলেজের ইংরেজি শিক্ষকের সুনাম, সামান্য অনুবাদ কাজের প্রয়াস… নানা কাজের প্রমোদে ও প্রমাদেই হয়তো দেশ ছাড়তে পারেননি। টিউশনি তেমন করেন না। এক ব্যাচ দু”ব্যাচ। না হলে এই অর্ধেক বেতনে সংসার চালানো যেত না। তাঁদের কলেজটি সরকারি নয়। সরকারি চাকরি তিনি পাননি। বাংলা ইংরেজিতে চোস্ত হলেও অঙ্কে বরাবর কাঁচা। দু/দু”বার পিএসসি”র পরীক্ষা প্রিলিমিনারি টেস্টে নৈব্যক্তিক গণিত সবই ভুল করেছেন। ঢাকা গিয়ে নতুন কোন চেষ্টা করা বা শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোন কাজের চেষ্টাও হয়নি…তিনি কি কিছুটা নিরুদ্যম প্রকৃতির? এই তো হাইকোর্টের রায় পক্ষে যেতেই এক/দু”ব্যাচের টিউশনি ছেড়ে দিলেন। এখন শুধু লেখা আর পড়া। ওপারে দুই ভাইয়ের বাসায় মাঝে মাঝে বেড়াতে যান। তাঁর দম আটকে আসে। গত দুই কী আড়াই দশকে মায়ের পেটের ভাইদের বাংলাও এমন পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা হয়েছে বলার না! ভাইদের বউরা ঘটি। ডাল–তরকারি–মাছ–মাংস… সবকিছুতেই দই আর চিনি দিয়ে রান্না করে তারা। তাঁর খেতে কষ্ট হয়। রাস্তায় হিন্দিতে কথা বলো! হিন্দি তিনি বলতেই পারেন না। তাঁর ছোটবোন বা মেয়েরা পারে অবশ্য। ওরা গ্রামে ব্যাটারি চালানো টিভিতে হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়াল দেখে দেখে পাকা। নেহাৎ মায়ের পেটের ভাই বলে তাদের দেখতেই বছর দু”বছরে এক/আধবার কলকাতা যাওয়া হয় তাঁর। গিয়েই ছটফট লাগতে শুরু করে। কতদিনে বাংলাদেশ ফিরবেন। ওপারে জায়গা জমি কেনা বা বাড়ি করার কথা এত দুঃখেও ভাবতেও ইচ্ছা করে না তাঁর।
“ধন্য দেশপ্রেম আপনার!এই শত্রুতার মুখেও এ দেশেই থেকে গেলেন!” জুলহাস তার হাতে গোনা কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীর একজন। প্রায়ই বলেন, “আগে ভাবতাম, হিন্দু মানেই স্বার্থপর। এপারের টাকা ওপারে পাচার করে। কিন্তু আপনাকে দেখলাম একেবারেই আলাদা মানুষ। আমি নিজে হলে তো এত ক্ষতি সয়ে পড়ে থাকতাম না। যে দেশ এত ক্ষতি করে, তার কাছ থেকে শত হাত দূরে চলে যেতাম! সত্যি রে ভাই!”
“আমার একার বিরুদ্ধেই তো মামলা না। কর্তৃপক্ষ তো আরো দু’জনের এগেইনস্টেও মামলা দিয়েছিল। তাদের একজনের দোষ থাকলেও অপরজন তো নির্দোষ এবং এই দু’জনই তো মুসলিম।”
“হ্যাঁ উলফাত সাহেব নির্দোষ ছিলেন। আসলে আমজাদ সাহেবের দোষে তার সঙ্গে জড়িয়ে আপনাদের দু”জনকেও অথরিটি কেন জড়িয়েছিল আল্লাহ্ মালুম। কিন্তু, কই? উলফাত সাহেব কি আর আপনার মতো সহ্য করলেন? বড় ভাইয়ের কাছে সৌদি আরব চলে গেলেন। মামলা চলা অবস্থায় কী ভাবে দেশান্তরী হলেন। আজকাল কী না হয়! এখন নাকি ওদেশে একটা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক। আরবরা বাচ্চাদের ইংরেজি পড়ানোর মানুষ খোঁজে। আপনি তো ইন্ডিয়া যেতে পারতেন। আপনার দুই ভাই আছে না ওখানে?”
“আমি কুয়ার ব্যাঙ রে ভাই । ইন্ডিয়া কেন, আমি ঢাকা পর্যন্তও যেতে পারব না!”
কলিং বেল বাজে। সারোয়ার, মোস্তাফিজ আর অরিন্দম এসেছে। সবাই “বৃন্দ” নাট্যগোষ্ঠির সদস্য।
“অনুবাদ কতদূর বিমলদা? অক্টোবরে পূজা উপলক্ষেই নামানো যাবে না?” সারোয়ার প্রশ্ন করে।
অরিন্দমের মুখ শুকনো, “শহর থেকে একটু ভেতরেই… গ্রাম বা ইউনিয়ন তো বটেই… উপজেলাগুলো থেকে পর্যন্ত কিন্তু বাজে সব সংবাদ আসছে। আমার পিসির বিয়ে হয়েছে মাগুরায়। পিসেমশায়কে স্থানীয় বিএনপি না জামাতের ক্যাডারদের পক্ষ থেকে দু’লাখ টাকা চাঁদা দিতে বলেছে। এক সপ্তাহের ভেতর না দিতে পারলে মেয়ে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিচ্ছে। পিসি আজ সকালে ফোন করে বাবার কাছে কী কান্না! এছাড়া ভোট দিতে যেন না যায়, গেলে প্রাণে মারা হবে… এ ভয় দেখানোও তো আছেই!”
“বাহ, অরি দেখি হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ক্যাম্পেইন শুরু করলো।” মোস্তাফিজ টিপ্পনি কাটলো!” সারোয়ার ধমকায়, “মোস্তাফিজ! তোরা পিকিংপন্থী লেফটরা শেষপর্যন্ত ঐ বিএনপি জামাতকেই ক্ষমতায় আনিস। আন… ইসলামি বিপ্লব কর… তাহলে আবার নাটক করতে আসিস কেন?”
“আহ… থাম তো”!” বিমলকান্তি এই তিন যুবকের চেয়ে বয়সে বড়ো। সে হিসেবেই ধমকান। এই তিনটি ছেলের ভেতর মোস্তাফিজ্ই সবচেয়ে মেধাবী ও তার সাথে কথা বলেই তিনি সবচেয়ে আরাম পান। আওয়ামী লীগ বা রুশপন্থী কমিউনিস্টদের হাজারটা সীমাবদ্ধতা তিনি নিজেও জানেন বা মানেন। কিন্তু মোস্তাফিজের এত পড়াশুনা আর মেধা কেমনভাবে মাও রচনাবলী আওড়ানো শুরু করেও শেষমেশ খালেদা জিয়া তো বটেই, কখনো কখনো দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রাজনৈতিক অবস্থানও সমর্থন করে বসে, এটাই তাঁর কাছে একটা ধাঁধা।
মোস্তাফিজ বিমলকান্তির সামনেই সিগারেট ধরায়, “বিমলদা, এই সব বাজে রাজনৈতিক তর্ক বাদ দিই। আপনার অনুবাদটা একটু শোনান না!” বিমলকান্তি খুশি হন। রাজনীতি নিয়ে তিনি নিজেও খুব একটা বিচলিত হতে চান না।
হিক্যুবাঃ তবে, উত্থিত হও এবার ভূমিশয্যা হতে– হে উদ্বিগ্ন, প্রৌঢ়া মস্তক, ওহ্ ভগ্ন কন্ঠদেশ। মাতৃভূমি পরাস্ত আর নিহত স্বামী ও পুত্রসকল, রাজবংশের সকল গৌরব বিনষ্ট, পরাভূত।
প্রথম নারীঃ মহামন্যা হিক্যুবা, আপনার কান্না এতটাই মর্মভেদী– আহ্, কী অর্থ এই কান্নার? তাঁবুর ভেতরে বসে আমরাও কাঁদছিলাম, যেহেতু আজ আমরা সবাই ক্রীতদাসী।
অপর এক ট্রোজান নারীঃ গ্রিক শিবির হতে কোন সৈন্য আসছে নাকি? কার ক্রীতদাসী হবো আমি?
অন্য এক ট্রোজান নারীঃ কোথায় নেবে আমাদের? আর্গোস নাকি পিথিয়া? অথবা, সমুদ্রের কোলে কোন দ্বীপে?
আর এক ট্রোজান নারীঃ আমার মৃত সন্তানেরা! আর একটিবার মাত্র ওদের দেখতে পাব। তারপর আর নয়।
অন্য এক ট্রোজান নারীঃ আরো মন্দ কিছু হতে পারে। জনৈক গ্রিকের শয্যাও আমি…
অপর একজনঃ অমন একটি রাত? না– কখনো না – তেমন ভাবতেই পারি না!
অপর একজনঃ আমি দেখতে পাচ্ছি নিজেকে এক ভিস্তিওয়ালি হিসেবে, পিয়েরিয়ানের ঝর্ণায় কলস ডুবিয়ে গ্রিক মালিকের জন্য জল ভরছি!
“অনুবাদ সত্যিই ভালো হচ্ছে বিমলদা! তবে, এটা গ্রিক নাটক হলেও পুরুষ চরিত্র বিশেষ করে গ্রিক বা ট্রোজান বীরপুরুষদের চরিত্রগুলো এত কম?” মোস্তাফিজ প্রশ্ন করে।
“সেটাই এ নাটকের বিশেষত্ব। ইউরিপিদিস এই নাটকটি লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ২৩৫০ বছর আগে। এথেন্সের স্টেজে এই নাটক প্রথম অভিনীত হয় ৪১৬ অব্দে। সম্ভবত এটিই পৃথিবীর প্রথম যুদ্ধ–বিরোধী সাহিত্য।”
“উফ… ঢাকার বড় থিয়েটারওয়ালাদের আগে আমরা যদি এই নাটকটা সত্যি নামাতে পারতাম! আপনি চব্বিশ ঘন্টা ধরে লিখতে থাকেন। কলেজ বন্ধ না? নাকি আরো দেরি আছে বন্ধ হতে?” সারোয়ার হাতের তালুতে জোরে ঘুষি মারে।
“আরো দিন দশেক পর বন্ধ হবে। দ্যাখো, সফোক্লেসের সাথে ইউরিপিদিসের বড় পার্থক্য হলো সফোক্লেস বলেন যে দেবতারা যা নির্দেশ করেন, তাতে কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু, ইউরিপিদিস বলছেন যে দেবতারা যদি অন্যায় করেন, তবে তারা আর দেবতা থাকেন না। সফোক্লেস যেন রবীন্দ্রনাথ যিনি জীবনের হাজারটা অন্যায় যন্ত্রণা শান্ত মুখে মেনে নেবেন। ইউরিপিদিস আমাদের নজরুল। সদা বিদ্রোহী।
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না…
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণরোলে রণিবে না, বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হবো শান্ত!”
সারোয়ার–অরিন্দম–মোস্তাফিজ একসঙ্গে আবৃত্তি করে। বা, ধুয়া ধরে। অরিন্দম সম্ভবত পিসির পরিবারের বিপন্নতা এতক্ষণে ভুলতে শুরু করেছে।
“মা মাটি ও দেশকে ভোট দিন/ দেশনেত্রীকে ভোট দিন। ভাই সব! নৌকা মার্কায় ভোট দিলে বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হবে, মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোন যাবে! ভাই সব!” উৎকট মাইকের শব্দ হঠাৎই ইউরিপিদিস আর সফোক্লেসের আলোচনায় ছেদ টানে।
“উফ্, বিএনপি–জামাত এমন দোস্তি!” সারোয়ার উঠে জানালার পর্দা সরায়।
“আর আওয়ামী লীগ এলে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার কমবে? আওয়ামী লীগ আমলে হিন্দুদের সম্পত্তি শত্রুর সম্পত্তি হয় নাই? শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র্র ছাড়া কিছুতেই কিছু হবে না!” মোস্তাফিজ মুখে মুখে উত্তর করে। দুম দুম দুটো বোমা ফাটার আওয়াজ হলো কোথাও। অরিন্দম তো বটেই, সারোয়ার আর মোস্তাফিজের মুখেও ভয়ের ছাপ দেখা গেল। “ফেয়ার ইলেকশন কি হবে? এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্ঘাৎ জামাতি!”
“আর আওয়ামী লীগ ধোয়া তুলসী পাতা? জয়নাল হাজারি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেঞ্চুরিয়ান মাণিক।”
“সারোয়ার, মোস্তাফিজ – আমার মনে হয় তর্ক বিতর্ক বাদ দিয়ে তোমাদের আগে বাসায় চলে যাওয়া ভালো।”
২
“আমার মনটা কেমন খচ্খচ্ করছে সুহা! আজ ১৫ সেপ্টেম্বর, ১ অক্টোবর ইলেকশন – লতিফুর রহমানের সরকার এসেই কী সব বদলি টদলি করছে… সারা দেশেই আওয়ামী লীগের লোকের ওপর হামলা হচ্ছে… এসময়ে আমি গ্রামে তোমদের কাছে আসব? বরং তোমরাই চলে এসো। যাওয়া কি ঠিক হবে? তারাপাশায় তোমার ভাইরাও তো সবাই এখন দেশে নাই। একা সরোজ আছে!”
“আমি উপজেলা বাজরের ফোন থেকে এইসব রাজনীতির কথা বলতে পারব না। পুরানো দালানটায় আর থাকা যাচ্ছিল না। নতুন দালান যখন হলই, তখন গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান না করে কী করব? আর, তারাপাশার কথা আলাদা। রায়বাড়ির কোন ক্ষতি করার সাহস আজো তারাপাশার মানুষের হয় নাই।”
“কিন্তু, দেশের অবস্থাটা ভাব!”
“তুমি এত ভীতু! দেশের অবস্থা তো এমনই সব সময়। এর চেয়ে ভালো আর কবে ছিল? মরলে মরব, বাঁচলে বাঁচব! এছাড়া আমাদের যদি তুমি শহরেই নিয়া আসবা, তাহলে গত বছর বকেয়া বেতনের সব টাকা পেয়েই কেন নতুন দালান তুলতে বললা? উল্টা খরচ হল না? আমিও তখন কিছু সাত পাঁচ ভেবে দেখলাম ন! শিবুকে দিয়ে দালানের কাজ করাতে লাগলাম!”
“দালান থাকুক তোমরা চলে আসো!”
“কিন্তু এখন যে বাসায় ভাড়া আছো, বাড়িওয়ালার সাথে সেখানকার কন্ট্রাক্ট কতদিনের?”
“এই রে! নভেম্বরের আগে তো ছাড়া যাবে না!”
“তাহলে? নভেম্বর পর্যন্ত টাকা তো দিতেই হবে। আবার তোমার এই বাসায় মোটে একটা রুম। আমি, শান্তা, মণিকা… কী করে এতোজন উঠবো? তার চেয়ে ভালো দেখে তিন/চার রুমের একটা বাসা খুঁজতে থাকো। রাজারচরে আমাদের নুতন দালানের গৃহপ্রবেশের পর ভাইয়ের বাড়ি দুর্গাপূজাটা সেরে আসি… তুমিও চলো…নাকি শ্বশুরবাড়ি যেতে মানে লাগবে… শ্বশুরের ভিটেতে মন্দিরটাও তো শত্রু সম্পত্তির ফেরে বেহাত! আছে এখন কুড়ি বিঘা জমি আর বসত বাটি। সামনে তোমার বোনের বিয়ের খরচ।”
“আচ্ছা–আচ্ছা-” সুহাসিনীর নিখুঁত সব যুক্তির সামনে বিব্রত বোধ করে বিমলকান্তি পরাভব মানেন, “ঠিক আছে। বাঁচলে বাঁচব। মরলে মরব। যা হবার হবে!”
৩
যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে দেশের সবচেয়ে নদীমাতৃক এই জেলাটিতেও এখন জেলা শহর থেকে উপজেলা পর্যন্ত বাস যায়। বাসস্ট্যান্ডে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখা হল জেলা হিন্দু–বৌদ্ধ– খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অমিয় সিনহার সাথে। অমিয় সিনহা ছাড়লেন না। চায়ের দোকানে নিয়ে গেলেন।
“ভুমিকম্পের সময় সবাই যখন ওপর থেকে নিচে নামে, তখন কেউ কি নিচ থেকে ওপরে ওঠে? গ্রাম থেকে শহরে সবাই বউ–মেয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে আর আপনি কিনা এখন গ্রামে যাচ্ছেন? ইলেকশনটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন্ সাহসে আপনি গ্রামে যাচ্ছেন?”
“সত্যিই কি বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছেন?”
“পত্র–পত্রিকা পড়েন না? সারা দেশ জুড়ে – চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নোয়াখালি… কোথায় না – জায়গায় জায়গায় পালরা যে প্রতিমা বানাচ্ছেন, সেই প্রতিমা ভাংচুর, হিন্দু পরিবার থেকে চাঁদা দাবি, একটু গ্রামের দিকে হলেই জোয়ান পুরুষেরা সব পালিয়ে বেড়াচ্ছে, টাকা দিয়ে রেহাই নেই, পুরুষ মানুষ মার খাচ্ছে আর যুবতী মেয়েদের শ্লীলতাহানি চলছে, ধর্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাচনে চার দলীয় জোট জিতলে কী হবে ভাবতে পারেন? সারা জীবন বামপন্থা আর লেখালেখির রঙিন চশমায় দেশটা দেখে গেলেন…আমাদের মতো মানুষদের হয়তো মনে মনে ভাবেন হিন্দু সাম্প্র্রদায়িক বলে…”
“ছি! তেমন কথা কি আমি একটিবারও বলেছি? তবে, আমার উপায়ও নাই। টিকিটটাও কেটে ফেললাম। এখন না হয় সাহস করে চলেই যাই।”
“অই চরমোনাই! চরমোনাই! চরমোনাইয়ের বাস যায়!” হাঁক ভেসে এল।
“উঠি অমিয় বাবু, নমস্কার!”
বাসে উঠতে ভিড় ঠেলাঠেলি। অর্শ্ ও ভগন্দর হতে মুক্তির মহৌষধ ফিরিওয়ালা, আমড়া, চানাচুর ও বাদামের বিক্রেতা, মাদ্রাসা নির্মাণে সাহায্য–প্রার্থী কোন অন্ধ ভিক্ষুক! মাইলখানেক চললেই ছোট ছোট নানা নদী আর ফেরি। সন্ধ্যা নদী…নামটাই অদ্ভুত সুন্দর। বাসের গতিতে অনেকেই পড়তে না পারলেও বিমল কান্তির এভাবে সমস্যা হয় না। অন্যমনস্কভাবে শুরু করলেও অচিরেই তিনি ডুবে যান হিক্যুবা, কাসান্দ্র্রা, ট্যালথিবিয়াস ও এ্যান্ড্র্রোমেকেদের পৃথিবীতে।
(গ্রিক দূত ট্যালথিবিয়াস অপর সৈন্যদের সঙ্গে প্রবেশ করে।)
ট্যালথিবিয়াসঃ আপনি আমাকে চেনেন, হিক্যুবা! গ্রিক শিবির হতে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে প্রায়্ই আমি বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছি। আমি ট্যালথিবিয়াস।
হিক্যুবাঃ হে ট্রয় শহরের মেয়েরা এতক্ষণে সেই দুঃসংবাদ সত্যিই এসে পৌছাল।
ট্যালথিবিয়াসঃ হ্যাঁ, আপনাদের নিয়তি আপনাদের নিকটবর্তী।
হিক্যুবাঃ কে আমরা কোথায় যাচ্ছি? থেসালি? পিথিয়া? থিবিস?
ট্যালথিবিয়াসঃ এক/একজন গ্রিক পুরুষ এক/একজন ট্রয় নারীকে নিয়ে যাবে। এমনটি নয় যে একসঙ্গে যাবেন সবাই।
হিক্যুবাঃ কে কাকে নিচ্ছে? কারো ভাগ্য কি এতটুকু ভালো?
ট্যালথিবিয়াসঃ আমি জানি সবার নিয়তি। তবে একজন একজন করে জিজ্ঞাসা করুন।
হিক্যুবাঃ আমার দুহিতা, কে তাকে নিল? বলো আমাকে, আমার কাসান্দ্রাকে কে নিচ্ছে? বড্ড অভাগা মেয়ে!
ট্যালথিবিয়াসঃ রাজা আগামেমনন তাঁকে সকল বন্দিনির ভেতর হতে বাছাই করে নিতে আগ্রহী।
হিক্যুবাঃ ওহ! নিশ্চয়ই তাঁর স্পার্টিয় স্ত্রীর সেবাদাসী করবেন বলে?
ট্যালথিবিয়াসঃ না, না রাজার নিজের শয্যার জন্যই।
হিক্যুবাঃ আহ্ না…কক্ষণো না! দেবতা এ্যাপোলোর বরনারী, আজীবন কুমারী। দেবতার বরে চিরকৌমার্যের অধিকারিণী!
ট্যালথিবিয়াসঃ কাসান্দ্রার এই অত্যাশ্চর্য বিশুদ্ধতাই আগামেমনকে মুগ্ধ করেছে!
হিক্যুবাঃ মন্দিরের চাবি ছুঁড়ে ফেলো ক্যাসান্দ্রা! খুলে ফেলো গলার ফুলমালা ও কাঁধের পবিত্র উত্তরীয়!
ট্যালথিবিয়াসঃ যাহোক, একজন রাজার শয্যা এত বাজে কিছু নয়।
হিক্যুবাঃ হেক্টরের স্ত্রী –আমার হেক্টর, যুদ্ধে যে প্রজ্ঞাবান–তার স্ত্রী কোথায়? অভাগী এ্যান্ড্রোমেকে?
ট্যালথিবিয়াসঃ এ্যাকিলিসের পুত্র তাকে নিয়ে গেছে। বন্দিনিদের ভেতর হতে সে এ্যান্ড্রোমেকেকেই পছন্দ করেছে।
হিক্যুবাঃ আর আমি? এই পলিত কেশ বৃদ্ধা? ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কার ক্রীতদাসী হব?
ট্যালথিবিয়াসঃ ইথাকার রাজা ওদিসিয়ুস।
হিক্যুবাঃ আঘাত করো, আঘাত করো আমার এই মুন্ডিত মস্তকে! আমি শেষ। আমি পরাভূত–নিঃস্ব!
ট্যালথিবিয়াসঃ (সৈন্যদের দিকে ফিরে) শোনো, কাসান্দ্রাকে এখানে নিয়ে এসো। ঝটপট, ছেলেরা! প্রধান সেনাপতি তথা রাজার হাতে তাঁকে তুলে দিতে হবে। এবং বাকি নারীদের অন্য সেনাপতিদের হাতে! কিন্তু, ও কী? ঐ কুঁড়েঘরটির ভেতর কিসের আলো জ্বলছে?
(বন্দিনি ট্রোজান নারীদের জন্য নির্মিত সার সার কুঁড়েঘরের একটির ভেতর আলো জ্বলছে)
কুঁড়েগুলোর আগুন দেওয়াই কি পরিকল্পনা এই ট্রোজান নারীদের? গ্রিসের উদ্দেশ্যে যাত্রার পরিবর্তে পুড়ে মরাই সংগুপ্ত ইচ্ছা কি তাদের? দ্বার খোলো–খোলো দ্বার– আহ্, এদের বের করতে হবে। নচেৎ অন্য গ্রিকরা দূষবে আমাকেই।
হিক্যুবাঃ না, না, কিছুই পুড়ছে না। ও আমার মেয়ে কাসান্দ্রার হাতের মশাল। সে উন্মাদিনী!
৪
“ও লান্ডিয়া’ মরদ লোগোঁকো জমিন তো হিন্দুস্থান নেহি হ্যায়। উসকো জমিন তো পাকিস্তান হ্যায়!”
“জয় শ্রীরাম! ছত্রপতি শিবাজি কী জয়! ছত্রপতি শিবাজি কী জয়! হিন্দুকে লিয়ে হিন্দুস্থান, মুসলমানকে লিয়ে পাকিস্তান!”
চলছে মহা আরতি। মুসলমানরা যদি লাউড স্পিকারে আজান দেয়, শুক্রবারের নামাজে মসজিদ উপচে পড়ে। রাস্তায়ও নামাজিরা সার বাঁধে। তবে হিন্দুদের আরতির কাঁসর–ঘণ্টা–ঢাক–ঢোল–শঙ্খের শব্দেও লাউড স্পিকার বসানো হোক, তবে হিন্দুরাও রাস্তায় আরতি নাচবে। শিবসেনা নেতা থ্যাকরের এই চ্যালেঞ্জে মুচকি হাসল মহারাষ্ট্রীয় পুলিশ। মুম্বাইয়ের রাস্তায় রাস্তায় ঘণ্টা দুই ধরে মহা আরতি সম্পাদনে সৃষ্ট যানজট পরম ধৈর্যে ও মমতায় ছাড়ানোর দায়িত্ব নিল পুলিশ। তবু, বাল থ্যাকরেই তাদের প্রিয় নেতা। মহারাষ্ট্রের মতো পড়শি গুজরাট রাজ্যেও ক্ষমতায় এসেছে সঙ্ঘ পরিবার। এরই ভেতর গুজরাটের গোধরায় হিন্দু তীর্থযাত্রী বহনকারী ট্রেন সবরমতি এক্সপ্রেসে কেউ বা কারা আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় অসংখ্য তীর্থযাত্রী আগুন পুড়ে নিহত। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সঙ্ঘ পরিবার সারা গুজরাটে বন্ধ ঘোষণা করলে প্রাদেশিক সরকারের সমর্থন। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বরোদার রেল স্টেশনে পুলিশের চোখের সামনেই একটি লাশ পড়ে যাওয়ার ঘটনাকে হিন্দুত্ববাদীরা সবুজ সংকেত হিসেবে গ্রহণ করল। ২৮ ফেব্রুয়ারি সারারাত ও ১ মার্চ সারাদিন জুড়ে বিজেপি–শিব সেনা–বজরং দল–সঙ্ঘ পরিবার তথা ধর্মযুদ্ধের সৈনিকেরা তলোয়ার, গ্যাস সিলিন্ডার, পেট্রল ও কেরোসিন বোমা হাতে নেমে পড়ল রাস্তায়। বরোদার নূর পার্ক, আতলাদারা ও কিসওয়ান্দির যত মুসলিম গৃহ ও উপাসনালয় প্রথমে লুট ও পরে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হল। নানা জায়গায় মুসলিম পুরুষদের দাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলা ও জোর করে রাম নাম বলার জন্য “রাম বলো” বলে সঙ্ঘ ক্যাডারদের তাণ্ডব চলল; বাহার কলোনিতে পুলিশ মুসলিম নারীদের স্তন ধরে টেনে–হিঁচড়ে বার করল রাস্তায়। পানিগেট নওয়াপাড়া নাকা পুলিশ চৌকির সামনে তিনটি হিন্দু কিশোর ছ”জন পুলিশ অফিসারের সামনে একটি মুসলিম বাড়ি পুড়িয়ে দিল। মান্ডভি পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে একটি মুসলিম দোকান ও শাস্ত্রি বাগ রোডে সৈয়দ স্টুডিও পোড়ানো হল। বরোদার মকরপুরা এলাকায় দু”টো পুলিশ গাড়ির নিরাপত্তা প্রহরায় ছেড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে কিছু অত্যাবশ্যকীয় জিনিস নিয়ে ফেরার সময় বত্রিশ জন মুসলিম পুরুষকে প্রায় ২০০০ হিন্দু জনতা আক্রমণ করল। দু”জন ঘটনাস্থলেই মারা গেল, চারজন হাসপাতালের ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হল আর আরো আঠারো জন গুরুতর আহত। আশা নগর ও রোশন নগরে পুলিশের গাড়িতেই পাওয়া গেল কেরোসিন লিটার যা দাঙ্গাকারীরা ছুঁড়ে মেরেছে মুসলিম বসতিতে। নূর পার্কের ১৮৫টি মুসলিম বাড়ি পোড়ানোর পর দাঙ্গাকারীরা হনুমান চালিসার গান গাইল। বরোদার পানবাদ ও কাওয়ান্ত, বরসালির আজওয়া সড়ক, মচ্ছিপিঠের রেইন বসেরা, ওয়াদি ও নওয়াপুরা, প্রতাপনগরের প্যাটেল স্টেট ও সর্দার স্টেটের মুসলিমরা পুলিশকে বারবার আগে থেকে ফোন করেও আক্রান্ত হবার সময় অরক্ষিত থেকে গেছে। ভূতাদি ঝাম্পা ও পুরনো পাড়া সড়কে পুলিশ অভিযোগ করতে আসা মুসলিমদের এফআইআর নিল না। “মারো মিঞা কো” আর “ভারত মাতা কী জয়” শ্লোগানে বরোদা শহরে অভিলাষ ও স্বাতী এলাকায় মুসলিম মালিকের লন্ড্রি ও দর্জি দোকান পুড়িয়ে ফেলা হয়। শুক্লানগরের হিন্দু–মুসলিম মিশ্র পাড়ার মুসলিমরা পালিয়ে গেল কামাতিপুরায় হিন্দু পরিবারগুলোতে আশ্রয় নিতে। আশ্রয় পেলও। উত্তর প্রদেশ থেকে গুজরাটে কাজ করতে আসা প্রচুর মুসলিম পরিবার দু/তিন মাসের জন্য পালিয়ে গেল উত্তর প্রদেশের গ্রামে। শুক্লানগরের অমর কমপ্লেক্সের পাশে ইকবাল পীরজাদা নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাকে পুড়িয়ে মারা হল। সঞ্চয়নগরের খাসির মাংসের দোকান সম্পূর্ণ ভেঙে–চুরে, রাতারাতি রাম আর হনুমানের ছবি ও প্রতিমা টাঙ্গিয়ে ডজনের ক্যাসেট চালিয়ে, প্রসাদ বিতরণ করে, হাতে নারকেল, প্রদীপ আর ফুল নিয়ে পূজা দিতে এল সঙ্ঘ উপাসকেরা। প্রায় ২৬৭টি মসজিদ, ঈদগাহ, পীরের দরগা, মাজার, মাদ্রাসা ও মুসলিম দোকানের ভগ্ন স্তূপের ওপর সদ্য নির্মিত হিন্দু মন্দির থেকে লাউড স্পিকারে চলল ভজন ও হনুমান চালিশার গান; হে রামভক্ত পবনপুত্র হনুমান!
৫
“সুনামগঞ্জ–৬ আসনে ২,৪২,০০ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বিএনপির ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের আবুল মকসুদ। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ১,১১,০০০।”
“এই মাত্র আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে পঞ্চগড়–১৪ আসনের ফলাফল। নির্বাচনে ১,৮৮,৫৮৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ সোহেল হক। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৫২,০০০।”
গ্রামের টিভি সেটে রাত জেগে ব্যাটারি চার্জ করে নির্বাচনী ফলাফল দেখা। রাজারচর গ্রামের হিন্দু পাড়ায় ত্রাস। ভোট কেন্দ্রে গোটা তল্লাটের একটি হিন্দু মানব মানবীও যেতে পারেনি। তারাপাশাতেও একই অবস্থা। বাঘে–গরুতে আগে যে বাড়িতে একঘাটে জল খেত সেই রায়বাড়ির মানুষকেও শাসিয়ে যাচ্ছে জামাতের ক্যাডাররা। যশোর, চাখার, কচুয়া, খুলনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফেনী, পটুয়াখালি, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, পাংশা, বগুড়া, রংপুর, ফতুল্লা, জামালপুর, শ্রীপুর, শ্যামনগর, ঝালকাঠি, উখিয়া, মুন্সীগঞ্জ, শাহজাদপুর, নরসিংদী, সিলেট, দিনাজপুর, মিরেরসরাই… দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন কী গ্রাম থেকে ভয়ানক সব খবর আসছে। বীভৎস সব শিরোনামসহ পত্রিকা ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন। নাটোরের মধ্যবানিয়ারির প্রায় ৪০টি পরিবারে ৭০/৮০টা বাড়িতে হামলা করে বাড়ি ও বাড়ির পার্শ্ববর্তী কিছু দোকান থেকে মালামাল লুট করে পরে ঐ বাড়ির দূর্গাপূজা মন্ডপ ভেঙে প্রতিমা ফেলে দেওয়া হয়। দেবীদ্বারে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া আঁখিরাণী দাস স্থানীয় এক মাস্তানের প্রণয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার বাবাসহ ছুরিকাঘাতে নিহত। পিরোজপুরের পত্তাশী ইউনিয়নের রেখাখালী গ্রামের সাতশ হিন্দু ভোট অধ্যুষিত বাওয়ালী, বিশ্বাস ও মিস্ত্রী বাড়িতে ৫০/৬০ জন সশস্ত্র দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সমর্থক পাড়ার আশ্রম ও আশ্রমের প্রতিমা ভেঙেছে। যশোরের বাগডাঙ্গা, বেজপাড়া, নলডাঙ্গা, মনিরামপুর, কেশবপুর, বাঘারপাড়া ও ঝিকরগাছায় চারশ হিন্দু ভোটারের নাম ভোটার তালিকায় না থাকায় ভোট দিতে পারেনি। নাটোরের কোন এক গ্রামের হিন্দু পাড়ায় ৭০/৮০টি হিন্দু পরিবারের বাড়িতে লুটপাঠ ও আগুন লাগানোর পর নির্মিতব্য দুর্গা প্রতিমা ভেঙে পুকুরের ফেলে দেওয়া হয়েছে। কচুয়ার হিন্দু পাটিকর সম্প্রদায়ের ছয়টি বাড়িতে ভাঙচুর করে পঞ্চাশ হাজার টাকা, মহিলাদের স্বর্ণালঙ্কার লুট করা ছাড়াও তাদের পরনের কাপড় খুলে ফেলা হয়। মঠবাড়িয়ার আমড়াগাছিয়া গ্রামে জনৈক উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের বাসায় ৫০ হাজার টাকার সোনার গহনা ডাকাতেরা কেড়ে নেয়। কচুয়ার নিশ্চিন্তপুরের বেশ কয়েকটি হিন্দুগ্রাম জনমানবশূন্য, খাঁ খাঁ করছে। সাতক্ষীরায় জামায়াতে ইসলাম সাতটি থানার প্রায় দু”লক্ষ হিন্দু অধিবাসীকে সাঁড়াশি আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত রাখছে। বাগেরহাটে গত পনেরো দিনে একশোর বেশি হিন্দু পুরুষ আহত হয়েছে। উৎকুল গ্রামের সাহাপাড়ায় পাঁচটি পরিবারের ছয়টি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সোনাগাজীর মতিগঞ্জে গরিব দলিল লেখক স্বপন শীল ৪০,০০০ টাকা চাঁদা দিয়েও সন্ত্রাসীদের ভয়ে এলাকা ছাড়া। চাঁদা দাবি করায় লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা সত্যেন্দ্র বসাক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাসখানেক আগে মারা যান। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলাকালে তার ছেলের কাছ থেকে চাঁদা চাওয়া হয়। পটুয়াখালির দুমকীতে মালাকার পাড়ায় নৌকার মিছিলে গেলে মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করার হুমকি দেওয়া হয়। ঢাকা–৩ কেরানীগঞ্জ আসনের ৭০ হাজার হিন্দু ভোটারকে ভোট না দিতে হুমকি দেওয়া হয়। ভোলার লেচপাতা গ্রামের হিন্দু পাড়াকে যে মুসলিম যুবক বশির গত দেড় মাস ধরে পাহারা দিচ্ছিল, তাকে খুন করা হয়েছে। ঢাকার কেল্লার মোড়, শ্মশানঘাট ও বউবাজার এলাকায় কালা খোকনের সহযোগী কামাল ও লম্বা জসিম বোমাবাজি করে হিন্দু ভোটারদের এলাকা ছাড়তে বলেছে। পাবনার সাতবাড়িয়া, নিশ্চিন্তপুর, কামারহাট গ্রামে হিন্দু বাড়ি ভাঙচুর ও লুট করা হয়। ভোলার লালমোহন, তজুমুদ্দিন, দৌলতখান প্রভৃতি উপজেলায়ও হিন্দুদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করা হয়। রংপুরের মিঠাপুকুরের গোপালপুর ও মিলনপুর গ্রামগুলোর ২০ হাজার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় রাতের গভীরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট দিতে বিশেষত মেয়েদের ভোটকেন্দ্রে যেতে মানা করা হয়। মুন্সিগঞ্জের সাতবাড়িয়া গ্রামের ২০টি হিন্দু পরিবার আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছে। রামনগর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের জগদীশ চন্দ্র দাসের বাড়িতে ঢুকে চাঁদা চাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা তাকে বেঁধে রেখে দুই কলেজগামী কন্যার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। মেয়ে দুটোর চিৎকারে প্রতিবেশীরা ঘর হতে বের হলে সন্ত্রাসীদের গুলি ও বোমায় মাছ ব্যবসায়ী বুবন দাস নিহত ও তার পুত্র দিলীপসহ পাঁচ জন আহত হয়। দানগভূঁঞার সিন্দূরপুর ইউনিয়নের রাকশ্যাম সরকার বাাড়ি, নসরতপুর, চন্দ্রপুর, অলাতলী ও কোরবানপুরে পুরুষেরা অত্যাচার ও চাঁদার ভয়ে বাড়িছাড়া। এই সুযোগে এলাকার মেয়েদের স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও আসবাবপত্র লুট করা হয়। সিন্দূরপুরের মাছিমপুযর গ্রামের সুনীলচন্দ্রের বাড়িতে লুঠপাটের সময় ৭০ বছর বয়স্ক জনৈক অর্জুন চন্দ্র তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীদের বোমাতে মারা যান। বাগেরহাট ও ঝালকাঠিতে কালীমন্দির ভাঙচুর। শ্যামনগরে এক হিন্দু পরিবারের তিন কিশোরীর শ্লীলতাহানি। মানিকগঞ্জে দু”টি মন্দির ও তিনটি প্রতিমা ভাঙচুর। সাতকানিয়ায় পরিকল্পিত ভাবে ৪০ হাজার হিন্দু নর–নারীকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। সিলেটে পথ্যপাড়ায় ১৫টি হিন্দু পরিবারের ঘরে তালা ঝুলিয়ে ভোট না দেবার জন্য শাসানোয় ৬৮৭ জন ভোটার ভোট দিতে পারেননি। পিরোজপুরে সাঈদীর ক্যাডাররা ৭২টি কেন্দ্রের ৪০টিতে হিন্দুদের ভোট দিতে দেয়নি, প্রায় ৩৩ জন হিন্দু আহত। খুলনায় জামায়াতের মিছিল থেকে হোগলার চর ও কাটাখালি এলাকার মন্দিরে হামলা চালিয়ে দুর্গা প্রতিমা ভাঙার সময় ভাস্কর পুলিন কয়ালের বামচোখ নষ্ট। তিন/চারশো জামাতি কাটাখালির মনসা মন্দিরে হামলা করে। উখিয়ায় পাঁচ হাজার হিন্দু–বড়–য়ার গ্রাম মানুষশূন্য। ফতুল্লার পঞ্চবটিতে এক আশি বছরের বৃদ্ধার কাপড় খুলে ফেলা হয়। গাজীপুরের গোলয়া গ্রামে হিন্দুদের ৩০টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। উজিরপুরের নয়াকান্দি ও নাথারকান্দিতে ভোট দিতে যাবার সময় চার/পাঁচ জন হিন্দু মহিলার শাড়ি– ব্লাউজ খুলে ফেলা হয়। ভাঙায় মায়ের সামনেই মেয়ে ধর্ষিত। গ্রামকে গ্রাম পুরুষশূন্য। সব মিলিয়ে গত ক”দিনে মারাই গেছে ১৬৩ জন, ছয় হাজারের বেশি আহত।
এই কি বিমল কান্তির দেশ? প্রিয় বাংলাদেশ? এ কি আর এক একাত্তর নেমে এল?
গ্রামের বাজারে পেপার পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর বারোটা বেজে যায়। কত খবর পড়বেন তিনি? পড়তে পড়তেও ক্লান্তি লাগে। পথ–ঘাটের এত বাজে অবস্থা যে মেয়ে–বউ–বোন–মা”কে নিয়ে জেলা শহরে ছুটবেন নিরাপত্তার আশায় সে গুড়েও বালি। নিজের বাড়িতেই একরকম জিম্মি হয়ে, চুপে চুপে হাঁটা–চলা করে আর ফিসফিসিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। দুপুরে বাজার থেকে পেপারটা পর্যন্ত যে এনে দেয় সে এ বাড়ির এক অত্যন্ত বিশ্বস্ত মুসলিম বর্গাদার চাষি।
(কাসান্দ্রা এক নারী পুরোহিতের পোশাকে একটি কুঁড়েঘর থেকে বের হন, তাঁর চুলে একটি ফুলের মালা, হাতে একটি জ্বলন্ত মশাল। যেন তিনি কাউকেই দেখছেন না)
কাসান্দ্রাঃ মা, আমার মুকুটে পরিয়ে দাও বিজয়ের ফুলমালা। আগামেমনন, গ্রিসের মহামান্য নৃপতি –আমি তাকে হত্যা করব মা –তার ঘর গুঁড়িয়ে দেব যেমন সে গুঁড়িয়েছে আমাদের। শোধ নেব সমস্ত বর্বরতার, এই বিধ্বস্ত ট্রয় আজো সুখী গ্রিকদের চেয়ে, একজন নারী, একটি মাত্র প্রেমিকা হেলেনের জন্য তারা এসেছিল এবং লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিহত হল। এমন এক নারীর জন্য, যে স্বেচ্ছায় স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়েছে প্রেমিকের হাত ধরে, তাকে কেউ জোর করেনি! আর, হেক্টরের যন্ত্রণা – মা শোনো, সত্য হল হেক্টর বরণ করেছে বীরের মৃত্যু।
ট্যালথিবিয়াসঃ (কাসান্দ্রার কথা ও আচরণে সামান্য বিস্মিত, কিন্তু সে আর সহ্য করতে পারে না)
এখন অ্যাষেপালো যদি তোমাকে উন্মাদিনী বানিয়ে ছাড়ত, এই সব গ্রিক–দ্বেষী কথার জন্য আমি তোমাকে শাস্তি দিতাম। (হিক্যুবার দিকে ফিরে শান্তভাবে) আর আপনি… ওদিসিয়ুসের সৈন্যরা এলে তাদের নিঃশব্দে অনুসরণ করবেন। তাঁর স্ত্রী একজস দয়াশীলা, বিচক্ষণ নারী।
কাসান্দ্রাঃ (যেন ট্যালথিবিয়াসকে এই প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়েছে এবং তার দিকে উদ্ধত ভঙ্গিতে তাকিয়ে) এক অদ্ভুত ধরনের ক্রীতদাস এরা, দূত যাদের বলা হয়। তুমি বলছো আমার মা কিনা হবে ওদিসিয়ুসের ক্রীতদাসী? (কাসান্দ্রা ঘুরে দাঁড়ায় ও নিজের সাথে কথা বলতে থাকে) কিন্তু, অ্যাপোলো যে আমাকে বলেছিলেন, মা এখানেই মারা যাবেন? মা, মাগো আমার! কেঁদো না! বিদায়, প্রিয় নগরী আমার! বিদায় ভাইয়েরা আমার, যারা শুয়ে আছে ট্রয়ের পবিত্র মৃত্তিকা, চিরনিদ্রিত পিতা মহারাজা, প্রিয়ম আমার!
(ট্যালথিবিয়াস ও অন্য সৈন্যদের সাথে কাসান্দ্রা চলে যায়। হিক্যুরা, এক মুহূর্তের জন্য নিশ্চল থেকে, পড়ে যায়)
৬
পিসি স্নান করেছে। মা–ও। স্নান করেনি শুধু শান্তা। এক মাস আগে সে টিভিতে একটি নাটক দেখেছে। নাটকে একটি মেয়ে ধর্ষিত হবার পর স্নান করলে তার সব আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আদালতে আর বিচার পায় না। নিজের এই শরীরটা শান্তার অচেনা। যখন জ্ঞান এল, তখন সবে ফর্সা হচ্ছে আকাশ। গা বেয়ে লাল পিঁপড়া উঠেছে। কোথায় সে? চারপাশে সফেদা, আম, কাঁঠাল, নারকেল আর সুপারির গাছ। হ্যাঁ, এ তাদেরই বাড়ির বাগান। দু”হাতের পাতায় ভর করে উঠতে গিয়েই দেখে যোনি আর দুই উরুতে রক্ত। মাসিকের রক্তের মতো নয় কিন্তু। উরুসন্ধিতে শাদা শাদা এগুলো কী?
কাল রাতে খুব চাপা ভয়ে আর আতঙ্কে একরকম নিঃশব্দেই গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান সারা হয়েছিল। মা খুব ভয়ে ভয়ে পোলাও, মুরগি আর পায়েস রান্না করেছিলেন। খেয়ে দেয়ে দশটার ভেতর তারা সবাই শুয়ে পড়েছিল। মা আর বাবা এক ঘরে আর সে আর পিসি আর এক ঘরে। সম্ভবত রাত বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে তাদের বাড়ির দরজায় জোর ধাক্কা শুরু হয়।
“সব ঘুমে নাকি? দরজা খোল্…. খোল্ দরজা! নয় সব ভাইঙ্গা ফেলমু!”
পিসিই গাঢ় ঘুম থেকে তুলেছিল শান্তাকে।
“শানতা– ওঠ্ তো! কারা জানি আমাদের বাসার দরজা ধাক্কাচ্ছে!”
বাড়ির মাঝামাঝি উচ্চতার দেয়াল টপকে তারা উঠোনে ঢোকে। সব মিলিয়ে প্রায় দশ/বারো জন। ভুলু কুকুরটা তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করছিল। একজন বন্দুক তাক করে গুলি করে। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বাতাসে তুলে থেমে যায় ভুলু। কুকুরের মরণ আর্তনাদে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। মণিকা আর শান্তা দুজনকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে।
“পিসি গো… এখন কী হবে পিসি?”
বাবা তার ঘরের দরজা খুলে বেশ জোরেই জিজ্ঞাসা করেন, “কারা আপনারা? কী চান?”
“চুপ মাদারচোত মালাউন কোথাকার! গৃহপ্রবেশ করো? নতুন দালান ওঠাও? তোর হাসিনার দিন শ্যাষ! এখন ইন্ডিয়া ভাগ্ নয় বউ–ঝিরে দে!”
একটা লোক বাবার মুখ চেপে ধরে। আর একজন একটা গামছায় বেঁধে ফেলে বাবার হাত–পা–মুখ। তিনটা লোক বন্দুকের মুখে বাবাকে তার ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে থাকে। সে, মা আর পিসি ডুকরে কেঁদে উঠতেই আরো আট/নয় জন বন্দুকধারী এসে তাদের চিবুকের কাছে বন্দুক ঠেকায়, “চুপ মাগীরা! বেবুশ্যে কোথাকার! একটি চিল্লানি দিবি তো খতম কইরা ফালামু!”
তিনটা তিনটা ছ’টা লোক মা আর পিসিকে ঘরের মেঝেতেই ফেলে দেয়। অন্য তিনজন শান্তাকে টেনে–হিঁচড়ে বাগানের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সে ক্রমাগত হাত–পা ছোঁড়ার আর লোকগুলোকে আঁচড়ে কামড়ে দেবার চেষ্টা করতে গেলে লোকগুলো তার হাত–পা শক্ত করে চেপে ধরে।
“অই শালি! চুপ থাক কইলাম! নয় চাক্কু হান্দায় দিমু।”
সবার আগে যে লোকটা শান্তাকে বাগানের মাটিতে ফেলে দিল, তার হাতের মুঠোর টানে চুল ছিঁড়ে যাবার দশা। ওড়না ভ্রষ্ট। কামিজের হাতা ছেঁড়া। লোকটি তার বুকে ভয়াবহ থাবা ও দাঁত নিয়ে মুখ নিচু করতেই সে শেষবারের মতো চিৎকার করে। ভুলুর মতো। লোকটি তার মুখে এবার হাত চেপে ধরে। সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে! মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। ছোটবেলায় চড়কের মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চাপলে মাটি হতে সবচেয়ে উঁচুতে উঠলে যেমন চক্কর দেয়, তেমনই।
সকালের দিকে জ্ঞান ফিরতে দেখে মা, বাবা আর পিসি ঝুঁকে আছে তার উপর। মা ডুকরে ওঠে,
“শান্তা রে! বেশি লাগছে নাকি মা?”
“শান্তা চল মা! স্নান করি। কাউরে কইস না কিছু!”
মা গ্রামের স্কুলে পড়ায় বলে এমনি সময় বাড়িতেও শুদ্ধ কথা বলে। কিন্তু, আজ কি আর মা ভাষার কোনোও ব্যাকরণ মানে?
“তোমরা যাও মা। আমি স্নান করব না!”
“স্নান না কইরা ঐ ময়লা আর রক্তের ভেতর থাকবি? কুকুরে যে তোরে মুখ দিছে মা! তোর শরীরটা নোংরা কইরা দিছে!”
“কুকুরগুলারে আমি ফাঁসিতে ঝুলাব! তাই স্নান করব না!”
“তা পারবি ক্যান মা? পারলে কি অরা তরে… আমাদের বউ–ননদে–ঝিয়ে এই অত্যাচার করে? এর কোনো বিচার নাই মা! এই দ্যাশে এর কোন বিচার হব না। পুলিশে কেসও নিব না। চল্, স্নান করবি! ঘিন্না লাগে না তোর?”
“আমার সব ঘিন্না শেষ। আর, নতুন কোন ঘিন্না নাই। স্নান আমি করব না, মা!”
কালু ভাই, তাদের বাড়ির তিন পুরুষের কামলা, সকাল হলে ঘরে ঢুকে উঠোনে হাত–পা বাঁধা, আহত ও রক্তাক্ত বাবাকে দেখে প্রকাণ্ড চিৎকার দিয়ে উঠেছিল, “কোন্ বেজন্মারা বাবুর গায়ে হাত দিচ্ছে? বাবু! বউদিদি, শান্তা মা, মণিকাদিদি কই?”
এখন শান্তা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া কামিজ আর সালোয়ারটাই আবার পরেছে। বাবা একটু আগে জ্ঞান হারিয়েছেন। সকাল থেকে কিন্তু শুরুতে বেশ শক্ত ছিলেন। রক্তে মাখামাখি নগ্ন শান্তাকে দেখেও চুপচাপ ছিলেন। একটুও ছটফট করেননি। এই আধ ঘণ্টা হল হঠাৎই চেতনাহারা। কালু ভাই বাজার থেকে ফার্মেসির এক কম্পউন্ডার ডেকে এনে ঘরেই স্যালাইন চালিয়ে বাবার মাথায় বরফ দিচ্ছে। মা আর পিসি শুয়ে আছে।
“কালু ভাই!”
“কন আম্মা!”
“আমাকে একটা রিক্সা ডেকে উপজেলা শহরের বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ভাড়া করে দেবেন?”
“একা একা কই যাইবেন?”
“আমি শহরে যাব।”
“শহরে? কার কাছে যাইবেন মা?”
“মহিলা পরিষদের এক নেত্রী… উকিল… তিন মাস আগে আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠানে আসছিলেন। ওনার বাসার কোন নম্বর আমার কাছে আছে। আমি ওনার কাছে যাব।”
কালু এক মুহূর্ত ভাবে। পরক্ষণেই তার ছেলে ইদ্রিস, যে এ বাড়ির নানা ফুট–ফরমাশ খাটে, তাকে হাত নেড়ে ইশারায় ডাকে, “বাবুর মাথায় বরফ দিতে থাকে। আমি আম্মারে বাসে তুইলা দিয়া আসি!”
৭
“দেয়ালগুলোতে সব রক্ত ছিটকে গেছিল।”
“খুব সম্প্রতি আমরা সেই রক্ত পরিষ্কার করেছি।”
“তারা সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে পেট্রল ঢালল এবং তারপর আগুন জ্বালাল।”
“আমি আজো তাদের চিৎকার শুনতে পাই।”
“আলামত নষ্ট করার জন্য তারা সব কিছু পুড়িয়ে ফেলল।”
“জাফরি সাহেবের লাশটা আমরা খুঁজে পাইনি… বড় রাস্তার ওপর শুধু কিছু হাড় পেয়েছি।”
“এই গর্তটি আমরা খুঁড়েছি।”
“দু’তিন মাস পর আমরা যখন এলাম, আমরা তাদের চুল, হাড়ের টুকরো…. শরীরের চর্বি ঘরের মেঝের ওপর পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে নিচের গর্তে মাটি চাপা দিলাম।”
“কাউকে তারা রেহাই দেয়নি, তরুণী থেকে শুরু করে আমার চেয়েও বয়স্ক মহিলা… কাউকে না।”
“সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।”
“সামনে খোলা মাঠটায় দশজনকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে।”
“দশ নারী ও তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।”
“ধর্ষিতা মেয়েদের বাবা–মা বা পরিবার পুলিশের কাছে কোন অভিযোগ জানায়নি। ধর্ষণের অভিযোগ জানালে মেয়েদের বিয়ে হবে না এই ভয়েই তারা এমনটি করেছে।”
“যে নারীরা ধর্ষণের হাত এড়িয়ে সামনের বড় রাস্তায় দৌড়ে পালিয়েছে, তাদের পিছু পিছু ধাওয়া করেছে উন্মত্ত জনতা।”
“কাললে পড়ে আছে ৬৫টি লাশ…”
“৪৩টি লাশ এখনো পাওয়া বাকি।”
“সুলতানা, তুম্ দেলল গাঁও মে ফিরনা চাহতি হো?”
“নেহি।”
“কিঁউ নেহি?”
“গাঁও কি লোগো নে তো নেহি চাহতা কী হাম মুসলমান আদমি ঔর আওরত ওয়াপস যাতা হ্যায় লেকিন হাম কো মরদ কোই জিন্দা নেহি হ্যায়। উ সব খুন হোতা হ্যায়।”
৮
কালু ভাই রিক্সা ডেকে দিলে হাঁটু, কোমর ও তলপেটের উদগ্র ব্যথা, রক্ত ও শাদা রঙের সেই অদ্ভুত বস্তুর প্রাবল্যে শান্তার হঠাৎই বমি পায়। প্রাণপণে বমি রোধ করে সে। কালু ভাই পিছু পিছু একটা সাইকেলে চড়ে বসে। রিক্সাঅলা শান্তাদের পরিচিত। গ্রামের বাজারে প্রায়ই উপজেলা সদর থেকে আসে। আজ অবশ্য কালু ভাই রিক্সাকে তাদের বাড়ি পর্যন্ত ডেকে এনেছে। পরিচিত এই রিক্সাঅলা অবাক মানা চোখে একবার শান্ত আর একবার কালুকে দ্যাখে। মুখ ফুটে কী একটা কথা বলতে গিয়েও বলে না। উপজেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে এবং বাসে অনেকেই চেনা মানুষ। এ গ্রামেরই মানুষ সবাই। অদ্ভুত চোখে তারা সবাই শান্তাকে দেখে। কালু ভাই শান্তাকে বাসের ভেতর জানলার পাশে একটা সিটে বসিয়ে দেয়। কন্ডাক্টরকে বলে যেন শান্তার পাশের সিটে কেউ না বসে। কালু ভাই নিজেই দু/দু”টো টিকিট কাটে শান্তার জন্য। শান্তাকে পয়সা দিতে দেয় না। বাসায় ক্লান্ত, মূর্চ্ছিত মা–বাবা–পিসি সবাইকে এড়িয়ে শান্তা খুব অদ্ভুতভাবেই ভীষণ ঠান্ডা মাথায় একটা হ্যান্ডব্যাগে তার গত মাসের স্কলারশিপের টাকা ও মার দেওয়া হাতখরচের কিছু জমানো টাকা, মহিলা পরিষদের সেই নেত্রীর নাম–ঠিকানা লেখা একটা ছোট্ট চিরকুট যা তার পার্সে ছিল… সব কিছু ভরে নিয়েছে। বাসে উঠে সে তার দিকে এক বাসভর্তি মানুষের সবার দৃষ্টিই লক্ষ্য করে এবং করে না। জানালার পাশে একটা সিটে বসে সে একমনে চারপাশের গাছ, ফসল, মানুষ… এ সবকিছুরই ছুটে চলা দেখতে থাকে।
রবিবার। সকাল বেলায় আজ কেমন অবসাদ চেপে বসেছিল। অ্যাডভোকেট রওশন আরা পারভীন আজ কোর্টে যাননি। সকালের নাস্তা বানিয়ে, বাসার সবাইকে খেতে দিয়ে নিজেও নাস্তা ও চা খেয়ে পেপার নিয়ে বসেছেন। খানিকবাদেই আবার দুপুরের রান্নার কাজ শুরু করতে হবে। কলিং বেল বাজছে কি? দরজা খুলতেই ছেঁড়া–খোঁড়া, রক্তমাখা জামাপরা এক অতীব সুশ্রী কিশোরীর মুখোমুখি হলেন।
“আপনি… তুমি?”
“আমার নাম শান্তা। শান্তা মিত্র। রাজারচর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গত মাসে আপনি ‘নারী ও অধিকার’ বিষয়ে একটা ট্রেনিং দিতে আসছিলেন না?”
“হ্যাঁ… আরে… তুমি বিমলকান্তি মিত্র স্যারের মেয়ে না? তোমার মা সুহাসিনী মিত্রও তো রাজারচর স্কুলে শিক্ষকতা করেন? তোমার এ কী অবস্থা?”
.উত্তর দিতে গিয়ে গত রাতের পর থেকে শান্তা এই প্রথম কেঁদে ফেলে। কাঁদে…।
একজন ট্রোজান নারীঃ মহামান্য হিক্যুবা, দেখুন এ্যান্ড্রোমেকে আসছে। কান্নায় স্পন্দমান বক্ষ,
হেক্টরপুত্র এ্যাস্তিয়ানাক্স মাতৃবক্ষে নিদ্রিত।
অপর এক ট্রোজান নারীঃ পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী নারী, কোথায় চলেছেন আপনি?
এ্যান্ড্রোমেকেঃ আমি যাচ্ছি যেখান আমাকে গ্রিক প্রভুরা নিয়ে যাবেন।
(ট্যালথিবিয়াস অন্য সৈন্যদের সাথে প্রবেশ করে। তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে এবং সে একটু ইতস্তত করে সামনে এগিয়ে আসে)
ট্রয়ের মহোত্তম পুরুষের পত্নী, আমাকে ঘৃণা করবেন না দয়া করে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা কথা আপনাকে বলতে এসেছি, গ্রিক সৈন্য ও রাজারা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে…
এ্যান্ড্রোমেকেঃ কী সেই সিদ্ধান্ত? এ যেন কিছু মন্দের সংকেত!
ট্যালথিবিয়াসঃএই শিশুটিকে…তাঁরা নির্দেশ দিয়েছেন – ওহ্, কী করে বলি?
এ্যান্ড্রোমেকেঃ বুঝতে পেরেছি – আমার সন্তানের প্রভু আর আমার প্রভু একই ব্যক্তি হবে না।
ট্যালথিবিয়াসঃ গ্রিসের কেউই তার প্রভু হবে না।
এ্যান্ড্রোমেকেঃ কিন্তু, তাকে এখানে ফেলে রেখে যাব – যখন ট্রয় পুরোপুরি ছেড়ে যাচ্ছি আমরা?
ট্যালথিবিয়াসঃ আমি জানি না আপনাকে কথাটা কীভাবে বলব। যা মন্দ, তাকে কখনোই কোন সুন্দর শব্দে সাজানো যায় না।
এ্যান্ড্রোমেকেঃ বুঝতে পারছি আপনি যথেষ্ট দয়ালু। কিন্তু আপনার কাছে কোন শুভ সংবাদ নেই।
ট্যালথিবিয়াসঃ আপনার সন্তানকে হত্যা করা হবে – এই হল পুরো মন্দ বিষয়টি।
এ্যান্ড্রোমেকেঃ ওহ, গ্রিক প্রভুর শয্যাদাসী হবার চেয়েও এ যে আরো বড় দুঃসংবাদ।
ট্যালথিবিয়াসঃ ওদিসিয়ুস এই আদেশের প্রণেতা, তিনিই সকল গ্রিককে এ নির্দেশ জানালেন।
এ্যান্ড্রোমেকেঃ হে ঈশ্বর! আমার যন্ত্রণার কোন পরিসীমা নেই।
ট্যালথিবিয়াসঃ তিনি বললেন এক বীরের ছেলেকে কিছুতেই বড় হতে দেওয়া যাবে না।
এ্যান্ড্রোমেকেঃ হে ঈশ্বর, তার নিজের সন্তানদের ওপর এই অভিশাপ বর্ষিত হোক।
ট্যালথিবিয়াসঃ ট্রয়ের সুউচ্চ প্রাচীর হতে এখন তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। সাহসী নারীর মতো বেদনা সহ্য করুন।
এ্যান্ড্রোমেকেঃ
যাও প্রিয়তম সন্তান আমার, আহ্, কেন তোর হাতের মুঠোয় শক্ত করে জড়িয়ে ধরছিস আমার হাত?
তোর বাবা হেক্টর আসবে না – কবর থেকে বর্শা হাতে সে আর উঠে আসবে না তোকে রক্ষা করতে।
(এ্যান্ড্রোমেকে পড়ে যায়, এবং তার পর হাঁটুতে ভর দিয়ে ওঠে)
৯
অরিন্দম, মোস্তাফিজ আর সারোয়ার এ ওর মুখের দিকে তাকায়। বিমলদাকে আপাতত সুস্থই মনে হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে আরো বেশ কয়েক মাস টানা সাইকো থেরাপি লাগবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো…. উনি অনুবাদও করছেন। না, অরিন্দমের পিসির পরিবারে কোন সমস্যা হয়নি। তারা সময় থাকতেই ঢাকায় তাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছিল। আর, ভগবানের অশেষ কৃপায় অরিন্দমের কোন বোন নেই ও তার মা–পিসিদের বয়স কারো পঞ্চান্নর নিচে নয়।
“শ্রেণি সংগ্রামের কী হবে মোস্তাফিজ?” সারোয়ার আনমনে রেস্টুরেন্টের প্লেটের সিঙ্গাড়ার আলুর পুর নখে খোঁটে। তবে, মুখে তোলে না।
অন্যদিন হলে মোস্তাফিজের মুখে রেলগাড়ি। তবে, আজ সে কোন জবাব করে না। শার্টের পকেট থেকে একটি নিউজ পেপার কাটিং বের করে।
“পেপারেও এসেছে এই নিউজ!”
“হ্যাঁ, গত পরশুই এসেছে। ভাগ্য তা–ও কোন নাম–ধাম দেয়নি। দাদাকে কত বললাম বউ–মেয়ে–বোনকে নিয়ে শহরে চলে আসতে। তা না করে উনি উল্টে গ্রামে গেলেন!” সারোয়ার শ্বাস ছাড়ে।
“আরে, দাদার ধারণা ছিল হাজার হোক ওনারা রাজার চরের জমিদার বংশ। উনি কলেজের শিক্ষক, বউ গ্রামের স্কুলে পড়ায়, বোন গান গায়!” অরিন্দম বাধা দেয়।
“শান্তা তো আমাদের সামনেই জন্মাল! কী মেয়ে ভাবতে পারিস? ঐটুকু মেয়ে… নাকি, গোসল না করে, একা একা শুধু বাড়ির কাজের লোককে বলে বাসে উঠে শহরে চলে এসে সোজা মহিলা পরিষদের অফিসে গিয়ে অভিযোগ করেছে। ওফ্! আর আমরা… দুই পয়সার নট… মুখে রং মেখে আজো সং সেজে যাচ্ছি… নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার! ছাগলমার্কা বিপ্লবী আমরা, ছাগল সংস্কৃতিসেবী!” মোস্তাফিজ পকেট থেকে সিগারেটর বের করেও ধরাতে পারে না।
“আমি অবশ্য নিউজটা এখনো দেখিনি। দেখি একটু?” সারোয়ার ঝুঁকে পড়ে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন – পরিবারে তিন নারীর সম্ভ্রমহানিঃ তৌফিক মারুফ, বরিশাল; একটি সংখ্যালঘু পরিবারের মা, মেয়েও পিসির ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে একদল সন্ত্রাসী। বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামে এ বর্বর ঘটনা ঘটেছে গত শনিবার রাতে। মা ও পিসি মুখ না খুললেও নির্যাতিত কিশোরী বরিশালের মহিলা পরিষদের এক নেত্রীর কাছে আশ্রয় নিয়ে ঘটনা জানানোর পর তাকে বরিশাল সরকারি মহিলা সহায়তা কেন্দ্রের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। পরে তার মা ও পিসি সেখানে আসেন। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ ঘটনা শুনে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে তাদের মামলা দায়েরের জন্য থানায় নিয়ে যায়।
“না! বিমলদার ফ্যামিলির এই লজ্জা আর অপমান আমি আর পড়তে পারব না। শান্তাকে কতটুকু দেখেছি! ছোটবেলায় কোলে এসে বসতো! পনেরো বছরের মেয়ের যা অভিজ্ঞতা হলো, তা অনেকের পঁয়ষট্টিতেও হয় না।”
পঁয়ত্রিশের সারোয়ার খবরের কাগজটা দুই হাতে মুচড়ে ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে রাখা ওয়েস্ট বিনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
অরিন্দম থমথমে মুখে ব্যাগ হতে একটি ফাইল খোলে। ফাইলভর্তি নিউজ পেপার কাটিং। সবই রেপ ভিকটিমদের ছবি। বাঁশখালির উমা দে গণধর্ষিতা। একই এলাকার রূপনা রাণী দাস ও তার মা গণধর্ষিতা। গফরগাঁওয়ের জ্যোৎস্না ধর্ষিতা হয়ে মুখে কাপড় ঢেকে রেখেছে। উল্লাপাড়া গ্রামের পাঁচজন নারী ধর্ষণের পর অপহৃত। পিরোজপুর সদরের গীতা রাণী বেপারি গণ–ধর্ষিত। চৌদ্দ বছরের পূর্ণিমা গণধর্ষিত। ভোলার লালমোহনের ধর্ষিতা তিন বালিকা ক্যামেরার সামনে মুখে কালো কাপড় বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। গৌরনদীর ছান্দসী গ্রামের গর্ভবতী সাবিত্রী ধর্ষিতা। ভোলার অন্নদা প্রসাদ গ্রামের এক পায়ের শেফালী রাণী দাস রেহাই পাননি ধর্ষণের হাত হতে। ভোলার লর্ড হার্ডিং ইউনিয়নের তরুণী গৃহবধু সুজাতা ধর্ষিতা।
আগৈলঝাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রেণুকা অধিকারী ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুটতরাজের শিকার। এছাড়াও আরো অনেকগুলো মুখে কাপড় গোঁজা ধর্ষিতা মেয়ের ছবি, যারা নিজেদের নাম–পরিচয় কিংবা গ্রামের বাড়ির ঠিকানা কিছুই জানাতে চায়নি।
“গত অক্টোবর হতে এই জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ২৮৪টি ধর্ষণ, ৩৮টি খুন, প্রায় দুই হাজার অগ্নিসংযোগ, ১০১টা মন্দির ভাঙচুর আর প্রায় চার কোটি টাকার সমান লুট–তরাজ হয়েছে,” অরিন্দম গ্লাস থেকে জল খায়।
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি…” সারোয়ার বিব্রত মুখে চুলে আঙুল চালিয়ে গুনগুন করার চেষ্টা করে।
১০
“বিমলদার কলেজের নতুন প্রিন্সিপ্যাল খুব ভালো মানুষ। গত তিন/চার মাস ধরে তিনি নিয়মিত কলেজে যেতে না পারলেও প্রিন্সিপ্যাল তাঁকে পুরো বেতন দিচ্ছেন।”
“শান্তা কি কলেজে যাচ্ছে?”
“না, বাসাতেই পড়ছে। প্রাইভেটে ইন্টার দেবে বোধ করি!”
“এদিকে দাদার বাসায় কারা নাকি ফোন করছে কেস উইথ ড্র করার জন্য। বাজে গালি–গালাজ দিচ্ছে। লাশ পড়ার হুমকি দিচ্ছে!”
“মণিকাকে নাকি ভারত পাঠায়ে দিচ্ছে?”
“দেশে থাকলে সবাই জানাজানি হয়ে ওর ত’ আর বিয়ে হতো না!”
“বউদি গ্রামের স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিলেন?”
“না দিয়ে কী করবেন? গ্রামে কি আর মুখ দেখানো যাবে?”
“বিমলদা নাকি গ্রামের জমি আর বাড়িও বিক্রি করে দেবেন? আল্টিমেটলি ওপারে চলে যাওয়াই ভালো হবে বোধ করি!”
“বিমলদাকে আর দেখতে পাব না বলে বিশ্বাস হয় না। এ পোড়া মফস্বলে এই একটা লোক লুকিয়ে লুকিয়ে এলিয়ট অনুবাদ করত, গ্রিক নাটক অনুবাদ করত… আমাদের হেগেল আর সার্ত্র অল্প অল্প বুঝিয়েছে…পড়াশোনা যা ছিল, অন্য কেউ হলে আর না হোক দশখানা এনজিও কি কিন্ডারগার্টেন… একটা না একটা ব্যবসা খুলত। নিদেনপক্ষে ঢাকার পত্রিকায় লিখে বুদ্ধিজীবী হতো। দশ বছর মিথ্যা মামলার লড়াই শেষ না হতে বউ মেয়ে–বোন, ওনার সামনে দাঁড়াতেও এখন নিজের ওপর ঘেন্না লাগে!”
মোস্তাফিজের মতো রুক্ষ মানুষও সিগারেটের ধোঁয়া আড়াল করার ছলে ডান হাতের তেলোয় চোখ মোছে। সারোয়ার একটা শ্বাস ফেলে কলিং বেল টেপে।
ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে বিমলদাকে। বহুদিন পর এত সজীব আর সতেজ লাগছে তাঁকে। শাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরনে। মুখে তাজ্জব ব্যাপার… আফটার শেভ মেখে পরিপাটি। এই বিধ্বস্ত পরিবারটি অবশ্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসার কারণেই কিনা কে জানে… একটু যেন হাত–পা ছড়িয়ে আপাতদৃষ্টে গোছানো গার্হস্থ্যে স্থিত।
“বাড়িওয়ালাকে বলেই ঘরে ডিসটেম্পার করালাম। নতুন পর্দা বানিয়েছি। দশ বছর পর বউ–মেয়ে আমার সঙ্গে আছে… বেঁচেই যখন আছি সব কিছুর পর, ভালোভাবেই বাঁচি না কেন?”
ব্মিলদার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক শোনালেও চোখ মুখ খুব ফোলা ফোলা লাগছে। কাজের মেয়ে চা রেখে যায়।
“সকালে তিন ঘণ্টা অনুবাদ করলাম। সারাদিন ছুটি ছিল। তারপর সারাদিনই ঘুমোলাম। সন্ধ্যায় উঠে স্নান করলাম!”
“দাদা, শুনলাম কারা নাকি আপনাকে মামলা উইথ ড্র করার হুমকি দিচ্ছে? বড় লজ্জা হচ্ছে দাদা… তবু, বলি কী আপনি জায়গা–জমি মোটামুটি একটা দাম পেলে সব বিক্রি করে বরং চলেই যান! এ দেশে আর কোন্ মুখে থাকতে বলি?” মোস্তাফিজ শ্বাস নেয়।
বিমলদা হাসেন।
“আজকাল ইন্টানেটে বসা শুরু করছি। বাসাতে একটা টেলিফোনেই কানেকশন নিলাম কয়েকদিন আগে। আজ এই প্রিন্ট আউটটা নামালাম!”
Gujarat Muslim women ‘rape victims’ by Jyotsna Singh.
Muslim women were subjected to “unimaginable inhuman and barbaric” sexual violence during recent communal riots in the West Indian state of Gujarat, according to a woman’s panel that has visited the state. Many women suffered the worst forms of sexual violence, including gang-rape, says their report, “How has the Gujrat massacre affected minority women. The survivors speak”. released on Tuesday. The violence began when 58 passengers were killed when a train carrying Hindu activists was torched on 27 February. It led to one of the worst bouts of Hindu-Muslim violence in the state. The official death toll in last month’s riots has now, risen to 778, although welfare groups put the figure at about 2000. ‘Complicity’ Most of the rape victims were burnt alive, Tuesday’s report says. The head of the team, Syed Hameed, told a Delhi press conference that the impact of such violence on women has been physical, economic and psychological. The team-one of the first to visit Gujarat in the aftermath of the riots-says it found evidence of police complicity in perpetrating crime against women. They allege that the police refused to file complaints by the victims. The team also demanded the announcement of a special compensation package. The panel also demanded that a special tribunal be set up to ensure justice for victims. The report also said there was no evidence of any support from the state authorities in Gujarat to help women who had suffered attack.
“মোস্তাফিজ, আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি যে এ কি আমার অক্ষমের সান্ত্বনা খোঁজা… আমি শালা আমার মেয়ে বউ–বোনের ইজ্জত বাঁচাতে পারিনি বলেই কি পাশের দেশের মুসলমান মেয়েদের আব্রু হারানোর কাহিনি পড়ে সুখ পাচ্ছি? আমার মেয়ে–বউয়ের কেস উইথ ড্র করার হুমকি পাই বলেই কি গতকাল পত্রিকার স্টল থেকে চড়া দামে “আউটলুক” কিনলাম যেখানে হুবহু একই ঘটনা? রেপ ভিকটিমকে মামলা তোলার জন্য রাম জন্মভূমিঅলাদের ভয় দেখানো? ওখানে জয় শ্রীরাম আর হর হর মহাদেব ডাকে বিজেপি–বজরং–শিবসেনার ক্যাডারদের হুমকি আর এখানে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম ডাকে বিএনপি–জামাতের ক্যাডারের থ্রেট যেন আমি আমার নাবালিকা মেয়ের ধর্ষণের মামলা উইথ ড্র করি? কোথায় পালাবোআমি মোস্তাফিজ? বিমলকান্তি মিত্র কোথাও পালাবে না। আমার শান্তা আমার কাসান্দ্রা! এই বরিশাল আমার ট্রয়। আমি ট্রয় ছাড়বো না! হোক ধ্বংস, হোক ভষ্মীভূত! ঐ যে শান্তা… আমার কাসান্দ্রা… কাসান্দ্রার চেয়েও ওর সাহস বেশি… কাসান্দ্রা মনে হয় পর্দার ওপারে মনে হয় হেঁটে যাচ্ছে। আমি কাসান্দ্রার পায়ের শব্দ চিনি, এ্যান্ড্রোমেকের পায়ের শব্দ চিনি!”
“বিমলদা আপনি ঠিক আছেন তো?”
“হ্যা, আমি ভীষণ ঠিক আছি। এত ঠিক কখনো ছিলাম না। কাসান্দ্রা! এ্যান্ড্রোমেকে!” তিনি গলা চড়ান।
যাদের ডাকা হলো, তারা মনে হয় এই ডাক দুটোয় অভ্যস্ত এতদিনে। পর্দার ফাঁক থেকে খুব সঙ্কুচিত ও শীর্ণ দুটো মুখ দেখা গেল। কিশোরী মুখটি এক পলক দেখা দিয়েই চলে গেল। উনচল্লিশের অন্তযৌবনা সুন্দরী সঙ্কোচ কাটিয়ে, পর্দা সরিয়ে ভেতরে এলেন।
“দেখতেই তো পাচ্ছো তোমাদের দাদার অবস্থা! সব কিছুই ঠিক আছে আবার কোথায় যেন বেঠিক। নাটক আর জীবনকে এক করে দেখছেন!”
“বোকার মতো কথা বলো না এ্যান্ড্রোমেকে! এ্যান্ড্রোমেকে ভাবছে তার হেক্টর মৃত। না, এই হেক্টর এখনো মরেনি!” বিমলকান্তি বুকে চাপড় দেন, “মোস্তাফিজ… না, না… তুমি ট্যালথিবিয়াস… মঞ্চ সাজাও! ঈজিয়ান সাগরের ব্যাকসিন সাজাতে একটা বড় সি ব্লু কালারের কাপড় কেটে ক্যানভাস, আলো ফেলে সাদা পালতোলা নৌকা বানাতে হবে… আর দেরি না… আমার অনুবাদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে!”
(ট্যালথিবিয়াস কিছু সৈন্যর সঙ্গে আসছে। সে সঙ্গে মৃত শিশুটিকে বহন করছে)
ট্যালথিবিয়াসঃএকটি জাহাজ অপেক্ষা করছে হিক্যুবা, এ্যাকিলিসের বখাটে ছেলে যা যা ট্রয় হতে দেশে নিয়ে যাবে তা বহন করার জন্য। এ্যান্ড্রোমেকেকে সে সঙ্গে নিয়ে গেছে। জাহাজে উঠবার আগে এ্যান্ড্রোমেকে কেঁদেছিল, আমাকে বলেছে তার পুত্রকে কবর দিতে, মিনতি করেছে সামান্য কিছু ফুল যেন
ছড়িয়ে দেওয়া হয় তার কবরের উপর।
(সমবেত ট্রোজান নারীরা হেক্টর পুত্র শিশু অ্যাস্তিয়ানাক্সের দেহ তার পিতার বর্মে আচ্ছাদিত করে)
ট্যালথিবিয়াসঃ সেনাপতিগণ, অ্যাটেনশন! আপনাদের ওপর আদেশ এসেছে এই শহর জ্বালিয়ে দেবার।
দ্রুত এই আগুন জ্বালান। নারীরা, তূর্যনিনাদ ধ্বনি শোনা গেলেই গ্রিক জাহাজে উঠে যাবেন। হিক্যুবা, আপনার জন্য সবচেয়ে খারাপ লাগছে, ওদিসিয়ুসের সৈন্যরা এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। আপনি তার ক্রীতদাসী হবেন।
হিক্যুবাঃ ওরা আমাদের গবাদি পশুর মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রিয়াম, প্রিয়াম–তুমি মৃত, কোন মন্দ লোকটি আমার মালিক হতে যাচ্ছে, তা কি জানো তুমি?
এক নারীঃ না, মৃত্যু তার দৃষ্টিতে অন্ধকার এনে দিয়েছে।
হিক্যুবাঃ দেবতাদের আবাসভূমি হে পবিত্র ট্রয়, প্রথম এসেছিল বর্শা এবং তারপর শুধু উজ্জ্বল লাল শিখা।
অপর এক নারীঃ পতিত হও ও নিজেকে বিস্তারিত হতে দাও। মৃত্তিকা বড়ই দয়ালু।
অন্য এক নারীঃ ধুলোর ঝড় উঠেছে, যেন বা ধোঁয়াশার সুবিশাল পক্ষবিস্তার, আমি আমার ঘর দেখতে পাচ্ছি না।
আর এক নারীঃ ট্রয় চিরদিনের মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত।
(একটি বড় ধসের শব্দ শোনা যায়)
হিক্যুবাঃ তোমরা কি শুনতে পেয়েছ?
এক নারীঃ ট্রয়ের পতন…
অপর এক নারীঃ ভূমিকম্প ও বন্যা আর আমাদের শহরের শেষ মূহর্ত।।
হিক্যুবাঃ কম্পিত দেহ– বৃদ্ধ অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ, আমাকে অবশ্যই নিয়ে যাবে তোমরা দাসত্বের নতুন দিনে।
(একটি তূর্য নিনাদ শোনা যায়)
এক নারীঃ বিদায় প্রিয়তম নগরী আমাদের, বিদায় প্রিয় শহর, যেখানে আমাদের শিশুরা খেলা করত – এখন যেতে হবে, যেহেতু গ্রিক জাহাজ অপেক্ষা করে আছে।
(আবার তূর্যনিনাদ শোনা যায় ও ট্রয়ের নারীরা বের হয়)
রচনা: অক্টোবর ২০০১– আগস্ট ২০০৯।
(উৎসর্গ: ২০০১–২০০২ এ ভারতের গুজরাট ও বাংলাদেশের নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাসে ধর্ষিত দু’দেশের সকল সংখ্যালঘু নারীকে!)
কবি,কথাসাহিত্যিক