| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: নারীর অধিকার । শ্রীশুভ্র

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

কোন নারী যখন প্রশ্ন তোলে পুরুষ পরস্ত্রীর সাথে বা বহু নারীর সাথে যৌন সুখ উদযাপন করলে দোষ নেই অথচ নারী বহু পুরুষের সাথে যৌন আনন্দ উপভোগ করলেই সমাজ সংসার রসাতলে চলে যায়, এ কেমন বিচার, তখন শুধু মাত্র পুরুষ সত্তায় নয় একজন মানুষ হিসেবেই নিরুত্তর হয়ে যেতে হয় এক অমোঘ অপরাধ বোধে। অপরাধ বোধ সমস্ত মানুষের হয়েই, অপরাধ বোধ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সভ্যতার উত্তরাধিকারেই। তখন আর এই কথা বলে আত্মপ্রবঞ্চনার ঝুলিটি বোঝাই করতে ইচ্ছে হয় না যে, বহুগামি যৌনতা সমাজ সংসারের পক্ষে শুভ নয় আসলে। কিন্তু কেন শুভ নয়? পিতৃতান্ত্রিক বন্দোবস্তের ভিতটাকে মজবুত রাখতে? যে কাজ পুরুষের পক্ষে ততটা দোষাবহ নয় সেই একই কাজ নারীর দ্বারা সংঘটিত হলেই সে সমাজের চোখে স্বৈরণী বলে প্রতিপন্ন হবেই বা কেন? কেন পুরুষের বহুবিবাহের সমাজ স্বীকৃত কালেও বহুগামি পুরুষে সমাজ যখন রসাতলে যায়নি, তখন নারীর ক্ষেত্রেও কেন একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না? এ কেমন বিচার? এই কথা, এই প্রশ্ন তুললেই বা কেন একজন নারীকে তসলিমানাসরিন বলে দোষারোপ করা হবে? সেই মানুষটি সততার সাথে পুরুষের গণ্ডীতে সদর্পে প্রবেশ করেছিলেন পুরুষের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্মণ রেখা ডিঙ্গিয়েই বলেই কি? এই ঔদ্ধত্ব বরদাস্ত করতে রাজী নয় পিতৃতন্ত্র।

না পিতৃতন্ত্র নারীকে কোনদিনও সেই অধিকার দেবে না, যে অধিকার বলে সে আবহমান কাল ব্যাপীসময়সীমায় নারীকে উপভোগ করে এসেছে তার অদম্য যৌন তারণায়। এইটাই তো স্বাভাবিক। এইটাই ক্ষমতা চর্চার চাবিকাঠি। নয় কি? এই যেমন বিশ্বে প্রথম পরমাণু শক্তিধর দেশ ও ইতিহাসে একমাত্র পরমাণু বোমা নিক্ষেপকারী দেশ মার্কীণ যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে, কে পরমাণু শক্তি অর্জন করবে আর কে করবে না, কোন দেশকে পরমাণু বোমা বানানোর মিথ্যে দোষারোপ দিয়ে গোটা দেশটাকে নরক বানিয়ে দেবে তা একাই  ঠিক করে দিয়ে থাকে, ঠিক সেই রকমই। কারণ আবিশ্বশোষণবাদী এই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রটি জানে যতদিনবিশ্বক্ষমতার ভারসাম্য তার দিকেই ঝুঁকে থাকবে, ততদিনই সে আবিশ্ব শোষণ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখতে পারবে। ধরুন আপনার লোকালয়ে সবচেয়ে বড়ো যে মস্তান সে ঠিক করে দিল, সে বাদে আর কারুর বাড়ির দরজায় খিল থাকবে না, বাজারে তালা চাবি বিক্রয় নিষিদ্ধ। কেউ বাড়িতে লাঠিসোটা দা কাটারি রাখতে পারবে না! মার্কীণ যুক্তরাষ্ট্রের আবিশ্ব পরমাণু বোমা বানানোর নিষেধাজ্ঞাও ঠিক সেই রকমেরই। আর এইটিই ক্ষমতা চর্চার মূল চাবিকাঠি। যে দেশ হিরোশিমানাগাসাকিউড়িয়ে দিয়েও লজ্জিত নয়, নয় ক্ষমাপ্রার্থী, সেই দেশই ঠিক করে দিচ্ছে কোন দেশ পরমাণু শক্তিধর হবে আর হবে না। এইটাই জগতের নিয়ম। কারণ ক্ষমতাধরের সবসময় ভয় থাকে ক্ষমতা হারানোর। তাই সে প্রাণপনে চেষ্টা করে সে যাকে শোষণ করছে, সে যেন ক্ষমতাধর হয়ে না ওঠে কোনদিন। এই প্রয়াসের সাফল্যের মধ্যেই তার ক্ষমতাচর্চারপ্রাণভোমরা।

পিতৃতন্ত্রও ঠিক সেই কাজটিই করে আসছে আবহমান কালব্যাপী সময় সীমায়। আর আমরা পুরুষরা, যার যেমন রুচি, শিক্ষাদীক্ষা, সুযোগ, সামর্থ্য; সেইমত এই পিতৃতন্ত্রের বরমাল্য পড়ে বসে আছি। তাই যে কাজ পুরুষ করলে আমরা বিশেষ আমল দিই না, সেই একই কাজ একজন নারী করলেই আমরা দলবেঁধে রে-রে করে উঠি। কারণ আমাদের ভয় থাকে, নারীর বহুগামিতা সমাজ মেনে নিলে ঘরের বৌটিকেসামলিয়ে রাখতে পারবো তো আদৌ? তার দেহ মন যৌনতার উপর স্বামী হিসেবে আমার একান্ত যে একছত্র অধিকার, সেই অধিকার চর্চায় বিঘ্ন ঘটে যাবে না তো একদিন? তাই আমরা কেউই এই ঝুঁকিটা নিতে পারি না। যে যত বেশিই নারীবাদী হই না কেন।

কিন্তু নারী? তার পিতৃতান্ত্রিক মগজ ধোলাইয়েরলক্ষ্মণরেখার বাইরে গিয়ে যদি সত্যই প্রশ্ন করতে চায়, যে দেহটি তার নিজের; সেই দেহের যৌন আনন্দ উপভোগের স্বাধীনতা তার থাকবে নাই বা কেন? আমরা তখনই পাল্টা প্রশ্নে শান দেব, যৌনতা যৌন আনন্দতো শুধুই দেহ সর্বস্ব নয়! পশুর সাথে মানুষের তো এইখানেই তফাৎ! ঠিকই তো, আর ঠিক সেই জায়গায়তেই একজন নারীও তো তার যুক্তিটি মেলে ধরতে পারে এই বলে যে, প্রতিদিন একই মানুষের সাথে সহবাসে সে তো মানসিক ভাবেও তৃপ্তি নাও পেতে পারে। দাম্পত্যের সেই তৃপ্তিহীন নিরানন্দ নিত্যনৈমিত্তিক যৌনতাও কি পাশবিক নয়? যা শুধুই শরীর সর্বস্ব! মনের আনন্দ যেখানে গিয়েছে ফুরিয়ে, বা হারিয়ে? আর সেই হারিয়ে যাওয়া আনন্দটুকু যদি সে অন্য পুরুষের সাহচর্যে খুঁজে পেতে চায়? তার সেই চাওয়াটুকু পেতে যদি তার সংসারকে ভাসিয়ে দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের চুড়ান্তপরিণতিরদিকে এগিয়ে না গিয়েই এই দুই দিকের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য তৈরী করতে চায় সে, সমাজ সংসার কেন তখন তার দিকে ব্যাভিচারের আঙুল ওঠাবে? মূল প্রশ্নটা কিন্তু এইখানেই। যার উত্তর দেওয়া, বা দেওয়ার মতো হিম্মত সত্যইকিপুরুষতন্ত্রের আছে আদৌ?

আমরা সবাই জানি নেই, আর নেই বলেই সে নানান ছলে সতীত্বের মহিমা কীর্তন করে চলে আবহমান কাল ধরে। শুধু সতীত্বের ফাঁক গলেও যদি তার যুক্তি জাল দূ্র্বল হয়ে পড়ে, তাই সে সতীত্বের সাথে মাতৃত্বের মহিমাকেও সমান তালে, ক্ষেত্র বিশেষে বেশি করে প্রচার করে থাকে। আর এই প্রচারের সংস্কৃতির মধ্যেই সাংসারিক মগজ ধোলাইয়ের ঘেরাটোপে কৈশোর পেড়িয়ে যৌবনে পদার্পণ করতে থাকে নারীর ভুবন। তার দেহ মন যৌনতা। ফলে স্বভাবতঃই সেও এই সতীত্ব ও মাতৃত্বের মোহে পড়ে যায় যৌবনের উন্মেষলগ্নেই। এখানেই পিতৃতন্ত্রের বিপুল সাফল্য। ঠিক যেমন গ্লোবালাইজেশনের মোহে আবিশ্ব মানুষকে বেঁধে ফেলেছে ধনতান্ত্রিকসাম্রাজ্যবাদ। আমরা যেমন সেই মোহেই আচ্ছন্ন হয়ে বিশ্বকবির ‘রক্তকরবী’ নাটকের রাজার এঁঠোদেরমতো ৬৯ফ ৪৯ঙ হয়ে যাই কখন বুঝতেও পারি না। চাইও না। ঠিক সেই মতোই একটি মেয়েও বুঝতে পারে না এই সতীত্ব আর মাতৃত্বের যাঁতাকল কিভাবে তার নিজস্ব নারীর ভুবনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে পিষে মারছে। ফলে সেও বিশ্বাস করতে শুরু করে পিতৃতন্ত্রই সমাজ সংসার সুস্থ রাখার একমাত্র বন্দোবস্ত। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। সতীত্ব আর মাতৃত্বই নারী জীবনের মূল আদর্শ। ঠিক যেমন আমরা ধরেই নিয়েছিধনতন্ত্রেরবিশ্বায়নই সম্পদের উপর অধিকার অর্জনের একমাত্র বিকল্প!  এই ভাবেই অন্ধবিশ্বাসে একটি অন্যায় ব্যবস্থা বা রীতিকে মেনে নেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। করা হয় কি ভাবে? যেকোন বিষয়ে একটি তীব্র মোহ বিস্তার করে তোলা ও সেই মতো সেই মোহজালে মানুষের মগজ ধোলাই করেই এই ধরণের প্রথাগুলিকে টিকিয়ে রাখা হয়। সে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই হোক, কিংবা আমাদের প্রতিদিনের সমাজ সংসারের দাম্পত্যের ঘেরাটোপেই হোক। এইটাই মূল পদ্ধতি। আর সেই প্রথার বিরুদ্ধেই যখন কোন নারী তাঁর একক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে প্রশ্ন করতে শুরু করে, তখনই সর্ব যুগেই তার বিরুদ্ধে সমাজ রে-রে করে ওঠে সমাজকে রসাতলে যাওয়া থেকে রক্ষার অজুহাতে, ঠিক যেমন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে আবিশ্ব সকল দেশকে রক্ষার অজুহাতে একমেরু বিশ্বে মার্কীণসাম্রাজ্যবাদ প্রায় সকল দেশকেই তার ক্ষমতার আওতায় ধরে রাখার জন্যে বিভিন্ন দেশে অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে তার সৈন্যসামন্ত বসিয়ে রাখে।  এও সেই রকমই এক অমোঘ অস্ত্র এই পিতৃতন্ত্রের। যাকে আমারাসতীত্ব আর নারীত্ব বলে বুঝে থাকি, প্রচার করে থাকি।

কিন্তু একটি নারীর জীবনে, এই সতীত্ব আর মাতৃত্ব কতটা প্রাসঙ্গিক, কতদূর প্রাসঙ্গিক, এবং সেই প্রাসঙ্গিকতার উপর তার নিজের ব্যক্তি স্বতন্ত্রতার স্বাধীনতাই বা কতখানি, এই মূল্যবান প্রাথমিক প্রশ্নগুলি আমরা কজন করি? বা করতে দিই কোন নারীকে? দিই কি আদৌ? কিন্তু আমরাই তো আবার আমাদের আধুনিক মানসিকতা নিয়ে কতই না গর্ব করে থাকি! ধরা যাক একজন ভদ্রলোক অফিস থেকে বাড়ি ফেরার শেষ ট্রেনটি মিস করে ফেলেছেন। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিলেন রাতটুকু অফিসের কোন এক কলিগের বাড়িতে কাটিয়েপরদিন অফিস করে বাড়ি ফিরবেন। খবর শুনে ভদ্রলোকের গৃহিনীনিশ্চিন্তে থাকলেন যাক রাতটা পথেঘাটে কাটাতে হল না তাঁর স্বামীকে। কিন্তু ধরুন এই একই ঘটনা যদি একটু উল্টো ভাবে ঘটে? ভদ্রলোক খবর পেলেন তার স্ত্রীকেই অফিস কলিগের গৃহে আশ্রয় নিতে হল একটি রাতের জন্যে? ভদ্রলোক কতটা নিশ্চিন্ত হতেন খবরটি শুনে? সে কি এই কারণে যে তাঁর দাম্পত্য প্রেম স্ত্রীর থেকে বেশি? না কি নিজ স্ত্রীর চরিত্রের উপর তাঁর নিজেরই ততটা বিশ্বাস নেই আসলে? অর্থাৎ একজন পুরুষ যখন হঠাৎ বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে বাধ্য হন তখন তাঁকে নিয়ে, তিনি রাতটুকু কার পাশে শুলেন, সেই কথা ভেবে ততটা উতলা হন না তাঁর স্ত্রী, ঠিক যতটা উতলা হবেন ভদ্রলোক সেই একই কথা ভেবে। ধরেই নেওয়া যায় বাড়িতে ফিরে স্ত্রীতাঁর রাত্রি যাপনের আনুপার্বিক সকল বিবরণ দিয়ে তবেই তাঁর সতীত্ব রক্ষা করতে পারবেন। লঙ্কাফেরত সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় সতীত্বের প্রশ্নে। কিন্তু সেই একই সময় আপন  স্ত্রী’র সাহচর্য হারিয়ে রামচন্দ্রেরনিশিজীবন কি রকম কাটতো, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলে না সমাজ কোনদিন। মহাকবিও সেই বিষয়ে পাশকাটিয়ে গিয়েছেন। এটাই পিতৃতন্ত্রেসতীত্বের মহিমা। পঞ্চ স্বামী নিয়ে দ্রৌপদীর সতীত্বকতটুকু রক্ষা হয়েছিল, কিংবা আমাদের তিন চার পুরুষ আগের বাপ ঠাকুরদাদের আমলে সতীন নিয়ে ঘর করা নারী জীবনে নারীর সতীত্বের রূপ কি রকম ছিল সে কথাও আমরা সকলেই জানি। এটাই পিতৃতন্ত্রেসতীত্বের মহিমা।

এই যে নারীরমূল্য আসলেই পুরুষের যৌনদাসত্বে, সেই কথাটাই প্রকারন্তরে নারীর অস্থিমজ্জায় চেতনার সর্বস্তরে জায়মান করে তোলাই সতীত্বের মহিমা প্রচারের আসল উদ্দেশ্য। মূল লক্ষ্য। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সেটাই উত্তরাধিকার। যে উত্তারাধিকারকে বহন করতে না চাইলেই আপনি ব্রাত্য। যে উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই আপনি অসামাজিক। আর প্রতিটি সিস্টেমের সাফল্য সুরক্ষিত রাখার জন্যে যেমন একটি ব্যাক-আপ মেকানিজম থাকে, এই পিতৃতন্ত্রের সাফল্য সুরক্ষিত রাখার জন্যে সতীত্বের পেছনে ঠিক তেমনই মাতৃত্বের মহিমা কীর্তন। এই সেই ব্যাক আপ মেকানিজম যা নারীকে পুরুষের যৌনদাসত্বে আবিষ্ট করে রাখে। শুধু সতীত্ব দিয়ে যে কাজ এমন অমোঘ ভাবে সম্পন্ন করা সহজ ছিল না আদৌ। আর সেই মাতৃত্বের মোহেই নারী তার গর্ভের উত্তরাধিকারও তুলে দিতে বাধ্য হলো পুরুষের বংশরক্ষায়বংশপরিচয়ের সংস্কৃতিতেই।  মাতৃত্ব যা নারীর একান্তই সহজাত প্রকৃতি, যে বিষয়ে পুরুষের ভুমিকা মূলত গৌন, নারীর ভুমিকাই প্রধানতম, সেইখানে নারীর সন্তান তার মাতৃপরিচয়ে পরিচিত হলেই সেটাই হতো সত্য। আর তখন কোন নারীকেই তার সন্তানের পিতৃপরিচয়ের জন্যে কারুর যৌনদাসত্বে বাঁধা দিতে হতো না আপন শরীর ও তার যৌন আবেগকে। নারী পুরুষের পারস্পরিক ভালোবাসার ক্ষেত্রটিও স্পষ্ট থাকত পারস্পরিক মৌলিক অধিকারের গণ্ডীতে। কিন্তু তাতে পুষ্ট হয়ে উঠত না আবহমান পিতৃতন্ত্র। বরং এই যে মাতৃত্বের মহিমা প্রচার করে নারীর সতীত্বের উপর পুরুষের জবর দখল; এই যাঁতাকল থেকে নারীজীবনকে পরিত্রাণ দিতে নারাজ পিতৃতন্ত্র।

এইভাবেই নারী জীবনের ভুবনকে পুরুষের ভোগে উৎসর্গ করে তুলেছে সমাজ সংসার পিতৃতন্ত্রের মাধ্যমে।  আর সেইখানেইবহুগামিগৃহবধুপুরুষতন্ত্রের কাছে সবচেয়ে বড়োচ্যালেঞ্জ। যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হয় নি আজও সমাজকে। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জকেএড়িয়ে চলতেই সমাজে নারীর বহুগামিতাকেব্যাভিচার বলে ধরা হয়। বহুগামি নারীর পরিচয় হয় স্বৈরণী বলে। কিন্তু কেন এমনটাই মেনে নিতে হবে, যদি প্রশ্ন করে ওঠে কেউ? বিশেষ করে তিনি যদি নারী হন, হন গৃহলক্ষ্মী? নিত্যনৈমিত্তিকদাম্পত্যের শৃঙ্খলে হাঁফিয়ে উঠে নিজের যৌনতাকে নতুন ভাবে অনুভব করতে চায় যদি কোন নারীর নিজস্ব শরীর? তখন! না সেই উত্তর আমাদের কারুরই জানা নেই হয়তো। কারণ আমারা এমন বেয়াড়া প্রশ্নকে নৈতিকতার তলায় চাপা দিয়ে রাখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু তাতেই কি মুখ রক্ষা হয় আমাদের? সত্যি করে? হয় না। হতে পারে না। প্রশ্নটা নারী বা পুরুষের নয়, প্রশ্নটা মানুষের। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত শিক্ষা দীক্ষা রুচি সংস্কৃতি অনুযায়ী তার কামনা বাসনার গতি প্রকৃতি ঠিক হয়। সেই অনুযায়ী তার যৌন আবেগও হয় নিয়ন্ত্রীত। সেই যৌন আবেগের পরিপূ্র্ণ বিকাশ হওয়াটাই প্রকৃতির প্রধানতম দাবি। সমাজকেও সেই মতো চলতে হবে যদি প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষিত করতে হয়। আমাদের মূল সমস্যই হচ্ছে, আমরা ধরেই নিই, দাম্পত্য মানেই চিরস্থায়ী একটি সম্পর্ক। ধরে নিই কারণ, তাতেই পিতৃতন্ত্র নিশ্চিন্তে থাকে তাই। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না যে, এই বিশ্বজগতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। নয় বলেই এই বিশ্বচরাচর চির সজীব। সেখানে দাম্পত্যকেবংশরক্ষারসুবিধার্থে সমাজ সংসারের সুস্থতা রক্ষার কথা ভেবেও চির স্থায়ীত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেলার মধ্যেই যে দাম্পত্যেরসজীবতার মৃত্যু; ভেবে দেখি না সেটাই। কিন্তু সমাজে সেই সুখহীন দাম্পত্য বয়ে নিয়ে বেড়ানো পুরুষের জন্যে স্বাদ পাল্টানোর উন্মুক্ত পথ থাকলেও নারীর জন্যে সেই পথ আজও রুদ্ধই। আর সেই সময়েই যদি দাম্পত্যেরযৌনসুখ বঞ্চিত কোন নারী অন্য কোন পুরুষের সাহচর্যে তার জেগে ওঠা যৌন আবেগকে তৃপ্ত করতে পারেন এবং সেই পারার মধ্যেই যদি তার রোজকার সংসারকে সুস্থ সুন্দর রাখার নিত্যদিনের কাজে তিনি প্রেরণা পেতে থাকেন তবে তাতেই বা ক্ষতি কি? এই মৌলিক প্রশ্নটিওরসম্মুখীন হতে হবে সমাজকেই। আমাদের চিরকালীন ধারণাগুলিকেই স্বতঃসিদ্ধ মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে এক যান্ত্রিকতা।  যার পৌনঃপৌনিক ব্যবহার আমাদের এগিয়ে যেতে দেয় না কোথাও। আমরা ঘুরপাক খেতে থাকি অসাড় কোন না কোন ধ্যানধারণার চারপাশেই। আমাদের সমাজ সংসারে দাম্পত্যও ঠিক সেই রকম একটি ধারণা, যাকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েই পুষ্ট করে চলেছি পিতৃতন্ত্রকে। আমাদের মনে রাখা দরকার দাম্পত্যের এই চিরকালীন ধারণাই পিতৃতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ। তাই সময় এসেছে এই ধারণাটিকে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য করে তোলা।

নিত্য নৈমিত্তিক দাম্পত্যের একঘেয়েমি কাটিয়ে তুলতে পুরুষের মতোই নারীও যদি তার যৌন সুখের বিকাশে, কারুর শারীরীক সঙ্গ সুখে তৃপ্ত করে নিতে পারে তার না মেটা যৌন আবেগকে, এবং সেই তৃপ্তির রেশ নিয়ে নিত্য নৈমিত্তিক দাম্পত্যকেই সুসহ করে নিতে পারে, তবে তো লাভ সংসারেরই। লাভ পরিবার পরিজনেরই। আমরা কেন এই কথাটি এই ভাবেও ভেবে দেখতে পারি না, আমাদের মনেরও যেমন বন্ধুর দরকার পরে জীবনের পরতে পরতে, ঠিক তেমনই সমান ভাবেই শরীরেরও প্রয়োজন আছে শারীরীক বন্ধুত্বের। যৌন সুখ বঞ্চিত দাম্পত্যে নারী বা পুরুষ যে কেউই যদি সেই বন্ধুত্বের অমলিন তৃপ্তি পেতে খুঁজে নিতে চান বিপরীত লিঙ্গকে, তবে তা সমাজগ্রাহ্য বিষয়ই বা হবে না কেন? পিতৃতন্ত্রের ভিতটা টলে যাবে বলে তো? যাক না। তাতে যদি কালক্রমে এই অন্যায় ব্যবস্থা ধ্বংসই হয়ে যায়, তবে সভ্যতার জন্যে সে সুখের দিনই হবে নিসঃন্দেহে বলা যায়। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত