উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: বৃষকাষ্ঠ: কাঠখোদাই শিল্পের অন্যতম নিদর্শন
শুদ্ধশীল ঘোষ
বাংলার কাঠ খোদাইশিল্প আমাদের ঐতিহ্য। গোটা বাংলা জুড়ে কাঠ খোদাই শিল্পের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। যার মধ্যে হাওড়া, হুগলী, দক্ষিন চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান, নদীয়া প্রভৃতি জেলা অন্যতম। হাওড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে দারুবিগ্ৰহ এর বিভিন্ন মন্দির লক্ষ্য করা যায়। উৎকৃষ্টতম দারুবিগ্ৰহ ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে কাঠখোদাই শিল্পের অন্যতম এক নিদর্শন ‘বৃষকাষ্ঠ’। এই জেলার জগৎবল্লভপুর থানা অন্তর্গত বেশ কিছু গ্রামে যেমন- গড়বালিয়া, পাঁতিহাল, মাজু, রামপুর, কৃষ্ণানন্দপুর প্রভৃতি জায়গায় প্রাচীন বৃষকাষ্ঠ দেখতে পাওয়া যায়। সনাতন হিন্দু ধর্মমতে মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়ার একটি বিশেষ অংশ হল ‘শ্রাদ্ধ’। মৃতের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাপূর্বক অন্নাদি দান হল শ্রাদ্ধ শব্দের আভিধানিক অর্থ। মৃত ব্যক্তির অশৌচান্তের পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বেশ কিছু তারতম্য থাকলেও সাতটি বিষয় বিশেষ অবশ্যকরনীয়। যেমন:- বৃষোত্সর্গ, তিল- কাঞ্চন, ষোড়শ দান, আদ্য একোদ্দিষ্ট, অঙ্গ প্রায়শ্চিত্ত, সুর্যার্ঘ্য দান, বৈতরণী পার। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই সবকটির মধ্যে সবচেয়ে উৎকীর্ণ হল ‘বৃষোত্সর্গ’। যে শ্রাদ্ধের দ্বারা মৃতব্যক্তির আত্মা স্বর্গবাস নিশ্চিত।
সেই বিশ্বাস কে মান্যতা দিয়ে গ্রামবাংলায় প্রচলিত ছিল বৃষোত্সর্গ শ্রাদ্ধ। কাঠখোদাই শিল্পীরা ভক্তি, নিষ্ঠায় ও শুদ্ধাচারে এই বৃষকাষ্ঠ গুলি নির্মাণ করতেন। জগৎবল্লভপুর থানা অধীন একমাত্র বৃষকাষ্ঠ তৈরী করতেন গড়বালিয়া নিবাসী কিশোরীমোহন দাস। জাতিতে তারা সূত্রধর। কিশোরীমোহন এর পর যুগোল দাস ও বৃষকাষ্ঠ নির্মাণ করতেন। বর্তমানে ওনাদের বংশধররা মৃৎশিল্পের সাথে যুক্ত আছেন। নিম এবং বেল কাঠকেই বৃষকাষ্ঠ নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হতো। মোটামুটি ছয় ফুট উচ্চতায় তৈরী হতো এই বৃষকাষ্ঠ গুলি সময় লাগতো কম করে পনেরো দিন।। মৃত ব্যাক্তির আদলে তৈরি করা হতো বৃষকাষ্ঠ গুলি। যেমন যদি মৃত ব্যাক্তি ব্রাহ্মন হতেন তাহলে তাঁর বৃষকাষ্ঠের আদল হতো আদুর গা,গলায় উপবীত এবং নামাবলী, হাতে জপমালা। আর অব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে উপবীত থাকতো না। অন্যদিকে সধবা মহিলাদের ক্ষেত্রে ছিল লালপার শাড়ি, পায়ে আলতা এবং মাথায় সিন্দূর, হাতে জপমালা। বিধবাদের ক্ষেত্রে সাদা শাড়ি, গলায় তুলসী মালা এবং হাতে জপমালা। সারা বছর যাতে রোদে জলে মূর্তি গুলি অক্ষত থাকে সেই জন্য বৃষকাষ্ঠের গায়ে মাখানো হতো বিশেষ ভাবে প্রস্তুত এক তেলরং। রংএর পর বিভিন্ন সাজসজ্জার মাধ্যমে সাজিয়ে তোলা হত মূর্তি গুলো কে।
শ্রাদ্ধের পর নদীর তীরে, পুকুরের পারে, শ্মশান ভূমিতে, প্রান্তরে, বন মধ্যে প্রোথিত করা হত এই বৃষকাষ্ঠ গুলিকে।একসময় নিজবালিয়ায় সিংহবাহিনী মন্দিরের অদূরে পুকুর পাড়ে, বুড়িপুকুর শ্মশানে কয়েকটি বৃষকাষ্ঠ দেখতে পাওয়া যেত। অবশ্য বর্তমানে সেগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়াও মাজুতে,পাঁতিহালের মণ্ডলা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে কয়েকটি বৃষকাষ্ঠ আজও দেখতে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলি জীর্ন হয়ে ভগ্নস্তুপে পরিনত হয়েছে।তবুও অতীতের কাঠখোদাই শিল্পের উল্লেখযোগ্য স্বাক্ষর হিসেবে আজও বৃষকাষ্ঠ গুলি মানুষের নজরকাড়ে।
সাক্ষাৎকার: সমর দাস। (বৃষকাষ্ঠ নির্মাণ শিল্পী কিশোরীমোহন দাসের বংশধর।)

লেখাটি পড়ে ভালো লাগল। তবে অতি সংক্ষিপ্ত। বিস্তারিত জানার ইচ্ছে রইল।
হীরক সেনগুপ্ত