| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: ভাষাংবুরুর লেখাগুলি (ধুলো আর ভাবনার লেখা) 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
সহজ ভাবা মোটেও জটিল কোনো কাজ নয়। পৃথিবীর যেকোনো কিছু সঙ্গে একটা ভাব করুন। দারুণ অপূর্ব্ব, আশ্চর্য একটা ভাব করুন,
(হ্যাঁ নিজেকে বাদ দিয়ে, নিজের সাথে ভাব করা যায় না, করতে গে ভাব করার বদলে ভাব দেখানো হয়ে যায়। তাই নিজের সাথে ভাব নয় ভালোবাসা করতে হয়। নিজের সাথে ভাব করলে নিজের সাথে আড়ি নামক সম্ভাবনাটিও সেই মুহূর্তে জন্মে যায়। যা ভুবনের সবচেয়ে বড়ো পাপ, নিজের সাথে আড়ি।) 
ধরুন ঠিক এই মুহূর্তে আপনার মোবাইল স্ক্রীনে দিকে তাকালে যে আবছা ধুলো পড়েছে তার সাথেই ভাব করুন না। পাগলামির কথা বলছি না, ধরে নিন ওই ধুলোগুলো কোনো বহুদূর মহাদেশ থেকে উড়ে উড়ে এসেছে কতো শতো বছর ধরে। ওই একটা অতি সুক্ষ্ম আবছা দানা যেটা আপনি স্ক্রীনের কোনার দিকে দেখতে পাচ্ছেন। তাকান ওর দিকে, চোখে পড়বে না এমনি তে। খুব খুঁটিয়ে দেখলে বুঝবেন কি বিরাট একটা ছোটো ও। দেখতে পাচ্ছেন যেই আপনি অতো ধুলোর মধ্যে থেকে ওটাকে আলাদা করে দেখতে পেলেন, ওর মুখে কি অনাবিল আকাশের মতো হাসি। ওকে দেখার চেষ্টা করছে কেউ, এ জিনিস ওর কাছে স্বপ্ন!! একটু চুপ করে দেখুন দেখবেন একটা মস্তো বড়ো পাহাড়, কোন দেশ প্রথমে বোঝা যাবে না, হয়তো কারাকোরামের ওদিকে হবে। দেখুন, শান্ত নিঝঝুম পাথরজনিত নীরব চারিদিকে, রোদের কট্টর আলো। হঠাৎ যেন এক ঘুমের মধ্যে ভয়ের স্বপ্ন দেখে বাচ্চারা যেমন হঠাৎ কেঁপে ওঠে তেমনি কেঁপে উঠলো একটা বড়ো পাথরের খন্ড আর সঙ্গে সঙ্গে গড়াতে শুরু করলো নীচের দিকে। তার আশে পাশে বাবা মা পাথরের আর্তনাদও আপনি শুনতে পাবেন। কিন্তু পাথর জন্মগত অসহায়, মাধ্যাকর্ষণ মাড়োয়ারীর কাছে তার সমস্ত ওজন দেনায় বাঁধা। আপনি দেখুন সেই বাবা মা চ্যুত পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় চলেছে, তার শব্দে কেমন মৃদু আর্তনাদতুল্য নীরবতার অংশ বেড়ে যাচ্ছে, একসময় মিলিয়ে গেল সব আওয়াজ। না জীবন থামেনি কিন্তু, এবার দেখুন আপনি পৌঁছেছেন সেই পাতর টুকরোর কাছে, তার গলায় খিলখিলে হাসি শুনতে পাচ্ছেন। এ কি কান্ড!! দেখবেন নীচের ওই পাহাড়ি ঝর্ণা যা বহুদূর পরে আস্তে আস্তে মোটা হয়ে হয়ে ইনদাস বা সিন্ধু নদীর ঘটনা হইয়ে গেছে। আপনি চমকে যাবেন, দেখবেন সেই পাথরের টুকরো পড়েছে তার জলে, সেখানে সে পেয়েছে তার বয়সী কতো ঝকঝকে বন্ধু। কলকল কলকল করে অনর্গল জলে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে তারা। ওপর দিয়ে বড়ো হয়ে নদী হবে যে ঝর্ণা যাচ্ছে, সে গল্প বলছে তাদের এক বহুকাল আগের, কেমন অদ্ভুত মানুষেরা ছিলো, তারা কএমন ষাঁড়ের পুজো করতো, আর কেমন হারিয়ে গেল তারা কিছু অচেনা ভাষা ছেড়ে রেখে। আপনি নিশ্চয় হয় বুঁদ হয়ে গেছেন, একটু আগেই ভাবছিলেন জীবন শেষ হয়ে গেল বুঝি। কিন্তু কলকলের মধ্যে হঠাৎ এক ভয়ংকর জোর এলো ধাক্কা, মস্তো বড়ো একটা আইসফল কোথায় ধ্বসে পড়েছে, আর সেই পাথরটার গায়ে তার সাথে একটু খেলছিলো কলকল করে তার বন্ধু পাথর, গল্প বলছিলো যে ঝর্ণা, তারা সব এমন হুমড়ি খেয়ে ধাক্কা মারলো যে পাথরটা পাঁচ টুকরো হয়ে গেল। বহুক্ষণ বাদে আবার নীরব। জীবন এখানেও থামেনি। বহুদূরে দেখবেন সেও পাঁচ টুকরো একটা টুকরো কেমন সিন্ধু নদীর তলায় তীব্র উদাসে নদীবক্ষে আলতো বসে আছে। একটু লক্ষ করলে দেখবেন অতো বড়ো একটা নদীর ওজন কি ওইটুকু বাচ্চা একটা পাথর সইতে পারে, সে আস্তে আস্তে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। দেখুন তার কতো পরে সেই ভয়াবহ বন্যা পাঞ্জাবে। বন্যার পরে ফিরে যাচ্ছে নদী আর সেই পাথরের টুকরোর গুঁড়োগুলো পড়ে আছে নদীতীরকে আরো অনেক বিস্তার দিয়ে। সে এক অপার কাদা হয়েছে কালোরঙ। আপনি বুঝতে পারলেন ওই গুঁড়োটা এখন পলিমাটির অংশ। লাফিয়ে উঠলেন আনন্দে এতে চাষা হবে, ধান হবে। হলোও তাই আর একদিন ওই লাঙল চলছে আপনার ওই বন্ধু পাথরের গুঁড়ো থেকে অতিগুঁড়ো একজন চীৎকার করে লাফিয়ে উঠলো। অতিকায় বলদ টির ক্ষুর এসে লেগেছে তার বুকে আর সে উড়ে গেছে হাওয়ার যন্ত্রণায় প্রবল। ওই আর্তনাদের মধ্যেই আপনি দেখবেন সূর্য গলে যাচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে আর লালের দপদপ চারিদিক। “এটা গোধূলি” ঠিক যেমন আপনি জানলেন, অমনিই ওই গুঁড়ো যা এখন কণা হয়ে গেছে তাতে ধাক্কা লেগে সরে যাওয়ার সময় একটি রশ্মি তাকে এটাই বলে গেল, “এটা গোধূলি। ভাগ্যিস তুই ছিলি, তোতে ধাক্কা খেলাম বলেই আমার লালটা পেলাম”। ওই কণাটির তখন উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসে পাগল অবস্থা। তাকে আলো এসে বলে যাচ্ছে “ভাগ্যিস তুই ছিলি”। আর সেই আনন্দে সে ধিন ধিনাক ধা বলে নেচে উঠলো হাওয়ার হাত ধরে। সেই হাওয়ার হাত ধরে একদিন গাঢ় রাঙাকালো ঝড়ের হাতে ছিনতাই হয়ে গেল। ভাসতে ভাসতে কতো কিছু পার করে একদিন আপনার বাড়ির খুব কাছেই ভাসছিলো। আর আকাশের প্রবল উপুড় জল। ভিজে ভারি হয়ে সে নামলো আপনার উঠোনে এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ কনা হয়ে। আর একদিন যখন সেখান দিয়ে আপনি ফোনে মেসেজ করতে করতে আসছে, সেই আগেকার গোরুর ক্ষুরের ধাক্কার মতো আপনার পায়ের চাপে সে লাফিয়ে উঠলো আর একটা অদ্ভুত আলো জ্বলে মসৃন  কাঁচের মতো মাটিতে এসে বসলো একটু জিরিয়ে নিতে। 
আপনি তো ওর দিকেই তাকাচ্ছেন এখন। ভাবতে পারছেন কি ভীষণ ভিআইপি এত তচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে বসে আছে আপনার ফোনের কাঁচে। ভাব করুন ওর সাথে। কথা বলুন, দেখবেন কতো কি বলবে। ও বলবে কেমন গোটা নদির ওজন নিজের বুকে নিতে, ও বলবে তার আদি বাবা সেই কারাকোরামের পাহাড়ের কথা। সে বলবে অল্প সময়ের জন্য সেই ঝর্ণাদি আর তার কলকলিয়া বন্ধুদের কথা। আপনি শুনতে পাচ্ছেন ওর উচ্ছ্বাস। আপনি হয়তো দেখতেও পাবেন ওর আনন্দ। এই হচ্ছে ভাব। নিখাদ প্রকৃত ভাব। আপনি জানেন একদিন ওকে ওর বর্তমান বাসস্থান অর্থাৎ মোবাইলের স্ক্রিন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আজীবন তো রাখা যায় না কাউকেই, ভাব রাখা যায় আজীবন। সেইদিন যেদিন আপনি নিজের রুমালটা বার করে স্ক্রীনটা মুছতে যাবেন, দেখবেন চোখের খুব ভেতরে একটা কোথাও টনটন করছে। আকুলি বিকুলি হবে বুকে, ওই দানা ধুলোটাকে খুঁজবেন, পাবেন না হয়তো। বা পেলেন। তাকে একটা সরি বলবেন। বলবেন খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার কিন্তু সরিয়ে দিতে হবেই তো। দেখবেন ওই তুচ্ছ ধুলোর কনা তখন কি বিরাট ব্রহ্মাণ্ডের মতো আপনাকে আশীর্বাদ করছে। আপনি একটা ধূলোকে জীবনে প্রথমবার প্রণাম করছেন। এতদিন মানুষের পায়ের ধুলো নেওয়ার জন্য প্রণাম  করেছেন। কোনোদিন কাউকে জিজ্ঞেসও করেননি, প্রশ্নও জাগেনি যে ধুলো নিয়ে কি হবে? কি কাজে লাগবে? আজকে সেই ধূলোর পায়ে যখন হাত দেবেন তখন বুঝতে পারবেন সেই অসীম রহস্য। ওই এক ছোট্ট কনা, যার পায়ের দিকে আপনার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তার একমাত্র পরিচয় সে ব্রহ্মাণ্ডের অংশ, আর কোনো পরিচয় নেই। সে হিন্দু মুসলিম, বড়ো ছোটো, হিংসুটে, ভালো খারাপ, মানুষ অমানুষ, প্রাণ, অপ্রাণ এই সমস্ত পরিচয় ঝেড়ে সে ব্রহ্মাণ্ডের একটি কণা, অস্তিত্ববান। সে কল্পনা নয়, সে ব্রহ্মাণ্ডের এক কনা সত্য। সব ছেড়ে ছেড়ে সে আজ পরম পরিচয়টি নিয়ে ঘোরে। ও আপনাকে এই বোধটির আশীর্বাদ করবে, আর আপনি বুঝবেন ফোনটা মুছে ফেললেন মানে কি জীবন শেষ হয়ে গেল নাকি। কখনোই নয়। জীবন ওই ধূলোর দানার মতোই ব্রহ্মাণ্ডের এক তুচ্ছ পরম। তুচ্ছই তার শক্তি তার ডানা। 
তো সহজ ভাবা মোটেও জটিল কোনো কাজ নয়। পৃথিবীর যেকোনো কিছু সঙ্গে একটা ভাব করুন। দারুণ অপূর্ব্ব, আশ্চর্য একটা ভাব করুন তার সাথে। দেখবেন ওই ধূলামলিনের মতো একটা আকার পেয়েছেন আপনার ভাব করার আকন্ঠ অভ্যেসে। 
ওই ধূলোটি যাওয়ার আগে তার একটি কন্ঠস্বর আর একটি উচ্চারণ দিয়ে যাবে আপনাকে। হয়তো এরকম কোনো উচ্চারণ…
“পৃথিবী আকাশে থাকে না এ কথা সবাই জানে। আকাশে পৃথিবী দেখা যায় না, এটাও সবাই জানে। তবুও পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে মানুষ আর কুসুমের কথা ভাবে।
অথচ আকাশকুসুম রঙের সূর্য কেউই দেখতে পায় না কেন, এ কথা আমি এখনো বুঝি না…”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত