| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: আলোক সরকারের ‘আলোক সরকার’ হয়ে ওঠা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আমার বাবার গলা

আমার বাবার গলা ঠিক আমার পিছনে

গম্ভীর আর নিচু অনায়াস

আবছা চাঁদের আলোয় গর্তটা লাফিয়ে ডিঙোই।

দূরে কাছে কিছুই দেখা যায় না কয়েকটা বাবলাগাছ

       হঠাৎ হয়ে-ওঠা বট-অশথ।

চাঁদও ক্রমশ নিভে আসছে সোজা চোখে আরো এগিয়ে চলি।

খাল পার হবার আগেই আমার বাবার গলা

   ঠিক আমার পিছনে–

বাঁশের সেতুর মাঝখানটা ভাঙা সতর্ক লাফে পার হই।

এখন আর চাঁদ নেই অন্ধকার ঘন-করা জোনাকি

   সোজা চোখে আরো এগিয়ে চলি।

সামনেই উঁচু মাটির ঢিবি–চমকে উঠে শুনি

আমার বাবার গলা গম্ভীর আর নিচু

আস্তে আস্তে উঠি উপরে।

জ্বলজ্বলে শেয়ালের চোখ অন্ধকার নাচিয়ে দিয়ে ছুটে যায়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

 


বলে দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না যে, এই কবিতাটি আলোক সরকারের লেখা। একটি অতি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের অতি বিখ্যাত কবিতা এটি। কী আছে এই কবিতাটিতে? পরপর কয়েকটা ছবি। যেটুকু বলার এই ছবিগুলোই বলছে। ইঙ্গিতময়, সহজ, অনায়াস এই কবিতা। পড়তে পড়তে যেন শুনতে পাওয়া যায় কবির বাবার গলাটিও, যা গম্ভীর, নিচু আর অনায়াস। যা কঠিন সময়ে যেন আগলে রাখে কবিকে। ভরসা দেয় নিভে আসা চাঁদের আলোকে অগ্রাহ্য করে, বাঁশের ভাঙা সেতুকে সতর্ক লাফে পার হয়ে যেতে। কবির বাবার গম্ভীর গলাটি এমনই এক রক্ষাকবচ যে, সেই গলার স্বরেই যেন জ্বলজ্বলে চোখের শেয়ালও অন্ধকার ভেদ করে ছুটে দুরে চলে যায়। কবিতাটি পড়ে বোঝা যায় না যে, কবির বাবা জীবিত না মৃত। কিন্তু মনে হয় যেন, প্রয়াণ ঘটেছে ওঁর বাবার। কিন্তু তাঁর ছায়া ওঁকে সুরক্ষা দিচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যেও রয়েছে তাঁর জ্যোতির্ময় উপস্থিতি। এত কিছু বলছে কবিতাটি কিন্তু প্রায় কিছু না-বলেই। শুধুমাত্র কতগুলো ছবি পরপর এঁকে দিয়ে। কিন্তু এই ছবিগুলিই যেন কবিতাটিতে বাঙ্‌ময় হয়ে উঠেছে। গঠনের দিক থেকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই কবিতাটিতে একটি শব্দও নেই যা অতিরিক্ত। একটি শব্দকেও যদি বিচ্ছিন্ন করা যায় এই কবিতাটির দেহ থেকে তাহলে কবিতাটির কাঠামোটি ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে। একজন কবির এই শব্দসিদ্ধি একদিনে হয় না। এই সহজ উচ্চারণ আসলে অনেক পরিশ্রমে অর্জন করতে হয়। এই সহজ চলন আসলে কঠিনের আত্তীকরণের নির্যাস। বাবকে নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক মহৎ কবিতা অনেক মহান কবিই রচনা করেছেন। কিন্তু নিজের বাবাকে নিয়ে লেখা ঠিক এইরকম একটি কবিতা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ যেখানে বাবাকে নিয়ে কবির চেতন, আশ্চর্যরকম ভাবে, আবেগের তরঙ্গ-আঘাতে বিচলিত নয়; বরং মগ্ন, প্রায় যেন এক নিরাসক্ত বোধিতে উন্নীত।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

        কবি হিসেবে আলোক সরকার এই সিদ্ধি একদিনে অর্জন করেননি। পাঁচের দশকে যখন তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন তখনই তাঁর কবিতাকে তাঁর সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে স্পষ্ট করে পৃথক করা গিয়েছিল। ‘আমার বাবার গলা’ আলোক সরকার লিখছেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষের দিকে।  মানে এই কবিতাটি যখন তিনি লিখছেন তখন কবিতার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের সহবাস হয়ে গেছে। আলোক সরকার তখন হয়ে উঠেছেন ‘আলোক সরকার’। ততদিনে এতখানিই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর কণ্ঠস্বর যে, তাঁর একটি নামহীন কবিতাকেও চেনা সম্ভব আলোক সরকারের রচনা হিসেবে। বলার কথা এইটেই যে, এই ‘হয়ে-ওঠা’টি কিন্তু একদিনে হয়নি। এবং এ-লেখায় আমি এটুকুই বলার চেষ্টা করব যে, যে-আলোক সরকারকে বাংলা কবিতা ‘আলোক সরকার’ হিসেবে চেনে, সেই আলোক সরকারের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে অন্ধকার উৎসব প্রকাশ পেলে। এই আলোক সরকার ঠিক কী ধরনের কবি? খানিকটা বোঝা যায়, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়লে। সেই প্রবন্ধটির নাম ছিল “কবিতা-ভাবনা”। যে-গ্রন্থটিতে এই প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছিল সেই সংকলনটির নামও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে পথ নির্জন।  যে-নির্জন পথের পথিক ছিলেন আলোক সরকার, সেই পথটিতে হাঁটতে গেলে একজন কবিকে “ইন্দ্রিয়ের শাসন, সংস্কারের শাসন, দেশ-কালের শাসন” সবকিছুকে উত্তীর্ণ হয়ে যেতে হয় এমনটাই বিশ্বাস ছিল আলোক সরকারের। “কবিতা-ভাবনা” প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “আবেগের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের তফাতটা বুঝে নেওয়া সব কবিরা কাছেই খুব জরুরী। আবেগের প্রত্যক্ষ সম্মোহ অনেক সময়েই আবিষ্ট করে, আবেগসঞ্জাত কবিতার তাক্ষণিক সাফল্য প্রলোভিত করতেই পারে কিন্তু তা একটা বিভ্রান্তি, বলা যেতেই পারে একটা অভিশাপ। সাকল্যিক মানুষ থেকে ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠা, ব্যক্তিত্ব অর্জন সাধনাসাপেক্ষ, তা জন্মসূত্রে লাভ করা যায় না–ইন্দ্রিয়ের শাসন, সংস্কারের শাসন, দেশ-কালের শাসন সবকিছুর ভিতর দিয়ে যাত্রা ক’রে সবকিছুকে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যেই স্বাধীন ব্যক্তিত্বের বিকাশ, আপন অস্তিত্ত্বের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা–কবি প্রথমত এই ব্যক্তিত্বের মধ্যে জেগে ওঠে”। আমার বলবার কথা এইটুকুই যে, এই ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোক সরকার প্রথম জেগে ওঠেন অন্ধকার উৎসব গ্রন্থে।

        যতই উতল নির্জন আলোক সরকারকে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিদের থেকে, বিনয় মজুমদার বা শঙ্খ ঘোষ বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর থেকে পৃথক করে চিহ্নিত করে থাকুক, প্রকৃত কবিকে চিহ্নিত করার যে-মাপকাঠির কথা তিনি নিজেই “কবিতা-ভাবনা” প্রবন্ধটিতে বলেছেন, সেই মাপকাঠিটি ব্যবহার করলে বলতেই হয় যে, উতল নির্জন-এ সেই কবিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি যেমন শুরু হয় এই ভাবে:

আশ্চর্য হাওয়ার হাত সবুজ তরুণ আচ্ছাদন

নির্নিমেষ অণ্বেষণে কী সার্থক! এতটুকু ধূসরের

সামান্য, সামান্যতম স্মৃতির ব্যাকুল উপস্থিতি

কী নিষ্ঠায় মুছে দেয়­ আশ্চর্য হাওয়ার হাত! (‘ফিনিক্স’)

এ-কবিতায় শুধু যে জীবনানন্দ দাশের শব্দ ব্যবহারের ছায়াই রয়েছে তাই নয়, একজন কবির ‘সাকল্যিক মানুষ’ থেকে ‘ব্যক্তি মানুষ’ হয়ে ওঠার যে-সমস্ত চিহ্নগুলি আলোক সরকার পরবর্তীকালে নিজেই চিহ্নিত করেছেন, সেই চিহ্নগুলিও অনুপস্থিত। পরের বই সূর্যাবর্ত-তেও আলোক সরকার লিখেছিলেন:

গোধূলি মেঘ অস্ত মেঘ জানি না কোন দেশের মেয়ে

তুমি, তোমায় পেলেম আজ গলির মোড়ে পথের বাঁকে।

কখন! মানি কী বিস্ময় স্মিত হাসির ও মুখে চেয়ে

সুদূর নীল সান্দ্র ধ্বনি দ্বিতীয় কোন সোপান বেয়ে।

অপ্রতিভ দিগন্তের লজ্জা-রাঙা মূর্ছনাকে

রহস্যের কাজলে ঢাকে, পলাশ-লাল ওড়না ছেয়ে (‘গোধূলি মেঘ অস্তমেঘ’)

আলোক সরকারের কবিতা বলতে বাংলা কবিতার পাঠক ঠিক যে-ধরনের কবিতাকে বোঝেন, এই কবিতা সেই কবিতার থেকে অনেক দূরের পথ দিয়ে হেঁটে যায়। পথটি, সেই অর্থে, নির্জনও নয়।

        আলোকিত সমন্বয়-এ আলোক সরকার ‘একা’ কবিতাটিতে লিখছেন:

মাগো, আমার খেলার পুতুল অনেকদিন হারিয়ে গেছে

সমস্ত ঘর এখন একলার।

উঠোন ভ’রে হাওয়া আসে ভালবাসবে ব’লে

ওদের মুখ। কিন্তু আমি কী করে আর পাতবো সংসার!

এলোমেলো রাঙা-শাড়ি ছড়িয়ে আছে ঘরের মলিন কোণে

কাকে ঘিরে আনবে আমার আকাশ-ভরা দিন?

সকল আয়োজন-ই আমি ভাসিয়ে দেবো ধুলোর স্নান কোলে

একলা তা’রা করুণ অর্থহীন।

এটি একটি চমৎকার কবিতা; বিশুদ্ধ কবিতা। দর্শনগত বৈভবের দিক থেকে কবি এই কবিতায় ‘সাকল্যিক মানুষ’ থেকে ‘ব্যক্তি মানুষ’ হয়ে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু দর্শনই তো কবিতার একমাত্র মর্মবস্তু নয়। গঠনগত দিক থেকে এই কবিতাটিতেও কবি আলোক সরকার পূর্ণরূপে প্রকাশিত নন। বরং এমনটা যদি কেউ মনে করেন যে, এই কবিতাটি আসলে রবীন্দ্র-কবিতার অনুসারী, তাহলে তাঁকে কণামাত্র দোষ দেওয়া যাবে না।

আসলে যে-আলোক সরকারকে আমরা ‘আমার বাবার গলা’ কবিতাটিতে পাই, সেই আলোক সরকারের পূর্ণ প্রকাশ প্রথম ঘটে অন্ধকার উত্সব-এ। আমার যুক্তির স্বপক্ষে এই বইটি থেকে দু’টি কবিতার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথম কবিতাটি ‘দেয়াল-ঘড়ি’:

যখন ঘুমিয়ে থাকি দেয়াল-ঘড়িটা বন্ধ থাক, এমন চাই না।

খুব আলো হয়েছে আকাশে।

দু-চোখে আলস্য এক দাবি যেন ধূপকাঠি জ্বলার মতন

একাগ্র। মালতী ফুল, তোমার বিশ্বাসে আমি নদী হ’তে কখনো পারি না।

এইসব কথা মনে আসে।

এইবার মনে হয় যে, দর্শন ও গঠন–এই দুই দিক দিয়েই কবির সিদ্ধিলাভ হয়েছে। আসছে ছবির পর ছবি। যে-উপমাটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটিও “ইন্দ্রিয়ের শাসন, সংস্কারের শাসন, দেশ-কালের শাসন সবকিছুর ভিতর দিয়ে যাত্রা ক’রে সবকিছুকে উত্তীর্ণ” না-হলে কবির কলমে জন্ম নেয় না। এই প্রসঙ্গে আর একটি কবিতার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। সেই কবিতাটির নাম ‘অভিমান’:

একছুটে পালিয়ে যাও কাছে গেলেই। কিন্তু আমি

ভালোইবাসতুম তোমাদের। হাতের মুঠোয়

একবার নিয়ে ওই হৃদয়ের আনন্দস্পন্দন

বুঝতাম। মাথায় রাখতাম হাত, দুইচোখে-যার অনুগামী

সমস্ত আকাশ। মুঠো মুঠো চাল ছড়াই ঘরের মেঝেতে

যখন-ই বাইরে যাবো আসবে তোমরা, বিস্তৃতভুবন

একটি নদীর মতো ছড়িয়ে দেবে ওইটুকু ঘরে। যেতে

বারবার পা কাঁপবে, দেখি তো অসীম ছবি কিন্তু আরো বড়ো

পরিচয় মন্দারের উঁচু ডালে রয়েছে কৌতুকী রঙে স্বার্থপর মেতে।Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

এটিও একটি পরিপূর্ণ কবিতা। তবে এই কবিতার শরীরেও অলঙ্কার পরিয়েছেন কবি। যতদিন গেছে, আলোক সরকার তাঁর কবিতাকে অলঙ্কারহীন সন্ন্যাসিনীর চেহারা দিয়েছেন। হ্যাঁ, সচেতনভাবেই আমি ‘সন্ন্যাসী’ না লিখে ‘সন্ন্যাসিনী’ শব্দটি ব্যবহার করলাম। রুক্ষ পৌরুষের বিপ্রতীপে ত্যাগের কৌলীন্যে উজ্জ্বল কোমলতাকে বোঝাতে।

        একটি কথা এখানে বলা দরকার। কথাটি এই যে, অন্ধকার উৎসব-এ ঠিক এই স্থানটিতে এসে যে কবি আলোক সরকার শেষমেশ দাঁড়াবেন তা তাঁর পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থগুলির কিছুকিছু কবিতার বিষয়বস্তু ও শৈলী থেকে খানিকটা অস্পষ্ট আভাসের মতো বোঝা গিয়েছিল। যেমন, কেউ যদি এই প্রশ্ন করেন যে, অন্ধকার উৎসব-এও কি আগের কাব্যগ্রন্থগুলির ছায়া পড়েনি? তাহলে বলতেই হবে যে, পড়েছে। কিন্তু সেই ছায়াকে অতিক্রম করে, ‘সাকল্যিক মানুষ’-এর সমস্ত দুর্বলতাকে অতিক্রম করে এই কাব্যগ্রন্থে যেন আলোক সরকার ‘ব্যক্তিমানুষ’-এর ব্যক্তিত্বের মধ্যে জেগে উঠেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত