| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা ভ্রমণ: ‘বিন্দু’ চিহ্ন লেখা পাহাড়মুলুক । মধুছন্দা মিত্র ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

মনভাসির টানে জব্দ হবো বলেই বোধহয় এই নদীটির কাছে আসা। নদী ও অববাহিকাসমুহ যেন রোদ্দুর ও ছায়ামাখা সংলাপ। আমি সেই জলজ মজলিসের পানে বুঁদ হয়ে শুনে যাচ্ছি অসম্ভব এক নদীগান। কখনও উথলে উঠছে তার কোমল বাচালতা। কখনও বেবাক নিরিবিলি। কালিম্পং তালুকের, প্যারেন-গোদক খাসমহলে, ভুটান সীমান্তে ফুটে আছে অপরূপ একফালি গ্রাম বিন্দু। বিহ্বল করে দেওয়া স্থানিক দৃশ্য। যেখানেজলঢাকা নদীর মিশেলে থেমে গেছে বিন্দুখোলার একাকী পথ চলা। ২০০০ ফুট উচ্চে বিন্দু জলাধার বা জলঢাকা জলাধার ভারত ও ভুটানের সংযোগ চিত্র। বাংলায় ‘বিন্দু’ অর্থাৎ ‘ফুটকি’ বা ‘বিন্দু চিহ্ন’। জলঢাকা নদী এখানে সংযোজিত করেছে জলের সঙ্গে আরও জল জমিয়ে বিন্দুখোলা, দুধপোখরির সঙ্গে বিশুদ্ধ সহবাস। দিগন্তের দিকে তার আশ্চর্য ভ্রমণ।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com  


আমরা রয়েছি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঝালং বনবিশ্রামাগারে। ঝালং, জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লোকালয়। শহরের প্রবেশপথে ঝোলুং নদী। অপাঙ্গে বিছিয়ে থাকা নুড়ি ও পাথরে ঝোলুঙ্গের ছলাৎছল। ঝোলুং সেতুপথ পেরোতেই চেকপোস্ট। অঞ্চলটি ভুটান সাম্রাজ্য লাগোয়া হওয়ায়, অনুমতিসাপেক্ষে ঝালং পাড় হতে হয়। চেকপোস্ট পেরিয়েই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের এক খুচরো বাজার। বুধবারে হাট বসে। বাজার পেরিয়ে উত্তরের পথ ধরে আরও ৯.৩ কিলোমিটার পথ উজিয়ে বিন্দু। ঝালংয়ের পরে জলছবির মতো আরেক পাহাড়িয়া জনপদ প্যারেন। এবার আঁকাবাঁকা পথটা আগাগোড়াই আরোহণের। পথের ডানদিকে নাব্যতা, গান ও ছন্দ উৎসবে আমার সহযাত্রী জলঢাকা নদীর চলন। পাহাড় ঘেঁষে ওপারেই ভুটান সাম্রাজ্যের টেন্ডু নামের এক অরণ্যছায়া অঞ্চল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


ছন্নমতি রোদ্দুর ও আকাশসহ পাহাড়ি ওম নিয়েঝালং আর বিন্দুর মাঝে প্রকৃতির প্রতিভূ প্যারেন। এবার আর পথ চড়াই নয়, বরং কিছুটা উৎরাই। ডানদিক বরাবর প্রাচীরের মতো উত্তুঙ্গ ভুটান পাহাড়। সবুজ চারণভূমি, কৃষিজমি, পরিচ্ছন্নতা,জলবিদ্যুৎপ্রকল্প কর্মীদের বাড়িঘর, অত্যাবশকীয় দোকানপাঠ এবং কিছু হোমস্টেসহ তিনটি ভাগে, লোয়ার প্যারেন–প্যারেন কম্পাউন্ড–আপার প্যারেন নিয়ে গ্রামের বিন্যাস।যেতে যেতে প্যারেনের নিসর্গ মুহূর্তগুলি অকপটে নিজের সঙ্গে ভাগ করে নিই।রয়েছে জলঢাকা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি শাখা। প্রকৃতি তার অপার বারোমাস্যা নিয়ে বারেবারেই আমাদের চমকিত রাখে। সে লাবণ্যপ্রভায় কেমন সম্মোহিতের মতো লাগছে। গন্তব্য থাকে না নাগরিক সময়। কৌতুহল চোখে অকাতর প্যারেনের প্রচ্ছদ। কখনও নিরিবিলি কখনও পাহাড়ি কথামালা।

প্যারেন থেকে উত্তর-পশ্চিমে নিস্তব্ধ উচ্চারণে পথ চলে গেছে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম গোদক। অন্তর্গত নির্জনে সীমান্তের অন্যপারে ভুটান। ঝালং থেকে দীর্ঘ পাকদণ্ডী পথে গোদক ১৫ কিলোমিটার। এখানকার আদিবাসী মানুষজন একটি পাথরকে সরল বিশ্বাসেদেবতাজ্ঞানে পুজো করেন। জলধারা অবিরত আছড়ে পড়ায় পবিত্র পাথরটি কখনও শুকিয়ে যায় না। ১ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে উৎকৃষ্ট এলাচের ক্ষেত্র। গোদক থেকে আরও উত্তরে ৭ কিলোমিটার দূরে তোদে, এক উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম। আরও একটু হাঁটাপথেই চলে যাওয়া যায় তাংতা। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকেই তোদে-তাংতা হয়ে ওঠে নানান রূপে বর্ণে ফুল্লকুসুমিত। রুকস্যাক কাঁধে এই পথটি তখন পাড়ি জমান তামাম পর্যটক। উত্তরে আরও কিছুটা গেলেই রোচে-লা-পাস। আমরা অবশ্য এযাত্রায় ওদিকে যাইনি। আমাদের গন্তব্য প্যারেন থেকে এবার বিন্দু অভিমুখী ৬ কিলোমিটার উৎরাই পথে পৌঁছে যাই ইন্দো-ভুটান সীমান্তের বিন্দু।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


 ‘ভারতের শেষ গ্রাম’ বিন্দুর রূপে সম্মোহিত হতে তখনও বাকি ছিল। গাড়ি যেখানে নামিয়ে দিল, সেখান থেকে প্রায় ৫০ ডিগ্রী খাঁড়াই হাঁটাপথ বেয়ে সংগ্রহযোগ্য ভ্রমণটুকু নিয়ে কিছুটা উঠে যাই।খুবই সংবেদনশীল এলাকা। আধাসামরিক বাহিনীর নিরাপত্তারক্ষীরা অতন্দ্র প্রহরায়। ওপাশে ভুটানের অরণ্যাবৃত পাহাড়। বিন্দু সত্যিই এক ব্যাতিক্রমী সৌন্দর্যবিন্দু। জলঢাকার উদ্দাম জলধারা ও লাবণ্য নিয়ে অসামান্য পরিবহ।বিন্দুর আসল চমকটা ঠাহর হলো বাঁধের কাছে এসে। বাঁধের ওপর পোক্ত রেলিং দেওয়া চওড়া পথ চলে গেছে অন্যদেশ, অন্য সাম্রাজ্যে। নীচে আধখোলা লকগেট। নদীর উত্তাল জলধারা উচ্ছ্বাসে জড়ো হচ্ছে নীচে। ডাইনে ভুটান পাহাড়ের গিরিখাত বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ক্ষীণতনু অন্য এক নদী। ‘বিন্দু’ নাম সেই নিরালা নদীটির। চঞ্চলা নদীর জলস্রোতকে লকগেটের শাসনে বেঁধে রেখে তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ। ৩৬.৯ মেগাওয়াট শক্তি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সে বিদ্যুতের ভাগ পায় ভুটানও। কেন না, ভারত ও ভুটানের পারস্পরিক সহযোগিতায় তৈরি এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের জলঢাকা এবং ভুটানের বিন্দু নদীর সংযোগস্থলে বাঁধটি। নদীর এপারে ভারত ওপারে ভুটান। ইন্দো-ভুটান সীমান্তের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সাধারণের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাকুল্যে চারটি গেট রয়েছে। অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে যাচ্ছে। জলকণায় সৃষ্টি হচ্ছে অনন্যমাত্রা। গুছিয়ে যে ছবি তুলবো, ক্যামেরার লেন্সে ঝরে পড়ছে উড়ন্ত জলকণার ছিটে।সব কিছুই যেন বদলে যাচ্ছে, রোদ্দুরের রঙ, পাতার সবুজ।

 সফরনামা দেশান্তরী হয়,সেতু পেরিয়ে বিন্দুর ঠিক ওপারে ভুটান গ্রাম বকবাকি পৌঁছে। তুখোড় অরণ্য, পাহাড় ও নদীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা আশ্চর্য নিরিবিলি এই গ্রাম অবকাশের আদরমাখা ঢঙে। এখানে মূলত ভুটানী অধিবাসীদের বাস। তারা সযত্নে আগলে রেখেছেন তাঁদের সংস্কৃতি, লোকাচার, জীবনদর্শন। সেখানে এক ভুটানি জলপানের গুমটি থেকে ভেসে আসছিল মোমোর সুবাস। ধুমায়িত স্যুপ সহযোগেখেলাম এক প্লেট। পায়ের তলায় বিদেশের মাটি ছুঁয়ে ভুটানের তেন্ডু অঞ্চল পর্যন্ত চলে যাওয়া যায় বহুবর্ণ সবুজের পর্দা সরিয়ে। সেখানে রয়েছে ভুটান সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ঘাঁটি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com       


অসম্ভব কোলাহলে বিন্দু লকগেটের নীচে নির্মিত হয়েছে জমা জলের চিত্তাকর্ষক ঠমক। সফেদ ফেনায়িত লাবণ্য সুষমাশোভিত সে জলের রঙ আকাশের ছায়া মেখে হয়ে উঠেছে আসমানি নীল। ওরকম হাটখোলা নদীচত্বর আর প্রকৃতি পেলে আকাশ, মেঘ, পিচ্‌ গাছের ঝিরিঝিরি পাতা বিলি কাটবেই। পাথর টপকে টপকে সাবধানে নেমে এলাম জলঢাকা নদীটির কোলে। এক নবীন উদারতায় পেলব শীতল আশ্রয়। অদ্ভুত মনকেমন করা জলধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছে কর্ণকুহকে।সূর্যের আলো কমে এলে বিন্দুর চারপাশের প্রকৃতি হয়ে উঠল আরও মায়াবী। তবে বিনিসুতোয় বুনতে থাকা এই সম্মোহন ক্ষণিকের। খেয়াল করি অপরাহ্ণের আলোককণার সমস্তটাই তো শুষে নিচ্ছে ওই ঘাই মারা নদীজল।

কীভাবে যাবেন –শিলিগুড়ি থেকে বিন্দুর দূরত্ব ১০২.৩ কিলোমিটার। সময় লাগে কমবেশি তিন ঘন্টা। শিলিগুড়ি পি.সি.মিত্তাল বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসও যাচ্ছে ঝালং-প্যারেন হয়ে বিন্দু। ঝালং থেকে বিন্দু ৯.৩ কিলোমিটার মাত্র।

কোথায় থাকবেন – বেশিরভাগ ভ্রামণিকরাই যদিও ঝালং থেকে বিন্দু ঘুরে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসেন। তবে ইদানিং বিন্দুতে প্রচুর হোমস্টে ও পছন্দসই জলপানের দোকান গড়ে উঠেছে। প্যারেনেও রয়েছে বেশ কয়েকটি হোমস্টে।

সেরা সময় –বর্ষাকাল বাদ দিয়ে বছরের সবসময়েই যাওয়া যায়। তবে শীতকাল বেশি মনোগ্রাহী। নভেম্বর-মধ্য জানুয়ারি, মধ্য এশিয়া ও লাদাখ থেকে যাযাবর শ্রেণীর জলজ পাখিরা জটলা বাঁধায় এখানে।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত