| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রবি ঠাকুর ও তাঁর সখা অমিয় চক্রবর্তী । পায়েল চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

“১৬ বছর বয়সের এক অজ্ঞাত কিশোরকে লেখা ১৯১৭ সালের পত্র এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ- শোকে অনুকম্পায়ী নিবিড় বিশ্বাস তিনি কোন দূর আসামের পত্র লেখককে পাঠিয়েছিলেন, তাকে উদ্ধার করেছিলেন, তারপরে প্রায় ২৪ বছর ধরে চিন্তায় চিত্রণে সমৃদ্ধ ঘরোয়া নানা উল্লেখে স্নিগ্ধ তাঁর পত্রলিপি দেশে-বিদেশে আমাকে ধন্য করেছে। প্রত্যেক চিঠি তার মুক্তাক্ষরে রচিত একটি অভাবনীয় উপহার, ভাষায় ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর, যোগ্যতার কথা ভুলে গিয়ে গ্রহণের অধিকার মেনেছি।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রাবলীর একাদশতম খন্ডের ভূমিকায় লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। রবি ঠাকুরের চিঠিগুলিকে তিনি অভাবনীয় উপহার হিসেবে মেনেছেন, কবির এই সাহিত্য সচিব কবিকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করেছেন। কবির সান্নিধ্যে অমিয় চক্রবর্তী দীর্ঘকাল ছিলেন। তাঁর সাহিত্য সচিব এবং সহকারী রূপে কাজ করেছেন। কবির পত্রাবলীকে তিনি চকিত আলোর মতো বলেছেন। সেই পত্রাবলী বৈচিত্র্যে কতখানি অতুলনীয় তা অমিয় চক্রবর্তী বলেছেন একাদশতম খন্ডের ভূমিকায়।

১৯১৭ সালে রবিঠাকুরের সঙ্গে প্রথমবার সাক্ষাৎ হয় অমিয় চক্রবর্তীর। শ্রদ্ধেয় প্রমথ চৌধুরী প্রথমবার দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন দুই সখাকে। যদিও অমিয়বাবু তখন তরুণ, কিন্তু রবিঠাকুর প্রৌঢ়। বয়সের ব্যবধান বন্ধুত্বে বাধা হয়নি। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর অনুশীলন ছাত্ররূপে তিনি যোগদান করেন এবং সাময়িক ও স্বল্প অধ্যাপনার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সহকারী থেকেছেন অমিয় চক্রবর্তী। সহকারি হিসেবে একাধিক জায়গায় কবির সঙ্গে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ড, ইউরোপ, মার্কিনদেশে, ইরানে ।

“তুমি এলে এখানে যে জায়গা হবে না তা নয়, তোমার যখন ইচ্ছে আসতে পারো।”

আমন্ত্রণমূলক একটি চিঠির অংশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে যাঁকে লিখেছিলেন, তিনি তখন উনিশ-কুড়ি বছরের একজন তরুণ। রবি ঠাকুর আরো লিখেছিলেন “তুমি এম এ দেবে বলে তোমার বিশ্বভারতীতে যোগ দেবার কোন বাধাই হবে না।” অমিয় চক্রবর্তীকে শান্তিনিকেতনে এভাবেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবি ঠাকুর। দীর্ঘ সাত বছর ধরে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব ছিলেন। পরবর্তীকালে সেই তরুণ ১৯৩৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতন থেকে অক্সফোর্ডে পাড়ি দেন। রবি ঠাকুরের মনে উচাটন। তিনি লিখলেন “তোমার কথা বার বার মনে পড়ে। তুমি আমাকে যেমন ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছিলে, পেয়েছিলে, এমন কারো পক্ষে সম্ভবপর নয়। এইজন্যে আমি তোমার ওপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পেরেছি। এরকম সঙ্গ আমি আর কারো কাছ থেকে আশা করিনে।”


কবি রোগ শয্যায়ও অমিয় চক্রবর্তীর উদ্দেশে লিখেছিলেন একটি কবিতা।
“হে বন্ধু নূতন করে,
আরোগ্যের স্বাদ দিলে মোরে,
পুরাতন কাল হতে নতুন কী রস,
আনি দিল সঙ্গের পরশ।
অকৃত্রিম তোমার মিত্রতা,
তোমার বুদ্ধির বিচিত্রতা,
ভুবন দর্শনের তব দান,
বন্ধুত্বের করে মূল্যবান।”

অমিয় চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে কবি পথসঙ্গী কবিতাটিও রচনা করেছিলেন।

অমিয় চক্রবর্তী নিজেও ছিলেন কবি। তাঁর লেখা ‘খসড়া’ এবং ‘এক মুঠো’ কাব্যগ্রন্থ দুটি রবি ঠাকুরের প্রশংসা পেয়েছিল। অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধেই রবি ঠাকুর ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ডেনমার্কের হিয়োর্গিসকে অমিয় চক্রবর্তী বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের বিবাহ উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন রবি ঠাকুর। বিদেশে থাকাকালীন অমিয়বাবু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একাধিক কাজ করেছেন। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলিত গ্রন্থ ‘দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর‘ প্রকাশ করেছেন। কবি অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে এতটাই ভালোবাসতেন যে সজনীকান্ত দাস যখন শনিবারের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা শুরু করেছিলেন তখন অমিয় চক্রবর্তী তাঁর ক্ষোভ সরাসরি প্রকাশ করেন। তিনি ‘বিচিত্রা‘ পত্রিকায় “সাহিত্য ব্যবসায়’ নামক প্রবন্ধে তাঁর এই প্রসঙ্গে মনোভাব লিখেছিলেন “ব্যবসায় বিলুব্ধের হাতে সাহিত্য, শিল্প, সংগীতের সদগতি প্রত্যাশা করা চলে না, কিন্তু বৈশ্য যুগধর্মের প্রভাবে, জীবনে যা কিছু অমূল্য তাঁকেও পণ্যদ্রব্যের মূল্য দিয়ে মানুষ পণ্যবীথির সামগ্রী করে তুলেছে।”

অমিয় চক্রবর্তীর মা অনিন্দিতা দেবীর সঙ্গেও কবির একাধিকবার পত্রালাপ হয়েছে। অনিন্দিতা দেবীকে স্নেহ করতেন কবি। তাঁর চিন্তাভাবনা বিষয়ে কবি ব্যক্ত করেছেন নিজের ভাবনা। অনিন্দিতা দেবী কবিকে নিজের রচনা পাঠাতেন। সেই প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন
” তোমার খাতাগুলি আমার হাতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে এবং সবগুলি পড়িয়া দেখিলাম। লেখাগুলি খুব পাকা হইয়াছে, ছাপাইলে দেশের অধিকাংশ পাঠক তোমার উপরে বিষম বিরক্ত হইবে। কিন্তু সেই জন্যই ছাপানো কর্তব্য বোধ করি। ‌ আমার গল্প সপ্তক প্রভৃতি দুই একখানি বই আজ পর্যন্ত প্রথম সংস্করণের চৌকাঠ পার হইতে পারে নাই, বিবাহিত বাঙালি পুরুষের ভয় মাঝে এইগুলি পড়িয়া যথাসময়ে স্বামীর লুচি ভাজা সম্বন্ধে স্ত্রীর উৎসাহ লেশমাত্র ম্লান হয়।” অনিন্দিতা দেবীর মেয়েদের শিক্ষা ও জীবন সম্পর্কে উৎসাহ কবি প্রশংসার চোখে দেখতেন।

আরেকটি পত্রে কবি অনিন্দিতা দেবীকে লিখেছেন
 
কল্যাণীয়াসু,
তুমি বোধ হয় জানো মেয়েদের দুঃখ ও অবমাননায় চিরদিন আমি বেদনা ও লজ্জাবোধ করি। আমার অনেক লেখার মধ্যে অনেকবার তা প্রকাশও হয়েছে। কিন্তু এই দুর্গতির যথার্থ প্রতিকার মেয়েদেরই হাতে। তাঁরা যেদিন নিজের অধিকারের মর্যাদা সমস্ত মন দিয়ে অনুভব করবে সেদিন সে মর্যাদা কেউ খর্ব করতে পারবে না।”

নারী মুক্তি নিয়ে অনেকবার বার্তা লাভ হয়েছে কবির সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী মায়ের।

বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশ এবং বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কবির বারবার পত্রলাপে কথা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীর অবস্থা কী হতে চলেছে। অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কয়েকটি পত্রালাপে সেই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। অমিয় চক্রবর্তীর প্রতি রবি ঠাকুরের স্নেহের সঙ্গে বারবার মিশেছে সম্ভ্রম ও আবেগ। ” অনেকদিন থেকে তোমার প্রতিক্ষা করে আসচি। আমার মুশকিল, আমার দেহ ক্লান্ত, তার চেয়ে ক্লান্ত আমার মন, কেননা মন স্থানু হয়ে আছে, চলাফেরা বন্ধ- তুমি থাকলে মনের মধ্যে স্রোতের ধারা বয়, তার প্রয়োজন যে কত তা আশেপাশের লোকে বুঝতেই পারে না।” পারস্পরিক এই নির্ভরতা কবিকে আশ্রয় দিয়েছে। যে রবি ঠাকুর বাঙালির আশ্রয় হয়ে থেকেছেন, সেই কবির নির্ভরতার আশ্রয়, সখা ও সচিব ছিলেন এই অমিয় চক্রবর্তী।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত