Categories
উৎসব সংখ্যা গল্প: বিকেলের চাতক । রাজকুমার শেখ
আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
সবাই যখন চলে গেল হুদো আলিকে একা ফেলে। তাঁর গ্রামকে ফেলে সে যেতে পারেননি। এখানে প্রতি নিঃশ্বাসে তাঁর বাপ দাদার ঘামের গন্ধ পান। মায়ের আদরের স্পর্শ এখনো চোখ বন্ধ করলে অনুভব করেন। জীবন যখন একটাই তখন আবার কোথায় যাবেন? তিনি অনড়। বড়ো ছেলে কামাল বার বার তাঁকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। তিনি কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত করেননি। বরং তিনি বলেছেন, কামাল, তুই যা। এখানে ছেলে মেয়েকে রেখে ভালো স্কুলে পড়াতে পারবি না। তোর কাজ যখন শহরে। সেখানেই গিয়ে থাক। বউমাও তাই চায়ছে।
কিন্তু বাপজি, আপনাকে একা ফেলে!
কামালের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ওরে কামু, অত চিন্তা করিসনে। আমার সঙ্গে জমির থাকবে। এতদিন সে এ বাড়িতেই আছে। সে আমাকে ফেলে আর কোথায় যাবে?
কামাল আর কোনো কথা বাড়ায় না। ওরা একদিন চলে গেল শহরে। কামাল এখানেই মানুষ হয়েছে। শিক্ষা দীক্ষা সবই এই গ্রামে থেকে। এখন নাকি গ্রামে থেকে শিক্ষা হয় না। সব যেন বদলে যাচ্ছে। দিনকাল সেই আগের মতো নেই। হুদো আলি সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি বড়োই একা হয়ে গেলেন। নাহার বানু বেঁচে থাকতে সবই ঠিক ছিল। ছেলেরা কাছে ছিল। বাড়ি ভরে ছিল। আজ তাঁর দুই ছেলেই বাইরে। তিনি কত যত্ন করে আম, জাম, কলার গাছ লাগিয়েছেন। নাতি নাতনিরা এসে খাবে। তিনি বসে বসে দেখবেন। আম পেকে পড়ে থাকে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা এসে খায়। তাদের গলা শুনতে শুনতে তিনি অন্য মনস্ক হয়ে পড়েন। তাঁর নাতিরাই যেন আম খাচ্ছে আর দাদুভাইকে দেখাচ্ছে। সে বড়োই আনন্দ। কিন্তু তাঁর সে সাধ পূর্ণ হলনা। কামাল মাঝে মাঝে আসে। দেখা করে যায় হুদো আলিকে। কামাল এলেই হুদো আলি সাহেব তড়িঘড়ি রাস্তার দিকে যান। তাকিয়ে দেখেন তাঁর নাতি নাতনি বউ আসছে কি না। কিন্তু শূন্য রাস্তা পড়ে থাকে। বাতাসে ধুলো উড়ে। ওঁর চোখে বালি পড়ে কেমন খচখচ করে। চোখে জল চল আসে। সে জল কি শুধুই বালির জন্য? কামাল সে যন্ত্রণার কথা বুঝতে পারে না। কামাল ফিরে গেলে হুদো আলি সাহেব গাছ থেকে নিজ হাতে আম পাড়েন। ব্যাগ ভর্তি করে আম পাঠান শহরে। আমের গায়ে তাঁর স্নেহ লেগে থাকে। সেই পরশ টুকু শুধুই দিতে চান তিনি। আম গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে হাত বুলান। যেন তাঁর নাতির মুখে চোখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। চোখ ভরে জল আসে। বুকের অতলে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়। সেই ব্যথার খোঁজ কেউ জানেনা। জীবন বুঝি এ রকমই? তিনি মনে বুঝ দেন। সব মেনেও নেন। কামালকে কখনোই জোর করেননি। তিনি ছেলেকে সাহস দেন। যাবার সময় জমির সবজি গুলো জমিরকে দিয়ে তুলিয়ে রাখেন। কামাল সব নিয়ে যায়। শূন্য বাড়িটাতে একা একা ঘুরে বেড়ান হুদো আলি। বাড়ির হাতায় একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে নানান ফলের গাছ। সবই তাঁর নিজ হাতে লাগানো। ছোট ছেলেটার আসার সময় নেই। ওরও একটা মেয়ে। নাতনিটা পাঁচ বছরে পরেছে। খুব মিষ্টি দেখতে। হুদো আলি গেছিলেন দেখতে। তিনি পারলে বুকে করে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আসেন। তার চিকন গলার কান্না এখনো কানে লেগে আছে। বারান্দার চেয়ারে বসে বসে তিনি হারিয়ে গেছিলেন। ডুবে ছিলেন ভাবনার জগতে। এমন সময় জমির এসে ডাকে, চাচা জি, একটু কিছু মুখে দেন। গত রাতেও কিছু খাননি।
ওরে জমির, আমার খিদে নেই।
তাই বললে কি হয়? একটু মুখে দেন চিড়ি টুকু।
রেখে যা। আমি খেয়ে নেব।
জামরুল গাছে বসে একটা মাছরাঙা ডাকছে। সকালের রোদটা এসে পড়েছে বারান্দায়। বেশ ঝকঝকে সকাল। সবুজ পাতার আড়ালে রোদ খেলা করছে। হুদো আলি সেই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখছেন। রোজ সকালে এই খোলা বারান্দায় এসে বসেন। প্রকৃতির রুপ দেখেন। পাখির ডাক শোনেন। ওদের জগতে তিনি ডুবে যান। পাখিকে বোঝবার চেষ্টা করেন। ওরা অনেক সুখী। ডানা আছে বলেই উড়ে বেড়ায়। কিন্তু তাঁর তো ডানা নেই। নিজের সন্তানদের মুখ দেখতে চান। ওদের কথা শুনতে চান। ওরা ছোট ছিল ভালোই ছিল। ওরাও যে এই পাখির মতো উড়ে গেল। শূন্য লাগে বাড়িটা। কেমন এক শূন্যতা তাঁকে গিলে খেতে আসে। জমির আছে বলেই তিনি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। জমির তাঁকে রান্না করে খাওয়ায়। জমিরের কতদিন হয়ে গেল এখানে আসার। সেও এ বাড়ির একজন। তাঁর ছোট ছেলে মিলু জিমিরের কোলে পিঠে চড়ে মানুষ। সেই মিলুটাও আর এমুখো হয়না। কতই বা কাজের চাপ? তার বাপকে দেখতে একটুও কি মন করে না? ওদের জন্য তিনি ঘুমোতে পারেন না। সব সময় মনের ভেতরে তোলপাড় হয়। ওদেরও সন্তানরা যখন দূরে কোথাও কাজ নিয়ে চলে যাবে তখন কি করবে? সকালের মিঠো বাতাসটাতে কেমন চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। গত রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি। বিছানায় উঠে বসেছিলেন। আজ-কাল একটু বেশিই এমন হচ্ছে। নিশু ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ঘুম আসতেই চায় না। বরং সকালে এই সময় একটু ঢুলুনি মতো আসে। ঘুম আসলে হবে কি? জমির তাঁকে পীড়াপীড়ি করে খাবার জন্য। ও শুনবে না। না খেলে বসে থাকবে। অগত্যা তাঁকে খেতে হয়। জমিরের শাসানি মেনে নিতে হয়। ও ছাড়া আর এখানে আছেই বা কে? জমিরই সব।আম গাছে একটা হলুদ বসন্ত পাখি এসে বসে। তার ডাক শুনতে শুনতে হুদো আলি সাহেবের চোখ আবার এঁটে এলো। পাখিটা ডেকেই চলেছে।
২.
বেশ কদিন হল হুদো আলি সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না। জানালা দিয়ে শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকেন। আম বাগান, পুকুর, পাখি দেখেন। এবার প্রচুর আম এসেছে। আর কদিন পরেই পাকতে শুরু করবে। আজ একটু গরম। সূর্যর তাপ বেড়েছে। জমির একটু আগে দুমুঠো ভাত খাইয়ে দিয়ে গেছে। দুখাবল খেয়ে আর খেতে পারেননি। মুখে একদম রুচি নেই। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। কেমন একটা বেস্বাদ টেকছে মুখে। জমির বেশ বকা দিল না খাওয়ার জন্য। হুদো আলি সাহেব তার শাসন মেনে নেয়। এতদিনের তাঁর সঙ্গী এই জমির। তাঁকে ফেলে চলে যায়নি। সে থেকে গেছে। তাঁর সুখ দুঃখের সাথী। যে টুকু জমিজিরাত আছে। সবই জমির দেখভাল করে। যা আয় হয় তা দিয়ে বছর চলে যায়। ছেলেদের রোজগারের টাকা তিনি নেন না। বরং এটা সেটা কিনে জমিরকে দিয়ে পাঠান। তাঁর চোখ বন্ধ হলেই তো সবই তাদের। তিনি ইদানীং ভাবছে যে জমিরকে কিছু জমিজমা লিখে দেবেন। সে যাবে কেথায়? জমিরেরও তো কেউ নেই। বিয়ে একটা করেছিল বটে। কিন্তু ওকে ছেড়ে চলে যায়। জমির আর দ্বিতীয় বার ও পথে হাঁটেনি । হুদো আলি সাহেব বলা সত্বেও ও আর রাজি হয়নি। তিনি আর ওকে জোর করেননি। ওর মতো ওকে থাকতে দিয়েছেন। জমির খুব হাসিখুশী মানুষ। হাতের রান্নাটাও ভালোই রপ্ত করেছে। ওর কোনো কাজে ক্লান্তি নেই। হুদো আলি সাহেব তাকে কোনো কিছুই হুকুম করেন না। ও ওর মতো করে সব করে। বাগানের আম পাকলেই শহরে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসে। ছেলে বউ এর খোঁজ নিয়ে আসে। কিন্তু ছেলেদের সময় নেই। ওরা আর তেমন আসে না। হুদো আলি আর জোর করেন না। তবুও তো মন করে ওদের মুখ গুলো দেখতে। তাঁর মনের ব্যথাটা কেউ বুঝতে চায় না। এত বড়ো বাড়িতে সে একা মানুষ। এই পাখিদের সাথে তাঁর বাস। পাখি গুলো বরং তাঁকে ছেড়ে যায়নি। রোজ আসে। ডালে বসে তাঁকে ডাকে। হুদো আলি ওদের ডাক শোনেন। দানাপানি দেন সময় সময়। ওরা ঠুকরে ঠুকরে খায়। ওদের খাওয়া দেখেন চেয়ারে বসে। যেন তাঁর সন্তানরা খাচ্ছে। মনটা ভালো হয়ে যায়। তিনি আম রেখে দেন। পাকলে পাখি গুলো যেন খেতে পায়। নারকেল গুলো দিয়ে দেন পাশের বাড়ি নিতাই হালদারকে। ওদের পুজোর সময় দরকার হয়। পুকুরের মাছ নিতাই হালদার দেখাশোনা করে। যখন যা লাগে নিতাই কে বলেন। কখনও কখনও নিতাই আসে। বসে। গল্প গুজব হয়। চা করে জমির দেয়। কিন্তু ওঁর শরীরটার আবার কি হল? ঘরে থাকতে মন করছে না। সকালে বারান্দায় বসতে যেতে পারেননি। পাখি গুলো খুউব ডাকছিল আজ সকালে। হয়তো তাঁকে দেখতে না পেয়ে। জমির ওদের খেতে দিয়েছে। কিন্তু আজ ওরা নাকি কিছুই খায়নি। বার বার এ ডাল ও ডাল করে বেড়াচ্ছে। জমির বেশ অবাক হয়েছে। ওরা কি ওদের প্রভুকে দেখতে না পেয়ে এমন করছে?
ও ভেবে পায়না।
হুদো আলি খোলা জানালা দিয়ে বাগান দেখছেন। তাঁর হাতে তৈরি। সবুজ ঘন। সবু সবুজ গন্ধ। পাতা পিছলানো রোদ। মৌমাছির গুনগুন। মনটা তাঁর কেমন করে ওঠে। আজ বড়োই উদাস তিনি। এই মায়া জড়ানো বাগান। বাড়ি। পাখি। এ সব ফেলে তিনি আর কোথায় যাবেন? তাঁর জীবন এখানেই কেটে গেল। আর কটা দিনই বা বাঁচবেন! যদি ছেলেদের সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে যেতে পারতেন? তাহলে তিনি শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে পারতেন। না– জমিরকে বলতে হবে। যেন তাঁকে এই পুকুর পাড়ে জামরুল গাছটার নিচে কবর দেয়। তিনি যেন পাখির ডাক শুনতে পান। সত্যি কি আর পাখির ডাক শোনা যায়? মনটা হঠাৎই বিষন্ন হয়ে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল করে সব দেখেন। হয়তো তিনি আর দেখতে পাবেন না। পুব পাড়ার মসজিদের হয়তো আসরের আজান আর শুনতে পাবেন না। হয়তো এই জোহরের সিজদাই শেষ। দুচোখ ভরে জল আসে। একা একা তিনি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকেন। বুকের কাছে জমানো ব্যথা গুলো গলে গলে পড়তে থাকে অশ্রু হয়ে।
৩.
বাপ বাপ গন্ধটা গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে। কামাল সে গন্ধ নেয়। কিন্তু আর কি দেখা হবে বাপের সঙ্গে? সকালে এসেছে বাপের শেষ যাত্রায়। কথা হয়নি কারোর সঙ্গেই। আজ গোটা বাগান কেমন চুপচাপ। কোনো পাখি ডাকছে না। জামরুল গাছের নিচে তাঁকে চিরদিনের জন্য শুইয়ে দেওয়া হল। কামালদের ফিরতে হল এক সময়। মাটির জিম্মায় রেখে এলো তার বাপকে। আর হয়তো তাদের আর আসা হবে না। জমির থাকলো। বাগানের পাখিরা। যে ডাকের জন্য কামাল বসে থাকবে। সেই ডাক আর কোনো দিনই সে শুনতে পাবেনা। তার মুঠো আলগা হয়ে গেল। যে মুঠোর ভেতর বাপজানের স্পর্শর গন্ধ লেগে আছে।
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে।সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ কবিতা লিখে।তারপর হঠাৎ গদ্যে বিচরন। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও লিটিল ম্যাগাজিনে ১৫০ টি গল্প প্রকাশিত। উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ১১টি। তাকে বার বার কবিতা হাতছানি দেয়। অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। গল্প সংকলন – রক্ত পলাশ।