| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
গদ্য সাহিত্য

সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা, ছোট্ট কিছু উল্লেখযোগ্য  নিরীক্ষণ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
 
কবি সাজ্জাদ সাঈফের বেশকিছু কাজ খণ্ড খণ্ডভাবে পড়া হইছে আগে-পরে। “প্রেমপত্রের মেঘ” পড়ছি গেল বইমেলার সময়। “বহুদিন ব্যাকফুটে এসে“-র পাণ্ডুলিপি পড়ছিলাম কয়েক বছর পূর্বে। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হইলো এবার “কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা” ও “মায়ার মলাট” পড়ার থ্রিল। দ্বিতীয় দশকের বাংলা কবিতার এই তুর্কির পোয়েসি নিয়ে কয়েকটা কথা বলা জরুরি।
 
প্রথমত, সাজ্জাদ ভাইয়ের শিল্পযাপন ও বয়ানের একটা নিজস্ব জগৎ আছে। বাংলার পরজীবী, ভাষার পরাঙ্মুখ সমকালীন কবিদের অধিকাংশেরই যা নাই। সেই জগতে পায়চারি করতে করতে উনি অনায়াসে বলতে ফেলতে পারেন-
 
“আমাদের পাশাপাশি হাঁটা আর সামনেই শাহবাগ
চঞ্চলা ফুলেরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে ফুল; এরই ভিতর রগড়ে চড়ে বসে হার্টবিট, শূন্যে ও শূন্যতায়
এরও লাগে নাকি রিখটার স্কেল? টের পাও নাকি
হার্টবিট?” 
(বই- প্রেমপত্রের মেঘ)
 
আমাদের এই কবির সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্টটি মেবি “প্রশ্ন করতে পারা”। একটা ইমেজ, একটা দৃশ্যকল্পের সাথে যাপন-অভিজ্ঞতা, চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও অমোঘ ইতিহাস, মিথ আর সমকালের প্রতি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মিথস্ক্রিয়ায় অজস্র বলা ও না বলার কার্যসম্পাদনপূর্বক তিনি এমন কিছু প্রশ্নের মুখে পাঠককে ঠেলে দেন যা পাঠকের মানবজন্মতাড়িত অস্তিত্বের মর্মমূলে টোকা দিয়ে যায় নিপুণ নিজস্বতায়, ভাবতে বাধ্য করে, পোয়েটিক কমপালশান ক্রিয়েট করে। তিনি অকপটে জিজ্ঞেস করেন-
 “ধার করা আয়ু নিয়ে বলো, বাঁচা যায় নাকি মা?” 
 
কবি সাজ্জাদ সাঈফ এইক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নিজেকে!
 
“পিছন পিছন বাঘের পা ফেলা টের পায় যে হরিণ
আমি তার চেয়ে সাবধানে মানুষের সামনে দিয়ে
হেঁটে গিয়ে দেখেছি, হিংস্রতা কাকে বলে?
অনিশ্চয় কাকে বলে? আততায়ী কাকে বলে?” 
(বই-কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা)
 
 
সাজ্জাদ ভাইয়ের কবিতার আরেকটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট হচ্ছে ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, গ্রাম-বাংলার আবহমানতা, সঘন দৃশ্যকল্পের জাল বুনন ও অনুপ্রাসের দুর্দান্ত ইন্দ্রজাল তৈরি করায় সক্ষমতা।
 
 
“কৃতি ও করুণার কাছাকাছি সমস্ত জীবন বিছিয়ে দিয়ে গল্প করে আর কাঁদে, কৃতদার পুরুষেরা!” 
(বই-কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা)
 
কিংবা
 
“হিংসা ও হননেচ্ছার কাছে বসে 
সারাদিন শিশিরপতন দেখি, একটা উল্টো সাঁতারের ভিতর ডুবে যাচ্ছে নিহিলিজম!” 
(বই- মায়ার মলাট)
 
তিনি ধর্ম ও মর্ম উভচর সংবেদনে যীশুকে অনুধাবন করেন। তাকে, তার বেদনাকে, তার হতাশাকে ধারণ করেন পরম মাতৃস্নেহে! পেশায় চিকিৎসক বিধায় জনপদের সকল অসুখকে নিজের ভিতর ধারণ করে যীশুর অনুরূপ গণমানুষের জরাযন্ত্রণায় সহায় হবার সচেতন প্রয়াস জারি রাখেন এবং গণমানুষের সমস্ত বেদনাকে একাই মনুষ্য বিক্রম আকারে সয়ে নিতে ‘সদা প্রস্তুতি’কে উচ্চারণ করতে জানেন একইভাবে যীশুর অনুরূপ নিপীড়িত গণমানুষের বৃহত্তর স্বার্থে জালিমের চোখরাঙানির ক্রুশকে মোকাবিলা করবার নিদারুন স্পর্ধায়-
 
“এই সমস্ত মানস অধিকৃতির প্রজ্ঞা ও প্রবঞ্চনায় বসে কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা, জনপদের সকল অসুখ এবং বেদনার মনুষ্য বিক্রম!”
 
এখানে “যীশু” যে কবি নিজেই তাতে একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবেও তো কোনো সন্দেহ নাই আমার। কবিতার মাধ্যমে মানুষকে স্পর্শ করা, মানুষের বন্ধ দুয়ারে অবিরাম ডাকহরকরার মতো কড়া নেড়ে যাওয়াতেই তার আনন্দ। সেখানেই তার অভীষ্ট নিহিত, ইষ্ট করে বসবাস। সবদিকেই তার আসাযাওয়া, সবখানেই তার অবাধ প্রবেশ- কিছুটা শারীরিক, কিছুটা আত্মিক আর কিছুটা কাব্যিক-
 
“সব দিকে যাওয়া চলে
সব দিকে অনিবার্য হাঁটা
ধানকল ডানে রেখে হাটের কসাইখানা
প্রচণ্ড নির্জন, মেশিন ঘরের চালে চুপ করে বসেছে চড়ুই, খুদ-কুঁড়ো-বিচালি ছড়ানো প্রসন্ন সৌরভে;
এইভাবে, এইসব ভ্রমণমাত্র জীবনের গাঢ় চুম্বনক্রিয়া, জন্মসাঁকোর দু’পাড়ে মানুষ ক্রীতদাস শুধু আজন্ম পাপপুণ্যের!”
 
 
এই কবির কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে বারবার “মা” উঠে এসেছেন। করপোরেট সংস্কৃতি, পুরস্কার ও মঞ্চনির্ভর কবিতা এবং ঢাকাইয়া পশনেসকে টেক্কা দিয়ে তিনি থাকেন বগুড়ায়, মফস্বলে। পরিবারের বাধা, প্রতিষ্ঠালিপ্সা ও গ্ল্যামারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি প্রথম যৌবনেই। খুঁজেছেন মাটির মাঝে কবিতা, বৃষ্টির সোঁদাগন্ধে কবিতা আর কবিতায় মাটিরই সোঁদাগন্ধ! মায়ের স্মৃতি তাই তাকে বারবার তড়পায়, ভাবায় আর তাই প্রতিফলিত হয় কবিতায়-
 
 
“আমি তো বুঝি মা, বুঝি –
মেঘলা দুপুরে হলো যার বুকে, বিষাদ ফলন
তুমি কি বাড়াবে হাত?
ইহকাল সাফ করে, বুকে হেঁটে, ধুয়ে দিবে মন?” 
 
কবি আরো বলেন
 
“অসুখের বিছানায় আর ক’টা দিন
মায়ের হাতের চুড়ি, ধ্বনিযোগ করে যাক।”
 
 
প্রতিষ্ঠার মোহকে এড়িয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে কবি সাজ্জাদ সাঈফ বছরকে বছর দু’টি যুগ যাবত স্বীকার হয়েছেন চূড়ান্ত অন্যায় উপেক্ষা আর অবহেলার, নীরবতার বাণে(কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্সে) বিদ্ধ হয়েছেন বারংবার। তবু কবিতাকেই সাধনার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে তিনি বাক্যের জাল বুনে গেছেন, প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন সৃষ্টির অস্তিত্বের দিকে দিকে অনবরত যা একজন নিগূঢ় দার্শনিকতায় উর্ত্তীর্ণ করে তাকে-
 
“খাঁচায় সারারাত তন্দ্রাচ্ছন্ন পাখি, ডোরাকাটা পাখি; অনিদ্রাকে প্রেম বলে ডাকে!
 
আওয়াজ করে গলার রগগুলারে দেখাও, পারো তো লাফ দিয়ে পার হও বাংলা কবিতার আগুন!” (বই- মায়ার মলাট)।
 
কবির মত আমরাও ভালোবেসে থাকতে চাই দ্বিধা ও ডাঙায়, সময়ের সাথে লড়তে চাই ডুয়েল। তার আসন্ন বই “দ্রাঘিমালণ্ঠন“র প্রায় সব কবিতাই ধাপে ধাপে  পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেটিতে নিজেকে আরও একধাপ ছাপিয়ে যাবেন কবি এই দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যাশা রেখে আপাতত এই পর্যন্তই থাকল আজ।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত