“সে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করতে পারে”- সত্যিই কি সে পারে? এক জোড়া জীবনানন্দের চোখ ধার পেলে বুঝিবা পারে। সোনার সিংহ না হোক, দিলরুবা ভাবার চেষ্টা করে স্টলের সামনে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় এক পুরুষ, ইঞ্জিন থেকে ছিটকে পড়া কয়লার গুড়োর মতো তার চুল। মানুষটা তাকালে হুশহুশ করা বাষ্পে বুজে যায় যে চোখ, সে চোখে কখনো কী ধরা পড়ে সোনার সিংহ!
তবু দিলরুবা অপেক্ষা করে। নিজেকে ফুলের তোড়ার মতো গুছিয়ে নিয়ে সামনের কাগজে আবারও অটোগ্রাফ দেয়ার রিহার্সাল করে। নামের পাশে বাগানের বেড়ার মতো দু-একটা কবিতার লাইন সাজিয়ে রাখে। প্রতিদিন। যেন একটা বিমূর্ত মূহুর্ত তৈরির সম্ভাবনায় ত্রুটি রাখতে নেই। হঠাৎ কেউ স্টলের সামনে দাঁড়ালে যে সম্ভাবনা ম্যাচের কাঠি হয়ে খস-খস করে। তারপর ফুঁস।
স্টলের এইটুকু বর্গাকার নিঃসঙ্গতা ছুঁয়ে একটা দেশলাই কাঠি হাতে দিলরুবার অপেক্ষা ওঠে, নামে পারদের মতো। বাড়ি ফেরা হয়ে গেলে অপেক্ষাটা ঝেড়ে-মুছে তুলে রাখে। সার্কাস শেষে তাবু গোটানোর মতো নিজের সাজগোজ গুটাতে গুটাতে কিংবা আগাছার মতোন কটা সাদা চুল ছুঁয়ে দিতে দিতে ভাবে- আটাশ দিনের জন্য আটাশটা শাড়ি সাজানোই কী বেশ নাকি কোথাও একটা পক্ষপাতিত্ব আছে? দিনটা হোক সেই শাড়িটার, যে শাড়ি পড়ে এক বসন্ত দিনে কথা ছিল একসাথে পালিয়ে যাওয়ার। যে শাড়িটা কোনদিন আর পড়াই হলো না। পড়ার প্রয়োজনই হলো না।
পশ্চিমের মেঘেই তো থাকে প্রত্যাখান। তবু অপেক্ষাকে যত্ন করে ভাঁজ করে দিলরুবা পড়ে, মেলায় যায়। দিলরুবার বইয়ের খোঁজ নিশ্চয়ই সে পেয়েছে। ওদের সব যে ফুরিয়ে যায় নি প্রমাণ করতেও তো স্টলের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে মানুষটা। হঠাৎ হঠাৎ যেমন সে টুকটাক ম্যাসেজ পাঠায়- কেমন আছো? তখন খুব একরোখা অভিমান চাপে দিলরুবার। উত্তর পাঠানোর ইচ্ছেটাকে একটা বিষন্ন চিতল মাছের মতোন কেটে ফেলে অভিমান দিয়ে। মানুষটা মনেও রাখিনি একটা চিঠির কাছে ও কতোটা অসহায় ছিল, আছে।
অবশ্য মানুষটার সে সময় কোথায়? বিস্তৃত পৃথিবী, বিস্তৃত সংসারে, সেইসব পুরনো প্রত্যাখানের জন্য এত আয়োজন করার সময় থাকতে আছে বুঝি! স্টেশনে জানালা থেকে বড়জোর একটা ভাটফুল ছুড়তে পারে, হুটহাট দু একটা কথা, স্টেশনে নেমে অতটা আয়োজন কী আর সম্ভব! স্ত্রীকে পাশে রেখে এই যে কেমন আছ লিখে এই বা কম কিসে!এ তোমার ভারী অহংকার মেয়ে। বাদামের খোসার মতো অহংকার ভেঙে দেখ। ভেঙে দেখেছে দিলরুবা। ভেঙেছে বলেই বুঝে এইটুকু আয়োজনই যদি না করতে পারে তবে কেন এই টুকরো টুকরো হওয়া, ঠুনকোতে ফিরে ফিরে আসা! বঞ্চিত বলে এইটুকু প্রত্যাশাও থাকতে নেই দিলরুবার?
প্রত্যাশা সে করে। জোর বৃষ্টিতে যখন বইগুলো ভিজতে থাকে, হায়হায় করতে থাকে আশপাশ, তখনও দেশলাই কাঠিটা একটা ভেজা বইয়ের পাতায় রেখে ও বুক চেপে ধরে অপেক্ষা। পরনের জামদানির ভেজা ফুলে সে পরখ করে নেয় বিমূর্ত শাড়ির দিন। পিয়ালী বলেছিল কেমন যেন শাড়িটা, রসুন ফুল রসুন ফুল লাগে। সেই পুরান কালে এ ফুলেরই তো নাম ছিল stinking rose। নিজেকেও তার বড়ো রসুনের ফুল মনে হয়। এমনও তো দিন ছিল পৃথিবীতে ছ’কেজি রসুন হলে হৃষ্টপুষ্ট ক্ৰীতদাস কেনা যেত। অথচ এক জমিন রসুনের ফুল নিয়ে কেটে গেছে যে জীবন, সে জীবনে অমন তুখোড় বৃষ্টিতেও পাওয়া হয় না কিছুই।
শুধু ভিজে যাওয়ার ধকলটা সামলাতে পারে না বলে দিলরুবার জ্বর আসে। ও বুঝি এক ডালা রসুন দিয়ে কিনে নিয়েছে পৃথিবীর কিছু হৃষ্টপুষ্ট জ্বর। মেলায় যাওয়া হয় না আর। তবে ওর অপেক্ষা ঠিক চলে যায়, ফিরে আসে। গায়ে তার রসুন ফুলের গন্ধ লেগে থাকে। একদিন জামসেদ ভাই, দিলরুবার বইয়ের প্ৰকাশক, দেখতে আসেন। চলে যাওয়ার সময় বুঝি দিলরুবাকে দিয়ে যান একটুখানি পশ্চিমের মেঘ ‘বুঝলে একজন তোমার খোঁজ করছিল আজ।’ ম্যাচ বাকসে খসখস ওঠে- ‘কে? কি নাম? ‘নামটা ঠিক মনে পড়ছে না ভাই।’
দিলরুবা বুঝি মেঘে সোনার সিংহ দেখতে চায়। তাই ও আবিষ্কার করে সোনার সিংহ, সোনার দাঁত। একটা বই শুয়ে আছে, যেন ওরই মতো, প্ৰিয় কোন হাতের স্পৰ্শে হয়ে গেছে অলকানন্দা। অথচ হঠাৎ ঝড় হয়ে ওঠে এক কোমল বউ। একটানে বইটাকে মাটিতে ফেলে ফুঁসে ওঠে ‘ওকেই যদি বুকে আগলে রাখবে, আমাকে বিয়ে করলে কেন? পুরনো প্ৰেমিকার সাথে দারুণ কাটালে না?’ যে মানুষটার দিকে তাকালে হুশহুশ করা বাষ্পে বুঝে যায় দিলরুবার চোখ, সেও বুঝি ঝড়ে উড়ে।
কি যে শুরু করলো ওরা। ঝগড়া তো এমনই। শুরুতে ‘যা হুস হুস’ না করলে ঠুকরে খায়। দাঁড়কাকটা দিলরুবাকেও ঠুকরায়, কা কা করে, ঠুকরে ঠুকরে খায়। দিলরুবা হুস যা সর সর করে তাড়াতে তাড়াতে ভাবে চড়ুই-চড়াইয়ের সংসারে কি দরকার ছিল এই সোনার সিংহের? নিজের বইটাকে পশ্চিমের মেঘে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে দিলরুবা বলে ওঠে-এসো না অনিমেষ, এসো না।
দেরাজে তখন একটা প্রত্যাখ্যাত জামদানি কাকতাড়ুয়া হয়, আরও এক দীৰ্ঘশ্বাস ফেলে, মুখ ফেরায়। আর জ্বর? জ্বর তো বরাবরই রেখে গেছে জমিনের বুকে ঝাঁক ঝাঁক রসুন বাতাস। সে রসুন বাতাসে দিলরুবা কেঁপে ওঠে করুণ পাতার মতো।