যুক্তিচিন্তা-অষ্টম পর্ব: আপনি কি এখনও বন্ধুদের টাকায় চা খান?
অ.
ঢাকার মশারা খুব চালাক, কীভাবে যেন ঠিকই মশারির ভিতরে ঢুকে যায়। আচ্ছা, ঢাকার মশারা কি আগে থেকেই এরকম চালাক?
মশার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ব্যাট কিনেছি। একেকটা মশা মরে আর ঠাস ঠাস করে শব্দ হয়। বেশ মজা। বাইরের থেকে মশারির ভেতরে মারতে বেশি সুবিধা।
আমাদের অব্যয় আত্মদীপ মশারির ভেতরে ব্যাট দিয়ে মশা মারতে পছন্দ করে। কোনও দিন মশারির ভেতরে মশা না থাকলে সে মশারির একপাশ উঁচু করে মশা ঢোকানোর চেষ্টা করে, যাতে সুবিধামতো মশা মারা যায়। এটা এক ধরনের ফাঁদ।
এরকম ফাঁদ পেতে মাছ ধরতে দেখেছি ছোটবেলায়। বর্ষায় মাঠের অল্প পানিতে বাঁশের তৈরি এক ধরনের খাঁচা পেতে রাখা হয়, মাছ ঢুকতে পারে, কিন্তু বের হতে পারে না।
শুধু বাঁশের, লোহার, সুতার বা মশারির নয়, আরও বহু ফাঁদের বেকায়দা অভিজ্ঞতা এ জাতির আছে। ভালবাসার ফাঁদ, বিশ্বাসের ফাঁদ, রাজনীতির ফাঁদ, টাকার ফাঁদ, ইজ্জতের ফাঁদ—এরকম আরও কত যে ফাঁদে আটকে কতজনের জীবন বরবাদ হয়ে গেল, কে রাখে খোঁজ তার! বলা চলে প্রাণিদের চেয়ে মানুষেরাই বেশি আটকায় মানুষের পাতা ফাঁদে!
তেমনি এক ফাঁদ আছে ভাষার। আমি নাম দিয়েছি ‘প্রশ্নফাঁদ’। আপনাকে এমন কায়দা করে এক প্যাঁচানো প্রশ্ন করা হবে, উত্তর দিতে গিয়ে আপনি রীতিমতো ধরা!
আ.
আপনি কি এখনও বন্ধুদের টাকায় চা খান? অথবা আপনি কি বউ পিটানো ছেড়ে দিয়েছেন? কী জবাব দেবেন? আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’—যে উত্তরই দেন, এটা মেনেই নিচ্ছেন যে, আপনি বন্ধুদের টাকায় চা খান অথবা আপনি বউ পিটান!
এক বন্ধু জানতে চাইলেন, তুমি কী জান যে, সুন্দরী বলেই সবাই আমাকে ভালবাসে? কী উত্তর দেই বলুন তো! সবাই ভালবাসুক বা আমি একাই ভালবাসি, এবং সে ভালবাসার কারণ যাই হোক, তার সৌন্দর্য্যকে কিন্তু অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই!
আমরা কি ওদের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক না? কম বা বেশি যেটাই বলেন, আপনাকে মেনে নিতে হচ্ছে যে, তারা দেশপ্রেমিক, তা তারা যদি ভোর ছয়টার সময় দেশের বারটাও বাজিয়ে দিয়ে থাকে!
ই.
এরকম প্রশ্নে একটি সিদ্ধান্ত আগে থেকে আরোপ করাই থাকে, ফলে উত্তর যাই দেওয়াহোক, আরোপ করা সিদ্ধান্তটিই মেনে নিতে হয়। এরকম প্রশ্নে উত্তরদাতাকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে বাধ্য করা হয়, কোন ব্যাখ্যা বা ভিন্নমতের সুযোগ থাকে না। এভাবে প্রশ্নের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে চাপিয়ে দেওয়াসিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।
এ জাতীয় প্রশ্নকে বলা যায় ‘প্রশ্নফাঁদের ছদ্মযুক্তি’, ইংরেজিতে বলে Complex Question Fallacy, যা ল্যাতিন Plurium interrogationum থেকে এসেছে।
আমরা ফাঁদটিকে যদি আগেই চিনে রাখতে পারি, ধরা খাওয়ার ঝুঁকি তাহলে কিছু কমে। আর অন্যকে ফাঁদে ফেলার মতো দুষ্টুবালিকা (অথবা বালক) নিশ্চয়ই আমরা নই!
আগের পর্বগুলো ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
কবি ও লেখক