| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা অনুবাদ গল্প: সৃজনঃ একটি অর্ধসমাপ্ত গল্প । রত্নোত্তমা দাস বিক্রম 

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 লেখক পরিচিতি- লেখিকা এবং লোককলার গবেষিকা ডক্টর রত্নোত্তমা দাস বিক্রম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ভাষা এবং সাহিত্য অধ্যায়ন বিভাগের অধ্যাপিকা এবং গবেষণা নির্দেশিকা।তার  নির্দেশনায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্র-ছাত্রী গবেষণা করে চলেছে। লক্ষ্মীমপুর জেলার নারায়ণপুরে ছাত্র জীবন শুরু হয়। পরবর্তীকালে কটন কলেজ, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন।আজ পর্যন্ত অসম, উড়িষ্যা,ছত্তিশগড় ,কালিম্পং এবং মনিপুরের বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে ক্ষেত্র অধ্যয়ন ভিত্তিক গবেষণা করেছেন। ‘হরি গুণ কহন ন যাই’,’ নখ ন রখা ছোয়ালীবোর’ এবং  তিনটি ভিন্ন স্বাদের উপন্যাসিকা ডক্টর দাসের প্রকাশিত গ্রন্থ। ‘হরি গুণ কহন ন যাই গ্ৰন্থ’টি জীবন’ নামক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ গ্রন্থ সম্মান লাভ করে।ডঃদাস বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন।

     

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস


এক (ক)মধ্যরাতের ঘন্টা

মধ্যরাত।

ঘুমের বিচিত্র এবং অনুচ্চ শব্দগুলি তার ঘরের বাতাসটুকু ভরিয়ে রেখেছে।কেবল সে জেগে আছে।এই সময় জেগে থাকাটাই তার পুরোনো অভ্যাস।লেপটপটা খুলে সে কিছু একটা করছে।হঠাৎ কোথা থেকে খুব ক্ষীণ একটা শব্দ ভেসে আসছে বলে মনে হল তার।খুব পরিচিত বলে মনে হওয়া একটা শব্দ।যেন দূরে কেউ কাঁসর ঘণ্টা বাজাচ্ছে।সে কান খাড়া করে রইল।কিন্তু সে পুনরায় সেই শব্দ শুনতে পেল না।

কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজে।ঘড়িটার যেন একটাই মাত্র কাঁটা।আর কিছু নেই।একেবারে কিছু নেই।এমনিতেই শূন্য।শূন্য দেওয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়িটা।সেই কবে ছেড়ে আসা নারায়ণপুরের মুগা-পামটার কথা তার মনে পড়ল।এই মধ্যরাতে সবুজ মুগা-পামটার কাছে থাকা তার শৈশব,কৈশোর,আদি যৌবনের ঘরটাতে থাকলে শুনতে পেত নাতিদূরের ঘন্টাধ্বনি।একবার করে থেমে থেমে কাঁসর ঘন্টায় ভোঁতা মাথার লাঠিটার কোব পড়ত পুরো বারো বার।মানে রাত বারোটা বাজে।কিন্তু সেই রোদ ঝলমল ঘর,সেই সবুজ মুগা-পাম সেই কোন অতীতে ছেড়ে এসেছে।দূরের কী কাছের কোনো ঘন্টাধ্বনি সে শুনতে পায় না।

সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়।একঘন্টা।কোনো ঘন্টাধ্বনি থাকে না।সে পরীক্ষা হলে পায়চারি করে।  

কোনো শব্দ থাকে না। এক ঘন্টা দুইঘন্টা এবং অবশেষে তিন ঘন্টা শেষ হয়। কোনো ঘন্টা পড়ে না। মুগা পামের পাশের স্কুলটিতে ফেলে আসা ঘণ্টাধ্বনি তার পেছন পেছন কখনও এল না।

দাঁড়িয়ে ফিরে তাকানোর মতো তার সময় থাকে না। বড়ো ব্যস্ত সে। বড়ো ব্যস্ত। এই ঘর,এই সংসার ,এই তার ছাত্রছাত্রীরা, লেখাপড়া করা…সব কিছুতেই ব্যস্ততা। একদিন মধ্যরাতে সে হঠাৎ আবিষ্কার করে সে কোথাও কিছু একটা শব্দ শুনছে। যেন দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে একটা পরিচিত শব্দ।

পরের দিন সারাদিনটা সে  শব্দের কথা ভুলে রইল।

মধ্য রাতেও সে সেই শব্দটা শুনতে পেল না। কিন্তু শেষ রাত্রে জেগে ওঠে যখন পুনরায় সে সেই একই শব্দটা পুনরায় শুনতে পেল তখনই মনে পড়ল আগের দিন মধ্যরাতে সে এই শব্দটা শুনেছিল। তার কাউকে কথাটা বলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু এই শেষ রাতে সে কাকে বলবে, কার সঙ্গে একটা ঘন্টাধ্বনি শোনার কথা পাতবে।

এক/(খ)পার্থ-স্বাতী

স্বাতী  বড়ো মনোযোগের সঙ্গে এতটুকু পর্যন্ত পড়ে তার কাছে থাকা সবুজ চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে মাথা তুলে তাকাল।পার্থ,তার মানুষটা সেখানে বসে তার দিকে তাকিয়েছিল।

–কতটা পড়লে?

–আরম্ভ করেছি মাত্র।

–তুমি যদি এটুকু পড়ে ভাবছ যে এটা রত্নোত্তমা দিদির নিজের কথা,তাহলে ভুল ভাবছ।

–কেন?কেন হবে না?এটা রত্নোত্তমা দিদিরই কথা হবে।আর কার কথা হবে?বারোঘর নারায়ণপুরে নয়?নারায়নণপুরের বাড়ির পাশে একটা মুগা পামের কথা সে বলছিল না কি? আর ইউনিভার্সিটিতে একঘণ্টার ক্লাস সেই তো নেয়।

  — তাতে কী হয়েছে? সেসব কিছুই বড়ো কথা নয়। ঘড়ির কথাটাই আসল কথা। রত্নোত্তমা দিদির বাড়িতে শূন্য ডায়েলের দেওয়াল ঘড়ি একটিও নেই। শূন্য একটি দেওয়ালের কথাও লিখেছে দেখ।তার ঘরে শূন্য দেওয়াল তো নেই। প্রতিটি দেওয়ালই সে সাজিয়ে রাখে। খালি রাখে না।

এইবার স্বাতীকে কিছুটা বিমূঢ় দেখা গেল। এমনিতেও সে এই মানুষটার কথাগুলিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তার পার্থ বলছে যখন হলেও হতে পারে। হতে পারে কেন, হবেই বোধ হয়। আরও একবার চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে তার মনে হল যে চা অনেকক্ষণ হয় ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর  এক কাপ গরম সবুজ চা খাওয়ার ইচ্ছা হল তার।

চা খাবে? আমি আরও এক কাপ খাব। এটা এমনিতেও খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে।

পার্থ পুনরায় তার দিকে তাকাল এবং বড়ো কাতর ঠান্ডা একটা কণ্ঠস্বরে বলল: ঠান্ডা তো হবেই। তুমি কী করছ আমি দেখতে পাচ্ছি তো। তুমি খবরের কাগজটার প্রথম পৃষ্ঠার কিছু অংশ পড়ে সেখানেই ছেড়ে দিলে এবং গল্পটার শুধুমাত্র আরম্ভটুকু পরে তিন ঘন্টা ধরে এভাবেই বসে রয়েছ। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছি।

স্বাতী চমকে উঠল। পার্থ কী বলছে? সে আধ খাওয়া চায়ের কাপ পুনরায় একবার হাতে তুলে ঠোঁটের কাছে নিল। ঠান্ডা গভীর পাতকুয়োর নিচ থেকে তুলে আনা জলের মতো হয়ে গিয়েছিল তার প্রিয় সবুজ চা। পার্থের অপরিচিত কণ্ঠস্বরের মতোই ঠান্ডা। 

দুই/ (ক) শেষ রাতের ঘন্টা ধ্বনি

শেষ রাতে যখন সে পুনরায় একবার দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসা একটা ঘন্টাধ্বনি শুনছি বলে মনে হল, সে ভাবতে শুরু করল, আশেপাশে কোথায় কী আছে? মন্দির? গির্জা ?স্কুল?থাকার মধ্যে একটি দুটি নয়, তিনটি স্কুল একেবারে কাছেই আছে। একটা তো একেবারে  তাদের আবাসিক চৌহদের ভেতরে রয়েছে। কিন্তু তার ঘণ্টার শব্দ তার কানে কখনও এসেছে বলে মনে পড়ে না। দিনের বেশিরভাগ সময় সে প্রায় বাড়িতে থাকে না। যতক্ষণ থাকে তার অনন্ত ব্যস্ততা। তার নিশ্ছিদ্র ব্যস্ততার কবচের মধ্য দিয়ে কোনো ঘন্টাধ্বনি প্রবেশ করার ফাঁকফোঁকর নেই। আর কথা হল, স্কুলের ঘন্টা বাজার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু তার এরকম মনে হল যেন সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে গভীরতা ভেদ করে বাতাসে  ভেসে আসা ঘন্টার প্রশান্তিকর ধ্বনি ।রাতে ফোঁটা সাদা ফুল গুলির  সুগন্ধের মতো ভেসে আসছে সেই করুণ ধ্বনি। এসে তার কর্ণ কুহরে আঘাত করছে। তার মনে হল, কে জানে অনেকদিন না খুলে বন্ধ করে রাখা একটি দরজা কোথাও তার মধ্যে আছে নাকি!

অনেকক্ষণ ধরে কান খাড়া করে থাকার পরেও সে পুনরায় সেই ক্ষীণ ধ্বনিটা আর শুনতে পেল না।ভোর হতে তখনও অনেকটা দেরি।শীত তখনও রাজধানী শহর ছেড়ে যায় নি।তার ঠান্ডা লাগছিল।চোখদুটি জ্বালা করছিল।এরকম এখনও হয় তার।রাতগুলি হাতের ইশারায় ডাকতে থাকে তাকে এবং ঘুমকে তাচ্ছিল্য করে রাতের কাছে চলে যায়।তার পুরোনো অভ্যাস।প্রায়ই ছটফট করে সে।কখনও শুতে চেয়েও শুতে পারে না।ব্যস্ততা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা ব্যথাগুলি রাতের দিকে চাগাড় দিয়ে উঠে।ঢাকনা খুলে দেওয়া সুরার মতো কলকল করে বেড়িয়ে যেতে চায় তার একান্ত নিজের কষ্টগুলি।সে কিছুই করে না।কিছু করতেও পারে না সে।

উষ্ণ আলোয়ানটা মুড়ে নিয়ে সে জোর করে চোখদুটি বন্ধ করে শোবার চেষ্টা করল।সকালে প্রথম শ্রেণিটাকে তাকে পড়াতে হবে।সকাল থেকে আরম্ভ হয়ে যাবে তার বিশ্রামহীন প্রাত্যহিকতা।

তার দিনগুলি,রাতগুলি আসে এবং যায়।তার ব্যস্ততা বাড়ে।সেই অনুপাতে বাড়ে তার কিছু সফলতা।সে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে।সেইসব কীসের ধাপ সেও জানে না।লোকেরা তাকে বাঃবাঃ বলে আর তার ভেতরের পুরো সত্ত্বাটা একটা শামুকের মতো সঙ্কুচিত হয়ে এসে তার গোপন খোলসটাতে জড়োসড়ো হয়ে ঢুকে থাকে।দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা একটা বালুচরে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ শামুকের খোলস একটার মতো সে পড়ে থাকে।ঠিক তখনই কাউকে বলতে না পারা তার গোপন কথাগুলি কুড়ে কুড়ে তার খোলসটার ভেতরে ঢুকে পড়তে চায়।কিন্ত সে তার খোলসটা কারও সাথে ভাগ করে নিতে চায় না।না,তার খোলসের ভেতরে আর কারও জন্য সূচাগ্রমান জায়গাও নেই।সে একাই পড়ে থাকে।দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া বালিচরটার ওপর দিয়ে সোঁ সোঁ বাতাস বইতে থাকে।প্রখর রোদ এবং ধারাসার বৃষ্টি বালিচরটাকে ধুয়ে দেয়।শামুকের খোলসটা সেভাবেই পড়ে থাকে।

দুই/(খ) পার্থ-স্বাতী

এবার স্বাতী নিশ্চিন্ত হল।পার্থ বলা কথাটাই ঠিক।আর কোনো সন্দেহ নেই।এটা তার পরিচিত রত্নোত্তমা দিদির কথা নয়।একবার মাঝখানে তার পুনরায় একটু মনে হয়েছিল যে এটা রত্নোত্তমা দিদিরই কথা। কারণ স্বাতীর মনে আছে, কোনো একদিন ফোনে কথা বলার সময় সে হুলুস্থুলের শব্দ শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করায় রত্নোত্তমা বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবাসিক পরিসরে সে থাকে, সেখানে তিনটি স্কুল আছে। তারই ছেলেমেয়েদের করা হুলুস্থুলের শব্দ। এমনিতে নাকি সেই জায়গাটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। পুরোনো গাছপালায় ভরা সেই এলাকাটায় থাকলে দিল্লিতে আছি বলে মনে হয় না। কিন্তু স্কুল গুলোর জন্য নির্দিষ্ট সময় হওয়া স্কুলের  কোলাহল গুলি এলাকাটা ভরিয়ে রাখে। গল্পটিতে তৃতীয় পুরুষের নারীটিরও আবাসিক এলাকাটাতেও তিনটি স্কুল থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পড়াশোনা করে থাকার সময় স্বাতীর মধ্যে পুনরায় মনে হয়েছিল, কে জানে গল্পটার এই ‘সে’ হয়তো রত্নোত্তমাই। কিন্তু পড়ে সে ভাবল,না, পার্থ বলাটাই ঠিক। এসব রত্নোত্তমা দিদির নিজের কথা নয়। হতেই পারে না ।স্বাতী একবার দিল্লি যাবার সময় পার্থ তাকে বারবার বলে দিয়েছিল তার প্রিয় রত্নোত্তমা দিদির সঙ্গে দেখা করার জন্য। সে দেখাও করেছিল। খুব ভালো লেগেছিল তাঁর। পার্থ, তাঁর ভালোবাসার মানুষটি যে এই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেছিল।পার্থ স্বাতীকে দিল্লির কত গল্পই না বলেছিল।সে তাকে ‘সৃজন’এর কথাও বলেছিল। রত্নোত্তমা  শুরু করা ওদের রবিবারের আড্ডাটার নাম ছিল ‘সৃজন’।সেই নামটা রেখেছিল। নামটা পার্থের খুব পছন্দ হয়েছিল।কিন্তু সত্যিই সেই নামটা পার্থের কতটা প্রিয় ছিল রত্নোত্তমা সেই কথার আভাস পেয়েছিল অনেক বছর পরে।ততদিনে সে দিল্লিতে স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিল,কোনোকিছু না ভেবেই।আর পার্থ ফিরে গিয়েছিল তার অসমে,সে চাওয়ার মতো।পরে পার্থের জীবনে স্বাতী এসছিল।আসাই নয়,স্বাতী নিজের অস্তিত্ব পার্থের নামে বিলীন করে দিয়ে তার জন্যই বেঁচে থাকতে শুরু করেছিল।আর একদিন পার্থ ওদের দুটো ঠিকানার নাম দিয়েছিল ‘সৃজন’।

ছবি,বই এবং ফুল দিয়ে ওরা সাজানো ‘সৃজন’এ বসে স্বাতী এই মুহূর্তে গল্পটা পড়ছে।পড়তে গিয়ে সে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছে।আসলে এটা কি গল্প?এটা তো বাস্তব চরিত্রের অনুভূতি এবং বাস্তবে ঘটা কিছু ঘটনার সমষ্টি মাত্র।স্বাতী নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগের প্রাধ্যাপিকা।সে নিজে পড়া এবং পড়ানোর বিষয় সাহিত্য।সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক গুলি বিষয়ে সে জানে।ছোটোগল্পের সংজ্ঞাও তার অজ্ঞাত নয়।কিন্তু সে এই গল্পটা পড়ে কোন ধরনের গল্প তা বুঝতে পারছে না।যেখানেই অসুবিধার সম্মুখীন হয় সেখানেই পার্থের মুখের দিকে তাকায়।এভাবে যখন তখন পার্থনির্ভর হওয়াটাই পার্থকে কেন্দ্র করে ঘোরা তার ছোট্ট পৃ্থিবীটার স্বাভাবিক নিয়ম।পার্থ সেখানেই ছিল,যেখানে স্বাতী ছিল।সে সেখানেই থাকে,যেখানে স্বাতী থাকে।

-তুমি ঠিকই বলেছিলে, পার্থ।শুরুটা পড়েই আমি এটা রত্নোত্তমা দিদির কথা বলে ধরে নিয়েছিলাম।কিন্তু এখন দেখছি তুমি বলাটাই ঠিক।এটা দিদির কথা নয়।হতেই পারে না।তার মতো এমন প্রাণবন্ত মানুষটার মধ্যে এই ধরনের হতাশা,নৈ্রাশ্যের কথা ঢুকে থাকাটা সম্ভবই নয়।কিন্তু এটা কি গল্প?কে জানে শেষ পর্যন্ত পড়ার পরে জানা যাবে সাহিত্যের কোন আঙ্গিকের মধ্যে এটাকে রাখা যাবে।

চারকোণের আয়তাকার কালো চশমা জোড়ার মধ্য দিয়ে পার্থ দূরের কোনো একটা দিকে তাকিয়েছিল।বোধহয় ধীরে ধীরে গুমোট বাঁধা ডিব্রুগড়ের আকাশটার দিকে।কোথা থেকে জানি গুমোট কালো মেঘ কিছু এসে তাদের মাথার ওপরে জমতে শুরু করেছিল।অথচ সেইসব বৃষ্টিবহনকারী মেঘ ছিল না।দূরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সে বলে গেল।শৈশবে একই ধরনের শিশুদের পত্রিকায় এবং খবরের কাগজের শিশুদের পাতায় আমরা লিখতাম।আমরা এভাবেই চিনতে পেরেছিলাম।পরে গিয়ে যখন দিল্লিতে রত্নোত্তমা দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল,তখনই ধীরে ধীরে আমরা ভালোভাবে জানার জন্য,ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।তোমাকে তো আগেও বলেছি,দিল্লিতে আমাদের ‘সৃজন’এর গ্রুপটির কথা।

–বলেছিলে তো।তোমরা রবিবার রবিবার ইউনিভার্সিটির  ক্যাম্পাসের ঘাসে বসে আড্ডা মারছিলে।গয়ার হলের ক্যান্টিনে মিষ্টি সিঙ্গারা খেয়েছিলে।

-অ’অ’।আর যেখানে সেখানে ঘুরেও বেড়িয়েছিলে।কখনও এনএসডিতে নাটক,কখনও কোথাও চিত্র প্রদর্শনী।ছাব্বিশ জানুয়ারিতে প্যারেড দেখতেও গিয়েছিল।আর গিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল গার্ডেনের ফুল ফোঁটা দেখতে।কোথায় কোথায় যে আমরা ঘুরে বেড়াতাম।কোথায় কোথায় বসে যে আড্ডা মেরেছিলাম।

-তোমাদের ‘সৃজন’এর পঙ্কজ তো এখন রাষ্ট্রপতি ভবনে এত ভালো চাকরি করছে।আমাদের‘সৃজন’এর প্রায় সবাই ভালো ভালো জায়গায় কাজ করছে।পঙ্কজ,আরুণি,বিপাশা,মিতালি দিদি,প্রজ্জ্বলিতা,অবন্তিকা…

–সব তোমার মুখে শোনা নাম।শুধুমাত্র সবার সঙ্গে দেখা হয় নি।

পার্থের দৃষ্টি তখনও ধূসরিত দিগন্তে।তাকে কিছু বলতে না দেখে স্বাতী পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করল,গল্পটার কথা বললে না যে তুমি?

–গল্প?

–আমি পড়তে থাকা গল্পটা? মানে যদি এটাকে গল্প বলা যায়…

–গল্প হোক বা না হোক।এটা কিন্তু একেবারে বাস্তব কথা,সত্যি কথা।

–মানে?রত্নোত্তমা দিদির নিজের কথা?তুমি তো প্রথমে না বলেছিলে?গল্পটার ‘সে’মানে ‘সেই’?কিন্তু তা কীভাবে হতে পারে?

–মানুষ দেখার মতো সে যদি এত সুখী এবং পরিপূর্ণ হত,সেই সেদিন আমাদের ‘সৃজন’এর জন্মই হত না।

–হুম…

–দিদির অদ্ভুত অস্থিরতা এবং একাকীত্বের একটু আভাস আমি পেয়েছিলাম।কিন্তু কখনও কোনো কথা বলিনি।কিন্তু সে আমাকে এবং পঙ্কজকে বলেছিল।আরুণি এবং মিতালি দিদিও জানত।

–পিতার অসুখ?কী অসুখ?

–কেন্সার।দিদির পিতার কেন্সারে মৃত্যু হয়েছিল।

–‘কেন্সার’শব্দটা শুনেই স্বাতীর চোখদুটি নিথর-নিস্তেজ হয়ে পড়ল।ডিব্রুগড়ের গুমোট আকাশটার সমগ্র কালো এসে বেচারির চোখের সামনে ঝুলে রইল।পুরো গুমোট গুমোট ঠান্ডা ভেজা উড়ে এসে তার শরীরে ভর করল।এখন স্বাতী কী করবে?এত ভারী ভার এখন একা সে কীভাবে সইবে?

–পার্থ? … পার্থ …

–জীবনের ভারগুলি কাঁধ বদলে ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিল ওরা দুজন।পার্থ কোথায়?কোথায় পার্থ?

তিন/সুদূরের ঘণ্টাধ্বনি

পার্থ নাই হয়ে গিয়েছিল।হঠাৎ।ওহো,হঠাৎ নয় আসলে।সমস্ত কিছু জেনে-শুনে সবাইকে জানিয়েই সে চলে গিয়েছিল।

–কী কেন্সার বললে?

–রত্নোত্তমা বিক্রমকে পার্থের ফুসফুসটা খুলে খুলে খাওয়া কর্কটটার নামটা বলেছিল।ধূমপান? ধূমপান এবং পার্থ?না,সম্পূর্ণ বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান করা দুটি শব্দ।

–বয়স কত পার্থের? 

–হ্যাঁ?কত মানে সে আমার চেয়ে এক বছরের ছোটো।

–বিক্রম জিজ্ঞেস করেছিল কখন কী কী হয়েছিল?কী কী চিকিৎসা করা হয়েছিল।তখন,পুনরায় পার্থের জীবনে ফিরে এসেছিল অনাহূত কর্কট।গম্ভীর হয়ে পড়েছিল সে।সে সেদিনই তাকে বলেছিল সে শুনতে না চাওয়া সত্যটা।এত কম বয়সে হওয়া এই ধরনের কেন্সার হয় ‘এগ্রেসিভ কেন্সার।’ডাক্তার বিক্রম প্রতিনিয়ত তার হাসপাতালে দেখে কেন্সার এবং রোগীর যুদ্ধ।রোগের সঙ্গে রোগীর সঙ্গে রোগীর পরিবারের যুদ্ধ।যোদ্ধা রোগীর ডাইনে-বামে থেকে ডাক্তার নার্স যুদ্ধ করে ঔষধ পথ্য,কেমো অপারেশন সমস্ত হাতিয়ার নিয়ে।তথাপি বড়ো অসমান,বড়ো বেইমান এই যুদ্ধ।কর্কট তার বিষাক্ত থাবা মেলে চেপে ধরে জীবনকে।আর শেষ পর্যন্ত জীবন হারবে না জিতবে তা নির্ভর করে যুদ্ধটাকে কে কীভাবে গ্রহণ করে তার ওপরে।

‘আমাদের পার্থ কখনও হেরে যায় নি।’

পার্থ নামের সরল,হাসিমুখের ‘পুলিশ লেখক’মানুষটার একদল বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয় এবং সহলেখক-সাহিত্যিক-সম্পাদক-সমালোচক সমস্বরে চিৎকার করে উঠেছিল।সবাই মিলে পার্থের স্বাতী নামের নিষ্প্রভ হতে চলা মানুষটাকে তুলে ধরেছিল।সবাই মিলেই তো হাসপাতালে পার্থের হাতে তুলে দিয়েছিল তার শেষের বইটি।সে প্রকাশিত রূপে দেখতে চাওয়া তার গল্পের সঙ্কলন,‘দূরের ঘন্টাধ্বনি।’।

পার্থ পড়া কিরোরীমল কলেজের প্রাঙ্গণে একা একা হাঁটতে হাঁটতে রত্নোত্তমা ভাবছিল,এখানে,এইখানটাতে তখনকার ‘সৃজন’এর আড্ডা একদিনও মারা হয়নি।সৃজনের সদস্যদের নিজের নিজের শিক্ষানুষ্ঠানগুলির চৌহদেও আড্ডার আয়োজন কখনও করা হয় নি।কখনও তা ভাবাও হয়নি।সৃজনের নিয়মিত সদস্যগুলি প্রত্যেকের ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল।অনেকেই স্থান থেকে স্থানান্তরে চলে গিয়েছিল।অসমে ফিরে গিয়েছিল।আর তারপরে ধীরে ধীরে কর্মজীবন,বিবাহ…।সৃজনের অস্তিত্ব থেকে গিয়েছিল কেবল স্মৃতিতে।

কতদিন আগের কথা আর,খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে স্বাতী এবং পার্থ দুজনেই ডিব্রুগড় থেকে দিল্লিতে ফোন করেছিল।রত্নোত্তমাকে বলেছিল,ওরা ওদের নতুন বাড়িটার নাম সৃজন রাখার কথা।

–দিদি,আমাদের ‘সৃজন’কে মরতে দেব না,বাঁচিয়ে রাখব।অতি উৎসাহের সঙ্গে পার্থ তাকে বলেছিল।পার্থ নাই হয়ে যাবার পরে এখন সৃজন একটা ‘হোয়াটস এপ গ্রুপ’।পুরোনো সৃজনের সদস্যদের একটা গ্রুপ।আড্ডাবাজ সৃজনের নতুন রূপ,একটা ঘর,একটা হোয়াটস এপ গ্রুপ,অর্ধসমাপ্ত,কিন্তু অস্তিত্ব বিহীন নয়।

চার/পারলে চেরীফুলের কিছুটা গোলাপি…

পার্থ নাই হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরের একটা ঘন্টাধ্বনি অনেকেই কখনও সুদূরে আবার কখনও নাতিদূরে থেমে থেমে বাজতে থাকা অনুভব করতে লাগল।সেই ধ্বনিটা কারও জন্য ছিল অনামী ত্রাসের।সেই অনেকের মধ্যে সেও ছিল।সে সেই ঘন্টাধ্বনিটা বুকে খামচে ধরে থাকতে চেয়েছিল।তার জন্য সেটা বড়ো আপন সুর ছিল।সে সেই ধ্বনিটা রাতে ফোঁটা সাদা ফুলের সুবাস বুক ভরে উজিয়ে নেওয়ার মতো উজিয়ে নিতে চেয়েছিল।সাদা ফুলগুলির ঠুনকো পাপড়ি ছুঁয়ে দেখার মতো বড়ো আকুলতার সঙ্গে সে ছুঁয়ে দেখতে চাইছিল সেই ধ্বনিটা।সে যেন কোথাও কখনও হারিয়ে ফেলে আসা কিছু একটা ছিল সেই ধ্বনিটা। 

কয়েকদিন অর্ধ উজাগর রাতের পরে হঠাৎ এক রাতে সে আবিষ্কার করেছিল, আসলে ঘন্টাধ্বনিটা দূর থেকে আসছিল না। একেবারে কাছেই কোথাও থেকে আসছিল।আর  নিজের বুকে হাত রেখে সে আভাস পেয়েছিল, সেই ধ্বনিটা অন্য কোথাও থেকে নয়, তার নিজেরই বুকের গভীর তলদেশ থেকে আসছিল।

সেদিন পূর্ব দিকে ভোর হওয়া না হওয়ার মুহূর্তটিতে পুনরায় ঘন্টাধ্বনিটা শুনে ছিল। থেমে থেমে যেন কাঁসার ঘন্টায় আঘাত এবং অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার করুণ অনুরণন। গায়ের আলোয়ানটা জড়িয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে সে মোবাইলে হাত দিয়েছিল। সময় দেখার জন্য। অভ্যাসবশত ‘হোয়াটস এপ’ খুলেছিল। তারপরে ফেসবুক। খুলেই ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাতীর একটা আপডেট। মানে এই অসময়ে সে জেগে আছে! সে কি ঘুম থেকে উঠেছে না সারারাত ঘুমোয় নি?সে স্বাতীকে মেসেজ করল। সঙ্গে সঙ্গে স্বাতী  উত্তরও দিল,’আমার ঘুম আসে না দিদি।’

স্বাতীর ঘুম আসে না। স্বাতী তার এবং তার পার্থের স্বপ্নের ঘর ‘সৃজন’এ সারারাত একা একা পায়চারি করতে থাকে। 

দিল্লি থেকে সে স্বাতীকে পুনরায় মেসেজ পাঠায়।’সৃজন’এর ফুলগুলিতে জল দিচ্ছ তো?

‘সৃজন’এর ফুলগুলি স্বাতীকে ডাকতে থাকে। মধ্যরাতেও ঝলমল করে ফোঁটা তারা স্বাতীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, জীবন সুন্দর এবং রঙীন। সে আড়চোখে একবার তাকায়। ফুলগুলি ফোঁটে উঠে।এক কাপ সবুজ চা করে এনে সে সেখানেই বসে।কাজ আছে,করার মতো অনেক কাজ আছে তার।

দিল্লিতে যাই বলেও না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শীতের রাতটাতে সে তার খোলটা থেকে বেরিয়ে এসে একটা হোয়াটস এপ গ্রুপ খোলে।কিছু একটা পুনরায় করার কথা ভাবে। নীল আকাশের নিচে গোলাপি চেরীফুল ফোঁটা মুক্ত বাতাস একটার কথা কল্পনা করে।সে ভাবে,চেরীফুলের গোলাপি স্বাতীকে যদি বিন্দুমাত্র শান্তি এনে দিতে পারে,তাহলে গোলাপি ভালোবাসা স্বাতীকে যেখান থেকে হলেও একগুচ্ছ চেরীফুল এনে দিত।কারণ,স্বাতী নামের তার ভগ্নীসমা মেয়েটির মধ্যে সে যে তার নিজের মাকে দেখতে পেয়েছে।কেন্সার গলা টিপে শেষ করে আনা তার বাবার শেষ মুহূর্তপর্যন্ত মানুষটাকে মা কীভাবে ঘিরে রেখেছিল,সেটা সে দেখেছিল।

    (গল্পটি ডঃস্বাতী কিরণের হাতে আন্তরিক ভালোবাসা,শ্রদ্ধা এবং ক্ষমা প্রার্থনায়)

 

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত