মুক্তচিন্তা: বদল আসুক দৃষ্টিভঙ্গিতে । প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ
আর জি কর কাণ্ডের পর একটি স্লোগান সামাজিক মাধ্যমে খুব শেয়ার হচ্ছে – “whereever we go, however we dress /no means no, yes means yes”. অবশ্যই নারীদের নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো জায়গায় যাওয়ার বা যেকোনো পোশাক পরার অধিকার আছে। ঠিক যেমন অধিকার আছে যেকোনো বিষয়ে হ্যাঁ বা না বলার। একজন নারী হিসেবেই যে উক্ত অধিকারগুলো রয়েছে তা কিন্তু নয়। সেগুলো রয়েছে একজন ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবেই। অর্থাৎ একজন সমাজের অংশ হিসেবেই, মানুষ হিসেবেই। কারণ আসলে তো আমরা সবাই মানুষ। নারী বা পুরুষ হিসেবে কেবলমাত্র ঈশ্বরপ্রদত্ত কিছু প্রাকৃতিক বৈসাদৃশ্যের কথা বাদ দিলে দিনের শেষে আমাদের সবারই খিদে পায়, ঘুম পায় আলাদা করে নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেও বলা যায় নারী আর পুরুষ প্রকৃত অর্থেই একে অপরের পরিপূরক। এই প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম এর বিখ্যাত কবিতার লাইন প্রনিধাণযোগ্য-
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”
তার মানে কি কোথাও কোনও সমস্যা নেই? সবকিছু মাখনের মতো নরম! না সেটা নয়।সমস্যা অবশ্যই আছে। আছে বলেই তো এত শ্লীলতাহানির ঘটনা। এত ধর্ষণ। এত অমানবিকতা। এত নৃশংসতা। গলদ তো গোড়ায়। সমস্যা তো ওরিয়েন্টেশনে। এই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েও কেন নারী, পুরুষ আলাদা করে দেখা হবে! কেন মেয়েরাও কেমন সিগারেট খাচ্ছে দেখ বলা হবে? (নারী, পুরুষ কারও সিগারেট খাওয়া উচিত নয়, কিন্তু আমি এখানে দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণ হিসেবে লাইনটা লিখেছি) কেন পাবলিক বাসে মহিলাদের আলাদা সিট থাকবে? কেন স্যানিটারি ন্যাপকিনকে বাধ্যতামূলকভাবে কাগজের মোড়কে মুড়ে দেওয়া হবে? পিরিয়ড এর মতো একটি ভীষণ স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিষয় নিয়েও কেন প্রকাশ্যে কথা বলা যাবে না! সমস্যাটা ভাবনার। দৃষ্টিভঙ্গির বদল দরকার। একেবারে গোড়া থেকে সমস্যাগুলো তুলে এনে সুনির্দিষ্টভাবে অ্যাড্রেস করা দরকার।
আমাদের সমাজে একটি বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য দেখভাল করার জন্য মা, দিদি, কাকিমা দিদিমণিরা রয়েছেন। সেই কিশোরীর যাবতীয় কৌতুহলের নিরসনও তাঁরাই করে থাকেন। অনেক এন জি ও বা সামাজিক সংগঠনও এই বিষয়ে কাজ করেন। কিন্তু আমাদের সমাজে একজন বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরের মানসিক স্বাস্থ্য দেখভাল করার জন্য বাবা, দাদা,মামা, শিক্ষক কেউ থাকে না। তার কৌতুহলের নিরসন করতে হয় গুগল থেকে, বা পর্নগ্রাফি দেখে। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা বিকৃতি নিয়েই সে এগোতে থাকে। এই ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনও এন জি ও বা সামাজিক সংগঠন ডেডিকেশনের সঙ্গে কাজ করছে এমনটা আমার অন্তত জানা নেই। (যদি কারও জানা থাকে আমাকে জানাবেন প্লিজ) এইখানেই দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈষম্য দেখা দিচ্ছে যা জন্ম দিচ্ছে ভবিষ্যতের ধর্ষকদের – বিষয়টা এতটা সরল এবং একমাত্রিক না হলেও এটা মানতেই হবে উপযুক্ত শিক্ষা ও সচেতনতা সমাজে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির মতো ঘটনার হার কমাতে সক্ষম হতেই পারে। আর জি কর কাণ্ডের নৃশংসতা নিয়ে কথা হচ্ছিল এক উচ্চপদস্থ সরকারী আধিকারিকের সঙ্গে। উনি একজন তেরো বছরের ছেলের মা। উনি স্পষ্টতই জানালেন, “তেরো বছরের ছেলেকে রেপ ভিকটিম এর অর্থ বোঝাতে হিমশিম খেয়েছি। আসলে আমাদের সমাজে মেয়েদের কীভাবে মানুষ করতে হবে তার একটা প্রোটোটাইপ আছে কিন্তু ছেলেদের কীভাবে মানুষ করতে হবে তার কোনো প্রোটোটাইপ নেই। ছেলেদের আসলে আমরা সবকিছু থেকে কৌশলে সরিয়ে রেখে চিরকাল শিশু হিসেবেই রেখে দিতে চাই। (আদতে সে যতবড়ই হোক না কেন! ) তারপর আবার ধরো আমাদের মতো মা, বাবা – দুজনেই যাঁরা ওয়ার্কিং তাঁদের তো বাচ্চাকে কোয়ালিটি টাইমই দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না অনেক ক্ষেত্রেই। ফলে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ছোটখাটো অন্যায়কেও প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে যায় নিজেদের অজান্তেই!”
এই সমস্যা কিন্তু ম্যাডামের একার নয়। এই সমস্যা আমাদের সমাজের প্রত্যেক মায়ের, প্রত্যেক অভিভাবক এর। এর সমাধান একটাই। অবিলম্বে দৃষ্টিভঙ্গির বদল আনতে হবে। আমরা সবাই সমাজবদ্ধ জীব, কেউই সেই অর্থে আইকোনোক্লাস্ট নই। তাই একদিনে বদল আসবে না কিন্তু একদিন বদল আসবেই। আমাদের সমাজটা পিতৃতান্ত্রিক বলে হয়তো সেই বদলটা আসতে অনেক, অনেক দিন লাগবে। কিন্তু বদলটা আসবেই। আসতেই হবে। আমাদের প্রতিনিয়ত এই বদলের কাজে ব্রতী থাকতে হবে।
ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনা যিনি ঘটান তিনি কি সাময়িক উত্তেজনার বশে তা ঘটান নাকি পুরোটাই একটা মেন্টাল ব্লকেজ। এই প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম এক মনোবিদ দাদার সঙ্গে। উনি জানালেন, ” সাময়িক উত্তেজনার বশে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির শুরুর একটা পর্যায় পর্যন্ত হতে পারে কিন্তু ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির প্রকৃত কারণ হচ্ছে অশিক্ষা এবং সচেতনতার অভাব। ঠিক সময়ে সচেতন করা সম্ভব হলে আমাদের সমাজে রেপিস্টদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই কমবে। আর এক্ষেত্রে আর একটা বিষয়ও রয়েছে সেটা হচ্ছে নেশা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ঘটনাগুলো ঘটানো হয়। উপযুক্ত নেশামুক্তির প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগেরও খুব দরকার আছে আমাদের সমাজে।”
মনোবিদ দাদার কথার রেশ ধরেই যোগাযোগ করলাম নেশামুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এমন এক এন জি ও কর্মীর সঙ্গে। উনি স্পষ্টতই জানালেন,” শুধু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি কেন, আমাদের সমাজে যে সমস্ত অপরাধ সংগঠিত হয় তার একটা বড় কারণ নেশা। নেশামুক্তির উপযুক্ত কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, খুন সহ সংগঠিত অপরাধের একটা বড় অংশকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ফান্ড এর অপ্রতুলতা বা অন্যান্য টেকনিক্যাল কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না।”
ঠিক সময়ে সচেতন করার কাজটা সুচারুভাবে করার জন্য যেমন বিদ্যালয় স্তরে যৌনশিক্ষার পাঠ জরুরি তেমনি দরকার বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরদের সঙ্গে বাবা, কাকা, দাদা, মামাদের সহজভাবে মেশা। তাই কিশোরীদের গুডটাচ, ব্যাডটাচ এর পার্থক্য বোঝানোর পাশাপাশি কিশোরদের কৌতুহলগুলোকেও নিরসন করা হোক সমান মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই। এর ফলে হয়তো ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনা রাতারাতি কমে যাবে এমনটা নয়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলের এই দীর্ঘ অনুশীলন যদি একজন হবু ধর্ষকের মানসিকতা ও বদলে দিতে পারে, এই হতভাগ্য সমাজে সেটাই বা কম কীসের!
লাস্ট বাট অবভিয়াসলি নট দ্য লিস্ট, এই প্রসঙ্গে আর একটি জিনিস ভীষণ দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। হ্যাঁ, পাঁচজন অপরাধীর শাস্তি না হোক, কিন্তু একজন নিরপরাধ ও যেন শাস্তি না পায়-এই নীতি মেনেই পুরো বিষয়টি হোক না। কোনো অসুবিধা নেই। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে উপযুক্ত তদন্তের পরই শাস্তি হোক প্রকৃত অপরাধীদের। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কেবলমাত্র তাহলেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে হাঁটতে পারবো আমরা।
পরিশেষে বলি, এইরকম একটা বহুমাত্রিক, স্পর্শকাতর বিষয়কে একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার না করে তার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণকে সমান গুরুত্ব সহকারে দেখতে পারলে এবং প্রত্যেকটার জন্য আলাদা আলাদা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলেই আমাদের সমাজ থেকে ঐ সমস্ত অভিশাপগুলো দূর করা সম্ভব হবে। নচেৎ নয়।
সাংবাদিকতা ও গণ-জ্ঞাপনের ছাত্র । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই যুক্ত হন প্রত্যক্ষ সাংবাদিকতায়। বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রের নিউজ ডেস্কে কাজ করেছেন বেশ কয়েকবছর ।বর্তমানে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিভিন্ন পত্র পত্রিকার হয়ে নিয়মিত কলম ধরেন।