দ্য প্যারাগন হাউজিং
ঋষি পাড়ার সবচেয়ে বড় ঘরটাতে পরীক্ষার হলের মতো পিনপতন নীরবতা। ঘরের সদস্যদের মাঝে কিছু লিখতে না পারা অসহায় ছাত্রের মতো দুঃসহ কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। আর তার চেয়েও বেশি ভার সে বিষাদের, সদ্যমৃত বাড়িতে মরদেহ পুড়িয়ে আসার পর যে দুঃসহ নীরবতা নামে, শাস্ত্রীয় কৃত্য চলে আপন গতিতে,কিন্তু আর্তনাদ থেমে যায়। অন্তর ফেটে যায় অথচ দম মেরে থাকে সবার মুখের কথা, সেরকম।
ঘরটা নিতেশ রবিদাসের। কেউ মারা যায়নি। তবু এ বেদনার ওজন যেনো মৃত্যুর অধিক। কিংবা বেঁচে থাকা মানুষদের অনিশ্চিত মৃত্যুর নিশ্চিত সময় জেনে যাওয়ার মতো আতঙ্কময় এই যাপন। বুঝি মা দশভুজা সত্যি গ্রহন করেন না নিম্নবর্ণের নিষাদদের অঞ্জলি। তাই এ লাঞ্চনা! নাকি এ আর কোন ভয়াবহ বিপদের বার্তা! দুইশ বছরেরও বেশি সংসার এই পাড়ায়, উত্তরাধিকারে,স্মৃতিতে। বংশানুক্রমে শোনা গল্প, সেই রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে উড়িষ্যা থেকে কিছু পায়ে হেঁটে কিছু রেলের গাড়ি কিছু নৌকায় কিছু গরুর গাড়ি করে পার হয়ে এই জনপদে এসে উঠেছিল তারা। কিন্তু এমন বাঁধভাঙা জোয়ারে তলিয়ে যাওয়ার মতো বিপন্ন বোধ করেনি তারা কখনো। সত্যি কি এখানে পাট ফুরালো এবার!
এই ঘরেই পূজার উপাচার আয়োজন জমা হয় গত কয়েকবছর ধরে। দেবীপক্ষের শুরুতে কারো মুখে
কথা নেই। ঘরের আসবাবে আসবাবে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে,আলনার কাপড়ে, দাওয়ায় মেলে দেয়া গামছায়,স্তুপ করে রাখা নারিকেল মালায়,কলতলায় এই আধাসকালেও ছিটিয়ে থাকা অমাবস্যার অন্ধকারের মতো নীরব উদ্বিগ্নতা।
ফিসফাস আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে নিতেশ রবিদাস ছেলেকে ডাকে, বেইল হইছে বাপ, ওঠ। তাঁর সামনে জ্বাল দেয়া গুড়ের চা। মাড় তোলা ফেনা ভাত খেয়ে এক কাপ গুড়ের চা খাওয়া দীর্ঘদিনের অভ্যাস তার,সাথে হুক্কা।নিশীথ কতোদিন বলেছে,বাবা হুক্কাটা ছাড়ঐন একবার৷ সিগারেট খান। এখন কেউ হুক্কা খায়? নিতেশ রবিদাস কান দেয়না। সেই ছোট্টবেলার অভ্যাস।পাকিস্তান আমল তখন।দুইদিন পরপর মিছিল মিটিং হট্টগোল। বাপের সাথে বাজারের শেষ মাথায় জুতা সেলাই শিখতে যেতো সে। তুমুল আলোচনা গাঁয়ের দোকানে দোকানে। নিতেশ রবিদাসের বাপ আধা সেলাই টায়ারের জুতা ফেলে দৌড়ে যেতো দোকানের সামনে। সেই ফাঁকে হুক্কায় দুইটা টান দিয়ে দিতো নিতেশ।হুক্কা খাওয়া কি আজকের অভ্যাস? পোলায় কইলেই ছাড়া যায়?
নিশীথ উঠে কলতলায় নামে দাঁতের ব্রাশ নিয়ে। সারা পাড়ায় যে দুচারজন ব্রাশে দাঁত পরিষ্কার করে তার মাঝে সে একজন। শহরের কলেজে অনার্স
শেষ বর্ষে পড়ে সে। ভদ্রলোকের নানা কায়দা কানুন রপ্ত করার চেষ্টা করছে।নিশীথকে কলতলায় দেখে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে রনজিত রবিদাস,সঞ্জীব রবিদাস সহ আরো কয়েকজন।তখন মাথার উপর একদল শরতের মেঘ মিনিট খানেকের জন্য সূর্যকে ছেড়ে সামনের দিকে যায়,উজ্জ্বল রোদ ঘাই মারা মাছের মতো চিলিক দেয়,খানিকক্ষণ মাত্র। আরেকদল মেঘ এসে ঢেকে দেয়…।
তারা এতোক্ষণ নিশীথের অপেক্ষাতেই ছিলো। তাদের মধ্যে একজন গলা খ্যাকরি দেয় উঠোনে মার্বেল খেলতে থাকা বছর দশেক বয়সের বাবুলকে। ওই হারামজাদা কলে চাপ দে। মার্বেলগুলা ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে আসে বাবুল। পারলে রঞ্জিত, সঞ্জীবের মতো প্রৌঢ়রা নিজেই এগিয়ে আসে কলে চাপ দিতে। নিশীথের প্রতি অসীম সমীহ তাদের। ভরসাও। পুরো পাড়া জুড়ে যে হতাশার নীরব দহন,আজ নিশীথই তাদের বাঁচতে পারে এই দহন থেকে। আজ এস পি অফিসে মিটিং। ঋষি পাড়ায় দুর্গাপূজা হবে কি হবে না আজই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। ঋষি পাড়ার একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত থাকবে নিশীথ। সেই রাতের একমাত্র সাক্ষী।
মোমের স্তুপে জ্বলে নিরাশ্রয় আলো
পাড়ার ঠিক মাঝখানে একটু খোলামত জায়গায় কালির থান। রূপসী গাছের নিচে বাঁধানো বেদিতে মানতের মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে ফুরিয়ে ফুরিয়ে বসে গেছে একটার উপর আরেকটা, যেনো ছোটখাটো টিলা একেকটা। এবড়োথেবড়ো বেদিটা পাড়ার মানুষগুলোর জীবনের মতোই। আশার উৎসাহ আসে বারবার, কিন্তু নিরাশার বেদনা নেই। নিরাশ হওয়াই স্বাভাবিক এদের। বাচ্চা বিয়ানোর সময় সমীর রবিদাসের বউয়ের মরে যাওয়া কিংবা একঘর ছেলেমেয়ে রেখে বউকে বিধবা করে হঠাৎ পা ফুলে মাঝবয়সী স্বপন রবিদাসের মরে যাওয়া….কতো কি। মদ খেয়ে চুরচুর হয়ে অসিতের মাতলামি কিংবা অবিবাহিতা মৌসুমির শিকড় বাকড় খেয়ে পেট খালাস করা কোনটাই কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয় এই পাড়ায়।
এ পাড়াটি ঠিক কবে পত্তন হয়েছে নিশীথ জানেনা। জানার প্রয়োজনও বোধ করেনা। এ নিয়ে ওর কোন কৌতুহল বা আগ্রহ কিছুই নেই। এস এস সি পাশের পর কলেজে ভর্তি হয়েই সে পড়েছে প্রবহমান ছাত্র রাজনীতির স্রোতে। গড্ডালিকা প্রবাহের স্রোতে ভেসে যাওয়া কুচুরিপানার স্রোতে সেও একখানা। অচিহ্নিত।ঝাঁকের কই। ঝাঁকহীন কেউ নেই আর। এখন থাকতেও পারেনা।
তবে এই ঝাঁকের কইয়ে বদরুল ভাই হঠাৎ হঠাৎ তাঁকে খুঁজে,বিশেষ ভাবে খুঁজে। কারণ সে বাংলাটা লেখে বেশ ভালো। সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে। প্রাইমারিতে আলী স্যার হাতে ধরে লেখা শিখিয়েছেন। এটাই এখন কাজে লাগে। বদরুল ভাই ডেকে পাশে বসায়। পত্রিকা অফিসে পাঠানোর জন্য প্রেস রিলিজ,ডিসি, এস পির কাছে পৌঁছানোর জন্য স্মারকলিপি লেখালেখির যা কিছু কাজ নিশীথকে বলে দিলেই হয়। সবচে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে কম্পিউটারে টাইপ করে দেয়। ডাকলে যখন তখন পাওয়া যায় তাকে,যে কোন কাজে। ফলে নিজের প্রিয় শার্টের মতো আলাদা প্রশ্রয় আর সোহাগের চোখে তাকে দেখে বদরুল ভাই।
এস এস সি পরীক্ষার পর ক্লিক কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে তিন মাসের ট্রেনিং করেছিলো সে। নিজ তাগিদে অন্যদের চেয়ে ভালো শিখেছিল। ফলে সংগঠনের যে কোন কাজে তার উপর ভরসা করে বদরুল ভাই। এটাই নিশীথের শক্তি। যে কোন দরকারে বদরুল ভাই নিজে তাকে ফোন দেয়। সে ফোন দিলে বদরুল ভাই প্রথমবারেই ধরে। তাকে বদরুল ভাইয়ের প্রয়োজন। কিন্তু বদরুল ভাইকে আজ পর্যন্ত তার কোন প্রয়োজন পড়েনি। বদরুল ভাইয়ের পেছনে সবাই মিছিলে শ্লোগান ধরে, সেও ধরে। এর বেশি কিছু ছেঁকে নেয়ার মতো সুবিধা খুঁজেনি নিশীথ, কমিটি,পদ ইত্যাদি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য নিয়ে অন্যদের মতো মরণপণ তো দূরে থাক, বিন্দুমাত্র কাঙ্ক্ষাও তার ছিলো না।
কিন্তু আজ পুরো ঋষি পাড়া তাকিয়ে আছে তার দিকে। আসন্ন উৎসব ঘিরে আছড়ে পড়া কাল বৈশাখীর ধ্বংসস্তুপ আর হতাশা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠার জন্য আজ নিশীথই তাদের ভরসা। আর নিশীথের ভরসা বদরুল ভাই। একমাত্র বদরুল ভাই তাদের বাঁচাতে পারা নিমজ্জিত এই হতাশার ঘূর্ণি থেকে, কথা দিয়েছে বদরুল ভাই। নিশীথের পাশে সে আছে।
শাখা প্রশাখায় কতো বিচিত্র পত্র পুস্প কীট
মাঝখানে ডিভাইডার রেখে রাস্তার ওপাশে দ্য প্যারাগন হাউজিং নামে এপার্টমেন্টটা তৈরি হয়েছে কয়েকবছর আগে। লোকজনে ভরে উঠতেও সময় নেয়নি বেশি। বড়জোর মাসছয়েক। দেখতে দেখতে ভরে গেছে ফ্ল্যাটগুলি।নানা কিসিমের মানুষে।অফিসের অবসরপ্রাপ্ত বড় কর্তা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল। মূলত এই শ্রেণির মানুষ ছাড়া এমন অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য যার তার নেই। তারা ফ্ল্যাটে উঠার আগেই সর্বপ্রথম নজর করে এই ঋষি পাড়াটি। নাশহরকে শহর বানানোর চেষ্টায় এই পাড়াটি পাতের কিনারে জমে থাকা এঁটো কাঁটার মতো অযাচিত উচ্ছিষ্ট।
ফ্ল্যাট কিনতে এসে প্রথম ফিরে যাওয়া লোকটির নাম হাজী মনোয়ার আলী। তিনবার হজ্ব করে আসা মানুষ তিনি। ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই বেপর্দা মেয়েমানুষের দল দেখে তিনি দিন শুরু করবেন নাকি। শেষ বয়সে যতোই মফস্বলে থাকার প্ল্যান করুন তাই বলে এই বেপর্দা বিধর্মী পাড়ার মুখোমুখি!
নিশীথের মা পিসি, শ্যামদুলালের বিধিবা বোন, রঞ্জিতের বউরা সকাল সকাল বাসি ভাত আর শুকনো বাসি ডাল শুকিয়ে মরিচ পুড়িয়ে কাঁচা পেঁয়াজে ভর্তা করে ঘরের পুরুষদের খাইয়ে বিদায় দিয়েই হা করে তাকিয়ে থাকে নতুন গড়ে উঠা দ্য প্যারাগন হাউজিং এর দিকে। বারান্দার বাগানে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে কেউ। বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে চা খাচ্ছে কেউ, ছাদে বেলাজের মতো হাতকাটা গেঞ্জি পরে লাফায় সোমত্ত মেয়েগুলা। নিজেদের ব্লাউজহীন শরীর মলিন রংচটা শাড়িতে ঢেকে তারা দেখে আর অবাক হয়। অপার কৌতুহলে তারা নিজেদের উনুন জ্বালাতে ভুলে যায়। দুপুরবেলা এরা কি খায়, কেমনে রাঁধে এদের জামাইয়েরা কি মাতাল হয়ে বউকে পিটায়, কতো চিন্তাই যে পীড়িত করে এদের!
মনোয়ার আলী ফ্ল্যাট না কিনে ফিরে গেলে ডেভলেপার কোম্পানি নড়েচড়ে বসে। শুরু থেকেই ছিলো এই খুঁতখুঁতানিটা। উপজেলা সদরের শ্যাওলা পরা বিলের জীবনে পদ্মফুল ফোটে ওঠার মতো যখন এই হাইরাইজ কমপ্লেক্সটি উঠে তখন থেকেই কোম্পানিতো বটেই, যারা ফ্ল্যাট বুকিং করতে আসে তাদের সবার কমপ্লেইন ছিল এই ঋষি পাড়াটি নিয়ে। ডেভলেপার কোম্পানি পাড়াটি স্থানান্তরের নানানুখী চেষ্টা তদবির করে ব্যার্থ হয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য পর্যন্ত গিয়েছে। বদরুল ভাইই তখন রক্ষা করেছে তাদের। বিপদের আঁচ চেপে রাখা যায় না,উনুনে রান্না করা সিঁদল ভর্তার গন্ধের মতো। ঋষি পাড়া উচ্ছেদের ভাসা ভাসা খবর নিশীথের কানে যেতেই নিশীথ হত্যে দিয়ে পড়েছে বদরুলের কাছে। এটা হতে দেয়া যায়না। যেবার খালি ভোট সেন্টারে যখন কেউ ভোট দিতে যায়নি। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে তারাই দলে দলে ভোট দিয়ে পাশ করিয়ে এনেছে সংসদ সদস্যকে। নিশীথ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব ভোট কাস্ট করেছে। বদরুল সাক্ষী।আজ এদের উচ্ছেদের প্রশ্নে সেই সংসদ সদস্যই টাকা খেয়ে হোক কিংবা ডেভলেপার কোম্পানির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই হোক বদরুলকে প্রথমে ধমক দেন। এদের তো উচ্ছেদ করা হচ্ছেনা। অন্যত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে। বদরুল তখন একা দাঁড়ায় সম্মিলিতের প্রতিরোধ হয়ে। না এদের বসতি আগে। পরে এই ডেভলেপাররা জায়গা কিনেছে! এই জাতীয় আইনের কথার বাইরেও বদরুল খুব দৃঢ়তায় যা উচ্চারণ করেছে তা হলো, এদের অসহায় গরীব সং্খ্যালঘু পেয়ে যা ইচ্ছা তাই চাপিয়ে দেবেন, পারতেন আমাদের গ্রামের কোন একটি পাড়া উঠিয়ে দিতে?
সাংসদ এবার থেমে যান। মূলত যে গ্রাম থেকে তিনি উঠে এসেছেন সেই গ্রাম তার ভোটব্যাংক। আর এই বদরুল তার কাণ্ডারি। বদরুলকে ক্ষেপালে তার চলবে না। এলাকার যোগসূত্র, শহরে দাপট, ভোট কাস্টিং সবকিছুর জন্য বদরুলের উপর তার সর্বাংশে নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া বদরুল যে যুক্তি উত্থাপন করলো, তা সুপরিকল্পিত কিনা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও, সুচিন্তিত যে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ার আশঙ্কা মনে পড়তেই তিনি হঠাৎ থেমে যান, মনে পড়ে সেবার এক কন্ট্রাকটারের সাথে টেলিফোনে ঝগড়া করে কি বিপদে পড়েছিলেন,পুরো প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়াপাড়া হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো তার পেছনে। আগুন লাগিয়ে দেয়া মৌচাকের চাকচ্যূত দলবাঁধা মৌমাছির মত।
বদরুল কেন এদের এতো অন্ধভাবে সমর্থন করছে তার অন্তর্নিহিত কারণ বের করার উদ্দেশ্য মনে গোপন করে তিনি প্রকাশ্যে বললেন এরা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে।
যদিও পরে তিনি তেমন কিছুই বের করতে পারেন নি, আর মাথাও ঘামাননি।কারণ মাথা ঘামানোর মতো হাজারটা কাজ তার প্রতিদিন তৈরি হতে থাকে।সেই বদরুলের ভরসাতেই আজ নিশীথ সালিশ বৈঠকে যাবে। সেই রাতে ঢাকায় প্রতিনিধি সম্মেলন শেষ করে বদরুল ভাই ভোররাতে তাকে পাড়ার মুখে নামিয়ে দিয়েছিল। আর দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যক্রমে নিশীথ মূর্তি ভাঙার নিঃশব্দ প্রলয়টুকুর সাক্ষী হয়ে গিয়েছিলো নিঃশব্দেই। বদরুল ভাইকে জানিয়েছে সে একথা।
পুষ্প যেমন বিচিত্র রং এর হয় কীটেরাও হয় নানান বিষের
প্রথমবার পূজা করার খবর জানাতে গিয়ে স্থানীয় হিন্দু নেতাদের কাছে গিয়েছিলো ঋষি পাড়ার মুরুব্বিরা। একেকজনের কাছে একেকজন। যেমন,
একদিন সকালে নিতেশ রবিদাস গিয়েছিলেন শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মুরুব্বি সীতেশ সেনগুপ্তের কাছে, যিনি আবার হিন্দু কমিউনিটির নেতাও বটেন, তাঁর বারান্দায় সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি জাতপাত ছুঁয়াছুঁয়ির ধার না ধেরে মেয়েকে বলেছিলেন বারান্দায় মোড়া পেতে দিতে। চা খাইয়েছিলেন আর ধবধবে চিনেমাটির প্লেটে বিস্কিট।আর নিজের উদারতার গর্বে নিজেরই আনন্দ উপচে উঠছিলো।কতো ভালোমন্দ গল্প করছিলেন, সেই যে ঋষি পাড়াটি শহরের ঢালে পড়ে থাকতো। অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে। এইতো বছর পনেরো আগেও।বিণা কারণে ওদিক মাড়াতো না কেউ। দেখতে দেখতে রোডস এন্ড হাইওয়ে মহাসড়কের সাথে সংযোগ সড়ক বানিয়ে দিলো। রাতারাতি বিদ্যুতের পিলার বসলো। এখন তো রাজধানী মুখী বাসগুলোর প্রথম প্যাট্রোল পাম্পটি এখানে। আর তা ঘিরে কতো বাহারী দোকান। খাবারের, পোশাকের। আর সি সি রাস্তার পাশে বিস্তীর্ণ ফসলী জমিগুলো ভরাট হয়ে গত পনেরো বছরে ভদ্রস্থ পাড়া হয়ে উঠেছে বিয়ের কন্যার গোল্ড প্লেটেড গয়নার মতো।আর সদ্য সমাপ্ত দ্য প্যারাগন হাউজিং এপার্টমেন্টটি সেখানে কনের মাথার তাজের মতো চকচক করছে।
সীতেশবাবু সুযোগে নিজের বদান্যতার কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলেন না। আরে সেবার যখন দ্য প্যারাগন হাউজিং তোমাদের উঠাইয়া দেয়ার জন্য উইঠা পইরা লাগলো, আমিই সবাইরে ডাইকাডুইকা একসাথে কইরা এম পি সাবের কাছে লইয়া গিয়া কতো বুদ্ধি খাটাইয়া আটকাইলাম।
সেকি আর নিতেশ রবিদাস জানেনা? পৌরসভার নোটিশ পেয়ে কার কাছে না গিয়ে ধর্ণা দিয়েছে তারা। বৃটিশ আমল পার হয়ে পাকিস্তানি আমল, জয়বাংলা, কেউ তাদের উঠাতে চায়নি। ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে তাদের পরিবার। বাঁশের বেড়া দিয়ে খোপ খোপ বিভক্ত হয়েছে পরিবার। চামড়া সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে রংমিস্ত্রী, রিক্সা মিস্ত্রি, কতো পেশায় ছিড়িয়ে গেছে তারা। কিন্তু সন্ত ঋষি সন্তানদের উঠানোর চিন্তা করেনি কেউ। দ্য প্যারাগন হাউজিংই প্রথম এদের উৎখাতের প্রসঙ্গ উঠায়। কেউ তখন পাশে দাঁড়ায়নি একা বদরুল ছাড়া। তাও নিশীথের কারণে। সব জানা আছে নিতেশের। মনে আছে তখন আর কেউ এগিয়ে আসেনি।
এ নিয়ে সীতেশ বাবুর সাথে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। সে এসেছে তাঁরা এবার মা দুর্গার পূজা করবে এটা জানাতে।বাঙালি না হলেও দীর্ঘদিন এই বাঙালি সমাজে থেকে তারা মনেপ্রাণে বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহন করেছে। আর এ যেন সেই দুর্গোৎসব যেন শুরুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খেয়ে পরে সবাই ভালো আছে তাই উদ্বৃত্ত টাকায় শারদীয় ঊৎসবের আয়োজন।মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা।
সীতেশবাবু চুপ মেরে যাবার আগে একবার বলেন, তোরা কেনো এতো টাকা খরচ করবি? এতোগুলো বারোয়ারি মন্ডপ শহরে, যেখানে ইচ্ছা আইসা ফুলপাতার অঞ্জলি দিবি, পাত পেড়ে প্রসাদ খাবি। সে ও দমবার পাত্র নয়। সবাই মিলে মানত করেছে বাবু, মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবে। আপনি একটু দায়িত্ব নিয়ে যদি ব্যবস্থাটা করে দেন।
নিতেশ উঠে যাবার পরপরই সীতেশ বাবু সবাইকে ফোন লাগায় একে একে। হোমড়া চোমড়া নেতা মুরুব্বিদের। কেউই তেমন উচ্ছ্বাস দেখায় না। শহর পেরিয়ে প্রায় না শহরে এক ঋষি পট্টি। দু দশ ঘর রবিদাস। আশেপাশে আর কোন হিন্দু বসতি নেই। এরা করবে দেবি দুর্গার পূজা। এদের নিরাপত্তা দেবে কে, আর এই দুঃসাহস কে প্রশ্রয়ই বা দেয় কি করে! বিশাল খরচই বা যোগাবে কে।
প্রথম চোটেই পরস্পর ফোন পেয়ে সবাই বিব্রত হলেও পরে আর ঋষি পাড়ার যুবকদের উৎসাহে বাঁধা দেয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারেনা তারাও। যুগটা তো আর মুচিকে মুচি বলে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখানোর নয়। তবু এক অপ্রকাশ্য অসহযোগিতা জারি রাখে তারা। এখানেও পাশে দাঁড়ায় বদরুল। সাহস দিয়েও, ভরসা দিয়েও, অর্থ দিয়েও।যদিও স্থানীয় এম পি মহোদয় তখন তার কারণ খুঁজতে ভুলে গেছেন। কিন্তু যেখানে বদরুল ছায়ার মতো সেখানে কথা বলার কেউ নেই।
এরই মাঝে ঘটনাটা ঘটে। পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে মাতৃপক্ষে পড়তেই কে যেন মাটির প্রতিমার মাথা মুড়িয়ে ফেলে রেখে গেছে মণ্ডপের সামনে। টিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী মণ্ডপ।সামনে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। ঢোকা এবং ভাঙা খুব সহজ হলেও কে বা কারা পাড়ার এমন ভেতরে ঢোকে এমন কাজ করার সাহস করলো তারা ভেবে পায়না। বিশ্বাস ভরসা সব যেনো মাটির মূর্তির সাথে মাটিতে আহত রক্তাক্ত হয়ে শুয়ে থাকে। ঘরে ঘরে উৎসব থেমে যায়। তখনো পাশে দাঁড়ায় বদরুল।
শহরের সব হিন্দুরা সন্ত্রস্ত হয়। এ অশনি সংকেত। তাঁরা অদৃশ্য মায়ের চরণ উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠুকে। মা গো দয়া করো মা। রুষ্ট হয়োনা মা।
কেউ কেউ তাদের গালি দেয়,চামারের দল, কে বলেছিল পূজা করতে তোদের! কই এতোদিন তো শহরে এমন ঘটেনি। সাফ জানিয়ে দেয় আমরা তোদের সাথে নাই।
তারই জরুরি মিটিং আজ। এস পি স্যার ডেকেছে।
এলাকার সবাই নিরাপত্তা চায়। বদরুল ভাই এদের সাহস। নিশীথের অনুরোধে এককথায় রাজি হয়ে যায়। যাবে না মানে অবশ্যই যাবে।
মিটিং হয়। পূজার সিদ্ধান্ত হয়। পূজা হতেই হবে। সব নিরাপত্তা দেবে পুলিশ।
এস পি স্যার নিজে দশ হাজার টাকা ডোনেশান দেন। ডিসি স্যার খবর পাঠান তিনিও এল আর ফাণ্ড থেকে পঞ্চাশ হাজার দেবেন। তারা যেনো মন বেঁধে আবার আয়োজনে নামে। বদরুল ভাই নিজে দেন হাজার দশ, সংসদ মহোদয় দেবেন আরো পঞ্চাশ, এমন বার্তাও বয়ে নিয়ে আসেন। হ্যা নিশ্চিন্তে অন্যান্যবারের চেয়ে জমজমাট পূজা হবে এবার। খরচের টাকার জন্য ভাবতে হবেনা মোটেই।
মিটিংয়ের বাইরে অপেক্ষারত রবিদাসদের আনন্দ আর ধরেনা।
পশ্চিমাকাশে সূর্যের যখন চরাচর অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে যাবার আয়োজন তখন মিটিং থেকে শুধু একরাশ অবসাদ নিয়ে বের হয় নিশীথ রবিদাস। বদরুল ভাই সরাসরি দোষ দিচ্ছিলেন শহরের পয়সাওয়ালা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের। তারা চায়নি নিম্নবর্ণের হিন্দুরা পূজা করুক। তাই তারা এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে।
অথচ সে রাতে নিশীথ নিজ চোখে দেখেছে, আজ যে ছেলেগুলো বদরুল ভাইকে ঘিরে বসেছিলো তারা যখন মূর্তি ভাঙে তখন অদূরে দ্য প্যারাগন হাউজিংএর পরিচালক দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল।
বদরুল ভাই দলবলসমেত বাইরে আসে সিগারেট টানতে টানতে।অভিমানে কিংবা ক্ষোভে দূরে নিজেকে আড়াল করতে চায় নিশীথ।
স্বার্থের খতিয়ান
বদরুল সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মোড়ায় মিনিট খানেক। অসহায়ত্বে নাকি অক্ষমতায় বুঝা যায়না। চারদিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজে, নিশীথকেই কী? গত কয়েকদিন সংসদ সদস্য, দ্য প্যারাগন হাউজিং এর মালিকপক্ষ আর গ্রামের উঠতি এই যুবকদের চাপে তার মনে হচ্ছিলো, নিজের অসহায়ত্ব হয়তো নিশীথের মুখোমুখি প্রতিরোধের শক্তি হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু না, আজ সে বুঝলো তার একার শক্তি, ইচ্ছা, পক্ষপাতিত্ব কিংবা মতামত সব কতো তুচ্ছ স্বার্থের খতিয়ানে।

১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।