শিশুতোষ গল্প: রূপনগরের রাজকন্যে । সবিতা বিশ্বাস
“এলাটিং বেলাটিং সই লো
কিসের খবর আইলো
রাজামশায় রাজামশায়
একটি বালিকা চাইলো”
রূপনগরের সবুজ মাঠে যেন ফুলেদের মেলা বসেছে| সব খুকুরা কি সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরে মাঠময় ছোটাছুটি করছে।
রূপনগরের রাজামশায় দূর থেকে দেখে খুব আনন্দ পাচ্ছেন। অবাক হয়ে ভাবছেন এত সুন্দর সুন্দর কন্যে আমার দেশে আছে! তারপরেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, আমার ঘরে পাঁচ-পাঁচজন রাজপুত্র আছে ঠিকই তবু মন ভরেনা| ওই ছোট্ট প্রজাপতি ছাপা ফ্রক পরে দু-হাত মেলে যে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও যদি আমার কন্যে হত তবে খুব খুশি হতাম।
বালিকারা কেউ খেয়ালই করেনি রাজামশায় ছদ্মবেশে রাজ্যের প্রজাদের খোঁজ নিতে বেরিয়েছেন। হঠাৎ ওরা গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনতে পেল, “রাজামশাই প্রজাপতি কন্যাকে চাইলো।”
কি সর্বনাশ! সত্যিই কি উনি রাজা! যদি তিতলিকে ধরে নিয়ে যায় কি সর্বনাশই না হবে! তিতলি একা কি করে থাকবে? ওর মা-বাবা সবাই কেঁদে কেঁদে পাগল হয়ে যাবে যে!
রাজামশায় হুকুম দিলেন, প্রজাপতি কন্যে এলাটিং বেলাটিং বন্ধুদের নিয়ে রাজপ্রাসাদে যাবে। আজ থেকে ওখানেই থাকবে।
রাজার হুকুম বলে কথা! না গেলে কি করে চলবে? রাজবাড়িতে যত আদর যত্নই থাক না কেন, কেউ যেতে চায় না।সবাই বলে আমাদের কুঞ্জলতা দিয়ে ঘেরা মাটির ঘরই ভালো। কি জানি বাবা, রাজপ্রাসাদে হয়তো পাখির বাসা, খরগোশের গর্ত এসব কিছুই নেই। এসব না থাকলে বেঁচে থাকার মজাটাই তো মাটি হয়ে যাবে।
প্রজাপতি কন্যে বুঝল রাজামশায় মা, মামণি করে যখন ডাকছেন তখন নিশ্চয় ওদের ভয়ের কিছু নেই। এত করে সাধছেন যখন এই সুযোগে রাজপ্রাসাদ দেখা হয়ে যাবে। সকলেই বলে রানীমার নাকি এমন গায়ের রঙ, অন্ধকারেও গা থেকে আলোর জ্যোতি বের হয়| কথা বললে—কথা বললে যে কি হয় সে তো কেউ বলেনি। বলেনি তো বলেনি, তিতলি যখন যাচ্ছে সব দেখে শুনেই আসবে।
তারপরে সে যা একখানা কান্ড হল, রূপনগরের মানুষ কোনদিন এমন ঘটনা শোনেনি তো বটেই, দেখেওনি। প্রজাপতি কন্যা তিতলি আর ওর বন্ধুদের জন্য ষোলো বেহারার সোনার পালকি এল –
“হুম না- হুম না/ রাজবাড়িতে চলোনা/ হুম না- হুম না / না কথাটি বোলোনা
পেরজাপতি কন্যে / তোমায় খুঁজে হন্যে/ আর বিলম্ব কোরোনা/ কন্যে তুমি চলোনা।”
পালকির সাথে এসেছে বত্রিশ জন দাসী। তারা তিতলির চুল বেঁধে দিল, নতুন জামা পরিয়ে সাজিয়ে দিল।
“পরো পরো গো কন্যে
সাতনরী হার
হাতে পরো বাজুবন্ধ
পাঁচভরি ভার
সোনার ফিতে রুপোর কাঁটা
হীরে মোতির ফুল
কান জোড়া কানপাশা
দুলবে দোদুল দুল।”
দাসীরা প্রজাপতি কন্যাকে সাজাচ্ছে আর কন্যে হাউ হাউ করে কাঁদছে। কাঁদছে ওই সব ভারী ভারী গয়নার আঘাতে ব্যথা লাগছে তো! তাই প্রজাপতি কাঁদছে, কাঁদছে হাপুস নয়নে। কিন্তু দাসীরা কি সে কথা শোনে? রাজামশায় নির্দেশ দিয়েছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলে গর্দান যাবে যে!
“চোখের কাজল ধুয়ে বইলো
কাঠ-কয়লা নদী
তারই শোকে পাথর হল
মখমলের গদি।”
ওদিকে রাজবাড়ি হুলুস্থুল, কি কারণ? কারণ কি? অ’মা! তাও জানোনা! পাঁচ রাজপুত্তুরের বোন আসছে যে! বোন দেখার জন্য রাজপুত্তুররা খেলতে পর্যন্ত যায়নি। আর রানীমা মেয়েকে কোলে নেবেন বলে কোল পেতে বসে আছেন।
এদিকে প্রজাপতি আর ওর বন্ধুদের, মা-বাবাদের কান্নাকাটি, হল্লাহাটিতে বিস্তর দেরী হয়ে গেছে| পালকি কাঁধে নিয়ে ষোলো বেহারা দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, তাদের পা ব্যথা হয়ে গেল। তবু দাসীরা সব কন্যেদের পালকিতে তুলতে পারছেনা।
এদিকে সারাদিন তেতেপুড়ে সুয্যিঠাকুর সোহাগ নদীর জলে নাইতে নেমেছে| আর দেরী হলে পথ চলাই মুশকিল হবে। তাই দাসীরা সবাইকে ঠেলেঠুলে পালকিতে তুলে দিল।
এদিকে হয়েছে কি! ঠেলাঠেলিতে প্রজাপতির হাতের কংকন গিয়েছিল খুলে। প্রজাপতির খেলার সাথি অঙ্গিরা বেশ লোভী, ও কঙ্কন দেখেই হাতে পরে নিয়েছে। প্রজাপতি ভাবলো ভালোই হল, ওকে ভারী ভারী গয়নাগুলো দিয়ে দিই।
যেমন কথা, তেমন কাজ। তারপর পালকির দুলুনিতে তিতলি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। রাজবাড়িতে পৌঁছানোর পর যা শোরগোল হল তা আর বলার নয়। কেঁদে কেঁদে প্রজাপতির চোখের কাজল ধুয়ে সারা মুখ কালি হয়ে গেছে। এই যে রাজামশায়ের পছন্দ করা কন্যে তা আর বোঝার উপায় নেই| কেননা গায়ে এককুচি গয়না নেই।
রাজকুমারদের বোন দেখে পছন্দ হল না। তারা রাগ করে নিজেদের মহলে চলে গেল। রাণীমা দেখতে তো ভারী সুন্দর। কিন্তু গলা শুনলে ভয়ে বুক কাঁপে, সব মেয়েদের ভালো করে দেখে বললেন, এ কেমন কথা! কোনটি প্রজাপতি কন্যে সে তো বুঝতেই পারছি নে। রাজামশায়কে অন্দরে আসতে বলো, আমি তো মেয়ে কোলে নেব বলে কোল পেতেই রেখেছি।
অঙ্গিরা মনে মনে প্রার্থনা করছে ওকে যদি রাণীমা কোলে নেয় তবে খুব মজা হয়। ও হবে রাজকন্যা| এদিকে তিতলি সইদের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে ওর দিকে কারো নজর না পড়ে। অবশ্য নজর পড়লেও কেউ চিনতে পারবেনা, কেবল একজন দাসী খপ করে ওর হাত ধরে বলল, “আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। তুমিই প্রজাপতি কন্যে| চলো রানীমার কাছে চলো।”
কিন্তু দাসীর কপালে যে দুঃখু লেখা ছিল, রাণী বললেন, এই কেলে পেঁচি মেয়ে হবে রাজকন্যা? দাসীর মাথাটা একেবারেই গিয়েছে। যা, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা।”
দাসী ভাবছিল এক, হয়ে গেল অন্য। কোনো উপহার তো পেলই না, আবার রাণীমার হুকুমে রাতের খাবার বন্ধ হয়ে গেল।
তিতলি চুপিচুপি বলল, “মাসি তুমি মন খারাপ কোরোনা, আমার খাবার তোমায় দিয়ে দেব। একদিন রাতে না খেয়ে থাকলে আমার কিচ্ছু হবেনা।”
ও মা! কি ভালো মেয়ে গো! দাসীকে মাসি বলে ডাকছে, কথা নয় তো যেন মিহিদানার মিষ্টি। এ মেয়ে রাজকন্যে না হয়ে যায় না। রাজা-রাণী দু’জনেই বোকা তাই হীরে ফেলে কাঁচ কোলে নিয়ে বসে আছে। কাঁচে যখন হাত কাটবে তখন বুঝবে!
রাত পেরিয়ে সকাল হল, কিন্তু পাখির ডাক কানে এল না তো! সকাল হলেই তিতলিদের ঘরের সামনের রঙ্গন গাছে এক ঝাঁক টিয়া বসে গান শুনিয়ে তিতলির ঘুম ভাঙায়, “পেরজাপতি কন্যে ওগো চক্ষু মেলে চাও/ তোমার জন্য ফল এনেছি মুখটি ধুয়ে খাও।”
কি মজা! কি মজা! এক একদিন এক একরকমের ফল এনে পাখিরা তিতলিকে খেতে দেয়, তিতলি একটুখানি খেয়ে সবাইকে খাইয়ে দেয়।
কিন্তু আজ তো ওকে পাখিরা কেউ ডাকলো না, গান শোনালো না!
ভালো করে চোখ খুলে দেখল রাজবাড়িতে তিতলিরা সবাই মস্ত বড় একটা পালঙ্কে ঘুমোচ্ছিল। ওই জন্যই পাখিরা ডাকেনি।
তিতলি কাল রাতেই মন ঠিক করে নিয়েছে, কান্নাকাটি করে লাভ হবেনা, বরং বুদ্ধি করে এখান থেকে বের হতে হবে। অঙ্গিরা না গেলে যাবেনা, ওর বরাবরই খুব লোভ| ও থাকুক রাজকন্যা সেজে, এক গা মোটা মোটা গয়না পরে। ওসব সোনা-রুপো, হীরে-মতি তিতলির একদম ভালো লাগেনা। ওর ভালো লাগে বকুল ফুলের বালা, জুঁই ফুলের মালা| ফুলের কথা মনে পড়তেই ও কলঘরে গিয়ে ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে, মাথার পরে চুড়ো করে চুল বেঁধে, সাদা রংয়ের ফ্রক পরে বাগানের দিকে গেল। যাবার আগে একটা ফুল তোলার সাজি খুজল কিন্তু খুঁজলেই পাবে নাকি? সে তো ঠাকুরঘরে!
সে না পেল, না পেল। গন্ধরাজের পাতা দিয়ে সাজি বানিয়ে নেবে, কিন্তু বাগানটা কোনদিকে? কাউকে দেখতেও পাচ্ছেনা যে, জিজ্ঞাসা করবে!
হঠাত্ কে যেন সুরেলা গলায় বলল, “টুই-টুই।”
আরে! এই তো ছোট্ট টুনটুনি, ও নিশ্চয় বাগানে থাকে। তাই তিতলি ওকে ডেকে বলল, “টুই টুই করো কেন টুনি?/বাগানটা কোনদিকে শুনি/সাজি ভরে ফুল তুলে/গাঁথব মালা বেলি ফুলে।”
বেলি ফুল? টুনটুনি বলল, রাজার বাগানে ফুল কোথায় পাবে? মালিগুলো মহা পাজি/ জল দেয় না রোজ/ গাছেদের বড় দুঃখ/ কেউ রাখে না খোঁজ।”
আহা গো! এ কেমন বাগান! গাছ শুকিয়ে কাঠ, ফুল নেই, পাতা নেই| তাই পাখিও নেই। তিতলি ছোট্ট ছোট্ট হাতে জল ভর্তি চৌবাচ্চা থেকে একটা নারকেলের মালা দিয়ে জল দিচ্ছিল। তাই দেখে সেই দাসী তো অবাক! তাই তো সেও তো গাছে জল দিতে পারত! তাড়াতাড়ি করে বালতি নিয়ে এসে জল দিতে লাগল। দাসী মালিদের ভয় দেখালো, “আজ থেকে গাছের যত্ন না করলে রাণীমাকে বলে দেবে। অন্য লোকের গাছ থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে এসে ঠাকুরঘরে দিয়ে সারাদিন খাওয়া আর ঘুমানো, আর চলবেনা। রাণীমা এই খুকুকে পাঠিয়েছেন গাছেদের খবর নিতে| সব গাছ তোমাদের নামে নালিশ করেছে।”
একটা মোটা মালি হা-হা- করে হেসে বলল, “আরে তোমরা সবাই শোনো, এই পুঁচকি মেয়েটা বলে কি? ও বলছে গাছেরা নাকি আমাদের নামে নালিশ করেছে। আমাদের বোকা পেয়েছো খুকি? গাছেরা কি কথা বলতে পারে যে নালিশ করবে?”
এই কথা শুনে তিতলি বলল, “মালি কাকু তুমি হাসছ কেন? তোমার খুব জল তেষ্টা পেলে, খিদে পেলে যদি তোমাকে কেউ খেতে না দেয় তাহলে তোমার কষ্ট হয়না? তুমি তো গাছদের ভালোবাসোনা, তাই ওদের কান্না শুনতে পাচ্ছনা।তুমি ওদের রোজ সকাল বিকাল জল দিও, সার দিও দেখবে ওরা তোমার সাথে কত গল্প করবে, গান শোনাবে।”
অন্য মালিরা বলল, “ঠিক বলেছো খুকু, আমাদের যখন খিদে-তেষ্টা পায় তখন ওদেরও পায়। এই বাকুর কথা শুনে আমরা ঠিক করিনি| আজ থেকেই আমরা গাছেদের যত্ন করবো।”
দাসী তিতলিকে বলল, “রাজকন্যে চলো এবার খাবে চলো| তুমি তো রাতে তোমার খাবার আমাকে দিয়ে দিয়েছিলে। চলো আমি নিজের হাতে তোমাকে খাইয়ে দেবো।”
“মাসি আমাকে খাইয়ে দিও, কিন্তু আমি তো রাজকন্যা নই। তুমি আমাকে রাজকন্যা বলে ডেকোনা। আমার নাম তিতলি, তুমি আমাকে এই নাম ডেকো। কিন্তু আমি তো এখন খাবোনা, আগে স্নান করে ঠাকুরকে প্রণাম করবো, তবে খাবো। বাড়িতে ঠাম্মা যখন পুজো করে আমি সব গুছিয়ে দিই। এখানে কে পুজো করে?”
“এটা তো রাজবাড়ি, তাই পুরুত মশায় এসে পুজো করেন। তবে পেসাদের বেশিটাই পুরুত তার ঝোলায় পুরে নিয়ে যায়। রাণীমা তো সারাদিন পালঙ্কে বসে বসে সবাইকে হুকুম করেন। কিন্তু কেউ নিজের কাজ ঠিকমত করেনা।”
এদিকে তিতলি যখন মন্দিরে ঠাকুরের আরতি দেখছে, অঙ্গিরা তখন শ্বেতপাথরের টেবিলে বসে সোনার থালায় লুচি, মোহনভোগ খাচ্ছে। তিতলির অন্য বন্ধুরাও খাচ্ছে, তবে তারা লম্বা কাঠের টেবিলে বসেছে।
মহারাজ ও খেতে বসেছেন, তখন পুজো শেষ হয়েছে।
প্রজাপতি কন্যে পাথরের রেকাবি করে পেসাদ সাজিয়ে নিয়ে রাজামশায়কে দিয়ে বলল, “মহারাজ আগে ঠাকুরের পেসাদ খেয়ে তবে লুচি মোহনভোগ খান, বলে রাজামশায়ের মাথায় ফুল ছুইঁয়ে বলল, মঙ্গল হোক।”
কতদিন পরে রাজামশায়ের মায়ের কথা মনে পড়ল। মা এইভাবেই মাথায় ফুল ছুইঁয়ে বলতেন, “আমার বাছার মঙ্গল হোক।”
রাজা ভাবলেন, কে এই কন্যে? এই কি সেই, যাকে আমি মাঠে দেখেছিলাম!
ওদিকে অঙ্গিরা ভালো ভালো জিনিস পেয়ে কপাকপ করে খেয়েই যাচ্ছে। রাজামশায় তার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো!
ওদিকে রাণীমার খাস দাসী হিংসুটে মঙ্গলা রাণীর কানে কথাখানা তুলবে বলে রাণীমার পা টিপতে বসেছে, তখনই প্রজাপতি কন্যে রেকাবি করে পেসাদ এনে পেন্নাম করে বলল, “রাণীমা পেসাদ খেয়ে সরবতটুকু খেয়ে নিন। আপনি তরমুজের সরবত ভালবাসেন শুনে আমি নিজে হাতে বানিয়েছি।”
রাণীমা তাজ্জব! “তা হ্যাঁ রে মেয়ে তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে সাত-আট বছর বয়স। তা এইটুকুনি বয়সে তুই সরবত বানালি? ঠিক করে বল, কোনো দাসী করে দেয় নি তো! আমি আবার যার-তার হাতে খাই নে।”
তিতলি কিছু বলার আগেই অঙ্গিরা বলে উঠল, “ও তো পাকা মেয়ে, সব কাজ জানে। পড়াশোনাতেও সেরা, রূপনগরে আমাদের প্রজাপতির মত অমন কন্যে আর একটাও নেই। নাচতে পারে, গাইতে পারে, আবার ঠাকুরের ভোগও রান্না করতে পারে। খেয়ে দেখো, এমন সরবত তুমি কোনদিন খাওনি।”
তিতলি তখন পালাতে পারলে বাঁচে, বোকা অঙ্গিরা না সব কিছু ফাঁস করে দেয়। ওই ভারী ভারী গয়না পরে রাজবাড়িতে বন্দী হয়ে থাকবেনা কিছুতেই। বাইরে থেকে কমলা দাসী ডাকতেই তখনকার মত রক্ষা পেল।
কমলা নিজের হাতে তিতলিকে খাইয়ে দিল। তিতলির মনে হল যেন মায়ের হাতেই খাচ্ছে। ওদিকে রাজামশায়ের পাঁচ ছেলে পড়াশোনা করেনা, সবকটা নিরেট মুর্খ, সবসময় বন্ধুদের সাথে খেলায় মশগুল। আবার যুদ্ধ্ বিদ্যাতেও সব অষ্টরম্ভা। কেউ কিছু বললেই রাণীমা তাদের বলেন, ওরা হল রাজার ছেলে, চাষার ছেলে তো নয়। যা ধন সম্পদ আছে বসে খেলে সাত পুরুষেও ফুরবেনা। রাণীর বাজখাঁই গলা শুনলে চমকে উঠতে হয়। রাজামশায় চেষ্টা করলে কি হবে? তিনি তো বাইরের কাজ করেন, অন্দরের সব কিছু তো রাণীর। সেখানেই যত গলদ।
তিতলিও রাণীমার কাছে বিশেষ যায় না। তবে খাস দাসী তিতলির নামে যতই নিন্দে-মন্দ করুক, অঙ্গিরা খুব প্রশংসা করে। আগে তিতলিকে হিংসে করত, কিন্তু তিতলি অঙ্গিরাকে রাজকন্যার পদ দেওয়ায় আর একটুও নিন্দে করেনা।
রাজমহলের অন্দরে শুধুই তিতলির প্রশংসা। কন্যে বটে একখানা, বাগানে গেলে ফুলগাছ ওদের ডাল নামিয়ে দেয় যাতে তিতলি সাজি ভরে ফুল তুলতে পারে। মালিকাকুরা বলে, “তুমি সাক্ষাত মা সরস্বতী। যখন গাছেদের গান শোনাও তখন ওরা কত খুশি হয়।”
রাজামশায়ও একদিন চুপি চুপি এসে তিতলির গান শুনে গেছেন। বাগান দেখে তিনি তো বাক্যহারা। রাজামশায় বুঝেছেন, এ মেয়ের অন্তরে টলটল করে বইছে ভালবাসার সোহাগ নদী|। আহা, একেই যদি রাজকন্যে করতাম! তবে বড় ভালো হত। অঙ্গিরা মেয়েটি খারাপ নয় তবে প্রজাপতি কন্যের কাছে কিছুই নয়। মনে হয় রাতে চিনতে ভুল হয়েছিল।
তিতলির বন্ধুরা বেশ সুখেই আছে, এখানে কাজ করতে হয়না। ভালো ভালো খাবার্ খাওয়া যায়। শুধু তিতলির জোরাজুরিতে নিয়ম করে পন্ডিত মশায়ের কাছে পড়াশোনা করতে হয়, এছাড়া সবই ভালো।
বেশ কিছুদিন ধরে তিতলির রূপনগরের মানুষদের জন্যে, মা-বাবার জন্যে মন খারাপ করছিল| টুনটুনি খবর দিয়েছে ফসলের মাঠ, নদীর ঘাট, কুলতলির হাট সব্বার নাকি পেরজাপতি কন্যের জন্যে ভারী মন খারাপ| এমন হলে মাঠে ফসল ভালো হবেনা| না, না এ তিতলি হতে দেবেনা, রাজাকে বোঝাতে হবে এমন হলে রাজামশায়ের ক্ষতি| প্রজারা পেট ভরে না খেলে কি রাজার মঙ্গল হয়? তবে তিতলি কথা দিচ্ছে তিনদিন পরে ও নিশ্চয় ফিরে আসবে|
রাজামশায় বলেছিলেন চার বেহারার পালকি করে যাক, কিন্তু তিতলি কিছুতেই রাজি হলনা| পালকিতে করে গেলে ওর নদী বন্ধু, মাছ বন্ধু, গাছ বন্ধু ওদের আদর করবে কি করে? সবাই খুব দুঃখু পাবে| তিতলির অন্য বন্ধুরা গেলনা, আসলে রাজবাড়ির এমন আরাম ছেড়ে কি সবাই যেতে পারে?
এদিকে তিতলি রাজবাড়িতে না থাকায় সব্বার মন খারাপ| রাজামশায়ের খেয়ে পেট ভরছেনা, এমনকি রাণীমা পর্যন্ত বলছেন মেয়েটা চমত্কার শরবত বানায়| এই এলাটিং বেলাটিং সইগুলো কোনো কম্মের না| সব থেকে আশ্চর্যের ঘটনা হল পাঁচ রাজকুমারেরও মন খারাপ| কন্যের নিয়ম-কানুন খুব কড়া হলেও আমরা সবাই এই ক’দিনে অস্ত্রচালনা, ঘোড়ায় চড়া এমনকি পড়াশোনা পর্যন্ত শিখে গিয়েছি|
একথা শুনে রাজামশায় তাজ্জব! আরে এ মেয়ে আমার ছেলেদের পর্যন্ত বশ করে ফেলেছে| আসলে ওসব জাদু-টাদু কিছু নয়, পেরজাপতি রাজপুরীর জন্য কিছু আইন-কানুন লিখে রাজামশাইকে দিয়ে দস্তখত করিয়ে সব জায়গায় টাঙিয়ে দিয়েছে| তাতে লেখা আছে রূপনগরের পাশের চুপনগরের রাজামশাই নাকি চুপি চুপি তৈরী হচ্ছেন রূপনগরের ধন-সম্পদ, সুখ-শান্তি সব লুঠ করার জন্য| আসলে চুপনগরের অত্যাচারী রাজার ভয়ে নদী ছলাত ছলাত ঢেউ তোলেনা, পাখি গান গায়না, ফুল পুরো ফোটার আগেই ভয়ে ঝরে পড়ে| গুপ্তচরের কাছে খবর পেয়ে চুপনগরের রাজা হিংসেয় জ্বলে মরছে| কিন্তু সব কাজে সবাইকে জোর করে চুপ করিয়ে রাখলে সে রাজ্য কখনো সুখে থাকে?
কি কান্ড! কি কান্ড! চুপনগরের রাজকন্যার ফুটফুটে এক কন্যা হয়েছে, নতুন খেলনা পেয়ে যেইনা সে খিল-খিল করে হাসছে, তখনই রাজা বলেন, “হাসি? অকারণে এত হাসি কিসের?”
ব্যাস্ ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটির হাসি আধখানা হয়ে ঝুলে রইলো ঠোঁটে| এমন কত যে সর্বনেশে কান্ড ঘটছে চুপনগরের ঘরে ঘরে, তার আর ইয়ত্তা নেই|
রাজা নাতনির হাসি বন্ধ করাতে রানীমা খেপে লাল| বললেন, “নাতনির মুখের হাসি ফিরিয়ে দাও|”
এবার রাজা এমন অট্টহাসি হাসতে শুরু করলেন, তা শুনে শুধু নাতনি নয় রাজ্যের যত বাচ্চা ছিল সব ভ্যাঁ-ভ্যাঁ- করে কাঁদতে লাগলো| এ তো মহাবিপদ! এখন যদি রাজা বলেন ‘চোপ’! তাহলে তো কান্নাও আধখানা হয়ে ঝুলে থাকবে| তাহলে উপায়?
রাজবৈদ্য বললেন, এই দিলাম ঘৃতকুমারীর(অ্যালোভেরা) রস| কাঁদলেই মাথার তালুতে লাগিয়ে দেবে| সব বাচ্চা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাবে|
প্রথম প্রথম সবার মনে হয়েছিল, ভালোই হল| কাজকম্ম নিশ্চিন্ত মনে করবো, ওরা কেউ জ্বালাবেনা| পরে মনে হল, এরা তো দিনদিন কাদার তালের মত নরম হয়ে যাচ্ছে| ঘুম থেকে ওঠেনা, ছোটেনা, হাঁটেনা, মা বলে ডাকেনা| না, না আমাদের সোনাদের ঠিকঠাক মানুষ করে দাও|
সবার রাগ গিয়ে পড়ল রাজামশায়ের পরে|
এমন বদখত রাজার রাজ্যে আমরা থাকবনা | থাকুন আপনি আপনার রাজ্যপাট নিয়ে, আমরা চলে যাবো রূপনগরে|
ওরে বাবা! এসব সত্যি হলে তো ভারী মুশকিল!
জোছনারাতে পরীরানী যখন পদ্মপাতার পরে গা এলিয়ে পদ্মফুলের মধু খাচ্ছিল পেরজাপতি কন্যে গিয়ে চুপি চুপি বলল, তুমি কোনো উপায় বের না করলে দু-দুটো রূপকথার দেশ হারিয়্বে যাবে| তখন ঠাকুমা-দাদু কাদের নিয়ে গল্প বলবে?
পরীরানী বলল, “আমারও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তুই কি সত্যিই মনুষ্য কন্যা? নাকি কোনো দেবকন্যা ! তবে তুই একদম চিন্তা করিসনে, আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করবো| আমার ডানা দুটো চেপে ধরে বোস, তার আগে যাদুদন্ড ছুইঁয়ে তোকে সাজিয়ে দি| চোখ বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়া|
পেরজাপতি কন্যে যদি আয়নায় নিজেকে দেখত তাহলে নির্ঘাৎ ভির্মি খেত! দাঁত ফোকলা এক বুড়ি চলেছে চুপনগরের রাজপথ দিয়ে| কখনো বা অঞ্জনী নদীর পারে খঞ্জনী বাজিয়ে গান গাইছে| সেই মধুর গান শুনে নদীর সব মাছেরা ভীড় জমিয়েছে বুড়ি ঠাকুমার পায়ের কাছে| এমন আজব কান্ডের কথা চুপনগরে কখনো ঘটেনি| যেসব বাচ্চাদের কান্না-হাসি মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারা আবার খিলখিল করে হেসে উঠল|
সব থেকে আশ্চর্য ঘটনা হল রাণীমা, রাজামশায়, রাজপুত্র বৃদ্ধা ঠাকুরমাকে রাজপ্রাসাদে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথা থেকে এসেছ? এমন দুধে-আলতা গায়ের রঙ তোমার, সাদা শাড়িতে অপরূপা লাগছে| ছোট বয়সে না জানি কত সুন্দর ছিলে! তা ঠাকুমা তুমি এখানে কোথা থেকে এলে?”
“সে অনেকদূর, নাম ‘চির বসন্তপুর’, সেখান থেকে আসছি বাছা| আসতে আসতে এক পথিক তোমার রাজ্যের কথা বলল| তাই ভাবলাম একটু সৎ উপদেশ দিই, যদি শোন| যুদ্ধ করে লুটপাট করলে কতদিন চলবে, তার থেকে সবাই মিলে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে ভালো মানুষ হও| দেখবে, মনে শান্তি আসবে| এই যে রাজা, তোমায় বাপু একখানা কথা বলি, অত জোরে কেন কথা বলো? আস্তে করে কথা বললেও সবাই তোমার কথা শুনতে পাবে”|
রাজপুত্তুর একটা প্রশ্ন করার জন্য ছটফট করছে| ঠাকুমা একটু থামতেই বলল, “তুমি যদি চির বসন্তপুরের মানুষ হও তবে তুমি বুড়ো হলে কি করে?”
এইবার আমাদের তিতলি ঠাকুমা হেসে গড়িয়ে পড়ল, “বেশ তো বুদ্ধি আছে রাজকুমারের| আমি তো রূপ পাল্টে এসেছি, এত দূরের পথ, রাস্তায় কত বিপদ আপদ আসতে পারে, তাই তো ছদ্মবেশ ধারণ করেছি”|
রাজপুত্তুর শিখরকুমার বলল, “এখন তো এখানে কেউ নেই| তোমার আসল রূপ দেখাওনা ঠাকুমা|”
তিতলি দেখল, এই কথা বলে তো বিপদে পড়লাম, পরীরানীকে ডাকি| নাহলে ধরা পড়ে যাবো|”
পরীরাণী ভ্রমরের রূপ ধরে মাথার উপর দিয়ে চক্কর কাটছিল, তিতলি রাজামশায়, রাণীমাকে পেন্নাম করে রাজকুমারকে বলল, “তুমি বড় হও, তখন তোমার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে নিজের রূপে আসবো| এখন চোখ বন্ধ কর দেখি”- বলে হাতের ছোট্ট লাঠিটা সবার গায়ে বুলোতে সবাই ঘুমিয়ে পড়তেই পরীরাণীর পিঠে চেপে রূপনগরে ফিরে এল|
পেরজাপতি কন্যে এখন আর রাজবাড়িতে আটকে থাকেনা| মাঝে মাঝে মা-বাবাকে দেখতে যায়| রাজামশায় না করেন না, তবে দু’রাতের বেশি থাকার অনুমতি নেই| তিতলি না থাকলে নাকি রাজামশায়ের খেয়ে পেট ভরেনা, ঘুম আসেনা| আসলে রাজামশায় পালংকে শুলে পেরজাপতি কন্যে মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে গল্প শোনায়—
“সোহাগ নদীর পাড়ে
গাছগাছালির ধারে
রাজ্য ছিল রূপকথার
ফুল পাখির গল্পকথার
সেই রাজ্যের রাজামশায়
ছিল তাঁর বিষয়-আশয়
তবুও মনে দুঃখু তার
পাঁচ-পাঁচটি রাজকুমার
একটিও নেই কন্যা
প্রাণে দুঃখের বন্যা
তারপরে ঘটল যা-তা
জন্ম হল গল্প-গাঁথা
বকুলতলার হাটে
রূপনগরের মাঠে
ঘটল মজার কান্ড”—
এইটুকু বলতেই রাজামশায় ঘুমে কাদা, ফুরুত ফুরুত করে নাক ডাকলেই তিতলি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পুরো রাজবাড়ি টহল দিতে বের হয়| এখন কন্যে বেশ বড় হয়েছে তাই বারো হাত তাঁতের কাপড় পরে, কিন্তু অঙ্গিরা তো রাজকন্যে তাই সে ভারী ভারী বেনারসী শাড়ি পরে| কিন্তু তাকেও তিতলির কথা শুনে চলতে হয়| সেও হাতের কাজ, পড়াশোনা, মালা গাঁথা, ঘর গোছানো সব শিখেছে| কিন্তু এলাটিং বেলাটিং সইরা আর এখানে নেই| তাদের পড়তে ভালো লাগেনা, কাজ করতেও ভালো লাগেনা, তাই ওরা বাড়ি চলে গিয়েছে|
সেদিন যখন তিতলি সব ঘরে টহল দিচ্ছে তখন বড় রাজপুত্র তিতলিকে ডাকল, “কি ব্যাপার কাজে ফাঁকি দিচ্ছ কেন? সব ঘর টহল দিলে কিন্তু আমার ঘরে তো এলেনা”?
তিতলি ভালো করে গায়ে কাপড় টেনে নিয়ে বলল, “আমি তো দেখেছি আপনি পড়াশোনা করছিলেন| তাই ঢুকিনি, কিন্তু অন্য কুমাররা দুষ্টুমি করছিল তাই ওদের ঘরে গিয়ে বারণ করলাম”|
রাজকুমার বলল, “আমি যখনই তোমাকে দেখি, কিছু না কিছু কাজ করছ! তুমি নিজে কখন পড়ো?”
পাশের ঘর থেকে দল বেঁধে রাজকুমাররা এসে বলল, “তিতলি দিদিকে আমিও কোনদিন পড়তে দেখিনি| তবে গুরুমশাইয়ের কাছে সবার থেকে ভালো পড়া পারে”|
রাজকুমার গম্ভীর মুখে বলল, “তাহলে তো পিতাকে বলতে হচ্ছে, তোমার আদরের মা-টি সারা বাড়ি টহল দিচ্ছেন| আমাদের এই নতুন পাহারাদার ভালো| তাকেই নিয়োগ করুন”|
অন্য রাজকুমাররা আজ সুযোগ পেয়েছে তারা যার যা মনে আসছে কৌস্তভকুমারকে বলছে| ছোট কুন্তল কুমার বলল, “মেঘ ডাকলেই ময়ূরের সাথে দু’হাত ছড়িয়ে নাচ করে তিতলি দিদি| আমি বারণ করলেও শোনেনা| বলবে বৃষ্টিতে ভিজলে আমার কিচছ হবেনা|”
কৌস্তভকুমার খুব গম্ভীর হয়ে তিতলির হাত ধরে বলল, “তোরাই বল কি শাস্তি দেওয়া যায়?”
অরণিকুমার মেজো, সে বলল, “সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরবে, সন্ধ্যেবেলা ওস্তাদের কাছে গান গাইবে কিন্তু আমি যদি বলি গান শোনাতে, শোনাবে না। তিতলিকে একটা গান শোনাতে বলো।”
তিতলি অনেকক্ষণ চুপচাপ মাথা নীচু করে শুনছিল, এইবার হাত ছাড়িয়ে কোমরে আঁচল জড়িয়ে, পিঠ ভর্তি গোছাভরা চুল খোপা করে বড় রাজকুমারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা আমার নামে রাজামশায়ের কাছে নালিশ করবে? তার আগে আমি তোমাদের সবার নামে নালিশ করে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে আমার গ্রামে চলে যাবো। সবাই খুশি তো! এই আমি যাচ্ছি।”
তিতলিকে বড় রাজকুমার ডাকলে একবারও ফিরে তাকালো না| অন্যরা একে অন্যকে দোষ দিল, কাজটা খুব খারাপ হল| তিতলিদিদি না থাকলে ওদের কে কদবেল মেখে দেবে? আচার করে খাওয়াবে? অঙ্গিরা বোন কোনো কাজের নয়| কুন্তল বলল, তিতলি দিদির চোখ দেখেছিস? কি সুন্দর মায়া জড়ানো!
পেরজাপতি কন্যে কারো নামে নালিশ না করলেও সব কথা রাণীমার কানে গেছে। রাণীমার বড় ইচ্ছে তিতলির সাথে বড় রাজকুমারের বিয়ে দিয়ে রূপনগরের রাজবধূ করে আনে। এত বিচক্ষণ কন্যে রাজবধূ হবার উপযুক্ত। নাই বা হল রাজার মেয়ে, তাতে কি? রাজকুমারীদের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
তাই বলে ভেবোনা, রূপকথার বিয়ে বলে একুশ বছর হবার আগেই বিয়ে হবে| কক্ষনো না, তিতলি রানী এখন দিদিমনি। রূপনগরে একটা মেয়েদের স্কুল খুলেছে। সেখানে মেয়েরা সুর করে পড়ে—
“হোকনা সে গল্পকথা
কথাটা কিন্তু সত্যি
গাছ পাখিকে বাসবে ভালো
ভুলোনা এক রত্তি
বাড়ি ঘর সাফ রাখবে
মন থাকবে ভালো
ভালবাসবে মানুষজনে
ঘুচিয়ে মনের কালো”
রাজামশায় একদিন এসে তিতলি দিদিমণির স্কুল দেখে গিয়েছেন। আর রূপনগরের সব প্রজাদের আগাম নেমন্তন্ন করেছেন, একুশ বছর হলেই বড় রাজকুমারের সাথে পেরজাপতি কন্যের বিয়ে। সেদিন রাতে কন্যে চিনতে ভুল হয়েছিল বলেই তো সারাজীবন তিতলি রাজবধূ হয়ে থাকবে। নাহলে তো অঙ্গিরার মত চুপনগরের বউ হয়ে চলে যেতে হত।
সেজন্য লোকজন বলে, যা হয় তা ভালোর জন্যেই হয়। আমাদেরও ভালো হল। দু-দুটো নেমন্তন্ন পেয়ে গেলাম। কি মজা বলতো!
