উৎসব সংখ্যা গল্প: দোলনা । সাদিয়া সুলতানা

ঐ বাসাতে এত তাড়াতাড়ি কেউ উঠে যাবে-নিপা ভাবেনি। নিপা কেন, ঐ বাড়ির মালিকও কি ভেবেছিল? আর এদিকে টু-লেট বোর্ড ঝুলিয়ে এক সপ্তাহ পার হতে না হতেই কিনা ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’ লেখা ট্রাকে মালপত্র নিয়ে ভাড়াটিয়া এসে হাজির!

ট্রাকের ওপরের নীল রঙা পলিথিন সরে যেতেই একটা গোটানো সংসার চোখে পড়ে। উৎসুক নিপা দেখে একটা লাল প্রাইভেট কার থেকে কমলা রঙা শাড়ি পরিহিত একজন ভদ্রমহিলা নামছেন। বারান্দা থেকে দেখেই নিপা বুঝতে পারে ভদ্রমহিলার বয়স বেশি না। কলেজ পড়ুয়া মেয়েই বলা যায়। শাড়ি পরাতে একটু বয়স মনে হচ্ছে। মেয়েটা ট্রাকের সঙ্গে থাকা শ্রমিকদের লক্ষ্য করে হাতের ইশারায় কিছু বলছে। নিপা কান খাড়া করে, দোতলা থেকেও কিছু শোনার উপায় নেই, নিচুস্বরে কথা বলছে মেয়েটি। মেয়েটির পায়ে পায়ে ঘোরা কুকুরটিকে এবার চোখে পড়ে ওর।

‘এ আবার কোন আপদ!’ নিপা চোখ কপালে তোলে।

মালপত্র নামানো শুরু হয়েছে। শুরুতেই নিপার চোখ দোলনাতে আটকে যায়। একজন শ্রমিক শক্ত হাতে রাস্তায় দোলনাটা রাখতেই খটাং করে একটা শব্দ হয়। ‘ও কী রে! জিনিসপত্র এমন যা তা করে নামাতে আছে!’ নিপা আঁতকে ওঠে। জিনিসের মালিকের কোনো হুঁশ নেই, মেয়েটি ফোনে কার সঙ্গে যেন বকবক করেই চলছে আর কতক্ষণ পর পর মাথা ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করছে। ‘কী মানুষ রে! সংসারের জিনিসপত্র আছড়ে ফেলছে…কোনো চ্যাতভ্যাত নাই!’ নিপার রাগ হয়। পরক্ষণেই দোলনার দিকে চোখ পড়লে ওর মুখে প্রশান্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। কী সুন্দর দোলনা! যতক্ষণ দোলনাটা বাড়ির ভেতরে না ঢোকে ততক্ষণ নিপা বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাখে।

দিনের এই সময়টাতে হাতের কাজ সেরে নিপা বারান্দার মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে থাকে আর আয়েস করে র-চায়ের কাপে চুমুক দেয়। এই বিলাসিতাটুকু প্রতিদিন করে ও। চা খেয়ে দেওয়ালে হেলান দিলে ওম ওম আরাম লাগে। এই আরাম ভীষণ উপভোগ করে নিপা। কেবল দুধ চা খাওয়া হচ্ছে না বলে বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটু খচখচ করে। অনেক দিন হলো জাহাঙ্গীর দুধ চা খাওয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সংসারের বাড়তি খরচ ছেঁটে ফেলার আদেশ হয় প্রতিমাসে। এক্ষেত্রে প্রথমেই রান্নাঘরের ডিব্বাগুলোর দিকে জাহাঙ্গীরের চোখ যায়। কোনো সদাই বাড়ন্ত দেখলে মেজাজ চড়ে যায় তার।

ছেলেও বাবার মতো হয়েছে, মাঝেমাঝে বাবার চেয়ে এক কাঠি ওপরে থাকে সে। ফরিদাকে কাপড়ের বালতি হাতে বাথরুমে যেতে দেখলেই ক্লাস সিক্স পড়ুয়া অনি বলে, ‘খালা, ডিটারজেন্ট কম কম করে ব্যবহার করো, বাবা সেদিন বলেছে গাদি গাদি ডিটারজেন্ট ফুরাও তুমি, কাপড় পরিষ্কার হয় না।’ সেদিন ফরিদা খুব রেগে গিয়েছিল, আর কোনো বাড়িতে নাকি ওর পেছনে এভাবে কেউ লেগে থাকে না। নিপা এক মগ দুধ চা আর দুটো টোস্ট খেতে দিয়ে আদর করে ফরিদাকে বুঝিয়েছিল, ‘ছোট মানুষ, বাদ দাও ফরিদা।’

এমন করে বাবা আর ছেলের কথা বারবার বাদ দেয় নিপা। শুধু দুধ চা খাওয়ার ওপরে যেদিন নিষেধাজ্ঞা জারি হলো সেদিন নিপা একবারও বারান্দাতে বসেনি। কদিন এক কাপ চা-ও খায়নি। বেশি দিন পারেনি। নিপার পক্ষে চা খাওয়া বাদ দেওয়া সম্ভব না। চা বাদ দিলে আর একটা জিনিসই থাকে ওর জীবনে। সেটা ওর মনে লুকানো ভীষণ গোপন এক বাসনা। সেই বাসনা ক্রমাগত অলীক স্বপ্নের মতো দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিপার কপালের মতো ওর ভাগ্যও তো দেড় ইঞ্চি। যদিও নীপা বুঝতে পারছে না, আজ হুট করে সেই স্বপ্ন কেনই বা ফের হাতছানি দিলো। এই যে সামনের বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া এলো আর এসেই কিনা নিপার একেবারে নাকের ডগাতেই দোলনাটা ঝুলিয়ে দিলো! তবে এই ভাড়াটিয়া কদিন টেকে আর নিপার স্বপ্নও কবে মরীচিকার মতো মিলিয়ে যায়-তার তো কোনো ঠিক নেই।

নিপা জানে, ঐ বাড়িতে এখনও পুলিশের ঝামেলা মেটেনি। গতকালও বাড়িওয়ালার বাসায় পুলিশ এসেছিল। বাড়িওয়ালা নিচতলায় দুটো ফ্লাট মিলিয়ে থাকে। দুর্ঘটনার পর বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে সে লাপাত্তা হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর সেদিন বলছিল, পয়সাওয়ালা মানুষ পুলিশকে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলবে।

নিপা মালপত্রের মান আর পরিমাপ দেখে বুঝেছে, নতুন ভাড়াটিয়াও টাকা-পয়সাওয়ালা মানুষ। ট্রাক থেকে শৌখিন সব আসবাব নেমেছে, আজকাল বড় বড় শোরুমে যেমন তেঁতুল বিচি রঙা আসবাব দেখা যায় তেমন। আর দোলনাটার তো কোনো তুলনাই নেই। মনে হয় বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানানো হয়েছে।

নতুন ভাড়াটিয়ার দোলনাটা বেশ সুন্দর। স্টিলের দোলনা। স্ট্যান্ড লাগানো। পাশাপাশি দুজন মানুষ আরাম করে বসা যায়। বসার অংশে পিঠের দিকে ভারি নকশা করা। দেখে চোখে ঘোর লেগে যায়। ঐ বাসায় ভাড়াটিয়া আসার পর নিপার বারান্দায় থাকার সময়কাল বেড়েছে। কেবল গৃহস্থালি কাজ শেষ করে যে নিপা বারান্দায় বসে থাকে তা না, কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে ও দোলনাটাকে এক নজর দেখে যায়। তবে সারাদিনই দোলনায় একটা কুকুর ছাড়া অন্য কাউকে বসে থাকতে দেখা যায় না।

ভারি অদ্ভুত! নিপা ভাবে, কুকুরই যদি বসবে তবে বাড়িতে অত বড় আর নকশাদার দোলনা রাখার কী দরকার ছিল! আর রাস্তার কুকুরেরও সেই কী ঢং! দোলনাতে পা টান টান করে লম্বা হয়ে শুয়ে বা আয়েস করে বসে ঝিমায় সারাদিন। গোবদা স্বাস্থ্যের ধাড়ি কুকুরটার সঙ্গে কোথায় যেন তন্বীর খুব মিল খুঁজে পায় নিপা।

নিপাদের তিলপা পাড়ার বাসার প্রতিবেশী ছিল তন্বী। তন্বীর বাবা সরকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা ছিল। ওদের বাড়ির সামনের বাগানে একটা ছাতার মতো গোল মাথার গাছের নিচে একটা দোলনা বসানো ছিল। বেশ বড়, লোহার পাতের তৈরি দোলনা। পাশাপাশি দুজনও বসা যায়। কিন্তু তন্বী কখনো নিপাকে বসতে দিতো না। বিকালে ঐ বাড়ির গেট খোলা পেলে নিপা বাগানের ভেতরে ঢুকে যেতো। যখনই যাক না কেন বাগানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটাতে একঘেয়ে একটা দৃশ্য দেখা যেতো। নিপা লোভী চোখে দেখতো গোবদাগাবদা শরীরের তন্বী দোলনা জুড়ে বসে আছে আর হাই তুলছে। দোলনার কাছে দাঁড়ানো নিপাকে হয়তো ভিখিরির মতো দেখাতো। তবু নিপা দাঁড়িয়েই থাকতো। এক-আধ দিন তন্বী ওকে দোলনা ঠেলে দোল দিতে ইশারা করতো, এতেই নিপা বর্তে যেতো।

একদিন বিকালে দোলনাটাকে ফাঁকা দেখে নিপা ভীষণ খুশি হয়েছিল। পা টেনে টেনে দোলনার কাছে হাজির হতেই তন্বীর বড় ভাই আনন্দ এসে নিপাকে বলেছিল, ‘আয় বোস, আমি ধাক্কা দিচ্ছি।’ নিপা হ্যাংলার মতো অনেকক্ষণ দোল খেয়েছিল সেদিন, ফেরার সময় আনন্দ ওর শিশুস্তন দুহাতের আঙুল দিয়ে মুচড়ে দিতে দিতে বলেছিল, ‘আবার আসবি কিন্তু।’

আর যাবে না যাবে না করেও নিপা দোলনার আকর্ষণে তন্বীদের বাড়িতে যেতো। আনন্দের কথা ও কাউকে বলেনি। তারপর একদিন তন্বীর বাবা বদলি হয়ে গেলো। তন্বীরা যেদিন ওদের পাড়া ছেড়ে চলে গেলো, সেদিন বাড়ি ফিরে নিপা খুব কেঁদেছিল। পরের মাসে নতুন একজন কর্মকর্তা এসে তন্বীর দোলনার জায়গায় সবজি বাগান তৈরি করেছিলেন। নিপা আর কোনোদিন ঐ বাড়িতে যায়নি।

আজ পর্যন্ত নিপার নিজের একটা দোলনা হয়নি। বিয়ের পর জাহাঙ্গীরকে একবার বলেছিল এই শখের কথা। বারান্দায় দোলনা ঝোলানোর আবদার শুনে বিচ্ছিরি করে হেসে জাহাঙ্গীর বলেছিল, ‘খরচের নতুন বাহানা! আর কচি মেয়েদের মতো দোলনায় দোলার বয়স আছে তোমার? যত্তসব আদিখ্যেতা।’ চায়ের তপ্ত চুমুকের সঙ্গে সেদিন সব শ্লেষ হজম করেছিল নিপা। রাতভর ঘুমায়নি, কেঁদেছে। কোনোদিন আর মুখ ফুটে দোলনা শব্দটা উচ্চারণ করেনি। যদিও নিপার বুকের ভেতরে থাকা একরত্তি নির্লজ্জ শখটা সুযোগ পেলেই দুল দুল করে নেচে ওঠে।

নিপা চায়ে চুমুক দিতে দিতে মুখোমুখি দোতলা বাড়ির বারান্দায় তাকায়। মেয়েটা ওকে দেখে মুচকি হাসে। নিপাই প্রথম কথা বলে, ‘ভালো আছেন?’

‘এই তো, একা বাসায় যতোটা ভালো থাকা যায় ততোটা, আপনি?’

‘আমিও একা। ছেলের স্কুল, কোচিং, সারাদিন বলতে গেলে বাসায় থাকে না।’

‘আচ্ছা।’

‘আপা, আপনার দোলনাটা খুব সুন্দর।’

‘বাসায় আসবেন, দোলনায় দুলতে দুলতে চা খাওয়া যাবে।’

সেই থেকে শুরু। রাস্তামুখো দুই বারান্দার খাঁচায় বন্দি থাকা মানুষ দুজন কাছাকাছি চলে আসে। নিপার সঙ্গে মেহেরার ভীষণ ভাব এখন। প্রথম আলাপেই আপন করে নেওয়ার মতো মানুষ মেহেরা। মেহেরার আন্তরিকতা তো আছেই, অন্য এক আকর্ষণও নিপাকে ঐ বাসার দিকে টেনে নেয়। যদিও এতদিন হয়ে গেল দোলনাতে আজও বসা হয়ে ওঠেনি ওর। নিপা আকারে-ইঙ্গিতে নিজের দোলনা প্রীতির কথা জানালেও মেহেরা একবারও বলেনি, ‘চলো আপু দোলনায় বসি।’

প্রতিদিনই নানা গল্পের সূত্র ধরে মেহেরা দোলনার কথা বেমালুম ভুলে যায়। নিজের ভেতরে পুষে রাখা গোপন স্বপ্নটি অন্যের কাছে গুরুত্বহীন হতে দেখলে এই বয়সে আর কতটা হ্যাংলা হওয়া যায়! নিপা মুখ ফুটে তাই কিছু বলে না। শুধু এক অদৃশ্য টানে বারবার ঐ বাসায় যায়।

মেহেরার বাসার বারান্দায় দাঁড়ালে একই দৃশ্য চোখে পড়ে। গাবদাগোবদা কুড়ো তন্বীর মতো দোলনা জুড়ে বসে আছে আর ঘনঘন হাই তুলছে। নামটাও একেবারে যথাযথ ওর, ‘কুড়ো।’ কুড়োকে দোলনায় বসা দেখলে নিপার রাগ হতে থাকে। রাগটা গিয়ে পড়ে মেহেরার ওপর, ও ভেবে পায় না, রাস্তার প্রাণীকে নিয়ে এত আদিখ্যেতার কী আছে? কিন্তু মেহেরা এত মিশুক আর অমায়িক যে ওর ওপর সামান্য অভিমানও করা যায় না। দুবছর হলো মেহেরার বিয়ের। বিয়ের পর পরই ওর স্বামী ইতালি চলে গেছে। মেহেরার সঙ্গে ওর ভাই থাকে, এখানেই একটা কলেজে পড়ে। সারাদিন মেহেরার সঙ্গী থাকে কুড়ো আর মুখোমুখি বারান্দার নিপা। বাসায় যাওয়া আসা না হলেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুজনে খানিকটা গল্প সেরে নেয়।

‘আজ কী রাঁধলেন আপা?’

‘যা রেঁধেছি, জোরে বলা যাবে না। হাহাহা।’

‘বলেন না। আমিই বা এমন কী খাই। আপনার রান্নার পদের নাম শুনলেই মায়ের কথা মনে পড়ে।’

‘রুই মাছের ডিম আলু কুচি দিয়ে ভাজি করেছি আর পুঁইশাকের ডগা দিয়ে রুই মাছের মুড়ো রেঁধেছি।’

‘ইস মা করতো মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক। খুব মজা।’

‘তোমাকে একটু দিয়ে পাঠাই? অনি আসুক।’

কোনো কোনোদিন নিপাই দোলনার প্রসঙ্গ তোলে।

‘তুমি দোলনায় বসো না?’

‘না, ভালো লাগে না। আর দ্যাখো না আপু, কুড়োর সিংহাসন ওটা। ওকে জ্বালাই না।’

কুড়োর নাম শুনে নিপার ভ্রু কুঁচকে যায়। মাঝখানের পঁচিশ ফুট রাস্তা ডিঙিয়ে মেহেরা মাঝেমাঝে কুড়োকে নিয়ে এ বাসায় চলে আসে। আজও এসেছে।

নিপা বলবে না বলবে না করেও আজ মেহেরাকে কথাটা বলে ফেলে, ‘মেহেরা, শখ করে বাড়িতে কুকুর রাখা ঠিক না, রহমতের ফেরেশতারা ঢোকে না। জানো তো বিনা কারণে কুকুর পুষলে প্রতিদিন দুই কিরাত পরিমাণ নেকি কমে যায়।’

নিপা নিরুত্তর মেহেরার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘এক কিরাতের পরিমাণ জানো?’

মেহেরা না-সূচক মাথা নাড়ে।

‘এক কিরাত মানে উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ। তাহলে তোমার নেকি কিছু থাকে বলো?’

নিপার কথা শুনে মেহেরা হাসিতে ভেঙে পড়ে, ‘আপা, তুমিও এ কথা বলছো! আমার শাশুড়ি মা ফোন করে এই কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিলো।’

‘মুরুব্বিদের কথা ফেলনা না বুঝেছো। ওকে বাড়িতে আর রেখো না, বিষয়টা অস্বাস্থ্যকরও। কদিন পর তোমার বাচ্চাকাচ্চা হবে, ওদের অসুখ-বিসুখ করবে। তারচেয়ে ভালো এখনই ওকে অন্য কোথাও রেখে এসো। আমাদের এদিকে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি আসে।’

কুড়ো নিপার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে মুনিবের পায়ের কাছে এসে শরীর ভাঁজ করে শুয়ে পড়ে। দুহাতে কুড়োর মাথায় আদর করতে করতে মেহেরা ঠোঁট ফুলানোর ভঙ্গি করে বলে, ‘বাদ দাও আপু, আমার কুড়ো মন খারাপ করছে দ্যাখো। তুমি ওকে কী খেতে দেবে দাও।’

সেদিনের পর দুজনের মাঝখানের সুরটা সামান্য কেটে যায়। নিপা বারান্দায় গেলেই দেখে দোলনাটা বিনা বাতাসে দুলছে আর তাতে বসে কুড়ো হাই তুলছে। রোজ মেহেরাও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কথার চেয়ে ওদের মধ্যে হাসির আদানপ্রদানই বেশি হয়। চা খেতে খেতে নিপা আগের মতো টুকটাক গল্প করার চেষ্টা করে। গল্প জমতে জমতে আবার সুরতাল কেটে যায়।

নিপা বলে, ‘তোমার দোলনাটা কিন্তু বেশ। তোমাকে অবশ্য কোনোদিন বসতে দেখলাম না। ও কি কুড়োর জন্যই বানানো?’

শুনে মেহেরা সশব্দে হাসে।

‘আরে না, তোমাকে তো বলেছি আপু এ আমার হাজবেন্ডের খুব পছন্দের জিনিস। বিয়ের পর শখ করে কিনেছে। বলতো, বিকালে দুজনে বসে চা-কফি খাবো। কদিন আর চা-কফি খাওয়ার সুযোগ পেলাম বলো।’

নিপা নিভে যায়। জাহাঙ্গীরের নির্লিপ্ত চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একদিন কী হয় নিপা চাপা স্বরে বলে ফেলে, ‘মেহেরা তোমার সঙ্গে কথা আছে, আসবে?’

দুজনের জন্য সেদিন দুধ চা করে নিপা। দুধের বলক ওঠা দেখতে দেখতে বুকের ভেতরটা ফুলেফেঁপে ওঠে নিপার। মাসের শুরু, এক-আধ কাপ দুধ চা খেলে কে আর দেখতে যাচ্ছে। বাবার চর অনি বাড়িতে নেই, কোচিংয়ে। টমেটো, ধনে পাতা, সরিষার তেল আর লাল-সবুজ কান ধরা ঝাল কাঁচামরিচ কুঁচি দিয়ে চানাচুর মাখিয়েছে নিপা। খেতে খেতে ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকায় আর হাসে। ঝালের দমকে মেহেরার চোখে পানি চলে আসে। আজ কুড়োকে নিয়ে আসেনি মেহেরা।

‘কী যেন বলবে বলছিলে আপু।’

‘হুম। মাস তিন তো হয়ে গেলো। তোমাকে বলিনি আমি কথাটা। তুমি আবার কী মনে করো।’

‘কী কথা আপু? বলে ফেলো। কী মনে করবো।’’

‘কেউ তোমাকে এতদিনেও বলেনি বিষয়টা? আশ্চর্য!’

‘কী বলবে বলো তো?’

‘আরে তোমার বাসায় তুমি আসার আগে যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটা।’

‘কী ঘটেছিল? আসলে আমি তো তুমি ছাড়া আশেপাশের কারও সঙ্গে মিশি না। বাসায় একা থাকি কোথাও যাওয়াও হয় না।’

‘তোমার বাসায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। তুমি যে মাসে এলে তার আগের মাসেই।’

মেহেরা এবার চুপ হয়ে যায়। নিপা যখন কিছু বলতে যাবে তখনই ও বলে, ‘বুঝেছি আপু, আগের ভাড়াটিয়ার কথা বলবে তো। উনাদের একটা মেয়ে মারা গিয়েছিল। শুনেছি। আমার ভাই প্রান্ত বাইরে থেকে শুনে এসেছিল।’

নিপার শ্বাস ভারি হয়ে আসে। রহস্যঘন কণ্ঠে নিপা বলে, ‘আরে শুধু মারা গেলে তো হতোই। আমার নিজের চোখে দেখা, তোমার শোবার ঘর যেটা করেছ সেই ঘরেরই ঘটনা, মেয়েটা সিলিংফ্যানের সঙ্গে ঝুলেছিল। ওইটুকুন একটা মেয়ে, আমার অনির সমান লম্বা, ক্লাস নাইনে পড়ে। খাটের ওপরে টুল নিয়ে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে ফাঁস নিয়েছে। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে তো। সারাদিন বারান্দায় হাঁটতো আর ফোনে গুটুরগুটুর করে কথা বলতো। তারপর বাবার সঙ্গে একদিন ঝগড়া করে এই কা- ঘটালো। কী সাহস বলো! একেবারে গলায় ফাঁস নিয়ে নিলো! আমি বারান্দা থেকে ছবি তুলেছিলাম, লাশ ঝুলছে, দেখবে?’

মেহেরার মুখের রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ। ও কোনো কথা খুঁজে পায় না। চায়ের কাপ টেবিলে ঠেলে দিয়ে বেপরোয়া কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘না আপু দেখবো না। এসব কেউ বলেনি আমাকে। বাড়িওয়ালাও বলেনি।’

‘বাড়িওয়ালা বলবে কী, সে সবাইকে বলতে নিষেধ করেছিল। আমার সঙ্গে তোমার খাতির দেখে একদিন আমাদের বাসায় এসেও নিষেধ করে গেছে। আমি ভাবলাম, তুমি কার না কার কাছ থেকে শুনে পরে আমাকে দোষ দিবে আর আমাকে ভুল বুঝবে যে আমি আগে জানালাম না।’

মেহেরা খানিকটা ধাতস্থ হয়। জোর করে হাসে।

‘আরে ব্যাপার না। আমার সঙ্গে কুড়ো আছে না? দিব্যি তো আছি। বাসাটা বেশ ভালো কিন্তু। তিন তিনটা বারান্দা, আমার খোলামেলা বাসা খুব ভালো লাগে।’

‘আমারও। জানো এর আগে যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, একটাও বারান্দা ছিল না। এ বাসার বারান্দা খুব প্রিয় আমার। শুধু বারান্দা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একটা দোলনা থাকলে বেশ হতো। আমার একটা দোলনার এত শখ!’

‘একটা দোলনা কিনে ফেল না কেন আপু।’

‘এই তো কিনবো। অনির বাবা বলেছে এবারের বিবাহবার্ষিকীতে আমাকে উপহার দেবে।’

কথাটা বলে স্বস্তি পায় না নিপা। উঠে দাঁড়ায়। অস্বস্তি কাটাতে আড্ডা ভেঙে দেয়, ‘মেহেরা আমি রান্নাঘরে ঢুকবো এবার। অনি চলে আসবে এখনই।’

পরের মাসে মেহেরা বাসা ছেড়ে দেয়। যাওয়ার আগের দিন বিকালে নিপাকে বারান্দায় দেখে হাত নেড়েছিল মেহেরা। নিপা সেদিনও ভ্রু কুঁচকে দোলনায় ঝুলন্ত বাদামি রঙের কুড়োকে দেখছিল আর ভাবছিল, নিপার অমন একটা দোলনা থাকলে কিছুতেই ওসব কুত্তা-বিলাইকে উঠতে দিতো না।

মেহেরার হাতছানিতে বিরক্তি চেপে এগিয়ে গিয়েছিল নিপা।

‘কী গো কদিন দেখা নেই। শরীর খারাপ নাকি?’

‘না আপু এই তো, বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।’

‘সে কী! জানালে না যে কিছু!’

বলতে বলতে বারান্দার দোলনাটার দিকে চোখ পড়ে নিপার বুক মুচড়ে ওঠে।

পরের দিন সকালে মেহেরার বাসার মালপত্র ট্রাকে তোলা শেষ হলে শূন্য বারান্দার দিকে তাকিয়ে নিপার দুচোখ পানিতে ভরে যায়। এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে জায়গাটা! কেউ যেন ভেজা কাপড় দিয়ে স্বর্গীয় একটা ছবি ঘষেমেজে তুলে নিয়েছে। নিপা টের পায়, অনেক অনেক দিনের গোপন এক আনন্দঅনুভব এক ফুঁতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

দিন পনেরো পরে ঐ বাড়ির সামনে মালভর্তি ট্রাক দেখে নিপা চমকে ওঠে। ওর বুকের ভেতরে ভালো লাগা আর শংকার মিশ্র অনুভব দোলনার মতো দুল দুল করে দুলতে থাকে। ট্রাক থেকে একে একে সব জিনিস না নামা পর্যন্ত বারান্দায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে নিপা।

সাদিয়া সুলতানা