আজ ৩১ অক্টোবর কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক সাইফ বরকতুল্লাহ’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
বনানী স্ট্যান্ড। এখানে দাঁড়াতেই বাসে উঠল সাত আটজন যাত্রী। লোকাল বাস। মাঝারি সাইজের। অনেক যাত্রী। সবাই যার যার মতো বসা। বাসের ভেতরে যাত্রীদের কথোপকথন। সাত/আটজন যাত্রীর মধ্যে একজন তরুণী। বয়স হবে তেত্রিশ কী চৌত্রিশ। বাসে বসার মতো কোনো সিট ফাঁকা নেই। সব ফিলাপ।
বাসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দাঁড়াতেই ড্রাইভার মুকিত বলল, এখানে সিট (ড্রাইভারের ঠিক পেছনের অংশের সিট) ডাউন, প্লিজ। তরুণী বসল। হাতে মেরুন রংয়ের হ্যান্ডব্যাগ। স্মার্ট। গায়ে দামী থ্রিপিছ।
বাস যখন ছাড়ল ড্রাইভারের মাথার ফ্যানটা ঘুরছিল। ফ্যানের বাতাসে তরুণীর মাথার চুল হালকা নড়াচড়া করছে। এ সময় মাথা থেকে সুগন্ধীর সুবাস নাকে আসছে মুকিতের। গাড়ি যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। শরতের রাতে আকাশে অনেক তারা। বাস যখন বিশ্বরোড অতিক্রম করল তখন মুকিত তরুণীকে জিজ্ঞেস করল
-হয়ার ইউ গোয়িং ?
-জসিমউদ্দীন (উত্তরার একটি এলাকা)।
-এই কামরান (বাসের কনডাক্টর), ম্যাডাম…রে ফাঁকা হলে বসায়া দিস।
-ওকে বস।
তরুণীকে আবার জিজ্ঞাসা
-আর ইউ ডোয়িং জব ?
– ইয়েস।
-নাইস।
-থ্যাংকস।
রাতের রাস্তা। কখনো জ্যাম, কখনো ফাঁকা। বাস যাচ্ছে। ড্রাইভারের ইংরেজিতে কথাবার্তায় কিছুটা বিস্মিত তরুণী। এই শহরে প্রায় সাত/আট বছর হয়ে গেল, প্রতিদিনই বাসে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু এই ড্রাইভারের মতো এ রকম স্মার্ট ছেলে, আবার যাত্রীদের সঙ্গে ইংরেজিতে স্পিকিং করে, তরুণী খুব কমই দেখেছে। ভাবতে ভাবতে দীপিকা (তরুণী) বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। শরতের রাতে বাতাস এসে দীপিকার চোখে, মুখে অনুভব হতেই শীতল হয়ে গেল। বাস যাচ্ছে।
রাত তখন প্রায় বারোটার কাছাকাছি। জসিমউদ্দীন নেমে রিকশায় বাসায় পৌঁছাল দীপিকা। বাসায় রুমে ঢুকতেই মা রেহনুমা চৌধুরী বলল, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস, আমি শুয়ে পড়লাম।
মা, দুই বোন নিয়ে দীপিকা থাকেন জসিমউদ্দীন রোডে ভাড়া বাসায়। বাবা থাকেন সুইডেনে। ছোট্ট সংসার। প্রায় সাত বছর আগে বাবা আদম ব্যাপারী সুইডেনে যান। সেখানে সে দেশের একটি কনসালটেন্সি ফার্মে চাকরি করেন। দুই বছর পরপর দুই মাসের ছুটিতে ঢাকায় আসেন। মাত্র ছয় মাস আগেই তিনি ছুটি শেষে আবারও সুইডেনে ফিরেছেন। এই ছুটিতে দীপিকাদের নিয়ে কী মজার সময় কেটেছে, তা মনে পড়লেই দীপিকার ডায়েরির পাতায় চোখ চলে যায়। মা শুয়ে পড়েছেন। দীপিকা ফ্রেশ হয়ে অল্প খেয়ে (ভাত, কচুশাক, গুঁড়ামাছ তরকারি) নিজের রুমে শুয়ে পড়ল। রুমে ড্রিম লাইট জ্বালানো। স্লো মোশনে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। পুবদিকের জানালার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎ¯œার আলো তার শরীর দেখা যাচ্ছে। সেলফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুক লগইন করতেই ওই বাস ড্রাইভারের ইংরেজি কথোপকথনের কথা মনে পড়ে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে তখন জ্যোৎস্নার আলোর সাথে হালকা বাতাস দীপিকার শরীর, মন আনমনে করে দিল। সে ততক্ষণে ঘুমের রাজ্যে।
রাত দেড়টার মতো। সব যাত্রী নামিয়ে দিয়ে বাস গ্যারেজে রেখে হেল্পারকে পরিষ্কার করতে বলল মুকিত। পরিষ্কার শুরু করলে বাসায় চলে যায় সে।
সূর্য তখন পুরোপুরি ওঠেনি। আজ সকালটা অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মুকিতের। গতরাতে ঘুম ঘুম ভাব হলে ভুল করে অ্যালার্মটা পাঁচটায় দিয়ে রাখে। সকাল যখন সাতটা তখন চলে এলো গ্যারেজে। বাস নিয়ে প্রতিদিনের মতো শুরু হলো দিন। বাস যাচ্ছে গুলিস্তানের উদ্দেশে।
বাসে যাত্রী কথোপকথন (এক)।
তরুণ : এখানে বস বস বস…
তরুণী : বসেন।
তরুণ : যে জ্যাম, কতক্ষণ যে লাগে যেতে…
তরুণী : ব্যাগ থেকে বের করে হাতে কেক নিয়ে বলে খান..
তরুণ : না না, আমি খেয়ে এসেছি (বলার পর এক টুকরো নিয়ে খাইতে শুরু করেন)।
তরুণী : অফিস কী চেঞ্জ হবে?
তরুণ : তোমার বাসা কোথায়?
তরুণী : গাবতলী।
তরুণ : জ্যাম এলাকা।
বাসে যাত্রী কথোপকথন (দুই)।
হেল্পারের কাছে জিজ্ঞাসা করল হাবিব- ভাই একটু টেনে চালাও। এত লোকাল হলে হয়? ভাড়া নেয়ার সময় কইল ডাইরেক্ট। তখন মুচকি হেসে হেল্পার করিম জানালেন, চান্স পাইছি, লইয়া লইছি যাত্রী। সক্কাল সক্কাল খালি আছিল। জ্যাম না থাকলে তাড়াতাড়ি গুলিস্তান যাইবেন।
বাস যাচ্ছে। কারওয়ানবাজার পৌঁছলে কন্ডাক্টর ডাকাডাকি শুরু করে…গুলিস্তান, গুলিস্তান…। কয়েকজন ছাত্র ওঠে বাসে। ভাড়া চায় কন্ডাক্টর। ছাত্ররা পাঁচ টাকা করে দেয়।
কন্ডাক্টর : আরো পাঁচ টেকা দেন।
ছাত্র : কারওয়ান বাজার থেকে উঠেছি। শাহবাগ নামবো।
কন্ডাক্টর : আরো পাঁচ টেকা দেন।
ছাত্র : আমরা স্টুডেন্ট।
কন্ডাক্টর : এই বাসে স্টুডেন্ট ভাড়া নাই।
ছাত্র : এটা…না লোকাল বাস?
বাস যাচ্ছে। শাহবাগ পৌঁছালে ওরা বাস থেকে নেমে গেল। বাস যাচ্ছে। আকাশে সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে। কন্ডাক্টর ও মুকিত গুলিস্তানে বাস স্ট্যান্ডে রেখে হোটেলে খেতে গেল।
ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। কিছুদিন নানাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে। এসএসসি পাসের পর নানি মারা গেলে পাশের বাড়ির এক ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসে মুকিত। এরপর মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে প্রথমে গ্যারেজে কাজ নেয়। কিছুদিন কাজ করার পর বাসের ড্রাইভারের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। দুই বছর কাজ করার পর পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছায় রাজধানীর একটা কলেজ থেকে এইচএসসিতে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে পাস করে। কিন্তু কোনো উপায় নাই, তাই বাসচালক হিসেবেই কাজ করতে থাকে। গাজীপুরা এলাকার একটি বাসায় দোতলায় একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট (এক বেড রুম, এক বাথরুম) নিয়ে থাকে। পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ায় এই ফ্ল্যাটে চার বছর কেটে গেল। নিজেই রান্না করে। শুধু রাতের রান্না। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার হোটেলেই খায়।
আরেকটু পরেই সন্ধ্যা হবে। ওরা কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে গুলিস্তান থেকে আবারও বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করল। আজ সোহরাওয়ার্দীতে বিকেলে জনসভা (একটি রাজনৈতিক দলের) ছিল। রাস্তায় প্রচ- যানজট। গাড়ি থেমে থেমে চলছে। গরমও অনেক। পল্টন, প্রেসক্লাব, শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটে আসতেই প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগেছে। মুকিত কন্ডাক্টরকে বলল, ওই কামরান একটা ঠা-া নিয়ায় তো…। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নেই। কামরান দৌড়ে আনন্দ সিনেমা হলের নিচে দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরায়ে টানতে টানতে মুকিতের জন্য জুস নিয়ে আসল।
সন্ধ্যার পর। বনানী স্ট্যান্ড। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দীপিকা। হঠাৎ চোখে পড়ল তিন নম্বর লোকাল বাসটি। স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই উঠল দীপিকা। ড্রাইভারকে দেখেই অবাক হলো সে। আরে!!! আজও সেই মুকিত। আজ সামনে মহিলা সিট ফাঁকা থাকায় সেখানেই বসল দীপিকা। মুকিত ফিরে তাকাতেই জিজ্ঞেস করল-
হাউ আর ইউ ?
-এক মিনিট নীরব থেকে দীপিকা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ফাইন। ইউ?
-ডেস আর গোয়িং সামহোয়াট গুড। ম্যাম মে আই গেট ইউর ভিজিটিং কার্ড?
-সিউর, বলেই হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দিল।
বাস যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। ওদের আর কথোপকথন হলো না। মাঝে মাঝে দুজনের একটু তাকানো মৃদুভাবে। উত্তরা গিয়ে ওকে সি ইউ বলে দীপিকা বাস থেকে নেমে গেল।
বাস গ্যারেজে রেখে যখন বাসায় ফিরল তখন ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটার ঘরে। আজ আর রান্না করতে মন চাচ্ছে না মুকিতের। খিদেও খুব বেশি লাগেনি। ফ্রেশ হয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দশ মিনিট গড়াগড়ির পর মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুকে ঢুকল। বালিশের নিচে রাখা মানিব্যাগ থেকে দীপিকার কার্ডটা বের করে নামের বানানটা ইংরেজিতে মিলিয়ে এফবিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। ঘুম আসছে না। বিছানা থেকে উঠে আরো একগ্লাস পানি খেয়ে রুমের পশ্চিম পাশের জানালা খুলে দিতেই একপশলা বাতাস শরীরটাকে শীতল করে দিল। আবারও শুয়ে পড়ল। মোবাইলটা অন করে এফবিতে ঢুকেই দেখে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট। সঙ্গে সঙ্গে খুদে বার্তায় লিখল, হাই! হাউ আর ইউ?, আই অ্যাম মুকিত, বাস পাইলট। জানালা দিয়ে বাতাস শরীরে আসছে। দীপিকার কথা ভাবতে ভাবতেই ততক্ষণে ঘুমের রাজ্যে মুকিত।
অন্যান্যদিনের চেয়ে আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। রোদ আছে হালকা। পুব আকাশে কিছুটা মেঘ দেখা যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে মুকিত ফ্রেশ হয়ে বের হলো। গাড়ি চালাতে মন চাইছিল না। তাই মালিককে ফোন করে জানালেন বস, আজ শরীরটা ভীষণ খারাপ, আজ চালাব না বাস, প্লিজ স্যার ব্যবস্থা নিয়েন। বসও সায় দিলেন। আর ছুটি দেবারই কথা। বাস মালিক কামাল চৌধুরীর গুডবুকে যে দশজন ড্রাইভার, তার মধ্যে মুকিত এক নম্বর চয়েস। প্রতিদিন ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে বের হওয়া, দিনশেষে জমার টাকা ঠিকমতো বুঝিয়ে দেয়া অন্য ড্রাইভাররা তা করে না। তাই মুকিত বসের নজরে থাকায় ছুটি মিলে গেল।
বাসার পাশে ছোট্ট একটা হোটেল। এখানে এসে তিনটা পরাটা ডাল-ভাজি দিয়ে নাস্তা সেরে নিল মুকিত। চা খাওয়ার পর আবারও বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে এফবিতে ঢুকে নোটিফিকেশনগুলো দেখছে। হঠাৎ দীপিকার কথা মনে পড়ে গেল। মেসেজ বক্সে ক্লিক করেও কেন যেন মন চাইল না খুদে বার্তা দিতে। বালিশের নিচে থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে মায়ের ছবিটা দেখতে থাকল। কতদিন মাকে দেখে না। মায়ের হাতের রান্নাÑসে তো কেবলি স্মৃতি। মা কত্ত স্বপ্ন দেখতেন-মুকিত একদিন বড় হবে, চাকরি করবে, সুন্দর একটা লক্ষ্মী বউ ঘরে আসবে…কত স্বপ্ন ছিল। সেসব কথা মনে পড়লেই মুকিতের চোখে জল চলে আসে। মায়ের ছবিটা রেখে আবারও এফবিতে ঢুকল। দীপিকার প্রোফাইল পিকটা দেখে মায়ের কথা ভাবতে লাগল। মা-তো এমনই একটা মেয়ে কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু দীপিকা অনেক এডুকেটেড। ভাল চাকরি করেন। ও- তো বাস পাইলট। চাইলেই কী দীপিকাকে প্রোপোজ করা যায়!!!- নানা চিন্তা করতে করতে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল সে।
বিকেলে ঘুরতে বের হলো মুকিত। অনেকদিন ঘোরা হয় না। চলে এলো যমুনা ফিউচার পার্কে। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে ব্লকব্লাস্টারের সামনে হঠাৎ দীপিকাকে দেখতে পেল। একবার চিন্তা করলো কাছে গিয়ে কথা বলতে, কিন্তু সে কী ভাববে?। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাছে গেল। দীপিকা দেখেই বলল,
-হাই! মুকিত, ইউ আর হিয়ার।
-ইয়েস, ছুটি নিয়েছি আজ, শরীরটা ভাল না, তাই ঘুরতে এলাম এখানে।
-দীপিকা বলল, আমার আজ ছুটি, তাই মুভি দেখতে এসেছিলাম।
-ভেরি নাইস, ইউ আর লাইক মুভি। দারুণ তো, আমিও ছোটবেলায় বিটিভিতে অনেক মুভি দেখেছি।
দীপিকা বলল, চলো সামনেই যাই। কথা বলতে বলতে পাশে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। দুইজন মুখোমুখি। দীপিকা হোটেলবয়কে বলল, কুক, বার্গার, চিকেন দিতে।
-তুমি এতো সুন্দর ইংরেজি শিখলে কীভাবে?
-মুকিত বলল, আমার ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে বড় কোম্পানির বড় বস হবো। কিন্তু, বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল…।
-রিলাক্স মুকিত। তারপর কী হলো?
-ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর অসহায় হয়ে পড়ি। তারপর অনেক সংগ্রাম করে জীবনটা এ পর্যন্ত এনেছি। ইন্টার পাস করার পর কয়েকমাস ইংরেজি শেখার চেষ্টা করি। এরপর থেকেই ইংরেজিতে কথা বলতে পারি।
-দীপিকা খাবার দেখিয়ে বলল, ভেরি নাইস, টেক ইট।
মুকিত এত স্মার্ট যে দেখে মনে হয় না বাসচালক। কথাবার্তায় এত পোলাইট যে মনে হয় সে বড় কোনো পরিবারের সন্তান। দীপিকার ভাল লেগে গেল। রেস্টুরেন্টে কফি খেতে খেতে নানা ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা হলো তাদের মধ্যে। ওরা কিছুটা সময় কাটানোর পর চলে গেল নিজ নিজ বাসায়।
রাত বারোটার কাছাকাছি। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার গ্লাস সরিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে-মুখে হালকা ঠা-া হাওয়া দোলা দিয়ে গেল। দীপিকা দরজা খুলে বারান্দায় চেয়ারটায় বসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে বৃষ্টির গান। বাতাস আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছন্দে হৃদয়ে বাজল অন্যরকম অনুরণন। মাথায় চিন্তা এলো মুকিতের কথা। ছেলেটাতো অনেক ভালো। ওকে যদি টেককেয়ার করে মানুষ করা যায়, তাহলে তো ওকে লাইফে এ্যাড করা যাবে। কয়েকটা ছেলেকেই তো দেখেছে সে, কীভাবে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে ভাবতে সম্পর্কের কথা ভুলে চলে গেছে। তারচেয়ে বরং মুকিতকে গ্র্যাজুয়েট করিয়ে ভালো ডিগ্রি নিয়ে ওকে তো ভালো চাকরিও দেয়া যাবে। ভাল ইংরেজি বলতে পারে, বাট অভিভাবক শূন্যতায় এরকম স্বপ্নবাজ একটা ছেলে হারিয়ে যাবে! মাথায় কি জানি চেপে বসল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল। মুকিতকে একদিন ডেকে বোঝাতে হবে, তুমি এসব ছেড়ে পড়াশোনা করো, সব খরচ আমি দেব, অনেক বড় হতে হবে। ওকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। বারান্দা থেকে রুমে এসে লাইট অফ করে দিয়ে এফবিতে নোটিফিকেশন দেখে শুয়ে পড়ল।
নিস্তব্ধ সকাল। রাতে স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই মনটা বিষণ্ণ। এরকম কত স্বপ্ন তো দেখে দেখে কত সময়ই না চলে গেল। এখন পর্যন্ত স্বপ্ন একটাও সত্যি হয়নি। তাই গতরাতে দীপিকাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর থেকেই কেন যেন বিবর্ণ, বিষণœ মন। সকালে যখন গ্যারেজে যাচ্ছিল, তখন পাশের এক রেস্টুরেন্টে গান বাজছিলÑ ‘এ জীবন কেন এতো রং বদলায়, কখনো কালো মেঘ, কখনো ঝড়ো বেগ, কখনো প্রেমের আবেগে সে, নিজেকে জড়ায়’। গ্যারেজে পৌঁছে বাস নিয়ে বের হলো। বাস যাচ্ছে। মহাখালী ওভারব্রিজ পার হতেই পেছন থেকে আরেকটা বাস এসে লুকিং গ্লাসটা ভেঙে দিল। এমনিতেই সকাল থেকে মনটা খারাপ। তারপর আবার এ রকম ঘটনা। মুকিতের মেজাজ প্রচ- খারাপ হলো। রাগে, ক্ষোভে মুকিতও ওই বাসকে ধাক্কা দিতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় থাকা লোকজন মুকিতকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার ঘোষণা করে সে আর নেই।
সকাল দশটা। অফিসে ঢুকেই দেখতে পায় দীপিকা টিভিতে ব্রেকিং নিউজ, দুই বাসের সংঘর্ষে চালক মুকিত নিহত। এটা কোন মুকিত? ওই যে ছেলেটা খুব সুন্দর করে কথা বলে, ইংরেজি জানে, স্মার্ট!! ওই ছেলেটা? যাকে নিয়ে নতুন একটা স্বপ্ন এঁকেছিল দীপিকা। না, বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা হতে পারে না। নিউজের কথা ভুলে ও কাজে মন দিল। পরদিন সকাল। দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিতেই মাথায় চক্কর দিল। দুর্ঘটনার খবর ও ছবিটা দেখে চোখে জল এসে গেল। সত্যিই তো গতকালের ব্রেকিং নিউজটা ঠিকই ছিল। মুকিত নিহত। হঠাৎ বাইরে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। সাথে বৃষ্টি। পত্রিকাটা রেখে দীপিকা বাইরে বেরিয়ে গেল।